#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১৮
#আর্শিয়া_সেহের
বরযাত্রী কে এভাবে ঘিরে ধরায় বিয়ে বাড়ির সকলেই অবাক হয়ে গেলো। অবাক হলো রাশেদের আত্মীয়-স্বজনরাও। রাশেদ বিপদ বুঝতে পেরে খুব দক্ষতার সাথে ফোন বের করলো রায়হানকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য। তনিম ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ছো মেরে ফোন নিয়ে নিলো। রাফিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ভাইয়া ওকে অ্যারেস্ট করো। আমি ওদিকটায় একটু ঘুরে আসি।”
বলেই রাশেদের ফোনটা নিজের পকেটে পুরে শিষ বাজাতে বাজাতে হাঁটা ধরলো।
রাফিন এসে রাশেদকে হাতকড়া পরিয়ে সবাইকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে বলা শুরু করলো। পুনমের মা, মামা-মামী সবাই ইতিমধ্যে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। রাশেদের কুকীর্তি শুনে পুনমের মামা বললো,
-“বরের ভাই খারাপ বলে বর খারাপ হবে এমন কোনো কথা তো নেই। রায়হানের এসবের সাথে সংযোগ আছে তার প্রমান কি?”
রাফিন ঠোঁট এলিয়ে হেঁসে বললো,
-“আপনি হলেন ঘরের শত্রু বিভীষণ টাইপের মানুষ। এক মূহুর্তের জন্য যদি ধরেও নেই যে রায়হান ছেলেটা ভালো তারপরও তো এখন কোনো কনেপক্ষই এ বিয়েতে রাজি হবে না। আগের হাল যেদিকে যায়, পেছনের টাও সেদিকেই যায়।
যাই হোক, আপনার সোনার ডিম পাড়া হাঁস মানে রায়হানও এই কুকর্মে যুক্ত আছে যা এক্ষুনি জানতে পারবেন। আর সমস্ত মেহমানদের উদ্দেশ্যে বলবো , আপনারা থাকুন আরো কিছুক্ষণ। বর-কনেকে দোয়া করে,খেয়ে তারপর যাবেন।”
পুনমের মামা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। উপস্থিত সকলেই একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এখানে কি হচ্ছে আর কি হবে কেউ ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না। যেখানে বরও অপরাধী সেখানে আবার বর কনেকে দোয়া করবে কিভাবে তারা? তবে রাফিনের কথামতো কেউই বিয়ে বাড়ি ছেড়ে গেলো না।
সকলেই রাশেদের দিকে ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যদি এখানে পুলিশ না থাকতো তাহলে হয়তো গনপিটুনি দিয়েই মেরে ফেলতো সবাই।
রাশেদ হুংকার দিয়ে বললো,
-“আমাকে অ্যারেস্ট করেছেন কোন সাহসে? কি প্রমান আছে আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কাছে? অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট দেখান।”
রাশেদের কথায় কেউ পাত্তা দিলো না।
কিছু সময়ের ব্যবধানে ডিআইজি স্যারের গাড়ি এসে থামলো পুনমদের বাড়ির সামনে। উর্বিন্তাও এসেছে বাবার সাথে। উর্বিন্তাকে দেখেই শান্ত বিন্দুকে নামিয়ে দিয়ে চুলে হাত দিয়ে স্টাইল করা শুরু করে দিয়েছে।
উর্বিন্তা সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
রাফিন উর্বিন্তাকে দেখিয়ে রাশেদকে বললো,
-“এই মেয়েটাই তোমার বিরুদ্ধে প্রমান। প্রত্যক্ষদর্শী । তাছাড়া আরো প্রমান আছে।”
রাফিন উর্বিন্তার দিকে তাকালো এটুকু বলে। উর্বিন্তা হালকা হেঁসে নিজের ফোনটা বের করে রেকর্ডিং অন করে দিলো। সেদিন লোকেশন অন করার সাথে সাথে রেকর্ডিংও অন করে রেখেছিলো উর্বিন্তা। যার ফলশ্রুতিতে সেদিন রাশেদ, হেলাল উদ্দিন এবং আরো কয়েকজনের কন্ঠ স্পষ্ট ভাবে শোনা যাচ্ছে ভয়েস রেকর্ডারে। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন রায়হান উপস্থিত ছিলো না তাই তার বিরুদ্ধে প্রমানের অভাব রয়ে গেছে।
ভয়েসে খুব ভালো ভাবে রাশেদের একটা কথা শোনা যাচ্ছে। সেটা হলো,
-“আমারে তো ওই ডিআইজি চিনে না। আমি রাশেদ হাসান। আমার সাথে টক্কর দিতে আসে। এবার নিজের মেয়ের চিন্তায় সবকিছু আওলায় যাবে বেচারার।”
রাশেদ চোখ বুজে ফেললো। এবার আর কোনোভাবেই নিজের পক্ষে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। সে এই মুহূর্তে উর্বিন্তার দিকে তাকিয়ে ভাবছে,’ আজকালকার পিচ্চিরাও কতটা অ্যাডভ্যান্স তা এই মেয়েকে না দেখলে জানা হতো না।’
প্রায় মিনিট দশেকের মাথায় তনিম রায়হানের কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো। রায়হান দূর থেকেই বুঝতে পারলো তাদের খেল খতম। বড় ভাইয়ের হাতে হাতকড়া পরানো। তনিমের পেছনেই আসছে বিথী এবং শান। সবার শেষে বেশ ভাবসাব নিয়ে রুশান আসতেছে।
ভাইয়া আর রুশানকে দেখেই শান্ত ভ্রু কুঁচকে ফেললো।তার ভাইয়া আর রুশান ভাই কখন এলো? ও তো দেখতেই পেলো না। অদ্ভুত তো।
আর এসেছে তো এসেছে, এতো ড্যাশিং হয়ে আসার দরকার কি এই ছেলের? এখন তো সবাই ওকে ছেড়ে রুশানের দিকে তাকাবে।
রায়হানের হাতে অন্য একজন অফিসার হাতকড়া পরাতে গেলেই রাশেদ গর্জে উঠে বললো,
-“ওকে কেন অ্যারেস্ট করছেন? ওর বিরুদ্ধে কি প্রমান আছে?”
রুশান হো হো করে হেঁসে উঠলো। এগিয়ে এসে রাশেদের কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“সব সময় এতো প্রমান প্রমান করেন কেন ভাই? আমরা হুদাই ধরে নিয়ে যাবো আপনার ভাইরে। কোনো সমস্যা?”
রুশানের হেঁয়ালি করে বলা কথায় গা জ্বলে উঠলো রাশেদের। রুশান রাশেদের কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ভাইয়ের মতো তোমারও কি প্রমান দরকার? নাকি নিজেই সব কিছু স্বীকার করবা?”
রায়হান একদম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বিরুদ্ধে প্রমান পাক বা ওকে ফাঁসি দিক সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই রায়হানের। তার সমস্যা পুনমকে নিয়ে। পুনমকে তার চাই। যেভাবেই হোক চাই।
রুশান বিথীর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“আপু প্রমানটা দেন।”
বিথী মুচকি হেঁসে চোখ থেকে চশমা খুলে রুশানের হাতে দিলো। রাশেদ ক্ষীপ্ত চোখে বিথীর দিকে তাকিয়ে আছে। এক্ষুনি যেন চিবিয়ে খাবে বিথীকে সে। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
-“চশমা? চশমা কিসের প্রমান?”
রুশান দাঁত বের করে হেঁসে বললো,
-“এটা যে সে চশমা না ব্রো, এটা স্পাই ক্যাম ওয়ালা চশমা।”
রুশান সব প্রমান ডিআইজি কে বুঝিয়ে দিলো। রাশেদ আর রায়হানকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো। রায়হান একবার পেছনে তাকিয়ে তার চাচাতো ভাইকে কিছু ইশারা করলো। তারপর সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেলো পুলিশের পিছু পিছু। এই ব্যাপারটা শান্ত ভালোভাবে খেয়াল করলো।
বরপক্ষের সবাই এক এক করে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো। পুনমের মামারও মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এমন জঘন্য মন মানসিকতা এই ছেলের তা উনি জানতেন না। এখন নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে তার। টাকাওয়ালা ছেলের কাছে পুনম সুখে থাকবে ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়েটাকে নিজেই জাহান্নামের রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছেন এটা ঘুনাক্ষরেও টের পাননি তিনি।
বরপক্ষ থেকে আসা শখানেক লোক বেরিয়ে যেতেই বিয়ে বাড়িটা বেশ ফাঁকা হয়ে গেলো।
রুমঝুম আর শাফিয়া বেগম পুনমকে ধরে বাইরে নিয়ে এলেন। পুনম আর শাফিয়া বেগম এতোক্ষণে রুমঝুমের কাছে সবটাই শুনেছে। শাফিয়া বেগম রুশান আর পুনমের সম্পর্কের কথাটাও জানলেন। পুনম তার জন্য এতো বড় ত্যাগ স্বীকার করছিলো ভেবেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন তিনি। রুমঝুম পুনম আর রুশানের বিয়ের জন্য প্রস্তাব রাখলো তখনই। শাফিয়া বেগম এবং আত্মীয়-স্বজন কেউই পুনম আর রুশানের বিয়ে নিয়ে মতবিরোধ করলেন না। ভালোবাসার পূর্ণতা পাক এটা তারাও চায়।
পুনম তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে সেই তখন থেকেই কেঁদে চলেছে । পুনমের চোখে চোখ পড়তেই রুশান চোখ টিপে দিলো। পুনম কাঁদতে কাঁদতেই ফিক করে হেসে ফেললো।
রুমঝুম সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমার বাবার প্রচুর অর্থবিত্ত থাকা সত্ত্বেও আমার আর আমার ভাইয়ের বিয়ে সাদামাটা ভাবে হয়েছিলো পরিস্থিতির চাপে। কিন্তু আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে এভাবে দিতে চাই না আমি। পুনম-রুশানের বিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই হবে। আপনারা সবাই সেখানে আমন্ত্রিত । আজ এই মূহুর্তেই ওদের দু’জনের এনগেজমেন্ট হবে। আগামী শুক্রবার বিয়ে। ওদের জন্য সবাই দোয়া করবেন।”
শান পুনমের মামার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু হেঁসে বললো,
-“তা মামা, আপনার কিছু বলার আছে এখানে? আমার শালাকে নিয়ে কিছু বলতে চাইলে বলতে পারেন।”
পুনমের মামা মাথা নিচু করে ফেললেন। পাশ থেকে পুনমের মামী বললেন,
-“লোকটা এমনিতেই বেশ লজ্জা পেয়েছে বাবা। উনাকে আর লজ্জা দিয়ো না। তবে রুশান ছেলেটাকে ব্যাক্তিগত ভাবে আমার ভীষন পছন্দের। পিহুকের বিয়ের সময় থেকেই আমার ভালো লাগে। আমার একটা মেয়ে থাকলে আমি রুশানকেই পছন্দ করতাম তার জন্য।”
পুনম অভিমানী কন্ঠে বললো,
-“আমি বুঝি তোমার মেয়ে নই, মামীমা।”
পুনমের মামী শব্দ করে হেঁসে বললেন,
-“হা হা পাগলী। তুই ই তো আমার মেয়ে।”
জিহাদ এক সাইডে নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পুনমকে এই একবছর তাদের বাড়িতে ,তার আশেপাশে বারবার দেখতে দেখতে কখন যে পুনমের মায়ায় জড়িয়ে পরেছিলো তা সে টেরও পায়নি। তার গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও কিভাবে যে এই মেয়েটার মায়ায় আটকে পড়েছে তা জিহাদ জানে না। যখন পুনমের বিয়ে ঠিক হয়েছে তখনই সে এই বিষয়টা অনুভব করতে পেরেছে। তবে বাবার ভয়ে এসব নিয়ে ভাবে নি জিহাদ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে তার গার্লফ্রেন্ডকে ঠকাবে না সে। পুনমের বিয়ের পরই বিয়ে করে নিবে।
জিহাদ রুশানের দিকে একবার তাকালো। একদিন তার সাথে থেকেই জিহাদ বুঝেছে ছেলেটা অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। ভীষণ ভালো আর বুদ্ধিমান একটা ছেলে। ধীর পায়ে হেঁটে পুনমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো জিহাদ। ঠোঁটে হাঁসি টেনে বললো,
-“তুই অনেক ভাগ্যবতী পুনম। এজন্যই রুশানের মতো কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাচ্ছিস।”
পুনম কিছু বললো না। বিনিময়ে শুধু একটু হাসলো।
ডিআইজি স্যার এগিয়ে এসে বললেন,
-“শুভ কাজে দেরি করতে নেই। আংটি বদল হয়ে যাক তাহলে?”
রুশান মাথা নিচু করে হাসলো। পাশ থেকে তনিম বললো,
-“কি স্যার? লজ্জা লাগছে? সেদিন আমাকে দেখে তো খুব মজা নিলেন। আজ আমিও একটু নেই?”
রুশান চোখ পাকিয়ে তাকালো তনিমের দিকে। তনিম ঢোঁক গিলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
-“আজকে আমি ভ..ভয় পাচ্ছিনা আপনাকে। একটুও না।”
রুশান হেঁসে উঠলো তনিমের কথায়। তারপর নিচু কন্ঠে বললো,
-“তোমার বউ তো এলো না। তাকে ছাড়াই তার বোনের এনগেজমেন্ট হয়ে যাবে ব্যাপারটা কেমন না?”
-“সে তো তার বোনের বিরহে দিনযাপন করছে স্যার। আপনাদের এনগেজমেন্টের ছবি তুলে তাকে পাঠাবো। দেখবো কেমন ঝটকা লাগে তার।”
রুশান আর তনিম দু’জনই হেঁসে উঠলো। তাদের হাসির মধ্যেই রুমঝুম এগিয়ে এসে রুশানের হাতে সকালের কেনা আংটিটা দিলো। ফিসফিস করে বললো,
-“যা এটা পুনমকে পরিয়ে দে।”
রুশান অবাক হয়ে বললো,
-“এটা তাহলে এই কারনে কিনেছিলে,আপু?”
রুমঝুম হেঁসে রুশানের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
-“তা কি আমার জন্য কিনেছি, ছাগল? যা এবার আংটি পড়া ওকে। অর্ধেক বউ বানিয়ে নে।”
রুশান মুচকি হেঁসে পুনমের কাছে গেলো।পুনমের চোখের দিকে তাকিয়ে বাম হাতটা ধরলো। সবার হাসিঠাট্টার মাঝেই রুশান আর পুনমের এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হয়ে গেলো।
রুশানের এনগেজমেন্ট হওয়ার পরপরই ডিআইজি স্যার চলে গেলেন। উর্বিন্তা থেকে গেলো। তাকে রুশান বা তনিম পৌঁছে দিয়ে আসবে পরে।
এনগেজমেন্টের ঝামেলা শেষ হতেই সবাই খাওয়া-দাওয়া করতে বসে গেলো। একটু আগেই এবাড়িতে এত বড় একটা কান্ড ঘটে গেছে তা বোঝাই যাচ্ছে না। সবাই কত হাসিখুশি হয়ে ঘোরাফেরা করছে।
শান্ত নিঃশব্দে উর্বিন্তার পেছনে এসে দাঁড়ালো। ফিসফিসিয়ে বললো,
-“আমাদের কবে এনগেজমেন্ট হবে গো?সবার বিয়ে দেখে দেখে আমার এখন হিংসে হয়।”
উর্বিন্তা ভ্রু কুঁচকে শান্তর দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-” এখনো নাক টিপলে দুধ পড়ে আর উনি আসছে বিয়ে করতে। যা ভাগ। আগে বড় হ।”
বলেই মুখ ভেঙচি দিয়ে সামনে হেঁটে চলে গেলো উর্বিন্তা।
উর্বিন্তা চলে যেতেই শান্ত দুই আঙ্গুল দিয়ে নিজের নাক টিপে ধরলো। গরমে ঘেমে নাকের ডগায় জমা ঘামটা চলে এলো আঙুলের মাথায়। সেটা দেখে শান্ত উর্বিন্তার পেছনে ছুট লাগালো। উঁচু গলায় বললো,
-“আমার বিয়ের বয়স হয়েছে, উর্বি। দেখো আমার নাক টিপলে দুধ পড়ে না, ঘাম পড়ে।”
চলবে……
#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১৯
#আর্শিয়া_সেহের
সকাল থেকেই রান্নাঘরে পড়ে আছে রুমঝুম আর বিথী। তিহানের সমস্ত পছন্দের খাবার বানাচ্ছে দুজন মিলে। শান আর সাঁঝ গেছে এয়ার পোর্টে তিহানদের আনতে। বেলা দশটার মধ্যেই চলে আসবে ওরা।
রুশান আর শান্ত সোফায় বসে বসে টিভি দেখছিলো । তখনই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো তনিম। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। রুশান তনিমের এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে বললো,
-“কি হয়েছে তোমার ? এমন বেহাল দশা কেমন করে হলো?”
শান্তর হঠাৎই মনে পড়লো গতকালকের সেই ইশারার কথা। খারাপ কিছু হয়েছে ভেবে যখনই মুখ খুলতে যাবে তখনি তনিম দুঃগ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো,
-“আমি একটু ঘুমাতে চাই স্যার।”
রুশান আর শান্ত দু’জনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো এমন কথা শুনে। না ঘুমানোর ফলেই তনিমের চোখ মুখের এমন অবস্থা তা বেশ টের পেলো রুশান। তনিমের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে টিভির দিকে তাক করে বললো,
-“ঘুমাবে পরে আগে কারন বলো। এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে? আর রাতে ঘুমাওনি কেন?”
তনিম ধপ করে সোফায় শান্তর পাশে বসে পড়লো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
-“আমার কর্মফল স্যার। বউকে সারপ্রাইজ দিতে গেলে যা হয় তাই হয়েছে। আপনার আর পুনমের এনগেজমেন্টের ছবিগুলো সারপ্রাইজ হিসেবে দেখাতে গিয়েছিলাম। ছবিগুলো দেখে প্রথমে কি খুশি হলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। তারপর হুট করে মুখ ফুলিয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলো। সারারাত কত ডাকলাম কিন্তু শুনলোই না। তাই সকালে চলে এলাম আপনার এখানে একটু ঘুমাতে।”
রুশান আর শান্ত হা হা করে হেসে উঠলো। রুশান হাসতে হাসতে বললো,
-“কালই বলেছিলাম পিহুকে আগে থেকে জানাতে। এমনিতেই সে ডিপ্রেশনে ছিলো। তার উপর এমন মজা সে মেনে নিতে পারে নি।”
তনিম মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। এর মধ্যেই টেবিলে রাখা রুশানের ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে পুন্যি নামটা জ্বলজ্বল করছে। রুশান রিমোট রেখে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যাস্ত কন্ঠে পুনম বললো,
-“তনিম ভাই কই? জানো তুমি? তোমার ওখানে আছে?”
রুশান আড়চোখে তনিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“না তো। তনিম এখানে এতো সকালে আসবে কেন? কি হয়েছে বলো তো? এতো উদ্বিগ্ন হয়ে আছো কেন?”
পুনম এবার আরো উত্তেজিত হয়ে বললো,
-“আপু কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে উঠেছে। বারবার বলছে তার উপর রাগ করে ভাইয়া চলে গেছে। সে নাকি কি একটা শাস্তি দিয়েছিলো ভাইয়াকে। সারারাত ঘরে ঢুকতে দেয়নি। কয়েকবার দরজার নিচে থেকে তাকিয়ে দেখেছে ভাইয়া আছে কি না। কিন্তু ভোরের দিকে নাকি ভাইয়াকে আর দেখেনি। তারপর থেকেই কান্নাকাটি শুরু করেছে।কেউ থামাতে পারছে না। ভাইয়ার ফোনটাও নাকি বাড়িতে।”
রুশান ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখলো খানিকক্ষণ হাঁসি থামানোর জন্য। নিজেকে সামলিয়ে তনিমের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে সোফায় হেলে থাকা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। রুশান টিভির সাউন্ড একটু কমিয়ে দিয়ে আস্তে করে পুনমকে বললো,
-“পিহু কখন গেছে তোমাদের বাড়িতে?”
পুনম অধৈর্য গলায় বললো,
-“এইতো একটু আগেই এসেছে হন্তদন্ত হয়ে। একদম পাগলপ্রায় অবস্থা। প্রিয়া আপু তো পিহুকে দেখেই দরজা আটকে দিয়েছে। পিহুর অবস্থা দেখে সেও ভয় পাচ্ছে।”
রুশান দুই আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। পেট ফেটে হাসি আসছে তার। কিন্তু এখন হাসা ঠিক হবে না। মানে এরা নিজেরাই শাস্তি দিবে আবার নিজেরাই কষ্ট পাবে। কি আজব মেয়ে জাতি। শান্ত ভ্রু কুঁচকে রুশানের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো এভাবে ঠোঁট চেপে রাখার কারন খুজতেছে।
শান্তর দিকে চোখ পড়তেই রুশান ঠোঁট ছাড়লো। পুনমকে আশ্বস্ত করে বললো,
-“তুমি পিহুকে দেখো। আমি তনিমকে খুঁজে দেখছি। চিন্তা করো না। রাখছি।”
-“আচ্ছা একটু তাড়াতাড়ি খুঁজো।”
পুনম ফোন রাখতেই রুশান দমফাটা হাসিতে ফেটে পরলো। তার হাসির তোড়ে তনিম ধড়পড়িয়ে উঠে বসলো। রুমঝুমও দৌড়ে এলো রান্নাঘর থেকে। বিয়ের খুশিতে ভাই পাগল হয়ে যাচ্ছে কিনা এমনটাই আশঙ্কা রুমঝুমের।
রুশান খুব কষ্টে হাঁসি থামালো। একটু একটু করে পুনমের বলা সবটাই খুলে বললো। রুমঝুম মুচকি হেসে চলে যেতে যেতে বললো,
-“এটাই ভালোবাসা, ছাগল। তোর কপালেও এমন থাকলে বুঝবি।”
শান্ত দাঁত বের করে হেঁসে বললো,
-“আমি তো আগেই বলেছি রুশান ভাই পুনম আপুর কাছে উদুম ক্যালানি খাবে।”
তনিম মুচকি হেসে মাথা চুলকাচ্ছে সোফায় বসে। পিহু যে এখন তাকে ভালোবাসে এটা সে বোঝে। ভালো না বাসলে এভাবে কাঁদতো না।
তনিম যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই উঠে বেরিয়ে গেলো। রুশান পিছু ডাকলে বললো,
-“স্যার আমি ওখানে গিয়ে ফোন দিবো। আগে ঘর সামলাই।”
রুশান হালকা হাসলো তনিমের কথায়। শান্ত এগিয়ে এসে রুশানের পাশে বসলো। নিচু কন্ঠে বললো,
-“তোমাকে কিছু বলার আছে রুশান ভাইয়া।”
রুশান আপেলে কামড় বসিয়ে বললো,
-“কি বলবি বল।”
শান্ত সতর্ক ভাবে বললো,
-“ওইযে কালকের যে ছোট শয়তানটা ছিলো না?”
রুশান কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
-“ছোট শয়তান? পুনমকে যে বিয়ে করতে এসেছিলো সে?”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই। ওই লোকটাকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার সময় সে পেছনে আরেকটা ছেলের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা ইশারা করেছিলো। ছেলেটা সম্ভবত উনার চাচার ছেলে।”
রুশান সতর্ক চোখে তাকিয়ে বললো,
-“নিজে দেখেছিস ইশারা করতে?”
-“হুম নিজেই দেখেছি।”
রুশান কিছুক্ষণ ভাবলো। অতঃপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“কিছু হবে নাহ। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”
…
শানদের বাড়িতে আজ জমজমাট অবস্থা। সিন্থিয়া,প্রান্ত, শিরীন ,তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে এসেছে। তিহান আর অ্যামিলিয়াও চলে এসেছে বেশ খানিকটা সময় আগেই। তিহান আসার শব্দ পেয়েই বিথী উপরে চলে গিয়েছিলো। সবাই আসলে তারপর সে দেখা দেবে। বিথী হলো আজকের সারপ্রাইজ। সোফায় একদম পাশাপাশি বসে আছে সিন্থিয়া,প্রান্ত আর তিহান। অ্যামিলিয়া রুমঝুমের সাথে হাতে হাতে এটা ওটা সাহায্য করছে। এতো দিন পর বন্ধুরা এক হয়েছে তাই ওদেরকে ওদের মতো ছেড়ে দিয়েছে।
-“তিহানের বউটা তো বেশ মিষ্টি রে। এই মিষ্টি মেয়ে দেখেই দেশ ভুলে গেছিস তাই না?”
শাফিয়া আক্তারের কথা শুনে সবাই হেঁসে ফেললো। তিহান উঠে এসে শাফিয়া আক্তারকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“না আন্টি,ভুলিনি। তবে এই দেশ থেকে দূরে থাকলেই ভালো থাকি।”
কথাটা জেরিনের দিকে তাকিয়ে বললো তিহান। কেউ খেয়াল না করলেও প্রান্ত সেটা খেয়াল করলো। সুন্দরীদের তালিকা করলে অ্যামিলিয়ার নাম সেখানে থাকবেই। এতো রুপবতী একটা মেয়েকে পেয়েও তিহান জেরিনকে ভুলতে পারেনি। এটাই বোধহয় ভালোবাসার জোর যা না চাইলেও মনের গহীনে নিজ ইচ্ছায় থেকে যায়।
রুমঝুম ট্রে তে করে পায়েস এনে সবাইকে খেতে দিলো। আজ বহু বছর পরে চার বন্ধু একসাথে হয়েছে। একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। সিন্থিয়া তো থেকে থেকে কেঁদে উঠছে বিথীর কথা ভেবে। একবার তো অভিমানী কন্ঠে বলেই ফেললো,
-“বিথীটা বড্ড স্বার্থপর। কি হতো আজ আমাদের সাথে এখানে থাকলে?”
রুমঝুমের খারাপ লাগলো বিথীকে স্বার্থপর বলায়। তাই সে মুখ খুলতে গেলেই শান থামিয়ে দিলো। চোখের ইশারায় বোঝালো,
-“এখন ওদের বলতে দাও।”
রুমঝুম মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিলো তখনই কানে এলো প্রান্তর অবাক কন্ঠস্বর। সে যেন বিষ্ময়ের সপ্তম আকাশ ছুঁয়ে বললো,
-“এটা বিথীর হাতে বানানো পায়েস। আমি বাজি ধরে বলতে পারি।”
তিহান আড়চোখে প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বিথীকে কোথায় পাচ্ছিস তুই? তোর মনের ভুল হবে।”
প্রান্ত নিভলো। আসলেই তো। বিথী কোথা থেকে আসবে? সিন্থিয়া পায়েস একবার মুখে নিয়ে আর নিচ্ছে না। বিথীর হাতের পায়েস ওরা বহুবার খেয়েছে। সেই স্বাদ চিনতে এতোটা ভুল হওয়ার কথা না।
সিন্থিয়া রুমঝুমকে ডাকলো। নরম স্বরে বললো,
-“এটা কে বানিয়েছে ,ঝুম? সত্যি করে বলো।”
রুমঝুম আড়চোখে শানের দিকে তাকালো। শান মুচকি হেঁসে বললো,
-“তোর কি মনে হয়? কে বানিয়েছে বল তো?”
সিন্থিয়া উত্তর দিতে পারছে না। যদি বিথীর হদিস একটাবারের জন্য হলেও ও পেতো তাহলে জোর গলায় বলতো এটা বিথী বানিয়েছে। তবে এখন সেটা পারছে না।
-“আম্মু আমরাও পায়েস খাবো।”
মাহিমের কন্ঠ পেয়ে সিন্থিয়া পেছনে তাকালো। মাহিম,সিনিম,সাঁঝ আর অন্য আরেকটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়ানো। এই বাচ্চাটাকে সিন্থিয়া চিনে না। শুধু সিন্থিয়া কেন শিরীন,প্রান্ত,তিহান কেউই চিনে না। তিহান সব বাচ্চাদেরই ভিডিও কলে দেখেছে কিন্তু এই মেয়েটা কে? প্রান্ত একধ্যানে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। বাম চোখের নিচে একটা তিল যেটা বিথীরও আছে। সবকিছু এমন কাকতালীয় কিভাবে হচ্ছে?
সিন্থিয়া বিন্দুকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে রুমঝুমকে বললো,
-“ওই বাচ্চাটা কে? আগে তো দেখিনি।”
রুমঝুম আস্তে করে শুধু বললো,
-“ও বিন্দু।”
প্রান্ত শানের দিকে তাকালো। শান একমনে পায়েস খাচ্ছে। প্রান্ত সটান দাড়িয়ে শানের সামনে গিয়ে বললো,
-“এই বাচ্চা মেয়েটা কার শান? দেখ সিরিয়াস হ প্লিজ। হেয়ালি না করে বল এই মেয়েটা কার?”
-“ও আমার মেয়ে, প্রান্ত।”
বহুপ্রতীক্ষিত একটি কন্ঠ হঠাৎ ধাক্কা মারলো সকলের কানে। সিন্থিয়া তাকাতে পারছে না। যদি কানের শোনাটা মিথ্যে হয়? যদি তাকালে আর দেখতে না পায় মানুষটিকে?
তিহান বিষ্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে। এ কোন বিথীকে দেখছে সে? বয়স যেন উপচে পড়েছে মেয়েটার। কি মলিন চেহারা। গায়ের রং আগের তুলনায় ময়লা হয়ে গেছে। চোখ ধাঁধানো লম্বা চুল গুলো আজ রুক্ষ শুষ্ক হয়ে গেছে। প্রান্তও বিশ্বাস করতে পারছে না যে এটা বিথী। হাত পায়ের বল ফুরিয়ে এসেছে মেয়েটাকে দেখে। প্রান্ত ধপ করে বসে পড়লো শানের পাশে। তিহান এখনো একধ্যানে বিথীর দিকেই চেয়ে আছে।
বিথী তাকালো না তিহানের দিকে। সে চায়না তিহানের বউয়ের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু করে ফেলতে। গুটি গুটি পা ফেলে সিন্থিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালো বিথী। ক্ষীণ কন্ঠে ডেকে উঠলো,
-“সিন্থু।”
সিন্থিয়া তড়িৎ বেগে ঘুরেই জড়িয়ে ধরলো বিথীকে। চোখ মেলে তাকায়নি। আগে মেয়েটাকে অনুভব করলো। দুটো মেয়ের কান্নার শব্দে আজ সবাই চুপ হয়ে গেলো। সিন্থিয়া গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো পরিচিত ছোঁয়া পেয়ে। যে মেয়েটাকে ছাড়া ওর একটা দিন যেতোনা সেই মেয়েটাকে ছাড়া সাতটা বছর কেটে গেছে।
সিনিম মায়ের কান্না দেখে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠলো।
বিথী সিন্থিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কান্নার বেগ কমে এলে বিথী সিন্থিয়াকে ছাড়ালো নিজের থেকে। এবার সিন্থিয়া বিথীর মুখশ্রী দেখলো। সাথে সাথেই আঁতকে উঠলো সে। এ কি অবস্থা মেয়েটার? মনে হচ্ছে বয়সটা যেন চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। ততক্ষণে শান বিথীর সাথে কি কি হয়েছে সবটাই বলতে শুরু করে দিয়েছে।
সিন্থিয়া কাঁপা কাঁপা হাতে বিথীর মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে আর শ্রবণ করছে প্রান প্রিয় বান্ধবীর ফেলে আসা গত সাত বছরের কুৎসিত,কালো আর জঘন্য এক অধ্যায়।
চলবে……
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)