চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৩৫+৩৬

0
407

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৫
লেখা : Azyah_সূচনা

মধ্যিখানে আরো দুটো মাস কেটে গেছে।দিন চলছে সবসময়ের মতন এক নিয়মে। খুনসুটি,অভিমান,ভালোবাসায়।আজকাল নতুন দায়িত্ব মাথায় নিয়েছে মাহরুর। মিষ্টি এবং মিষ্টির মা দুজনকেই একসাথে নিজের ছাত্রী বানিয়েছে।পড়ায় দুজনকে।মিষ্টির অত্যাবশ্যকীয় পড়ালেখা।আর মল্লিকার জ্ঞান বাড়ানোর জন্য।নিজের পুরোনো বইগুলো পড়তে দেয়। আগ্রহ নিয়েই পড়ে সেও।দোকানের ব্যাপারে কোনো চিন্তাই করতে হয় না মাস শেষ হওয়ার আগে। ভরসাযোগ্য দুলালকে পেয়েছে। অফিসে তানিয়া থাকে ডিরেক্টরের নজরে নজরে।সেও কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারেনি।শিরীনের আগমন ঘটেছে কয়েকবার।রেদোয়ান এর সাথে আলাপতো হয় দুদিন পরপরই।টাকা ফেরত দিয়েছে অর্ধেকাংশ।আরো বাকি আছে।অনেকটা হিসেব নিকেশ করেই চলছে জীবন।

দেখতে দেখতে ঈদ উল আযহা চলে এসেছে। হাট বসেছে পুরো মহল্লা জুড়ে।নানান পশুর বিশাল সমাহার।বাচ্চাদের আনাগোনা বেশি বড় মানুষের চেয়ে।

অফিস শেষে বাড়ি ফিরে মাহরুর মিষ্টিকে বললো, “আম্মাজান?”

“জ্বি মাহি বাবা?”

“রেডি হন।আপনাকে হাট দেখিয়ে আনি”

মিষ্টি এক পায়ে রাজি। স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে গরু, ছাগল আর উট দেখেছে।মায়ের কাছে বায়না করেছে।কাছে যাবে।আদর করবে তাদের।তার মা হাত উঁচিয়ে না করে দেয়। উল্টো পথে নিয়ে আসে তাদের। পশুপাখি অনেক ভয় পায় মল্লিকা।সেই ইচ্ছেটা মাহরুর পূরণ করবে।

মাহরুর হাঁটু গেড়ে ঝুঁকে মিষ্টির পায়ে ছোট্ট জুতো পড়িয়ে দিলো।যাওয়ার পথে একবার মল্লিকাকে প্রশ্ন করলো, “যাবি নাকি?”

মল্লিকা উত্তর দেয়, “না বাবাহ!আপনারাই যান।আমার ভয় করে অনেক।”

মিষ্টি মল্লিকাকে ভেঙিয়ে বললো, “ভীতু মা! ভীতু মা!”

সন্ধ্যার সাজ আজ ভিন্ন।কম সমাগমের এলাকায় আজ চারিপাশে কোলাহল।বড় বড় ট্রাক বোঝাই করে আসছে কোরবানির পশু।রাস্তা ময়লায় আবৃত।আগেও ঈদ দেখেছে মিষ্টি।অন্য বাড়ির গরু ছাগল দেখতে যেতো।আদর করতো।তাদের খাওয়াতো।আজও ওই ঈদটা ফিরে এসেছে বলে বুঝলো মিষ্টি।

বললো, “মাহি বাবা?”

“হ্যাঁ?”

“আমাদের আগের বাড়িটা আছে না?যেখানে দাদী থাকতো?….ওই বাড়ির পাশে আমার একটা বন্ধু আছে।ওর নাম হলো পিচ্চি।ওদের বাড়ি যাবো।”

পিচ্চি?ভীষণ অদ্ভুত নাম।তবে মাহরুর এর বাগানবাড়ির কথা শুনে মোটেও পছন্দ হলো না।ওই রাস্তায় যাবে না।একদম না।ভয়ে নয়।চায় না অহেতুক সমালোচনার শিকার হোক। যত ঝামেলামুক্ত থাকা যায় তত ভালো।

মিষ্টিকে বললো, “ওখানে যাবো না মা।সামনে হাটে চল গরু দেখে আসি।”

“পিচ্চিদের বাড়িতেও ছোট্ট ছাগল আছে।ওরা কিনেছে।সাদা ছাগল।আমি ওকে আদর করবো।”

“তুই সাদা ছাগল দেখতে চাসতো?”

মিষ্টি মাথা উপর নিচ করে বললো, “হ্যা”

“পিচ্চিদের বাসায় মাত্র একটা ছাগল।আর হাটে অনেকগুলো ছাগল।”

“অনেকগুলো মাহি বাবা?”

মাহরুর হেসে বললো, “অনেকগুলো ছাগল।চল দেখে আসি?”

“ঠিক আছে চলো”

প্রথমে বড় আকারের পশু দিয়েই শুরু করে।লম্বা লম্বা উট দেখে চক্ষু ছানাবড়া মিষ্টির।মায়ের মতই রূপ তার।সাধারণের মধ্যেই অসাধারণ।তবে রং একেবারে মাহরুরের মতন।ফারহান ছিলো কৃষ্ণবর্ণের সুদর্শন একজন পুরুষ।তার দেহ গঠন এর কাছে চাপা রঙ ছিলো ফিকে।অথচ তার মেয়ের রং মিলে যায় মাহরুরের সাথে। অদ্ভুত লীলাখেলা সৃষ্টিকর্তার।গোল টসটসে গাল প্রায় অনেক সময় লাভ আভায় ছড়িয়ে থাকে এই বাচ্চা মেয়ের।চোখ দুটো বিশাল।অবাক হলে আরো প্রসারিত করে নেত্রদ্বয়কে।আবার ঠোঁট কামড়ে নেয়।

আদুরে কন্যা বলে উঠে তার বাবার উদ্দেশ্যে, “ও বাবা?ছাগল দেখবো না?”

বাবার আগে ‘মাহি’ শব্দটি যোগ করেনি।হয়তো এত এত পশু দেখে ঘোরে আছে।ধ্যান যায়নি।আলগোছে বলে ফেলেছে। মাহরুর খুশি হয় অনেক।হোক মাহি বাবা অথবা বাবা।দুটোই যে মিষ্টির মুখে শান্তির বাণী।

মেয়ের গালে শক্ত চুমু খেয়ে বললো, “দেখবোতো আম্মা।আগে গরু দেখি?”

“গরু দেখে ছাগল দেখবো?”

“হ্যাঁ”

মানুষের সমাগমে হাটবাজার।দরদাম কষাকষি চলছে। ঈদের বাকি চারদিন। চড়া দাম সবখানে। উচ্চবিত্তরা টাকার হিসেব না করেই কিনছে পশু।কেউ আবার স্বল্প টাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে।নিজেদের সাধ্যমত পেলেই বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটানো যাবে।বড়দের আর ঈদ আছে? ঈদ আসে বাচ্চাদের জন্য।তাদের মুখের হাসি দেখেই ঈদের আনন্দ ভোগ করে তাদের বাবা মা।

গরু দেখার প্রতি বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই মিষ্টির।বাবার কোলে ঘাড় আঁকিয়ে বাঁকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। নিশ্চয়ই ছাগল।একটু পরপর বিড়বিড় করে ‘ সাদা ছাগল ‘ বলে। অতঃপর মাহরুর ছাগলের দিকটায়ও গেলো।এবার মিষ্টির আনন্দ দেখে কে?ভয় ভীতি কাটিয়ে নেমে যায় তরতরিয়ে কোল থেকে।গিয়ে দাঁড়ালো এক ঝাঁক ছাগলের দিকে।

বেছে বেছে একটি ছাগল মনে ধরলো তার।ধবধবে সাদা তবে মাথার অংশে একটু কালো।মিষ্টি ছাগলের মালিককে, “আংকেল আংকেল”

মালিক উঠে দাড়ায়। কোমরে গামছা পেচিয়ে বললো, “বলো খুকি?”

“ওর মাথার কালো দাগ ধুয়ে পরিষ্কার করে দেন”

হাসিতে ফেটে পড়লেন মালিক।সাথে মাহরুর আর আশপাশের মানুষও।বোকা চোখে তাকায় মিষ্টি।

মালিক বলে উঠলো, “এটাতো পরিষ্কার করা যাইবো না।”

“তাহলে?আমাকে একটা সাদা ছাগল দেন।দাগ ছাড়া”

মালিক বাচ্চার বাচ্চামো দেখে এক ঝাঁক ছাগলের মধ্যে একটি সাদা ছোট ছাগল এনে মিষ্টির সামনে দাঁড় করায়।বলে,

“এই লও ”

মিষ্টি হাত দিয়ে আদর করতে লাগলো ছাগলকে। অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় পরপর।চুমু দিয়ে বসে ছাগলের মাথায়। মাহরুর এগিয়ে আসে।বলে,

“আম্মা চুমু দেয়না।”

“কেনো?এই বাবু ছাগলটা সুন্দর।”

“হ্যাঁ সুন্দর কিন্তু হাত দিয়ে আদর করতে হয়।”

হাঁটু ভাঁজ করে মিষ্টির কাছে এসে বসলো মাহরুর।ছাগলের দড়ি ধরে মিষ্টি বললো মালিককে, “আংকেল ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই?এইযে সামনেই আমাদের বাড়ি”

মালিক আরেকদফা হাসলেন।বললেন, “পয়সা আইনছো নি?”

“আমার বাসায় মাটির ব্যাংকে পয়সা আছে।আপনাকে দিবো?”

সরল মন মিষ্টির।এখনও বয়সের সীমা সেই কোঠায় যেখানে বাস্তবতার অমুখাপেক্ষী।ছোট মনে যতটুক বুঝেছে ততটুকুই বলেছে।সেতো জানে না তার মায়ের দেওয়া ছোট পয়সায় তার এই পছন্দের জিনিস কেনা যাবে না।

মাহরুর বললো, “পয়সা দিয়ে ছাগল কেনা যাবে না আম্মা”

“কেনো বাবা?এই ছাগলটা আমার পছন্দ হয়েছে।আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাবো।”

মাহরুর উঠে দাড়ালো। ছাগলটি ভালোমত দেখে শুনে দাম জিজ্ঞেস করে।বলে, “দাম কেমন চাচা?”

“দাম চাইলে ১৬ হাজার।”

এতটুকু ছাগল ষোলো হাজার টাকা। সত্যিই অনেক ঊর্ধ্বগতি। ষোলো হাজার টাকা এই হাটে শুনতে ছোট অংক মনে হলেও মাহরুরের কাছে বেশিই বটে।অফিস আর দোকান সব মিলিয়ে সংসার চলে।টুকটাক শখ আহ্লাদ পূরণ হয়।তবে মন খারাপ হয়ে গেলো।

মিষ্টি বললো, “নিবো মাহি বাবা।আমি এই বাবু ছাগলকে বাড়ি নিবো।”

নেতানো মুখে মাহরুর বললো, “এখন না আম্মা।পড়ে”

“আমি এখনই নিবো!”

গলার জোর বাড়িয়ে বললো মিষ্টি।ছাগলের দড়ি ধরে টানতে শুরু করলো।তার সমান ছাগলকে টেনে নিবে?অত শক্তি আছে। মালিকও সামনে দাড়িয়ে।এভাবেই নিয়ে যাওয়া যায় না যেখানে মিষ্টির অভিভাবক কিনতে নারাজ।

মাহরুর বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো, “আম্মা?বাবার কাছে এখন টাকা নেই।আমি তোকে কিনে দিবো পড়ে।কথা দিচ্ছি।”

“আমি টাকা দেই?আমার ব্যাংকে টাকা আছে।”

“ওই টাকা দিয়ে হবে না মিষ্টি।”

মালিক মিষ্টির হাত থেকে ছাগল ছাড়িয়ে বেধে রাখলো।শক্ত শরীরে দাড়িয়ে আছে মিষ্টি।কোনো নড়চড় নেই।চোখ টলমল করতে শুরু করলো পানিতে।ঠোঁট উল্টে আছে।বোঝা গেলো এখনই কেঁদে দিবে।

“কাঁদিস না মা।আমি বললাম আমি তোকে এর চেয়ে বড় সাদা ছাগল কিনে দিবো”

“আমার এই ছাগলটাই লাগবে। কিনে দাও না মাহি বাবা”

কেঁদে ফেলেছে মিষ্টি।গোল তুলতুলে গাল বেয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছে।বেধে রাখা ছাগলের দড়ি আবার ধরলো।সে ছাড়বে না। মাহরুর চেষ্টা করলো আরো কিছুক্ষন।বুঝদার স্বল্পবয়সী মেয়ে তার। বোঝালে বোঝে।তবে আজ কোনো বাহানা কাজে দিলো না।প্রথমবার মিষ্টি মেয়ের জেদ দেখা গেলো। মাহরুর তাকে কোলে তুলে নিলে জোর বাড়ে কান্নার।চিৎকার দিয়ে আমার সাদা ছাগল বলে চেঁচাতে লাগলো।কান্না মাখা গাল মুছতে মুছতে মাহরুর বেরিয়ে গেলো হাট থেকে।মিষ্টি এখনও কেঁদে চলেছে।

বাড়ি ফিরে এসেছে।সিড়ি ঘর থেকেই কান্নার আওয়াজ চিনে ফেলে মল্লিকা।দৌড়ে দরজা খুলে কয়েক সিড়ি নেমে আসে। মাহরুরের কোলে মিষ্টিকে কেঁদেকেটে নাজেহাল অবস্থা দেখে বিচলিত সুরে প্রশ্ন করলো,

“কি হয়েছে?কাদঁছে কেনো ও?”

মিষ্টি মাহরুরের কোল ছেড়ে মল্লিকার কাছে লাফিয়ে পরে।বলে,

“পঁচা মাহি বাবা।আমাকে সাদা ছাগল কিনে দেয়নি।আমাকে এখন চকোলেটও দেয়না এখন।আমি একদম কথা বলবো না তার সাথে। তাকাবোও না।মাহি বাবা ভালো না”

মাহরুর মলিন মুখে চেয়ে আছে। ওষ্ঠজোড়া কিঞ্চিত ফাঁকা। পুরুষালী সুদর্শন মুখটায় মনে হলো বিষাদ ছুঁয়েছে। মিষ্টির কান্নারত গালে হাত রেখে মাহরুরের পানে চেয়ে। হুট করে পলক ফেললো মাহরুর কয়েকদফা।

বললো অত্যন্ত ধীমে গলায়, “ওকে বুঝাস যেনো কান্না না করে।টাকা থাকলে ওর চাওয়া অপূর্ণ রাখতাম না। দোকানটা নিয়ে এখন আর হাতে তেমন টাকা থাকে না।”

“আপনি কি….”

মল্লিকা বলতে যাচ্ছিলো মাহরুর কি কষ্ট পেয়েছে?রাগ হয়েছে?কথাটা পূর্ণ হওয়ার আগেই মাহরুর চোখ নামিয়ে বললো,

“দোকানে যাচ্ছি।একটু পর ফিরে আসবো।কিছু লাগবে?”

মল্লিকা মাথা দুদিকে দুলিয়ে না বোধক উত্তর দেয়। মাহরুরও এক পলক মিষ্টির দিকে চেয়ে চলে গেলো। জ্বিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভেজায় মল্লিকা।মেয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।কি করবে?কি করে বোঝাবে?এই সংসারে ভালোবাসার অভাব না থাকলেও টাকা নামক কাগজী খরখরে বস্তুটা নেই।সেতো ছোট।কি বুঝবে অভাব? মাহরুরও জানে,বুঝে।তবে কিছু ব্যাপার হৃদয়ে গিয়ে লাগে?হোক বুঝদার ব্যক্তিত্ব অথবা নাদান হৃদয়।নিজের অজান্তেই বেদনার্ত ছায়ায় ঘিরে ধরে।

দোকানে হিসাব নিকাশ করলো মাহরুর।সাথে বেতনের টাকাসহ লাভ অংশ যোগ করলো। সংসারের হিসেবটাও করেছে।এই মাসে রেদোয়ান এর টাকা দেওয়া হয়ে যাবে। দুলালের হাতে তার বেতন ধরিয়ে দিলো।কিছু টাকা বোনাসও দিয়েছে।

দুলাল বললো, “ভাইজান টাকা বেশি দিছেন।”

শান্ত কণ্ঠে মাহরুর উত্তর দেয়, “ইচ্ছে করেই দিয়েছি। ঈদ চারদিন পর।তোর ঈদ বোনাস।”

“ভাই?”

“হুম?”

“আপনার মনটা মনে হয় ভালো না।”

অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর।ধরে ফেলেছে এই ছেলেটি। ফিকে হেসে বললো, “তেমন কিছুই না।অফিসে কাজের চাপ”

“আচ্ছা ভাই।আমি আরো ভাবলাম।আমার হাসিখুশি ভাইজানের হঠাৎ কি হইলো?”

আরো কিছু টাকা আলাদা করে পকেটে ভরে নিল।দোকান বন্ধ করে আবার হাটা দিয়েছে হাট এর দিকে। হাটতে হাটতে এসে দাঁড়ালো সেই জায়গায়।সেই ছাগলটা এখনও বিক্রি হয়নি।সেখানেই বাঁধা।নিজের চুলে হাত ফিরিয়ে মাহরুর আমতা আমতা করে ছাগলের মালিককে বললো,

“ছাগলটা কত হলে দিবেন?”

“ভাই আপনি সন্ধ্যায় আসছিলেন হেয় না?”

“জ্বি”

“আপনার মাইয়াটা কানতাছিলো।আমি মাইয়ার মন রাখুম।এক দাম কইতাছি চৌদ্দ হাজার টাকা।অন্য মানুষ হইলে পনেরো এর নিচে নামতাম না।”

আরো শঙ্কিত হয় মাহরুর।পকেটে হাত রাখে। টাকা স্বল্প।কিছু সময় দাড়িয়ে থাকলো।ভেবে চিন্তে বললো,

“সাত আট হাজারে দেবেন?”

“এটা কি কইলেন ভাই?জানেন ছাগল পালতে আমগো দুনিয়ার খরচ।আজকাল সাত আট হাজারে ছাগলের বাচ্চাও পাইবেন না।”

“আচ্ছা ভাই।” বলে ফিরে হাটতে থাকলো মাহরুর।

মালিক পেছনে চেচিয়ে বলেছে, “কিছু বাড়াইতে পারলে আইসেন ভাই”

পরাস্ত মাহরুর।একটা চেষ্টা করতে এসেছিল।অফিসে তাড়া দিচ্ছে। ল্যাপটপ দরকার।কিনতে হবে।সেই জন্যেই টাকা জমাচ্ছিলো।পুরোনো এক ল্যাপটপ বন্ধুর কাছ থেকে নেওয়ার কথা ছিলো।সেই টাকাটা মেয়ের খুশিতে ঢালার জন্য এসেও হারতে হয়।

বাড়িতে ফিরে।গেট ধরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে মল্লিকা।তাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হাসলো মাহরুর।এগিয়ে এসে গাল টেনে দেয়।ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো মিষ্টি ঘুমিয়ে পড়েছে।

পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে মল্লিকার কাছে জানতে চাইলো,

“খেয়েছে?”

“জোর করে দুই লোকমা খাইয়ে দিয়েছি।”

“কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।”

মল্লিকা মাহরুরের মুখোমুখি এসে বসলো।অতি সন্নিকটে। মাহরুরের প্রেমের গভীরত্বে ডুবে খোলস ছেড়েছে।লজ্জা পায় না এখন।অনেক স্বাভাবিকতা এসেছে তার মধ্যে। কাঁধের দিকে হাত রেখে উল্টে থাকা কলার সোজা করে দিলো।এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

“আপনিওতো পেয়েছেন কষ্ট”

“তাতে কি?আমিতো ওর মত অবুঝ বাচ্চা না।বাচ্চা কালে যেকোনো বিষয় মনে গভীরভাবে দাগ কাটে।”

কপাল কুঁচকায় মল্লিকা।হাত সরিয়ে চুলোর দিকে চলে গেলো। প্লেটে খাবার নিয়ে এক মিনিটের মধ্যে মাহরুরের সামনে এসে বসলো। ভাত মাখছে।এক লোকমা মাহরুরের মুখের সামনে ধরে বললো,

“বেশি বেশি সবসময়।আমাদের মেয়েটা অনেক লক্ষী। আগামীকালই ভুলে যাবে।”

“এক না একদিন মনে পড়বে।”

“চুপ থাকুন আপনি।খাবার খান।”

খাবার মুখে পুরে অস্পষ্ট গলায় মাহরুর বললো, “ধমকাচ্ছিস আমায়?”

“হ্যাঁ।আমি ভেবেছি এখন থেকে আমিও শিরীন বুবুর মতন হয়ে যাবো। আপনাকে হাতে রাখতে হবেনা?”

“বড্ড পেকেছিস!আমি তোর হাতেই আছি।বাহু ছড়িয়ে বুকে টেনেও নিতে পারিস”

“আপনার কাছে যত বাজে কথা।”

মাহরুর তেরছা দৃষ্টি ফেলে বললো,

“বাজে কথা?আমাকে বেহায়ার মতোন বারবার কাছে টেনে নিস আর আমি কিছু বলতে গেলেই আমি খারাপ হয়ে যাই না?”

মাহরুরের মুখ বন্ধ করতে ভাত পুড়ে দিলো দ্রুত। নাহয় এই লোক থামবে না। হাসতে লাগলো আর বললো,

“আমি বলবো আপনি শুনবেন।আমি আপনার প্রেমিকা এর খাতা থেকে বাতিল হয়ে বউ হয়েছি এখন। ওমনি আচরণ পাবেন এখন থেকে আমার কাছে।বউ এর মতন আঁচলে বেঁধেই ঘুরাবো।”

ভাত গিলে মাহরুর উত্তর দেয়, “তোর লজ্জা ভাঙ্গানো হয়েছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।ঠিক আছে মহারানী ঘুরান যত ঘুরানোর।আমি আজীবন ঘুরতে রাজি। দশ বারোটা বাচ্চা হওয়ার পরও মাহরুর একজন প্রেমিক পুরুষ হিসেবেই থাকবে।”

“দশ বারোটা!” চক্ষু কপালে মল্লিকার।

“কেনো?কম?অলরেডি মিষ্টি আছে।তারপর আমাদের পনেরো বিশটা বাচ্চা।মিষ্টি হলো তাদের লিডার।ওদের বিয়ে দেবো।নানা নানী,দাদা দাদী হবো।সবাইকে একসাথে বসিয়ে আমাদের প্রেম কাহিনী শুনাবো”

___

চোখ কচলে মিষ্টি উঠেছে।পাশ ফিরতেই মাকে পেলো না।অন্যদিকে ফিরেছে মাহি বাবাকে দেখার আশায়।অদ্ভুত!সেও নেই।ছোট্ট দেহ নিয়ে উঠে বসে।চোখ কচলে আবার খুঁজলো দুজনকে।একা ঘরে নিজেকে উপলদ্ধি করে লাফিয়ে নেমে যায়।পর্দা সরিয়ে ছাদে পা বাড়ানোর আগেই থেমে গেলো।তার মাহি বাবা দাড়িয়ে।পাশেই বেধে রাখা সাদা। ছাগলটাকে আদর করে খাওয়াচ্ছে তারই মা মল্লিকা।মিষ্টিকে দেখে বিশাল হাসি দিলো মাহরুর।

বললো, “দৌড়ে আয় বাবার কাছে”

খুশিতে গদগদ করতে করতে জোরে দৌড় লাগায় মিষ্টি। একলাফে মাহরুরের বুকে এসে লেপে গেলো।খুশিতে কোলে চড়েই লাফিয়ে যাচ্ছে।যত দ্রুত এসেছে তত দ্রুতই নেমে গেলো।ছাগলের গলা জড়িয়ে বললো,

“আমার বাবু ছাগল।”

ঘরের লক্ষ্মী বলে যাদের আখ্যায়িত করা হয় তারা হলো নারী।হাত খরচের টাকা জমিয়ে রাখে মল্লিকা।তার আর কিসের খরচ?ওই টাকাগুলোই মাহরুরের হাতে তুলে দিয়েছে।সকাল বেলা এক মুহূর্ত দেরি না করে মিষ্টির ইচ্ছে পূরণে বেরিয়ে গিয়েছিল।

মল্লিকা মিষ্টির উদ্দেশে বললো, “কাল বাবাকে কষ্ট দিয়েছিলি মিষ্টি।দেখ আজ তোর বাবা তোর সাদা ছাগল নিয়ে এসেছে।”

মিষ্টি মাহরুরের কাছে গিয়ে দাড়ায়। কান ধরলো।মায়ের সাথেও এমন করেছে অনেকবার। কান ধরে বললো,

“আর করবো না”

মাহরুর জমিনে বসে মিষ্টির গাল টেনে বললো, “তোর জন্য সবকিছু সব!”

কোরবানি ঈদের দিন এসেছে।মিষ্টিকে প্রথম দিন থেকেই বুঝানো হয়েছে।তার এই বাবু সাদা। ছাগলটাকে আল্লাহ্ পাকের রাস্তায় কোরবান করতে হবে। ও বেশিদিন এখানে থাকবে না।যেনো পরবর্তীতে কোনো কান্না না করে।

মিষ্টি প্রশ্ন করে, “আল্লাহ ওকে কোথায় রাখবে মাহি বাবা?”

মাহরুর উত্তরে বলেছিলো, “ওর জন্য বিশাল একটা ঘর আছে।অনেক সুন্দর।সেখানে রাখবে।ওর বাবা মার সাথে থাকবে ও”

কিছুসময় মন খারাপ করে বসে থাকলেও ওই শিশু মন মেনে যায় বাবা মার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।ঈদের দিন নিজ হাতে কোরবানি দিয়ে গোস্ত আলাদা করে মল্লিকার কাছে এনে দিলো তিন ভাগ করতে।গোস্ত সামনে এনে রাখে।কিছু সময় থমকে থাকার পর দ্রুত উঠে দাড়ায় মল্লিকা। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে বললো,

“গোস্তগুলো একটু দূরে রাখুন।আমার ভেতরে সব গুলিয়ে আসছে।…….আমাকে ভুল বুঝবেন না।আমি এই পবিত্র জিনিসকে অবজ্ঞা করছি না।আমার বমি পাচ্ছে” বলে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো মল্লিকা।

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৬
লেখা : Azyah_সূচনা

মল্লিকার আচরণে তফাৎ।ঘরের কাজে অনীহা ছিলো না কখনো।রান্নার কাজে কাচা গোস্ত অনেকবার ছুঁয়েছে।আজ এমন কেনো? ওয়াশরুমে গিয়েছে কয়েকবার। উশখুশ ভাবটা কাটে নি। কোরবানির পর মল্লিকার এমন কথার কোনো অর্থ খুঁজে পেলো না। দূরে মুখ ঢেকে দেয়ালের সাথে লেপ্টে থাকা মল্লিকাকে দেখে নিজেই হাত দেয় কাজে। দুলালতও নেই।থাকলে বিতরণের কাজে সাহায্য করতো।

একা হাতে সামলে নিলো মাহরুর। বিপরীতদিকে মিষ্টির মনটাও খারাপ। গালে হাত দিয়ে মাহরুরের ফোনে ছাগলের ছবিটা দেখে যাচ্ছে।মেনে নিলেও এখনও ভুলতে পারেনি। খানিক সময় বাদেবাদে ঠোঁট ভেঙে আসে মেয়েটির।স্পষ্ট জানিয়েছে সে এই গোস্ত খাবে না।

গোস্ত বিতরণ করে মাহরুর মল্লিকার কাছে এসে বললো, “রান্না বসাবি না?”

বিচিত্র মুখ ভঙ্গি করে মল্লিকা বললো, “আমার কেমন যেনো লাগছে মাহরুর ভাই”

মাহরুরের কপালে আকস্মিক চিন্তার দেখা ফুটলো।স্বল্প বিচলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে?তোর কি শরীর খারাপ?”

“জানি না। ঘাড় ব্যাথা হচ্ছে।ভেতরে সব গুলিয়ে আসছে বারবার।বমিও হয়েছে একটু আগে।আমার ভালো লাগছে না কিছুই।এই গোস্তের গন্ধ অসহ্য লাগছে।”

কপালে আঙ্গুল ঘষে মাহরুর।বুঝে উঠতে পারলো না এর কারণ কি?বললো, “চন্দ্র তোর শরীর বেশি খারাপ।ডাক্তারের কাছে যাবি?”

“না এখন কোনো দরকার নেই।ভাজাপোড়া খাওয়ার কারণে হয়তো এমন হচ্ছে।আমাকে টক কিছু এনে দিন।খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“লেবু খা”

“খেয়েছি তেতো লাগে।”

ঈদের একটা দিনে এমনাবস্থা কখনোই কাম্য নয়।মল্লিকার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো।পিঠের পেছনে বালিশ রেখে কপালে হাত চেপে বললো,

“একটু চোখ বন্ধ কর।আমি দেখি কি করা যায়।”

“আমি পোলাও রান্না করেছি।আপনি কি গোস্ত বসাতে পারবেন?বিশ্বাস করেন আমার এমন অদ্ভুত না লাগলে আমি কোনোদিন আপনাকে দিয়ে রান্না করাতাম না।”

চোখের কোণে এক বিন্দু জল জমে আছে। মাহরুর বৃদ্ধাঙ্গুল এর সাহায্যে মুছে নিলো।ঘরের কাজতো সেই একা সামলায়।একদিন নাহয় মাহরুর দায়িত্ব পালন করুক?

সন্তনাদায়ক বাক্যে আওড়ায়, “তুই বিশ্রাম কর।আমি সব সামলে নিবো”

ভাবুক ভঙ্গি মাহরুরের। অসুস্থতা অস্বাভাবিক কিছুই নয়।আসে আবার চলে যায়।তারপরও উদ্বেগপূর্ন।অসুস্থ প্রিয় মানুষকে দেখতে কার চোখে সয়?রান্না বসালো।একেবারে হালকা আচে গোস্ত বসিয়ে এক দৌড়ে গোসল করতে চলে গেলো।সময় নেবে না বেশি। ততক্ষণে রান্না হতে থাকুক।মিনিট দশেক এর মধ্যে ফিরে এসেছে মাহরুর।ভেজা চুলে তোয়ালে চালাতে চালাতে মল্লিকার পানে চোখ পড়ে।ঘুমিয়ে গেছে।সাথে মিষ্টিও।

ঢাকনা তুলে গরম গরম তরকারির ঘ্রাণে তুষ্ট হলো।কোনো উৎসবে খাবার স্বাদ বুঝি দ্বিগুণ হয়?পোলাও গরম করে মিষ্টি আর মল্লিকার কাছে গিয়ে ডাকতে শুরু করে।

বলে, “মিষ্টি?চন্দ্র?উঠে যা।খেয়ে তারপর ঘুমোস।”

সম্পূর্ণ ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো না। মাহরুরের এক ডাকে চোখ মেলে চেয়েছে। পেটে ক্ষিদে।সকাল থেকে না খাওয়া।মল্লিকা ভাবলো এবার একটু খেয়ে নেবে।মুখে সচ্ছ পানির ঝাঁপটা দিয়ে এসে বসে। মাহরুর বড় থালে খাবার নিয়ে হাজির।বোঝা গেলো এই একই থালে খাবে তারা তিনজনা। গামছায় মুখ মুছে মাহরুরের কাছে এসে বসলো।

বললো, “আজকে আপনার উপর অনেক চাপ পড়ে গেলো না?আমার শরীরটা যদি ভালো থাকতো তাহলে আর এই কষ্ট করা লাগতো না আপনার।”

মাহরুর উত্তরে বলে, “বাদ দে না চন্দ্র।একদিন নাহয় করলাম।আমার দায়িত্ব আছে না তোর যত্ন নেওয়ার?তোকে অসুস্থ অবস্থায় কাজ করাবো?”

“খাইয়ে দিবেন?” স্মিথ হাসে মল্লিকা।

“হ্যাঁ আয়।”

কয়েক দানা মুখে তুলেছে সবে।গলা দিয়ে নামলো না।বুক ধড়ফড় করছে মল্লিকার। অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার আগেই দৌড়ে গিয়ে মুখ থেকে খাবার ফেলে কুলি করে আসলো।

এসে হাপিয়ে বললো, “আমি খেতে পারবো না।আমার অসস্তি হচ্ছে।”

পূর্বের তুলনায় উদ্বেগ বৃদ্ধি পায় মাহরুরের।প্লেট থেকে হাত সরিয়ে মল্লিকার সামনে দাড়িয়ে বলে, “তোর প্রেশার নেমেছে বোধহয়। একটু খাবার মুখে তুলতে পারবি না?তারপর প্রেশার মেপে আসতাম?”

“পারবো না।ভালো লাগছে না।” কাঁদো গলায় উত্তর দেয় মল্লিকা।

ঠোঁট ভেজায় মাহরুর।পরপর চিন্তা চেতনায় ওষ্ঠ কামড়ে ধরলো।কি করবে?পরপর ভেবে নিলো আগে প্রেশার মাপুক।তারপর বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাওয়ানো যাবে। মল্লিকাকে বসতে দিয়ে মিষ্টির দিকে এগোলো।যত দ্রুত সম্ভব ওকে খাইয়ে দিয়েছে।মিষ্টি খেতে চাইলো না প্রথমে।ওর সাদা ছাগলের গোস্ত সে কিছুতেই খাবে না।অনেক মিথ্যে অজুহাতে পনেরো মিনিট সময় পার হয়।

মল্লিকা কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে।কাপড় বদলে নিয়ে মাহরুর বললো, “চল প্রেশার মাপতে যাবো।সাথে ডাক্তার দেখিয়ে আসবো”

নিভু নিভু চক্ষুজোড়া চায় মাহরুরের দিকে।দুর্বল অনুভব করছে।বললো,

“এই ঈদের ছুটিতে কোথায় পাবেন ডাক্তার?আমি একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবো।”

“ঘরে বসে না থেকে ডাক্তার দেখানো উচিত। ঔষধ নিতে হবে।তোর চোখ মুখ ডেবে গেছে।দ্রুত আয় তর্ক করবি না।করলেও আমি শুনবো না।”

মিষ্টিকে রহিম চাচাদের ঘরে রেখে রওনা হয় মল্লিকা এবং মাহরুর।পাশের দোকান থেকে একটা আচারের প্যাকেট কিনে নিয়েছে।বাহিরে আবর্জনার গন্ধে মল্লিকার অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল।কোনো রকম রাস্তা পেরিয়ে আসলো হাসপাতালে।কোনো ফার্মেসি খোলা নেই।ঈদের ছুটিতে বন্ধ।শুধু হসপিটালেই চব্বিশ ঘণ্টা সেবা পাওয়া যায়।মোটামুটি জন সমাগমহীন হাসপাতাল।অনেক স্টাফ এবং ডাক্তার ছুটিতে। ভাগ্যক্রমে একজন ডাক্তার পেলে দ্রুত সিরিয়াল দেয় মাহরুর।চার জনের পরই তার সিরিয়াল।মল্লিকার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে।

“সমস্যা বলেন”

পনেরো মিনিট অপেক্ষার পর ডাক্তার তাড়াহুড়োয় প্রশ্ন ছুড়লেন।দেখে বোঝা গেলো তাড়া আছে তার।যতই হোক ঈদের দিন।পরিবারের টান আছে নিশ্চয়ই।

“স্যার আমার স্ত্রী মল্লিকা।বমি হচ্ছে, ঘার ব্যথা।কোনো খাবারের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারছে না।খেতেও পারছে না।”

ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, “জ্বর আছে?”

এবারে মল্লিকা বলে উঠলো, “জ্বি না জ্বর নেই।তবে ভেতরে অনেক অস্থির লাগছে।বমি বমি ভাব।আর দুর্বলও লাগছে।”

“আসুন প্রেশার মাপবো।”

ডাক্তার প্রেশার মাপলেন,হার্ট রেট, পালস রেট,ওজন সবই চেক করলেন।সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন, “এই মান্থে পিরিয়ড হয়েছে?”

পুরুষ ডাক্তারের কাছে এমন প্রশ্নে মাথা নুয়ে ফেলে মল্লিকা। আড়ষ্ট হলো লজ্জায়।গ্রামের মেয়ে সে।সেখানে এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা চলতো না।লুকিয়ে বেড়াতো সবার কাছে।সেই স্বভাবটা রয়ে গেছে।পাশাপাশি মস্তিষ্কে আরো একটা চিন্তা চেপে বসলো।এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আগেও গিয়েছে।

“বলুন? পিরিয়ড হয়েছে?”

মাহরুর আশ্বাস দেয়।মল্লিকা নতজানু হয়েই বলল, “এই মাসে এখনও হয়নি।”

“প্রেগনেন্সি টেস্ট দিচ্ছি।করিয়ে জানাবেন আমায়।আমি রাতে আবার বসবো। আশা করি ততক্ষনে রিপোর্ট পেয়ে যাবেন।”

ডাক্তারের কথা শুনেই পিত্তি জ্বলে উঠেছিল।মিষ্টি জন্মের আগেও ঠিক এই কথাটাই জানতে চেয়েছিল ডাক্তার।যা সন্দেহ করলো তাই। মাহরুর এর কি প্রতিক্রিয়া সেটা দেখার সুযোগই মিললো না।মল্লিকা নিজের চিন্তায় মগ্ন।

বেরিয়ে এসে টেস্ট করিয়েছে।আপাদত মাহরুর চুপচাপ আছে।শুধু কাউন্টারে কথা বলেছে টেস্ট করানোর জন্য। একটু পরপর মাথা চুলকাচ্ছে দাড়িয়ে দাড়িয়ে।এদিক ওদিক চাইছে তোতা পাখির মতন।এখনও তার মস্তিষ্ক হয়তো ধারণ করতে অক্ষম।

মল্লিকাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মাহরুর মুখ খুললো।জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলো, “এমন হয়ে আছিস কেনো?”

মাহরুরের আওয়াজে চোখ তুলে। চট জলদি বলে ফেলে, “ডাক্তার শুধু সন্দেহ করছে।আমি জানি এমন কিছুই না। মিস্টির সময় আমার বমি হয়নি,খারাপ লাগেনি। সব খাবার খেতে পেরেছি আমি।”

মাহরুর আবার মাথায় হাত ফেরায়।মল্লিকা তার ব্যাপারে নতুন কিছু অনুধাবন করতে পারলো।কোনো বিষয়ে মাথা কাজ না করলেই এমন করে মাহরুর।

সময় নিয়ে বললো, “সব ক্ষেত্রে অবস্থা এক হয়না।বাড়ি চল।খাবার খাবি।”

“আমি খেতে পারবো না।”

“পারবি।ডাক্তার বমির ঔষধ দিয়েছে।”

দুপুর গড়িয়ে বিকেল।খাবার খেয়েছে মল্লিকা।তবে অল্প।শুয়ে আছে কাথা মুড়ি দিয়ে।পাশেই অর্ধ শোয়া মাহরুর।ডান হাতের একটা নখ বোধহয় অবশিষ্ট নেই। কামড়ে কামড়ে শেষ করে ফেলছে!মল্লিকা দু চারবার প্রশ্ন করলে একই উত্তর দেয় ‘ কিছুই হয়নি তার ‘।দেহে শক্তি নেই সাথে মুখেও।আর প্রশ্ন করলো না মল্লিকা।

____

রেদোয়ান আর শিরীন এসেছে।সাথে তার দুই ছেলে মেয়েও।মিষ্টি এত সময় অব্দি রহিম চাচার ঘরেই ছিলো। সুমাইয়া আর সায়মনের নাম শুনে এক দৌড়ে ফিরে আসে ঘরে।কোরবানির গোস্ত ফ্রিজে রেখে শিরীন মল্লিকার কপালে হাত রাখলো।

বললো, “কেমন লাগছে এখন?শুনলাম তোর শরীর ভালো না।”

সর্বাঙ্গে জোর খাটিয়ে উঠে বসলো মল্লিকা।বললো, “এখন একটু ভালো আছি বুবু।”

“ডাক্তার কি বললো?” শিরীন জানতে চায়।

মল্লিকা এদিক ওদিক চায়।নাহ!রেদোয়ান মাহরুর কেউ নেই এখানে। মেনিমুখো হয়ে উত্তর দিলো, “টেস্ট দিয়েছে বুবু।সন্দেহ করছে আমি আবার মা হতে চলেছি।কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো এটা ভুল।আমি একবার মা হয়েছি।গতবারের সাথে কোনো লক্ষণ মিলছে না।”

‘আমি আবার মা হতে চলেছি’ শিরীনের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিল।আগে পরে মল্লিকা কি বলেছে না বলেছে তাতে কিচ্ছুটি আসে যায় না। ডাক্তাররা চতুর হয়।মানুষের অর্ধেক অবস্থা মুখ দেখেই বলে ফেলে।মনে মনে নিজেকে আশ্বাস দিলো এবার ভাইয়ের ঘরে আসছে নতুন কেউ।মন বলছে তার।

মল্লিকাকে বললো, “শোন সবসময় এক লক্ষণ থাকে না।আমার দুই সন্তান।দুইজনের সময় দু রকম অনুভুতি হচ্ছিল।”

“কিন্তু বুবু?” ফ্যালফ্যাল নয়নে চাইলো মল্লিকা।

“তুই খুশি না?মাহি ভাই খুশি না?”

“এখনওতো পুরোপুরি যাচাই হয়নি।তাছারাও আমি ওনার মনোভাবটা বুঝতে পারছি না বুবু। অদ্ভুত আচরণ করছেন।মাথা চুলকয়। নখ কাটে।আবার অযথাই ছাদ থেকে ঘর, ঘর থেকে ছাদ হেঁটে বেড়াচ্ছে।”

মুখ চেপে হাসলো শিরীন।মল্লিকার কথার ধরন হাস্যকর। মাহরুরের আজগুবি চালচলনে হতচেতন সে।স্বামীর মন বুঝে উঠতে পারল না মেয়েটি।

বললো, “আমার কি মনে হয় জানিস?”

“কি বুবু?”

“ভাই আমার পাগল হয়ে গেছে” বলেই শব্দ করেই হাসলো শিরীন।

রিপোর্ট আনতে মাহরুরই গিয়েছে।একা।মল্লিকা আর শিরীন দূরের কথা রেদোয়ানকেও সাথে নেয়নি।বুক ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলে গিয়েছে সে একা যেতে পারবে।শিরীনের মতে যাক!যেতে পারলে।রিপোর্ট শিরীনের মন মোতাবেক হলে যেই শক্তপোক্ত দেহ নিয়ে যাচ্ছে সেটা নিয়ে ফিরতে পারবে কিনা কে জানে?তাই ভেবে হাসলো শিরীন।

একাকী শিরীনকে হাসতে দেখে রেদোয়ান বললো, “কতবার বলেছি একটা ওঝা ডাকি। তোমার লক্ষণ আমার ভালো ঠেকছে না।”

চোখ রাঙিয়ে শিরীন বললো, “কি করেছি আমি?”

“একা একা পেত্নীদের মতন হাসছো কেনো?”

“কারণ জীবনে প্রথম বারের মতন ফুপ্পি হবো মন বলছে।আর তুমি ফুপা।সাথে খালা আর খালুও।” হাই ভোল্টেজ এর হাসি দিয়ে বললো শিরীন।

“এটা কখন হলো?”

রেদোয়ান এর প্রশ্নের ধরন দেখে অবাক না হয়ে পারলো না শিরীন। অদ্ভুত লোকতো!কখন হলো মানে কি?মুখের বিচিত্র ভঙ্গি আর কুচকানো কপালের মধ্যভাগ নিয়ে তাকিয়ে রইলো রেদোয়ান এর দিকে।ভাবছে এই লোকের সাথে কি করে তার বিয়ে হয়ে গেলো?

মাহরুর ফিরেছে ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে।সবাই গোল হয়ে বসে তার মুখের দিকে চেয়ে।বড়দের দেখাদেখি বাচ্চারাও। মাহরুরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।চোখ এড়াচ্ছে সবার।

এক পর্যায়ে তাদের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলো, “কি সমস্যা তোদের?”

শিরীন বলে, “ডাক্তার কি বললো?”

পরপর রেদোয়ান প্রশ্ন ছুঁড়ে, “রিপোর্টে কি এসেছে।”

মাহরুর ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়, “ডাক্তার ওষুধের নাম বলেছে আর ওষুধ দিয়েছে।”

শিরীন আবার জেরা করে, “তোমার ঘরে নতুন কেউ আসছে কিনা সেটা বলো?”

কপালের ঘাম মুছে মাহরুর। আবার চুলে হাত ফেরাতে লাগলো।মল্লিকা বলে উঠলো, “দেখেছো বুবু?”

শিরীন তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুঁড়ে বলে, “দেখেছি। দেখছি!”

পূনরায় মাহরুরের দিকে একই প্রশ্ন করলো, “কেউ আসছে কি?”

থমথমে গলায় মাহরুর উত্তর দেয়, “হ্যা”

একেক জনের একেক প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো কয়েক মিলি সেকেন্ডে।কথাটি কর্ণপাত হওয়ার সাথে সাথে মল্লিকা রসগোল্লার ন্যায় চায়।শিরীন তালি বাজিয়ে দুহাত একত্রে মুঠ করে আছে।রেদোয়ান এর ঠোঁট জুড়ে বিশাল হাসি।বোকাসোকা বাচ্চারা শুধু কিছুই বুঝলো না।
তবে বুঝলো রেদোয়ান।এখন সময় তাদের দুজনকে একাকীত্বে ছেড়ে দেওয়ার।নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করবে না?এই নতুনত্ব।সম্পর্কের নবপ্রবর্তিত রূপ। প্রস্থান করলো বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে। মাহরুর মল্লিকার দিকে চায়।আবারো সেই আগেকার রূপ?চোখ নামিয়ে রাখলে কি ভালো লাগে?

মুখে কথা ফুটে অনেক সময় বাদে। মাহরুরই আগ বাড়িয়ে বলে,

“আগেও এমন সময় পাড় করেছেন তাই না?”

“হুম”

“তাহলে অধমের মতন বসে ছিলেন কেনো?যেনো প্রথমবার মা হচ্ছেন?যেনো কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।”

ফটাফট নেত্রযুগল তুলে ধরলো মাহরুরের পানে।এগিয়ে এসে মাহরুরের হস্ত নিজের দুহাতে নিয়ে বললো,

“আপনি খুশি না তাই না?”

তোয়াক্কাবিহীন মাহরুর মল্লিকার এই প্রশ্নে।নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন রেখে বললো,

“দ্বিতীয়বারে অনীহা হয় কি করে? ডাক্তার কি বলেছে জানিস? অতিরিক্ত দুর্বল তুই।”

আঁধার ঘনিয়ে আসা মুখটা চন্দ্রের।ঠোঁটজোড়া কাপছে।নিজের কম্পনকে সঙ্গে রেখেই বলতে লাগলো,

“আগের বারও বুঝিনি। তিনমাস পর জানতে পেরেছি।তাও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায়। মিষ্টির জন্মের সময় আমার স্বাস্থ্য ভালো ছিলো।বমি হতো না, বিচলিত অনুভব করতাম না। স্বাভাবিক ছিল তখন।”

মাহরুর এই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলো।এমন কিছুই আশাবাদী ছিলো সে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে। দৃষ্টি গাঢ় করে বলে,

“সেই সময় রমজান চাচা একটা সুন্দর চাঁদকে তুলে দিয়েছিল। যার মধ্যে না ছিলো কোনো কলঙ্গ না কোনো ত্রুটি।ছিলো একটা উদাসী মন।তাই হয়তো অনুভব করিস নি”

“এখন কেনো অনুভব করছি এই দুর্বলতা?”

“কারণ মিষ্টির অনাগত ভাই অথবা বোন আমাদের একে ওপরের প্রতি দূর্বলতার প্রতীক।”

মাহরুর মল্লিকার হাত টেনে নেয়।মুঠ করে থাকা হাত ছাড়িয়ে নিলো।প্রথমে ডানহাত পরবর্তীতে বাম হাত। রেখা মেলাচ্ছে।হাতের তালুর এলোপাথাড়ি রেখাগুলো খুবই মনোনিবেশ করে দেখে নিচ্ছে।

মল্লিকা জানতে চাইলো, “কি দেখছেন?”

ভাবুক ভঙ্গি আর কন্ঠস্বর টেনে মাহরুর বললো, “পড়ালেখার রেখা তোর হাতে নেইরে। রাশিতে শনির দশা।সামনের বছরের মাঝামাঝি একজন আসবে।এরপরের বছরের মাঝামাঝি আরেকজন আসবে।তারপর আরেকজন।এভাবে তোর পড়ালেখা করার প্ল্যান ভেস্তে গেল।বাদ দে তুই অশিক্ষিতই থাক।”

হতবিহ্বল মল্লিকা।এই সময়তো তার অনুভূতি প্রকাশ করার কথা।প্রথম বাবা হচ্ছে।কি তার মনের হাল? তা না।সে তার আজগুবি কথার ঝুড়ি খুলেছে।

“আমার চোখে চোখ রেখে বলেন।আপনি খুশি?”

অকপটে চোখে চোখ রাখে মাহরুর।বললো, “খুশি আমি?”

“ধাঁধায় ফেলছেন”

“তোকে আমি অনেক জ্বালাবো চন্দ্র।”

কথার ধাঁধায় পড়ে বিরক্ত হয় মল্লিকা।কপাল কুঁচকে বলে, ” উফ!”

“আমি যখন বাড়ি থেকে বেরোলাম তখনই ডাক্তার আর রিপোর্ট দুটোই পেয়েছি।জেনেছি তুই মাত্র আড়াই সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা।ওই ছোট্ট জানটা আমার আর তোর অংশ?একটু একটু করে বেড়ে উঠবে।মিষ্টির খেলার সাথী আসবে।আমি স্তব্ধ ছিলাম।শূন্য লাগছে নিজেকে।হলো কি?ভাবতে পারছি না কিছু।এখন মনে হচ্ছে আমার ভেতরে সব গুলিয়ে আসছে।আমার প্রেমে পড়ে একবার কি বলেছিলি মনে আছে?মনের মধ্যে প্রজাপতি উড়ে কিনা জানতে চেয়েছিলি?আমার মনে উড়ছে।মনে, পেটে,মস্তিষ্কে সবখানে প্রজাপতি উড়ছে।”

লজ্জা সরম ধুয়োয় উড়িয়ে দিল চন্দ্রমল্লিকা। চারিপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করলো না। চট করে মাহরুরের কপালের চুল সরিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় মধ্যিখানে। কাছে এসে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে পড়ল মাহরুরের বক্ষে। এরসময় খেয়ালহীন থাকলেও মিষ্টি এই বিষয় লক্ষ করেছে।হিংসে হলো তার।কেনো মা তার মাহি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে।অন্যপাশে এসে তাদের মধ্যিখানে ঢুকে বসে।

হিংসুটে গলায় বললো, “আমার মাহি বাবাকে ছাড়ো মা।”

ছাড়লো না মল্লিকা।ছাড়বে না। পূর্ন অধিকার আছে।মা মেয়ের মাঝে ফেঁসে আছে মাহরুর।মল্লিকাকে ধাক্কা দিচ্ছে মিষ্টি। আলগোছে মাহরুর তাদের মধ্যিখানে জায়গা করলো মিষ্টির জন্য।চোখের আড়ালে এক বলিষ্ঠ হাত শাড়ির অচল ভেদ করে মসৃণ পেটে হাত রেখেছে।
মিষ্টির মাথায় মাথা ঠেকায়।
প্রশান্তির চোখ বুজে বললো,

“এখানে আমরা চারজন।আজ থেকে আমরা চারজন”

চলবে…গল্পের

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে