#চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে
পর্ব ৬৭
লেখা আশিকা জামান
শুক্রবার সকালে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়লো ওঁরা। মাঝখানে যাত্রাবিরতি হয়েছে দুবাইতে।
অনন্যা দু’চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সম্ভবতঃ ফিরে গেছে নষ্টালজিয়ায়। কিছু নষ্টালজিক ভাবনা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমানের গন্ডি পেরিয়ে অনেক অনেক পেছনে। হঠাৎ করেই মনের কোন এক কোণে বিক্ষিপ্ত প্রশ্নরা উঁকিঝুঁকি খায়। তার জীবনটা এত নাটুকীয় কেন? অবাক বিস্ময়ে চোখ খুলে সে।
শরীর ঘেঁষা উত্তপ্ত স্পর্শ মনে করিয়ে দেয় আরও একজনের উপস্থতি। আলতো হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে চুপটি করে বসে আছে। দীঘল চোখের পাপড়ি মেলে কেমন অপরাধী চাহনিতে চেয়ে আছে। কখন তার প্রিয়দর্শীনীর অভিমান ভাঙবে সে আশায়।
ওই চোখের অতলে বেশিক্ষন তাকাতে পারলো না সে। চোখ নামিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
পাশে বসে থাকা মানুষটা হয়তো অভিনয় আর বাস্তবতাটাকে প্রায়শই গুলিয়ে ফেলে। না হলে এত নাটকীয় ভাবে কেন সবসময় চমকে দিতে ভালোবাসে।
এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে আসা সব ক’টা প্রিয়মুখের মাঝে অনন্যা বারবার অঙ্কনকে খুঁজেছে। ব্যর্থ হয়ে রাগে, দুঃখে, সীমাহিন জেদে দাঁতে দাঁত চেঁপে থেকেছে। যখন একদম নিশ্চিত হয়ে যায় অঙ্কন আর আসবে না । তখন হাল ছেড়ে দিয়ে অনিকের হাত ধরে পেছন ঘুরে হাটা শুরু করে।
আর পেছনে তাকানোর সাহস হয়নি। এতগুলো প্রিয় মুখের চোখের জল দেখার সাহস তার নেই।
আরও একবার পেছনে ফেরার কথা সে চিন্তাও করেনি৷ কখন এসে দাঁড়িয়েছে অঙ্কন, অনন্যার জানার কথা নয়। চেনা সুরের ডাকে অনন্যা প্রথমে হকচঁকিয়ে উঠলেও হ্যালুসিনেশন ভেবে উড়িয়ে দেয়।
অনিক মুচঁকি হাসছিল। এই অঙ্কনটা এত ছেলেমানুষ, এর কার্যকলাপে সত্যিই না হেসে উপায় নেই।
” ম্যাডাম, এত কষ্ট করে আসলাম এবার আমায় ফেলেই চলে যাবেন না-কি!” অঙ্কন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
অনিক বোনের দুই কাধ ধরে ঘুরিয়ে দেয় পেছন দিকে। অনন্যা যেন বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝখানে দুলছিল। কেবল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে থাকলো। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করলো না। এমন একটা ভাব নিল যেন এটাই হবার ছিল। অঙ্কন আসায় সে একটুও চমকায় নি।
অনন্যার এই হিমশীতল দৃষ্টি অঙ্কনের কাছে বড় অচেনা। একটু একটু করে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এই অচেনা দৃষ্টিই যথেষ্ট। ভেবেছিল রাগে দুঃখে অনন্যা তাকে ইচ্ছেমতো মারবে কিংবা দু’চোখের নীচে সাত সাগরের অশ্রু জমা করবে। কে জানে সবার সামনেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সে সবের কিছুই হলো না। ভেতরে ভেতরে সেও চুপসে গেল। তবে এত সহজেই হেরে যাবার পাত্র সে নয়। আরও ৭ দিন থাকবে অনন্যার সাথে এই কয়েকদিনে ঠিক মানিয়ে নেয়া যাবে৷ মনস্থির করে অনন্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
আহনাফ সাহেবে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলেন। মেয়েটা বড্ড অভিমানী দু’চোখ জুড়ে কেবল মেঘের আসা যাওয়া। মেয়ের জন্য মনে মনে হয়তো অঙ্কনের মত এমন চমৎকার মনের মানুষই চেয়েছিলেন। আজঁ আর কোন সংশয় মনে রইলো না। প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন।
গলাটা কয়েকবার কেশে পরিষ্কার করে নিল অনন্যার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। আশানুরূপ ফল পাওয়া গেল না। ভেতরে ভেতরে অনেকটা অধৈর্য্য হয়ে উঠলো। অপেক্ষাকৃত নীচু স্বরে বলল,
” আর কত গাল ফুলিয়ে থাকবে। একবার তো তাকাও! আমাকে দেখতে কী এতোটাই খারাপ লাগছে। ”
কোন উত্তর দিলোনা কেবল রক্তিম চোখে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো।
অঙ্কন উশখুশ করতে থাকা মুখটা দেখতে পেয়ে অনন্যা গলায় ঝাঁজ ঢেলে বলল,
” শান্ত হয়ে বসতে পারছ না। এত অস্থির হওয়ার কিছু হয়নি।”
” আমার বউ গাল ফুলিয়ে বসে আছে আর আমি অস্থির হবোনা!” অঙ্কন আৎকে উঠে বলল।
” অঙ্কন, প্লিজ… ” অনন্যা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। দুচোখের কোণ ভিজে যাচ্ছে। অঙ্কন জানে না। জানতে দিতে চায় না সে, তাই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। এতগুলো প্রিয় মুখ, প্রিয় কিছু স্মৃতি তাকে কুঁড়েকুড়ে খাচ্ছে। এই মুহুর্তে বড্ড দিশোহারা লাগছে।
অনন্যা দু’চোখ বন্ধ করে চুপ করে সিটে মাথা হেলিয়ে বসে থাকল।
” অন্ততঃ, আমার দিকে ঘুরে তাকাও। কখন থেকে মুখটা ঘুরিয়ে রেখেছ।” কথাটা বলতে বলতেই প্লেন চলতে শুরু করে দিল।
অঙ্কন আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। কিংবা বলতে পারল না। ফাইনাল টেক-অফ করার আগে কিছু সতর্কতা মূলক নির্দেশনা দেয়া হচ্ছিলো। টেক-অফ করতে কিছুটা সময় লাগলো। সীট বেল্ট এলার্ম বা স্মোকিং এলার্ম হিসেবে বিকট শব্দ শুরু হলো। অনন্যা ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করেও সহ্য করতে পারছিল না। একসময় অঙ্কনের দু’হাত খামচে ধরে ভয়ার্ত চোখে তাকায়। অনিক বসেছিল সামনে। ঘাড় ঘুরিয়ে অঙ্কন অনন্যার দু’হাত এক হতে দেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। প্লেন একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে যাবার পর সিগন্যাল বন্ধ করে দেয়া হলেও অনন্যা যক্ষের ধনের মত অঙ্কনের হাত আঁকড়ে ধরেছিল।
” খুব ভয় করছিল বুঝি!”
অনন্যা কেবল ঘাড় নাড়লো। কিছু বলল না।
” সেই তো পারলে না। অযথা, কেন রাগ করে নিজে কষ্ট পাচ্ছ আর আমাকেও দিচ্ছ।” অনন্যা প্রতিউত্তরে আরও একবার চোরা চোখে চাইলো।
অঙ্কন অনন্যার মুখটা দু’হাতে ছাপিয়ে ধরে। মাথাটা, কিঞ্চিৎ ঝুঁকিয়ে এনে আধভাঙ্গা গলায় বলল,
” কষ্ট হচ্ছে, বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে বুঝোনা তুমি!”
” আমারও হয়। আমাকে কেউ ইগনোর করলে বিশেষ করে সেই মানুষটা যদি তুমি হও।”
” সরি! আমি কেবল তোমায় সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। এই যে, আমি আমার সব কাজ থোড়াই কেয়ার করে কেবল তোমার জন্যই এলাম। কয়েকটা দিন কেবল তোমার সাথে কাটাবো বলে। এইটুকুর জন্যও কী তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারো না।” অনন্যার গভীর কালো কুচকুচে চোখের দিকে চোখ রেখে কথাগুলো বলল সে।
তখনো অনন্যা নিমেষহারা চোখে চেয়ে থাকল।
” তোমার অভিমানী মুখটা না আমাকে বড্ড টানে। তাই লোভটা সামলাতে পারিনি।”
অনন্যা মুখ বাঁকিয়ে বলল, ” তার মানে ভাইয়া সব জানে। জেনে বুঝে ইচ্ছে করেই তুমি এমনটা করলে! ওঁকে ফাইন, অভিমানী মুখটা দেখতে চাও তো! একদিন অভিমান করে অনেক দূরে চলে যাব সেদিন বরং খুশি হয়ো।”
” উঁহু যেতে দিলে তো! সাত সাগর তেরো নদীর উপারে গেলেও ঠিক জোর করে ধরে নিয়ে আসব।এরপর জাপটে ধরে রাখব। আমার ভালোবাসার শক্তিকে কী এতোটাই ঠুঁনকো মনে করো। ”
অনন্যা মৃদু হেসে বলল, ” সে দেখা যাবে ক্ষন। হয়েছে অনেক হয়েছে এবার থাম।”
নিউইয়র্কে যখন পৌঁছলো তখন শুক্রবার সন্ধ্যা। কিন্তু মাঝখানে কেটে গেছে প্রায় চব্বিশটি ঘণ্টা। কি অবাক ব্যাপার, তাই না! ঢাকায় কিন্তু তখন শনিবার সকাল হয়ে গেছে। অনন্যা অবাক চোখে এলোমেলো ভাবছিল। ইমিগ্রেশন অতিক্রম করে
পাঁচ ডলার নগদ ভাড়া দিয়ে একটি কার্টে করে বিরাট বিরাট সব সুটকেস নিয়ে ওঁরা বেরিয়ে এলো।
বিমানবন্দরের দরজা ঠেলে যখন বাইরে বেরিয়ে আসতেই , মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস মুখে এসে আছড়ে পড়ল। যেন তাদের স্বাগত জানাতেই এই বাতাসের আগমন। বিমানবন্দরে পৌছেই পরিচিত গুটি কয়েক বাংলাদেশী সাংবাদিকদের সাথে দেখা হয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যপার হলো এদের দেখে অঙ্কন মোটেই বিরক্ত হলো না বরং ধৈর্য্য সহকারে তাদের সাথে কথা বলল। এবং তাদের অনুরোধে ক্লান্তিতে বোধ হয়ে থাকা অনন্যাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ছবিও তুলে নিল।
ঝা চকচকে জন অফ কেনেডি এয়ারপোর্টে থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে ওরা যাবে ম্যানহ্যাটন, নিউইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্রে।
পরিষ্কার ঝকঝকে নীলচে আকাশের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রায় ত্রিশ মিনিট পর অনন্যার নজর পড়ে হাডসন নদীর দিকে। ওরা তখন রুকলিন ব্রিজে। ব্রিজের অপর পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে চকচকে ম্যানহ্যাটন শহর। চারপাশে গগনচুম্বী অট্টালিকা যেন শহরটাকে ঢেকে রেখেছে।
অবশেষে ওরা পৌছালো বিগ অ্যাপেলের শহরে।
সিড়ি বেয়ে লাগেজ, ব্যাগপেক তুলতে গিয়ে ওদের জানের তখন দফারফা। অনিকের তিন বেড রুমের এপার্টমেন্টে পৌছেই ক্লান্তিতে অনন্যার চোখ বুজে আসতে চাইল। পারলে তখনি ঘুমিয়ে পড়ে। অনিক বারবার করে সাবধান করলো,
” যা ফ্রেস হয়ে আয়। আমি ডিনার অর্ডার করে দিয়েছি। এখনি ঘুমিয়ে পড়িস না যেন, জেট ল্যাগের ধকল কিন্তু সামলাতে পারবি না।”
কে শোনে কার কথা৷ কোনরকমভাবে খেয়েছে কী না খেয়েছে, অঙ্কন, অনন্যা দুজনেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
চলবে…
???