চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে অন্তিম পর্ব (১ম অর্ধাং)

0
2370

#চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে
অন্তিম পর্ব
১ম অর্ধাংশ

৬ বছর পর।

নায়াগ্রা ফলস! অবাক বিস্ময়ে তাঁকিয়ে আছে সৌহাদ্র। হঠাৎ করেই উৎফুল্ল মুখটায় মেঘের ঘনঘটা! অনন্যা ভ্রুকুঞ্চন করে তাঁকায়।

” মাম্মা, আমি এটা সামনে থেকে দেখতে চাই। নিশ্চয়ই সামনে থেকে দেখতে আরও সুন্দর! ”

” অফ কোর্স, তুমি এটা সামনে থেকেই দেখবে। নেক্সট মান্থেই তো আমরা কানাডা চলে যাচ্ছি তখন নিয়ে যাব।”

সৌহাদ্রর মুখটা আর আগের মত উৎফুল্ল হয়ে উঠল না। মুখটা আমষেটে বানিয়ে বলল,
” বাবা, কী কানাডাতে থাকে মাম্মা?”

অনন্যা চমকে উঠল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে বলল, ” না। কিন্তু কেন বাবা?”

” যদি বাবা আসে! আমরা এখান থেকে চলে গেলে বাবা আমাদের খুঁজে পাবে কী করে?”

” বাবার তো অনেক কাজ। কী করে আসবে? আসবে না তো! তাছাড়া আসলে তো আমাকে ইনফর্ম করেই আসবে। তুমি টেনশন নিও না। প্লিজ এনজয় মাই বেবি।”

“বাবা, আমাকে একদম ভালোবাসে না। কেবল তোমার সাথেই কথা বলে!”

” না, বাবা তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। বাবা তো অনেক বিজি থাকে ওখানে টাইম শিডিউল এখানের থেকে পুরা উলটো। তাই তোমার সাথে কথা বলতে পারে না। মন খারাপ করে না বাবা। আমাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করে, সবসমই করে।”
” সত্যি বলছ!”
” ইয়েস! এবার একটু হাসো।” সৌহাদ্রর মুখটা মুহুর্তেই হাসিতে জ্বলজ্বল করে উঠে। অনন্যা বেশিক্ষন তাঁকিয়ে থাকতে পারে না সেদিকে।

★★★★★

দুই তিনবার রিং হওয়ার পর কল ব্যাক করে রিজভী। বরাবরের মতোই কানে ধরে বসে থাকে মায়ের ঝঁজালো কন্ঠস্বর শুনার অপেক্ষায়। কিন্তু আজ ঝাঁজালে গলাটা আর শোনা গেল না…
” তোর ওখানে অনেক রাত জেগে আছিস কেন?”
” আমি ঘুমিয়ে গেলে ফোনটা কে ধরত।”
” রিজভী, আমি একা হাতে তোকে মানুষ করেছি। তুই আমার সন্তান। আমার গোটা পৃথিবী তুই! তোর এত উদাসীনতা, বৈরাগ্যতা এত দূর থেকেও আমি অনুভব করতে পারি। বাবা, বুড়ো বয়সে একটু শান্তি ছাড়া আর কীইবা চাওয়ার আছে তোর থেকে।”
” মা প্লিজ, তোমার শান্তির জন্য এখন অন্য কোন মেয়ের জীবন আমি অশান্তিতে ভরিয়ে দিতে পারি না।”
” অন্য কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করতে নাই চাস তো তার কাছেই ফিরে যা! তবু জীবনে থিতু ‘হ। আমার আর কী চাওয়ার আছে, তোকে সুখী দেখতে চাওয়া ছাড়া।”

” তুমি না খুব সেলফিস! এসব তোমার দ্বারাই সম্ভব। ওঁর বাবা মাকে তুমি যে অপমান করেছিলে এরপর ওর নাম তুমি নাও কী করে! কেবল তোমার জন্য ওঁর বাবা মা ওঁর মুখও দেখতে চাইত না। ছিঃ মা।”

” রিজভী! আমার দিকটা ভেবে দেখত। যে মেয়ে অঙ্কনের সাথে বিয়ের আগে ফষ্টিনষ্টি করে পেট বাঁধিয়ে তোর ঘাড়ে ঘচাঁতে চায় তাকে আমি কী করে মেনে নেই।”

” এনাফ! মা প্লিইজ! বাচ্চাটা অনন্যা আমার ঘাড়ে ঘচাঁতে কোনদিনও চায়নি। অনন্যা অমন মেয়েই না। বরং আমিই চেয়েছিলাম। মন থেকে চেয়েছিলাম। কিন্তু চাইলেই কী সব পাওয়া যায়? ” রিজভী বিদ্রুপের সুরে বলল।

” রিজভী, হাউ ডেয়ার ইউ? ওরকম একটা ফালতু ইস্যুতে কেন নিজেকে জড়ালে? আমার মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় হয় এইসব ভাবতে বসলে। যেখানে অঙ্কন হা্টু গেঁড়ে বসে দাবি করছিল বাচ্চাটা তার। সেখানে তুমি আর অনন্যা
বলছ কীনা এটা তোমাদের বাচ্চা। কেন রিজভী এতটা খামখেয়ালিপনা কেন?, জীবনটাকে কী পুতুল খেলা মনে হয় তোমার কাছে? যাকগে, ওই বিদঘুটে সময়ের কথা আত ভাবতেও চাইনা। এবার অন্ততঃ স্বীকার করো বাচ্চাটা তোমার নয়?”

রিজভী ফোনের ওপাশ থেকে বেশ অদ্ভুতভাবে হাসছে। ভয়ার্ত চোখে তাকান উনি। হঠাৎ সুর পালটে রিজভী বলল,
” বড্ড হাসালে!, ক’বছর ধরে তো হাসতেই ভুলে গেছি। থ্যাংকস অ্যা লট!”
” হোয়াট? ”
” হোয়াট, ফোয়াটের কিছু নাই তো মা। বাচ্চাটা অনন্যার! তাই তার নিজের বাচ্চা নিয়ে সে হারিয়ে গেছে কোন অজানায়। তোমার ছেলে মনের জোরে, এক পৃথিবী সমান ভালোবাসা দিয়ে তাকে বাঁধতে চেয়েছিল। পারেনি মা। হেরে গেছি আমি। আজন্ম হেরে গেছি। অঙ্কন না থেকেও অনন্যার সবটা জুড়ে রয়েছে সেখানে রিজভীর কোন স্থান নেই, গট ইট।”

” এত ভালোবাসা যখন তখন এতবড় দূর্ঘটনা ঘটে কী করে?”
” একসিডেন্টের ব্যপারে কারো হাত থাকে না, মা। এই ব্যপারে না অনন্যা না আমি কেউ দায়ী নই এটা একটা সেন্সিবল মানুষ হয়ে কেন বুঝতে পারো না।”
” আমি বুঝলেই তো আর সোসাইটি বুঝে যাবে না! রিজভী ওই মেয়েটা অঙ্কনকে খেয়েছে এবার তোমাকেও খাবে।”

” ওহ্, রিয়েলি। আমি তো সেই কবেই মরে গেছি নতুন করে আর কেমনে মরব। এই প্লিজ ফোন কাট না হয় আমি কেটে দিচ্ছি। এরপর আমি উল্টাপাল্টা কিছু বলে দিব ও তোমার সইবে না।” রিজভী থম ধরা গলায় কথাটা বলেই ধপাস করে লাইন কেটে দেয়।

★★★★★★

মেসেঞ্জারে রিং হচ্ছে, পরিচিত মুখ ভাসছে। বারবার ধরতে না চেয়েও কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন হাতে তুলে নেয়। এই সময়টা অনন্যার একার। ডিনার শেষে সৌহাদ্র ঘুমিয়ে গেছে। এইতো সময় স্মৃতি আকঁড়ে ধরে রাত পার করার। তারপর সকাল হলেই আবার রঙচঙ হীন জীবন টাকে টেনেহিঁচড়ে সুখী মানুষের মুখোশ পড়াতে হবে। এইতো জীবন! এটাই হয়তো চেয়ে এসেছিল!
শেষ বারের মত পূর্বের ফেসবুক একাউন্টে ঢুকেছিল। কত স্মৃতি, কত ছবি, কত রোমাঞ্চকর মুহুর্তে ছিল অঙ্কন আর তার। সব নতুন করে দেখার শখ হয়েছিল। তাই ঢুঁকেছিল।

কিন্তু থামতে হয় অনিকের ফোনে! ধরবে কী ধরবে না ভাবাভাবির ঠিক মাঝামাঝিতে ফোনটা কখন ধরেছে সে খেয়াল নেই। হয়তো অবচেতনেই!
” অনন্যা!, একবার কথা বল! বলনা কেমন আছিস? একবার ভাইয়া বলে ডাক! ডাকনা! মনে হয় কত যুগ ধরে শুনিনা। অনন্যা কথা বল, বলনা!”
অনিকের নিঃশ্বাসের উঠানামা, কান্নার শব্দ সব অনন্যা শুনতে পাচ্ছে। এই ফোনটা কেন ধরেছে সে! এই নির্বাসিত জীবনে দূর্বল হওয়ার বিন্দুমাত্র স্থান তার নেই।
” ভাইয়া!” অনন্যার কাঁপা কাঁপা গলায় বলা কন্ঠস্বর চিনতে অনিকের এক্টুও ভুল হয়না। আনন্দে দু’চোখের কোণ ভিজে যায়।
” আমি ভালো আছি। আমার জন্য কোন চিন্তা করিস না। তোরা ভালো থাকিস। আমি মন থেকে চাই তোরা ভালো থাক। প্রতিটি মোনাজাতে দু’চোখ ভিজাই তোদের কথা ভেবে ” অনন্যা যন্ত্রের মত বলল।
” অনন্য, তোকে ছাড়া কী করে ভালো থাকি! ভালো থাকাটা ভুলে গেছি আমি চিরদিনের জন্য।”
” ও কথা বলিস না! আমি তো ভালো আছি। বললাম তো! আমি আর আমার পৃথিবী সৌহাদ্র
ওঁকে নিয়েই যাচ্ছে দিন।”

” অনন্যা, একবার বল না কোথায় আছিস? তোর সৌহাদ্রকে একবার তার পঁচা মামা টাকে দেখাবি না! শুধু একবার দেখব, একটাবার তোকে জড়িয়ে ধরব। প্লিজ বল না!”

” না রে! বাবা মাকে দেখে রাখিস। অন্বেষা কষ্ট পাবে আমার সাথে কথা বললে। ওঁ আমাকে ঘৃনা করে। তুই ফোন রাখ প্লিজ! ওর কাছে যা! মেয়েটা বড্ড অভিমানী। ”

” অনন্যা সেদিন তুই কেন আমায় বিয়ে করতে বললি, বল! আজকে অন্বেষা না থাকলে অন্তত তোকে এই একা ভীষণ কঠিন সময়টা পার করতে হত না। সবসময় কেন সবার কথা ভাবিস তুই? তোর কথা কে কবে ভেবেছে?”

অনন্যা থামিয়ে দেয় অনিককে। ” ভাইয়া, অন্বেষার তো কোন দোষ নেই। ওর দিক থেকে কিন্তু ও ঠিক। পরোক্ষভাবে হলেও অঙ্কনের চলে যাওয়ার জন্য তো আমিই দায়ী। গোটা পৃথিবীর কাছে আমি অপরাধী। ন এবং আমি নিজে নিজের কাছে অপরাধী। এই অবস্থায় আমাকে মেনে নেওয়াটা কী সহজ ছিল! ছিল না ভাইয়া। ওর যায়গায় থাকলে আমিও এমন করতাম। আর অন্বেষা ওর পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে এক কাপড়ে সারা জীবনের মত সম্পর্ক ছিন্ন করে আমাদের বাসায় এসে উঠেছিল কেবল তোকে ভালোবাসে বলে! ভাইয়া, ওর বাবা মা এখন অব্দি ওকে মেনে নেয়নি তুই ওর দিকটা একটু ভাব। কতটা কষ্টে আছে সে। প্লিজ ওঁকে আর কষ্ট দিস না।”

” বাবা, মা তোকেও তো বলেছে তোর মুখ দেখতে চায় না। তুই আমার সাথেও যোগাযোগ রাখিস না। তাহলে তুই কী কম কষ্টে আছিস।”

” আমার দিকটা আলাদা, আমি অঙ্কনকে যে কষ্ট দিয়েছি তার তুলনায় এ কিচ্ছু নয় ভাইয়া। আমার দেয়া প্রতিটা আঘাত আমার অঙ্কনের সহ্য হয়নি তাই তো আজন্মের মত অপরাধী বানিয়ে চলে গেছে। তাই আমি স্বেচ্ছায় এই নির্বাসন বরণ করেছি ভাইয়া। আর বাবা মা যা,জেনেছে বুঝেছে তাই বলেছে। তাদের কোন দোষ নেই। সমস্যাটা আমারই, সৌহাদ্রকে পৃথিবীতে আনার চেয়ে বড় দায়িত্ব আমার কাছে কিছুই ছিলনা। এমনকি বাবা মা ও না। একটা অবৈধ সন্তানসম্ভবা মেয়েকে কোন বাবা মা মেনে নেবে তুই বল! তাও আবার তার পিতৃপরিচয় নিয়ে জটিলতা। এমন খারাপ মেয়ে যার জন্য বাড়ি বয়ে এসে কেউ এমন সব খারাপ কথা শুনায় যার জন্য তার বাবার হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হয়। এমন মেয়ের তো সমাজে মুখ দেখানোর কথাই না ভাইয়া। সেখানে আমি সিঙ্গেল মাদার হয়ে বেচেঁ আছি একটু তো লজ্জা হওয়া উচিৎ। ভাইয়া আমার থিউরি আলাদা, মরে গেলে তো বেচেঁই গেলাম। আমার প্রয়োজন আমৃত্যু শাস্তি। তাই তো সৌহাদ্রের সামনে সুখী মানুষের মুখোশ পড়ে জীবন্ত লাশ হয়ে বেচেঁ আছি। ”

” অনন্যা তুই থাম প্লিজ নিজেকে এতটা ছোট করিস না। আমি জানি বাচ্চাটা অঙ্কনের। আর সে মোটেই অবৈধ নয়। নিজের বাচ্চাকে অন্তত ইলিগ্যাল বলে অপমান করিস না। ওই মানুষটা আর নেই। তোর এইসব অভিমানী কথার গুরুত্ব কেউ দিবে না, কেন বুঝিস না। যার দেয়ার কথা সে চলে গেছে। আর কেউ অভিমান ভাঙ্গাতে আসবে না। কোনদিন না।”

” ভাইয়া, আমি এখনো বিশ্বাস করি অঙ্কন ফিরে আসবে। এমনও তো হতে পারে অঙ্কন সেদিন প্লেনেই উঠেনি। বল এমনটা হওয়া কী খুব কঠিন! বল না ভাইয়া অঙ্কন ফিরে আসবে। সেদিন জেদের বসে বলা কথাটাকে কেন ও সত্যি বলে ধরে নিল। কেন অপেক্ষা করল না আমার রাগ পড়ে যাওয়ার! এতটা অভিমান নিয়ে সে কেন চলে গেল ভাইয়া! এতটা অপরাধী হয়ে কিভাবে বাচঁব আমি। ভাইয়া জানিস অন্ধকারে আমি সৌহাদ্রের দিকে তাঁকাতেও পারি না। ভয়ে কেঁকিয়ে উঠি প্রতি মুহুর্তে গুমড়ে মরি। অবিকল যেন অঙ্কন শুয়ে থাকে। সেই নাক, সেই মুখ, চোখ, হাত, পা, চুল সব সব সব ” কঠিন পাথরসম অনন্যা আজ কাঁদছে। অনিক চাইলেও না জল মুছিয়ে দিতে পারছে আর না সান্ত্বনা দিতে। কী করে দিবে সান্ত্বনা। যদি অনন্যার কথাই সত্যি হবে তবে এতদিনেও কী অঙ্কন ফিরে আসত না। কোন খুঁজ পাওয়া যেত না। যদিও বডি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবুও অনেকেরই বড়ি পাওয়া যায়নি কিংবা সনাক্ত করার অবস্থায় ছিল না।

★★★★★

অনিক কয়েকবার হ্যালো, হ্যালো, করেও আর অনন্যার কন্ঠস্বর শুনতে পায়নি। ততক্ষনে সে চলে গেছে তার অতীত দর্পনে…

ইউনিভার্সিটিতে প্রথমদিন অঙ্কনের সাথেই গিয়েছিল। সেদিনই দেখা হয়েছিল রিজভীর সাথে। দেখার সাথে সাথেই চিনে ফেলেছিল। তানভীরের ফুফাতো ভাই মল্লিকা আন্টির ছেলে। ভাগ্যক্রমে নাকি দূর্ভাগ্যক্রমে ঠিক বলা যায় না। ওঁরা দুজনেই একই প্রফেসরের আন্ডারে পি এইচ ডি ক করতে এসেছিল। অঙ্কন বেশ উৎফুল্ল হয়েছিল রিজভীকে দেখতে পেয়ে। তীক্ষ্ণ চোখে তাঁকিয়ে অনন্যার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষন করা রিজভীকে তার মোটেও ভালো না লাগলেও আস্তে আস্তে বেড়েছে সখ্যতা আর আন্তরিকতা।

স্বপ্নের মত সাতটা দিন কাটিয়ে চলে যাওয়ার দিন বারবার অনন্যার মনে কুঁ গাইছিল, দুশ্চিন্তায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। কখনো কখনো অহেতুক দুশ্চিন্তাগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায় না সত্যি হয়ে কেমন যেন সামনে দাঁড়ায়।তখন ভূত -ভবিষ্যৎ দূর্বিষহ হয়ে সম্পর্কের ভীতটাই যেন নড়ে উঠে।

অঙ্কন চলে গেল নিজের চেনা গন্ডিতে আর অনন্যা পড়ে রইল এক নতুন দুনিয়ায়। নতুন নতুন বন্ধু, সম্পর্ক, পি এইচ ডির ব্যস্ত শিডিউল কোর্স ওয়ার্ক, রিসার্চ এরিয়া সিলেক্ট, প্রচুর গবেষণা পত্র পড়া সব ছাপিয়ে কেবল অঙ্কনের মুখটাই ভেসে উঠত। দুজন যতক্ষণ পারত চেষ্টা করত অফ টাইমে কানেক্টেড থাকতে। অনন্যা করত তার নতুন জীবনের গল্প অঙ্কন উৎফুল্ল হয়ে শুনতো। ততদিনে রিজভী আর অনন্যার বন্ধুত্বটা বেস্ট ফ্রেন্ডের পর্যায়ে চলে যায়। বিষয়টা অঙ্কনের অজানা ছিল না। এক্ষেত্রে তার পূর্ণ ইন্ধন হতো। এটুকু ভেবেই অঙ্কন স্বস্তি পেত বিদেশ বিভূইয়ে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু সে পেয়েছে।

অনন্যার আর অঙ্কনের গোপন বিয়ের এনিভার্সারি সামনে অঙ্কন মনে মনে অনেক প্ল্যান কষেছে তবে অনন্যার অজানা ছিল না। এনিভার্সারির আগের দিন অঙ্কনের ফ্লাইট ছিল । রিজভী আর অনন্যাও ভেবে রেখেছিল সারপ্রাইজ প্ল্যানের। নিনিত, সাইমন ছাড়াও রিজভীও ততদিনে জেনেছে বিয়ের ব্যপারটা।

অনন্যার শরীর খারাপের ব্যপারটা প্রায়শই অনন্যা কথায় কথায় বলে ফেলত। অঙ্কন ডাক্তারের কাছে যেতে বললে এক কানে ঢুঁকিয়ে আরেক কানে বের করে দিত। মনে মনে ঠিক করাই ছিল এবার ধরে বেধে হলেও ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে।

সেদিন খুব ভোরে অঙ্কন উঠে, নতুন ছবির প্রয়োজনে পরিচালকের সাথে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং এটেন্ড করার কথা ছিল। এরপর সন্ধ্যায় ফ্লাইট ধরার কথা। জিহাদ নেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে দেশের বাহিরে। না হলে গোটা ব্যপারটাই সে হ্যান্ডেল করত। এখন একা একা সব মেইন্টেইন করতে গিয়ে কেমন তালগোল পাঁকিয়ে যাচ্ছে।
মায়ের সাথে দেখা করতেই এসেছিল ড্রয়িংরুমে চেলসিয়াকে বসে থাকতে দেখে কেমন হতভম্ব হয়ে তাঁকায়। এখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে গোটা ব্যপারটাই যেন মাথায় উপর দিয়ে যাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল।
চেলসিয়া একা আসেনি। সাথে এসেছে, সাংবাদিক, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, এবং সিনিয়র অনেক আর্টিস্ট, পরিচালক অনেকেই যাদের অঙ্কন সম্মান করে। যারা ওঁকে ভালো বলেই জানে। সবচেয়ে বিস্ময়কর আবদার হলো চেলসিয়া নিজেকে অঙ্কনের বউ হিসেবে দাবি করছে আর স্যামপ্যাথি কুঁড়ানোর আশায় মেকি কান্নায় ভেঙে পড়ছে। অঙ্কন চিৎকার করে অস্বীকার করে, তীব্র ব্যথায় যখন দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে তখন চেলসিয়া ক্ষান্ত হয়নি। বরং মোক্ষম অস্ত্র চেলেছে। অঙ্কন বিস্ময়ে হতবাক চেলসিয়া কনসিভ করেছে আর তার বাচ্চার বাবা অঙ্কন। চেঁচামেচির এক পর্যায়ে নাসির, আখি আর সেদিনের সেই কাজীকে দেখতে পেয়ে অঙ্কনের মাথা দ্বিগুণ খারাপ হওয়ার যোগাড়। এরা এখানে কী করছে এই প্রশ্নটা করার আগেই। সবাই একযোগে বলল এই কাজী বিয়ে পড়িয়েছে সাথে কাবিননামাও দেখাল। নাসির আর আঁখি বলল ওরা চাক্ষুষ সাক্ষী। এই বিয়েতে ছিল। এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে জিততে চেলসিয়া তার প্রেগনেন্সির রিপোর্ট ও দেখাল। মোটামুটি পরিস্থিতি তখন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। বাকি সবাই তখন অঙ্কনকে বুঝাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। অঙ্কনের একটা কথাও তারা বিশ্বাস করল না। এতকিছুর পর অঙ্কন স্পষ্টভাবে বলে দিল চেলসিয়া আমার ওয়াইফ নয়। এই সব সাজানো নাটকের বলি আমি কেন হব। ওঁর যা প্রমাণ করার ও কোর্টে গিয়ে করুক। আর এটাই আমার শেষ কথা।
দৃশ্যপটটা হয়তো আরেকটু বদলাতে পারত কিন্তু অঙ্কনের ফ্যামিলিও তখন চোখের সামনে এতকিছু দেখে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিল। অনীলা তুমুল রাগে বলে দিল, ” যতই ময়ুর পুচ্ছ লাগাও না কেন কাকের বাচ্চা সবসময় কাকই হয়। ছিঃ এই দিন দেখার জন্য ছোট থেকে মানুষ করেছিলাম৷ যে ছেলে আমার শিক্ষা সংস্কৃতি সব মিথ্যে করে দিতে পারে তার মা হওয়ার বাসনা আমার নেই। চরিত্রহীন বাবার চরিত্রহীন ছেলে আজকের পর থেকে আমায় মা বলে ডাকবিনে। কক্ষনো আমার কাছে আসবিনে৷”

এই একটি কথাই অঙ্কনকে দূর্বল করে দেয়ার জন্যই যথেষ্ট ছিল। আর একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি৷ ছুটে চলে গিয়েছিল এয়ারপোর্টে সব ঝামেলা পেছনে ফেলে। এতটুকু ক্ষীণ আশা বুকে নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল হয়তো অনন্যা তাকে বুঝবে। নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে কেবল এতটুকুই আশার আলো ছিল সেটাও অনন্যার দুমড়ে মুচড়ে নিকষ আধাঁরে পরিণত করে দিয়েছিল।

এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা অনন্যা মেনে নিতে পারেনি। কারো সন্তান গর্ভে ধারণ করে কেউ কী মিথ্যে বলতে পারে! পারে না। কোন মা কক্ষনো মিথ্যে বলতে পারে না। চেলসিয়ার ফ্ল্যাটে ঘুমন্ত অঙ্কনের সাথে কতশত সেলফি। সিনেমায় পর্দায়
কত আবেগময় রোমান্টিক মুহুর্ত৷ এগুলো তো এমনি এমনি সফল হয়নি। দুজনের গভীর প্রেমের ফসল এইগুলো। তাহলে মাঝখানে অনন্যাকে কেন টেনে আনল? এত নাটক, নিখুঁত অভিনয় হয়তো অভিনেতারাই পারে! আর অনন্যা সে তো সাধারণ। সহ্য করতে পারেনি। সজ্ঞা হারিয়েছিল অনন্যা। সারারাত হাসপাতালে থেকে সকালে বাসায় ফিরেছে। মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত! অনিক এর কাজে বেরোতে হবে, গিয়ে ছুটি নিতে হবে। অনন্যাকে নিয়ে কোথা ও বেরিয়ে আসবে। এই ট্রমা থেকে ওঁকে বের করতেই হবে। অনিকের শার্ট খাঁমচে ধরে কিভাবে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে এই দৃশ্য কিছুতেই ভুলতে পারছে না। ইচ্ছে করছে অঙ্কনকে খুন করতে।
একা একা অনন্যাকে রেখে যাওয়ার ভরসা পাচ্ছিল না তাই রিজভীকে ডেকেছে।

ক্লান্ত দেহ আর দূর্বল মন নিয়ে অঙ্কন যখন অনন্যার দোড়গোড়ায় তখন দরজাটা রিজভীই খুলেছিল৷ তীক্ষ্ণ চোখে তাঁকিয়ে অঙ্কন অনন্যার খুঁজ করতেই রিজভী গমগম করে উঠে,
” কেন এসেছ? মেয়েটাকে কী মেরে ফেলতে চাও। অঙ্কন ভাই, প্লিজ অনন্যাকে ছেড়ে দাও। ও অসুস্থ! শরীরের কন্ডিশন ভালো না।”

অঙ্কন, কথাটা শোনামাত্র অনন্যার ঘরে দৌড়ে ঢুকে। রিজভী চিৎকার করেও ফেরাতে পারেনি। তবে পিছুও নিতে পারেনি৷ হয়তো সেই অধিকার অনন্যা তাঁকে দেয়নি।

বিছানায় বসা অনন্যার আলুথালু চুল, পাথরের মতো নিস্পৃহ চোখ মুখ দেখে অঙ্কন নিজেকে সামলাতে পারেনি। দৌড়ে গিয়ে হাঁটু জড়িয়ে ধরে ফ্লোরে বসে পড়ে।
অনন্যার কোন ভাবান্তর হলোনা। অঙ্কনের দু’চোখের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে অনন্যার পায়ে পড়ছিল।
” সবাই আমাকে ভুল বুঝছে অন্তত তুমি আমায় ভুল বুঝনা৷ প্লিজ!” অঙ্কনের কথাগুলো কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল।

অনন্যা এবার আর সহ্য করতে পারল না। পা ঝাড়া মেরে উঠে দাঁড়ায়৷ চিৎকার করে বলে,
” কেন এসেছ? কী চাও? আর কী পাওয়ার বাকি আছে। আর কোন অভিনয় দিয়ে আমায় ভুলাতে পারবে না। সব পারো তুমি! তোমরা সব পারো৷ প্লিজ চলে যাও…”

অঙ্কনকে হতভম্ব হয়ে তাঁকাতে দেখে অনন্যা দ্বিগুণ তেজ নিয়ে অঙ্কনের শার্ট খাঁমচে ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
” কেন করলে এমন? কী দোষ করেছি আমি? তোমার এই জটিল জীবনে আমায় কেন জড়ালে? চেলসিয়া তোমার ওয়াইফ তাহলে আমার সাথে কেন নাটক করলে? কেন এই মিথ্যে খেলায় আমায় জড়ালে?…”
প্রশ্ন করতে করতে অনন্যা ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। ওইমুহুর্তে অনন্যাকে থামানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল অঙ্কনের কাছে। তড়িৎগতিতে অনন্যার ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল সে। কিছুক্ষণ পর অনন্যাও শিথিল হয়ে আসে। সাড়া দেয় শরীরী ভালোবাসার আহবানে। অভিমান, কষ্ট, রাগ, জেদ শরীরী ভালোবাসার আহবানে কেমন কর্পূরের ন্যায় উবে যায়৷ ঠিঁক ততক্ষণ এই ভালোবাসা চলল যতক্ষন না মস্তিষ্ক সচকিত হয়ে উঠে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে