চন্দ্র’মল্লিকা ৪০
লেখা : Azyah_সূচনা
অপেক্ষারত এক যুগল।তাদের অনাগত প্রাণকে বরণ করবে এই চিলেকোঠায়।জানাবে এই ছোট্ট পুরোনো ঘরে অভাব আছে কিন্তু কমতি নেই।কিসের কমতি নেই যখন আধোআধো গলায় জানতে চাইবে সে?তখন জবাব আসবে ‘ প্রেম,ভালোবাসা,আদর,যত্ন,সম্মান’ এসবের কমতি নেই।যদি জানতে চায় তাহলে অভাব কিসের?উত্তর দিবে আবারো অভাব আছে খরখরে একটা কাগজী বস্তুর। যাহার প্রয়োজন আছে তবে অপ্রয়োজনীয়।শিখাবে অল্পতে তুষ্ট থাকা কত প্রয়োজনীয়।শিখাবে এসির কৃত্রিম বাতাসের চেয়ে জোঁছনা রাতের দমকা যাওয়া প্রশান্তির।দামী পোশাকের চেয়ে কারো ভালোবাসায় আনা কমদামী পোশাকের মূল্য।ভিন্নভিন্ন ঘরে একাকীত্বে ভোগার চেয়ে একই কামরায় ঠাসাঠাসি করে একে অপরের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করার মাঝে কত প্রসন্নতা।
অষ্টম মাসের প্রথম সপ্তাহে আরও একটু ভালোলাগায় সিক্ত হলো মল্লিকা। পেটে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো।ভাবলো আর মাত্র ক’ টা দিন।আর ক’ টাদিন?মল্লিকার হাসিকে মিয়ে দিয়ে প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগায় পুরো দেহ মুষড়ে আসলো।বুক ধড়ফড় করতে শুরু করলো। ক্ষণিকের মধ্যে এলোমেলো লাগছে সব। খাটের কোণায় হাত রেখে বসে পরে তীব্র ব্যাথায়।
মিষ্টি উঠে আসে।মাকে ডেকে বললো, “মা? ও মা? কি হয়েছে?”
অস্থির গলায় মল্লিকা বললো, “মিষ্টি!”
“মা মা! তোমার কি হয়েছে”
জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, “আমার ফোনটা দে মিষ্টি!”
মিষ্টি দৌড়ে যায়। মায়ের ফোন খুঁজে এনে ধরিয়ে দিলো।অল্প সময়ে পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে ঘামে।কপাল বেয়ে অনবরত ঘাম ঝরতে লাগলো। মিষ্টি ভয় পাবে। যথাসাধ্য চাইছে যেনো অবস্থা হাতের বাহিরে না যায়।
কাপতে কাঁপতে মাহরুরকে কল করে। দুয়েকবার ফোন বাজতেই মাহরুর কল ধরলো।মল্লিকা বললো,
“মাহরুর… মাহরুর ভাই..!”
বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলো অফিস থেকে।মল্লিকার এমন ভারী অস্থির গলা ফোনে পেয়ে ভরকে উঠে। হন্তদন্ত হয়ে বললো,
“কি হয়েছে চন্দ্র?তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো?”
নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিয়ে মল্লিকা উত্তর দেয়,
“আপনি..যেখানেই আছেন দ্রুত আসুন।..আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে।”
“চন্দ্র!চন্দ্র শান্ত থাক আমি আসছি।আমি জোবেদা চাচী আর রহিম চাচাকে পাঠাচ্ছি।চন্দ্র! আমি আসা পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিস একটু”
মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।আজ হেঁটে নয় রিকশা নিলো।ভাড়া অব্দি জানতে চাইলো না।কল মেলায় রহিম চাচাকে।দ্রুত উপরে যাওয়ার অনুরোধ করলো।পরপর রেদোয়ান আর শিরীনকে।তারপর বুকে হাত রেখে দুলালকে কল করে বললো,
“দুলাল দোকান বন্ধ কর।একটা গাড়ি ভাড়া কর দ্রুত।তোর ভাবিকে হাসপাতালে নিতে হবে।দ্রুত কর!”
“জ্বি ভাইজান!”
মিষ্টি চেচিয়ে কাদঁছে।চোখের সামনে মাকে এভাবে দেখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।দুহাত মুঠ করে মা মা বলে বিড়বিড় করছে একটু পর।আগামীকাল তার জন্মদিন।ছোটোখাটো একটা আয়োজন করবে বলে ভেবেছিল।সেই আশা আর দেখছে না।সেটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই মিষ্টির।তার মাকে চাই তার। হাসপাতালে মিষ্টিকে সামলানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো।শিরীন মিষ্টিকে বুকে জরিয়ে এদিক ওদিক হাটাহাটি করছে।
চেয়ারে বসে থাকা থমথমে মাহরুর এর কাছে রেদোয়ান গিয়ে বললো,
“ওপর ওয়ালার উপর ভরসা রাখো।”
আকস্মিক মাহরুর বললো, “চন্দ্রের ডেলিভারি ডেট আজ থেকে আরো তিন সপ্তাহ পরের ছিলো।এখনও সময় হয়নি। হঠাৎ কি হলো রেদোয়ান!”
রেদোয়ান চুপ বনে গেছে মাহরুরের কথায়।সময়ের আগে চলে আসাটা সবার ভাবনার কারণ।অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে মল্লিকাকে।বুকের গতি একেবারেই ঠিক নেই মাহরুরের।শূন্য মনে হচ্ছে সবকিছু।শরীর সম্পূর্ণ ভার হয়ে আছে।চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে কয়েকবার।চোখ বুজে সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি করতে করতে শ্বাস আটকে আসার উপক্রম।শান্তি মিলবে না কিছুতেই।
একজন ডাক্তার বেরিয়ে এলেন পঁয়ত্রিশ মিনিট পর।এসেই জানতে চাইলেন মল্লিকার স্বামী ও পরিবারের নাম। মাহরুর একলাফে এগিয়ে গেছে।
ডাক্তার বললেন, “মেয়ে হয়েছে।তবে বেবি প্রি ম্যাচুওর। ভেন্টিলেটরে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”
“ডাক্তার আমি দেখতে পারবো?আমি কি ওকে ছুঁয়ে দিতে পারবো?”
“জ্বি না মিষ্টার মাহরুর।যতদিন বেবি স্ট্যাবল না হচ্ছে যতদিন মা ব্যতীত আর কেউ ছুঁতে পারবে না। দুর থেকে দেখতে পারবেন।”
পৃথিবী থমকে যেতে আর কি দরকার? কয়েকটা বাক্য মাহরুরের স্তম্ভকে নাড়িয়ে তুললো।হৃদপিণ্ড এত জোরেজোরে ধকধক করছে যেনো বিস্ফোরণ ঘটাবে।দেখতে পারবে?তাও দুর থেকে।ওই ছোট্ট জানটাকে ছুঁয়ে দিতেও পারবে না। নিয়তির কি তাদের সুখ সইছিলো না?মল্লিকা ঠিক আছে কিনা জেনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মাহরুর। রেদোয়ানকে জড়িয়ে বলতে লাগলো,
“আমি খুশি হব নাকি কাঁদবো আমি বুঝতে পারছি না রেদোয়ান।আমার বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে আমাদের কাছে ফিরবেতো?”
বহু কষ্ট করে মিষ্টিকে ঘুম পাড়িয়ে বরাদ্দকৃত কেবিনে রেখে এসেছে জোবেদা খাতুন এর কাছে। মাহরুরকে কাঁদতে দেখে শিরীন এগিয়ে এসে ভাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
“কেনো আসবে না?আজকাল এসব হয় ভাইয়া।তুমি চিন্তা করো না।”
রেদোয়ান বললো, “ভাই শক্ত হও।তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেখলে মল্লিকা আর মিষ্টিও ভেঙে পড়বে।”
এক বুক অস্থিরতা নিয়ে মাহরুর বললো, “আর পারি না!”
___
ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে ইতিমধ্যে।গলা শুকিয়ে কাঠ। মল্লিকাকে এখনও ক্যাবিনে শিফট করা হয়নি। ডাক্তার জানিয়েছে সময় লাগবে। এনেসথেসিয়া এর প্রভাবটা অল্প কমলেই ক্যাবিনে আনা হবে।মিষ্টিকে একবার দেখে হাতে মুখে গ্লাভস আর মাস্ক পড়ে নিলো মাহরুর।নিজেকে সম্পূর্ণ নীল আবরণে ঢেকে চলে গেলো এন. আই. সিউ রুমটার দিকে।একটাবার কি দেখবে না তার নবজাতককে?চোখ আর হৃদয় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছেতো! মৃদু কম্পিত কদমে হেঁটে এসেছে। নার্সের কড়া আদেশে গ্লাসের অন্যপাশ থেকে আঙ্গুল তুলে দেখালো।
বললো, “এটা আপনার বাচ্চা”
একদম ছোট একটা শরীর। মাহরুরের একহাতের সমান হবে। কত বড় বড় নল লাগিয়ে রাখা হয়েছে নাকে মুখে।মাথা ভর্তি চুল।শ্বাস নিচ্ছে একটু পরপর। ধবধবে ফর্সা লালচে মুখটা ঘুরিয়ে আছে ঠিক তার বাবার মুখ বরাবর। ঘুমিয়ে আছে বুঝি?আবারো চোখ ছলছল করে উঠে মাহরুরের।
গ্লাসে হাত রেখে অস্পষ্ট কম্পিত স্বরে ডাকল, “বাবা…”
চোখ ভরে দেখতেও দিলো না।মিনিট পাঁচেক মাত্র অধিকার?তাও আবার নিজের সন্তানকে দেখার?সরিয়ে নেওয়া হলো মাহরুরকে। পৃথিবীটা কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে। ডাক্তার এর সাথে কথা বলেছে।সে জানান যখন বাচ্চা পুরোপুরি স্ট্যাবল হবে?কোনো সাপোর্ট ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে পারবে তখনই তাকে ভেন্টিল্যাটর থেকে বের করে আনা হবে।আরো জানিয়েছেন মল্লিকার জ্ঞান ফিরেছে। বাচ্চার কাছে নিজে যাওয়া হবে তাকে সর্বপ্রথম।ত্রিশ মিনিট পর ক্যাবিনে শিফট করা হবে।
অপেক্ষারত সকলেই। মাহরুর হাতে তুলে মিষ্টিকে খাইয়ে দিচ্ছে। মুখে খাবার পুড়ে মিষ্টি বললো,
“বাবু কখন আসবে মাহি বাবা?”
বারবার হৃদয়ের ক্ষত জ্বলে উঠে।মিষ্টির উত্তরে মাহরুর বললো,
“তুই দুআ কর মা।দেখবি তোর দুআতে দ্রুতই চলে আসবে।”
“আচ্ছা মাহি বাবা?বাবুটা দেখতে কেমন?”
“একদম তোর মতন।তোর বোন”
“তাহলে কি ও আরেক মিষ্টি?”
“হ্যাঁ আরেক মিষ্টি।”
“আমি ওকে দেখবো বাবা।ওকে এনে দাও”
মিষ্টির মাথায় হাত রেখে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো মাহরুর।বললো, “খুব শীগ্রই এনে দিবো”
খুশির সময়গুলো দ্রুতগতিতে যায়।আর অপেক্ষার প্রহর হয় আরো বিষণ্ণতা বাড়ায়। এতটা মর্মপীড়া অল্পস্বল্প উপশম হলো মল্লিকার মুখ দেখে।শরীরটা কেমন নিথর দেখাচ্ছে।নিঃশ্বাস চলছে,চোখ পিটপিট করছে,কথাও বলতে চাইছে। মাহরুরকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো।
নিজের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে মুখ থেকে আওয়াজ বের করে বললো, “মিষ্টি…”
মাহরুর মল্লিকার হাত চেপে ধরে।ঠান্ডা শীতল নরম হাতটা।বলে, “মিষ্টি আছে।রেদোয়ান ওকে নিয়ে একটু বাহিরে গেছে।”
মল্লিকা ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “আমার বাচ্চাটাকে…ওরা ওখানে রেখেছে কেনো?”
মাহরুর নিজেকে শক্ত করে বললো, “সময়ের আগে চলে এসেছে ও।তাই কিছুদিন ভ্যানটিলেটরে রাখতে হবে”
“ভ্যানটিলেটর কি?”
শীতল চাহনি মাহরুরের।মল্লিকা জানে না ভেন্টিল্যাটর কি জিনিস।হয়তো মিষ্টির জন্মের সময় এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে।মল্লিকার চুলে হাত বুলিয়ে মাহরুর বলে উঠে,
“যেসব বাচ্চারা সময়ের আগে জন্ম নেয় তাদের যেনো কোনো সমস্যা না হয় সেই জন্য ছোট্ট কাচের ঘরে তাদেরকে রাখে।”
মল্লিকা ঢুকরে কেঁদে উঠলো।বললো, “ওর..ওর নাকে….পাইপ দিয়ে রেখেছে… ও কষ্ট পাচ্ছে।ওর কিছু হবে নাতো? মাহরুর..!”
কষ্টে জর্জরিত হৃদয়টা অঙ্গের পীড়ার চেয়েও দ্বিগুণ।মনের মধ্যেখানে অজানা ভয় নিশপিশ করছে।কি হবে?মল্লিকা সম্পূর্ণ অজ্ঞ এইসব বিষয়ে। মাহরুরেরও তেমন জানা ছিলো না।হাত পায়ের কাপুনি বেড়েছে ইন্টারনেটে প্রি ম্যাচিওর বাচ্চার সমস্ত তথ্য গ্রহণ করে।
মাহরুর লম্বাটে নিঃশ্বাস ফেলে।শক্ত থাকার ভনিতা এখানে করতেই হবে।উত্তরে বললো,
“আজকালের যুগে টেকনোলজি অনেক উন্নত চন্দ্র।আমি ইন্টারনেটে দেখেছি।কিছু হবে না আমাদের মেয়ের।”
“আমি ওর কাছে আবার কখন যাবো?”
“ডাক্তার বললো দুই ঘণ্টা পর।একটু ঘুমো দেখি এখন।”
এখন বুঝি পেটের ব্যথাটাও অনুভব হলো। এনেসথেসিয়ার প্রভাব কমছে।যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্র হবে।কাতর গলায় বললো,
“অনেক ব্যথা।সহ্য হচ্ছে না।”
“আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করছি?ব্যথা নাশক কোনো ঔষধ দেওয়া যাবে কিনা?”
মাহরুর দৌড়ে গেলো বাহিরে।আশেপাশে নার্সদের প্রশ্ন করছে।তারা সকলেই বললো দেওয়া যাবে না।তাও সঠিক তথ্যর জন্য ডাক্তারের চেম্বারের দিকে দ্রুত কদমে হেঁটে যায়।কিছু সময় পর অনুমতি পায় প্রবেশ করার।
মাহরুর বিনয়ের সুরে বললো, “স্যার আমার স্ত্রীর অনেক কষ্ট হচ্ছে।ওকে ব্যথানাশক কোনো ঔষধ দেওয়া যাবে?”
“আমরা পেইন কিলার ইনজেকশন দিয়েছি মিষ্টার মাহরুর।”
“তাহলে ব্যথা কমছে না যে?”
ডাক্তার সাহেব হাসলেন।বললেন, “একটা সুস্থ দেহের অংশে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে।এত সহজেই ব্যথা কমে যাবে?পেইন কিলার অল্প সস্তি দিবে শুধু।আমরা একটু পর ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে যাবো।”
“স্যার আরেকটা প্রশ্ন?”
“জ্বি শিউর”
“আমার মেয়েটা স্যার? ও সত্যিই ঠিক আছেতো?”
ডাক্তার চক্ষু নামান।চোখের চশমা খুলে পাশে রেখে আবারো মাহরুরের দিকে চাইলেন।বললেন,
“দেখেন মিষ্টার মাহরুর।একটা বাচ্চা যখন প্রি ম্যাচিওর হয় তখন ডাক্তার শুধু পারে তাকে সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার। ভ্যানটিলেটরে রেখে মায়ের গর্ভের মতন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা।কিন্তু যতই হোক মায়ের গর্ভ মায়ের গর্ভই।কোনো যান্ত্রিক শক্তি এর সাথে শতভাগ মিলতে পারবে না।তবে আমি একটু আগে চেক করেছি।আপনার বেবি ঠিক আছে।একটু একটু করে ভ্যানটিলেটরের সাথে মানিয়ে নিচ্ছে।ইনশাল্লাহ খুব শীগ্রই আপনাদের কাছে চলে আসবে”
__
একদিন?দুইদিন?নয়টা দিন কেটে গেছে। দিবা রাত্রি পাল্লা দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে।খেয়াল করেনি কারো।হাসপতালকে নিজের ঘর বলে মনে হচ্ছে।রাতের আঁধারে পাঁচ তলা ক্যাবিন থেকে নিচে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল মাহরুর।বুকে হাত ভাজ করে আছে।মাথা ভার ভার মনে হচ্ছে।প্রতিদিন একই প্রশ্ন।একই জবাব।তার মেয়েটাকে কবে দেওয়া হবে?প্রতিদিন একই উত্তর আসে যেদিন পুরোপুরি তাকে স্ট্যাবল মনে হবে সেদিনই।দিন রাতের পালা বদলে নয়টা দিন কেটেছে অথচ মেয়েকে একটাবার কোলে তুলতে পারলো না?বুকে জড়াতে পারলো না?নিচের রাস্তা থেকে চোখ তুলে আকাশের দিকে চাইলো। পলকহীন চেয়ে কিছু কথা আওড়ায় মনে মনে।এই আলাপন গোপন। মাহরুরের মন ব্যতীত আর কেউ জানেনা।
আকস্মিক একজন নার্স এসে বললেন, “মিসেস মল্লিকা?”
মাহরুর ঘুরে তাকায়।মল্লিকা ঘুমিয়ে ছিলো নার্সের ডাকে লাফিয়ে উঠেছে। মাহরুর বললো, “জ্বি সিস্টার?”
“বেবিকে খাওয়াতে হবে।আপনার স্ত্রীকে নিতে এসেছি।”
মল্লিকা বেড থেকে পা নামায়। মাহরুর সাহায্য করলো তাকে। নার্স তাকে ধরে নিয়ে গেলো এন. আই. সিউ এর দিকে।প্রতিদিন চেয়ে থাকে মল্লিকার যাওয়ার পানে।বুকটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়।আর কিছুদিন তার মেয়ে দূরে থাকলে বোধহয় হৃদয়ের রক্তিম আভা সরে গিয়ে কয়লার রঙ ধারণ করবে।
পনেরো বিশ মিনিট পর মল্লিকা ফিরে এসেছে। মাহরুর তার কাছে এসে বসলো।ফল কাটছে। নিঃশব্দে। নীরবতায়। কাটাকুটি শেষ করে মুখে তুলে খাইয়ে দিল।
চরম হতাশা নিয়ে বললো, “হিংসে হয় তোকে।প্রতিদিন তিন থেকে চারবার ওর কাছে যাস।ছুঁয়ে দেখিস।আর আমি? আমিওতো বাবা।আমাকে কেনো দেয় না।”
মল্লিকা হাত বাড়ালো মাহরুরের মুখের পানে। দুহাতের সাহায্যে টেনে কপালে চুমু খায়।মল্লিকা ব্যতীত কারোই অনুমতি নেই। অকস্মাৎ মাহরুর ফলের প্লেট খট করে পাশে রাখে। উদ্বিগ্ন হয়ে লুটিয়ে পড়ে মল্লিকার বাহুতে।জড়িয়ে ধরে পুরুষালি কান্নার আভাস পাওয়া গেলো। হৃদয়টা ঢিপঢিপ করছে মল্লিকার। মাহরুরকে কাঁদতে দেখেনি কোনোদিন।এত দুর্বল করে ফেললো কেউ তাকে?যে তার অস্রু থামছেই না?
বুকে জড়িয়ে চুলের ভাজে হাত বুলাতে থাকে মল্লিকা।এতটা দিনতো তাকে সামলে এসেছে।আজ নাহয় মাহরুরকে সামলে নেক?
“আপনি আমাদের মেয়ের নাম ভেবেছেন?”
অস্পষ্ট আওয়াজে মাহরুর বললো, “অনেক আগেই ভেবে রেখেছি”
“আমাকে বলেননি কেনো?”
“ভুলে গিয়েছিলাম”
মল্লিকা ঠাট্টা করে বললো, “বাহরে! এখনই মেয়ের মাকে ভুলে যাচ্ছেন।মেয়েকে পেলে আর চিনবেনই না”
ব্যথিত;কান্নারত মুখে হাসি ফুটলো।মনে মনে হিংসুটে বলে আখ্যা দিলো মল্লিকাকে।মাথা তুলে দুহাতের সাহায্যে নিজের মুখ মুছে নিয়ে বললো,
“তোকি? তুই পুরোনো হয়েছিস।তোকে ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক না?”
চমকিত মল্লিকা দ্রুত জবাব দেয়, “আমি আমার মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবো।তখন দেখবো!”
“আমাদের মেয়েদের রেখে যাস।”
“ওরা আমার মেয়ে।মায়ের অধিকার বেশি।”
“মেয়েদের উপর বাবাদের অধিকার বেশি থাকে।”
“না এটা চলবে না।”
“আলবৎ চলবে!”
মল্লিকার ঝগড়ার মধ্যেও মিষ্টির কথা মনে পড়লো।আজ মেয়েটা আসেনি।অভিমান করেছিলো গতকাল।কেনো তার পুঁচকে বোনকে দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। করিডোরে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করেছে।মায়ের পিছু নিয়েছিলো।সাথে যাবে দেখবে বোনকে।শিরীনের বাড়িতেই থাকে সে। আজ আসেনি।
মল্লিকা বললো, “মিষ্টি আজ আসলো না যে?”
“শিরীন ইচ্ছে করেই পাঠায়নি।বাচ্চা মানুষ বুঝবে না বায়না করবে বোনকে দেখার জন্য।আবার হসপিটালের পরিবেশে ওর না থাকাই ভালো।”
“কাল আনবেন ওকে।”
“আচ্ছা”
“মেয়ের নামটা বলেন জনাব”
“মাহরুর,মল্লিকা,মিষ্টি আর মেহুল”
একবার শুনেই নাম পছন্দ হয়েছে মল্লিকার।মনে হলো যেমন ‘ ম ‘ শব্দের সমাহার।মল্লিকার ঠোঁট জুড়ে এক চিলতে হাসি ফুটেছে।এই নামকে সেও অনুমোদন দিলো।তাদের মেয়ের নাম হবে ‘ মেহুল ‘।মিষ্টি মাহরুর ইবনাত এর সাথে যোগ হয় আরো একজন মেহুল মাহরুর ইবনাত।
নীরবতা কাটিয়ে মাহরুর বললো,
“তিন নারীতে সংসার আমার।”
চলবে….