#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
সূচনা_পর্ব
~মিহি
-“মিস.চাশমিশ! আপনি বাড়িওয়ালি, ভাড়াটিয়ার ঘরে অনুমতি ছাড়া মাঝরাতে আসছেন। এখন আমি চুমু-টুমু খেয়ে বসলেই তো ধর্ষণের মামলা দিবেন।”
আয়াশ দুষ্টু হাসি দিয়ে কথাটা বললেও পরক্ষণেই সিদ্ধির অগ্নিঝড়া চোখটার নেশায় ডুবে যায়। কিছু মানুষকে রাগলে মারাত্মক লাগে, সিদ্ধি হলো সেই ধরনের। সিদ্ধি রাগান্বিত দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে একবার তাকালো, একবার আয়াশের ঘরটার দিকে। আয়াশ ভেবেছিল সিদ্ধি একা এসেছে কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল করলো দরজার ওপাশে সিদ্ধির বাবা সায়ন সাহেবও দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও সায়ন সাহেবের সাথে আয়াশের সম্পর্কটা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ তবুও একটু আগে সিদ্ধিকে বলা কথাটার জন্য লজ্জিত হয় আয়াশ।
-“আয়াশ সাহেব, প্রথম থেকেই আমি আপনাকে এই চিলেকোঠা ঘরটাতে থাকতে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম তবুও থাকতে দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই না যে আপনি ছাদে বসে যা ইচ্ছে তাই করবেন।”
-“আমি করেছি-টা কী?”
-“আপনার রুমের জানালার কাছে আমি সিগারেট পেয়েছি। তার চেয়েও বড় কথা আপনি আমার গাছ থেকে ফুল ছিঁড়েছেন।”
-“এসবের কোন প্রমাণ আছে?”
-“আমি স্বচক্ষে দেখেছি।”
-“আমিও স্বচক্ষে আপনাকে সিগারেট খেতে দেখেছি, মিস.চাশমিশ। কিন্তু কাউকে বলিনি কারণ প্রমাণ নেই।”
-“বাবা, তুমি কিছু বলবে না এই লোকটাকে?”
সিদ্ধির কথা শুনে সায়ন সাহেব আমতা আমতা করতে লাগলেন। অনেক দ্বিধা-সংকোচের পর বললেন,” ছোটখাটো ভুল করেছে, মাফ করলাম। পরেরবার কিছু হলে দেখবো।” নিজের বাবার কথা শুনে বেশ রেগে গেলো সিদ্ধি। সে ছেলেটাকে বাড়ি থেকে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে আর তার বাবা কী-না ছেলেটাকে কিছুই বললো না। সায়ন সাহেব হাসতে হাসতে চলে গেলেন।
-“তোমায় আমি বাড়ি থেকে বের করেই ছাড়বো আয়াশ সাহেব।”
কথাটা বলেই আয়াশের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল সিদ্ধি। আয়াশ হাসলো। মনে মনে বললো,” বাড়ি থেকে বের করতে গিয়ে মনে না ঠায় দিয়ে ফেলেন মিস.চাশমিশ।”
ভোরবেলা থেকেই প্রচুর ব্যস্ততা সিদ্ধির। মা মারা গেছেন চার বছর হলো, এই চার বছরে নিজেকে আর বাবাকে নিয়েই তার নতুন জগতের সৃষ্টি। সকালবেলা বাবাকে খাওয়ায়ে নিজে খেয়ে তারপর কলেজে যাওয়া। এখন অবশ্য আয়াশ ছেলেটার জন্যও রান্না করতে হয়। রান্না করতে সিদ্ধির কোন আপত্তি নেই কিন্তু আয়াশ ছেলেটার সবকিছুতে আপত্তি। চায়ে চিনি খাবে না, কফিতে চিনি বেশি, তরকারিতে ঝাল সহ্য হবে না আবার লাউ দিয়ে মিষ্টি তরকারিও খাবে না। সিদ্ধির মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় আয়াশকে করলা, বেগুন, পটল একসাথে ভেজে বেশি করে ঝাল-লবণ দিয়ে মেখে ভর্তা করে খাওয়াতে। আয়াশ এসব খেতে চায় না। এক মাস হলো বাড়িতে থাকে অথচ ভাবটা এমন যেন যুগ যুগান্তরের সম্পর্ক।
আয়াশ নিচে নামলো। নীলরঙা শার্টটার উপর মেডিকেলের সাদা এপ্রোন। যে ছেলেটা একবছর ডাক্তার হবে, সে কিনা এই সামান্য দোতলা বাড়িতে একঘর নিয়ে থাকছে। ভাবতেই মাঝেসাঝে রহস্য উঁকি দেয় সিদ্ধির মনে তবে পাত্তা দেয়না সে।
-“এই যে চাশমিশ, খাবার দেন তো। লেইট হচ্ছে।”
-“আজব! আমি কি আপনার বউ নাকি? অর্ডার করেন কোন সাহসে? আপনাকে আমি নাস্তা দিবো না। নিজে বানিয়ে খান।”
-“উফ! সিদ্ধি প্লিজ। আমার এক্সাম আছে আজ আর আমি না খেয়ে থাকতে পারিনা। তাড়াতাড়ি দেন।”
-“বাইরে খান যান। টাকার তো অভাব নেই। আমার হাতের রান্না খাওয়ার যোগ্যতা সবার নেই।”
সিদ্ধি যদিও ইয়ার্কি করে বলেছিল তবে কথাটা শোনামাত্র আয়াশ উঠে দাঁড়ালো। কোন কথা না বলেই সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। একটু পর সায়ন সাহেব নিচে নামলেন। আয়াশের কথা জিজ্ঞাসা করলে সিদ্ধি কিছু বললো না। অফিসে কাজের চাপ থাকায় তাড়াহুড়ো করে তিনিও বেরিয়ে গেলেন। সিদ্ধির আর মন চাইলো না খেতে। কেন যেন তার মন পড়ে আছে সকালবেলা আয়াশকে বলা কথাগুলোর উপর।
কলেজে আর যাওয়া হলো না সিদ্ধির।ঘরদোর পরিষ্কার করে, চিলেকোঠার চারপাশটা পরিষ্কার করলো সে। বেশ অনেকটা সময় ছাদে কাটালো। ঘড়িতে বাজে বারোটা ছাপ্পান্ন অথচ আয়াশ তো বারোটার মধ্যেই বাড়ি চলে আসে। আজ হঠাৎ এত দেরি? দু’টো পেরোয়, আয়াশ আসে না। বাধ্য হয়ে আয়াশের নম্বরে কল দিতে নেয় সিদ্ধি। পরক্ষণেই মনে হয়,”আমার কি বাধ্যবাধকতা যে ওকে কল দিব? যা ইচ্ছে করুক।” অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তার আর কোনকিছুতে মন বসে না। আয়াশ বাড়িতে থাকলে দুজনের অকারণে ঝগড়ার কারণে সময়টা বেশ ভালোই কাটে কিন্তু আজ যেন সময় কিছুতেই কাটছে না। আয়াশের অনুপস্থিতি ব্যথিত করছে সিদ্ধির মনকে।
____________________________
সন্ধ্যের ঠিক আগ মুহূর্তে আয়াশ আসে। আয়াশের সাথে একজন মেয়ে আসে। মেয়েটা আয়াশকে দরজা অবধি ছেড়ে নিজের খেয়াল রাখতে বলেই চলে যায়। মেয়েটাকে দেখে অজ্ঞাত কারণে সিদ্ধির মন খারাপ হয়ে যায়, রাগের মাত্রা তীব্র হয়।
আয়াশ ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সারাদিন শরীরের উপর দিয়ে যে ঝড় গেছে তা কেবল সে-ই জানে। আয়াশের ইচ্ছে হলো সিদ্ধিকে একটু দেখবে। দরজা খুলেই সেই যে মেয়েটা ঘরে ঢুকেছে আর বেড়োচ্ছেও না। কিন্তু এইমুহূর্তে উঠে সিদ্ধিকে দেখতে যাওয়ার মতো শক্তি পাচ্ছে না আয়াশ।
রাত দশটার পর সায়ন সাহেব আসেন আয়াশের ঘরে। তাকে দেখেই আয়াশ উঠতে ধরলেও ঠিকমতো উঠতে পারে না।
-“আয়াশ, আজ খেতে আসোনি যে?”
-“আ..আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসছি আঙ্কেল।”
-“বাড্ডি থেকে আঙ্কেল হয়ে গেছি? কি হলো কি আমার বন্ধুর?”
-“কিছুনা আঙ্কেল। এইতো শরীর খারাপ ছিল।”
-“বুঝিনা ভাবছো? আয়াশ, দেখো, সিদ্ধির কিছুই মনে নেই। ওর উপর রাগ করো না তুমি। ওকে সব মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা তোমারই বাবা।”
সায়ন সাহেব উঠে যেতেই আয়াশের মুখে হাসি ফুটে উঠে যেন বুকের উপর থেকে পাথর নামলো তার। আসলেই তো সিদ্ধির কিছুই মনে নেই। মনে থাকলে হয়তো সে এমন করতো না। সায়ন সাহেব চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর সিদ্ধি একটা প্লেট হাতে আয়াশের ঘরে ঢুকলো।
-“বাবার মুখে শুনলাম আপনার নাকি শরীর খারাপ?”
-“জ্বী! আসলে না খেয়ে থাকতে পারিনা আর বাইরের খাবার সহ্য হয় না। সেজন্যই খাবার নিয়ে এত বাছাবাছি করি।”
-“কথাটা জানালেই পারতেন। এখানে খাবার আছে, খেয়ে নিয়েন।”
-“আমি তো খেয়ে এসেছি।”
-“বাইরের খাবার নাকি খান না?”
-“বান্ধবীর বাসায় খেয়েছি। তারপর ও আমায় ড্রপ করে গেছে।”
-“খাবার দিছি, খাওয়ার হলে খান নাহলে রেখে দেন।”
বলেই আয়াশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সিদ্ধি। “হুহ! বান্ধবীর বাসায় খেয়ে এসেছে! তো রোজ ওখানেই যা, ওখানেই থাক, আমার বাড়িতে কেন?” রাগান্বিত স্বরে কথাটা বলার পর তার মনে হয় সে আসলে রাগ করছে কেন। আয়াশের উপর তো তার কোন অধিকার নেই। যেখানে অধিকারই নেই, সেখানে অভিমানের প্রত্যাশা কেন?
_________________________________
স্কুল লাইফটা তখন শেষের দিকে। হাত বাড়ালেই কলেজের পথ, পা বাড়ালেই চৌকাঠে কদম। তখন কেবলমাত্র পরীক্ষা নামক কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে ছিল আয়াশের সামনে এগোনোর পথটা। এরই মধ্যে ঘটে গেলো দুর্ঘটনাটা। আয়াশের জীবনে আগমন ঘটলো দুই বিনুনীওলা, চিকন ফ্রেমের চশমা পড়া এক মেয়ের। আয়াশের জীবন থমকে দাঁড়ালো, থমকে গেল সময়। টেনে পড়া আয়াশ প্রেমে পড়লো এক ফোরের বাচ্চা মেয়ের। মেয়েটার লম্বা চুলের মায়ায় বেঁধে ফেললো সে আয়াশকে। আয়াশ না পারছিল সামনে এগোতে আর না পারছিল পিছনে ফিরতে। হাতে সময় ছিল মাত্র চার মাস। এই চার মাসের মধ্যে পিচ্চিটাকে তার মনের কথা জানাতেই হবে। আয়াশ চেষ্টা করে বারবার কী করে মেয়েটাকে নিজের মনের কথা জানানো যায়। ব্যর্থ চেষ্টা। ফোরের বাচ্চা কী আর তখন ভালোবাসার অনুভূতি বুঝতে শিখেছে? যে মেয়েটাকে তখনো তার মা আদর করে খাইয়ে দেয়, সে কী করে বুঝবে তার জন্য কোন একজনের নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে। দিন যত যেতে লাগলো, ততই পিচ্চিটার প্রতি আয়াশের অনুভূতি প্রখর হতে লাগলো। প্রথম দেখায় সেই ভালোবাসার অনুভূতিটা কয়েকগুণ হয়ে ধরা দিতে থাকলো আয়াশের মনে। এই অনুভূতির শিকলে জড়িয়ে ছাত্রজীবনের প্রথম বড় ধরনের ভুলটা করে ফেলল আয়াশ। সকলকে লুকিয়ে ঐ পিচ্চির জন্য জমানো নিজের অনুভূতিগুলো লিপিবদ্ধ করলো কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না চিরকুটটা মেয়েটাকে দেওয়ার। একদিন সুযোগ বুঝে মেয়েটার পিছু নিল সে। কিছুদূর যেতেই মেয়েটাকে ডাকলো। পিচ্চি মেয়েটা আয়াশের ডাক শুনে পিছু ফিরতেই আয়াশ চিরকুটটা মেয়েটার হাতে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। আয়াশ ধরেই নিয়েছিল সে তার মনের কথাটা নিরাপদে জানাতে পেরেছে মেয়েটাকে কিন্তু নাহ! মেয়েটার হাতে আয়াশের এই চিরকুট ধরিয়ে দেওয়ার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিল আরেকজন ব্যক্তি, আয়াশের বাবা স্কুলমাস্টার রফিকউদ্দিন।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]