চিত্রলেখার কাব্য পর্ব-১১+১২

0
599

#চিত্রলেখার_কাব্য
একাদশ_পর্ব
~মিহি

“ভাবী, এসব কথা যেন ভাইয়া না জানে প্লিজ। তোমাকে আমার কসম ভাবী।” সাথী নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো। এক ভাই বোনের স্বার্থে কথা গোপন রাখতে বলেছে তো অন্যদিকে বোন ভাইয়ের সংসারের স্বার্থে কথা গোপন করতে বলছে।

-ভাবী, আমার কথা রাখবে তো তুমি?

-তুই অন্যায় আবদার করছিস লেখা।

-বাড়িতে থেকে আমার আসলেই পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে ভাবী। এত হইচইয়ের মধ্যে আমার মনোযোগ বসে না।

-এই কালো পর্দা তোমার ভাইয়ের জন্য রাখো, আমার জন্য না।

-তুমি আমার কথা না মানলে ঐ মহিলার কথা সত্যি হবে ভাবী। তোমার ননদের উপর আনা অপবাদ সত্যি হোক তুমি সেটা চাও?

-লেখা!

-তাহলে আমার কথা মেনে নাও ভাবী, দোহাই লাগে তোমার।

সাথী আবারো অসহায়ের মতো তাকালো। চিত্রলেখা আর কথা না বাড়িয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলো। আজ কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু এ মুহূর্তে বাড়িতে থাকলে তার মন আরো বিষণ্ণ হয়ে পড়বে।

চিত্রলেখা বাড়ি থেকে বেরোতেই অর্ণবের কল আসলো সাথীর ফোনে।

-সাথী, লেখা কোথায়?

-কলেজে গেছে ভাইয়া।

-অনিক কবে আসবে?

-ও এই মাসে আসতে পারবে না, কাজের চাপ আছে।

-আচ্ছা। আমি সরাসরি মার্কেটে যাচ্ছি। আর অপর্ণা বা ওদের ওখান থেকে কি কল করেছিল কেউ?

সাথী নীরব রইলো। কী বলবে বুঝতে পারছে না। চিত্রলেখার কথা অমান্য করলে সে আর কখনো সাথীর প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারবে না।

-কী হলো সাথী? কল আসছিল?

-না ভাইয়া।

-আচ্ছা, রাখো।

-আল্লাহ হাফেজ।

সাথী কল কাটলো। সে এখন উভয় সঙ্কটে পড়েছে। অর্ণবের কথা চিত্রলেখাকে বলতে পারছে না আবার চিত্রলেখার কথা অর্ণবকে বলতে পারছে না। সাথী একবার ভাবলো অনিককে কল করে জানাবে কিন্তু অনিক এসব বিষয়ে বড্ড ভাবলেশহীন। বোনের ব্যাপারে তার যেন কোনো ভাবনাই নেই। অনিক বাড়িতে থাকলেও চিত্রলেখার সাথে তেমন কথা বলে না। আবারো ভাবনায় পড়লো সাথী। বড়সড় ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে।

কলেজে এসে আরো বিরক্ত হলো চিত্রলেখা। সুবহা আসেনি আজ। কলেজের বড় রুমটাতে শত শত স্টুডেন্টের মধ্যে একাকীত্ব অনুভব করার মতো যন্ত্রণা বোধহয় আর হয়না। শেষের দিকের কর্ণারের একটা বেঞ্চে বসলো সে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। রঙ্গনের মেসেজ চেক করার ইচ্ছে গতকাল হয়নি। দুদিনে যা হয়েছে তাতে যথেষ্ট মানসিক অবসাদে পড়েছে সে তবুও এখন রঙ্গনের মেসেজটার রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করছে তার। রঙ্গন লিখেছে,”অপরিচিতা ভাববো নাকি পরিচিত কোনো ব্যক্তির হাস্যরসের প্রচেষ্টা?”

-যার জীবনে এত দুঃখ, তাকে হাসানোর প্রচেষ্টা নিছক মজা নয় কি?

রঙ্গন অনলাইনেই ছিল। রিপ্লাই আসতে বড়জোর দু’মিনিট লাগলো।

-কথা মন্দ বলেন নি, অপরিচিতা তবে দুঃখ শেয়ার না করে বারবার খোঁচা দেওয়া কিন্তু মন্দ অভ্যেস।

-আমি মানুষটাই মন্দ, অভ্যেস কী করে ভালো হয়?

-আপনি মানুষটা রহস্যময়ী।

চিত্রলেখা সিন করলো না। তার চোখে অদ্ভুত একটা জ্যোতি খেলা করলো। এ জ্যোতির রহস্য অনুভব করে সে আপনাআপনি পুলকিত হলো। ফোনটা ব্যাগে রেখে ক্লাসে মনোযোগ দিল।

_______________

চিত্রলেখা সন্ধ্যের পর থেকে নিজেকে প্রস্তুত করছে, বারবার ভয় এসে জেঁকে ধরছে তাকে। বড় ভাইকে কিভাবে রাজি করাবে ভাবতে ভাবতে অস্থির সে। অর্ণব বাড়িতে ফিরলো নয়টার পর। মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। সাথী খাবার বাড়লো। অর্ণব হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসেছে। চিত্রলেখা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সে অপেক্ষায় আছে কখন তার ভাইয়ের খাওয়া শেষ হবে। অর্ণব বেশ ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করে চিত্রলেখাকে ডাকলো। ভয়ে আড়ষ্ট চিত্রলেখা অর্ণবের সামনে দাঁড়ালো।

-কিছু বলবি? এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছিস!

-আসলে একটু কথা ছিল ভাইয়া।

-হ্যাঁ তো বল সেটা।

-আমি আসলে কলেজের হলে শিফট করতে চাচ্ছি ভাইয়া।

-কেন?

-বাড়ি থেকে যেতে আসতে অনেকটা সময় লাগে, তার উপর এখানে একটু নিরিবিলিতে পড়াও যায়না। পরীক্ষার সময়টুকু হলে থাকলে ভালো হতো।

-আমি সবাইকে বলে দিব তোকে পড়ার সময় বিরক্ত না করতে। যা ঘরে যা।

-ভাইয়া আমার এখানে পড়াশোনায় মনোযোগ বসেনা, সবসময় বাচ্চাদের সাথে খেলতে মন চায়।

-মনকে নিয়ন্ত্রণ করে পড়।

-হলে থাকলে এমনিতেই মনোযোগ বসবে।

-হলের খাবার খেতে পারবি তুই? ওখানে এক রুমে তিনজনের সাথে ম্যানেজ করতে পারবি?

-ভাইয়া, তুমি কি ভাবছো খরচ বেশি হয়ে যাবে? আমি আমার জভানো টাকা থেকে খরচ দিব, তোমার দিতে হবে না।

-বেশি বকিস না, ইচ্ছে যখন হয়েছে যাও তবে পড়াশোনার জন্য যাচ্ছিস। এটা মনে রাখিস।

-জ্বী ভাইয়া। ভাবী কবে আসবে? আমি তো পরশুর মধ্যে শিফট করবো। বাচ্চাদের সাথে দেখা করে যেতাম।

-কাল নিয়ে আসবোনি।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। এখনো অনেক কাজ বাকি তার।

অর্ণব খানিকটা চিন্তায় পড়লো। চিত্রলেখা হঠাৎ হলে যাওয়ার জেদ করছে কেন? অপর্ণা কি কিছু বলেছে? সাথীকে ডাকলো সে।

-সাথী, অপর্ণা কি লেখাকে কিছু বলেছে যার জন্য ও হলে যেতে চাইছে?

-না ভাইয়া, তবে আপা সারাক্ষণ ওকে এটা সেটা করতে দেয়। হলে গেলে হয়তো বেচারার পড়ায় কোনো বাধা থাকবে না।

-আচ্ছা যাও।

সাথী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কথাটা যদিও মিথ্যে নয় তবুও ভয় করছে সাথীর। অপর্ণার মায়ের কলের বিষয়টা অর্ণবকে জানাতে পারলে বোঝ কমতো তার কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।

চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢুকলো। রঙ্গনকে এক্টিভ দেখে মুচকি হাসলো সে।

-আপনার পরিবারের সবাই কি আপনার মতো ফুল? রঙ্গনের বোন কি গোলাপ?

-না না, আমার বোন নেই। ভাই আছে ছোটো।

-ওহ আচ্ছা। আপনার পরিবারের ছবি দেখলাম অনেক আগের, আপনার পাশে একজন যুবক। উনি আপনার বড় ভাই?

-না, উনি আমার মামা। বয়স্ক কিন্তু বয়স বোঝা যায় না।

-ওহ আচ্ছা। নায়কের মতো হাবভাব।

-তা বলা যায় তবে উনি আপাতত রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান।

-ওহ আচ্ছা।

-আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন এবার অপরিচিতা।

-আমার পরিবারে কেউ নেই।

-স্যরি টু আস্ক ইউ।

-সমস্যা নেই। পরে কথা হবে।

ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এলো সে। যা দরকার ছিল তা জেনে গেছে। এখন শুধু কাজটা করার অপেক্ষা।

_________________

চিত্রলেখা পরশুদিন হলে চলে গেল। অপর্ণার মুখ দেখেই বোঝা গেল সে বড্ড খুশি। অর্ণব আজ সকালেই তাকে এনেছে। চিত্রলেখা রূপসা রাদিফকে আদর করে অর্ণবের সাথে বেরোলো। কোনোরকম কান্না আটকে রেখেছে সে। অর্ণব যদি একবার জানতে পারে চিত্রলেখা কেন এসব করছে তবে বাড়িতে আর শান্তির চিহ্নটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না।

-লেখা, তুই থাকতে পারবি তো হলে?

-পারবো ভাইয়া, খুব পারবো।

-বেশ। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।

-সব সমস্যা তুমি সমাধান করলে আমি কী করে সমস্যা মোকাবিলা করতে শিখবো?

-সমস্যা মোকাবিলা শিখতে হয় না। পরিস্থিতিই তোকে শিখিয়ে দিবে কখন কী করতে হয়। আর তুই জানিস সেটা, জানিস বলেই হলে যাওয়ার জেদ করেছিস।

চিত্রলেখা কথা বাড়ালো না। অর্ণবের কথায় সে বুঝতে পারছে অর্ণব কিছুটা আন্দাজ করেছে। অর্ণব আর বেশি কিছু বললো না। চিত্রলেখাকে হলে রেখে সব বুঝিয়ে ফিরে গেল। চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একটা যুদ্ধ এখনো বাকি আছে, নিজের সাথে যুদ্ধ। নিজের অস্তিত্বকে জাগ্রত করার সে যুদ্ধ!

____________

নওশাদ মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। ইদানিং মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে তার। চিত্রলেখার উপর না মেটাতে পারা ঝাঁঝটা এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। ফোনের মেসেজ টিউন শুনে ঘোর কাটলো তার। ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকলো সে।

-আপনি দেখতে তো বেশ সুদর্শন, বিয়ে করেননি কেন?

-আপনার মতো কখনো কেউ সুদর্শন বলেনি তাই।

নওশাদের মনে জ্বলতে থাকা আগুনে পানির ছিটে পড়লো। অবশেষে কেউ স্বেচ্ছায় তার জালে পা বাড়াতে এসেছে। চিত্রলেখার উপর না মেটানো ঝাঁঝটা এর উপরেই মেটানো যায়।

-আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি বেশ শক্তসামর্থ্য পুরুষ।

-সন্দেহ আছে?

-থাকতেই পারে।

নওশাদ বুঝতে পারলো মেয়েটা তাকে কী ইঙ্গিত করছে। এসব মেয়েদের সে ভালোমতো চেনে। ভদ্রবেশী প্রস্টিটিউটের মতো আচরণ এদের। মুখে কিছু বলবেনা অথচ ইঙ্গিতে সব চায় তাদের। নওশাদ খানিকটা ঝোঁকের মধ্যেই ছিল তখন, আগে-পিছে কিছু ভাবলো না। নিজের একটা ছবি মেয়েটির ইনবক্সে পাঠালো সে, অপ্রীতিকর সে ছবিটি যে তার জন্য কাল হয়ে আসতে চলেছিল তা তখনো অনুভব করেনি সে।

চলবে…

#চিত্রলেখার_কাব্য
দ্বাদশ_পর্ব
~মিহি
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদেরদের জন্য উন্মুক্ত]

“নির্বাচন পূর্ব সময়ে *** এলাকার চেয়ারম্যানের অশ্লীল কৃতকর্মে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব।” ফেসবুকের পোস্টগুলো দেখে ঠোঁটে হাসি খেলা করছে মেয়েটার। অবশ্য সে ধারণা করতে পেরেছিল লোকটা সহজেই তার জালে ধরা দিবে। বাকি কাজ গার্লস গ্রুপ করে দিয়েছে। গার্লস গ্রুপের একটা মারাত্মক ফায়দা হলো একটু ইমোশনাল কথাবার্তা দিয়েই কাজ হাসিল করানো যায়।

‘কায়া’ আইডি থেকে গার্লস গ্রুপে নওশাদের অশ্লীল ছবিসহ কিছু অশ্লীল কথাবার্তার স্ক্রিনশট পোস্ট করা হয়েছে। উপরে বেশ আবেগী বাক্যে লেখা,”এই লোকটা আমার এলাকার চেয়ারম্যান। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি আমাকে শারীরিক নির্যাতনের চেষ্টা করেছেন।” কমেন্টবক্সের ক্ষুদ্র একাংশ সহমত পোষণ করলো। নওশাদকে তারাও চেনে, লোকটা তাদের সাথেও খারাপ আচরণ করেছে। ব্যস! পোস্ট ভাইরাল হতেই কায়া আইডিটার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। এতে যুক্তি আরো প্রখর হলো যেন নওশাদই ধমকে আইডি বন্ধ করাতে বাধ্য করেছে। ফেসবুক জুড়ে এ বিষয় নিয়েই চর্চা চলছে। নওশাদ এখনো এসব নিয়ে মুখ খোলেনি। দ্রুত তাকে সব খোলাসা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

_______________

হলের বাথরুমের ছোট আয়নাটা বড্ড নোংরা। হলদেটে একটা দাগ আছে আয়নাটাতে। চিত্রলেখার বমি বমি ভাব হচ্ছে। নিজের উপর আবারো একটা বিতৃষ্ণা চলে এসেছে তার। চোখেমুখে পানি দিতেই আয়নায় নিজের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি লক্ষ করে সে। হলদেটে আয়নাতেও প্রতিচ্ছবিটি শুভ্র স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। প্রতিচ্ছবিটি যেন ডেকে উঠলো চিত্রলেখাকে।

-নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে চিত্রলেখা?

-হুম। কুকুরকে কামড়েছি মনে হচ্ছে।

-কুকুর তোমার সভ্রমে হাত দিয়েছিল আর তুমি তার সভ্রম এবং ক্ষমতা ভরাবাজারে নিলামে তুলেছো। নিজের সাথে এর চেয়ে বড় ইনসাফ কী হতে পারতো? নিজের ‘কায়া’ পরিচয় ভুলে যাও।

-আমি কি ঠিক করেছি? লোকটার অশ্লীল মেসেজগুলো আমার চোখে ভাসছে দুঃস্বপ্ন হয়ে।

-কায়ার অস্তিত্ব মিটিয়ে লেখা হয়ে বাঁচো।

চিত্রলেখা কিছু বলার আগেই দরজায় শব্দ শুনতে পায়। সামনে তাকিয়ে প্রতিচ্ছবিটিকে আর দেখতে পায় না সে তবে কথাগুলো তার মনে ভাসে। সে অবশ্যই সঠিক কাজটাই করেছে। এরকম একজন পুরুষের সাথে এটাই হওয়া উচিত!

“মরে গেছিস নাকি ওয়াশরুমে? বের হ!” চেঁচামেচির শব্দে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বের হয় চিত্রলেখা। তাকে রুম শেয়ার করতে হচ্ছে আর্টসের একজনের সাথে। মেয়েটা বেশ উগ্র। চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢুকলো না আর। ফেসবুক ডিলিট করে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করলো। হোয়াটসঅ্যাপ আনইনস্টল করেছিল দিন কয়েক আগে। হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করতেই সিয়ামের গতকালের মেসেজ ভেসে উঠলো,”নোটখাতাটা যত্নে রাখিস।” চিত্রলেখা মৃদু হাসলো। সিয়ামকে অনলাইনে দেখে রিপ্লাই দিল।

-এতই যখন নোটখাতার চিন্তা, তো দিলে কেন আমায়?

-সাহায্য তো করতে নাই মানুষকে!

-সাহায্য করে বারবার খোঁটা দেওয়া উচিত?

-আচ্ছা স্যরি। পরীক্ষা তো কয়েকদিনের মধ্যে। পড় মনোযোগ দিয়ে।

-আচ্ছা।

ফোন রেখে বসতেই ওয়াশরুম থেকে তার রুমমেট বেরোলো। মেয়েটির নাম সঞ্চারী, হিন্দু সম্প্রদায়ের। আরেকজন রুমমেট আছে, অহনা নাম। অহনা সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে। সঞ্চারীর চোখজোড়া সবসময় অদ্ভুত এক রাগে রাগান্বিত থাকে। সে এসে বসলো চিত্রলেখার ঠিক মুখোমুখি।

-তুই সায়েন্সের?

-হ্যাঁ। আমার বাংলা নোটটা করে দে তো।

-আমার পড়া আছে।

-তো? তোর পড়া আছে পরে পড়বি। আমার কাজটা কর আগে, বেশি কথা বলিস না।

চিত্রলেখার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করলো না তার উপর এই মেয়ে এসেছে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে। কী লাভ তাকে খেপিয়ে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঞ্চারীর জন্য নোট করতে বসলো সে।

_______________

-ভোটের আগে এসব ফাজলামি করার কোনো মানে হয় নওশাদ? যেভাবে পারো এসব বন্ধ করো।

-আমি দেখছি বিষয়টা।

নওশাদ ফোনটা দূরে আছাড় মারলো। আসলেই সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চিত্রলেখাকে দেখার পর থেকে তার মধ্যে যে আগুনের শিখা জ্বলতে শুরু করেছে তা কেবল চিত্রলেখার নরম শীতল স্পর্শেই দূর হওয়া সম্ভব। নিজের লোকদের কাজে লাগিয়ে ভাইরাল পোস্টগুলো সরানোর ব্যবস্থা করেছে নওশাদ আর পাবলিককে ভুজুংভাজুং বোঝানোর ফন্দি আঁটাও শেষ। ‘এডিট’ বলে পুরো ব্যাপারটাই ধামাচাপা দেওয়া যাবে তবে চিত্রলেখার ঝড় তার মনে তখনো বহমান। এ ঝড় থামানো আবশ্যক। নওশাদ মির্জাকে এখনো চেনেনি চিত্রলেখা। নওশাদ জীবনে প্রথম কাউকে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখেছে, এ স্বপ্ন এত সহজে ভাঙতে তো সে দেবেনা তবে আপাতত পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওয়া অবধি নীরব থাকবে সে। নীরবেই চিত্রলেখার দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করতে হবে।

আশফিনা আহমেদ নওশাদের অবস্থা বুঝতে পারছেন। তবে তিনি কিছু বলছেন না। ঘটনাটা আকস্মিক মনে হচ্ছে না তার। যদিও চিত্রলেখা বেশ সরল তবুও তার সন্দেহের তীরটা কেন যেন চিত্রলেখার দিকেই ঠেকছে। এ কথা তিনি নওশাদকে জানাবেন না। তার ভাই ভুল করেছিল এবং শাস্তি পাওয়াটা উচিত। যতটুকু অসম্মান তার হয়েছে তা একজন মেয়ের অসম্মানের নিকট তুচ্ছ মাত্র।

অহমের ইদানিং মন ভালো থাকেনা তবুও পড়ায় মন বসিয়েছে সে। চিত্রলেখার কথা মনে পড়ে তার আবার পরক্ষণেই মনে পড়ে ম্যামের কলেজে চান্স পেতে হলে পড়তে হবে। রসায়ন স্যারের মেয়েটা তাকে আর বিরক্ত করে না। অবশ্য তার ব্রেক আপ হয়েই গেছে, এখন আর বিরক্ত না করলেই কী? বড় ভাইকেও বড্ড মিস করছে সে। সব মিলিয়ে জীবনটা বেশ বিষণ্ণ কাটছে তার।

-অহম, কী ভাবছো এতো?

-মা, ভাইয়া আর কিছুদিন থাকতে পারতো না?

-পরীক্ষা শেষ হলেই আসবে।

-আমি একদিন চিত্রলেখা ম্যামের সাথে দেখা করতে যাবো ভাইয়ার সাথে।

-ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে যাও।

-না আমি ভাইয়ার সাথেই যাবো।

আশফিনা আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছু বিষয় না চাইতেও সামনে উপস্থিত হয়। এসব বিষয় যেমন ছুঁড়ে ফেলা যায় না তেমন প্রতিবাদও করা যায় না। রঙ্গনের ব্যাপারে তিনি কখনো চিত্রলেখাকে নিয়ে আপোস করতে পারবেন না। রঙ্গনের মনে যে ক্ষণিকের অনুভূতি জন্মেছে তা অচিরেই বিনাশ হওয়াটা আবশ্যক ছিল। তার জন্য নিজের ছেলের সাথে রুক্ষ্ম ব্যবহার তার কাছে অযৌক্তিক নয়। রঙ্গনের জন্য তিনি সেরা ছাড়া কিছু নির্বাচন করবেন না কখনোই।

_______________

চিত্রলেখার লেখা শেষ করতে অনেকটা সময় লাগলো। অতঃপর সঞ্চারীকে নোটটা দিল। সঞ্চারী অনেকটা রুক্ষভাবে সেটা নিল। চিত্রলেখার বিরক্ত লাগলেও কিছু বললো না। অযথা অশান্তি করার ইচ্ছে তার নেই। যে অশান্তি থেকে বাঁচতে সে এখানে এসেছিল, সে অশান্তি বোধহয় এত সহজে তাকে ছাড়বে না।

-তুই নোটে কাটাকাটি করেছিস কেন? দেখে লিখতে পারিস না?

-এত সমস্যা হলে নিজে লেখতে পারো। কেউ সাহায্য করলে ধন্যবাদ দিতে শেখো।

-তোকে কেন ধন্যবাদ দিতে হবে?

-তোমার নোটটা আমি করে দিয়েছি। ধন্যবাদ না দিতে পারলে ভুল ধরিও না অযথা।

-ভুল করলে ভুল ধরবো না?

-নিজে লেখো তাহলে।

চিত্রলেখার কণ্ঠস্বর উচু হলো। সবসময় নীরব থাকা যায় না। চিত্রলেখার উচ্চ কণ্ঠস্বরে বোধহয় দমে গেল সঞ্চারী। মুচকি হাসলো সে। নোটখাতাটা বিছানায় ফেলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে চিত্রলেখার বাহু ধরে তাকে বিছানায় বসালো।

-আসার পর থেকে দেখতেছি চুপচাপ, যে যা বলে তাই শুনতেছিস। এই যে তোর মধ্যে বাকশক্তি আছে এটাই পরখ করলাম।

-মানে?

-মানে প্রতিবাদ করতে শিখ। সবার কথা মাথায় রেখে কাজ করলে নিজের ভালো থাকার সবটুকু অংশ বিসর্জন দিতে হবে আর অন্যের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে কেউ ভালো থাকে না।

-অযথা ঝগড়া বাড়ে প্রতিবাদ করলে।

-তার জন্য সব মেনে নিবি? শোন, জীবনে লড়াই না শিখলেও কৌশলী হতে হয়। মুখে ঝগড়া না করলেও সুচতুরভাবে পরাজিত করতে হয় শত্রুকে। যুক্তিবাদী হ, তোকে আমি প্রতিবাদ করতে বলেছি তোর কাজের মাধ্যমে। সডার হা’তে হা মিলাস না। পরে যেন পস্তাতে না হয়। জীবন বড্ড কঠিন।

সঞ্চারী আবারো হাসলো। চিত্রলেখা লক্ষ করলো মেয়েটার হাসি অদ্ভুত সুন্দর। এতক্ষণ যাকে উগ্র মনে হচ্ছিল তাকে একমুহূর্তেই যেন খুব ভালো মনে হচ্ছে তার। চিত্রলেখার চোখে আবারো সেই জ্যোতি অনুভব করলো সে। ভুল কিছু সে করেনি, সে লড়েছে নিজের জন্য তবে নীরবে।

“ইন্ট্রোভার্টরা সচরাচর লোকসমাগম ভয় পায় তবে ভার্চুয়াল জগতটা তাদের জন্য কমফোর্ট জোন। এখানে তারা নিজেদের রাজত্ব চালায়। ইন্ট্রোভার্টদের জন্য এই ভার্চুয়াল জগতে যুদ্ধ জয় করাও বড্ড সহজ। এরা বাস্তবতা ভয় পায়, কল্পনার আশ্রয়ে আশ্রিত এরা কল্পলোকে বাস করতে ভালোবাসে।” চিত্রলেখা আনমনে আওড়ালো কথাগুলো। ঠিক সে সময় রঙ্গনের টেক্সট আসলো। টেক্সট ওপেন করতেই ভীতি গ্রাস করলো চিত্রলেখাকে। রঙ্গনের থেকে এই টেক্সট মোটেও প্রত্যাশা করেনি সে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে