চন্দ্রাণী পর্ব-১৫+১৬

0
472

#চন্দ্রাণী(১৫)
রাস্তা থেকে বাড়ি খানিকটা দূরে। টগর চন্দ্রকে হাসানোর জন্য বিভিন্ন গল্প করছিলো আর চন্দ্র মনে মনে ভাবছিলো,”কে বলবে এই হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলেটা ক্রিমিনাল,নেশাখোর? ছন্নছাড়া হয়ে গেলে কি মানুষ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আর? ”

টগর বিরক্ত নিজের উপর নিজে। একটা মেয়েকে ইমপ্রেস করা এতো টাফ?
আগে তো মনে হয় নি এরকম।কতো মেয়েই তো একবার একটা পজিটিভ সাইন পাবার অপেক্ষায় থাকতো। অথচ এই মেয়েকে কি-না সামান্য কফি খাওয়াতে রাজি করাতে গিয়ে ঘাম ছুটে গেলো, সেই সাথে কতো নাটক যে করতে হলো!
উফ বাবা!
কেমনে মানুষ প্রেম করে? কতটা অভিনয় প্রতিভা থাকলে মানুষ প্রেম করতে পারে টগর তাই ভাবছে।

চন্দ্রর কেমন আনইজি লাগছে। সকালে এসেছিলো তখন ইন্সপেক্টর নির্জর সাথে ছিলো, এখন আর কেউ সাথে নেই।এই লোকটা যদি চন্দ্রকে মেরে ফেলে?
অথবা যদি নিয়াজকে খবর দেয়?
কোন ভরসায় এলো চন্দ্র এখানে? বাড়িতে কাউকে তো বলে ও আসে নি যে এই বাড়িতে আছে।

নিজের বোকামির জন্য নিজের চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করছে চন্দ্রর।টগর লাউটা হাতে নিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো। তারপর চন্দ্রকে বসতে বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।সুপারি বাগানটার পরে টগরের ছোট চাচার বাড়ি।ওই বাড়িতে গিয়ে চাচাতো বোন রিমিকে ডেকে আনলো।

চন্দ্র একা একা বসে রইলো। তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। টগর ঘর থেকে বের হতেই চন্দ্রর মনে হলো ও বুঝি নিয়াজকে খবর দিতে গেছে।
কেমন আতংকিত লাগছে চন্দ্রর।

নিজেকে নিজে সাহস দিয়ে চন্দ্র বললো, “এতো ভেঙে পড়ছো কেনো?এর চাইতে দুঃসাহসিক কাজ ও তো তুমি করেছো চন্দ্র।শান্ত হও।”

মন বারবার ভয় পাচ্ছে অথচ মস্তিষ্ক বারবার বলছে কিছু হবে না,তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।

মন ও মস্তিষ্কের এই দোলাচলে ভুগতে ভুগতে টগর ফিরে এলো। রিমি চন্দ্রকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। টগর বললো, “আমার মেহমান উনি।একা একা বোর হবে ভেবে তোকে নিয়ে এলাম।তোরা গল্প কর,আমি কফি নিয়ে আসছি।”

রিমি তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “কেমন আছেন আপনি? ”

রিমি বিড়বিড় করে বললো, “ভালো আছি,আপনি? ”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কি নাম আপনার?”

রিমি বললো, “রিমি,আপনার নাম?”

চন্দ্র বললো, “আমি চন্দ্রাণী তালুকদার।”

রিমি তখনও হতভম্ব। টগর ভাইয়ের ঘরে একটা মেয়ে,কিছুতেই রিমি হিসেব মেলাতে পারছে না।এই মেয়েটাকে রিমি চেনে ও না।দেখে মনে হচ্ছে শহরের মেয়ে।কথাবার্তা,ভাবভঙ্গি সবই আলাদা।

রিমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, “আপনি কি টগর ভাইয়ের স্পেশাল কেউ?”

চন্দ্র বুঝতে না পেরে বললো, “কেমন? ”

রিমি গলা নামিয়ে বললো, “লাভার না-কি আপনি ওনার?”

চন্দ্র লজ্জিত হয়ে বললো, “আরে না,কি বলছেনে এসব?”

রিমি অবিশ্বাসের সুরে বললো, “মিথ্যা কথা কইবেন না আপা।কেউ না হইলে টগর ভাই এমনে এমনে কাউরে বাড়িতে আনে?আবার তার লাইগা কফি ও বানাইতে যায়?টগর ভাই তার ঘরে কাউরে জায়গা দেয় না।আমাগোরে ও না।মাঝেমাঝে আমার মা, আমি আসি এই বাড়িতে।যতই চেষ্টা করি একটু কিছু করে দেওয়ার,উঠান বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে দেওয়ার, ঘরটা মুছে দেওয়ার কিছুতেই উনি রাজি হন না।এমনকি গল্প করতে ও আসতে দেন না কাউরে।
একটা কাজের মেয়েও রাখতে চান না।পুরাই মহিলা মানুষ এভয়েড করে চলেন। অথচ সেখানে আপনাকে নিজে নিয়ে এলো?কিছু না কিছু তো আছেই।”
চন্দ্র হেসে বললো,”বিশ্বাস করুন,এরকম কিছুই না।উনি আমার পরিচিত শুধু। তাছাড়া এক গ্রামের মানুষ যখন একজন অন্যজনের বাড়ি আসতেই পারে। ”

টগর রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে কা*টা জায়গা বরাবর লাউটা আলাদা করে ফেললো। তারপর দ্রুতহাতে সবগুলো প্যাকেট বের করে নিলো।লাউটা আবারও আগের মতো জোড়া দিয়ে রেখে কফি বানাতে বানাতে মনে পড়লো এই লাউ যখন ওরা বাড়িতে নিয়ে রান্না করার জন্য কা*টতে যাবে তখন তো বুঝা যাবে এটা আগেই কাটা ছিলো।ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন করে রাখা পিৎজা বের করে ওভেনে দিলো টগর।
তারপর রান্নাঘরের দরজা খুলে দিলো যাতে ওদিকে শব্দ যায়।এরপর তাকের উপর থেকে শিল/পাটা ফেলে দিলো লাউয়ের উপর। মুহূর্তেই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেলো লাউটা।

ধপ করে ভারী কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে রিমি আর চন্দ্র দুজনেই ছুটে গেলো রান্নাঘরের দিকে। গিয়ে দেখে টগর অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চন্দ্রকে দেখে লজ্জিত হয়ে বললো, “এক্সট্রিমলি সরি চন্দ্রাণী,আসলে আমার সাথে ধাক্কা লেগে পাটাটা পড়ে গেলো নিচে।আপনার লাউটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ”

চন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, “না না,ছি!ওসব নিয়ে ভাববেন না।আপনার কোথাও লাগে নি তো?আপনি ঠিক আছেন?”

টগর হেসে বললো, “আমি ঠিক আছি।প্লিজ কিছু মনে করবেন না আপনি। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “কি যে বলেন। সামান্য একটা লাউ ছিলো।”

টগর মনে মনে বললো, “আপনার কাছে যেটা সামান্য লাউ আমার কাছে সেটা অসামান্য জিনিস। ”

পিৎজা বেক হতেই ওভেন থেকে বের করে নিলো টগর। তারপর ট্রে-তে করে কফি,পিৎজা সাজিয়ে সার্ভ করলো।
রিমি তখনও অবাক। টগর ভাই আজ প্রথম তার হাতের পিৎজা খাওয়াচ্ছে তাকে।অথচ কতো দিন ওরা সবাই মিলে বলেছিলো কখনোই রাজি হয় নি।রেষ্টুরেন্ট থেকে হোম ডেলিভারিতে ওদের বাড়ি পাঠিয়েছে। সবসময় বলতো আমার ছন্নছাড়া জীবন গুছিয়ে দিতে যে আসবে আমার জীবনে,তাকে খাওয়াবো আমার নিজের হাতের পিৎজা।
এই কি সেই তাহলে?

কফি খেতে খেতে চন্দ্র বললো, “আপনি পিৎজা ও বানাতে পারেন?”

রিমি ফোঁড়ন কেটে বললো, “আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না,ভাইয়া কখনোই ওনার বানানো পিৎজা আমাদের কাউকে খাওয়ায় নি।সবসময় বলতো যে তার বউ হবে তাকে খাওয়াবে শুধু।আজকে আপনার সুবাদে খেতে পারলাম। ”

টগর আড়ষ্ট হয়ে গেলো রিমির কথা শুনে। এটা ঠিক যে তার একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো এটা।কিন্তু আজকে চন্দ্রকে বাসায় এনে শুধু কফি খাওয়াতে ইচ্ছে করলো না। তাই বলে রিমি এরকম কিছু ভেবে নিবে তাও টগরের ধারণায় ছিলো না।

চন্দ্র বিব্রত হয়ে বললো, “আমি উঠি,বাসায় চিন্তা করবে।”

টগর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “চলুন,আপনাকে এগিয়ে দিই।রিমি,তুই চলে যা।”

রিমি বের হতে হতে বললো, “উনি কে টগর ভাই?”

টগর হেসে বললো, “চিনিস না তো তুই ও?উনি চেয়ারম্যান সাহেবের বড় মেয়ে।অবশ্য গ্রামে থাকে না উনি তাই চিনিস না। ”

চন্দ্র হাটতে হাটতে ভাবতে লাগলো টগরের কথা। ছেলেটাকে যতটা খারাপ ভেবেছে তা না।অনেক ভদ্র মনে হচ্ছে। অন্তত একা বাসায় চন্দ্রর খারাপ লাগবে ভেবে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে এই ব্যাপারটা চন্দ্রর ভীষণ ভালো লেগেছে। মানুষটার সবই ভালো অথচ কেনো এসব খারাপ কাজে জড়িয়ে গেলো?
অথচ এরকম একজন লয়্যাল মানুষ সব মেয়েই এক্সপেক্ট করে।

টগরের ভীষণ রিল্যাক্স লাগছে।কাজটা যতটা কঠিন হবে ভেবেছিলো ততটাই সহজ হয়েছে।পথেই ফোন এলো টগরের।রিসিভ করতেই নির্ঝর বললো, “টগর বলছো?”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “হ্যাঁ বলছি,বলুন।”

নির্ঝর বললো, “আচ্ছা, তোমার বাবার যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি জানো তুমি? ”

টগর শান্ত স্বরে বললো, “হ্যাঁ জানি।”

নির্ঝর বললো, “আমাকে তো বল নি এই কথা? আমি তো জানতাম তোমার বাবা স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছেন।”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনি তো জিজ্ঞেস করেন নি।আর এটা বলার মতো কোনো ঘটনা না।সেই সময় পুলিশ তদন্ত করে কোনো কিছু পায় নি।”

নির্ঝর বললো, “এই সময় পেতে ও পারে টগর। ”

টগর একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “আমার আর কোনো আশা নেই এসব ব্যাপারে। আমার মা থাকতে যদি জানা যেতো তাহলে হয়তো আমার আগ্রহের অন্ত থাকতো না।আমার মা এই কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন। এখন আর এসব জেনে কি হবে বলেন?আমার বাবা মা কেউ-ই ফিরে আসবে না।দুনিয়ার আদালতের বিচার আমার আর চাই না।বিচার হবে ওই দুনিয়ায় গেলে।প্রতিটি ধূলো কণা পরিমাণ সবকিছুর বিচার হবে।”

নির্ঝর বললো, “তুমি না চাইলেও আমি এর তদন্ত করবো।”

চলবে…

রাজিয়া রহমান

#চন্দ্রাণী(১৬)
শর্মী ফেসবুকে নিজের একটা ছবি আপলোড করলো। সাদাকালো একটা ছবি।এক গোছা চুল আলগোছে বাম গালের উপর ছড়িয়ে আছে। কানে গোঁজা একটা ফুল।

নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে।একটা মেয়ে এতটা স্নিগ্ধ কেনো হবে?যেনো আকাশে উড়ে বেড়ানো মেঘ,কেমন শান্তি শান্তি লাগে তাকালেই।নির্ঝর কমেন্ট করলো,”কারো সাদাকালো ছবি,কারো জীবনের রঙিন স্বপ্ন হয়ে ধরে দেয়।”

কমেন্টটা নিয়াজের নজরে আসে। শর্মী ছবি আপলোড করে আর কমেন্ট চেক করে নি। কাজে ছিলো।বিকেলে হঠাৎ কল আসায় কল রিসিভ করে চমকে উঠলো শর্মী।নিয়াজ নতুন একটা নাম্বার থেকে কল দিয়েছে তাকে।হ্যালো শব্দটা শুনে শর্মীর কেমন সারা শরীর কেঁপে উঠলো।

এক মুহূর্তের জন্য ভালো লাগলেও পরক্ষণে বিষের মতো জ্বালা ধরে উঠলো সর্বাঙ্গে যেনো।অত্যন্ত কর্কশ গলায় বললো, “কে আপনি? কাকে চাই?”

নিয়াজ খিকখিক করে হেসে বললো, “চিনতে পারো নি ডার্লিং? তোমার ভা*তার বলছি।”

শর্মী কেমন গা ঘিনঘিন করতে লাগলো এই ধরনের বাক্য শুনে।অথচ এই লোকটা কেমন মুখোশ পরে শর্মীকে ভালোবাসায় মজিয়েছিলো।

নিজেকে শান্ত রেখে শর্মী বললো, “আমি এখন আর এসব কুত্তা পালি না।”

নিয়াজের গালে যেনো জুতার বাড়ি মেরেছে এমন ফিল হলো। শর্মী এই ধরনের কথা বলতে পারলো?
নিয়াজের মাথায় রক্ত উঠে গেলো।বিড়বিড় করে বললো, “শা*লীর তেজ দেখি বাড়তেছে দিনদিন।পেটে অবৈধ বাচ্চা আসছে,মনে ভয় আসে নাই এখনো? ”

শর্মী হেসে বললো, “আমি বিশ্বাস করেছিলাম,আমার আল্লাহ তো জানে সেটা। আমার চিন্তা না করলেও চলবে।”

নিয়াজ খিকখিক করে বললো, “ক্যান,নতুন ইন্সপেক্টর কি ভালো করে চিন্তা করে না-কি? শালার চেয়ারম্যানের মাথায় সব জিলাপির প্যাচ।ইন্সপেক্টরকে হাত করতে এবার নিজের মেয়ে লাগাই দিছে।”

শর্মী রেগে গিয়ে বললো, “আমি তো দেখছি সেলিব্রেটি হয়ে গেছি,মানুষের কতো আজাইরা সময় থাকলে বসে বসে আমাদের ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করে। তবে আমার না এতো সময় নেই।আশেপাশে অনেক কুকুর আছে তো,তাদের ঘেউঘেউ অনেক শুনি।তাই ফোনে আবার ঘেউঘেউ শোনার ইচ্ছে নেই।রাখছি।”

কল কেটে শর্মী নাম্বার ব্লক করে দিলো।তার কেমন শান্তি শান্তি লাগছে এভাবে জবাব দিতে পেরে।যেমন কুকুর তেমন মুগুর না হলে হবে না।একটা বিশ্বাসঘাতককে কেনো সুযোগ দিবে?

কিন্তু ইন্সপেক্টরকে নিয়ে এসব কথা কেনো বললো নিয়াজ?

দেয়ালে ঘুসি মেরে নিয়াজ একটা গালি দিলো শর্মীকে।এতো তেজ তার?দুই দিন আগেও যেই মেয়ে ফোন করে কান্নাকাটি করতো তার এতো বদল কিভাবে?
কিচ্ছু হচ্ছে না নিয়াজের প্ল্যান মতো। ভালো লাগছে না নিয়াজের কিছু।সব গুবলেট হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলো শর্মীর ব্যাপারটা নিয়ে একটা ধামাকা হবে কিন্তু এখনো কিছুই হচ্ছে না। শর্মী কি তাহলে এবোর্শন করিয়ে ফেললো?
আবার ভেবেছিলো নীলির লাশ দিয়ে চেয়ারম্যানের ব্যাপারে মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকাবে কিন্তু তাও হলো না।উল্টো সবাই বলাবলি করছে চেয়ারম্যান এই কাজ কিছুতেই করবে না।কেউ তাকে ফাঁসাতে চাইছে।

নিয়াজের কেমন অশান্তি লাগছে।মনে হচ্ছে কিছুই করতে পারছে না সে।
সব মাল ডেলিভারি দিয়ে টগর এলো নিয়াজের সাথে দেখা করতে।গেঞ্জির ভেতর থেকে একটা বোতল বের করে খুলে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিলো অর্ধেকটা। তারপর বললো, “বুঝলেন ভাই,এই দুনিয়ায় কোনো শান্তি নাই।শান্তি শুধু এই ম**দের বোতলে আছে।”

নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বললো, “বাজে বকিস না।মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।”

টগর হেসে বললো, “একটা বোতল খোলো, সব মিটে যাবে।”

নিয়াজ কিছু বললো না।টগর পুরো বোতল শেষ করে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লো। নিয়াজ দুই তিন বার পা দিয়ে লাথি দিয়ে ডাকলো।টগরের হুঁশ হলো না।

টেবিলের উপর রাখা নিয়াজের ফোনটা বাজতেই নিয়াজ রিসিভ করতে এগিয়ে গেলো।

ওপাশ থেকে একটা ভারী স্বর ধমকের সুরে বললো, “গাছের ও খাবে,তলার ও কুড়াবে?মাল কিভাবে পালটায়?কে পালটায়?বেশ কয়েকদিন ধরে এই কমপ্লেইন আসছে।”

নিয়াজ আমতাআমতা করে বললো, “বস,আমি নিজেও বুঝতেছি না।”

ওপাশ থেকে রাগী মানুষটা বিরক্ত হয়ে বললো, “এভাবে হলে তোমাকে তো রাখা যাবে না।”

নিয়াজ মিনমিন করে বললো, “আমি আমার পুরো সিস্টেম চেক করতেছি বস।আমার একটা আবদার ছিলো আপনার কাছে। ”

ওপাশের মানুষটা বললো, “আগে নিজের সিস্টেমের সমাধান কর এরপর আমার সাথে কথা বলতে এসো।”

খট করে নিয়াজের মুখের উপর ফোন কেটে গেলো।নিয়াজ মুখ ভোঁতা করে বসে রইলো।মাথায় ঢুকছে না কাকে সন্দেহ করবে সে?
তার সাপ্লায়ার তো ৮ জন।এদের মধ্যে কে প্রতারণা করছে?
কিভাবে বুঝবে নিয়াজ?

টগরের দিকে চোখ যেতেই নিয়াজ আবারও গিয়ে দু-তিনটে লাথি দিয়ে ডাকতে লাগলো। সাড়া না পেয়ে এক মগ পানি এনে ঢেলে দিলো টগরের গায়ে।টগর লাফিয়ে উঠে বসতেই নিয়াজ বললো, “আমার একটা হেল্প লাগবে তোর।”

টগর দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বললো, “কি হেল্প?”

নিয়াজ কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “আমার সাথে কে প্রতারণা করতেছে সেটা বের করতে হবে খুঁজে। আমি এই দায়িত্ব তোকে দিলাম।”

টগর টলতে টলতে বললো, “ওক্কে বস,কাজ হয়ে যাবে।আমাকে একটা সিগারেট দিতে পারেন?”

নিয়াজ বললো, “দিচ্ছি এনে।”

নিয়াজ বের হয়ে গিয়ে টগরের জন্য সিগারেট নিয়ে এলো।এই মাতালটার ব্রেইন ভালো নিয়াজ জানে।মাতাল ম*দের লোভে সব করতে পারে।
সিগারেট ধরিয়ে টগর বললো, “আমার সাথে আপনি ও যাবেন কিন্তু,এক সাথে যাবো।আমি তো আপনার লোকদের চিনবো না।”

নিয়াজ বললো, “বেশ,তাহলে রাতে বের হবো।”

রাতে টগর আর নিয়াজ দুজনেই গেলো।নিয়াজ আড়ালে থাকলো,টগর কাস্টমার সেজে সবার থেকে মা*ল নিলো।
একজনের ব্যবসা এক স্পটে। টগর ভাবতো শুধু তার মতো বাউন্ডুলেরাই এসব করছে অথচ এখন দেখছে এদের মধ্যে কেউ কেউ আছে অতি ভদ্রলোক।

চেক করে দেখে সবার মাল-ই ভালো, অরিজিনাল মাল।
নিয়াজ এক দলা থুথু ফেলে বললো, “শা*লারা,সবদিন মনে হয় এরকম দু নাম্বারি করে না।”

টগর বললো, “আমারে তো চেক করলেন না।আমি ও তো হইতে পারি।”

নিয়াজ মনে মনে বললো, “তুই যে জাত মাতাল,নিজেই মানুষরে নেশা করতে কস।তুই আবার কি নকল মাল বেচবি। ”

মুখে বললো, “তোরে পরীক্ষা সবার আগে করছি। ”

টগর হাঁ হয়ে গেলো শুনে।

পরের দিন সকাল বেলা চন্দ্র টগরের বাসায় গেলো টগরের জন্য নাশতা বানিয়ে নিয়ে। আজ সাথে শর্মীকে নিয়ে গেলো।
টগর সবেমাত্র কফিতে চুমুক দিচ্ছে।পরনে একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর খালি গা।
দরজা নক হতেই টগর উঠে দরজা খুললো।মুহূর্তেই
লজ্জায় লাল হয়ে গেলো টগর চন্দ্রকে দেখে।চন্দ্র চোখ বন্ধ করে বললো, “আমি চোখ বন্ধ করে রাখছি কিন্তু,আপনি নার্ভাস হবেন না।”

এক ছুটে গিয়ে টগর টি-শার্ট পরে এলো।তারপর মুচকি হেসে বললো, “আসুন ভেতরে। ”

চন্দ্র হাসতে হাসতে বললো, “আসলে আমার বোন যখন শুনলো আমি গতকাল আপনার সাথে এসে গল্প করেছি ও বায়না শুরু করলো ওকে ও নিয়ে আসতে হবে।গতকাল আমি রান্না করেছি শুনে আজ আপনার জন্য নাশতা বানিয়ে এনেছে ও নিজেই।আমি জানি আপনি বিব্রত হবেন তার জন্য আগেই বলছি আমার বোন আমার মায়ের মতো। আমার মা সবাইজে রান্না করে খাওয়াতে পছন্দ করে। আমি ও করি আমার বোন ও করে। তাই শুরু করলো আসবে এখানে।আপনি কষ্ট করে আপনার ওই কাজিনকে ডেকে আনুন ন্স গতকাল যিনি এসেছিলেন।”

টগর হতভম্ব হয়ে বললো, “ঠিক আছে।”

বের হয়ে টগর মনে মনে বললো, “এদের কি মাথা খারাপ না-কি? এতো গায়ে পড়া স্বভাব কেনো?আমি কি বলেছি আসতে?”

টগর বের হতেই চন্দ্র ছুটে গেলো টগরের রান্নাঘরে। রান্নাঘরের উপরের শেল্ফের ওপর একটা ছোট ক্যামেরা ফিট করে আরেক ছুটে গেলো টগরের রুমে।
শর্মী বাহিরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলো।

টগরের রুমের চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে চন্দ্র দেখলো একটা বইয়ের সারি টগরের আলমারির উপরে।সেখানে একটা বইয়ের ভেতর আরেকটা ক্যামেরা রেখে এলো চন্দ্র।
তিনটি ক্যামেরা নিয়ে এসেছে।শেষ ক্যামেরাটা সেট করার আগেই টগর চলে এলো।

ভীষণ বিরক্তি নিয়ে টগর কথা বলতে লাগলো। চন্দ্র মনে মনে হাসলো।টগরের বিরক্তি চন্দ্র স্পষ্ট বুঝতে পারছে।অথচ তার কেমন জানি ভালো ও লাগছে টগরকে বিরক্ত করতে।
চন্দ্র বেশ খানিক সময় কাটিয়ে বের হলো শর্মীকে নিয়ে। টগর রিল্যাক্স মুডে চন্দ্রর আনা বক্সটা নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বসলো। এরপর ঢাকনা খুলতেই দেখে ঘি দিয়ে ভাজা পরোটার পাশে গরুর মাংস ভুনা।পরোটা র‍্যাপিং করে এনেছে যাতে ঝোলে মাখামাখি না হয়ে যায়।

টগরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বহুদিন পর কেউ তাকে এভাবে যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। মেয়েটার প্রতি বিরক্ত হলেও রান্না খেয়ে টগরের বিরক্তি মুছে গেলো।গরুর মাংসের স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো।
টগরের মনে হলো এটা চন্দ্রর রান্না।গতকাল কোনো এক ফাঁকে টগর বলেছিলো ঝালঝাল করে গরুর মাংসের ভুনা তার পছন্দ।
সত্যি সত্যি আজ তাই নিয়ে এসেছে মেয়েটা।

যেতে যেতে পথে শর্মী বললো, “আপা,রান্না করলি তুই,আমার নাম দিলি কেনো?”

চন্দ্র হেসে বললো, “পাগল, আমাকে নয়তো হ্যাংলা মেয়ে ভাববে।মনে করবে আমি বুঝি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই তার জন্য এসব করছি।”

শর্মী হেসে বললো, “এতো উতলা হয়ে কেনো তবে সাত সকালে বাজার থেকে তাজা মাংস আনালি?ফ্রিজের মাংস রান্না করিস নি তাজা মাংসের স্বাদ আলাদা বলে। ”

চন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললো, “বেশি বুঝিস তুই? আমি আমার কাজ করছি।আর মানুষ হিসেবে মানবতা,অথবা বলতে পারিস যেহেতু ওনার মা নেই তাই একটু মায়া হচ্ছিলো বলেই এটুকু করেছি।”

শর্মী হাসলো।সে জানে তার বোনের মনটা অনেক নরম।কারো মা বাবা নেই শুনলে চন্দ্র ভীষণ মন খারাপ করে। কিন্তু কেনো জানি তার মনে হচ্ছে এখানে অন্য কিছুও আছে।
দুই বোন এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে বাড়ি এসে দেখে নির্ঝর এসেছে। নীলির ব্যাপারটা নিয়ে শর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছে।
শর্মী মুখ ভোঁতা করে বসলো নির্ঝরের সাথে কথা বলতে। এই লোকটার কমেন্ট সে রাতে দেখেছে।দেখে মনে হয়েছে লোকটা ভীষণ বাজে।শর্মী তক্ষুনি তার আইডি লক করে ফেলে যাতে এই লোক আর তার ছবি দেখতে না পারে,কমেন্ট করতে না পারে।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে