চরিত্রহীন পর্ব-১

0
2914

# চরিত্রহীন
# পর্ব-১
লেখাঃ আমিনুর রহমান

বিয়ের দুইমাস পর থেকেই আমি একটা বিষয় খুব করে লক্ষ্য করতাম। আমার বোন তানিয়া যখন আমার বাসায় আসতো আমার হাসবেন্ড তখন আমার সাথে ঘুমাতে চাইতো না। আমার সাথে না ঘুমানোর কারণটা আমি বুঝতাম না। তানিয়াকে যখন বলতাম তুই একা ভয় পেতে পারিস,আমার সাথে ঘুমাবি তুই। তখন সেও আমার সাথে ঘুমাতে চাইতো না। তানিয়া বলতো,ওর পাশে কেউ থাকলে নাকি ওর ঘুম আসে না। তাই আমার সাথে ঘুমাতো না। তানিয়া আসলেই তাকে নিয়ে আমার হাসবেন্ড বাহিরে ঘুরতে যেতো। অথচ আমাকে নিয়ে কখনো নিজের ইচ্ছাতে ঘুরতে যেতো না। আমি বলার পরেও দেখা যেতো না করে বসে আছে। এই বিষয় গুলো আমাকে ইদানীং খুব ভাবাচ্ছে।

আজকে তানিয়া এসেছে। তাঁর আসার খবর পেয়ে আমার হাসবেন্ড হাসান অফিস থেকে অনেক আগেই চলে এসেছে। অথচ কখনো তাকে রাত আটটার আগে আমি বাড়ি ফিরতে দেখিনি। রাতে ডিনারের সময় যখন বললাম,
“আমি কিন্তু একা ঘুমাতে পারবো না। আমার একা ঘুমাতে ভয় লাগে। তুমি না হয় তানিয়া যেকোনো একজনকে আমার সাথে ঘুমাতে হবে।”
তখন তানিয়ার মুখটা আর আমার হাসবেন্ড এর মুখটা কেমন যেনো কালো হয়ে গেলো। তখন আর আমার বুঝতে কোনো কিছু বাকি রইলো না। আমার সন্দেহের চাকাটা আরো জোরালো হতে শুরু করলো।

আমি যাদেরকে অনেক বিশ্বাস করি,অনেক সম্মান করি,অনেক ভালোবাসি। সেই মানুষগুলোই কি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে? আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে? অবশ্য এখন সবচেয়ে কাছের মানুষ গুলো যেমন খুব যত্ন করে কষ্ট দিতে পারে,তেমনি অতি বিশ্বাস প্রবণ মানুষগুলোই খুব সুন্দর করে বিশ্বাসঘাতকতা করার অপরিসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। দেখা যাবে আমরা যাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে বুকের খুব গভীরে আশ্রয় দিয়েছি একসময় সেই মানুষগুলোই বুকে ছুড়ি মেরে বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে যাবে। সেজন্যই হয়তো আমার মনে ভয় কাজ করছে। সত্যি যদি আমার সন্দেহটা সত্য হয় তাহলে হয়তো আমার বেঁচে থাকাটাই হবে না। যে দুজন মানুষকে ভালোবেসে আমি বেঁচে আছি তারাই যদি আমাকে ধোঁকা দেয় তাহলে হয়তো আমার থেকে হতভাগা মানুষ আর কেউ থাকবে না।

আমার সাথে তানিয়া ঘুমালো। আমার হাসবেন্ড অন্য রুমে ঘুমালো। তবুও আমার মনে শুধু একটা ভয়ই কাজ করছে আমার ধারণাটা বুঝি সত্যি হয়ে যায়। তাইতো ঘুমানোর পরে যখন তানিয়াকে বিছানায় দেখলাম না,তখন বুকের ভিতরটা কেমন জানি করে উঠলো। আমার সন্দেহটায় সত্যি হলো। আমি তখন আস্তে আস্তে কচ্ছপের চেয়েও ধীর গতিতে বিছানা থেকে উঠে আমার হাসবেন্ড এর রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। যখন দেখলাম হাসানের রুমের বাতিটা জ্বালানো তখন আমার সন্দেহট সত্য বলে মনে হলো। আমি দরজার কাছে গিয়েই দেখলাম দরজা লাগানো। ঠিক তখনই তানিয়া আমার গায়ে হাত রাখলে আমি কিছুটা কেপে উঠি। বুঝতে পারলাম তানিয়া বাথরুমে গিয়েছিলো। আমি শুধু শুধুই তাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা করেছি। হাসানও হয়তো ভুল করে বাতিটা নিভাতে ভুলে গিয়েছে। আমি আর তানিয়া সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ি।

পরের দিন সকালে তানিয়া আর হাসান বাসা থেকে একসাথেই বের হয়। হাসান তাঁর অফিসে চলে যায়। আর তানিয়া তাঁর একটা বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বাসা থেকে বের হয়। আমি মনে করতে পারলাম না এখানে তানিয়ার কোন বান্ধবীর বাসা। যদিও আমি তাঁর প্রায় সব বান্ধবীকেই চিনি,কিন্তু এখানে কার বাসা সেটা জানি না। যখন জিগ্যেস করলাম কার বাসায় যাবি তখন সে এমন একটা মেয়ের নাম বলল যেটা এর আগে কোনোদিন তানিয়ার মুখ থেকে শুনেছি বলে আমার মনে হয় না। আমি একা বাসায় বসে থাকি। আর অদ্ভূত সব চিন্তা করতে থাকি। নিজের প্রতি কেমন জানি ঘৃণা হতে লাগলো। কি সব চিন্তা করছি আমি। আর কেনোই বা এমন চিন্তা আমার মাথায় আসছে বুঝতে পারছি না। দুনিয়ায় এতো চিন্তা থাকতে আমার মাথায় কেনো ওই চিন্তাটায় আসতে হবে? নিজেই নিজের কাছে উত্তর চাইলাম কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না।

বিকেল তিনটার সময় তানিয়া বাসায় আসলো। যখন জানতে চাইলাম এতো দেরি করলি কেনো? তখন সে বলল অনেকদিন পর দেখা হয়েছে তাই আসতে দিতে চাইলো না। জোর করে চলে এসেছি। আমিও আর বেশি কিছু জিগ্যেস করলাম না।

কিছুসময় পর দেখলাম তানিয়া গোসল করার জন্য বাথরুমে গেলো। যে মেয়েটা শীতের কারণে ঠিকমতো গোসলই করতো না সেই মেয়েটা এতো শীতের মাঝেও আজ গোসল করছে এটা ভাবতেই কেমন জানি অবাক লাগছে। আবার মনে হলো মেয়ে মানুষ যেহেতু,সেহুত কোনো সমস্যা হতে পারে,সে কারণেই হয়তো গোসল করছে। কিন্তু তার ত্রিশ কিংবা চল্লিশ মিনিট পরে যখন আমার হাসবেন্ড হাসান বাসায় আসলো এবং সেও তানিয়ার মতো গোসল করার জন্য বাথরুমে ঢুকলো তখন আমার মনের সন্দেহটা ভূমিকম্প এর মতো জেগে উঠলো। মনে হলো বুকের ভিতর থেকে কোনো সন্দেহের প্রকান্ড একটা জলোচ্ছ্বাস বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। যেটা আমার জীবনটাকে দুমড়ে মুচড়ে গুড়িয়ে দিবে। আমার সংসারটা ভেঙে তসনস করে দিবে। আমি কাকে কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। তানিয়াকে বলবো? কিভাবে তাকে বলবো তুই কি আমার হাসবেন্ড এর সাথে? ছি! এটা আমি জীবনেও বলতে পারবো না। নিজের ছোট বোনকে কখনোই আমি এ কথা বলতে পারবো না। কিন্তু হাসানকে তো বলতে পারি। শুধু সন্দেহের বশে এই কথাটাও তো কাউকে বলা যায় না। তবে আমি হাসানকে বলবো কথাটা।

হাসানকে যখন রাতে জিগ্যেস করলাম,
“তুমি কি আমার থেকে দূরে যেতে চাইছো?”
তখন সে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
“এমনটা মনে হওয়ার কারণ কি? অফিসে একটু কাজের চাপ। তাই তোমাকে সময় দিতে পারছি না। এজন্য কেউ রাগ করে? তুমি ছাড়া আর কাকে ভালোবাসবো বলো?”

কথাগুলো যখন হাসানের মুখ থেকে শুনলাম তখন আমার ভিতরটা কেনো জানি জুড়িয়ে গেলো। আমি তাকে যে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম সেই কথাটা আর বলতে পারলাম না।

সকালে একটা কাজের জন্য বাহিরে যেতে হলো। যাওয়ার আগে যখন তানিয়াকে বললাম,
“তুই চল আমার সাথে। একা একা বাসায় বসে কি করবি? আমার আসতে অনেক দেরি হবে। বিকেলের আগে আসতে পারবো না। হাসানও তো সন্ধ্যার আগে আসবে না।”

তখন তানিয়া বলল,তাঁর নাকি প্রচন্ড মাথাব্যথা তাই সে আমার সাথে যেতে পারবে না। আমিও তাকে আর জোর করলাম না।

আমার বিকেলে আসার কথা থাকলেও আমি দুপরের কিছুটা আগে বাসায় চলে আসি। বাসায় এসে দেখলাম মেইন গেট খোলা। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি গেটটা লাগিয়ে বাহিরে গিয়েছিলাম। বাসায় ঢুকেই যে জিনিসটা দেখলাম সেটা দেখে খুব একটা অবাক হলাম না। তবে নিজের অজান্তেই দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।

আমার আপন বোন তানিয়া আর আমার হাসবেন্ড এক কাথার নিচে অন্তরঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। আমার সন্দেহটাই সত্যি হলো। আমাকে দেখে তারা নিজেদের কাপড় ঠিক করে আলাদা হয়ে কিছুটা দূরে সরে গেলো।

আমি তাদেরকে না দেখার ভান করে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলাম। কান্নাটা থামছে না। অনবরত চোখের পানি ঝড়ে চলেছে। আমার সংসারটা আমার বোনের হাতেই এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে কখনো ভাবিনি। তানিয়া কিভাবে পারলো এই কাজটা করতে? ওর কি আমার কথা মনে ছিলো না। হাসান তো জানতো আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি। নিজের থেকেও তাকে বেশি ভালোবাসি। তারপরেও সে এমনটা কিভাবে করতে পারলো? কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। বিশ্বাসী মানুষগুলোই খুব যত্ন করে ধোঁকা দেয়,যেটার প্রমাণ আজ আমার সামনে উপস্থিত।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে