চিলেকোঠার_ভালোবাসা পর্ব-০৬

0
1300

#চিলেকোঠার_ভালোবাসা
#পর্ব_৬
#Adharer_Musafir (ইফ্ফাত)

সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই আমার আর কথার চোখ গেলো রুমের একমাত্র দরজার দিকে।
সেদিকে তাকাতেই দেখি কেউ একজন স্বশব্দে দরজা বাহির থেকে আটকে দিলো।
দরজা বন্ধ হবার আগে নিলার মুখ আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি।
ওপাশ থেকে যে নিলা নিজ হাতে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেছে তা আমি দলীল দিয়ে লিখে দিতে পারবো।

হুট করে এমন হয়ে যাবে সেটা আমি আর কথা দু’জনই জানতাম না।
কথাকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি আর কথা দু’জনই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
পরক্ষনেই কথা জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে শুরু করলো।
বদ্ধ রুমে এই মুহূর্তে এমন একজন পুরুষের সাথে, যার সাথে মোটেও কথার বনে না; তার সাথে আটকে থাকবে ভাবতেই বোধহয় ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা।

আমি ভাবছি কথাকে কিভাবে শান্ত করা যায়।
মেয়েটা যে সত্যিই ভয় পেয়ে গেছে সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
হুড়মুড়িয়ে কথা কাঁধে থাকা ব্যাগের চেইন খুলে কিছু একটা খুঁজছে।
কথাকে দেখে মনেহচ্ছে শ্বাস নিতে কথার খুব কষ্ট হচ্ছে।
হালকা শব্দে শ্বাস নিচ্ছে, চোখে মুখে আতঙ্ক।

হুট করেই কথা তাল সামলাতে না পেরে, পাশে হেলে পরে যেতেই তাকে আমি ধরে ফেললাম।
আচমকা পরে যাওয়াতে আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি তাই কথাকে সামলাতে না পেরে কথাকে সহই নিচে হাটু গেলে পড়ে যাই।
চোখ মুখ খিচে আসছে কথার।
চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পাগলাটে দেখাচ্ছে কথাকে।
কি থেকে কি করবো আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা।
আমার কাছে পানিও নেই যে কথাকে পানির ছিটা দেবো।

দরজার কাছে চোখ যেতেই দেখি একটা বড় বোতলে পানি রাখা।
ঠিক পানি কিনা বুঝতে পারছি না কারন বোতলের উপরের অংশ দেখতে খুবই নোংরা।
কাছে গিয়ে বোতলের ক্যাপ খুলে শুকে বুঝতে পারলাম এটা বোধহয় বহুদিনের পুরোনো পানিই হবে।
নাই মামার চেয়ে অন্তত কানা মামা ভালো।
নোংরা বোতলের পানিটাই নিয়ে কথার চোখে মুখে মারতেই কথা মুখ সরিয়ে নিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগলো।
পানির ঝাপটায় কথার কামিজের কিছু অংশ ভিজে গেছে।

মাটি থেকে উঠিয়ে বসিয়ে দিতেই কথার বা হাত আমার বা উরুর উপর পড়লো।
সেদিকে অবশ্য আমাদের কারোই খেয়াল নেই।
কিছুক্ষণ পর একটু শান্ত হতেই কথা বললো–

— আমি বাহিরে যাবো, দরজা খুলুন প্লিজ।
আমি বদ্ধ ঘরে আটকে থাকতে পারিনা, দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।

কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা আমি।
আমার আর নিলার বোঝাপড়ায় কথাকে টেনে আনাটা আমার বড্ড বোকামি হয়ে গেছে।
কাল নিলাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কথাকে নিয়ে রিকশায় উঠে বসাটা মোটেও ঠিক হয়নি।

দরজার কাছে গিয়ে জোড়ে জোড়ে হ্যান্ডেল ধরে ঝাকাচ্ছি আর চিৎকার করে নিলাকে ডাকছি।
আমার চিৎকারে লাইব্ররীর সামনে ভির জমে যাবার কথা, সেখানে কি আমার গলার আওয়াজ কারো কানে যাচ্ছেনা!

পাক্কা দশ থেকে পনেরো মিনিট চিৎকার চেঁচামেচির পর ওপাশ থেকে কেউ একজন দরজাটা খুলে দিলো।
খোলার সাথে সাথে আমি লাইব্রেরীর দাড়োয়ানকে দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।
রুম থেকে বেড়িয়ে এসে লাইব্রেরীর বড় রুমে পা রাখতেই দেখি সবাই আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

একেকজন নিজেদের মধ্যে ইতোমধ্যেই কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে।
দু’একজন প্রথম শ্রেণীর টিচাররাও এখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
পেছন থেকে কথা বেড়িয়ে আসতেই সবাই চুপ হয়ে গেলো।
পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি কথার অবস্থা বেহাল।
এলোমেলো চুল, চোখে পানি।
কাজলটাও লেপ্টানো আর হালকা ভেজা কাপড়।
আমার লেবাসও যে খুব একটা ভালো তা কিন্তু না।
কথাকে সেসময় সামলাতে গিয়ে আমি নিজেও প্রায় ঘেমে গিয়েছি।
এ অবস্থায় যে কেউ আমাদের দু’জনকে দেখলে খারাপ কিছু ভাববে তা স্বাভাবিক বটে।

গুটি গুটি পায়ে কথা শক্ত হাতে ব্যাগ ধরে নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
দু’একজন এবার রীতিমতো হাসা-হাসি শুরু করে দিয়েছে।
আশ পাশ তাকিয়ে নিলাকে কোথাও খুঁজে পাইনি আমি।
নিজেকে বড্ড অপরাধি লাগছে এখন আমার।
কথার সাথে সত্যিই আজকে খারাপ হয়েছে।
এমনটা আমি কখনোই আশা করিনি নিলার কাছ থেকে।
অবশ্য নিলা যেরকম মেয়ে তাতে অসম্ভবের কিছু নেই।
এতদিনের সম্পর্কে এতটুকু অন্তত বুঝে নিয়েছি আমি।

🍂

প্রায় দৌড়েই ভার্সিটির সামনে রাস্তার কিনারায় এসে দাঁড়ালাম।
কথার পেছন পেছন ফুটওভার ব্রিজের সিড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠছি।
মেয়েটা নিজেকে সামলাতে পারবে কিনা তার গ্যারান্টি নেই, যতোই হোক আমার কারনেই কথার এ দশা।
চোখের পানি মুছতে মুছতে উদভান্তের মতো উপরে উঠছে কথা।
বার বার মনে হচ্ছে এখনই হয়তো পরে যাবে সে।
অপরাধির মতো কথার পেছন পেছন হাঁটছি আর নিজের ওপর আফসোস করছি।

🍂

রিকশায় কোনোরকম উঠে বসলো কথা।
মুখ ফুটে কথাকে কিছু বলতেও সাহসে কুলাচ্ছে না।
কি বলবো আমি, আজকে কথার এ অবস্থার জন্য যে দায় সবটা আমারই।
নিলাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কাল কথাকে নিয়ে আসাটা খুব বড় ভুল হয়ে গেলো।

🍂
🍂
🍂

সেদিনের পর প্রায় সপ্তাহ্ খানেক কথা আমার মুখোমুখি হয়নি।
না ভার্সিটিতে না ছাঁদে না ঐ চিলেকোঠার বদ্ধ রুমটায়, আমাদের বাসাতেও ফিরে তাকিয়ে দেখেনি।
ফাইজার সাথে আড্ডা দিতেও দেখিনা কতদিন।
কথা যে আমাকে এক প্রকার এড়িয়ে চলছে তা আমি ঢের বুঝতে পারছি।

তারপর আরো বেশ কিছুদিন চলে যায়।
কথাকে আমার সামনে আসতে আর দেখিনি।
মুখোমুখি হয়ে গেলেও পাশ কেটে চলে যেতো।
খুব ইচ্ছে হয় কথার সাথে মন খুলে কথা বলি।
কথার ঐ খোঁচা দেয়া কথাগুলো ইদানিং বড্ড বেশিই মিস করছি আমি।
দিন দিন আমার অবস্থাও কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে।
খুব অস্থির অস্থির লাগে আজকাল, কি যেনো নেই নেই লাগে।
নিজেকে কেমন শূণ্য শূণ্য লাগে, মনেহয় যেনো চারপাশ থেকে শূণ্যতা আমাকে ঘিরে ধরেছে।
কথার এভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা কেমন যেনো মেনে নিতে পারছিনা আমি।
বোধহয় আমি কথার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছি।
দিন রাত চব্বিশঘন্টা শুধু কথার চিন্তাই মাথায় ঘুরে।
যেভাবেই হোক, আমাকে তার সাথে কথা বলতেই হবে।

🍂

এদিকে আমাদের ফেরওয়েল চলে এসেছে।
কাল বাদে পরশু ফেরওয়েল তার কিছুদিন পরই পরীক্ষা।
পড়ায় ঠিকভাবে মন বসাতেও পারছিনা।
বার বার শুধু কথার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
নিজেও ঠাহর করতে পারছিনা ঠিক কি হচ্ছে আমার সাথে।
এতকিছু না ভেবে চলে এলাম গিটার হাতে ছাঁদে।
অনেকদিন হলো ছাঁদে আসা হয়না।
সেই ঘটনার পর থেকে কথা নিয়মিত ছাঁদে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমিও আর আসিনা ছাঁদে, মেয়েটা আমি না থাকলে যদি ছাঁদে আসে তবে আমিই নাহয় ঘরে বন্দি থাকলাম।

নিলাকে সেদিনের পর চেয়েছিলাম একটা উচিত শিক্ষা দেবো।
কিন্তু কি লাভ, কুকুরের লেজ তো আর সোজা হবার নয়।
প্রকৃতি তাকে আমার থেকেও বড় শাস্তি দেবে সে বিশ্বাস আমার আছে।
তাই নিলাকে কিছু বলে আমি আমার মুখ আর অপবিত্র করতে চাইনি।
আমি নিলাকে কিছু না বললেও আমার চুপ থাকাটা হয়তো কারো মনে আঘাত লেগেছে খুব।

🍂

সিগারেটের শেষ অংশটুকু চিলেকোঠার বদ্ধরুমে শেষ করে ছাঁদে পা রাখতেই দেখি কথা রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।
মুহূর্তেই যেনো আমার পা থেমে গেলো, আর চলছেই না।
নীল শাড়িতে কথাকে এই মুহুর্তে কোনো অপ্শরীর থেকে কম লাগছে বলে মনে হয়না আমার।
খোলা চুলগুলো বাতাসে মাতালের মতো উড়ছে।
নীল শাড়ির ভারি আচলটা একবার এদিক তো আরেকবার ওদিক হেলে যাচ্ছে।
মনেহচ্ছে এইবুঝি সব অপেক্ষার অবশান ঘটলো।
আমি চাতকের মত কথার জন্য পথ চেয়ে ছিলাম।
শহর জুড়ে হট্টগোল-হইচই, কতশত অপরিচিত মুখের যে আনাগোনা।
শত মানুষের ভিড়ে আমি শুধু নিজেকে এককোণে ফেলে রেখেছিলাম এতদিন।
আজ যেনো সবকিছুর অবশান ঘটেছে।

আস্তে আস্তে পেছন থেকে কথার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই কথা আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো।
পরক্ষনেই আবার চোখ সরিয়ে নিলো, মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে বললাম-

কেমন আছো কথা?

— বোধহয় আমার কথা তার কান পর্যন্ত পৌছেনি।
নাকি ফিরিয়ে জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করেনি কে জানে।
চোখের পাপড়িগুলো স্থির হয়ে আছে কথার।
পলকহীনভাবে একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
আমতা আমতা করে বললাম-

আসলে সেদিন ওভাবে, মানে এমন কিছু হয়ে যাবে আমি বুঝতে পারিনি।
যদি জানতাম তাহলে আমি লাইব্ররীতে সেদিন যেতামই না।
ভাবতে পারিনি নিলা তখন দরজা ওপাশ থেকে বন্ধ করে দিবে।
আর তারপর যা হলো তাতে সবাই..!

— আপনি নিজেকে প্রেমিক মনে করেন?

মানে?

— লোকে আপনাকে প্রেমিক বললেও আমি আপনাকে কখনই প্রেমিক বলব না।
প্রেমিক হতে কি কি গুণ থাকা লাগে তা কি জানা আছে আপনার?

কথা আমি আসলে নিলার সম্পর্কে তোমাকে…

— আমি আপনার অতীত সম্পর্কে কিছু জানতে চাইনা।
আপনার অতীত নিয়ে আমার আদৌ কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
কিন্তু কি বলেন তো, যে মানুষটা অতীত নিয়ে পড়ে থাকতে চায় তাকে কিভাবে টেনে তুলবো তা আমার জানা নেই।
জানেন, আপনার উপর সেদিন আমার বিশ্বাস ছিলো যে আপনি আমার সাথে বন্ধ রুমে খারাপ কিছু করবেন না; আর হয়েছেও তাই।
কিন্তু আমি ভাবিইনি আপনি সত্যটা জেনেও সবার সামনে এভাবে চুপ করে থাকবেন।

কথা আমি সেদিন, আসলে বুঝতে পারিনি কি থেকে কি হচ্ছিলো।

— আপনি তো কিছুই বুঝতে পারেন না তাইনা!
কেউ আপনার সাথে প্রতারনা করলেও বুঝতে পারেন না, কেউ আপনাকে মন থেকে ভালোবাসলেও বুঝতে পারেন না।
কেউ অভিমান করে থাকলেও বুঝতে পারেন না যে তার অভিমান ভাঙাতে হবে।
সবকিছুই আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে তাইনা?

এখন আবার কি হলো, হাসছেন কেনো আপনি?
আমাকে পাগল মনে হয় আপনার, বলা নেই কওয়া নেই আমার উপর হাসার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে!
কথা বলবেন না আপনি আমার সাথে।
চলে যান এখান থেকে, কেনো এসেছেন আমার কাছে আপনি!
আমার অনূভুতির তো কোনো দাম নেই কারো কাছে।
ঘৃণা করি আপনাকে আমি খুব ঘৃণা করি।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে কথা কাঁদতে কাঁদতে ছাঁদ থেকে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই আমি…

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে