চন্দ্র’মল্লিকা ৩৭
লেখা : Azyah_সূচনা
“চন্দ্র সোজা হয়ে ঘুমো।এটা কেমন ভঙ্গি ঘুমানোর? পেটে চাপ পড়ছে”
বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে মাত্রই চোখটা লেগে এসেছিল। মাহরুরের বাজখাই গলায় সেটা সম্ভব হলো না। একঘেঁয়েমি লাগছে। অবসন্নতায় ঘেরাও।চোখ টানছে ঘুমে।সাথে মাহরুর বাহু টানছে।উঠতে হবে।সোজা হয়ে শুতে হবে।
মল্লিকা নাকোচ করলো।বললো, “আমি এভাবেই থাকবো।”
“চন্দ্র!সোজা হ বলছি”
“ভালো লাগছে না মাহরুর ভাই।সরুন”
ধমকের সুর মিয়ে এসে অস্থির হলো। বিচলন চললো হৃদয়ে।ভালো লাগছে না?দ্রুত মল্লিকার টেনে জানতে চাইলো,
“কি হয়েছে?কেনো ভালো লাগছে না?সমস্যা হচ্ছে কোনো?ডাক্তারে যাবি চন্দ্র? ওষুধ খেয়েছিলি?..”
“না…”
“দোষ আমারই।তোর ওষুধের ব্যাপারটা আমার খেয়াল রাখা উচিত। ধুর!”
মাহরুর মাথা ঝাঁকাচ্ছে।মল্লিকা হাত এগিয়ে মাহরুরের মুখ চেপে স্থির করলো তাকে।বললো,
“থামেন!কিছু হয়নি।ঘুম পাচ্ছে।আর সোজা হয়ে শুয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না তাই উপুড় হয়েছি।”
“না চন্দ্র এভাবেতো চলবে না। পেটে চাপ পড়ছিলো। তোরতো বোঝা উচিত।”
পল্লবিত মুখে মল্লিকা বলে উঠে, “মাত্র আড়াই সপ্তাহ বয়স ওর।এখন আমি যেভাবে ইচ্ছে শুতে পারবো।তিনমাস পর পেটে চাপ দেওয়া যাবে না আর।জানি বলেই করেছি এই কাজ।”
মানলো না মাহরুর।নিজের মতই প্রশ্ন করে গেলো, “ডাক্তার যে বললো প্রথম তিনমাস সাবধানে চলতে হবে?”
“হ্যাঁ তাতো অবশ্যই।”
কিছু একটা ভাবতে বসলো মাহরুর। বোধগম্য হয় মল্লিকার।এখনই আবার কিছু আদেশ ছুঁড়ে বসবে।এটা করিস না,ওটা করিস না।ঘুমে ভেঙে পড়া চোখগুলো সজাগ রেখে বসে রইলো মাহরুরের অপেক্ষায়।
ভাবনা চেতনার অবসান ঘটিয়ে মাহরুর বলে,
“এই শোন।সন্ধ্যার দিকে ছাদে যাবি না।চুল খোলা রাখবি না।তোর পছন্দের ফল কি?আর খাবার?একটা লিস্ট দিস।আমি সব নিয়ে আসবো।আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে?”
মল্লিকা ঠোঁট প্রসারিত করছিলো তার আগে মাহরুর ফোন হাতে নেয়। বৃদ্ধাঙ্গুল চালিয়ে দ্রুত গতিতে রমজান চাচার নাম্বার বের করলো।বললো,
“আমি চাচা চাচীকে ঢাকায় আনছি।এখন চাচীর অনেক প্রয়োজন।আমি অফিসে থাকি।মিষ্টিকে দেখতে হয়।তুই আর যাবি না মিষ্টিকে আনতে স্কুল থেকে ভর দুপুরে।আমি দিয়ে আসবো আর দুলাল গিয়ে আনবে।”
“এসবের কোনো দরকার নেই তো!”
“চুপ থাক!”
মাহরুরের কর্মকাণ্ড বীমূঢ় করে তুলছে।লোকটা মল্লিকার চেয়ে বেশি ছটফট করছে।কি রেখে কি করবে দিশা খুঁজে পেলো না। হেঁটে চলে আবার ভাবনায় মশগুল হয়ে উঠে।মোবাইলে খুঁটে খুঁটে দেখছে প্রথম তিনমাস একটা হবু মায়ের জন্য কি কি প্রয়োজন।লিস্ট করে ফেলে কাগজে কলমে।আবার কাছে বসে কপালে হাত রেখে দেখে। পেটে হাত রাখে।কোনো সমস্যা আছে নাকি যাচাই করতে।ডাক্তার সাজার উপক্রম।ইতিমধ্যে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে মল্লিকাকে চুপ থাকতে বলে রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগমের মাথায়ও প্রেশার তুলে ফেললো। কাল পরশুর মধ্যেই হাজির হবে তারাও।
কপালে হাত চেপে বসলো মল্লিকা।গতকাল বললো না?তাকে অনেক জ্বালাবে।ঠিক!এই জ্বালাতন চলবে দীর্ঘ নয়মাস। রক্তক্ষয়ী নয় মস্তিষ্কক্ষয়ী যুদ্ধ চলবে।
একহাত কোমরে আর অন্যহাতে মাথা চুলকে মাহরুর বলে,
“মাতৃকালীন ছুটি আছে। পিতৃকালীন ছুটি নেই কেনো?থাকলে ভালো হতো না?আমি তোর সাথে থাকতে পারতাম।”
“আপনি অফিসেই থাকেন ভাই।”
“কি বললি!”
“কিছুনা ঘুমাবো।শুভ রাত্রি”
__
“এখনতো সবকিছু ঠিকই গুছিয়েছেন।নিত্য নতুন আইডিয়া আসছে আপনার মাথায়।শুনলাম বিয়ে করে ফেলেছেন?আমার বেলায় সেগুলো কোথায় ছিল?আমি থাকতেতো নতুন চাকরি খোঁজার ইচ্ছেটাও জাগেনি আপনার মাথায়।নাকি আমাকে সাইড করে ওই মল্লিকার জন্য জায়গা বানাচ্ছিলেন?”
দামী পোশাক আর অলংকারে আবৃত হীরা।পরনের কাপড়ের ধরন বিলেতি। চুলগুলো অন্য রঙে রাঙিয়েছে।কেমন যেনো লাগছে দেখতে।তবে মাহরুরের মনে একবিন্দু তার প্রতি আগ্রহ জাগলো না।উল্টো তার তাচ্ছিল্যে আমর্ষ।মল্লিকাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকেই ফিরছিলো।ডাবের পানি খাওয়ানোর জন্য দোকানে বসিয়ে রেখে যে এতদিন বাদে হীরার মুখ দেখতে পাবে সেটা ভাবেনি।
হীরা আবার বললো, “এই হলো মল্লিকা? তাইতো?চিনি একে আমি।আমাদের বিয়েতে শোকাহত মুখটা দেখেছিলাম।”
মাহরুর বাকা হেসে হীরাকে প্রশ্ন করলো, “ফিরলে কবে বিলেত থেকে?”
“সেটা জেনে আপনার কি লাভ?আপনাকে মাত্র যা বললাম?মনে হচ্ছে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন।”
“মোটেও না।আসলে এসব ব্যাপারে কথা বলার ইচ্ছে,সময় দুটোরই বড্ড অভাব।বাবা হতে যাচ্ছি।দুআ করো”
“বাব্বাহ! খুব বদলেছেন আপনি”
“ঠিক তোমার মতন হীরা।”
কটাক্ষ করছে মাহরুর।রাগে ফুঁসতে থাকা মল্লিকার মুখটাও দেখা গেলো। লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। মাহরুরের হৃদয় প্রসন্ন হয় এই হিংসুটে স্বভাব দেখে।
মল্লিকার হাত ধরে তাকে উঠিয়ে দাড় করালো। বিদায় নেওয়ার আগে বললো,
“তোমার জন্যও এসবই করতাম হীরা।যদি তুমি মানুষটা আমার হতে।চেয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে সংসার সাজাতে।এটা সত্য মন থেকে ভালোবাসতাম না তোমাকে।তবে ভালোবাসতে কত সময় লাগে? একটু যত্ন? একটু আদর?একটু সমঝোতা? সব মিলিয়ে প্রেম হতো।কিন্তু হয়নি।তুমি ভালোবাসতে টাকাকে।আর যে জীবন্ত জিনিসকে ভালো না বেসে কোনো জড়বস্তুকে ভালোবাসে সেতো মানুষই না।সেও জড়বস্তু।ভালোবাসলে ভালোবাসা পেতে।ভালোবাসলে আমি তোমার সব আবদার পূর্ণ করার চেষ্টা করতাম।তুমি মজেছিলে অন্য পুরুষে।তাহলে তোমার উপর আমার কষ্টের কামাই কেনো উড়াবো?কথাগুলো বলতে চাইনি।তবে আজ বলছি।আরেকটা পরামর্শ দিচ্ছি।তোমার লোভ এখন অহংকারে পরিণত হয়েছে।সামলাও।ডুবে যাবে।দুআ করি যেনো এমন না হয়।”
হীরা রাগে ডগমগ করে বললো, “আমি আমার স্বামীর সাথে খুব ভালোই আছি মাহি।আমাকে ভালোবাসে আমার সব শখ পূরণ করে।আপনার জ্ঞান না ঝারলেও চলবে।”
কথার উত্তর দিলো মল্লিকা, “গলা নামিয়ে কথা বলুন।এত তেজ দেখানোর কোনো কারণ নেই।এত টাকা?এত ভালোবাসা?তাহলে এখানে এসেছেন কেনো?এসব আমাদের দেখাতে?…ভালোই করেছেন দেখিয়ে।আপনাকে দেখে আমাদের খুব ভালো লাগলো।নিজেদের অবস্থান আরো ভালোভাবে বুঝলাম।আমরা আপনার চেয়ে লাখগুন ভালো আছি।”
“এই মেয়ে!এই!” চেচিয়ে উঠলো হীরা।
“আসতে পারেন আপনি।আমার স্বামীর দোকানের সীমানায় পা দিয়ে রেখেছেন।বের করে দেওয়ার অধিকার আছে।দিলে আপনারই সম্মানহানি হবে।যান এখান থেকে।আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না”
অতিরিক্ত রাগ মল্লিকার জন্য ঠিক নয়। হীরা তরতর করে বিলাসবহুল গাড়ীর দরজা লাগিয়েছে।সাইসাই করে ছুটলো কোথাও। মাহরুর দেরি করলো না। মল্লিকাকে নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরেছে।মিষ্টিকে নিয়ে রাতের খাবারটাও খেয়ে উঠলো।মল্লিকার মাথা গরম।রেগে আছে মুখে স্পষ্ট।মিষ্টিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।সকালে স্কুলে যেতে হবে।অথচ নিজে ঘুমালো না।সাথে মল্লিকাকে টেনে নিলো নিজের কাছে।আজকাল মল্লিকা পূর্বের তুলনায় বেশি আকর্ষণবোধ করে মাহরুরের প্রতি।বুকের উষ্ণতায় জড়িয়ে থাকতে চায় প্রায় সময়।পিঠ ঠেকায় মাহরুরের বুকে।চাদরে আবৃত করে নেয়।তবে কথা বললো না। রাগটা ধরে রাখলো নিজের মধ্যেই।
মাহরুরের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটে।কানের কাছে ফিসফিস করে মল্লিকাকে তারই বলা কথা ভেঙিয়ে বললো,
“আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। হুহ”
মল্লিকা ঘাড় ঘোরায়।বলে, “মজা করছেন?”
“উহু!আমার এই দুঃসাহস?”
“অভদ্র মহিলা সে একজন।”
“জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে বসলো মল্লিকা।বললো,
“আপনিও কম যান না।কি বলছিলেন?তুমি ভালোবাসলে আমিও ভালোবাসতাম।আদরে,যত্নে আরো কত কি?এখন এইসব বলার মানে কি?”
“আরেহ বাবাহ আমিতো উদাহরণ দিচ্ছিলাম।”
“এরকম উদাহরণ কেনো দিবেন?এখন আমি আছিনা?”
“আছিসতো চন্দ্রমল্লিকা।”
ঠোঁট কামড়ে ধরলো মল্লিকা।মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো।তার অভিমান কমছে না।ভালো লাগছে না। বাচ্চামোতে নেমে এসেছে।নিজেকে অনুধাবন করলো মিষ্টি রূপে।
মাহরুর বলে উঠে, “আপনার অধরজোড়া মুক্ত করবেন?”
“কেনো?”
“হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটাতাম ছুঁয়ে দিয়ে।”
“উহু!দিবো না।আপনি তৃষ্ণার্তই থাকেন।”
ক্ষুদ্র আকৃতির চক্ষু যুগল আশাহত।আধাঁরে আবছা চন্দ্রের মুখ পানে চেয়ে আছে।হাসি তার ঠোঁটে স্পষ্ট। অদ্ভুত এক পুরুষালি ঘ্রাণ ঘ্রানেন্দ্রিয়তে এসে ধাক্কা খাচ্ছে বারেবারে।মা হবে?জননী হবে আরো এক সন্তানের।তাই বুঝি আরো রূপবতী মনে হচ্ছে চন্দ্রকে?
মাহরুর সময় নিলো।চোখের তৃষ্ণা আছে নিবারণ করলো। খানিক বাদেই বললো,
“আজ যেমন আমার হয়ে দাঁড়িয়েছিস এভাবে সারাজীবন দাড়াবি?”
“যে মানুষটা পুরো একটা সংসারের হাল কাঁধে নিয়ে চলছে?কোনো অভিযোগ ছাড়া।তার জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়াবো না?সমাজের চোখে নারী দুর্বল।সৃষ্টিকর্তা আমাদের কোমল বানিয়েছেন ইচ্ছেকৃত।এই জগৎ সংসারে স্নেহ, মমতার দরকার আছে বলেই।তবে সেই কোমল নারীজাতির পাশে যখন একজন শক্ত পুরুষ এসে দাঁড়ায়?দুজনার সমন্বয়ে তৈরি হয় একটা স্তম্ভ। আপনাআপনি ওই নারী নিজের মধ্যে শক্তি অনুভব করে।আপনি আছেন বলেই আমি আছি।”
মল্লিকার এলোমেলো চুলের গভীরে হাত রেখে মাহরুর মুগ্ধ হয়ে উত্তর দেয়, “তুই আছিস বলে আমিও আছি।নাহয় ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতাম।ধুলোয় উড়ে বেড়াতো আমার অস্তিত্ব।”
“এই সুখে আমি কাউকে বাধা হতে দিবো না।আপনাকে আমার জন্যই বানানো হয়েছিলো মাহরুর ভাই। অনন্তকাল আমার হয়েই থাকবেন।”
“সত্যি বলেছিস।নাহয় এত শক্ত বাঁধ থাকার পরও দ্বিমুখী দুই নদী একত্রে এসে মিললো কেনো?”
ঠোঁট চেপে হাসি উপহার দেয় মল্লিকা।তাদের অল্পস্বল্প কথা অনেকটা প্রশান্তির।নিজেদের মধ্যে রুটিন তৈরি করেছে।অন্তত দশ মিনিট হলেও একে অপরের জন্য বরাদ্দ।রাতের আধারে আচ্ছন্ন শহরে আড়াল করে নিজেদের।ঝুড়ি খুলে বসে অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যতের।
নিজস্ব ব্যক্তিত্বের বাহু বন্ধনে নিবদ্ধিত হয়ে যাওয়া মল্লিকা কোনো নড়চড় করলো না।নাই কোনো অনিচ্ছা প্রকাশ করলো তার পানে।ডুবিয়ে নিতে চাইলে নেক।মল্লিকা বারেবারে ডুব দিতে চায় প্রেম সাগরে।অতলে ডুবে মাহরুরের ওই হৃদয়টাকে ছুঁয়ে দেবার বড্ড ইচ্ছে।কতই পরিষ্কার আর পবিত্র হবে ওই হৃদপিণ্ডটা?কতকত স্নেহ সেখানে সঞ্চিত করা।প্রতিদিন, প্রতিরাত যে আলোময় ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটায়?সেই হৃদয়টাকে দেখতে চায় চন্দ্রমল্লিকা।এক কোণে জমে থাকা দুঃখ নিজের সাথে নিয়ে ফিরতে চায়।
মনের এই আকুতি মুখ ফুটে বেড়িয়ে এলো। ধীমা গলায় বললো,
“কষ্ট তোমার অযোগ্য মাহরুর।কত সুখ চাই বলো?আমার জন্য বরাদ্দ সুখটুকুও তোমার জন্য চেয়ে নেবো”
বক্ষ পিঞ্জিরায় আবদ্ধ থাকা হৃদয়টা ঢিপঢিপ আওয়াজ করে যাচ্ছে।মল্লিকার কথায় যেনো স্পন্দনের গতিবেগ বাড়ালো।কথা কারো হৃদয়কে এভাবে প্রভাবিত করতে পারে?বড্ড বোকা এই হৃদয়।কখনো কথার জালে ফেঁসে কাঁদে আবার কখনো হাসে।হাত রেখে অনুভব করলো মল্লিকা সেখানটায়।
“জানো কি প্রিয়?এই দেহের সবচেয়ে অবুঝ অঙ্গ হচ্ছে হৃদয়”
ঘোর লেগে যাচ্ছে মল্লিকার বাচন ভঙ্গিতে।মাহরুর নীরবতা ভাঙ্গতে প্রস্তুত ছিল না।শুনতে চাইছিল কোকিল কণ্ঠে ওই সুমধুর বাক্যগুলো।তবে মস্তিষ্ক?সেকি অবুঝ?অহেতুক চিন্তা নিয়েই আসে। অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভাবায়।
“আবার প্রশ্ন করছি?… দ্বিতীয়বারের মতন ভালো বাবা হতে পারবোতো?”
“কেনো পারবে না?”
“স্বল্প অভাবী মানুষ আমি”
“যত্নে অভাব আছে?”
“সেটা তুই বল”
“নেই।এতেই চলবে”
ব্যাকুলতা এসে ঘিরে ধরলো মাহরুরকে। তৃষ্ণার্ত সে।রূপবানের স্পর্শে থাকবে বলে জানান দিয়েছে।কাছে টেনে শীতল স্পর্শে উন্মত্ত করে নেয়।মধুসুধা পান করেই রেহাই দিলো তার আসমানের চাঁদকে। শুভ্র আলোর সম্মুখে লাজের মেঘ এসে হাজির। তবে বাঁধা প্রদান করেনি মাহরুরকে। তারও আবডালে প্রয়োজন এই পুরুষের সান্নিধ্য।
___
“জীবনে তোমার মাইয়া মানুষের কমতি নাই। পুরান নায়িকা,নতুন নায়িকা,আবার সাইড নায়িকা।আমার শা*লার কপাল খারাপ। বউও ঠিকমতো তাকায় না।”
দোকানের চেয়ারে পা তুলে বসে হিসেব কষছে মাহরুর। শাটার অর্ধ নামানো।রেদোয়ান এর সাথে আলোচনা করছিল বিগত দিনের কথাগুলো।বলা হয়নি তাকে।তানিয়া থেকে শুরু করে হীরা অব্দি সকল ঘটনাই খুলে বললো।তার প্রতিক্রিয়াতেই এরূপ বাক্য ছুঁড়ে রেদোয়ান।
কথার ভঙ্গিতে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো মাহরুর।চক্ষু তার কাগজে,কলমে।উত্তর দিলো,
“আমার জীবনের নায়িকা একটাই।বাকিগুলো খলনায়িকা।”
“তাতো বটেই।বাকিরা মাঝেমধ্যে আসে হাওয়া বাতাস খেতে।”
“সময়-রুচি কোনোটাই নেই তাদের দিকে তাকানোর।”
“আমার দিকে আজ অব্দি কেউ চাইলো না।যারা চেয়েছে পুলিশের কাপড়ে দেখে কপাল কুচকে নিয়েছে।”
“আমার বোন থাকতে তুমি অন্য কারো দৃষ্টি আশা করছো কি করে?”
“না! মানে এমনেই।তোমার বোন থাকতে আমার সাধ্য নেই অন্য কারো দিকে তাকানোর।কিন্তু অন্যের দৃষ্টিতেতো কোনো বাধা নেই।তাকাবে।আমাকে অনুভব করাবে আমিও সুদর্শন ”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মাহরুর।রেদোয়ান মজার মানুষ। বোনজামাইর চেয়ে উর্ধ্বে তাদের সম্পর্ক।এইতো কতবার আপন ভাইয়ের মতন সাহায্য করেছে।এগিয়ে এসেছে সকল বিপদে।ভাবতেই শান্তি লাগে।দুজনের মধ্যে যোগ হলো আরো একজন।রহিম মিয়া এসে উকি দিলেন।দোকানে কেউ আছে কিনা দেখতে চাইলেন। মাহরুর আর রেদোয়ানকে দেখে ভেতরে এসে বসেন হাসি মুখে।
মাহরুর বললো, “আসসালামু আলাইকুম চাচা।কি খবর?”
“আল্লাহ রাখছে।তোমারে যে পাই না এক সপ্তাহ যাবৎ?কই থাকো?”
জানতে চাইলেন রহিম চাচা।
“এইতো চাচা অফিস থেকে বাড়ি,বাড়ি থেকে দোকান।মিষ্টির আবার পরীক্ষা চলে।ওকেও সময় দিতে হয়।”
“আইচ্ছা আইচ্ছা।তয় বউ ভালো আছেনি? খাওয়ন দাওয়ন ঠিকমতো করে?”
হতাশ গলায় মাহরুর জবাবে বললো, “আর খাওয়া দাওয়া!বলে বলে খাওয়াতে হয়।”
ভাবুক ভঙ্গিতে মাথা দোলান রহিম মিয়া।বলেন,
“পরশুদিন গ্রামে যাইতাছি বুঝছো।ক্ষেত খামারি করে আমার ছোট ভাই।পুকুরে মাছও আছে। ওহান থেকা টাটকা সবজি আর মাছ আইনা দিমু।বউরে দিও। নাতিনরেও দিও,তুমিও খাইও।”
সৌজন্যমূলক হেসে মাহরুর বলে, “অবশ্যই চাচা।ভালো হবে।আজকাল ঢাকার বাজারে ফরমালিন ছাড়া কিছু পাওয়া দুষ্কর।”
“তয় তোমার ব্যবসা কেমন চলে?”
“আলহাদুলিল্লাহ চলে চাচা আপনাদের দোয়ায়”
আকস্মিক রহিম মিয়া নিরব হলেন।সাদা দাঁড়িতে আবৃত মুখটা নুয়ে ফেলেন।হয়তো কিছু ভাবছেন।মুখে সেই ভাবটা স্পষ্ট দেখা গেলো।খানিক সময় বাদে মলিন গলায় বললেন,
“তোমার চাকরিও চলে।লগে ব্যবসাও।আমার এই চিলেকোঠার ঘরটা ছাইড়া যাইবা গা তাই না?”
মন খারাপের আভাস পাওয়া গেলো রহিম মিয়ার কণ্ঠে। মায়াভরা বৃদ্ধ মুখ তার। মাহরুরের হৃদয়টাও শিরশির করে উঠলো।খারাপ লাগায় ভরে গেলো।আসলেই এক না একদিন ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর বললো, “আপনাদের ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমারও নেই চাচা।আমাকে আমার কঠিন সময়ে মাথার ছাদের ব্যবস্থা করেছেন। ঋণী আমি আপনার কাছে।তবে মেয়েকে যে কথা দিয়েছি।ওকে একটা ঘর দিবো।বাড়ি দিবো নিজস্ব।”
“যাইও না। আমার পোলাটা বিদেশ থাকে।দেশে ফিরতে চায় না। মাইয়া বিয়া দিছি বছরে একবার আসে।আমার বুড়ি বউটা তোমার মাইয়ার লেইগা পাগল। মিষ্টিরে না দেখলে নাকি বুড়ির পেটের ভাত হজম হয়না।লাগলে ওই ছাদে তোমারে একটা সুন্দর ঘর বানায় দিমু খালি জায়গাগুলাতে।তাও এদিকেই থাকো। তমগো দেখলে শান্তি লাগে।”
চলবে….
চন্দ্র’মল্লিকা ৩৮
লেখা : Azyah_সূচনা
গতকাল রহিম চাচার কথাগুলো বেশ ভাবিয়েছে মাহরুরকে।নিজেই নিজে অপরাধবোধ ভুগেছে।এরূপ অনুভব হওয়ার কথা ছিল না।মনে হচ্ছে এক বিপদের সময় যে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল মাহরুর তাকেই ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো?আবার পরিবারের শখ পূরণের দায়িত্বও আছে।রহিম চাচা চাপা মানুষ। মাঝেমধ্যে দেখা হলে আবেগে দু চারটে লাইন বলেন।ওই দুই চারটে লাইনে অনেক লোকানো গল্প থাকে। আস্ত পাঁচ তলা বাড়িটা নিজ হাতে বানিয়েছেন। এখন এই বাড়িটার উপর তার কোনো অধিকার চলে না।বিদেশের মাটিতে ছেলের নিজস্ব বাড়ি আছে,গাড়ি আছে বিরাট ব্যবসা আছে।মেয়ের বিয়ে হয়েছে বিরাট পরিবারে।কমতি নেই।তারপরও বাবার ভিটা থেকে কোনো অংশ কেউই ছাড়তে রাজি না।দুই ভাই বোনের মধ্যে বিবাদ চলছে অনেকদিন।দোষী করে নিজের বাবা মাকে।তাদের যথা সময়ে চাহিদা পূরণ করলেও একটা বার এসে মুখ দেখানোর সময় নেই।গতরাতে কথাগুলো বলে কেমন যেনো কাঁদোকাঁদো মুখ হয়ে উঠেছিল তার।আভাস পেয়েছেন হয়তো। মাহরুরও একদিন পাড়ি জমাবে অন্যত্র।হয়তো তার মুখ দর্শনটাও হবে না আর।
“আমারও মায়া জন্মেছে এই চিলেকোঠায়।”
মল্লিকার কথায় মাহরুর মুখ ফিরে তাকায়।মায়া জন্মানোটাই কি স্বাভাবিক না?এখানেই তাদের নতুন জীবন এর সূচনা।এখানেই প্রণয়, পরিণয়।অল্প সময়ে বিশাল স্মৃতি ভান্ডার নিয়ে দাড়িয়ে আছে ঘরটা।
মাহরুর বললো, “এখনও বিদায়ের অনেক দেরি চন্দ্র।এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।”
মিষ্টিকে পড়তে বসিয়েছে মাহরুর।এই পরীক্ষা শেষে আরেক ক্লাস উপরে উঠবে।শিক্ষিকা নিজে কল করে বলেছেন বিশেষ দেখভাল করতে মিষ্টিকে।মল্লিকা পাশে এসে বসলো।এক গ্লাস দুধ মিষ্টির সামনে দিয়ে কঠোর গলায় বলেছে খেয়ে নিতে।
মাহরুর উঠে দাড়ালো।আরো এক গ্লাস দুধ এনে মল্লিকাকে দিয়ে বললো,
“আমার দুটো বাচ্চারই পুষ্টি দরকার।”
“দুধ পছন্দ না আমার।”
“তোর মধ্যে যার অস্তিত্ব তার পছন্দ। নাক চেপে খেয়ে নে।”
“উম!”
“চন্দ্র!”
মাহরুরের ঠান্ডা ধমকে একহাতে নাক চাপলো মল্লিকা। অন্যহাতে দুধের গ্লাস নিয়ে গটগট করে গিলে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে।
বলে, “আপনিও খান।দুইটা বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে দেখাশোনা করার জন্যও শক্তি দরকার।”
“আমি রাতের খাবারের পর খাবো চন্দ্রমল্লিকা।আয় চুলে তেল দিয়ে দেই।”
গ্রামীণ আভায় জড়ানো তিনজনার টোনাটুনির সংসার পরিবেশ মনোরম।তাদের বিনোদনের সঙ্গী তারা একে অপরে। প্রয়োজন নেই কোনো বিলাসিতার।যত্ন করে কেশমালায় তেল দিয়ে দেওয়াটাও একটা সুখময় সময় পাড় করাচ্ছে।বাবার দেখাদেখি মিষ্টিও কোকড়া চুল এর বেনী খুলে মায়ের কোলে এসে বসলো।আবদার করেছে।আজ নিজ থেকেই চুলে তেল দিবে।চুলের গভীরে বলিষ্ঠ আঙ্গুলের স্পর্শে মস্তিষ্কে ঝিম ধরে যাচ্ছিলো।ঘুমঘুম ভাবটা এসেই পড়েছিল প্রায়।মেয়ের মর্জিতে বিতাড়িত করলো তন্দ্রাকে।চাঙ্গা করে তুললো শরীর।আজ মেয়ের চুলগুলোতে যত্ন করে তেল দিয়ে দেবে। সচরাচর চুলে তেল দেওয়ার নাম শুনলেই দৌড়ে পালায় মিষ্টি।আজ পেয়েছে হাতের কাছে তাকে।
মুখে উৎসাহের হাসি ফুটিয়ে তেল দিতে লাগলো মল্লিকা।তার ক্লান্তি দুর করার জন্য পেছনেই বসে আছে আরেকজন।
মল্লিকার তার উদ্দেশ্যে বললো,
“আমাদের যত্ন নিতে গিয়ে নিজে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন না যেনো।সামনে পথ আরো কঠিন।প্রথমবার আপনার জন্য।আগেই জানান দিচ্ছি শক্তি যোগান।”
“ভয় দেখাচ্ছিস কেনো?” মাহরুর জবাবে বললো।
“ভয় দেখাচ্ছি না। সতর্ক করছি।আমি একবার এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি।আপনি নতুন।নিজের প্রতি হেয়ালি করবেন না।আমার কথাও শুনেন না তার উপর।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।শুনবো।এখন কি করতে হবে আমার বলেন? হুকুম করেন?”
“এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে লম্বা ঘুম দেবেন।সকালে নাস্তা করে তবেই যাবেন অফিসে।অফিস থেকে ফিরে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেবেন।তারপর দোকানে যাবেন।”
“মিষ্টিকে পড়াবে কে?তোকে কে দেখবে?”
“কাল আম্মা আব্বা আসছে।আর মিষ্টিকে আমি পড়াতে পারবো।”
তেল মাখা হাতে মল্লিকার গাল চেপে ঘুরিয়ে আনলো মাহরুর। আলতো হাতে।জোর বেশি প্রয়োগ করেনি।ভনিতা করে বলতে লাগলো,
“আমার আগের চন্দ্র কই রে?তুই এমন রাক্ষসী হচ্ছিস কেনো দিনদিন। কড়কড় করে কথা বলিস।”
“আপনার আগের চন্দ্রেকে মনের কামরায় তালাবদ্ধ করে রেখেছি।”
“লজ্জা পাস না কেনো?আমাকে ভয়ও পাস না।আমার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলাস না।”
মল্লিকা মুখ ফুলিয়ে বললো, “এই চন্দ্রকে ভালো লাগেনা বুঝি?”
মাহরুর থমকালো।চক্ষু পল্লব পিটপিট করলো।কপালে ভাবনা চেতনার রেখা।কি যেনো ভাবছে।হিসেব মেলাচ্ছে হয়তো। সর্বদার ন্যায় মল্লিকা অপেক্ষায় রইলো।ঠিক ভাবনা শেষে কিছু একটা বলবে।তাকে ভাবতে দেখলেও অদ্ভুত সুন্দর লাগে।
সময়ের অতিবাহিত করে মাহরুর বললো, “ভারী মুশকিল!আগের ভীত চন্দ্রও আমার পছন্দ।নতুন সাহসী চন্দ্রও আমার পছন্দ।”
“এখন কি করবেন জনাব?”
“এখন?তুই মাঝেমধ্যে ভীত।আবার কখনো কখনো সাহসী হয়ে যাস।দুটো চরিত্রেই ঘায়েল করিস আমায়।”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় মল্লিকা।দুইহাত তুলে নিজের গাল মুছলো।ঘটলো বিপত্তি।তেলে মাখা গাল মুছতে গিয়ে আরো তেল মাখিয়েছে।তার নিজের হাতও যে তৈলাক্ত।মল্লিকার এমন বোকামিতে মাহরুরও হোহো করে হেসে উঠে।তার শাড়ির আঁচল টেনে ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে দিলো দুইগাল।
আর বললো, “তেলে মাখা মুখটাও যে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে রূপবান”
মল্লিকা জবাবে বলে, “এই ভালোটা ছয় বছর আগে লাগলো না কেনো?”
“তখন আমি নিজের অনুভূতির মধ্যেই গড়মিল পাকিয়ে ফেলেছিলাম।”
“এখন?”
“এখন হিসাব বরাবর।প্রথম আর শেষ ভালোবাসা আমার রূপবান আমার চন্দ্রমল্লিকা।আর কোনো নারী মাহরুরের হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে না।” বুক ফুলিয়ে হেসে জবাব দেয় মাহরুর।
“মাহরুর হচ্ছে দিবার অম্বরে তেজস্বী রবি।”
“আর মল্লিকা রাত্রীর তামাশায় জ্বলজ্বল করা শুভ্র চন্দ্র।”
মিষ্টি বুঝেনি।বুঝার উদ্দেশ্যে মুখ ঘোরায়।তারা কি এমন ভারী শব্দ উচ্চারণ করছে?বোকা চোখে চেয়ে রইলো।মল্লিকা আর মাহরুরের চোখ পড়তেই তারা একে অপরের দিকে চেয়ে হাসে।
মাহরুর বলে, “আমার মিষ্টি আর অনাগত প্রাণ রবি-চন্দ্রের ছড়ানো নিষ্পাপ প্রভা।”
মিষ্টি এবারও অবোধ।জানতে চাইলো, “অনাগত?”
কপালে হাত রাখলো মাহরুর। ফটাফট বলে উঠলো, “ওহহো!বাচ্চাদের লিডারকেতো এই সংবাদ দেওয়াই হয়নি।এত বড় ভুল কি করে করলাম আমি?”
“কি করেছো মাহি বাবা?”
মাহরুরও মল্লিকার শাড়ির আঁচলের হাত মুছে নিল।মিষ্টির কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসলো।মিষ্টির হাত টেনে মল্লিকার পেটের উপর রেখে বললো,
“জানিস এখানে কি?”
“কিহ?”
“এখানে একজন আছে।একটা কুট্টি বাবু।একদম ছোট।তুই যদি ভালোমত খাওয়া দাওয়া করিস,ভালোমতন পড়ালেখা করিস।এই বাবুটা তাড়াতাড়ি বড় হয়ে তোর কাছে চলে আসবে।এসে কি বলবে জানিস?”
চক্ষু রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো মিষ্টির।গোলগোল চক্ষু প্রসারিত করে আছে।ছোট অধর জোড়া কিঞ্চিত ফাঁকা। মাহরুরের কথার প্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ফেলে বললো,
“কি বলবে?”
“বলবে আমার মিষ্টি আপু অনেক ভালো মেয়ে।তোকে আপু বলে ডাকবে।”
“আপু ডাকবে বাবা?”
“হুম”
“আমি ওকে কোলে নিতে পারবো?”
“হ্যাঁ পারবিতো।কোলে নিবি।আদর করবি।ওর আরেক মা হয়ে উঠবি। বোনতো তুই”
মিষ্টি দুহাত মায়ের পেটে রেখে মল্লিকার উদ্দেশ্যে বললো,
“ওকে এখনই আনো মা।আমি পড়ালেখা করবো।তুমি আমাকে পঁচা সবজিগুলো খেতে দিলেও খাবো।প্রতিদিন দুধ খাবো।ওকে এখনই আনো।ওকেও দিবো”
মল্লিকা জবাব দেয়, “ওর আসতেতো দেরি হবে মিষ্টি।তোর অপেক্ষা করতে হবে।”
“ও কি তোমার পেটে মা?”
“হ্যাঁ মিষ্টি”
“ওকে পেটে কেনো রাখলে?ওকে কোলে নাও।তোমার পেটে একা ভয় পাবে না?”
“তুইও এখানে ছিলি।ভয় পেয়েছিলি?”
নিষ্পাপ মুখ ফুটে বললো, “উম!…কি জানি?”
পেছন থেকে মিষ্টির গাল আলতো করে টেনে ধরলো মাহরুর।পেছনে বসে বললো,
“ও মিষ্টির ছোট্ট ভাই অথবা বোন।অনেক সাহসী।একদম ভয় পাবে না।”
“মিষ্টির ভাই,বোন কি করছে মাহি বাবা?”
“ও? ও এখন ঘুমোচ্ছে”
“আচ্ছা আচ্ছা! আস্তে কথা বলো নাহয় জেগে যাবে।হুশ”
ঠোঁটে তর্জনী আঙ্গুল চেপে চুপ থাকতে ইশারা করলো মিষ্টি।তার মুখ বলছে সম্পূর্ণ না বুঝলেও একটা বাবু আসবে তাদের কাছে সেটা বুঝেছে।তাই ভেবে খুশির আভা ফুটেছে তার মুখে।চুপ বনে রইলো যেনো অনাগত বাবু কথার আওয়াজে উঠে না যায়।
__
কর্মরত পুরুষের অবসর নেই।এক কাজের স্থানে দুই দুইটা কাজ হাতে তুলে নিয়েছে।সকালে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে দৌঁড়াতে হয়।সেখান থেকেই অফিসে।অফিস থেকে ফিরে আবার নিজের শখের ছোটোখাটো ব্যবসায় মনোযোগ দিতে হয়।আজকাল ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসে বসে শান্তি পাওয়া যায় না।মাথায় চিন্তা ঘুরতে থাকে।কি করছে একা চন্দ্র? দুলালকি মিষ্টিকে আনলো স্কুল থেকে?ঠিকঠাক মতন খাওয়া দাওয়া করছেতো?কোনো প্রয়োজন হলে কি করবে?শারীরিক আর মানসিক চাপ বোঝাই হচ্ছে দিনদিন।আর এই চাপের চিন্তা মল্লিকার বেশি।একটু পরপর কল করে বলবে টেনশন করতে না।টুকটুক করে মেসেজ করা শিখেছে।মেসেজ দিয়ে ছোট্ট করে জানান দেয় ‘ আমরা ঠিক আছি ‘।সেও জানে চিন্তা করতে করতেই মাহরুর অর্ধেক শুকিয়ে যাচ্ছে।এইতো মাত্র আবার মেসেজ এলো।
ফাইলের মধ্যে হারিয়েও মেসেজটা দেখতে ভুললো না মাহরুর।
লেখা ছিল, “আম্মা,আব্বা এসেছে।দ্রুত আর সাবধানে ফিরবেন”
লম্বাটে সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মাহরুর।যাক!অল্প চিন্তা উপসম হয়েছে।একা নয় মল্লিকা।তার শক্ত ঢাল এসে হাজির।বাবা মার মতন যত্নতো সে নিজেও নিতে পারবে না।
রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগম এসেছেন হাত ভর্তি বাজার নিয়ে। কি পছন্দ তার?সবটাই এনেছেন। মেয়ের দিকে নজর দিতে গিয়ে ভাতিজা এর নাতনিকেও ভুলেননি।তাদের পছন্দ মোতাবেকও কিছু না কিছু এনেছেন।এসে শ্বাস অব্দি নিলেন না ফরিদা বেগম মা হওয়ার খুশি মেয়ের সাথে উৎযাপন করে হাত লাগান ঘরের কাজে।
এলোমেলো সবটা গুছিয়ে নিলেন।ভাত বসিয়েছেন।তরকারি কাটাকুটি করছেন নিজের নিপুণ হাতে।কোনো বারণ শুনেননি।
জোবেদা খাতুন আসলেন হুট করে।ঘরের মাঝে মেহমান দেখে জানতে চাইলেন কারা তারা?মল্লিকা উঠে এসে পরিচয় করিয়ে দেয়।তিনি সালাম জানিয়ে মল্লিকার হাতে এক বক্স ভর্তি বাদাম ধরিয়ে বললেন,
“এডি খাইবা দুধের লগে মিলায়।বাদাম দুধে বহুত ভিটামিন।”
“চাচী?কেন এত কিছু করতে গেলেন?”
“ওমা কি করলাম?কোমড় বেদনায় আইতেই পারি না উপরে। আইজকা দুলালরে দিয়া বাদাম আনাইছি তোমার লেইগা।”
জোবেদা খাতুন এসে বসলেন ফরিদা বেগম এর সাথে।দুইজন বয়স্ক নারী একে ওপরের সাথে আলোচনায় মশগুল হতে শুরু করলেন।তাদের দেখে হাসলো মল্লিকা।তবে মাথায় অন্য চিন্তা ভর করলো।বাবা মা এসেছে মল্লিকার কাছে থাকার জন্য।থাকবে কোথায়? ঘর একটা।তারা তিনজনই থাকে সমন্বয় করে।শিরীনের বাড়ি বেশি দুর না হলেও আসা যাওয়া ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য। মাহরুরকে বলবে ভেবেও মত পরিবর্তন করলো মল্লিকা।এই লোকের মস্তিষ্ক চিন্তার ভান্ডার।আরো জুড়ে দিলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে।
জোবেদা বেগমের আওয়াজ শোনা গেলো।গল্প এগিয়েছে নিজেদের অতীত জীবনের দিকে।বলে উঠলেন,
“আমার শাশুড়ি আমার পোলা পেটে থাকতে খাইবার দিতো না আমারে।কি কষ্ট কইরা যে জন্ম দিছি এই পোলারে।আর এই পোলা এখন মায়ের খবর রাখে না।”
ফরিদা বেগম মলিন গলায় বললেন, “হয়তো আপনার ছেলে কোনো কাজে ব্যস্ত। বিলেতে কারবারতো আর মুখের কথা না।”
“কি এমন ব্যস্ত? বিয়া করছে বিদেশি সাদা মাইয়ারে।দিন বেদিন ঘুরতে যায়।ঐযে ইন্টারনেটে ছবি ছাড়ে।দুলাল দেহাইলো।মাসের পর মাস এক দেশ থিকা অন্যদেশ ঘুইরা বেড়ায়।নিজের দেশে আওয়ার সময় নাই।এই জীবনে নতিপুতিগো ছুইয়া দেখবার পারলাম না।”
ফরিদা বেগম জানতে চাইলেন, “আপনার মেয়ে নাই?”
“আছে!কুমিল্লা চৌধুরী বাড়ির বউ।ভাইয়ের লগে জমিজমার অভিমান কইরা আর আহে না আমগো বাসায়।কয় বাপ মা নাকি সবটা লেইখা দিছে ভাইয়ের নামে। আমাগো দুষায়।”
দুঃখ প্রকাশ করলেন ফরিদা বেগম।এই পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্কের মূল্য নেই।সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি পারিবারিক অবক্ষয়ও পরিলক্ষিত।কত বাবা মা ভোগে সন্তানের এক ঝলক দেখবে বলে।কত সন্তান আশাহত বসে মা বাবার ভালোবাসার পরশ পাবে বলে।কাকে দোষারোপ করবে এই ক্ষতির জন্য? পারিবারিক মনোমালিন্যের অন্ত কোথায়?অনেক যুগ আগ থেকেই চলে আসছে।কাগজের তৈরি টাকা, ধন সম্পদ এর কাছে অনুভূতিরা অত্যন্ত দুর্বল।আজকাল প্রশ্ন উঠেছে আবেগের প্রতি।বলা হয় ‘ আবেগে দুনিয়া চলে না ‘।চলে খসখসে টাকায়। প্রাচুর্যে!
মল্লিকা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো।মনে মনে ভাবলো,
“সারাজীবন টাকার পেছনে দৌড়ে মানুষ আবার এক সময় মানসিক শান্তি খোঁজে।হাহ!”
ফরিদা বেগম আকাশের দিকে চাইলেন।সন্ধ্যা হচ্ছে।মেয়েকে আড়ালে ডেকে নিচু গলায় বললেন,
“আমরা থাকবো কোথায় রে? শিরীনদের বাড়ি চলে যাই কি বলিস? কাল সকালে আসবো।”
মল্লিকা আবারো চিন্তায় পড়লো।চক্ষু পল্লব নামিয়ে ভাবলো।এটা আসলেই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।একটা ব্যবস্থা দরকার। আরচোখে চেয়ে কান পেতে শুনলেন দুই মা মেয়ের কথা জোবেদা বেগম।কোনো রকম চিন্তা না করে দুজনার মধ্যে বলে উঠলেন,
“শিরীনগো বাড়ি যাইবেন কেন?আমার ঘরে আহেন।চারটা ঘর আমার। একটায় আমরা বুড়াবুড়ি থাকি।আর দুইটা আমার পোলা মাইয়ার।আরেকটা নাতি-নাতকুরগো লেইগা বানাইছি।ওদিকে থাকবেন। আহেন ”
ফরিদা বেগম জোবেদা খাতুন এর কথার উত্তরে বললেন,
“আপা আমরা অনেকদিনের জন্য এসেছি।এভাবে কারো বাসায় থাকা কি ঠিক দেখায়?”
“কেনো ঠিক দেখাইবো না?সারাদিন দুই বেডা বেডি একলা থাকি ঘরে। এতএত গল্প করছি এতটা বছর আর কোনো গল্প খুইজা পাই না।আপনি আহেন।আমি একটা সঙ্গী পামু।আমার বুইড়া ব্যাটাও একটা সঙ্গী পাইবো।একলাই আমরা হয়তো বাকিডা জীবনও একলাই কাটান লাগবো।”
চক্ষু নত করে ফেললেন জোবেদা খাতুন শেষ বাক্যে।সোজা কথার মানুষ সে।ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে দেখেনি মল্লিকা তাকে। প্রথমে রাগী মনে হলেও পরবর্তীতে তাকে মনে হয়েছে খাঁটি মানুষ।কতটা অপেক্ষা তার চোখে?এই আশায় আছেন যদি একবার দুই সন্তানের দেখা পান?
মল্লিকা বললো,”চাচী উনি আসুক?ওনার সাথে কথা বলেই আপনাকে জানাই আম্মা আব্বা কোথায় থাকবে?”
“তোমার উনি না মানলে আমারে কইবা। মুরব্বী মানুষের কথা কেমনে ফালায় দেখমু”
জোবেদা খাতুন চলে গেলেন। ধীরে সুস্থে নিচে নেমে গেছেন।মল্লিকা হাসলো।কি সুন্দর হুমকি দিয়ে গেলেন।বয়স বাড়লেও মানুষ নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতন হয়ে উঠে।অবুঝ হয়ে যায়। বায়না ধরে।এই সময় তাদের প্রয়োজন ছিলো ভরা সংসারের।অনেক অনেক মানুষের আনাগোনার মধ্যে জীবন যাপন করার কথা ছিল।অথচ সেই ভাগ্য কই?এত বড় বাড়ির মালিক হাওয়া সত্বেও একাকিত্ব ভোগাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মাহরুর ফিরেছে হালকা নাস্তা সাথে নিয়ে।মল্লিকার মন মোতাবেক এসেই বিছানায় পিঠ ঠেকায়।থাকুক ঘরে মেহমান।তারা কি পর নাকি?আপন মানুষ।
চা নাস্তা এগিয়ে দিয়ে মল্লিকা বললো, “জোবেদা চাচী বলছিলো আম্মা আর আব্বাকে ওনাদের বাসায় থাকতে।কিন্তু আম্মা আব্বা সংকোচ করছেন।”
মাহরুর বিনা ভাবনা চিন্তায় বলে ফেললো, “জোবেদা চাচীর কথা শোন।আমি ইদানিং খেয়াল করছি তাদের স্বামী স্ত্রীর মন ভালো যাচ্ছে না।হয়তো পারিবারিক সমস্যা।চাচা চাচী থাকলে একটু গল্প গুজব করবে ভালো সময় কাটাবে।”
“সেটা আমিও লক্ষ্য করেছি।কথায় কথায় আম্মার সাথে বসে কত দুঃখ প্রকাশ করে গেলো।আমার জন্য এক বাক্স বাদাম এনেছে।”
মাহরুর চায়ের কাপে চুমুক রেখে বললো, “ভালো মানুষ তেনারা।”
মাহরুরের কথা রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগমও শুনলেন।কতবার আর শিরীনদের বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করা যায়?এক বাড়িতে থাকলে অন্তত যাতায়াত এর ঝামেলা থাকেনা। মাহরুর নিজের কষ্টটা আড়াল করে গেলো।কি পারলো জীবনে এটাই ভাবছে? শশুর শাশুড়ি পরের কথা। আপন চাচা চাচী এসেছে।তাদের অব্দি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলো না।অন্যের ঘরে গিয়ে থাকা লাগছে।লজ্জিত সে।চোখ বুজে গরম চা গটগট করে গিলে নিঃশ্বাস ফেলে।রাতের খাবার শেষে চাচা চাচীকে রহিম মিয়ার বাড়িতে দিয়ে এসে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।আবারো প্রতিনিয়তের মতন মস্তিষ্কে চাপ দিচ্ছে।দুনিয়া জাহানের চিন্তা চেতনা।বর্তমান সময় চলছে কিছুটা অভাবে।সামনে আরেকজন আসবে।তার ভবিষ্যৎ কী হবে?
ঘাড়ে হাত রেখে দাঁড়াতেই পেছন থেকে মেয়েলী মধুর বাক্য কর্ণপাত হলো,
“সব ঠিকঠাকভাবেই হবে মিষ্টির বাবা”
চলবে..