#চিত্রলেখার_কাব্য
সূচনা_পর্ব
~মিহি
“লেখা, এত রাতে লুকিয়ে রান্নাঘরে কী করছিস তুই? তোর এতবড় সাহস আমার বাচ্চাদের জন্য আনা এত দামী বিস্কিট তুই চুরি করে খাচ্ছিস!” ভাবীর চেঁচামেচিতে চিত্রলেখার হাত থেকে বিস্কুটের বয়ামটা মেঝেতে পড়ে বিকট শব্দে ফেটে যায়। ভাবীর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায় চিত্রলেখা। এখন তার সাথে কী হবে তা কল্পনা করতেও ভীত হচ্ছে সে। এমনিতেই তার বড় ভাই আজ ব্যবসার কাজে বাইরে গেছে। আজ তো ভাবীকে আটকানোরও কেউ নেই!
-তুই জানিস এই বিস্কিটের দাম কত? আমার ভাই বিদেশ থেকে পাঠিয়েছে এটা আমার বাচ্চাদের জন্য আর তুই সব নষ্ট করে ফেললি!
-ভাবী স্যরি, আমি ইচ্ছে করে করিনি সত্যি। আসলে আমি দুপুর থেকে খাওয়ার সময় পাইনি তাই রান্নাঘরে কিছু খেতে এসেছিলাম। টেবিলের উপর বিস্কুটের বয়াম ছিল। ভাবলাম ওখান থেকেই কয়েকটা…
-কী এমন রাজকার্য করছো সারাদিন? এক রান্না ছাড়া তো কিছুই করো না, বই নিয়ে বসে থাকো। তাও তো তোমার ভাই তোমারে পালতেছে। অন্য কেউ হলে এমন সৎ বোনরে মাথায় নিয়ে পালে নাকি!
চিত্রলেখা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ‘সৎ’ শব্দটা কানে বাড়ি খাচ্ছে তখন। সামান্য একটা বিস্কুটের জন্য এত কথা শুনতে হয় তা জানলে চিত্রলেখা কোনভাবেই বয়ামটাতে হাত দিত না। চিত্রলেখার ভাবী অপর্ণার চেঁচামেচিতে তার ছোট ভাবী সাথীও ঘুম ঘুম ভাবে রান্নাঘরে এলো।
-কী হয়েছে আপা? এত চেঁচামেচি করছো কেন রাতে? বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে তো।
-চেঁচামেচি করবো না তো কী করবো? তোর এই ননদ কী করেছে জানিস? আমার ভাই বাচ্চাদের জন্য বিদেশ থেকে বিস্কিট পাঠিয়েছে। এ মেয়ে সব নষ্ট করে ফেলল। আমার ভাইকে আমি কিভাবে মুখ দেখাবো বল?
-আহা আপা! এর জন্য তুমি রাত বিরাতে এভাবে বকছো মেয়েটাকে? বাদ দাও তো। ঘুমাতে যাও। রাত জাগলে তোমার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে যাবে তো।
অপর্ণা কথা বাড়ালো না। চিত্রলেখার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। সাথী লক্ষ করলো চিত্রলেখা তখনো রান্নাঘরের মেঝেতে বসে কাঁচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।
-লেখা, রেখে দে ওসব। তোর তো কাল পরীক্ষা, হাত কেটে গেলে সমস্যা হবে।
-এইতো হয়ে গেছে ভাবী। তুমি বাঁচিয়ে নিলে আজ।
-তোকে কতবার বললাম খেয়ে পড়তে বস। তোর জন্য তো খাবার ফ্রিজে রেখেছিলাম আমি। জানিই তো তুই খালি পেটে ঘুমাতে পারিস না।
-ফ্রিজের ভাতে বড় ভাবী পানি দিয়েছে আর তরকারিও ফেলে দিয়েছে।
-আচ্ছা দাঁড়া, আমার ঘরে ড্রাইকেক আছে, ঐটা খেয়ে নে চল।
চিত্রলেখা সাথীর দিকে তাকাতেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মাকে হারানোর পর সে কারো কাছ থেকেই ভালোবাসা পায়নি একমাত্র কিছু মানুষ ছাড়া। বাবা তো তাকে কেবল নিজের পাপ ভেবে গেছে সবসময়। মা মারা যাওয়ার পর যখন বাবা তাকে এ বাড়িতে আনে, তখন তার বয়স নয়। এখন বয়সটা বিশ ছুঁই ছুঁই অথচ এখনো ভালোবাসার কাঙাল সে। বড় ভাইয়া আর ছোট ভাবীই তাকে একটু ভালোবাসে। কানন আপুও মাঝে মাঝে ভালোবাসে। চিত্রলেখা আনমনে সব ভাবতে ভাবতে ড্রাইকেক খেতে লাগলো। কাল শেষ পরীক্ষা অথচ আজ মনটা এমন বিক্ষিপ্ত হলো। কালকের পরীক্ষা কেমন যাবে বুঝতে পারছে না সে।
___________
-পরীক্ষা কেমন হয়েছে লেখা?
-মোটামুটি ভাবী। মনে হয় পাশ এসে যাবে তবে নম্বর ভালো আসবে না।
-আচ্ছা চিন্তা করিস না, ফাইনালে কভার করে নিবি। তোর জন্য একটা সংবাদ আছে।
-কী সংবাদ? সুসংবাদ তো আসে না আমার জন্য!
-আমার এক ফুপা আছে, তুই হয়তো চিনিস না। বেশ বড়লোক, তো তার ছেলে এবার নাইনের ফাইনাল এক্সামে ডাব্বা মেরেছে। এখন তারা একজন শিক্ষক খুঁজছে। ছেলের বাবার শখ তোদের কলেজেই যেন ওর চান্স হয়।
-বাঁশবাগানে ছেলেকে পাঠানোর এত শখ কেন!
-আরে ধুর! মজা করিস না তো। তো আমাকে তোর কথা জিজ্ঞাসা করলো। তুই তো ভালো ছাত্রী। তোর কি সময় হবে একটু পড়ানোর? ওরা যথেষ্ট টাকা দিবে বলছে।
-সংবাদটা আসলেই সুসংবাদ ভাবী। এখন আমার পড়াশোনার টাকা সংক্রান্ত ঝামেলা খানিকটা কমলো। তোমাকে অনেক থ্যাংকস। তোমার জন্য আজ বিকেলে সেমাই রান্না করবোনি।
-আহা শখ কত! তোমার বড় ভাবী আমাকেও সেমাইয়ের সাথে গিলে খাবে। তিনি দুধ রেখেছেন চুলে দেওয়ার কী জানি বানাতে, খাওয়ার জন্য না।
-এই ভাবী যত জিনিস চুলে দেয়, তাতে আমাদের একমাসের খাবার হয়ে যেত।
-এই চুপ! যাও ফ্রেশ হও আর ওরা আজ বিকেলে গাড়ি পাঠাবে। ওরাই নিয়ে যাবে, নামিয়ে দিয়ে যাবে। তুমি শুধু ভালোমতো পড়াও।
চিত্রলেখা মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। সত্যিই সে অনেক খুশি। বড় ভাইয়ার কাছ থেকে সবসময় টাকা নিতে তার খানিকটা লজ্জাই লাগে আর ভাবীর কাছে চাইতে গেলে তো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যায়। এসব ভেবে ভেবে কয়েকটা প্রাইভেটও বাদ দিতে হয়েছে তার। এখন বোধহয় সমস্যাটা মিটলো। ভাবতে ভাবতেই সে হাতমুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নিল। খানিকটা ক্লান্ত লাগছে। একটু চা পেলে ভালো হতো কিন্তু এখন চা বানাতে গেলে বড় ভাবী চেঁচামেচি করবে। বাজখাই গলায় বলে উঠবে,’গ্যাসের বিল তোর মা দেয়?’ সচরাচর এসব গালিতে বাবাকে আনা হয় কিন্তু চিত্রলেখার মাকেই দোষারোপ করে অপর্ণা। এমনকি কতবার যে তাকে নাজায়েজ শব্দের সাথে পরিচিত করিয়েছে তা গোণার বাইরে অথচ চিত্রলেখার মা ছিলেন তার বাবার প্রথম স্ত্রী। এসব অতীতের স্মৃতিগুলো মনে করলেই চিত্রলেখার বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করতে থাকে।
ঘড়ির কাঁটা চারটে ছুঁই ছুঁই। সরু রাস্তায় এক বিশালাকার গাড়ি এসে সমস্ত জায়গা দখল করে ফেলেছে। আশেপাশের লোকজন বিরক্তির সমেত তাকাচ্ছে সেদিকে। বাচ্চারা গাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছে। চিত্রলেখা দ্রুত গাড়িতে বসতেই গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে সরে গেল। আশেপাশের লোকজন তখনো ভ্রু কুঁচকে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতায় পরিক্রমা করে বেড়াচ্ছে কতিপয় অশ্লীলতর কথাবার্তা। চিত্রলেখার চরিত্র সম্বন্ধে তারা এখন নিজেদের সবজান্তা ভাবতে শুরু করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
____________
-এসে গেছি ম্যাম, নামুন। ভেতরের দরজায় গেলে একজন আপনাকে রুম দেখিয়ে দিবে।
-ধন্যবাদ।
চিত্রলেখা গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে গেল। বাড়ির সামনে বিশাল বাগান। বাগানে শোভা পাচ্ছে প্রচুর ফুল। রঙ্গন ফুলের সংখ্যা বেশি। ধীর পায়ে দরজায় আসতেই একজন যন্ত্রন্যায় গলায় প্রশ্ন করে বসলো তাকে।
-কাকে চান?
-না মানে আমি আসলে পড়াতে এসেছি।
-কাকে পড়াতে?
‘সর্বনাশ!’ মনে মনে উচ্চারণ করলো সে,’আমি তো ভাবীর কাছে ছাত্রের নামও শুনিনি। এখন কী বলবো একে?’ চিত্রলেখা ভারী মুসিবতে পড়লো।
-রঙ্গন স্যার উপরে আছেন। যান।
-আচ্ছা ধন্যবাদ কিন্তু ঘরটা?
-উপরে গিয়ে সিঁড়ির ডানপাশের রুমটা।
চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে। প্রথমদিনেই ছাত্রের নাম না জেনে পড়াতে আসা নিশ্চিত লজ্জাজনক ব্যাপার হয়ে যেত। প্রথম ইমপ্রেশনটাই শেষ হতে চলেছিল। চিত্রলেখা ভাবলো ছাত্রের নাম বুঝি রঙ্গন! সে বাড়ির ভেতরটা একদৃষ্টিতে দেখে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। সিঁড়ির ডানপাশের রুমটার দরজা হালকা আটকানো। চিত্রলেখা ‘রঙ্গন’ বলে ডেকে উঠলো।
-রঙ্গন? ভেতরে আসবো আমি?
-আসুন।
দরজা অল্প খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকালো চিত্রলেখা। প্রায় ছয় ফুটের এক দানবীয় পুরুষকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। একে পড়াতে হবে? কতবার ফেল করলে এ এখনো নাইনে পড়ে থাকতে পারে? আদুভাই লাইট? না না আদুভাই প্রো ম্যাক্স!
রঙ্গন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। পুঁচকি একটা মেয়ে কিনা তাকে নাম ধরে ডাকে। ভারী সাহস তো!
-কে আপনি? কী দরকার?
-আমি আসলে পড়াতে এসেছি। আপনি এখনো নাইনে পড়ে আছেন কেন?
-অ্যাহ? আমি? এক্সকিউজ মি! আমার ছোট ভাই অহমকে পড়াতে এসেছেন আপনি।
কথাটা শোনামাত্র চিত্রলেখার মাথা ঘুরে উঠলো। মনে মনে বললো,’হে ধরণী, দ্বিধা হও!’ বোকাসোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুঃখিত বলে দরজা অতিক্রম করতেই বিকট একটা শব্দে মাথা ঘুরে পড়ে গেল চিত্রলেখা।
চলবে…