#চিলেকোঠার_ভালোবাসা
#পর্ব_২
#Adharer_Musafir (ছদ্দনাম)
বলতে বলতেই ফাইজা মেয়েটির এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
যাওয়ার আগে মেয়েটি একবার পেছন ফিরে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়েছিলো অবশ্য।
শুনেছি আজ পাশের ফ্লাটে নাকি নতুন ভাড়াটে এসেছে, এই মেয়েটা সেখানেই উঠেছে হয়তো।
সব চিন্তা মাথা থেকে ফেলে ফোন হাতে নিতেই দেখি নিলার মেসেজ।
“ফায়াজ, আমি চাইনা তুমি আমার সাথে আর কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখো।”
মেসেজটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিলা আমাকে ব্লক করে দিলো।
আমার ঠোঁটের কোনে না চাইতেও মুচকি হাসি চলে এলো, আর সাথে হাজারো স্বপ্ন ভঙ্গের চাপা কষ্ট।
নিলা হয়তো পারবে আমাকে সব যোগাযোগমাধ্যম থেকে মুছে ফেলতে কিন্তু আমি পারলাম না।
তার সাথে বোধহয় আর যোগাযোগ হবে না, যোগাযোগহীনতায় কেটে যাবে অনেকদিন।
তারপর হয়তো কোনো একসময় নিলার নাম্বারটাও লিস্টের নিচে পড়ে রবে।
.
গিটারটা হাতে নিয়ে সিড়ি ভেঙে নিচে চলে এলাম।
বাসায় ঢুকতেই দেখি ছাঁদের সেই মেয়েটি ডাইনিংয়ে বসে ফাইজার সাথে দিব্যি গল্প করে যাচ্ছে।
আমার রুমে চলে আসতে যাবো ঠিক তখনই পেছন থেকে মা আমাকে বললেন–
–ফায়াজ, পাশের বাসায় আজ নতুন ভাড়াটে এসেছে।
তুই গিয়ে একটু দেখে আয়তো।
অবাক হয়ে আমি বললাম–
আমি সেখানে গিয়ে কি করবো মা?
— কি করবি মানে?
শুনেছি তাদের কোনো ছেলে নেই, মাত্র দুই মেয়ে।
তুই গিয়ে একটু হাতে হাতে ভারি মালপত্র এগিয়ে দিবি।
আমি, মা আমার ভালো লাগছে না এখন।
— ফায়াজ, যেতে বলেছি যখন তখন তুই যাবিই।
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার।
একে তো মন ভালো নেই, তার উপর এই উটকো ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছে।
রুমে এসে গিটারটা রেখে টিশার্ট চেঞ্জ করে একটা গেঞ্জি পড়ে বের হলাম।
আমাকে দেখে ঐ ছাঁদের মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসছে।
রাগটা আরো দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
বির বির করতে করতে চলে এলাম সেখান থেকে।
🍂
টিউশনি শেষ করে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত সাড়ে ন’টা বেজে গেলো।
রাস্তার কিনার ঘেষে হাঁটছি আর নিলার কথা ভাবছি।
মেয়েটা বোধহয় এখন আমাকে ছেড়ে দিব্যি ভালো আছে।
বাস্তবতা বুঝে গেছে হয়তো।
ভেবেছে আমার সাথে থাকলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
সত্যিই তাই, কি আছে আমার!
না ভালো বাড়ি না সম্মান না টাকা পয়শা ঐশ্যর্য কিছুই তো নেই।
শুধু শুধু আমার সাথে পথ চলার তো কোনো মানেই হয়না।
🍂
আজ তিনদিন হলো ভার্সিটি যাইনা।
সত্যি বলতে ইচ্ছে করেই যাইনা।
নিলার সামনে দ্বিতীয়বার মুখোমুখি হবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
তাকে দেখলেই বোধহয় কষ্টটা আরো বাড়বে।
অন্যের হাতে যখন নিলা হাত রাখবে তখন না চাইতেও বুকের ভেতরের নতুন ক্ষত-তে জ্বালা-পোড়া করবে।
চোখের সামনে কি করে দেখবো আমি এসব?
কিন্তু সামনে ফাইনাল পরিক্ষা আমার।
পরিক্ষাটা শেষ হলেই একটা চাকরির যোগান দিতে বেশি বেগ পেতে হবে না।
জীবনটা কিছুটা হলেও গুছিয়ে নেয়া যাবে।
আমার শত মন খারাপের ভার কিছুতেই পড়ালেখার উপর দেয়া চলবে না।
ভাবছি কাল থেকে আবার ভার্সিটি যাবো, নিলার সাথে দেখা হলেও তাকে এড়িয়ে চলতে হবে।
পারবো কিনা জানিনা তবে আমাকে নিজের জন্যই শক্ত হতে হবে এখন।
🍂
ভার্সিটিতে ঢুকে সামনে তাকাতেই দেখি একটা মেয়েকে কয়েকটা ছেলে মিলে র্যাগ করছে।
বুঝলাম মেয়েটি ভার্সিটিতে নতুন।
এসবে আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই।
তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ছেলেগুলো একটু সরে দাঁড়ালো।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমার ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ একসাথে হয়ে গেলো।
এ’তো কালকের সেই মেয়েটি, আমাদের পাশের ফ্লাটে উঠেছে।
চুপচাপ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সে ভয় পেয়ে আছে তা ঢের বোঝা যাচ্ছে।
চোখের চশমাটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, চুলগুলো সামনে এসে পড়ায় বার বার মাথা নিচু করেই কানের পেছনে গুজে দিচ্ছে।
ছেলেগুলো মেয়েটার দিকে কেমন হা করে তাকিয়ে আছে।
বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে তাদেরকে বললাম–
কি হচ্ছে কি এখানে? নতুন পেয়ে র্যাগ করা শুরু করে দিয়েছো তোমরা!
ভুলে যেওনা তোমরাও এক সময় নতুন ছিলে।
এই মেয়ে, যাও তুমি ক্লাসে।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।
মেয়েটা এবার আমার দিকে মাথা উঁচু করে তাকালো।
যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না।
একবার ছেলেগুলোর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে সেখান থেকে হেঁটে চলে গেলো।
ছেলেগুলোর দিকে এবার কড়া চোখে তাকাতেই আমাকে সরি বলে এক প্রকার দৌড়েই চলে গেলো সবাই।
🍂
🍂
ক্লাস শেষে ভার্সিটির বাইরে আসতেই নিলার মুখোমুখি হলাম আমি।
সেদিনের ঐ ছেলেটার সাথে বাইকে উঠে গেলো।
নিলা ছেলেটার কাঁধে হাত রাখতেই আমার চোখে বোধহয় ছোট্ট কোনো পোকা এসে পড়লো।
না চাইতেও চোখে পানির আভাস পাচ্ছি আমি।
দ্রুত সানগ্লাসটা পড়ে নিলাম।পোকা পড়ার আর সময় পেলো না বুঝি।
কি মনে করবে সবাই, ছেলেটা কাঁদছে।
খুব ইচ্ছে ছিলো, কোনো একদিন আমি আর নিলা বাইকে করে এভাবেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।
নিলা আমার কাঁধে হাত রেখে গল্প করবে।
দু’জনার মন সেদিন থাকবে দু’জনার জন্য উন্মুক্ত।
কিন্তু দেখো, আজ তুমি অন্য কারো কাঁধে হাত রেখে নতুন স্বপ্ন বুনে যাচ্ছো।
সব ভুলে গেছো নিলা?
তুমি সব ভুলে গেছো, যেদিন তুমি সিদ্ধান্ত নিলে আমার সাথে আর কোন ধরনের যোগাযোগ রাখবে না, সেদিন আমার কেমন লেগেছিলো তুমি জীবনেও তা বুঝতে পারবে না।
তুমি তো সোজা সহজ ভাষায় না করে দিলে, আর কোন সম্পর্ক থাকবেনা আমাদের।
কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছো, এক কথায়ই কি সম্পর্কের ইতি টানা যায়?
যেখানে একটা সম্পর্ক গড়তে এতোটা সময় লাগে, সেখানে এক কথায় কিভাবে সব শেষ করা যায়?
আমি বুঝতে পারিনা, যেখানে একটা সম্পর্ক করতে দুজনের সম্মতি লাগে, সেখানে একজন কিভাবে তা ভেঙ্গে দিতে পারে?
তোমার এই আকস্মিক চলে যাওয়াতে আমার যে কি নিদারুণ কষ্ট হয়েছে, তার ভাগ তুমি নেবে না? ভালোবাসার ভাগ দুজনে নিলে, কষ্টের ভাগ একজনে কেনো নেবে?
মানুষ একেবারে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে মেনে নেওয়া যায়।
কিন্তু এভাবে একই আকাশের নিচে থেকেও দুজনের মন যোজন যোজন দূরে থাকলে তা কিভাবে মেনে নেওয়া যায়?
দুজনের এক হওয়ার সিদ্বান্ত যদি দুজন নেয়, তবে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত একজন কিভাবে নিতে পারে?
তবে তুমি কি আমার সাথে খেলা খেললে?
তাইতো খেলার বিজয়ী হয়ে শেষ প্রস্থান করলে! তাহলে কি আজকাল ভালোবাসাটাও এক প্রকার খেলা হয়ে গেছে?
নেহায়েত সময় কাটানোর খেলা!
সানগ্লাসটা ঠিক করে সামনে ফিরে চলে আসতে যাবো ঠিক তখনই বোধহয় পেছন থেকে কেউ একজন আমায় ডাকলো।
শিওর হতে পেছনে তাকাতেই দেখি সকালের সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে।
কেনো জানিনা মেয়েটার চোখে চশমা দেয়াটা আমার মোটেও ভালো লাগছেনা।
খুবই রুপবতী মেয়েদের চোখে চশমা কেনো থাকবে!
তাদের চোখে চশমা একদমই মানায় না।
আমতা আমতা করে মেয়েটি আমাকে বললো–
— আমাকে একটা রিকশা ঠিক করে দেবেন?
অনেক্ষন থেকে দাঁড়িয়ে আছি একটা রিকশাও থামছে না।
এইটুকু রাস্তা রিকশায় যাওয়ার কি দরকার!
হেঁটে গেলেই তো পারো, আমিওতো হেঁটেই যাই প্রতিদিন কই আমার তো রিকশা লাগে না।
— আপনি কি আমাকে ইনডাইরেক্টলি আপনার সাথে হেঁটে যাওয়ার জন্য বলছেন?
আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে হেঁটে যেতে রাজি আছি।
বলেই মেয়েটি মুচকি হাসলো।
বুঝতে পারছিনা এই হাসির মানে কি।
একটু কড়া গলায় বললাম–
প্রথম দিনেই এসে সিনিয়রের সাথে এভাবে নির্ভয়ে কথা বলছো, বাহ্ সাহস তো তোমার কম না।
তখন তো বিড়ালের মতো চুপ করে মাথা নিচু করে ছিলে, আর এখন বড় বড় কথা বের হচ্ছে কিভাবে।
আমার কড়া গলায় বলা কথা শুনে মেয়েটি বোধহয় এবার কিছুটা চুপষে গেলো।
পরক্ষনেই মুখে হাসি টেনে বললো–
— সিনিয়রের সাথে নির্ভয়ে কথা বলাটা প্রথম দিনে আপনিই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন।
অন্তত আপনার সাথে ভয় পেয়ে আমি কথা বলব না।
আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে হেঁটে বাসায় যেতে পারি।
কিন্তু আপনার মুড দেখে মনেহয়না আমার এখন আপনার সাথে হেঁটে যাওয়াটা ঠিক হবে।
এখন কি আমাকে রিকশা ঠিক করে দেবেন, নাকি আমি বাসায় গিয়ে আপনার মাকে বলব আপনি আমায় রাস্তায় একা ফেলে চলে এসেছেন; উপায় থাকা সত্তেও আমায় সাহায্য করেন নি।
তারপর আপনার মা আপনাকে যা বলবেন তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না।
মেয়েটার সাহস দেখে আমি রীতিমত অবাক হয়ে যাচ্ছি।
এক দিনের সামান্য দেখায় এই মেয়ের সাহস এতদূর চলে আসবে আমি ভাবতেও পারিনি।
অগত্যা তর্ক না করে আমি তাকে একটা রিকশা ঠিক করে দিতেই, সে দ্রুত রিকশায় উঠে গিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি দিয়ে বললো–
চলবে…