#চিলেকোঠার_ভালোবাসা
#পর্ব_৫
#Adharer_Musafir (ইফ্ফাত)
কথাকে নিয়ে বিনাবাক্যে একটা রিকশায় উঠে বসলাম।
মেয়েটা এখনও বিস্বয়ভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কথার মাথায় কি চলছে কে জানে!
এদিকে আকাশ খুব মেঘলা, একটু বাদেই ঝুম বৃষ্টি এসে পড়বে তা নিশ্চিত।
আজ বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে হলেও এক প্রকার জেদ করেই নিলাকে দেখিয়ে কথাকে নিয়ে রিকশায় উঠে বসেছি।
এখন আফসোস হচ্ছে খুব, হেঁটে গেলেই বোধহয় বেশ হতো।
কথার সাথে এভাবে হুট করে রিকশায় উঠে বসাটা মোটেও উচিত হয়নি আমার।
এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিকে আরো লজ্জায় ফেলে দিয়ে রিকশাওয়ালা মামা যা করলেন তাতে আমি এবং কথা দু’জনেই লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেলাম।
রিকশার হুড উঠিয়ে দিলেন রিকশাওয়ালা মামা।
কালো আকাশে চারপাশটা একদম আবছা সাদা বর্ণ ধারন করেছে।
রিকশার ভেতরে হালকা অন্ধকারেও দু’জন চুপচাপ বসে আছি।
বৃষ্টি এই এলো বলে, ইশশ কথা কি ভাবছে কে জানে।
মেয়েটা আমাকে নির্ঘাত বাজে ছেলে ভাবছে নিশ্চয়ই।
কেনো যে রিকশায় উঠতে গেলাম!
পাল্লা দিয়ে ভারি বাতাস বইছে, বাতাসের সাথে তাল উঠিয়ে কথার অবাধ্য চুলগুলো সব আমার মুখে এসে ঠেকছে।
বার বার কানের পেছনে চুল গুজেও কোনো লাভ হচ্ছেনা।
একটু বিরক্তি মাখা মুখ নিয়েই কথাকে বললাম-
চুলগুলি ঠিক করে বসতে পারছো না!
কথার নির্লিপ্ত জবাব–
— এমন দমকা বাতাসে এক রিকশায় পাশে মেয়ে নিয়ে বসলে এমন একটু আধটু মেনে নিতেই হবে জনাব।
বলেই কথা পাশ ফিরে মুচকি হাসলো।
মেয়েটা যে আমাকে ভদ্র ভাষায় লজ্জায় ফেলতে চাইছে সেটা বুঝতে আমার বিন্দু মাত্র সময় লাগেনি।
চুপচুাপ বসে বসে কথার চুলের ঝাপটা সহ্য করে যাচ্ছি।
দু’একবার হাত দিয়ে সরিয়ে আনলেও মনে হলো ইচ্ছে করেই কথা এমন করছে।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, এখন তো আমার মন খারাপ করে থাকা উচিত।
কিন্তু শত চেষ্টা করেও কেনো জানিনা এখন মন খারাপের রেশ মাত্রও দেখছিনা আমার ভেতর।
নিলার বলা প্রত্যেকটা কথা আমার কানে ভাসছে।
সত্যিই, নিজের স্বার্থে মানুষ কিনা করে।
খেলার পুতুল করে ছেড়ে দিলো আমাকে।
আমার সামর্থ্য থাকলে তো, পুরো পৃথিবীই আমি তার পায়ের কাছে এনে দিতাম।
আমার সামর্থ্য নেই তাই আমি নিজেই, তার পায়ের কাছে পরে ছিলাম এতদিন।
আমার শক্তি থাকলে, বিশাল সমুদ্র তার নামে লিখে দিতাম।
আমি মঙ্গলময় হলে, শুধু তার জন্যই সাফল্য এনে দিতাম।
আমার সম্পদ থাকলে সকল সৌন্দর্য তার হাসিতে
এক নিমিষেই খরচ করতে কুন্ঠা বোধ করতাম না।
আমি দরিদ্র, তাই তার চোখে এই অনাহারী জীর্ন, শীর্ণ এই আমিটাকে সে পথের মানুষ ভেবে ভুল ট্রেনের মতো আমাকে রেখে চলে গেলো।
অথচ, আমি তাকে আমার জীবনের সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু এতকিছুর পর মনে হয়না তার জন্য মন খারাপ করে বসে থাকা বোকামি বৈ আর কিছু হবে।
— কি হলো, কি ভাবছেন?
কিছুনা।
— সেদিনতো আমার সাথে রিকশায় যেতে কঠিনভাবে মানা করে দিলেন।
আজ কি এমন হলো।
কথার প্রশ্নের জবাব দিলাম না আমি।
এক দৃষ্টিতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি দেখে যাচ্ছি।
কথার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি, সে আমার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে।
লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবার উপক্রম।
— ছেলেদের এতো লজ্জা মানায় না।
আমাকে কেনো বলছো এসব, চুপচাপ বসে থাকতে পারোনা?
কথা মুচকি হেসে বললো–
— জীবন কখনো থেমে থাকে না জনাব।
তাতে প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেলেও বা প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলেও না।
কিছুদিন হারানোর ব্যাথায় মানুষ কাতর থাকে।
পরবর্তীতে একটা সময় ঘুরে দাঁড়ায় মানুষটি।
জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ভালবাসার মানুষটি হারিয়ে গেলে মানুষ মরে না। সাময়িক সময়ের জন্য ভেঙ্গে পড়ে শুধু।
অবশ্য ভালবাসার মানুষটিকে পেয়ে গেলে দিনের শেষে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়না কিংবা রাতের আঁধারে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে হয় না।
তবে ভাগ্য বলে যে বিষয়টি আছে তা মানতে আমরা সবাই বাধ্য।
কথার প্রতিটা লাইনই তো সত্যি।
জীবন কারো জন্য থেমে থাকবেনা।
অবশ্য নিলা চলে যাওয়াতে আমার এখন আর কোনো আফসোস নেই।
যা আছে তা কেবলই আক্ষেপ।
কারণ প্রাপ্তির খাতায় যা যোগ হয়েছে তা হলো ভাঙ্গাচুরা একটা মন, এলোমেলো একটা আমি, পুড়ে যাওয়া একটা হৃদপিন্ড, ক্ষতবিক্ষত কিছু রক্তাক্ত স্মৃতি আর কিছু বোবা অভিমান।
অথচ যোগ বিয়োগের এই জাদুর খেলায় তুমি কিস্তিমাত করে জিতেই গেলে নিলা।
আর আমি হেরে গেলাম।
তবুও এই হেরে যাওয়াটা আমার জন্য কেবল হেরে যাওয়া নয়।
এই হেরে যাওয়া মানে নিজেকে শুধরানোর নতুন সুযোগ।
এই হেরে যাওয়া মানে ভবিষ্যতের শিক্ষা।
যা আমায় আগামীর জন্য যোগ বিয়োগের অংকটা পাকাপোক্ত করেই শিখিয়ে গেলো।
আমি নরম তুলো থেকে পাথর হবার সুযোগ পেলাম।এখন অবশ্য কেউ আঘাত করলে আমার নয় বরং কপাল তারই ফাটবে।
প্রিয় কারিগর ধন্যবাদ তোমায়, আমি মানুষটাকে এভাবে ভেঙ্গেচুরে নতুন করে গড়ে তুলতে সাহায্য করার জন্যে।
— কিছু বলছেন না যে!
হুম না আসলে কেউ একজন বোধহয় সত্যিই বলেছিলো, কিছু বলতে না পারা আর বলে না বোঝাতে পারার পরিস্থিতি গুলো সত্যিই শ্বাসরুদ্ধকর!
— একটা কথা বলবো?
নতুন করে আবার শুরু করাতে কিন্তু লজ্জার কিছু নেই।
পুনরায় শুরু করা মানে নিজেকে আরেকটি বড় সুযোগ দেওয়া।
কথার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি।
মেয়েটা কি চায়, কথার ঐ চোখের ভাষা আমি শুরু শুরুতে নিলার মাঝেও দেখেছি।
তবে কি, ছিঃ ছিঃ কি ভাবছি আমি।
.
.
.
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে এক প্রকার দৌড়েই চলে এলাম আমি।
পেছন থেকে কথার ডাক শুনেও আর তাকালাম না তার দিকে।
🍂
🍂
🍂
বইয়ের ভেতর ঢুবে আছি আমি।
সাধারণত আমার রুমে কেউ আসেনা, তবে এখন মনে হচ্ছে কেউ একজন খুব গভীর মনযোগী হয়ে আমাকে পেছন থেকে স্ক্যান করছে; ফলাফল আমি পড়ায় মনযোগ দিতে পারছি না একদমই।
কড়া গলায় বললাম- ফাইজা, কিছু বলার থাকলে ভেতরে এসে বলে যা।
দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই।
— আপনি কি করে বুঝলেন কেউ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে!
বলতে বলতেই কথা আমার রুমের ভেতরে ঢুকে পড়লো।
হুট করে মেয়েটা এভাবে আমার সামনে এসে পড়বে বুঝতে পারিনি।
আজ রিকশায় একসাথে আসার পর থেকে কথার সামনে ইচ্ছে করেই আর যাইনি।
বিকেলটাও রুমে কাটিয়ে দিয়েছি।
— কি হলো, চুপ কর আছেন যে!
তু তুমি এখানে! এখানে কি করছো!
— তোতলাচ্ছেন কেনো! দেখতেই তো পাচ্ছেন দাঁড়িয়ে আছি।
বলছি যে আজ বিকেলে ছাঁদে গিয়ে আপনাকে পেলাম না, খুব ব্যস্ত ছিলেন?
নাকি ইচ্ছে করেই আমার সামনে আসতে চাননি, প্রশ্নের উত্তর দেবার ভয়ে!
ভয় কেনো পাবো! তাছাড়া একটা নোট করতে হয়েছে তাই।
ফাইজা কোথায়! ফা ফাইজা ফাইজা।
— ঘুমাচ্ছে, ফাইজা রুমে ঘুমাচ্ছে।
আপনার মা আমাদের বাসায় বসে গল্প করছে।
আমি বসে বসে বোর হচ্ছিলাম তাই ভাবলাম এদিকটা একবার দেখে আসি।
আপনি কি ভয় পাচ্ছেন!
আ আমি ফাইজাকে ডেকে দিচ্ছি, এই ভর সন্ধ্যে বেলা কিসের এতো ঘুম।
পড়ালেখার খবর নেই।
— পালাচ্ছেন নাকি!
না মানে, থাক না ফাইজা ঘুমিয়ে; ডেকে তোলার প্রয়োজন নেই।
আচ্ছা আপনি রুমের জানালা খোলেন না!
উত্তরের জানালাটা খুলে রাখবেন সবসময়।
ঠান্ডা বাতাসে মন ভালো থাকবে।
চুপচাপ সটান দাঁড়িয়ে আছি আমি।
ফাইজার কোনো প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারছি না।
সত্যি বলতে দিতে ইচ্ছে করছে না।
নতুন করে মায়ায় পড়তে যে আমার খুব ভয় হয়।
— আজকে আসি, ডাইনিং টেবিলে মাংসের ঝোল রেখে গেলাম, ডিনারে মনে করে খেয়ে নিবেন।
আর হ্যাঁ, আমাকে দেখে ভয় পেলে কিন্তু আমি আন্টিকে বলে দেবো আপনি সিগারেট খান।
হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো কথা।
না চাইতেও আমার ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
মেয়েটা ইদানিং বড্ড বেশিই বাড়াবাড়ি করছে।
কিছু হলেই মাকে সিগারেট খাওয়ার কথা বলে দেবো বলে হুমকি দিচ্ছে।
না না এর একটা বিহিত করতেই হবে।
🍂
🍂
🍂
ভার্সিটির মাঠ পেড়িয়ে লাইব্রেরীর দিকে পা বাড়াতেই দেখি সেদিনের ঐ ছেলেটার কাঁধে নিলা নিশ্চিন্তে মাথা রেখে বসে আছে।
যেখানে আমরা প্রথম প্রথম আড্ডা দিতাম।
নোটসগুলো নিয়ে ঐ বটগাছটার নিচেই দু’জনার ঝগড়া হতো।
তবে আমার কাঁধে নিলা কখনও মাথা রাখেনি।
আমিই অবশ্য সে সুযোগটা দেইনি।
ভেবেছিলাম কাঁধটা নিলার মাথা রাখার জন্য পার্মানেন্ট করে নেবো।
তারপরই নাহয় সে আমার কাঁধে মাথা রাখবে, আর আমি ভালোবেসে নিলার হাত শক্ত করে ধরে রাখবো।
তবে আফসোস নিলা, ঐ যে কবিতায় আছেনা–
“তোমায় যতটুকু ভালোবেসেছি, যতভাবে চেয়েছি!
তার অর্ধেকও যদি বুঝতে-মিথ্যে মোহে ছাড়তে না আমায়, হন্যে হয়ে আমার ভালোবাসাটাকেই খুঁজতে!”
🍂
লাইব্রেরীর ছোট্ট একটা রুমে এসে দেখি কথাও এখানে দাঁড়িয়ে কিছু খুঁজছে।
এদিকটায় আমাদের ব্যাচ ছাড়া তেমন কোনো স্টুডেন্ট আসার কথা না।
তাই কথাকে দেখে খানিকটা অবাক-ই হলাম বটে।
হালকা কাশি দিয়ে বললাম- কিছু খুঁজছো তুমি?
হুট করে পেছন ফিরে কথা আমাকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলো।
বুকে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দম নিয়ে বললো-
— শুনেছি এখানে আপনাদের করা কিছু পুরোনো নোটস পাওয়া যাবে।
আসলে আমার একটু এসাইনমেন্টের জন্য প্রয়োজন ছিলো।
নিশিকে বললাম আমার সাথে আসার জন্য, বললো সে নাকি আসতে পারবেনা তাই একাই চলে এলাম।
আমাকে কাল সন্ধ্যায় বললেই পারতে, আমি হেল্প করে দিতাম।
— বললে ঠিক কতটা কাজ হতো তা আমার বেশ জানা আছে, এমনিতেই আমার সামনে আসতেই আপনার…
সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই আমার আর কথার চোখ গেলো রুমের একমাত্র দরজার দিকে।
সেদিকে তাকাতেই দেখি….
চলবে…