#চিত্রলেখার_কাব্য
পঞ্চদশ_পর্ব
~মিহি
“আমরা অনিক মাহমুদের সাথে দেখা করতে চাই। তার উপর এটেম্পট টু রেপের চার্জ আছে। তিনি একজন মেয়েকে মলেস্ট করার ট্রাই করে পালিয়ে এসেছেন।” অফিসারের কথাটা সাথীর কানে ভ্রমরের ভোঁ ভোঁ শব্দের ন্যায় ধাক্কা দিল। এক মুহূর্তে বাড়ির পরিস্থিতি বদলে পরিণত হলো সঙ্কটারণ্যে।
অনিক চমকে তাকালো সাথীর দিকে। মেয়েটার চোখে কি অবিশ্বাস দেখা যাচ্ছে? অনিক আচমকা সাথীর দুহাত চেপে ধরলো। অনিকের চোখ ছলছল করছে।
-সাথী বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু করিনি।
-আমি বিশ্বাস করি তোমাকে। পুরো পৃথিবী তোমার বিপক্ষে থাকলেও আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো।
“আপনাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্যাচাল পরে হবে। আপনি চলুন আমাদের সাথে।” বলেই অনিককে আর সময় দিলেন না পুলিশ অফিসার । অনেকটা টেনেই নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসালেন। অন্তরের বাবা মা তখনো সেখানে উপস্থিত। সুযোগটা হারালো না তারা, অপমানের প্রতিদান দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে বলে কথা।
-যেমন পরিবার, তেমন শিক্ষা! ভাই আরেকজনের ইজ্জত কেড়ে পালিয়ে আসে, তার বোন আবার কেমন হবে? দেখা যাবে বিয়ের পর আমার ছেলেকে লুকিয়ে আরেকজনের সাথে…
-আমার বোনের চরিত্রে আঙুল তোলার আগে নিজেদের পারিবারিক শিক্ষার দিকে নজর দিন এবং সম্মানসমেত বের হোন।
চিত্রলেখা অর্ণবকে আটকানোর চেষ্টা করলো। এখন এসবের সময় নয়। আজ শুক্রবার। রবিবারের আগে বেইল করানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাস্তবতা বুঝে বিবেচনা করতে হবে তাদের।
-আমরা কি পুলিশ স্টেশনে যাবো না?
-সাথী, শান্ত হও। আমি যাচ্ছি পুলিশ স্টেশনে। আমি কথা বলে আসি।
-ভাইয়া আমিও যাবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে, চলো। বাকিরা বাড়িতে থাকো।
সাথী অর্ণবের কথায় সায় দিল। মনে মনে প্রচণ্ড ভেঙে পড়লেও সে প্রকাশ করছে না। নিজেকে শক্ত রেখেছে সে। সাথী অনিককে অবিশ্বাস করেনা। অনিক আর যাই করুক কখনো কোনো মেয়ের সভ্রমে আঘাত হানার মতো অন্যায় করতে পারেনা।
_______________
পুলিশ স্টেশনের পরিবেশের সাথে ঠিকমতো পরিচিত নয় সাথী, অর্ণবও বেশ অপ্রস্তুত। দায়িত্বরত অফিসারের ব্যবহার যথেষ্ট রূঢ় মনে হচ্ছে তবুও অর্ণব গেল কথা বলতে।
-স্যার আমার ভাই অনিক মাহমুদকে একটু আগে এটেম্পট টু রেপ কেসে এরেস্ট করা হয়েছে। আমরা তার সাথে দেখা করতে চাই।
-উকিল ছাড়া দেখা করতে পারবেন না। কেস যথেষ্টই সিরিয়াস, ভিক্টিম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
-প্রমাণাদি ছাড়া শুধুমাত্র কথার ভিত্তিতে আপনি কিভাবে একজন মানুষকে জেলে ঢোকাতে পারেন?
-আইন শেখাচ্ছেন? ভিক্টিম নিজে সাক্ষী দিয়েছে, আপনার ভাই তাকে ফোনে আজেবাজে মেসেজ করতো সেসব দেখিয়েছে। আপনার ভাইয়ের এ শহরে আসার আগে লাস্ট লোকেশন মেয়েটার বাড়িতে। আরো কোনো প্রমাণ দরকার?
-আমরা ওর সাথে দেখা করতে চাই অফিসার, প্লিজ।
-একজনকে এলাও করতে পারবো। যেকোনো একজন যান।
সাথী করুণ দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব না বলতে পারলো না। সে সাথীকেই ভেতরে যেতে বললো। সাথী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কনস্টেবলের সাথে ভেতরে গেল।
সাথীকে দেখে অনিক একটু হলেও প্রাণ ফিরে পেল। সাথী এগিয়ে আসতেই সে সাথীকে জড়িয়ে ধরলো। চোখ বেয়ে অশ্রুকণা বেহিসেবি গতিতে ঝরে পড়ছে।
-অনিক, তুমি চিন্তা কোরো না। কী হয়েছে আমাকে সবটা বলো।
-আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা সাথী। আমার পি.এস দীতি করেছে এসব।
-ও কেন করছে এসব অনিক?
-এটা তোমাকে আগেই বলা উচিত ছিল, স্যরি সাথী। আমি যা বলছি শোনো এবং প্লিজ আমাকে বিশ্বাস কোরো।
-আমি কখনোই তোমাকে অবিশ্বাস করিনা। তুমি বলো কী হয়েছে।
-দীতি নতুন হওয়াতে ওকে মোটামুটি সব কাজ আমাকেই শেখাতে হতো। আর শেষ দুই মাসের ব্যস্ততা তোমাকে বলেছিলাম। মিটিং আর কাজের চাপে বাসায় আসার সময়টুকু পেতাম না। আর মিটিংয়ের সময়টুকু আমার ফোন ওর কাছে থাকতো। আমি জানতাম না ও আমার ফোন থেকে আমার ইমেইল মিসইউজ করতো। অফিসের দরকারি তথ্যগুলো ও অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রি করতো। এটা আমি জানতে পারি গত সপ্তাহে। আমি ভেবেছিলাম আগে ওর সাথেই এটা নিয়ে কথা বলবো।
-আর ও এজন্য তোমাকে বাড়িতে ডাকে?
-হ্যাঁ কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ও সব অস্বীকার করে, এমনকি আমার কাছে তখন কোনো প্রমাণ নেই কেননা ও আমার ফোন ব্যবহার করতো। ও আমাকে হুমকি দেয়। আমি কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। তাই আমি বসের কাছে ছুটির মেইল করে এখানে আসি। আমি ভুলেও ভাবিনি ও আমার উপর এরকম একটা মিথ্যে মামলা চাপিয়ে দিবে। এমনকি আমি চলে আসার পর ও আমার ইনবক্সে উল্টোপাল্টা মেসেজ, নিজের ছবি পাঠিয়েছে। আমি বিরক্ত হয়ে ব্লক করে দিয়েছিলাম ওকে।
-বুঝতে পেরেছি।
-তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছো না তো সাথী?
-না অনিক, তোমার উপর আমার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে। আমি সত্যিটা জেনেই ছাড়বো। তুমি শুধু একটু ধৈর্য রেখো।
অনিকের চাহনি বলে দিচ্ছে সে কতটা অসহায় অনুভব করছে। কনস্টেবল আর সাথীকে থাকতে দিল না। অনেক সময় হয়ে গিয়েছে বিধায় তাকে বের হয়ে যেতে হলো। অর্ণব বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সাথী তৎক্ষণাৎ কিছু বললো না। পুলিশ অফিসার তাদেরকে আর কিছু বললেন না। সাথী এবং অর্ণব বেরিয়ে আসলো।
-ভাইয়া, আজ তো বেইল করার উপায় নাই।
-তুমি বাসায় যাও। আমার এক বন্ধুর ভাই আছে, ও জুনিয়র উকিল। ওর সাথে পরামর্শ করে দেখি আমি। যেতে পারবে?
-হ্যাঁ ভাইয়া। পারলে উকিল নিয়ে বাসাতেই আসুন। অনিক আমাকে যা যা বলেছে, সেসব উকিলেরও জানা দরকার।
-আচ্ছা।
______________
সাথী বাসায় এসে নিজের ঘরে ঢুকলো। অপর্ণা এখন পর্যন্ত সাথীর সাথে এ বিষয়ে কথা বলেনি। তবে অপর্ণার বাড়ির লোকজনকে ইতোমধ্যে সে সবই জানিয়েছে। সাথীর বাড়ির লোকজন এখন পর্যন্ত কিছু জানে না। জানলে কী হবে সেটা ভেবেও ভয় পাচ্ছে সে।
অর্ণব উকিল নিয়ে আসলো বিকেলের পর। সাথী যা যা জানতো সবটাই জানালো। উকিলের নাম তৌহিদ। বয়সে যুবক, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। সে মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো এবং সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য কিছুটা সময় চাইলো। অর্ণব কথাবার্তা শেষ করে তাকে বিদায় জানালো।
ঝামেলার সূচনা হলো সন্ধ্যের পরপর। সাথীর মা তার ফুপু আশফিনা আহমেদকে সাথে করে নিয়ে আসলেন। বাড়ির পরিবেশ তখন থমথমে। আশফিনা আহমেদ সোজা গেলেন সাথীর সাথে কথা বলতে। অর্ণব কিংবা বাড়ির অন্য কোনো সদস্যদের তিনি কোনোরকম পাত্তা দিলেন না। সোজা সাথীর পাশে বসলেন।
-সাথী, তুই এখনি কাপড়-চোপড় নিয়ে চল।
-ফুপু, কোথায় যাবো আমি?
-নিজের বাড়িতে। আমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবো। তুই ওই ছেলেকৈ ডিভোর্স দিবি যত দ্রুত সম্ভব।
-আমি এটা কখনোই করবো না। তোমরা যদি আমাকে জোর করার চেষ্টা করো আমি বিষ খেয়ে মরে যাবো। মা, তুমি কেমনে পারলা নিজের মেয়ের এ সময়ে তাকে এরকম পরিস্থিতিতে ফেলতে?
-সাথী, তোর মাকে দোষারোপ করবি না অযথা। তোর স্বামী যা করেছে, এরপর আমি কোনোভাবেই তোকে এখানে রাখতে পারবো না। যার বাবার রক্তেই সমস্যা, সে কিভাবে ভালো হবে?
-ফুপু, তুমি যাও দয়া করে। আমাকে দয়া করো তোমরা। আমাকে আমার সংসারটা বাঁচাতে দাও। তোমরা প্লিজ চলে যাও।
কথাগুলো বলে একদণ্ড দাঁড়ালো না সাথী। ছুটে গিয়ে বাথরুমে নিজেকে আটকে ফেললো। আশফিনা আহমেদ বাইরে থেকে চেঁচামেচি করলেও ভেতর থেকে সাথী কিছুই বললো না। শেষমেশ তিনি বিরক্ত হয়ে সাথীর মাকে নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে কেবল একবার অগ্নিদৃষ্টিতে চিত্রলেখাকে দেখে গেলেন। চিত্রলেখা তাতে প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে কেবল নিজের ভাবীর কথা ভাবছে। একজন মানুষ কতটা শক্ত হলে এমন পরিস্থিতিতেও নিজেকে এভাবে সামলাতে পারে? এ পরিস্থিতিতে কতজন স্ত্রী পারবে নিজের স্বামীর প্রতি বিশ্বাস রাখতে?
চলবে…
#চিত্রলেখার_কাব্য
ষোড়শ_পর্ব
~মিহি
রঙ্গন এসেছে মিনিট দশেক হয়েছে কেবল। নির্বাচনের ঝামেলার কারণে তার পরীক্ষা দেড়মাস পিছিয়েছে, ক্লাসও বন্ধ। ভেবেছিল এখানে এসে সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে কিন্তু এখন সে নিজেই সারপ্রাইজড। ফুপাতো ভাই হিসেবে সাথীর সাথে রঙ্গনের বিশেষ সখ্যতা নেই। রঙ্গন বরাবরই শহরেই বড় হয়েছে, নানিবাড়িতে খুব কমই যাওয়া হয়েছে তার। কিন্তু সাথীর সাথে জুড়ে থাকা আরেকটা নাম চিত্রলেখা। রঙ্গন সাথীর কথা জানতে পারার পর থেকেই খানিকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। তারপর যখন শুনলো তার মা তার মামীসমেত সাথীকে জোর করে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনার চেষ্টা করেছে, এতে সে আরো উদাস হয়ে পড়লো।
-রঙ্গন, তোর মা কল করেছিল। সাথী আসেনি, এখন ও সাথীর মাকে নিয়ে ও বাড়িতেই আছে।
-সাথী আপু যখন আসবেই না, তখন তাকে জোর করে লাভ কী বাবা?
-সেটা তোর মা বুঝলে তো হতোই। এ বিয়েটা শুরু থেকেই মানেনি সে, এমনকি বাড়ির প্রতিটা সদস্যকে অপছন্দ করতো সে। চিত্রলেখা এখানে আসাতে তার প্রতি তোর মায়ের অপছন্দ বেড়েছে। এখন সুযোগ পেয়েছে নিজেকে সঠিক এবং সাথীর বরকে ভুল প্রমাণ করার। এ সুযোগ সে কী করে ছাড়বে সে?
-ও বাড়িতে তাহলে যাওয়া উচিত বাবা।
-রঙ্গন, তুমি এসব থেকে দূরে থাকো।
-কিন্তু বাবা…
-যা বলছিলাম করো। বাইরে থেকে এসেছো, যাও ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।
রঙ্গন কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে এগোল। বাড়ির পরিবেশ বেশ শান্ত। নির্ঘাত অহম ঘুমিয়েছে। রঙ্গন ঘরে ঢুকেও স্বস্তি পেল না। চিত্রলেখার জন্য মন কেমন করতে থাকলো তার। অদ্ভুত রকমের অস্বস্তিতে তার আর খাওয়াও হলো না রাতে।
ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা। সাথী নিজের ঘরে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করছে। অপর্ণা, অর্ণব ঘুমিয়েছে। চিত্রলেখা নিজের ঘরে বসে সাথীর কথা ভাবছে। অনিকের থেকে যথাযথ স্নেহ না পেলেও সে তাকে সর্বদাই সম্মান করে এসেছে কিন্তু গতদিন নিজের ভাইয়ের মেসেঞ্জারে আসা ছবিটা তার মনে সন্দেহ বাড়িয়ে তুলেছে। তার মনে ভয় হয় কেবল নিজের ভাবীকে নিয়ে। যে মানুষটা প্রেমের টানে নিজের পারিবারিক সুখ বিসর্জন দিয়ে এসেছে, সে যেন দিনশেষে কষ্ট না পায়। চিত্রলেখার ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। রঙ্গন কল করেছে। চিত্রলেখা কল রিসিভ করবে কিনা ভেবে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করলো। ঘরের দরজা লাগানোই আছে তবে শব্দ বাইরে যেতে পারে ভেবে সে শীতের মধ্যেও ফ্যানের সুইচ অন করলো।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো চিত্রলেখা?
-আল্লাহ যেমন রেখেছেন তেমনই আছি। আপনি এতো রাতে কল করলেন?
-আসলে আমি খুব দুঃখিত। মা তোমাদের ওখানে গিয়েছিল শুনলাম। সাথী আপুকে জোর করে আনার চেষ্টাও করেছে নাকি।
-আপনার দুঃখিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি তো কিছু জানতেনও না। তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে পড়লে অনেক সময় স্ত্রীরাই স্বামীকে বিশ্বাস করতে পারে না, আর তো শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
-সাথী আপু তো বিশ্বাস করছে, ভালোবাসার টান এটাই হয়তো।
-ভালোবাসার টানেই সবসময় এমন হয়না, অনেক ভালোবাসার সম্পর্কেই বিশ্বাস থাকে না।
-আমার মন বলছে অনিক ভাইয়া কিছু করেনি, তুমি দুশ্চিন্তা করো না চিত্রলেখা।
-আমার ভাইকে আমিই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না, আপনি কিভাবে পারছেন?
-আমার মন বলছে। আমার পরিচিত একজন উকিল আছে।
-আমরা কথা বলেছি উকিলের সাথে। উনি সব কাগজপত্র রেডি করছেন বেইলের জন্য।
-ওহ আচ্ছা। চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
-হুম ইনশাআল্লাহ। আর কিছু বলবেন আপনি?
-না, মনে হলো বন্ধু হিসেবে বিপদের সময় পাশে থাকা দরকার।
-আমরা বন্ধু?
-বন্ধু নই?
চিত্রলেখা কিছু না বলেই কল কেটে দিল। রঙ্গনের থেকে দূরে থাকার চেষ্টাটা সে বরাবরই করে। আশফিনা আহমেদের দৃষ্টি ভয় পায় সে। ভদ্রমহিলা তার গোটা পরিবারকে অপছন্দ করে আর চিত্রলেখা যেন অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে। সে জায়গা থেকে রঙ্গনের সাথে বন্ধুত্ব করা আশফিনা আহমেদের কাঠগড়ায় মৃত্যুদণ্ড সমপরিমাণ পাপ। তবুও রঙ্গনকে অবহেলা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ। একটু বাদেই রঙ্গনের দ্বিতীয়বার কল আসলো। রিসিভ করলো চিত্রলেখা।
-এমন পরিস্থিতিতে এসব বলা আমার সত্যিই উচিত না। দুঃখিত, তবে আমি বন্ধু হিসেবে এতটাই অযোগ্য? চিত্রলেখা, আমার খারাপ সময়ে যখন আমি মানসিকভাবে অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম তখন তোমার সাথে কাটানো কিছুটা মুহূর্ত আমাকে ভালো রেখেছে। আমি তাই ধরেই নিয়েছিলাম আমরা বন্ধু। তুমি সত্যিই আমার জন্য খুব ভালো একটা বন্ধুর জায়গা দখল করে আছো। আমরা কি সত্যিই বন্ধু না?
-হ্যাঁ আমরা বন্ধু। এখন কল রাখুন।
চিত্রলেখা কেন যেন না বলতে পারলো না রঙ্গনকে। মুখের উপর বলে দিতে পারলো না যে আমরা বন্ধু না আর না কখনো বন্ধু হতে পারবো। এই না বলতে না পারাটা বোধহয় ভবিষ্যতে তাকে আরো বিপদে ফেলবে।
_______________
শনিবার আশফিনা আহমেদ আর এলেন না চিত্রলেখার বাড়িতে তবে সাথীর বাবা আলতাফ হোসেন এলেন। তিনি অবশ্য আশফিনা আহমেদের মতো সবাইকে উপেক্ষা করলেন না। সকলের সাথে বসে কথা বলে তবে সাথীর সাথে কথা বলার জন্য এগোলেন। সাথী নিরুত্তাপ ভাবলেশহীন হয়ে এক কোণে বসে আছে। এক টুকরো বিশ্বাসের ভেলায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে নেমেছে সে। সারা রাত নির্ঘুম থাকার ফলে চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে।
-সাথী, মা আমার। এ কী অবস্থা তোর?
-আমি ঠিক আছি বাবা। তুমি কেন এসেছো এখানে?
-আমি অনিককে বিশ্বাস করি মা। ওকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে যা করতে হয় আমি করবো। তুই চিন্তা করিস না।
-ধন্যবাদ বাবা।
-কিন্তু তুই নিজের এ অবস্থা করলে অনিককে কিভাবে সামলাবি মা? তোকে আমি এ অবস্থায় এখানে রেখে যেতে পারিনা। তোকে আমি ভরসা করতে পারছি না। তুই যদি নিজের ক্ষতি করে বসিস? তোকে আমি নিজের কাছে রেখে যা করার করবো। তুই চল আমার সাথে।
-বুদ্ধিটা খারাপ না বাবা। এটাও কি আমার ফুপুর বুদ্ধি? সাবাশ! কী তীক্ষ্ম বুদ্ধি!
-সাথী, তুই আমাকে বিশ্বাস করছিস না?
-বিশ্বাসের একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ আছে বাবা। তোমার নিকট থেকে আমি সেটা পাচ্ছি না।
আলতাফ হোসেনের মুখের ভাব তৎক্ষণাৎ পাল্টে গেল। সাথীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
-এরপর যদি তোমরা আমাকে জোর করো তবে তোমাদের নিজের মেয়েকে হারাতে খুব বেশি সময় লাগবে না বাবা।
-যার জন্য এতটা পাগল হয়েছিস, সে রেখেছে ভালোবাসার মর্যাদা? ও দোষী সাব্যস্ত হলে কী করবি তখন? কাউকে এতটা বিশ্বাস করিস না যেন বিশ্বাস ভাঙলে জীবনটাও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়।
-বিশ্বাসের বিশেষত্বই এটা বাবা। আমি না আমার বিশ্বাস ভাঙতে দেব আর না আমার জীবন।
আলতাফ হোসেন রেগে বেরিয়ে গেলেন। সাথী মেঝেতে বসে হাঁটু মুড়ে সেখানে মাথা রাখলো। চিত্রলেখা সাথীর পাশে গিয়ে সাথীকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। সাথী ভেঙে পড়লো না। শক্ত ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ় সে কেবল প্রার্থনা করলো,”আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিও আমি যেন আসন্ন সব বিপদ মোকাবিলা করে আমার বিশ্বাস অটুট রাখতে পারি।” সাথীর চোখ শুষ্ক অথচ যাবতীয় যন্ত্রণা সে জমিয়ে রেখে বুকে এ মুহূর্তে। চিত্রলেখার চোখ ভিজে উঠে। মানুষটা এতটা দৃঢ় কী করে? এতটা বিশ্বাস? শুধুই কি ভালোবাসার কারণে?
অর্ণবের ফোন বেজে উঠলো। পুলিশ অফিসারের নম্বর ভেসে উঠছে স্ক্রিণে। আচমকা স্টেশন থেকে কল পেয়ে খানিকটা ভীত হলো সে। চটজলদি ফোন রিসিভ করলো। সেকেন্ড তিরিশেক সময় লাগলো অর্ণবের অপর প্রান্তের কথা বুঝতে। অতঃপর তার চোখের সামনে অন্ধকার ছেঁয়ে গেল। সামনে বসে থাকা সাথীকে কিভাবে কথাটা বলবে ভেবে তার বুক কাঁপতে লাগলো। কান্নাগুলো আটকে আছে কোনোরকম, সাথীর সামনে কাঁদতে পারবে না সে আর না সাথীকে এ মুহূর্তে কিছু জানানোর সামর্থ তার আছে।
চলবে…