চন্দ্র’মল্লিকা ৪১
লেখা : Azyah_সূচনা
“গাড়ির ধর্মঘট এখনই হওয়া লাগতো!ফরিদা কত ছটফট করছে মাইয়াটার লেইগা!ওরা মানুষের বিপদ আপদও বুঝে না।সব বাস বন্ধ কইরা রাখছে।”
দীর্ঘ দশ দিন পর হাজির রমজান সাহেব এবং ফরিদা বেগম।মেয়ের আর নাতনির কথা শুনে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। দূরপাল্লার বাসগুলো আকস্মিক ধর্মঘট শুরু করে।ট্রেন ব্যবস্থা নেই।প্রতিদিন কাউন্টারে গিয়ে খবর নিয়েছিলেন রমজান সাহেব। অবশেষে আসতে পেরেছেন ঢাকা।মেয়েকে দীর্ঘদিন পর বুকে জড়িয়ে সাহস দিলেন।ফরিদা বেগমও নিজের কান্না লুকান।
বলেন, “পরীক্ষা চলতাছে তোদের।সুখের জীবনে সামান্য পরীক্ষা মাত্র।ধৈর্য্য ধর!দেখবি সব ঠিক হইয়া যাইবো।”
মল্লিকা উত্তর দিলো, “তাই যেনো হয় আম্মা”
মাহরুর নাস্তা আনতে বাহিরে গিয়েছে।অনেকটা পথ জার্নি করে সরাসরি হসপিটালে এসেছে রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগম। সারা রাস্তা না খেয়ে আছেন।আসার পথে দুলাল কল করলো।
বললো, “আসসালামু আলাইকুম ভাই”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিরে?”
“ভাই ভাবি ঠিক আছে?আর আমার ভাইঝি?”
“আলহামদুলিল্লাহ”
“ভাই আমি অনেক মেহনত করতাছি।আপনি দোকান নিয়ে কোনো টেনশন করবেন না।আপনার মাইয়ার বদৌলতে দোকানে রহমত আইছে। বিক্রি কিনি অনেক ভালো।”
এর বিপরীতে মাহরুর উত্তর দিলো ভিন্ন।বললো, “তোর মতন একজন পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের।অনেক বড় হ দুলাল।”
“কি যে কন ভাই? আপনারা জলদি ফিরা আহেন।আমি এদিকে সব সামলায় নিমু।”
“আচ্ছা।রাখছি”
মাহরুর ফিরে এসেছে।চা নাস্তা সবটা ফরিদা বেগম এবং রমজান সাহেবকে দিলো।রমজান সাহেব নিজের পরিবর্তে মাহরুরের শুকনো মুখ দেখে বিষণ্ণ হন।হাত টেনে নিজের কাছে বসিয়ে মাথায় হাত রেখে যতনে আদর দিলেন।
বললেন, “এক্কেরে ভাইজানের মতন হইছিস তুই।আমার বড় ভাইটা আছিলো এত দায়িত্ববান।আম্মা, আব্বা থেকা শুরু কইরা আমারে মানুষ করছে।নিজের সংসার একহাতে সামলাইছে ক্ষেত খামারি কইরা।তোর লগে কোনো অন্যায় হইবো না।তুই চিন্তা করিস না।ভালোর ফল ভালো পাবি।হইতে পারে একটু দেরিতে।”
ছোট করে উত্তর দেয় মাহরুর, “হুম চাচা”
“অফিসে যাস?”
“চারদিন যাই নাই। বাকিদিনগুলা অর্ধেক বেলা কাজ করেছি।”
“তোর মালিক কেমন?”
“আলহাদুলিল্লাহ চাচা ভালো।আমি ভাবি এই ভালো মানুষগুলো না থাকলে আমার কি হতো?”
“চিন্তা করিস না বাপ।”
“চাচা মেহুলের আকীকা দেওয়া হয় নাই এখনো।পড়ে দিলে হবে না?”
“হ হইবো।আগে মাইয়াটা আহুক সুস্থসবলভাবে তোর কাছে।তারপর”
___
গুনে গুনে পঁচাত্তর হাজার টাকা বিল এসেছে এই কয়দিনে। সমস্ত খরচ মিলিয়ে।বিশাল রকমের একটা ধাক্কা।এই কথাটি মাহরুরকে জানিয়ে তাকে অভাবের সমুদ্রে ফেলার আগেই ডাক্তার এসে জানালেন তার মেয়েকে আজ সন্ধ্যায় তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।আজকাল দ্বিমুখী অনুভূতি মধ্য দিয়েই যাচ্ছে।কখনো বাবা হওয়ার সংবাদ খুশির জোয়ারে ভাসানোর পূর্বেই সন্তানকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার বিষাদ এসে হাজির।অপরদিকে মোটা অংকের হাসপাতালের বিল শুনে মাথায় হাত রাখার পূর্বেই খুশির সংবাদ দেওয়া হয় তাকে।তার মেহুলকে আজ প্রথমবারের মতন ছুঁয়ে দেখতে পারবে। নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে গেছে সে।মস্তিষ্ক থমকে গেলো।অচল হয়ে পড়েছে।আশপাশের কোলাহল যেনো শুনেও শুনছে না।
বিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে থাকা মাহরুরের কাধে হাত রাখে রমজান সাহেব।আকষ্মিক হুশ ফিরল।রমজান সাহেব এর দিকে চেয়ে বলল, “কিছু লাগবে চাচা?”
“না।কিছু লাগবে না কিছু দিতে এসেছি।”
“কি?”
“আমার ছোট নাতনিকে সালামি দিতে চাই। বড়জনেরও জন্মদিন ছিল।ওকেও কিছু না কিছু দিবো।”
কথার ভাজ ঠিকই বুঝেছে মাহরুর।স্মিথ হাসলো।বললো, “সালামি শব্দটা বোঝার জন্য আপনার নাতনিরা অত বড় হয়নি চাচা।যখন হবে তখন দিয়েন।”
“এখনই দিবো।পড়ে যদি সময় না পাই?মৃত্যু কি কইয়া বইলা আসে?”
“আপনি হাজার বছর বাঁচবেন চাচা।তবে এখন আমি আপনার সালামি গ্রহণের অনুমতি আমার মেয়েদেরকে দিবো না।”
“নানা নাতিনের মধ্যে কথা কওয়ার তুই কে?”
মাহরুর পূনরায় হাসলো।বললো, “ওদের বাবা”
“অত কথা কইও না। আমার নাতনিরা কখন আসবো?তাই বল”
“আসবে কিছু সময় পর।”
সময় অতিবাহিত হয়। মাহরুর নিজের কথায় অটল।রমজান সাহেব দেখেছেন তার কপালে চিন্তার রেখা। খুব আত্মসম্মানবোধ তার।তাইতো নাতনীদের সালামি দেওয়ার বাহানায় মাহরুরকে সাহায্য করতে চেয়েছেন।কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হলো না মাহরুরের জেদে।কোনো সাহায্য নেবে না খুব আগে থেকেই পণ করেছিলো।
হাসপাতালের বারান্দায় দাড়িয়ে কল করলো ডিরেক্টর শরিফুলকে।
ফোন রিসিভ করে শরিফুল বলে উঠলেন,
“হ্যালো মাহরুর।”
“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছেন?শুনলাম বাবা হয়েছেন?মেনি মেনি কংগ্র্যাচুলেশন।”
“থ্যাংক ইউ স্যার।”
“কেমন আছে আপনার মেয়ে?শুনলাম বাচ্চাটাকে ভ্যানটিলেটরে রাখা হয়েছে?আসলে আপনিতো জানেন আমি দেশের বাহিরে ছিলাম।নাহয় অবশ্যই হাসপাতালে আসতাম।”
মাহরুর ডিরেক্টর শরিফুল এর কথায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুরে বলল,
“ইটস ওকে স্যার।আপনি দুআ রাখবেন শুধু।”
“আপনার মেয়েকে কি বের করে আনা হয়েছে ভ্যানটিলেটর থেকে?”
“সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আজ আমার মেয়েকে আমার কাছে দেওয়া হবে।”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
মাহরুর ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “স্যার আমার…. মানে একটা রিকোয়েস্ট করার জন্য আপনাকে কল করা।”
“শিউর। বলুন কি সাহায্য করতে পারি?” জবাবে বললেন শরিফুল।
“স্যার আমার আগামীমাসের বেতনটা কি এই মাসে কোনোভাবে দেওয়া সম্ভব?….স্যার প্লিজ কিছু মনে করবেন না।আমি এভাবে বলতাম না কথা। দশদিন যাবৎ হাসপাতালে আছি। বিল মেটাতে একটু হিমশিম খাচ্ছি।আমি আগামীমাস থেকে কোনো ছুটি নেবো না স্যার।দরকার পড়লে ওভার টাইম করবো।”
মাহরুরের সমস্ত কথা শুনলেন শরিফুল।সময় নিয়ে উত্তর দিলেন,
“আপনাকে আমি একজন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে চিনি। এভাবেই বেতন আগে আগেতো দেওয়া যায় না।তারপরও আমি আপনার মেয়ের জন্য বেতন আগে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।আপনি আগামীকাল এসে একটা অঙ্গীকারনামায় সাইন করবেন।সাথে টাকাটা নিয়ে যাবেন।”
আবেগে আপ্লুত হয়ে মাহরুর উত্তর দেয়, “আপনার কৃতজ্ঞতাগুলো আমি কখনো ভুলবো না স্যার। থ্যাংক ইউ সো মাচ”
“ইটস ওকে মিষ্টার মাহরুর।আমিও একজন মেয়ের বাবা।কিছু ক্ষেত্রে প্রফেশনাল লাইফে পার্সোনাল জিনিসগুলোকেও প্রাধান্য দিতে হয়।”
“জ্বি স্যার। থ্যাংক ইউ ওয়ান্স এগেইন”
___
পৃথিবীর বুকে এত সুন্দর মুহুর্ত আর দুটো মনে হয় নেই।প্রথম প্রশান্তি পেয়েছিলো মল্লিকা আর মিষ্টিকে পেয়ে।দ্বিতীয় প্রশান্তি আজ আসতে চলেছে।ছোট্ট কেবিন ভর্তি মানুষ।সবার মুখে হাসি। দরজার সামনে জায়গাটা খালি করে রেখেছে।যেনো কোনো মহারানীর আগমন হবে। মহারানী নয় সে রাজকুমারী বটে।অনেক অপেক্ষা অনেক সাধনার পড়ে আসছে।কিসের টাকার চিন্তা?কিসের হয়রানি?এক মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যাবে মেয়ের মুখ দেখে।রহিম মিয়া এসেছেন মিষ্টি নিয়ে।এতদিন মিষ্টির আয়োজন করা হয়নি।দুঃখের ছায়া ছিলো সর্বখানে।আজ খুশি সকলে। সুখের সময় মুখ মিষ্টি করা আবশ্যকীয়।
প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে তার ফুটফুটে কন্যাকে নিয়ে হাজির মল্লিকা।বক্ষে জাপ্টে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসেছে।জানে সে।অনুভব করে। মাহরুরের কদম এগোবে না।নিজেই এসে তুলে দিল তাদের দুজনার অংশকে তার পিতার কোলে।
মাহরুর সবাইকে তাক লাগিয়ে বলে উঠলো, “আমি বসে নেই।”
মল্লিকা জানতে চাইলো, “কেনো?”
“এতটুকু বাচ্চা কোলে নেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই চন্দ্র।”
সবাই হেসে উঠলো একাধারে।সাথে মল্লিকাও।সে নিপুণ এই কাজে।প্রথম সন্তানকে নিজেইতো কোলে পিঠে মানুষ করেছে সেই অল্প বয়সে। মাহরুর বেডে একপা তুলে ভাজ করে বসলো।বুকে সাহস যুগিয়ে কোলে নিয়েছে মেয়েকে।
“আপনার মেয়ে আপনার দিকে চেয়ে আছে দেখুন”
গোলগোল চোখ গুলো।গালের দুই অংশ লালচে। ড্যাবড্যাব করে মাহরুরের দিকে চেয়ে আছে।চেনার চেষ্টা করছে বুঝি?নাকি রক্তের টান অনুভব করছে।অন্যদিকে মাহরুর নির্বাক।মুখের শব্দরা ছুটি নিলো এই মাত্র।বাবা হওয়ার অনুভূতিটা এমন কেনো?শিরশির করছে সর্বাঙ্গ।
আকস্মিক ঠোঁট ভেঙে আসে মাহরুরের। আটকাতে চাচ্ছে নিজেকে। যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।পলক ঝাপটে চোখের পানি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো।ছোট্ট তুলতুলে গালে ঠোঁট ছুঁয়ে নিস্তার দিলো সমস্ত অস্থিরতার।
মিষ্টি বাবার পাশেই বসে।তার ছোট আঙুল বোনের গাল ছুঁয়ে দেওয়ার সাথেসাথে মেহুল চোখ ফেরায়।এবার মনোযোগ গেলো বড় বোনের দিকে।আনন্দে উচ্ছাসিত হয়ে মিষ্টি বললো,
“আমাকে দেখছে মা?মাহি বাবা?….বাবুটা আমাকে দেখছে।”
ইতিমধ্যে চোখের জল এর বিরুদ্ধে জয়ী হতে সক্ষম মাহরুর।মিষ্টিকে বললো, “তুই ওর বড় বোন না?চিনে ফেলেছে তোকে দেখলি?”
“ও আমাকে চেনে মাহি বাবা?”
“হ্যাঁ চেনে।কেনো চিনবে না? মেহুল এর একমাত্র বড় বোন মিষ্টি।”
এমন কথায় ক্ষিপ্ত হলো সুমাইয়া,সায়মন দুজনে।তাদের কেনো বাতিল করা হলো লিস্ট থেকে?দুজনেই ধেইধেই করে এগিয়ে আসে।
বলে,
“আর আমরা?”
মাহরুর ভ্রু উচু করে দেখলো দুজনকে।হাসতে হাসতে বললো, “সরি মামা ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দে।”
সুমাইয়া, সায়মন এগিয়ে আসে।কথা নুয়ে দেখতে লাগলো বোনকে।পরপর মাহরুর ওই অবুঝ শিশু মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,
“দেখ মেহুল এই দুজন হচ্ছে তোর সুমাইয়া আপু আর সায়মন ভাইয়া।তোর ঝগড়াটে ফুপ্পীমনির ছেলে মেয়ে।”
মাহরুরের এমন কথায় সকলে হাসছে।শুধু শিরীন ব্যতীত।সেও তেড়ে এলো। ছো মেরে নিজের ভাতিজিকে কেড়ে নিয়ে বলতে লাগলো,
“আমার সাথে তোমার খোচাখোচি না করলেই নয়?”
“তুই মানুষটাই এমন।”
শিরীন মেহুলের দিকে চেয়ে বলল, “আমি ভালো তাই না ফুপ্পীমনি?”
একে একে সবার কোলে যাচ্ছে মেহুল।সবার দিকেই একই ভঙ্গিতে চায়।যেনো অনেক দিনের পরিচয়। কান্নাকাটি বিহীন ঘুরে এলো আপন মানুষের কাছ থেকে। মাহরুরের চোখ সরে না।অবশেষে মায়ের কোলে এসে প্রাণজুড়ানো হাসি দিলো।এই হাসিতে মুগ্ধ চারিপাশ।
মিষ্টি আর মেহুলকে একসাথে জড়িয়ে নিয়ে মল্লিকা বললো,
“মেয়েরাতো মায়েদেরকে পরিপূর্ণ করে তাই না?আজ থেকে আমাদের দল ভারী হলো।…আমরা তিনজন মিলে বাবার অনেক খেয়াল রাখবো ঠিক আছে?”
মিষ্টি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।আবার জানতে চায়, “আমরা কবে বাড়ি যাবো মা?আমার বন্ধুদের বলতে হবেতো।মিষ্টির ছোট বোন এসেছে।”
জবাব দিলো মাহরুর।বললো, “আমরা আগামীকাল বাড়ি ফিরবো। এখন তুই ভালো মেয়ের মতন মনির সাথে যা।খেয়ে দেয়ে দ্রুত ঘুমাবি।ঠিক আছে?”
“আচ্ছা মাহি বাবা।আমি বোনের জন্য ঠিকমত ভাত খাবো। মনিকে জ্বালাবো না।”
“এইতো!আমার ভালো মেয়ে মিষ্টি।”
মাহরুর রেদোয়ানকে ইশারা করলো।রাত হচ্ছে।এখনই ফিরতে হবে।রমজান সাহেবকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ফরিদা বেগম আর মাহরুর হাসপাতালেই থাকবে। একটু আগে দুলাল খাবার আর মাহরুরের কাপড় দিয়ে গেছে। এখান থেকেই অফিসের জন্য রওনা হতে হবে।বিকেলে ডিসচার্জ করে নিয়ে যাবে মল্লিকা আর নতুন সদস্যকে।
___
বেতন আর জমানো কিছু টাকা মাত্র।সামনের মাসের অগ্রীম বেতন নেওয়া হয়েছে।ঘরের বাজার বাকি,নতুন সদস্যের জন্য কেনাকাটা বাকি,তার আকীকা বাকি,দোকান ভাড়া বাকি।আগামী মাস কীভাবে চলবে এই চিন্তায় পথ হাঁটছে মাহরুর।এই জীবন থেকে ‘ চিন্তা ‘ নামক শব্দটা থেকে রেহাই কবে পাবে?কবে এক কাপ চায়ে চুমুক রেখে বলবে ‘ আহ! আমার কোনো চিন্তা নেই ‘।এক মুঠোয় পঁচাত্তর হাজার টাকা আলাদা করে নিয়েছে।আসার পথে টুকটাক কেনাকাটা করে নিলো। হাতে টাকার পরিমাণ অত্যন্ত স্বল্প।আজ আবার অফিস ব্যাগের ভারটা বেশি মনে হলো।অন্যহাতে ঘাড় চেপে হেঁটে এলো হাসপাতালে।আগেই বিলটা মিটিয়ে নেক।এত যন্ত্রণা সহ্য হয় না।বিশ্রাম দরকার!
হাসপাতালের বিলটা মিটিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে ক্যাবিনের দিকে এগিয়ে এলো।তার স্ত্রী আর ছোট্ট বুড়ি তৈরি।ফরিদা বেগম গোলাপি তোয়ালেতে যতনে তাকে মুড়িয়ে নিয়েছেন।কপালে কালো টিপ দিয়েছেন।বাহিরে ঠান্ডা মৃদু হাওয়া বইছে।মাথায় ছোট্ট টুপিও পড়িয়ে দিলেন। মাহরুর হাত মুখ ধুয়ে আসলো।
ফরিদা বেগম তার কোলে মেহুলকে দিতে চাইলে মাহরুর বললো,
“এখন দিয়েন না চাচী।অফিস থেকে ফিরেছি।কাপড়ে ময়লা, জীবাণু থাকবে।”
ফরিদা বেগম বুঝলেন।বললেন, “তাইলে একবারে বাড়ি গিয়া গোসল কইরা নিও কোলে।”
মাহরুর ফোন লাগায় শিরীনকে।মিষ্টিকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে রওনা হতে। রেদোয়ানকেও কল করেছে।মিনিট দশেক এর মধ্যে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ফিরে এলো।
এসে বললো, “তৈরি সবাই?”
মল্লিকা মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়, “হ্যা”
মাহরুর বললো, “বোস।আমি গাড়ি ডাকছি”
কোনো রকম ট্যাক্সি পেয়েছে।আজকাল উবার, পাঠাও এর যুগ। পুরোনো হলুদ রঙের ট্যাক্সি দেখা যায় না।আগে গ্রামে নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই এরিয়াটায় বহুবার দেখেছে ট্যাক্সি।আজ বোধহয় ভাগ্য সহায় হলো। হাসপাতালের সামনে যাত্রীদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য ট্যাক্সি আর সি.এন.জি এর সমাহার।বাড়ি বেশি দুরত্বে নয়।অল্প টাকায় ভাড়াটাও মিটে গেলো। সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে বেরিয়ে এসেছে হাসপাতাল থেকে।নানুর কোলে আরামসে ঘুম যাচ্ছে মেহুল।অপরদিকে আলগোছে মল্লিকার হাত শক্ত করে চেপে মাহরুর।
বাড়ির ঠিক দ্বারপ্রান্তে এসে গাড়ি থেমেছে।সচ্ছ গ্লাসের অন্যপ্রান্তে চোখ পড়তেই দেখা মিললো রহিম মিয়া আর দুলালের।রহিম মিয়া পেছনে হাত বেঁধে দাড়িয়ে আছেন হাসিমুখে।গাড়ি দেখতেই দুলাল দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিল।
বললো, “ভাই আহেন।আপনাগো ব্যাগ কই?দেন।আমি সব উপরে নিয়া যাইতাছি।”
মাহরুর উত্তর দিলো, “দিচ্ছি। দাঁড়া।”
রহিম মিয়া বললেন, “তোমার চাচী হেই কহন রাইন্দা রাখছে।আজকে বুয়ারে দিয়া রান্দায় নাই।নিজেই করছে সব।এত দেরি করলা কেন?”
মাহরুর উত্তর দেয়, “অফিস থেকে ফিরে তারপর এসেছি চাচা।”
“ওহ আচ্ছা।আমার বুড়ির আবার ধৈর্য্য নাই বুঝলা।আমারে আধা ঘণ্টা আগ থেইকা দরজায় দাড় করায় রাখছে।”
মাহরুর আবেগপ্রবন হয়ে পড়ে প্রায়ই।রহিম মিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আপনাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও শেষ হবে না।”
কথার মধ্যিখানে দেখা মিললো ফরহাদ এর স্ত্রী মৌ এর।তার ঘরেও ছেলে সন্তান এসেছে একজন।একই এলাকায় থাকা সত্বে মাঝেমধ্যেই সাক্ষাৎ হয়ে যায়।মল্লিকার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো। মাহরুর মুখ শক্ত হয়ে গেল আপনাআপনি। মৌকে এগিয়ে আসতে দেখে কপাল কুচকে নিলো মাহরুর।
পুরোনো কথা ভুলে মৌ বললো, “আসসালামু আলাইকুম মল্লিকা ভাবি?”
মল্লিকা উত্তর দেয়, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছো?..আর আম্মা?”
গা যেনো জ্বলে উঠে মাহরুরের।কেনো জানতে হবে এসব মানুষের কথা?কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো।
মৌ উত্তর দিলো, “ভালো আছি।আপনার?”
“হ্যাঁ।আমার মেয়ে” জবাব দেয় মল্লিকা।
“মাশাআল্লাহ।”
মাহরুরের রুক্ষ মুখের দিকে চেয়ে মৌ বললো, “এখানে একটা কাজে এসেছিলাম।আসি তাহলে।ভালো থাকবেন।”
রহিম মিয়া,দুলাল আর ফরিদা বেগম আগেই উঠে গেছেন কয়েক সিড়ি। মল্লিকার সাথে মাহরুর।তাকে সাপোর্ট দিয়ে আনতে হবে। প্রথমবার সি.সেকশনের ফলে সে এখনও অনেকটা দুর্বল।এক সিঁড়ি উঠেই ক্লান্ত হয়ে পড়লো মল্লিকা। রেলিংয়ে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পাঁচ তলায় উঠতে অনেক সমস্যা পোহাতে হবে তাকে।মল্লিকাকে চমকে দিয়ে পাঁজাকোলে তুলে নেয় মাহরুর। আকষ্মিক নিজেকে শূন্যে ভাসতে দেখে ভরকে উঠলো।
বললো,
“কি করছেন?কষ্ট হবে আপনার!”
সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মাহরুর বলতে লাগলো, “বয়স হচ্ছে বলে কি দুর্বল ভেবেছিস?বাহুতে এখনো তোর মতন দশটা চন্দ্রকে সামলানোর শক্তি আছে।”
চলবে…গল্পের