চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-২৫+২৬

0
528

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চবিংশ_পর্ব
~মিহি

“আমি বিয়েতে রাজি, চাচী। আমার কোনো অসুবিধা নেই, সুবহার যদি সম্মতি থাকে তবে আমারও আর কোনো আপত্তি থাকবে না।” সিয়ামের কথায় রেহানা সুলতানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সিয়ামকে সব জানানোর পর যে সে বুঝেছে তাতেই তিনি সন্তুষ্ট।

-সিয়াম, বাবা এটা ভেবো না তোমার উপর সুবহাকে আমরা চাপিয়ে দিচ্ছি। তোমার চেয়ে ভালো ছেলে আমরা খুঁজে পেতাম না। চোখের সামনে তোমাকে বড় করেছি, আমার মেয়ের জন্য তোমার চেয়ে ভালো আর কাকে পাবো আমি?

-চাচী, এসব কথা থাক। চাচ্চুর শরীরের যা অবস্থা তাতে আমরা এসব পরে ভাববো।

-তোমার চাচ্চু বিয়ের কথাটা জানলেই স্বস্তি পাবেন সিয়াম। উনি চান তোমরা যেন এই মাসের মধ্যেই বিয়ে করো।

-চাচ্চুর এ অবস্থায় আমরা কিভাবে…তাছাড়া সুবহার মতামতেরও একটা ব্যাপার আছে চাচী।

-তুমি সুবহার সাথে একবার কথা বলো সিয়াম। আমি নিশ্চিত ও তোমার কথা শুনবে এবং বুঝবে।

সিয়াম মাথা নাড়লো। সুবহাকে এ মুহূর্তে কিছু বোঝানো কী সম্ভব তার পক্ষে। তাছাড়া চিত্রলেখা আছে সেখানে। সিয়াম কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। চিত্রলেখার সামনে সুবহাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কথা বলাটা তার ভালো লাগবে না। চিত্রলেখার দিকে তাকাতে অবধি পারছে না। নিজেকে বারবার দোষ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন সে যাওয়ার আগে একটাবার চিত্রলেখাকে মনের কথা বলে গেল না। অবশ্য চিত্রলেখা কি তাকে ভালোবাসতো কখনো? উত্তরটা স্পষ্টত না বোধহয়। মেয়েরা নাকি ক্রোশ দূর থেকেও বুঝে যায় ছেলেরা কোন চাহনিতে তাদের পর্যবেক্ষণ করছে। চিত্রলেখারও বোঝার কথা, হয়তো সে ভালোবাসে না বলেই বুঝতে চাইছে না।

সুবহা শান্ত থাকলেও তার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে চিত্রলেখা। মেয়েটার মনের উপর দিয়ে কী এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

-আঙ্কেল একদম সুস্থ হয়ে যাবে। তুই এতটা ভেঙে পড়িস না।

-আমি পারছি না রে লেখা। আমার মনের অবস্থা আমি কী করে বোঝাবো তোকে? আমি যদি কাউকে একটু বোঝাতে পারতাম!

-সুবহা তুই..

-তুই..তুই তো অনেকক্ষণ এসেছিস। হোস্টেলে ফিরতে হবে তো তোর। চিন্তা করিস না আমার, তুই ফিরে যা। বাবা সুস্থ হলে আমি তোকে জানাবো।

-কিন্তু …

-তুই একা যেতে পারবি?

-হুম।

চিত্রলেখা বুঝতে পারলো সুবহা একা থাকতে চাইছে। এখন ওকে বেশি কিছু বোঝানোর চেষ্টা করা যাবে না। বন্ধুত্ব মানেই যে সবসময় বোঝাতে হবে তা নয়, মাঝেমধ্যে একটু স্পেস, একটু একা ছাড়তে হয় বন্ধুকে। সুবহাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে চিত্রলেখা ফেরার জন্য বেরোলো। চিত্রলেখাকে যেতে দেখলো সিয়াম। অন্য সময় হলে হয়তো সেও পৌঁছে দেওয়ার বাহানায় দুয়েকটা বাক্য বিনিময়ের নানান কৌশল বের করতো কিন্তু আজ যেন পরিস্থিতিই থমকে গেছে। যার সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজতো সে, আজ তাকেই এড়িয়ে চলতে চাইছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুবহার দিকে এগোলো সে। এখন সুবহাকে বোঝাতে হবে তার।

-সুবহা, একটু শোন তো।

-বলো ভাইয়া।

-একটু ছাদে চল তো, এখানে বলার মতো সিচ্যুয়েশন নেই।

-চলো।

সুবহা ওঠার চেষ্টা করতেই নিজেকে সামলাইতে পারলো না। দুর্বল শরীর, কান্নাকাটি করে আরো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে সে। উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো। পড়তে গিয়েও পড়লো না সিয়ামের আগলে নেওয়াতে।

“ঠিক আছি আমি।” সুবহা নিশ্চয়তা দিলেও সিয়াম ছাড়লো না। আলতো হাতে সুবহাকে ধরে ধরেই সিঁড়ি বেয়ে উঠলো। হাসপাতালের ছাদের পরিবেশ থমথমে। আজ আকাশটাও মেঘলা। কিছুক্ষণ পর পর বৃষ্টি হচ্ছে। শীতে এমন টুপটাপ বৃষ্টি খুব একটা হয়না তবে হিমশীতল বাতাসের স্পর্শে সুবহা খানিকটা কুঁকড়ে ফেলল নিজেকে।

-কিছু বলবে ভাইয়া?

-হুম।

-আমারো কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি কাউকে বলতে পারছি না। আমি একদম পাথর হয়ে যাচ্ছি ভেতর থেকে। আমার কথা একটু শুনবে?

-বল।

-বা..বাবার এ অবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমি যদি বাবাকে কথাগুলো না বলতাম, বাবা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতো না। এসব কিছু হতো না।

-কী কথা? কী বলছিস তুই?

-গত রবিবার আমি একা ফিরছিলাম কলেজ থেকে। কলেজের মূল রাস্তা পার হতেই কয়েকটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরে আমার মুখে পানি ছুঁড়ে মারে এবং বলে পরেরবার এসিড মারবে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি সোজা গিয়ে বাবাকে সব বলে দিই। এ কারণেই বাবার এ অবস্থা।

কথাগুলো বলতে বলতে সুবহার চোখ ভিজে উঠলো, অবারিত অশ্রুধারা গুলো সুবহার গাল বেয়ে গড়াতে লাগলো। কান্না করতে করতে সিয়ামের বুকে ঢলে পড়লো সুবহা। সিয়াম এবার শক্ত করেই সুবহাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রথমবারের মতো সিয়ামের মনে হলো মেয়েটার তাকে প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন।

_________

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল চিত্রলেখা। বৃষ্টির কারণে এখন গাড়ি পাওয়া একটু মুশকিল। আচমকা একটা রিকশা এসে থামলো চিত্রলেখার সামনে। চিত্রলেখা মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পেল রঙ্গনের হাস্যোজ্জল মুখখানা।

-এখন গাড়ি পাবেনা, এসো আমিই পৌঁছে দিই।

-আমি যেতে পারবো, আপনি যান।

রঙ্গন আর কিছু বললো না। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে রিকশাওয়ালাকে বিদায় করলো। চিত্রলেখা রঙ্গনের কাজের কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

-মানুষ চাক বা না চাক, আল্লাহ চাইলে সাক্ষাৎ তিনি করায়েই দেন।

-আপনার মনে হয়না আপনি ফিল্মি ডায়লগ মারতেছেন?

-আমরা তো বন্ধু ছিলাম, হঠাৎ এত রুক্ষ ব্যবহার! আচ্ছা আমি স্যরি, আমিই একটু বেশি পাগল টাইপের তো। এহ শোনো, আজ তো ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। তোমার ঘণ্টা তিনেক সময় হবে?

-কেন?

-ঐ সুন্দর জায়গাটা বৃষ্টির সময় আরো সুন্দর হয়। ‘আমার আশিয়ানা’ টা।

-অন্য কোনোদিন। আজ আমার এক ফ্রেন্ডের বাবা অসুস্থ, তাকে দেখতে এসেছিলাম।

-চিত্রলেখার তবে আজ মন খারাপ। আচ্ছা চলো আজকে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। একটু সময় হবে কি? অতি সামান্য?

-আপনি এত জেদী কেন? মাত্র ত্রিশ মিনিট, এর বেশি না।

-যথা আজ্ঞা রানীসাহেবা। আসুন এখন রিকশা খুঁজতেই না ত্রিশ মিনিট পেরিয়ে যায়। এসো রাস্তা পেরোতে হবে।

আনমনেই চিত্রলেখার হাতটা ধরে দুপাশে তাকিয়ে সামনে এগোলো রঙ্গন। চিত্রলেখা অবাক বিস্ময়ে আবদ্ধ হাতজোড়া আর রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটাকে প্রথম দেখাতে যথেষ্ট ম্যাচিউর ভেবেছিল সে। এ তো অহমের চেয়েও ছোট বাচ্চা।

__________

-মামা যাবেন?

-কোথায় যাবেন?

-সামনের রাস্তার মোড়ে যে ‘আরশিনগর’ আশ্রম আছে সেখানে। কত নিবেন?

-বৃষ্টির দিন, কী আর বলবো মামা! চল্লিশ দিয়েন।

-আচ্ছা ঠিক আছে। চিত্রলেখা উঠো।

চিত্রলেখা খানিকটা বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। সামনের রাস্তার মোড় হেঁটে গেলে মাত্র দশ মিনিট লাগবে। সেখানে এই ছেলে চল্লিশ টাকা দিয়ে রিকশা ঠিক করলো? আল্লাহ যখন জ্ঞানবুদ্ধি বিতরণ করতেছিল, তখন এ নিশ্চিত ভিডিও গেম খেলতেছিল! অবশ্য কীসব ভাবছে চিত্রলেখা! রঙ্গন সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ছেলে, তার কাছে টাকার কী-ই বা মূল্য।

“তুমি যা ভাবছো তা কিন্তু ঠিক না চিত্রলেখা।” ফিসফিসিয়ে চিত্রলেখার কানের কাছে বলে উঠলো রঙ্গন। চিত্রলেখার শরীর শিউরে উঠলো। এভাবে আচমকা কানের কাছে এসে বলায় তা শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। চিত্রলেখা ফিসফিসিয়েই উত্তর দিল।

-কী ভাবছি আমি?

-এই যে আমি খুব টাকা ওড়ায়ে বেড়ায়, আসলে তা না। আশ্রমে আমরা হেঁটেও যেতে পারতাম। তবে এই বৃষ্টির মাঝে তোমাকে ভিজায়ে সর্দিজ্বরে ফালানোর চিন্তা আমার নাই। জিনিসটা দেখতে খুব এস্থেটিক লাগে তবে অসময়ের বৃষ্টি সেইফ না বুঝছো?

-হুম বুঝেছি।

-কী বুঝেছো?

চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। অতঃপর এক অদ্ভুত মোহনীয় স্বরে বলে উঠলো,”অসময়ের বৃষ্টি সেইফ না।”

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
ষড়বিংশ_পর্ব
~মিহি

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। রিকশায় খানিকটা দূরত্বেই বসেছে চিত্রলেখা। আকাশের ঘনঘটা আর ঝুম বৃষ্টির শব্দে রিকশায় বসে রাস্তা দেখার মতো সুন্দর অপরাহ্ন বোধহয় সে আগে এভাবে উপভোগ করেনি।

-হুড তুলে দিব, তোমার অসুবিধা?

-আপনার বৃষ্টির সাথে কোনো শত্রুতা আছে? হালকা বৃষ্টিই তো হচ্ছে, হুড তুলতে হবে না।

-আমার এক্সের নাম বৃষ্টি ছিল তো তাই।

-আসলেই?

-আরে না। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাঁচি ফেলতে ফেলতে যে আমাকে গালি দিবা, তার বেলায়? তোমাকে অসুস্থ হতে তো দিতে পারিনা!

-চুপচাপ বসে থাকেন। আর একটা কথা বললে ত্রিশ মিনিট থেকে দুই মিনিট করে মাইনাস করবো।

রঙ্গন চ’কারান্ত শব্দ করে মুখ বন্ধ করলো। রিকশা চলছে ধীর গতিতে। রিকশাওয়ালা তেমন কথা বলছে না। এক অদ্ভুত রকম নীরবতায় রঙ্গনের কানে আসে বৃষ্টির শব্দ। এবার সে অনুভব করতে পারে চিত্রলেখা কেন তাকে চুপ থাকতে বলেছিল। ব্যস্ত রাস্তার কোলাহলেও যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে শব্দটা। বৃষ্টির একটা অদ্ভুত ঘ্রাণও আছে যা অচিরেই রঙ্গনের নাকের কাছে এসে দোল খাচ্ছে। অসময়ের বৃষ্টি বোধহয় খুব একটাও খারাপ না। এই বৃষ্টির নাম আসলে প্রেম, অসময়ে হঠাৎ আসে আর যখন আসে মানুষের মনকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়।

মিনিট দশেক পর রিকশা থামলো আরশিনগর আশ্রমের সামনে। রঙ্গন রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটালো। চিত্রলেখা ততক্ষণে নেমে সামনে তাকিয়েছে। খোলামেলা একটা জায়গা, ভেতরে দোতলা একটা বাসার মতো দেখা যাচ্ছে তবে যথেষ্ট প্রশস্ত জায়গা।

-চলো ভেতরে।

-এটা কি বৃদ্ধাশ্রম?

-না এটা ইচ্ছেমহল। এখানে ইচ্ছে পূরণ করা হয়।

-মানে?

-এটা আসলে এমন একটা আশ্রম যেখানে বৃদ্ধা, তরুণ সবাই থাকে। সবাই কোনো না কোনোভাবে অসহায় হয়ে এখানে এসেছে। ওনারা এখানেই থাকেন এবং প্রতিদিন অসংখ্য শিশুরা এখানে আসে তাদের হাতে খাবার খাওয়ার জন্য, একটু গল্প করার জন্য। তারা যেন মনে না করে যে তারা কারো দয়া নিয়ে বাঁচছে। তাদের রান্না করা খাবার যে একটা শিশুর ক্ষুধা নিবারণ করছে এটা ভেবে যেন তারা প্রশান্তি পায়।

-এটার ফাউন্ডার কে? আপনি?

-নাহ, এটা আমার মায়ের তবে আমি আসি তাদের সাথে আনন্দ ভাগ করতে। আগে কয়েকজন বন্ধুরা মিলে আসতাম, ওনাদের সাথে আমরাও রান্না করতাম, বাচ্চাদের পড়াতাম। এখন তো সবাই আলাদা শহরে তাই যোগযোগ নেই।

-ভেতরে যাই?

-হ্যাঁ এসো কিন্তু তুমি আমার সাথে আসছো, ওনারা অন্য কিছু ভাবতে পারেন। এসব নিয়ে রাগ করোনা যেন, এডভান্স স্যরি বলে রাখলাম আমি।

চিত্রলেখা উত্তর দিল না। চুপচাপ ভেতরে প্রবেশ করলো সে। দোতলা বাড়িটার একপাশে বিশালাকার গাছ। তার নিচে বসে একজন বৃদ্ধ বাচ্চাদের সবাইকে কী যেন বলছেন। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে। চিত্রলেখা আগ্রহী দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

-ঐটা আজাদ চাচা। উনি রিটায়ার্ড শিক্ষক। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর একেবারেই একা হয়ে পড়েছিলেন। এখন এখানে তার বাচ্চার অভাব নেই।

-উনার মেয়ে?

-যার কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন, সে যৌতুকের লোভে মারধোর করতো মেয়েটাকে। রিটায়ার্ড অসুস্থ বাবাকে না জানিয়ে নিজেকেই শেষ করে ফেলে মেয়েটা। আজাদ চাচা নিজের সমস্ত টাকা সে ছেলের মুখে ছুঁড়ে মেয়ের লাশ আনেন।

চিত্রলেখা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। নিয়তি এত নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে? মানুষই বা এত পাষাণ হয় কী করে?

-এখানে সকলের জীবনের গল্পে বিষাদ মিশে আছে চিত্রলেখা তবে সে বিষাদে ডুব দিও না। তাদের আনন্দটাকে দু চোখ ভরে দেখো তবেই জীবনের আসল মানে বুঝতে পারবে।

-আমি আগে কখনো এ আশ্রমের নাম শুনিনি।

-না শোনাই স্বাভাবিক। এখানকার কথা কেবলমাত্র অসহায় মানুষ আর পথশিশুরাই জানে কারণ তাদেরই প্রত্যহ যাতায়াত এখানে। লোক কোলাহল থেকে একটু দূরেই তো জায়গাটা তাই।

-আমি তো আগে কখনো আসিনি এখানে, ওনারা রাগ করবেন কি?

-করতেই পারে, মানিয়ে নিও তুমি। এসো পাগল, ওনারা খুশি হবে।

রঙ্গন একদৌড়ে গাছের দিকে এগোলো। চিত্রলেখা রঙ্গনের পেছনে পেছনে সেদিকে চলতে লাগলো।

____________________

-তুমি আমাকে বিয়ে করে আফসোস করবে না?

-কেন? তুই রান্না করতে পারিস না বলে?

-মজা করো না সিয়াম ভাইয়া, হুটহাট বিয়ে করে পরে যদি আমরা দুজনেই আফসোস করি! আমাদের তো একটু সময় নেওয়া উচিত হতো কিন্তু সত্যি বলতে বাবাকে নিয়ে আমি খুব ভয় পাচ্ছি। তুমি বাবাকে বলো আমরা রাজি।

-শোন, বিয়ে আমরা পারিবারিকভাবেই করবো। তোকে নিয়ে রাজশাহী চলে যেতে বলছে চাচ্চু। রাজশাহীতে তো বন্ধুদের সাথে থাকি। এসব নিয়ে একটু ভাবতে হবে।

-নিচে চলো, বৃষ্টি জোরে আসছে।

সিয়াম মাথা নাড়ালো। সুবহা বড্ড সরল, কোনো প্যাঁচ ছাড়াই মনে যা ছিল বলে ফেলেছে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে সিয়ামের মনে হলো সে অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। এখন তার সামনের পথটুকু সুবহার হাত ধরে তাকে আগলে রাখার পথ। চিত্রলেখাকে হয়তো সে অনেক বেশিই ভালোবেসেছে তবে তা একতরফা। সে ভালোবাসা মনের কোনো এক কোণে চাপা পড়ে থাকুক। সুবহা তার দায়িত্ব, সুবহাকে আগলে রাখতে হবে তাকে।

-তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসতে সিয়াম ভাইয়া?

-বউ হওয়ার আগে থেকে এত জেরা? তোর প্রতি আমার অবহেলা থাকবে না সুবহা। তোর দায়িত্বটা আমার কাছে গুরুদায়িত্ব, আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করিস না। তোর খেয়াল আমি এমনিতেও রাখতে পারতাম তবে চাচ্চুর দেওয়া দায়িত্বের ভারটা অনেক বেশি। তোর মানিয়ে নিতে কষ্ট হলে দয়া করে আমার থেকে আড়াল করিস না। আমি সবটুকু মন থেকে চাই তুই ভালো থাক। তুই কিসে ভালো থাকবি তা একটু বুঝে নেওয়ার সুযোগটা আমায় দিস।

সুবহার চোখের কোণ সজল হয়ে উঠে। আসলেই তার বাবা কখনো ভুল ছিলেন না, তিনি তার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত কখনো নেননি। সিয়ামের প্রতি সুবহার হয়তো অনুভূতিরা এখনো ঘর বাঁধেনি তবে সুবহার প্রতি যে সম্মান সে সিয়ামের চোখে দেখেছে তা যথেষ্ট দুজনের একসাথে চলার পথে।

রেহানা সুলতানা শাহজাহান আলীর কেবিনের বাইরেই আছেন। তিনি এখন ঘুমাচ্ছেন। ডাক্তাররা আর কোনোভাবেই কাউকে এলাও করবেন না। একে তো হার্টের পেশেন্ট তবুও জোরাজুরিতে এলাও করেছিলেন। এখন রোগীর অবস্থা খারাপ হলে দোষ তো ডাক্তারের হবে। রেহানা বুঝতে পারছে না সে কী করবে। সিয়াম যদি সুবহাকে রাজি করাতে না পারে? মেয়েটাকে কিভাবে বাঁচাবেন তিনি? একা লড়তে পারবেন? এ শহরের আইন কি আদৌ সুবহার নিষ্পাপ অস্তিত্বটা বাঁচাতে পারবে? পারবে না! শাহজাহান আলী জানেন সেটা। জানেন বলেই সিয়ামকে বেছে নিয়েছেন তিনি। সিয়াম পরিস্থিতি বোঝে, তার মধ্যে যে দায়িত্ববোধটুকু আছে তার সর্বোচ্চ দিয়ে সে সুবহাকে আগলে রাখবে।

________________

-রঙ্গন তোমায় পছন্দ করে?

আঁতকে উঠলো চিত্রলেখা। মনোয়ারা বেগম চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে আবারো কাঁথা সেলাই করতে লাগলেন। চিত্রলেখা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রঙ্গন আছে কিনা। না নেই, ভাগ্যিস নেই!

-লজ্জা পেয়ো না মেয়ে। মনের কথা মনে চেপে রাখতে হয় না সবসময়।

-আমরা বন্ধু শুধু।

-তোমার বয়স কত?

-উনিশ।

-রঙ্গনের বাইশ। তোমরা বন্ধু?

চিত্রলেখা লজ্জা পেল। মনোয়ারা বেগম যে তাকে খোঁচা দিল তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে। যদিও সে এবং রঙ্গন আসলেই বন্ধু তবুও এ কথা অতি সহজে যে কেউ বিশ্বাস করবে তা মানার মতো নয়।

-তুমি এতো লজ্জা পেয়ো না। আমরা তো অভিজ্ঞ মানুষজন, সবকিছু বুঝি। রঙ্গন ছেলেটা বেশ অদ্ভুত। এক মুহূর্তে তোমার মনে হবে এ ছেলে শান্ত, আবার কখনো মনে হবে মারাত্মক চঞ্চল। বন্ধুদের নিয়ে কখনো মুখর আবার কখনো বন্ধুহীন নির্জীব।

-হুম অদ্ভুত।

-চলো এখন সবাই খাবার খাবে।

-এখন তো বিকেল।

-আমরা বিকেলে একসাথে বসে নানান খাবার খাই, ভারি খাবার না, হালকা কিছু। চলো আজ তুমিও উপভোগ করো।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। মনোয়ারা বেগম তাকে নিচে নিয়ে এলেন। রঙ্গন ততক্ষণে বড় একটা গামলাতে মুড়ি মেখেছে, আশেপাশে আরো কিছু ভাজা খাবারদাবার রয়েছে। মানুষের সংখ্যা বেশি না এখানে। কুড়ি-পঁচিশজনের মতো। সকলে একসাথে গোল হয়ে বসেছে। মনোয়ারা চিত্রলেখাকে নিজের পাশে বসালেন। রঙ্গনও কিছুক্ষণ পর চিত্রলেখার পাশে এসে বসলো।

-খুব বেশি সময় ব্যয় করে ফেললাম বোধহয়।

-কিছু সময়ের হিসাব রাখতে হয় না।

-তোমার হোস্টেলে ফিরতে হবে তো! আমরা একটু পরেই উঠবো কিন্তু।

চলে যাওয়ার কথা শুনে চিত্রলেখার মনটা অল্প হলেও খারাপ হলো। বাচ্চাদের সাথে কিছু মুহূর্ত অতঃপর পড়ন্ত বেলায় সবার হাসিমুখ- সবকিছু তাকে মুগ্ধ করছে। এ মুহূর্ত ফেলে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না তার কিন্তু যেতে তো হবেই।

চিত্রলেখার হোস্টেলে ঢোকার লাস্ট টাইম সন্ধ্যে সাতটা। এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। সকলের থেকে বিদায় নিতে নিতেই মিনিট দশেক লেগেছে। রঙ্গন আশ্রম থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তার দিকে হাঁটছে।

-এটুকু হাঁটতে হবে, অসুবিধা হবে তোমার?

-না।

-তো সময় খারাপ গেল?

-না, এতটা ভালো সময় শেষ কবে কাটিয়েছি তাই মনে পড়ছে না। ধন্যবাদ আপনাকে।

-তোমায় কিছু কথা বলা বাকি আমার।

-কী কথা?

-তার জন্য আরেকদিন সময় নিব, ঐ বিলের পড়ে পা ভিজিয়ে বসে বলবো।

চিত্রলেখার মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন স্পষ্ট চোখে পড়লো রঙ্গনের। সন্ধ্যের আলো আঁধারিতে চিত্রলেখার মুখের সে চিহ্ন যেন জ্বলজ্বল করছে। রঙ্গনের ডুবে যেতে ইচ্ছে করলো চিত্রলেখার চোখের চাহনিতে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে