#চিত্রলেখার_কাব্য
ঊনবিংশ_পর্ব
~মিহি
চিত্রলেখা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। ক্রমাগত নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। ভয়ে এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে ছিল। কিছু মুহূর্ত এতটা স্মরণীয় হতে পারে তা সে কখনো ভাবেনি। হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসতেই ফোনটা বেজে উঠলো। চিত্রলেখা রিসিভ করলো তড়িৎ গতিতে।
-ঠিকঠাকভাবে পৌঁছেছো?
-হুম।
-আচ্ছা ঘুমাও। অনিক ভাইয়ার বেইল করা হয়েছে?
-না, কিছু জটিলতা আছে।
-আচ্ছা চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
-হুম। আপনি ফিরেছেন বাড়িতে?
-না। এখন গেলে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাবা শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে বই-টই পড়েন। একেবারে সকালে বাবা অফিসে গেলে বাড়িতে ঢুকবো।
– আপনি কোথায় থাকবেন আর বাইক কোথায় রাখবেন রাতে?
-বাইক বন্ধুর, ওকে সকালে ফেরত দিয়ে দিব। এখন আমি আর বাইক আরো কিছু মুহূর্ত উপভোগ করবো। তুমি ঘুমাও। টা টা।
চিত্রলেখার ফোন রাখতে ইচ্ছে করলো না তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় জানালো। কণ্ঠে নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট।
-তুমি কি আরো কিছুক্ষণ কথা বলতে চাইছো?
-ন..না তো।
-সত্যি?
-হ্যাঁ।
-তার মানে কথা বলতে চাও আরো?
-কখন বললাম?
-এই তো হ্যাঁ বললে।
-সেটা তো সত্যির জন্য বললাম।
-তার মানে আগেরবার মিথ্যে বলেছিলে!
-ধূর! কথার প্যাঁচে ফেলছেন।
-আচ্ছা স্যরি। মজা করছিলাম। তোমার ঘরের পিছনের জানালাটা রাস্তার উল্টো পাশে হওয়ায় ভালো হয়েছে। এদিকে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ টের পাবে না।
-মানে?
-পিছনের জানালাটা খোলো বোকা মেয়ে।
চিত্রলেখা দ্রুত জানালাটা খুললো। এ জানালা সবসময় বন্ধ থাকে। জানালাটা খুলতেই ক্যাচ ক্যাচ ধরনের একটা শব্দ হলো। চিত্রলেখা ভয়ে আঁতকে উঠলো। নিস্তব্ধ পুরীতে শব্দটা যেন আতঙ্কের ন্যায় শোনালো। জানালার নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গনের হাস্যোজ্জল চেহারা মুহূর্তেই তাকে আতঙ্ক ভুলিয়ে দিল।
-কী ম্যাম? শকড?
-না, সারপ্রাইজড যে এখনো যাননি!
-নিশ্চিত হলাম যে তুমি ঠিকমতো ফিরেছো।
-এখন তবে চলে যান।
-বিদায় করার সবচেয়ে কঠোর তরিকা ব্যবহার করলে! একটু ভালোমতোও বলতে পারতে, এভাবে অর্ধচন্দ্র দেখিয়ে বিদায় করা ঘোরপাপ।
-আপনি কি লিটারেচারের স্টুডেন্ট? এত ড্রামাটিক কথা কী করে বলেন?
-আমি এমনই। তুমিও আমার সাথে বেশি বেশি মেশার চেষ্টা করো, দেখবে মুখের ম্লান ভাব কমবে।
-একটু পর আযান দিবে, যাতায়াত বাড়বে এ রাস্তায়। এখন আপনার যাওয়া উচিত।
-আচ্ছা নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ।
চিত্রলেখা বিদায় জানিয়ে কল কাটলো। বিছানায় বসতেই যেন জগতের সমস্ত ঘুম তার চোখে নেমে এলো। ঘুমে চোখই খুলতে পারলো না সে।
________________
হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভাঙলো চিত্রলেখার। লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে। ফোনে সময় দেখলো। নয়টা বাজে। মাথায় হাত দিয়ে বসলো সে! নির্ঘাত বড় ভাবী চেঁচামেচি করছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলো সে। বাইরের পরিবেশ আশঙ্কাজনক। অর্ণব চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। অপর্ণা রান্নাঘরে কিছু একটা করছে আর সমানে চেঁচাচ্ছে। চিত্রলেখাকে দেখে তার রাগের মাত্রা আরো বাড়লো।
-এসেছে মহারানি! তো রানীসাহেবা, শাহী ভোজ আনি আপনার জন্য? জমিদারের ঘরে জন্মাইছেন, কাজ কামে তো মন থাকবে না। হোস্টেলে থেকে এখন নিজের বাড়িতে রান্নাও করতে মন চায় না?
-স্যরি ভাবী, তুমি সরো আমি করছি।
-কী এমন রাজকার্য করছিস রাতে যে ন’টা অবধি ঘুমাস? খুব ভাব হইছে সবার! একজন দরজা লাগায়ে বসে আছে কাল থেকে, আরেকজন ঘুমাচ্ছে! সব আমার করা লাগে!
চিত্রলেখা অবাক হলো। সাথী এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কখনোই থাকেনা।
-ভাইয়া, ছোট ভাবী তো এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কখনো থাকেনি। একটু দেখবে?
-হ্যাঁ চল! আমিও অনেকক্ষণ দেখিনি ওকে।
চিত্রলেখা অর্ণবকে সাথে করে সাথীর দরজার বাইরে দাঁড়ালো। দরজায় বার কয়েক শব্দ করলো।
“ভাবী? দরজা খোলো!” অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরেও সাড়াশব্দ না পেয়ে চিত্রলেখার মনে ভয় ঢুকলো। সে অর্ণবকে বললো দরজা ভাঙতে। অর্ণবেরও মনে হলো এছাড়া উপায় নেই। অপর্ণা ভ্রু কুঁচকে কেবল দৃশ্রগুলো অবলোকন করছে। অর্ণব সজোরে দরজার দিকে এগোতে যাবে এমন সময় সাথী দরজা খুললো। সাথীর চোখেমুখে রক্তিম আভা। চিত্রলেখা সাথীর এ রূপ দেখে ভয় পেল।
-ভাবী কী হয়েছে তোমার? এমন লাগছে কেন তোমাকে?
-আমি কি খুব দুর্বল লেখা? আমার সহ্যক্ষমতা নাই? আমার স্বামীর এ পরিস্থিতিতেও আমি ধৈর্য রেখেছি। আর কী চাস তোরা আমার থেকে? আমার স্বামী হসপিটালাইজড, কথাটা জানলে কি আমি নিজেকে শেষ করে ফেলতাম? অনিকের অসুস্থতায় ওর পাশে থাকার অধিকার আমার নাই?
-ভাইয়া হসপিটালাইজড! মানে? কেন? কী হয়েছে ভাইয়ার?
-সেটা তোর বড় ভাইয়া বলতে পারবে। অর্ণব ভাইয়া, হসপিটাল থেকে কল করে আপনার নম্বরে যোগাযোগ করতে না পেরে আমাকে কল করেছিল। অনিকের সকালে জ্ঞান ফিরেছে। আমি এতটা দুর্বল নই ভাইয়া যতট আপনি ভেবে নিয়েছিলেন। দয়া করে পরেরবার আমার স্বামী সংক্রান্ত কিছু আমার থেকে লুকোবেন না।
সাথীর শান্ত কথায় অর্ণব মাথা নত করলেও অপর্ণার মনে যেন আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে।
-তোর স্বামী হওয়ার আগে সে আমার স্বামীর ভাই! নিজের ভাইয়ের জন্য চিন্তা করা ভুল নাকি? অর্ণব ঠিকই করেছে। আমার স্বামীকে দোষারোপ করা বন্ধ কর।
-আমি দোষ দিচ্ছি না ভাবী, শুধু আমার মনের কথাটা বলেছি।
-তুই স্পষ্টত আমার স্বামীকে অপমান করেছিস!
সাথী চুপ করলো। এ মুহূর্তে অপর্ণার সাথে ঝগড়া করার সময় তার নেই। হসপিটালে যেতে হবে তার। অর্ণব এ মুহূর্তে নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারলো না। অপর্ণার দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকালো সে।
-নারীজাতির প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান। তুমিও সেই নারীজাতির অন্তর্ভুক্ত। নিজের ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিজেকে আরো নীচ প্রমাণ করার চেষ্টা না করলেও চলবে।
অপর্ণা রাগে জ্বলে উঠলো কিন্তু অর্ণব সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে চুপচাপ সাথীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরোলো। চিত্রলেখা তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। অপর্ণার রাগ সরাসরি চিত্রলেখার উপরেই পড়লো।
-তুই ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো নাটক দেখছিস কেন?
– গৃহপালিত ছাগলের বাচ্চা তো তাই কখনো বনের গাধার হাঁকডাক দেখিনি। তাই দেখছিলাম আর কী!
বলেই আর সেখানে দাঁড়ালো না চিত্রলেখা। একদৌড়ে রান্নাঘরে জুট লাগালো। যতক্ষণে অপর্ণা চিত্রলেখার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছে, ততক্ষণে সে আর তার হাতের নাগালে নেই। অপর্ণা রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরের দিকে এগোলো।
_____________
অনিকের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে উন্নত। কেস কোর্টে যেতে আর চারদিন সময় আছে। অনিককে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করবে আজ তবে তার সাথে সর্বদা একজন পুলিশকে রাখা হবে কেননা বিষয়টা এখন সাধারণ কেইস থেকে তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে পৌঁছেছে। অনিককে ইতোমধ্যে জব থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সাথীকে হাসপাতালে দেখামাত্র অনিক কান্নায় ভেঙে পড়লো। পুরুষ মানুষের কান্না নাকি দুর্লভ অথচ অনিক মনের সমস্ত যন্ত্রণা অবাধে কিছু অশ্রুকণা দ্বারা সাথীর নিকট প্রকাশ করলো। সাথী চুপচাপ অনিকের বুকে আলতো করে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বুঝিয়ে দিল সে সবসময় তার পাশে আছে।
“তোমার সত্যটা আমি জানি। যদি নিজেকে বাঁচাতে চাও, চুপচাপ তিন লাখ টাকা আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। ভুলেও পুলিশকে হাবিজাবি বোঝানোর চেষ্টা করো না। তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণও আছে আমার কাছে। টাকা নিয়ে জায়গামতো এসো, নিজের বাঁচার প্রমাণ নিয়ে দূর হও।” মেসেজটা দেখামাত্র দীতির পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গেল। ভয়ে নখ কামড়াতে লাগলো সে। স্বভাবতই সে ভীতু। অনিককে ফাঁসানোর সাহসও তার মধ্যে ছিল না। দীতির ভয় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। দীতির সত্য কে জানতে পারলো? এটা তো দীতি নিজের সহযোগীকেও জানানোর সাহস পাচ্ছে না। সে যদি জানে তবে সর্বপ্রথম দীতিকে মেরে ফেলবে। একটা টেক্সট দীতির পুরো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেছে!
চলবে…
#চিত্রলেখার_কাব্য
বিংশ_পর্ব
~মিহি
চিত্রলেখা ছাদের প্রাচীরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মাঝে মাঝে তার ওষ্ঠজোড়ার ফাঁকে শিসের ন্যায় শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথী তার সামনে বসে। চিত্রলেখার এমন রহস্যময়ী রূপ আগে দেখেনি সে।
– তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারোনি ভাবী?
– তুই কাউকে না জানিয়ে এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ একা কেন করতে গিয়েছিস? তাছাড়া দীতির পরবর্তী পদক্ষেপ আমরা জানবো কী করে?
– আমি যতদূর জানি দীতি একা এসব করেনি। হয় সে নিজের সহযোগীর সাহায্য নিবে অথবা আমাদের আগে কল করবে। দেখা যাক কোন জুয়াটা সে খেলে!
– ওর উপর নজর রাখাটা দরকার।
– পুলিশের সহায়তা নেওয়া যাবে না। তৌহিদ ভাইকে বললে কাজ হবে বোধহয়।
– তুই কোথায় ডেকেছিস দীতিকে?
– এখনো ডাকিনি। আগে তৌহিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ভাইয়াকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করলো না?
– শরীরের আবার অবনতি হয়েছে। অনিক প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব পুলিশি অত্যাচার ওকে পুরোপুরি শেষ করে দিচ্ছে লেখা।
– চিন্তা কোরো না ভাবী, আমি এখনি বের হচ্ছি। তৌহিদ ভাইকে কল করে কোথাও আসতে বলছি। বাসায় ডাকা যাবে না, অপর্ণা ভাবী চেঁচামেচি করতে পারে অযথা। তুমিও যাবে আমার সাথে।
– তুই আগে বের হ, আমি একটু পরে যাবো। তোর বড় ভাবীর মতো মানুষকে আমি এতদিন শ্রদ্ধা করে আসছি! এখন আমার খারাপ সময়েও তার ব্যবহার জঘন্য। তুই বাড়ি ছাড়লি ঐ মহিলার জন্য! তোর কি মনে হয় আল্লাহ এসব দেখতেছে না?
– ভাবী শান্ত হও। আমি বের হচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো, আমি মেসেজ করে জানাবোনি জায়গার কথা।
সাথী মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। চিত্রলেখা নিচে নামলো। অপর্ণা নেই আশেপাশে। চটজলদি বোরকা পড়ে নিল সে। অপর্ণার চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত বেরোল।
তৌহিদের পরিচিত একটা ক্যাফেতে বসেছে তারা। চিত্রলেখা ইতোমধ্যে সাথীকে জানিয়েছে জায়গার কথা। তৌহিদ চিত্রলেখার কথা এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো।
– চিত্রলেখা, তুমি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছো! তবে এখনো সবটা ঠিক করা যাবে। কোর্টের ডেইটের আগে দুদিন সময় আছে হাতে। আমি আজকেই দীতির পেছনে একটা গোয়েন্দা লাগানোর ব্যবস্থা করছি। আগামীকাল বিকালে তুমি ওকে দেখা করতে ডাকো। এই ক্যাফের পেছন পাশে একটা পরিত্যক্ত বাড়ির মতো আছে। ঐখানেই আসতে বলবে।
– আচ্ছা ভাইয়া।
আচমকা চিত্রলেখার ফোনটা বেজে উঠলো। চিত্রলেখা স্ক্রিনে রঙ্গনের নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকালো। এ সময় রঙ্গনের কল? তৌহিদ ভাইয়ের সামনে কলটা রিসিভ করা মোটেও উচিত হবে না। কল কেটে দিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করলো সে।
– কার কল? রিসিভ করো!
– কলেজের ফ্রেন্ড। রিসিভ করলে অযথা গল্প শুরু করবে। ভাবী যে কেন আসছে না এখনো!
– একটু বসো, আমি কফি আনছি। এর মধ্যে হয়তো ভাবীও চলে আসবে।
চিত্রলেখা হালকা হেসে সম্মতি জানালো। রঙ্গন চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যগুলো দেখলো। চিত্রলেখার ঠোঁটের হাসি আর খুব সন্তর্পণে তার কল ইগনোর করা! রঙ্গন অনুভব করতে পারলো চিত্রলেখার জীবনে আসলে তার কোনো জায়গাই নেই। সে কাছের বন্ধুও নয় চিত্রলেখার। এক মুহূর্তের জন্য তৌহিদ নামক মানুষটার উপর রঙ্গনের ক্রোধ যেন আকাশ ছুঁলো। সেখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না রঙ্গনের। দ্রুত ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল সে।
_________________
বিকেলের দিকে আশফিনা আহমেদ ফিরলেন। রঙ্গনকে দেখে তিনি অবাক হলেন না তবে তার চোখেমুখে কাঠিন্য স্পষ্ট।
– মা কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা?
– সাথীর ডিভোর্সের জন্য বড় ভাইয়া উঠে পড়ে লেগেছে তবে আমার মনে হচ্ছে অনিক নির্দোষ। যতই ঐ ফ্যামিলিকে দোষারোপ করি, সাথী অনিককে ছাড়া থাকতে পারবেনা এটাও সত্য।
– এখন?
– এখন আবার কী? জোর জবরদস্তি করে কী আর করতে পারবে?
– তুমি মামাকে সাহায্য করতে চাচ্ছো?
– নাহ! যখন বিয়ের সময় আটকেছিলাম তখন তারা আমার কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। এখন তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার হস্তক্ষেপ ঘটবে না।
আশফিনা আহমেদ আর কথা বাড়ালেন না। নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। রঙ্গন মাঝেমধ্যে অবাক হয় নিজের মায়ের একেক রূপ দেখে। সব রূপেই একটা বস্তু কমন, তার প্রগাঢ় আত্মসম্মানবোধ! তার মায়ের মতো আত্মসম্মানবোধ সে তার পরিবারে অন্য কারোর দেখেনি। রঙ্গন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ঠিক সে সময় অহম এসে পথ আটকালো তার।
– তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো ভাইয়া!
– নাহ! পালাবো কেন? তোর না পরীক্ষা চলছে? তাই বিরক্ত করছি না।
– ওহ! ভালো, সবাই আমাকে একা করে দাও।
– ছ্যাঁকা খাওয়া কথাবার্তা বলছিস কেন?
– কারণ আমি ছ্যাঁকা খাইছি। আমার গার্লফ্রেন্ডটা যে আস্ত গাধা! যে যা বলে বিশ্বাস করে ফেলে। একটা সম্পর্কে যদি আমার উপর তার বিশ্বাসই না থাকে, তবে সম্পর্ক কী করে টিকবে বলো তো!
রঙ্গনের কানে অহমের বলা কথা বাজতে থাকলো। সেও তো চিত্রলেখাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে কিন্তু তার আর চিত্রলেখার মধ্যে আদতে কোনো সম্পর্ক নেই যার ভিত্তিতে সে কিছু বলতে পারবে। ছেলেটা সত্যিই চিত্রলেখার খুব কাছের কেউ হতে পারে। যদি সত্যি তাই হয় তবে চিত্রলেখা কেন তার সাথে সময় কাটাতে রাজি হলো? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে রঙ্গনের মাথায়। সরাসরি চিত্রলেখাকেই প্রশ্ন করবে সে! অহম উদাসী মন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়েছে ততক্ষণে। রঙ্গনও এগোলো ছাদে যাওয়ার জন্য।
ক্যাফে থেকে বাড়িতে ফিরেই রঙ্গনকে কল করলো চিত্রলেখা। রঙ্গন রিসিভ করলো একটু পরেই।
– কল করেছিলেন যে?
– হুম। ব্যস্ত ছিলে?
– একটু।
– কোথাও গিয়েছিলে?
– হ্যাঁ, এক বন্ধুর সাথে বেরিয়েছিলাম।
– ওহ।
রঙ্গনের আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। ছেলেটা তবে সত্যিই চিত্রলেখার বন্ধু কিন্তু আদতে এটা বন্ধুত্ব নাকি অন্যকিছু? রঙ্গন কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। চিত্রলেখার উপর তো তার কোনো অধিকার নেই তবে চিত্রলেখার জীবনে কেন সে অধিকার ফলাতে চাইছে? নিজের প্রশ্নে নিজেকেই জড়িয়ে ফেলছে সে।
– আর কিছু বলবেন?
– না!
রঙ্গন আচমকাই কল কাটলো। চিত্রলেখার কণ্ঠস্বরও তাকে দগ্ধ করছে। অদ্ভুত এক আকুতি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে যেন! কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছেনা সে।
___________________
দীতি কী করবে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। তার কাছে আবারো টেক্সট এসেছে। টাকা নিয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে তাকে। দীতি এখন অবধি নিজের সহযোগীকে কথাটা জানায়নি। জানলে লোকটা তাকে মেরেই ফেলবে! দীতি লোকটার থেকে প্রায় দশ লাখ টাকা নিয়েছে। সেখান থেকে লাখ তিনেক টাকা নিয়ে এসব চাপা রাখতেই হবে। দীতির ভয় কোনভাবেই কমছে না। অনিককে ফাঁসানোটা সহজ ছিল বোধহয় তাকে এই কাজটা দেওয়া হয়েছিল। অনিকের ফোন ব্যবহার করাটাও কঠিন ছিল না। প্যাটার্ন সিম্পল, আইডি ব্যবহার করতেও অসুবিধা হয়নি। কাজ শেষ করে সমস্ত প্রমাণ অনিকের আইডি থেকে ডিলিট করাটাও কঠিন ছিল না কিন্তু অসুবিধেটা অনিক বাঁধালো দীতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
____________________
চিত্রলেখার অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত এ অশান্তির কারণ দীতিকে নিয়ে ভয় নাকি রঙ্গনের কারণে বুঝতে পারছে না সে। রঙ্গনের কথার ধরন তাকে পীড়া দিচ্ছে। চিত্রলেখা বুঝতেও পারছে না রঙ্গনের হঠাৎ কী হলো! চিত্রলেখা রঙ্গনকে কল করবে ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। ‘ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ সমস্যাটা তার বেশ পুরনো। এ মুহূর্তে রঙ্গনকে কল করার সাহসও তার হচ্ছে না। বারংবার মনে হচ্ছে রঙ্গনের সাথে এ ঘনিষ্ঠতা তার জন্য সঠিক নয়। এ ঘনিষ্ঠতার পরিণতি কী? রঙ্গন কি কেবল তাকে বন্ধুই মনে করে? অজস্র প্রশ্ন মনে, উত্তর চাওয়ার সাহস করতে পারছে না সে।
দু প্রান্তে দুজন, একই মুহূর্তে অলস ভঙ্গিতে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে অজস্র প্রশ্নের ভীড়ে নিজেদের নাম না জানা সম্পর্কের উত্তর তালাশ করে বেড়াচ্ছে।
চলবে…