চন্দ্র’মল্লিকা ৩৯
লেখা : Azyah_সূচনা
জীবনে আর নতুন কি হয়েছে?পুরোনো নিয়মেই চলছে যখন থেকে দায়িত্ব ঘাড়ে পড়েছে।টাকা কামাও আর জমাও।আলাদা ব্যাংক একাউন্ট খুলে এসেছিল সেইদিন।মিষ্টি আর নতুন সদস্যের জন্য।আপাদত সেখানে অনাগত সন্তানের প্রাথমিক সব খরচা মেটানোর জন্য মাসে মাসে টাকা রাখছে।সাথে মল্লিকার প্রতিনিয়ত এর চেকআপের জন্য।যেনো সে পৃথিবীতে আসার পর কারো কাছে হাত পাততে না হয়। ভালোয় ভালোয় চলে আসুক মাহরুর আর চন্দ্রমল্লিকার কোলে।
সপ্তম মাসে পদার্পণ করা মল্লিকা কিছুটা অগোছালো। আহ্লাদে আটখানা।মিষ্টির সময় যত শক্ত ছিলো এখন ততটাই দুর্বল।মনে গেঁথে গেছে একটা বিষয়।তাকে সামলানোর জন্য আছে একটা শক্ত সম্ভ।আদরে আদরে অলসতা ধরে গেছে।কথা শুনে না।খাওয়া দাওয়ায় অনীহা।আজ মাহরুর রাগ দেখাতে বাধ্য হলো।ছোটোখাটো ঝগড়া করেছে মল্লিকার সাথে।এড়িয়ে যাবে তার চন্দ্রকে।একটু গুরুত্বহীনতায় ভুগলেই লাইনে চলে আসবে বদ মেয়েটা।দুই দুইটা বাচ্চার মা হতে চলেছে।তারপরও বুঝশক্তি নেই?
“কি করেন?”
অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে অপেক্ষায় বসে ছিলো।ফোন করবে না চন্দ্র? তা কি করে হয়?ফোন আসলেও মাহরুর নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখলো।
উত্তর দিলো বটে, “কাজ করছি”
“খেয়েছেন?আজ তরকারি কেমন হয়েছে বললেনও না”
“কেনো তুই চেখে দেখিসনি?”
“আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।আপনি খেয়েছেন জেনেই খেতে বসতাম।”
আরো রাগ চড়ে মাহরুরের।ঘড়িতে দুপুর আড়াইটে বাজে।এখনও খাওয়া হয়নি মল্লিকার। বিগড়ে যাওয়া মেজাজকে সংযত না করতে পেরে সামান্য ধমকের সুর প্রয়োগ করলো।
বললো, “তুই আমার নতুন বউ?আমি না খেলে তুই খাবি না? চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো যদি এক্ষণ ফোন রেখে খেতে না বসিস!”
আহ্লাদী কণ্ঠে প্রশ্ন এলো, “পুরোনো হয়ে গিয়েছি না?”
“হ্যাঁ হয়েছিস!কতবার বলেছি দুপুর একটা থেকে দুইটার মধ্যে খাবার খেতে। মিষ্টিকেও না খাইয়ে রেখেছিস?”
“না ওকে খাইয়েছি।”
“তোর দুপুরের খাওয়ার পর ওষুধ আছে তুই এটা ভুলে যাস কেনো বারবার?আমার কথাকি শুনবি না চন্দ্র!কত বোঝানো যায় একজনকে।”
“জোর করে খাওয়া যায়? ইচ্ছের একটা ব্যাপার আছে।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর।চোয়াল শক্ত করে বললো, “চাচা চাচীকে গ্রামে যেতে দেওয়াই ভুল হয়েছে আমার।তারা থাকলে অন্তত আমার চিন্তা কম হতো।”
“খাচ্ছি এখন। চেচাবেন না।”
“কি চেচাবো না!একটার পর একটা ভুল করে যাস।আদরে আদরে বাঁদর হচ্ছিস।তোর সাথে কঠোরতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই।আসতে দে আজকে বাড়ি।”
মাতৃত্বকালীন সময়ে বুঝি অন্য সময়ের তুলনায় বেশি অভিমান জমে?কারো অত্যুগ্র বাক্য এসে হৃদপিণ্ডে করাঘাত করে? মাহরুর সহজে রাগে না।তবে তার রাগের বেশ দেখেছে মল্লিকা।কিভাবে রাগের বশে জহিরকে মেরে তক্তা বানিয়েছিল?আবার রেহালাকে শায়েস্তাও করেছে। চাপা রাগ তার।তবে মল্লিকা সম্পূর্ণ নির্দোষ।কত চেষ্টা করলো নিজের যত্ন নেবে।পারে না।ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করতে গেলেও মনের বিরুদ্ধে করা যায় না।মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। অন্যপাশের ক্ষ্যাপা মানুষটা ফোন কেটে দিয়েছে।
মিষ্টিকে ডাকলো মল্লিকা।নিজের কাছে বসিয়ে বললো, “জানিস তোর মাহি বাবা আমাকে বকেছে”
“কেনো মা?মাহি বাবা আমাকে কখনো বকে না।”
“কিন্তু তোর মাকে বকেছে।”
“আমি কি মাহি বাবাকে বকে দিবো মা?তুমি কষ্ট পেয়েছো?”
মল্লিকা নিজের পেটে হাত রেখে বলল, “বাবুটা কষ্ট পেয়েছে।”
ছোট্ট কপালে ভাজ পড়লো।এত বড় দুঃসাহস?মিষ্টির অনাগত ভাই অথবা বোনকে কষ্ট দিলো?মিষ্টি বললো, “মাহি বাবাকে ফোন করো।আমি বাবাকে বকবো।বাবুকে কেনো কষ্ট দিলো? ও যদি এখন রাগ করে?আমাদের কাছে না আসে?…মা তুমি ফোন করো।”
মল্লিকার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটলো।নিজে পারবে না মাহরুরের সাথে।তকি?মিষ্টি ঠিকই উসুল করে নিবে।বাবা মেয়ে বুঝে নিবে।ততক্ষনাত ফোন হাতে নেয়।ফোন করে মিষ্টির কানে ধরিয়ে দিলো।আরো একবার ফোন পেয়ে মাহরুর হাসে।হয়তো ক্ষমা চাইতে ফোন করেছে।নিশ্চয়ই এতক্ষনে খাওয়া করে নিয়েছে মল্লিকা।
ফোন ধরেই বললো, “হ্যালো”
“মাহি বাবা!”
আশা ছিলো চন্দ্রের মিনমিনে গল্প শুনবে।হলো ভিন্ন।মিষ্টির মিঠা কন্ঠ শুনছে।তবে আজ মিষ্টির কন্ঠে পরিবর্তন। আদুরে ভাবটা নেই।কেমন রুক্ষ গলায় বললো মাহি বাবা।
মাহরুর উত্তর দেয়, “হ্যা বাবা?”
“তুমি মাকে কেনো বকেছো?…মাকে বকলে আর আমাদের বাবুটাও কষ্ট পেলো।মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।আমি ওকে বসে দেখছি।”
দ্বিরুপ প্রতিক্রিয়া এর মধ্যে গোলগাল পেকে গেলো।মিষ্টির কথায় ফিক করে হেসে ফেলবে নাকি মল্লিকা মেয়ের কাছে বাবার নামে নালিশ করেছে সেই বিষয়ে মল্লিকাকে মনেমনে গালমন্দ করবে?দুটোই হলো একই সাথে। ওষ্ঠেজুড়ে হাসি ফুটলো মেয়ের শাসনে আর মল্লিকার এমন কাণ্ডে কপাল কুঁচকে গেল তৎক্ষনাৎ।মেয়েকে হাতিয়ার বানিয়েছে!আজ সত্যিই মল্লিকাকে মাহরুরের অভিমান থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
“কথা বলছো না কেনো মাহি বাবা?কেনো কষ্ট দিলে বাবুকে?”
“আমাকে ক্ষমা করে দে আম্মা।আমি বাড়ি ফিরে বাবুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।”
“আর মার কাছে?”
মাহরুর সময় নিয়ে উত্তর দেয়, “হুম চাইবো”
“কানে ধরবে?”
“হ্যাঁ ধরবো।”
এরই মাঝে মিষ্টি তার নিজের আবদার রাখতেও ভুললো না।বলে ফেললো,
“আচ্ছা আজ চকোলেট আনবে কিন্তু”
“আচ্ছা মা।”
__
মল্লিকা গাল ফুলিয়ে রাখলে তাকে মাঝেমধ্যেই ‘ ফুলন দেবী ‘ বলে সম্বোধন করেছে মাহরুর। এখনতো মাহরুরই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।আসার পর থেকে ঘণ্টার পর ঘন্টা কেটে গেলো।মুখে বিশাল আকারের তালা।মল্লিকার ফুলন দেবী এর পুরুষবাচক শব্দ বের করে নিতে বেশি সময় লাগলো না।নাম দিলো মনে মনে।ফুলন দেব।মল্লিকার ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের মতন করে মাহরুরের পেছন পেছন ছুটতে পারবে না। গোলগোল নেত্রজোড়াকে নিজের হাতিয়ার বানালো।যা এখন মাহরুরের রাগ ভাঙার আগ অব্দি তার উপরই থাকবে।তাতেও বিশেষ কোনো লাভের আশঙ্কা দেখতে পায়নি মল্লিকা।
আবারো নিজের প্রথম হাতিয়ার মিষ্টিকে কাজে লাগালো।
বলল, “তোর বাবাকে বল আজ দোকানে যেতে না।”
মিষ্টিও মায়ের আদেশ পালন করলো বিনা প্রশ্নে। মাহরুরের দিকে চেয়ে বলে উঠে, “যেও না মাহি বাবা”
মাহরুর জবাবে বলে, “তোর মাকে বল যা বলার নিজে বলতে।অন্যকে কেনো বাহক বানায়?”
মিষ্টি আশ্চর্য্য হয়ে প্রশ্ন করলো, “বাহক?”
মল্লিকা মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠে, “তোর বাবা কি জানে না তুই ছোট?এত কঠিন ভাষা কেনো ব্যাবহার করে তোর সাথে।আবার আমার সাথে কঠিন আচরণও করে।”
মাহরুর বললো, “তোর মার বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে।ওই সতেরো বছরের কিশোরীর মতন আহ্লাদী হচ্ছে।”
“তোর বাবাকে বল বউদের আহ্লাদী হতে হয়।যদি সে হয় তার বাচ্চাদের মা তাহলে আরো বেশিবেশি আহ্লাদী হতে হয়।”
মাহরুর প্যান্টের পকেটে ফোন রাখতে রাখতে বললো, “ন্যাকামো দেখলে আর বাঁচি না।”
“ঠিক আছে।করলাম না ন্যাকামো।একটুও আহ্লাদ করবো না।কারো সাথে কথাও বলবো না।আমাকে এখন ভালো লাগবে কেনো? মোটা হয়ে গেছি।বিশ্রী দেখায়।এজন্যই আজকাল আমার উপর মানুষ রাগ থাকে।তোর বাবাকে বল আজকে থেকে সব বাদ।আমি মুখ তালাবদ্ধ করলাম।”
এতোটা জেদী কি করে হলো? মল্লিকাকে সর্বদা শান্ত আর বুঝদার হিসেবে জেনে এসেছে মাহরুর। দুষ্টুমির স্বভাবটা অব্দি ছিলো না তার মধ্যে।গ্রামীণ ভীত সন্ত্রস্ত কিশোরী হিসেবেই জানতো। নারীরূপে অভিভূত হওয়ার পরও এরকম আচরণই লক্ষণীয় ছিলো।
মাহরুর বলে উঠে, “এরকম করে রাগ উঠাস কেনো আমার?তোর বুঝা উচিত।আমি আমার মাথায় অনেক চিন্তা নিয়ে ঘুরি।জানিস তুই।সবটা মুখ ফুটে বলি না বলে আমি খুব শান্তিতে আছি?একটা সংসার সামলানো সহজ?নিজের যত্ন কেনো নিতে বলি?তোর মধ্যে আরো একটা প্রাণ আছে।কেউ দেখলে বলবে তুই সপ্তম মাসের অন্তঃসত্ত্বা?নিজের মুখটা দেখেছিস? যথাসাধ্য চেষ্টা করছি তোর যেনো কোনো সমস্যা না হয়। দৃষ্টিশক্তি থাকতেও যে অন্ধ তাকে আর কিইবা বলা যায়।আজ যতই অভিমান কর চন্দ্র।আমি গলবো না।নিজের যত্ন না নিলে আমিও এই মুখ তালাবদ্ধ করলাম।”
_____
রহিম মিয়ার ঘর থেকে চেঁচামেচির শব্দ ভেসে এলো।কোনো বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করছেন। মাহরুরের পা থমকে যায় রহিম চাচার অর্ধ ভেড়ানো ঘরের দরজায়।কারো কথা এভাবে লুকিয়ে শোনা ভালো না।তারপরও মাহরুরের পা যেনো গেড়ে গেলো।মস্তিষ্ক জানতে চাইছে কেনো এমন চেঁচামেচি?কি কারণ?রহিম চাচার পরপর জোবেদা বেগমের মৃদু কান্নার আভাস পাওয়া গেলো। মাহরুর এবারে চমকায়।দরজার পাশের ডাইনিং রুমে বসে কথা বলছেন।সবটা পরিষ্কার না হলেও বোঝা যাচ্ছে অনেক কথাই।কান্না শুনে ভেতরে ঢুকতে চাইলেই ফোনে কারো গলার আভাস শুনলো।সেও একইভাবে উত্তেজিত। পুরুষালী গলা।রাগ দেখিয়ে কিছু একটা বলছে।
মাহরুর আর ভেতরে গেলো না।তবে চিন্তা হচ্ছে।এই বয়সে এতো পেরেশানি ঠিক নয়।ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো অদৃশ্য অধিকারবোধে।মিনিট দশেক পর কথা শেষ হয়েছে। মাহরুর এবার দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে এসে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম”
দুজন অর্ধ বৃদ্ধ নারী পুরুষ বসে আছে।রহিম মিয়া কপালে হাত রেখে ডাইনিং টেবিলে আর জোবেদা খাতুন এর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন।
মাহরুরকে দেখে দুজনই ভারী পরিশ্রান্ত কণ্ঠে সালামের উত্তর নেয়। মাহরুর কোনো কিছু না ভেবেই প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে চাচা?..চাচী?”
মাহরুরের প্রশ্নে নির্বিকার হয়ে উঠলেন দুজনেই। অপরাধীর ন্যায় চোখ নামিয়েছেন। নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরলো চার দেয়ালের মধ্যে। মাহরুর গলা ভেজায়।তাদের এমন চুপ থাকা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাহরুর এগিয়ে গেলো জোবেদা খাতুন এর দিকে। তিনিই একমাত্র যেকিনা নির্দ্বিধায় বলে ফেলবেন।
জোবেদা খাতুন এর পাশে বসে মাহরুর পূনরায় জানতে চাইলো,
“বলেন না চাচী কি হয়েছে?আমি আপনাদের ছেলের মতন।বিশ্বাস রাখুন।আমি এই বিশ্বাস ভঙ্গ করবো না।”
রহিম মিয়া উত্তর দিলেন, “বইলা কোনো লাভতো হইবো না।”
মাহরুর তার দিকে দৃষ্টি নিবেশ করে বললো, “লাভ লোকসান এর হিসেব পড়ে।আগে জানতে হবে।সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে হবে।পরবর্তীতে কি হলো না হলো দেখা যাবে।”
সাদা লম্বা দাড়িয়ে হাত বুলিয়ে স্ত্রীর দিকে ইশারা করলেন রহিম মিয়া।বললেন, “তোমার চাচীরেই জিগাও।”
মাহরুরও দ্রুত জোবেদা খাতুন এর উদ্দেশে বললো, ” বলেন চাচী?”
জোবেদা বেগমের কুচকে পড়া মুখ বেয়ে আরো কয়েক রেখা অস্রুজল দেখা গেলো।বললো,
“আমার পোলায় কইছে বাড়িটা বেইচা দিতে।তারারা নাকি কোনোদিন দেশে ফিরবো না।বাড়ি রাইখা কি লাভ?”
রমজান মিয়া তাল মিলিয়ে বললেন, “পোলায় ফোন দিছিলো।কইতাছে তোমরা বাচবা কতদিন?কেউ না থাকলে এই বাড়িটা দখলে যাইবো গা।এই কারণে বেইচা দিয়া টাকা সব ব্যাংকে রাখবার কইসে।”
মাহরুর খানিকটা কঠোর গলায় বললো, “ভবিষ্যৎ কী কেউ দেখেছে?আগেই ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েতো লাভ নেই।”
“আমি এই ঘরটা আমার টাকায় তৈরি করছি।আমার শখ আছিলো এই বাড়ির কোনো ভাগ আমার পোলা মাইয়ার নামে যাইবো না।ওদের দুইজনের নামে দুইটা জমি আছে গেরামে।আমরা যাওয়ার পর এটা এতিমখানার বাচ্চাগো লেইগা দিয়া দিমু।জীবনে জানতে অজান্তে পাপ করছি। এতিম বাচ্চাগো মাথায় একটা ছাদ দিতে পারলে মরার পরও দুআ পামু।আমার উসিলায় আমার সন্তানরাও পাইবো”
“ভালো সিদ্ধান্ত চাচা।”
“কিন্তু আমার পোলায় মানবো না মাহি।”
“এটাই কি কারণ চাচা?যে আপনারা না থাকলে এই বাড়ি কি হবে?নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?”
চটজলদি একটা বিষয় পাকড়াও করে ফেলায় হতবিহ্বল দেখালো রহিম মিয়াকে।জোবেদা খাতুন আর সে একে ওপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।কেউ কোনো উত্তর দিলো না।
মাহরুর সন্দিহান গলায় বললো, “আমার মনে হচ্ছে এখানে একটা কারণ না।আরো কিছু কারণ অবশ্যই আছে।বাড়ি বিক্রির জন্য তাগাদা দেওয়ার পেছনে।”
পরাজিত হয়ে রহিম মিয়া বললেন, “ওর নাকি টাকা লাগবো। দশ লাখ”
মাহরুর হাসলো।এই হাসি তাচ্ছিল্যের।বললো, “বিদেশি টাকায় দশ লক্ষ কোনো ব্যাপার না চাচা।কিন্তু বাংলাদেশে অনেক বড় অংক।আপনার ছেলেকে বুঝতে ভুল করছেন ”
রহিম মিয়া আর জোবেদা বেগম চাইলেন মাহরুরের দিকে।তার বলা কথার অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। প্রশ্নবিত্ব চোখে চেয়ে রইলেন। মাহরুর উচিত কথা সময়-ক্ষণ ভেবে বলে না।হোক আপন হোক পর।
বাধহীনভাবে বলে উঠলো, “হতে পারে সে আপনার ছেলে।আমি যে কথাটা বলবো আপনার কষ্ট হবে।তারপরও শুনুন চাচা।আপনার ছেলে বাড়িটা বিক্রি করতে বলছে কারণ এই বাড়ির সম্পূর্ণ টাকা তার চাই। দশ লক্ষ টাকা লাগবে,বাড়ি দখল হয়ে যাবে এসব বাহানা মাত্র।”
একটু থেমে আবার বললো, “আমার কথায় কষ্ট পেলে দু চারটে থাপ্পড় দিন আমায়।তারপরও আমি যা বলছি তাই ঠিক। মিলিয়ে নেবেন।”
তাদের মুখেই শুনেছে মাহরুর। বিলেতে স্থায়ী রহিম মিয়ার ছেলে।অনেক বছর যাবত।সেখানে নিজস্ব বাড়ি আর ব্যবসা আছে।তার সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করেই এমন উক্তি ছুঁড়েছে মাহরুর।যে লোক বিদেশে এত এত অর্থের মালিক সে নিশ্চয়ই দশ লক্ষ টাকার জন্য বাড়ি বিক্রি করতে বলবে না। মাহরুরের কথায় পূনরায় নীরব হয় দুজনে।জং ধরা মস্তিষ্কে জোর দিলো। মাহরুরের কথায় ভুল নেই কোথাও।যুক্তি আছে।
আশাহত চোখে রহিম মিয়া জানতে চাইলেন, “কি করমু?তুমিই কিছু বুদ্ধি দাও।আমি বাড়িটা হারাইতে চাই না।”
মাহরুর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো, “আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে আমি আসলে খারাপ দেখায় চাচা”
“না বাবা খারাপ দেখায় না।আমার বাড়িটা বাঁচাইতে সাহায্য করো।”
মাহরুর কিছু সময় অতিবাহিত করে বললো, “বাড়ি কার নামে চাচা?”
“এখনও আমার নামেই আছে।”
“আচ্ছা।আপনি নিজের নামেই রাখুন।যে যাই বলুক কারো কথায় বাড়ির কাগজে অথবা অন্যকোনো কাগজে সই করবেন না।”
“মাহি শুনো আরেকটা কথা।আমার পেনশনের টাকা ছাড়াও আরো কিছু টাকা ব্যাংক থেকে সরানো হইসে”
“ব্যাংক থেকে টাকা সরানো এত সহজ না চাচা।”
“সহজ।আমি জানি আমার ছেলেই সরাইছে।ওর কাছে সব তথ্য আছে।আমি নিজে ব্যাংকে এই অঙ্গীকারনামা দিছিলাম আমার অনুপস্থিতিতে আমার ছেলে যেনো টাকা নিতে পারে।”
“এটাইতো ভুল করলেন চাচা।আপনি ব্যাংকে যাবেন।গিয়ে বলবেন আপনি ছাড়া যেনো আর কেউ আপনার একাউন্ট থেকে টাকা নিতে না পারে।হোক আপনার ছেলে বা অন্য কেউ”
“আচ্ছা।” সম্মতি দিলেন রহিম মিয়া।
মাহরুর উঠে দাড়ায়।বিদায় নিয়ে বলে, “সতর্ক হলেই হবে কোনো চিন্তা করবেন না।কোনো দরকারে আমাকে ডাকবেন।আমি হাজির থাকবো।আর কান্নাকাটি করা চলবে না কিন্তু চাচী।”
__
কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মাহরুর।আসলে ঘুমোয়নি। ঘুমোনোর নাটক করছে।একটা মাত্র ঘরে একজনকে কত এড়িয়ে যাওয়া যায়?অন্তত চোখাচোখি হয়।এই চোঁখের চাহনিটাই দুর্বল করে ফেলে মাহরুরকে।মল্লিকার মলিন চক্ষু জ্যোতি হৃদয়ে এসে তীরের মতন বিধে। উপেক্ষা করার সাহসে কুলায় না।মন বলে,
“কাছে যা।বুকে জড়িয়ে নে।দেখ কি রূপবতী হয়েছে তোর চন্দ্রমল্লিকা?”
নিজের হৃদয়ের লাগাম টানতে আগে অবাধ্য চোখকে মল্লিকার থেকে সরিয়ে নেয়।না দেখবে না মন গলবে। মল্লিকাও মুখ ফুলিয়ে।এই লোক কি তাকে মানাবে না?আরাম করে সিংহাসনে বসে নয় শুয়ে পড়লো যে? মহাশয়ের মিথ্যে রাগের বালাইয়ে ধরেছে।কি এমন করেছে সে?একটু নিজের অযত্ন?তাও কি শখে?এই নিয়ে কত তোলপাড়।
তৃতীয়বারের মতন মিষ্টিকেই হাতিয়ার বানালো।কানে কানে শিখিয়ে দিলো,
“মাহি বাবাকে বল মা কাদঁছে।তুমি তার সাথে রেগে আছো বলে।”
মিষ্টি উত্তর দেয়, “তোমার চোখে পানি নেই মা। কোথায় কাঁদছো?”
এইটুকু মেয়েকে এত বুদ্ধিমতী কে হতে বলেছে?মল্লিকা ঢোক গিলে। মিছেমিছি কাদো মুখ বানিয়ে বললো,
“এখন কাঁদবো।যা গিয়ে বল”
মিষ্টিও একলাফে মাহরুরের চাদর টেনে সরিয়ে দেয়।বলে, “মা কাদঁছে।”
“কাঁদুক!” সোজা জবাব এসেছে।
এবার মিথ্যে কাদো মুখটা সত্যিসত্যি ক্রন্দনে সিক্ত হতে শুরু করলো। মুখ ঘুরিয়ে নেয়।লাইট নিভিয়ে অন্যদিকে ঘুরেই শুয়ে পড়েছে।রাতের গভীরতা বাড়ছে ক্রমশ।মল্লিকার চোখে ঘুম নেই। মাহরুরকে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতেও ক্লান্ত।পেটের ভার একজায়গায় দেওয়া উচিত হবে না।তাই সামান্য ঘুরল।রাগ,অভিমান বাচ্চার বাবার উপর।বাচ্চার উপর নয়।পিছু ঘুরে চাইতেই চমকে উঠলো।মাথার একদিকে হাত মুঠ করে ঠেকিয়ে আছে মাহরুর। বারংবার পলক ফেলছে মল্লিকার দিকে চেয়ে।অভিমানে মল্লিকার মুখ কুচকে আসে।অন্যদিকে ফিরতে চাইলে মাহরুর থামিয়ে দিল।
বললো, “বিবাহিত পুরুষেরা কোনোদিন জিততে পারে?তাও তার একমাত্র বউয়ের কাছে?ভুল করেও জিতে যাওয়া যেনো বউদের বউগত অধিকার।”
মাহরুরের কথার বিনিময়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মল্লিকা।উত্তর দিলো না। মাহরুরকে এড়াতে চোখ বন্ধ করে নেয়।মল্লিকার কপালে আঙ্গুল স্পষ্ট করে মাহরুর বললো,
“আমার দুটো সন্তান।অথচ দুজনের একজনও জানে না তাদের মা গাঁধী,পাগল!”
চলবে….