চিলেকোঠার_ভালোবাসা পর্ব-০৩

0
1514

#চিলেকোঠার_ভালোবাসা
#পর্ব_৩
#Adharer_Musafir (ছদ্দনাম)

মেয়েটার সাহস দেখে আমি রীতিমত অবাক হয়ে যাচ্ছি।
এক দিনের সামান্য দেখায় এই মেয়ের সাহস এতদূর চলে আসবে আমি ভাবতেও পারিনি।
অগত্যা তর্ক না করে আমি তাকে একটা রিকশা ঠিক করে দিতেই, সে দ্রুত রিকশায় উঠে গিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি দিয়ে বললো–

— আপনি কিন্তু চাইলে আমার সাথে আসতে পারেন, আমি মানা করবো না।

কোনো প্রয়োজন নেই তোমার সাথে এক রিকশায় যাওয়ার।
মামা আপনি যান তো।

মেয়েটি আর কিছু বললো না।
আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
কথায় কথায় এত হাসি কি করে পায় আমার তো সেটাই বুঝে আসে না।
অবশ্য মেয়েরা চাইলে সবই পারে।
হাসিতেই এদের যতো ছলনা।

অবশ্য আমিওতো কারো মুখের মিষ্টি হাসিতে ভুলে গিয়েছিলাম সব কিছু।
ভুলে গিয়েছিলাম ঐ হাসির পেছনের কঠিন সত্যটা।
আমাকে হাসতে শিখিয়ে এখন সেই হাসির মালিক চলে গেছে অন্যকে হাসাতে।
কিভাবে পারে এরা এত ছলনা করতে!
সব ঠিক হবে একদিন, আমিও হাসবো মন খুলে।
জেনে রাখো প্রিয়,
কালের পরিক্রমায় বদলে যাবে সব কিছু।
মেঘ সরিয়ে সূর্য উঁকি দিবে, নীল আকাশ হাসবে, হাসবেই!

🍂

বিকেলের টিউশনি শেষে গিটার নিয়ে প্রতিদিনের মতোই চলে এলাম ছাঁদে।
আঙুল নাড়িয়ে গিটারে সুর তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এ কয়েকদিনে গিটারে একদমই হাত দেয়া হয়না।
হবেই বা কি করে, যাকে নিয়ে সুর বেঁধেছিলাম সেইতো চলে গেছে অন্য কারো গানের শেষ লাইন হতে।
সে হারিয়ে গেছে আমার গান থেকে।
দূরত্বকে আপন করে সে হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে।
কথা হবে না দেখা হবে নাম্বারটাও ব্লক।
এতেই বুঝি তোমার মুক্তি মেলে, অপ্রাপ্তি থেকে।
তুমি স্বাধীন পেলে মুক্ত আকাশ কিনে নিলে।
রোদ্দুর আকাশে বসে দুরত্ব কে আপন করে নিলে।
কিন্তু তুমি হয়তো জানোনা নিলা, তোমার ওই হাজারো কোটি মাইল দুরত্ব আমি চাইলেই আমার দু’চোখের পলক ফেলে পারি জমাতে পারি।
তোমায় জানানো বা তুমি বুঝতে পারো এমনটা করিনা কারণ কিছুটা সুখ পেয়ে তুমি দূরে থেকে শুধু এটাই মনে করে হাসো।
আমি নিজ ভুবনে তোমার হাসিমুখ দেখি আর রোজ বিকেলে আমি গানের সাথে আমার সুখ বিক্রি করি।

আমার আবার গিটার ছাড়া খোলা গলায় গান গাইতে একদমই ভালো লাগে না।
কিছুক্ষণ গিটারে হাত বুলাতে বুলাতেই চিলেকোঠার রুমটায় কারো কাশির শব্দ শুনতে পেলাম।
কেউ আসছে ভেবে দ্রুত হাত থেকে সিগারেটটা ছুড়ে ছাঁদ থেকে ফেলে দিলাম।
এক প্রকার কাশতে কাশতেই নাকে মুখে হাত দিয়ে পাশের বাসার মেয়েটি এসে আমার সামনে দাঁড়ালো।
মুহূর্তেই চোখ মুখ কুচকে অবাক হয়ে আমাকে বললো–

— আপনি সিগারেট খান?

মেয়েটির প্রশ্নের কোনো জবাব দিলাম না আমি।
তবে ভয়ে আছি, এই মেয়ে না আবার মাকে কিছু বলে দেয়।
চিলেকোঠার ফাঁকা বদ্ধ রুমটায় সিগারেট টানাটা নিতান্তই আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো সেটা এখন বুঝতে পারছি।
কোনো ভাবে যে এখন ‘আমি খাই নি’ বলে চালিয়ে দেবো তারও উপায় নেই কারন আমার আশপাশ থেকেও সিগারেটের বাজে গন্ধ আসছে।
তাই এখন চুপ করে থাকাই শ্রেয়, যা ইচ্ছে ভাবুক তবে আমার কোনো ভাবেই স্বীকার করা চলবে না।
বাধ্য হয়ে গিটার হাত দিয়ে নাড়ছি আর মেয়েটির দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছি।

আমার নিরবতা বোধহয় মেয়েটির পছন্দ হচ্ছেনা, তাই চশমাটা চোখ থেকে খুলে হাতে নিয়ে বললো–

— নিজ থেকে বলবেন নাকি আন্টিকে গিয়ে আমি বলব ‘আন্টি আপনার ছেলেকে আমি সিগারেট টানতে দেখেছি?

যা আশংঙ্কা করছিলাম ঠিক তাই, ঠিকই দেখে ফেললো আবার মাকে বলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে।
সব ঐ মোটা চশমার জন্য।
কিছুটা ভয় আর বিরক্তি নিয়ে বললাম–

দেখেই যখন ফেলেছো তখন আর জিজ্ঞেস কেনো করছো?

— হুম বুঝলাম, তা কতদিন থেকে এসব ছাইপাশ টানেন?

বলতে বলতেই আমার পাশে লোহার মোটা পাইপের উপর বসে গেলো মেয়েটি।
কি অদ্ভুত, বলা নেই কওয়া নেই হুট করে কোনো মেয়ে একটা ছেলের পাশে এসে বসে যায় নাকি!
কাট কাট ভাষায় বললাম–

দেখো মেয়ে আমার ব্যপারে তোমার নাক গলাতে হবে না।

— কথা, আমার নাম কথা।
আর যদি নাক গলানোর প্রসঙ্গ আসে তবে বলবো পাশাপাশি থাকলে তো নাক গলাতেই হবে তাইনা!

মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারিনা।
চেনা নেই জানা নেই এভাবেও কেউ কারো সাথে কথা বলতে পারে তা আমার জানা ছিলো না!
এবারও চুপ করে আছি আমি, কথা বললেই এই মেয়ে পাল্টা জবাব দেবে।

— কি হলো; বললেন না যে! কতদিন থেকে এসব করেন!

দুই তিনদিন হলো।

— সত্যিই! নাকি আমি আন্টিকে বলে দেবো সেই ভয়ে কমিয়ে বললেন!
তা এসব কেনো খান! ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে আছেন বুঝি!

বলেই মেয়েটি হাসতে লাগলো।
আমি তাকিয়ে আছি তার হাসির দিকে।
কি নির্মল হাসি, পাক্কা সাহিত্য প্রেমি পুরুষেরা এই মেয়ের হাসির প্রেমে পড়ে যাবে।
সাহিত্য প্রেমি কেনো বলছি?
কারন এ হাসির মর্মার্থ শুধু সাহিত্যকরাই দিতে পারবে।
আমার মতো ছেলেরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেনা।
ছিঃ ছিঃ এসব কি ভাবছি আমি, আমারতো তার এ কথায় প্রচুর রেগে যাওয়া উচিত।
কিন্তু আমি চেয়েও তার কথায় রাগ আনতে পারছি না।

হুট করেই গিটার পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
আমার উঠে যাওয়া দেখে কথা হাসি বন্ধ করে দিলো।
ছাঁদের রেলিং ঘেষে দাঁড়ালাম আমি, দু’হাত সিমেন্টের পাকা করা রেলিংয়ের উপর ভর দিয়ে কিছুটা সামনে ঝুকে আছি।
বাতাসের হালকা ঝাপটা আমার ছোট চুলগুলোকে মাতাল করে দিচ্ছে।
কপালে নড়েচড়ে আমাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
বাহু পর্যন্ত খোলা হাতে আর মুখে বাতাসের হালকা ঝাপটা মনটাকে শান্ত করতে বাদ্ধ।
ভাবছি সত্যিই কি আমি ছ্যাঁকা খেয়েছি!
এটাকে কি সত্যিই ছ্যাঁকা খাওয়া বলে!
আমি তো ভালোবেসেছিলাম, প্রনয়ে না গিয়ে পরিনতীতে বিশ্বাস করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
তবে আমার সাথেই কেনো এমন হলো!
ভালোবাসায় বিচ্ছেদ এসেই আমাকে ‘ছ্যাঁকাখোর’ তকমা কেনো দিয়ে গেলো।
সে কি পারতোনা আমার সাথে থেকে যেতে!
পারতো না আমার দুঃখের সঙ্গি হতে!
ইশশ, যদি সত্যি হতো দিনের পর দিন মুখোশে ঢাকা আবেগী প্রতিশ্রুতিতে মাখানো প্রতারণার ভাষা গুলো।
যদি মিথ্যে আবেগ আর অপ্রেম বিদায় নিতো পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো!
যদি সম্পর্কে “বিচ্ছেদ” শব্দটাই নিষিদ্ধ করা হতো প্রতিটা নগর থেকে!
কেমন হতো যদি গোটা শহরবাসীর ঘরে ঘরে খামে মোড়া চিঠি পৌছাতো আবার, রাত্রি ভোর হতো ডাকপিয়নের অপেক্ষাতে।
প্রিয় মানুষটির হাতের স্পর্শ আর কালির গন্ধ মেখে থাকা চিঠির অপেক্ষাতে!
রান্না, কাজ, মিটিং, মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যস্ত মানুষ হাঁপিয়ে উঠে যদি ছুটি চাইতো একদিনের।
ইগো গুলোকে সাইডে রেখে মানুষ একদিন তার প্রিয় মানুষের সঙ্গে সময় কাটাত, ঘুরতে যেতো, ফুচকা খেতো, ঝগড়া করতো, ভালোবাসতো।
স্বল্প পরিচিত, নাম না জানা, ঠিকানাবিহীন প্রেমের অপেক্ষাগুলো যদি একবারও উপেক্ষিত না হতো!
চোখ বুজে মানুষ মানুষকে যদি আর একবার বিশ্বাস করতে পারতো!

— সরি, আসলে আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি।
আপনাকে হাসানোর জন্যই…
তবে কি জানেন, বছরের পর বছরের ভালোবাসা ভুলে চোখের পলকেই অন্য একজনকে একদিনেই সেই জায়গায় বসিয়ে দেওয়াটা ভালোবাসা না।
ভালোবাসি বলাটাই ভালোবাসা না।
তাকে অপশন ভাবলেও সেটা ভালোবাসা না।
ভালোবাসার সঙ্গা একএকজনের কাছে একেক রকম কিন্তু ভালোবাসা শব্দটার অনুভূতি একই।
ভালোবাসা বছরের হোক আর এক দিনের ভালোবাসা হোক, মানুষকে একমাত্র ভালোবাসার মানুষ হিসেবে অধিকার দেওয়াটাই ভালোবাসা।
সারাদিন ভালোবাসি না বলে দিনে হঠাৎ একবার ভালোবাসি বলে চমকে দেওয়াটাই ভালোবাসা।
হাজার টা অপশন থাকলেও ভালোবাসার মানুষকেই যেনো বাছাই করে নেওয়া হয় সেটাই ভালোবাসা।

কথার প্রতিটা লাইনে আমি আশ্চর্য হয়ে আছি।
সে কি কোনো ভাবে কিছু আঁচ করতে পেরেছে?
কিন্তু কিভাবে, দু’দিনের পরিচয় আমার কথার সাথে।
নিলাকে নিয়ে তো আমি কথাকে কিছুই বলিনি, এমনকি তার সাথে আমার তেমন কথাই হয়নি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে কথা বললো…

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে