চিলেকোঠার_ভালোবাসা পর্ব-০১

0
2870

#চিলেকোঠার_ভালোবাসা
#পর্ব_১
#Adharer_Musafir (ছদ্দনাম)
(ফাহমিদা ইফ্ফাত ছিদ্দীকা)

হাজার চেষ্টা করেও আজ গিটারে সুর তুলতে পারছিনা আমি।
বার বার শুধু নিলার বলা শেষ কথাগুলো মনে পড়ছে।
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে যখন সেই পুরোনো বট গাছের নিচটায় গেলাম, তখনই নিলাকে অন্য একটা ছেলের সাথে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে মাথাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
কাছে গিয়ে নিলাকে বললাম–

এই ছেলেটা কে?

নিলা বিরক্তি মাখা মুখ করে আমাকে বললো–

— ফ্রেন্ড!

তার এমন সোজাসাপ্টা জবাবে বেশ চটে গেলাম আমি।
নিলার হাত শক্ত করে ধরে একটু দূরে নিয়ে এসে বললাম– তুমি অন্য একটা ছেলের পাশে কেনো বসবে?
তুমি জানোনা আমি তোমাকে ভালোবাসি?
জেনেও কেনো এমন করো?
তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি ঐসব টিপিকাল ছেলেদের মতো নই, যে কিনা তার ভালোবাসার মানুষের সাথে কোনো ছেলেকে সহ্য করতে পারবেনা।
কিন্তু তুমি শুধু বসে থাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকোনা, যার তার হাত ধরে বসে থাকো আর…
দেখো নিলা, আমার এসব একদম পছন্দ না।
আমি চাইনা তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলের সাথে এমন ভাবে মেলামেশা করো।

— ভালোবাসা মাই ফুট, কে কাকে ভালোবাসে?
তুমি? তুমি আমাকে ভালোবাসো?
ভালোবাসলে আমি যা বলি তাই করতে।
পাগলামি বোঝো পাগলামি?
মেয়েরা চায় তার ভালোবাসার মানুষটা তাকে নিয়ে পাগলামি করুক, মুখ ফুটে কিছু চাওয়ার আগেই সব এনে হাজির করুক।
কিন্তু না, তোমার সময় কোথায় আমার জন্য?
সারাদিন ক্লাস টিউশন আর গান নিয়েই ব্যস্ত তুমি।
আমরা যে রিলেশনে আছি সেটাতো তুমি ভুলেই গেছো।
আর মেলামেশার কথা বলছো?
আমি আগেও তোমাকে বলেছি, তোমার জন্য আমি আমার স্বাধীনতায় বাঁধা আসতে দেবো না।
আসলে কি বলো তো ফায়াজ, আমাদের রিলেশনে যাওয়াটাই ভুল সীদ্ধান্ত ছিলো।
আমি আর পারছিনা তোমার সাথে থাকতে, একচুয়েলি আমি আর থাকতেই চাইছি না তোমার সাথে।
আমাদের সম্পর্কটা এখানেই শেষ, তুমি তোমার রাস্তা মাপো আর আমি আমার।

চলে গেলো নিলা!
আমি তখনও “থ” হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
এতো অভিযোগ আমার উপর পুষে রেখেছে!
নিলা তো জানতোই পড়াশোনা টিউশন এসব আমার জন্য কতটা জরুরী।
পরিবারের হাল যে এখন বলতে গেলে সবটা আমাকেই বয়ে বেড়াতে হয়।
বাবা মারা যাবার পর থেকে টিউশনটাই আমার একমাত্র ভরসা।
বাড়ি ভাড়া মা বোনের ভরন পোষন বাবার রেখে যাওয়া টাকায় আর ক’দিনই বা চলবে?
এই অবস্থায় সত্যিই আমার নিলার সাথে রিলেশনে যাওয়াটা বোধহয় ভুল সীদ্ধান্তই ছিলো।
তার চাহিদা আমার দ্বারা পুরোন হবে না ভেবেই হয়তো সম্পর্কটা এখানেই শেষ করে দিয়েছে।
ক্লাসের টপ স্টুডেন্টদের মধ্যে ছিলাম, তাই বোধহয় আবেগে ভালোবাসার কথা বলে ফেলেছিলো।
একই ব্যাচের ছিলাম কিনা; শুনেছি সমবয়সীদের সম্পর্ক নাকি বেশিদিন টিকে না।
আমার ক্ষেত্রেও হয়তো এমনই হয়েছে।
তাছাড়া মধ্যবিত্তদের প্রেমে পড়া মানায় নাকি!

ঘন্টার পর ঘন্টা মেসেঞ্জারে কথা বলাকে প্রেম বলে না।
যেই মেয়েটা প্রতিদিন নিয়ম করে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা কথা বলতে চায়, সে আসলে প্রেম করছে না, সে ক্যারিয়ার নষ্ট করছে!
আজ না হলেও কাল হয়তো নিলাও আমার ক্যারিয়ারের দোহাই দিয়ে বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে নিতো।
রাত দুইটার সময় কল দিয়ে যদি আইসক্রিম খাওয়ার বায়না করে আর বোকার মত দৌড়ে গিয়ে আইসক্রিম কিনে দিয়ে আসতে হয়, তাহলে সে আর যাই হোক প্রেম করছে না।
সেটাকে ঢং বললে খুব একটা ভুল হবে না।
নিলা হয়তো জানেই না যে, ঘন্টার পর ঘন্টা কথা না বলেও প্রেম করা যায়।
রাতের পর রাত ন্যাকামি না করেও প্রেমিকা হওয়া যায়।
অবশ্য সব মেয়ে প্রেমিকা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেই মেয়েটা ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই মেয়েটাই প্রকৃত প্রেমিকা হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

🍂
🍂
🍂

গিটারটা লোহার পাইপের উপর রেখে রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাসটাও আজ বিষাদময় লাগছে।
মন ভাঙলে বুঝি সব কিছুই বিষাদময় লাগে!
আমি তো সত্যিই ভালোবেসেছিলাম।
ভালোবাসলেই কি সময় দিতে হবে!
অপর মানুষটার অবস্থাটাও তো একবার দেখা উচিত।
তাকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চাই বলেইতো এতো আয়োজন ছিলো আমার।
তুমি আমায় বুঝলেনা নিলা!
তুমি ফিরবেনা আর কোনোদিন,
তবুও আমি তোমার ফেরার অপেক্ষা করি।
তোমার ফেরার পথে গত হয়েছে আমার বেদনা-যন্ত্রণার মাত্র কিছু সময়, শত শত ইচ্ছের বলি হয়েছে, সাদা-কালো হয়েছে কত রঙ।
তুমি তো তার কিছুই খবর রাখোনি!
তুমি ফিরবেনা জেনেও আমার শহর জুড়ে তোমাকে নিয়ে হাজার রঙিন স্বপ্নের আনাগোনা।
তুমি তো জানো না আমি তোমাকে কি রূপে সাজাই, তোমাকে ছাড়া আমার অশান্ত সময় কিভাবে কাটাই!
তুমি ফিরবেনা আর কোনোদিন, তবু এ দু’চোখ শুধু তোমায় খুঁজে ফেরে।
তুমি ফিরবেনা জেনেও এই অবুঝ মন বোকামির ছলনায় বুকের গহীনে শত অভিমান পোষে।
তুমি শুনবে না জেনেও কত শত অভিযোগ পোষে আমার মন, দিন শেষে শূণ্য আমি তুমি অন্য কারো প্রিয়জন।

— বাহ্ আপনি দেখছি দারুন কবিতা বলতে পারেন।
ভালোই হলো, আপনার কাছ থেকে আমার বিনামূল্যে সাহিত্যচর্চা হয়ে যাবে।

ভাঙা মন নিয়ে নিস্তব্ধ ছাঁদের রেলিং ঘেষে নিজের সাথে নিজেই কথা বলছিলাম ঠিক তখনই মেয়েলি একটা কণ্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি অপরিচিত একটা মেয়ে হাতে হিমু সমগ্র বইটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সুন্দর, না না মেয়েটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর।
উপরের ঠোঁটের আউট লাইনের ছোট্ট তিলটা মেয়েটির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
চোখে পাওয়ারের মোটা চশমাটায় মেয়েটাকে দেখতে কিছুটা গম্ভীর বানিয়ে দিয়েছে অবশ্য, দেখেই মনে হচ্ছে পাক্কা বই পড়ুয়া হবে।
চুল ছেড়ে রাখায় বাতাসের ঝাপটায় সামনের চুলগুলি বার বার মুখের সামনে এসে মেয়েটাকে বিরক্ত করছে।
কিন্তু মেয়েটাকে আজ অবদি আমি এ এলাকায় দেখেছি বলে আমার মনে হয়না।
প্রশ্নবোধক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম—

আপনি কি আমাকে বলছেন?

— আপনি ছাড়া ছাঁদে কি আর কেউ আছে?

মেয়েটি আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আশে পাশে চোখ বুলাচ্ছে, খুব সম্ভবত কিছু খুঁজছে।
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মেয়েটির চোখ আমার পাশে স্থির হয়ে যায়।
দৃষ্টি অনুসরন করে আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখি ফাইজা চিলেকোঠার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি তাকাতেই হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে বলে– তুই এখানে কি করছিস ভাইয়া?

প্রতিদিন যা করতে আসি তাই।

— ধ্যাৎ তোর সাথে কথা বলাই বোকামি।
কথা আপু, তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান।
চলো তোমাকে মা ডাকছে।

বলতে বলতেই ফাইজা মেয়েটির এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
যাওয়ার আগে মেয়েটি একবার পেছন ফিরে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়েছিলো অবশ্য।
শুনেছি আজ পাশের ফ্লাটে নাকি নতুন ভাড়াটে এসেছে, এই মেয়েটা সেখানেই উঠেছে হয়তো।
সব চিন্তা মাথা থেকে ফেলে ফোন হাতে নিতেই দেখি…

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে