চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
800

#চলো_না_হারিয়ে_যাই
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়
#অন্তিম_পর্ব

জোছনার আলোয় মিষ্টির বু”কের উঁচু অংশবিশেষ স্পর্শ বোঝা যাচ্ছে।বিষণ্ণ শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে চোখ সরাতে পারলো না।বিষণ্ণ বুঝতে পারলো নিজেকে সামলা রাখা আর সম্ভব না।দাবানলে ঝাপ দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলার সময় হয়ে এসছে।বিষণ্ণ তার কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মিষ্টির দিকে,ঠিক তখনি মিষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসলো।

বিষণ্ণ হকচকিয়ে নিজের হাত সরিয়ে নিলো।মিষ্টি কান্না করছে।কান্না করতে করতে সে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।বিষণ্ণর নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।ছিঃ এটা কি করতে গিয়েছিলাম?

বিষণ্ণ রুম থেকে বেড় হয়ে দেখলো মিষ্টি বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে।তার শরীর ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে।বোঝাই যাচ্ছে সে কান্না করছে।

বিষণ্ণ মিষ্টির পাশে দাঁড়ালো। নিজেকে তুচ্ছ এবং নর্দমার মতো নোংরা মনে হতে লাগলো বিষণ্ণর।মিষ্টির অশ্রুসিক্ত মুখ দেখে বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো

” মিষ্টি,আমি বুঝতে পারিনি কতবড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম।আমার মাথা কাজ করছিলো না,প্লিজ আমায় মাফ করে দাও ”

মিষ্টি চোখের জল মুছে বললো ” বিষণ্ণ একটা সত্যি কথা বলবি? ”

” আমি তোমার কখনো মিথ্যা বলি না ”

” তুই কি আমায় রাস্তার মেয়ে ভাবিস, যাকে ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যায়?তুই তো জানিস কতবড় মানসিক অবস্থা দিয়ে যাচ্ছি,জেনেও এত নীচু ভাবনা তোর মনে এলো? ”

মিষ্টির মুখে এরুপ একটা কথা শুনে বিষণ্নর মনে হতে লাগলো কেউ যেন ওর বু’কে ছু”রি বিঁধে দিয়েছে।মিষ্টি কি আজীবন তাকে এভাবেই ভুল বুঝে যাবে?কখনোই কি বুঝতে চেষ্টা করবে না? কথা সহ্য করতে না পেরে বিষণ্ণর চোখে জল চলে এলো।

বিষণ্ণকে চলে যেতে বাঁধা দিলো না মিষ্টি।ভোরের আলো দৃশ্যমান হবার পর মিষ্টি ঘরে গেলো।দেখলো ঘরে বিষণ্ণ নেই।মিষ্টি ঘুরে ঘুরে বিষণ্ণকে পুরো বাড়িতে খুঁজলো।কোথাও না পেয়ে মিষ্টি বুরো দাদুর ঘরে টোকা দিলো।সঙ্গে সঙ্গে তিনি দরজা খুলে বেড়িয়ে এলেন।মিষ্টি চিন্তিত গলায় বললো

” দাদু ঘরে বিষণ্ণ আছে? ”

তিনি চোখ মুখ কুঁচকে বললো ” ও তো বাড়িতে চলে গেলো।তোমায় জানায়নি? ”

” কিহ? বাড়িতে গেছে! কখন? ”

” অনেক্ক্ষণ হলো।তোমায় বলে যায়নি? ”

মিষ্টি হতভম্ব এবং বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

_________

বিষণ্ণকে বাড়িতে দেখে বিষণ্ণর বাবা বললো ” তুমি বাড়িতে আসবে আমায় জানিয়েছো? এখানকার অবস্থা জানো তুমি? গাঁধার মতো একটা কাজ করলে যে ”

বিষণ্ণ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।বিষন্নর মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বিষন্নর বাবাকে বললো ” বাড়ির ছেলে বাড়িতে আসবে না? কি এমন হবে আসলে? ”

বিষণ্ণর বাবা রেগেমেগে বললেন ” তোমার ছেলে তো এখানে পূজা করে গেছে,তাই না ”

” ছেলেটার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।এখন রাগারাগি থামাও তো ”

এটা বলে বিষণ্ণকে নিয়ে বিষণ্ণর মা ঘরে গেলেন।ঘরে গিয়ে বললেন

” কি হইছে বিষণ্ণ? তুই তো জানিস এখানের ঝামেলা এখনো চলছে,তবুও চলে আসলি কেন? ”

বিষণ্ণর চোখে জল দেখে তিনি হকচকিয়ে বললেন ” তুই কান্না করছিস কেন? কি হইছে? মিষ্টির সাথে কোনো ঝামেলা হইছে কি? ”

বিষণ্ণ ছোট বাচ্চার মতো ভ্যা ভ্যা করে কান্না করতে করতে বললো ” মিষ্টি সবসময় আমায় ভুল বুঝে মা ”

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো ” কি ভুল বুঝলো? ”

বিষণ্ণর কান্না থামছে না।রেগে গিয়ে তিনি বললেন

” ছোট বাচ্চার মতো প্যান প্যান না করে কি হইছে বল ”

মায়ের ধমক শুনে বিষণ্ন চুপ হয়ে গেলো।মিনমিন করে বললো ” কি হইছে বলতে পারবো না,লজ্জাজনক ঘটনা ”

” জরিয়ে ধরছিস? না চু’মু? ”

বিষণ্ণ প্যাঁচার মতো মুখ করে বললো ” ধরে নাও সেরকমই কিছু।আচ্ছা মা মিষ্টি এতো গাঁধি কেন?এই বুদ্ধি দিয়ে কিভাবে পরিক্ষায় টপ করে?এত্তো ভালোবাসি সেটা কি ও বুঝে না? ”

” এই ব্যাপার।তা মেয়েটাকে রেখে চলে এলি, ও তো একা ভয় পেয়ে যাবে ”

” রাগ লাগছিলো খুব।বলছে আমার নাকি নীচু ভাবনা।তুমি বাবাকে বলে ওকে আনার ব্যবস্থা করো ”

” সরাসরি এই বাড়িতে নিয়ে আসবো নাকি? ”

” না। ওর একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।আমার মতো ওকে কেউ ভালোবাসবে না সেটা ওকে বুঝাতে হবে ”

ছেলের পাকনামি কথা এড়িয়ে বিষণ্ণর মা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।বিষণ্ণ চেঁচিয়ে বললো ” আমার কথা কেউ শুনতে চায় না কেন?যথেষ্ট বড় হইছি তবুও আমার সিরিয়াস কথা কেউ পাত্তা দিবে না এটা কেমন কথা!”

মিষ্টি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।মিষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণর মা।মিষ্টি বললো ” আন্টি বিষণ্ণর সাথে একটু কথা বলায় দাও “।বিষণ্ণর মা বিষণ্ণর ঘরের সামনে মিষ্টিকে রেখে নিচে নেমে এলো।মিষ্টি বিষণ্ণর রুমের দরজায় টোকা দিলো।বিষণ্ণ দরজা খুলে মিষ্টিকে দেখে শক খাওয়ার মতো অবস্থা হলো।অজানা একটা আনন্দে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

কিন্তু না,এখন তো খুশি হলে চলবে না।রাগ দেখাতে হবে,প্রচন্ড রাগ।বিষণ্ণ প্রায় দরজা বন্ধ করবে তার আগেই মিষ্টি দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলো।বিষণ্ণ যতটা সম্ভব মুখ গম্ভীর করে বললো

” এখানে কি চাই ”

” তোকে ”

মিষ্টির এমন উত্তরে বিষণ্ণ মুখ ভোতা করে দাঁড়িয়ে রইলো।রাগ দেখাতে এখন কি করা উচিত? ঘরের কোনো বস্তু মেঝেতে আছাড় মা”রলে কি রাগ প্রকাশ পাবে? যেমন ভাবনা তেমনি কাজ।

মিষ্টি ভ্রু কুঁচকে বললো ” এইটা কি হলো? ”

” কি হইছে? ”

” কোলবালিশ মেঝেতে আছাড় দিচ্ছিস কেন?রাগ দেখাচ্ছিস নাকি? ”

বিষণ্ণ হকচকিয়ে গেল।এ কেমন মেয়ে! রাগ দেখাচ্ছি বুঝতে যখন পেরেছে তখন সেটা এভাবে কেউ বলে নাকি? এই মেয়ে দেখি রাগকে সম্মান করতে জানেনা।বিষণ্ণ চোখ মুখ কুঁচকে বললো

” নীচু মনমানসিকতার ছেলেরা এমনেই বালিশ ছোটাছুরি করে ”

” না বলে চলে এসছিস কেন? ”

” তোমায় বলে আসতে হবে নাকি?নীচু মনমানসিকতার ছেলে চলে আসলো না থাকতো সেটায় কার কি আসে যায় ”

বিষণ্ণর এমন বাচ্চা স্বভাব দেখে মিষ্টির হাসি পেলো।এইজন্যই তো ওকে এতোটা ভালোলাগে।মিষ্টি বিষণ্ণর খুব কাছে এসে দাঁড়ালো।বললো

” ভালোবাসিস? ”

বিষণ্ণর সব রাগ-অভিমান ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেলো।মিষ্টির মুখে ভালোবাসা শব্দটা শুনে বিষণ্ন ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মিষ্টি বললো

” তুই অনেক ভালো একটা ছেলে রে বিষণ্ণ।তোর এসব বাচ্চাসূলভ আচরণ সবসময় আমার ভালোলাগতো।আমি জানি তুই আমায় ভালোবাসিস ”

” আমি কাউকে ভালোবাসিনা ”

” আমি তোকে কত্তটা ভালোবাসি সেটা তুই কখনোই জানবি না রে ছোট গাঁধা।ভেবেছিলাম সেরাতে তোকে ভালোবাসার কথাটা বলবো।কিন্তু তার আগেই জীবনের কালো অধ্যায় নেমে এলো।সত্যি বলতে আমি ইচ্ছে করেই তখন তোকে বাজে সব কথা বলেছি।যেন কষ্ট পেয়ে তুই আমায় ভুলে যাস।আমার মতো বাজে একটা মেয়ে তোর যোগ্য না রে ”

” আমার ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখো? ”

” হু রাখি তো।সামান্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসায় যে ছেলে স্যারের বাড়ির জানালার ক্লাস ভেঙ্গে আসে,কলেজ থেকে রেস্ট্রিক্টেড হয়,প্রেমিকার গায়ে হাত রেখেছে বলে সাইকোর মতো বাড়িতে ঢুকে খু”ন করে আসতে পারে,তার ভালোবাসায় বিশ্বাস না রেখে থাকতে পারি? ”

বিষণ্ণ মিষ্টির কাছে এসে ওর হাত দুটো বু’কে শক্ত করে ধরে বললো ” মিষ্টি বিশ্বাস করো,তুমি আমার কাছে আগে যেমন পবিত্র ছিলে,এখনও ঠিক সেরকমই পবিত্র আছো ”

মিষ্টির চোখে জল চলে এলো।অশ্রুসিক্ত চাহনিতে বললো ” সবটা বুঝি রে,তবুও নিজের কাছে নিজেকে নর্দমার মতো মনে হয় ”

বিষণ্ণ মিষ্টিকে থামিয়ে দিলো।মিষ্টি কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিষ্টিকে বু’কে জড়িয়ে নিয়ে বিষণ্ণ বললো

” চলো না হারিয়ে যাই ”

_____________

কে’টে গেলো চারটা বছর।বিষন্ন এখন বাবার ব্যবসা সামলায়।চারটা বছরে বিষণ্ণ খুব সময়ের জন্য হেসেছে।সেই হাসিটাও মিথ্যা হাসি।সবসময় কেমন যেন একটা ব্লেকের মধ্যে থাকে।মাথায় সবসময় একটা কথাই ঘুরপাক খায়,চলো না হারিয়ে যাই।

মিষ্টির সাথে বলা শেষ কথাটা ছিলো চলো না হারিয়ে যাই।আশ্চর্যের ব্যাপার মিষ্টি কথারা রেখেছে।সে হারিয়ে গেছে,শুধু সাথে নেয়নি বিষণ্ণকে।রেখে গেছিলো একটা চিঠি।বিষণ্ণ রোজ ঘুমানোর আগে চিঠিটা বু’ক পকেট থেকে বেড় করে।চিঠির লেখাগুলিতে হাত বুলায়…..

বিষন্ন,তোর বয়স অল্প।এই বয়সে আবেগ বেশি থাকায় ঠিক ভুল বুঝার ক্ষমতা থাকে না।প্রথম প্রথম তোর কাছে আমাকে পবিত্র লাগলেও সময়ের সাথে সাথে তুই আমার প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলবি।এটাই নিয়ম।যতই ম্যাচিউর হবি তোর মধ্যে আমার জন্য একটা ঘৃণা তৈরী হবে।শুধু তোর না,আমি নিজেও তোর সামনে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে উপস্থাপন করতে পারবো না।আমি জানি তুই সমাজ কি বললো এসবে পরোয়া করিস না।কিন্তু দিনশেষে আমরা তো সেই সমাজেই থাকি।আমার জন্য তোর গোটা পরিবারকে লোকের কথা শুনতে হবে।আমাদের বিয়েতে লোকজন এসে বলাবলি করবে,”এই মেয়ে তো কলঙ্কিনি।বিয়ের আগে ধর্ষিত হয়েছে “।এসব কথা তুই,আমি কেউ ই আটকাতে পারবো না।যতদিন বেঁচে থাকবো এসব কথা শুনতেই হবে।ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানের উপরেও এর প্রভাব পড়বে।ওরা একটা ব্যক্তিত্ববান মা হারাবে।এতোসব নেগেটিভিটি শুধু শুধু তুই কেন নিবি?আমি অন্তত তোর কাছে আজীবন পবিত্র থাকতে চাই রে ছোট গাঁধা।প্লিজ আমায় ভুল বুঝিস না।আর হ্যা,এই চিঠিটা পাওয়ার সময় হয়তো আমি অনেক দুরে থাকবো,ভেবে নিস তোর আশেপাশেই আছি।আমার খুব কান্না পাচ্ছে রে ছোট গাঁধা।চলে যাওয়ার সময়টাতে তোকে দেখার ভাগ্যটাও হলো না।তুই সেরাতে কেন আমায় একটু জড়িয়ে করলি না,কেন হাতে হাত রাখলি না? কেন আমায় বু’কে জড়িয়ে নিলি না?ভালোবাসার মানুষের প্রতিটা এতটুকু জোরটাও খাটাতে পারলি না?এতো বোকা কেন তুই?।তোকে আর কখনোই ছোট গাঁধা বলে ডাকতে পারবো না ভেবে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে।তোর ভালোবাসার স্পর্শ আমার আর পাওয়া হলো না রে।ভালো থাকিস আমার সুপার হিরো।আর হ্যা,সুন্দর একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিস কেমন?

প্রত্যেকবার চিঠিটা পড়ার সময় বিষণ্ণর চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,তুমি চাইলেই আমরা দুজন হারিয়ে যেতে পারতাম।তুমি সেটা করোনি।একাই হারিয়ে গেলে।তাতে কি,তোমার স্মৃতি তো হারাতে দিই নি!

———–সমাপ্ত—————

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে