চন্দ্র’মল্লিকা ৩৪
লেখা : Azyah_সূচনা
মাহরুর ঘোরে আচ্ছন্ন।জ্বলজ্বল করছে তার সম্মুখে মল্লিকা নয়নের মণি। ফুলে থাকা অধর আকৃষ্ট করছে।নিজের অজান্তেই এগিয়ে গেলো।কোমরে পেঁচিয়ে নিজের কাছাকাছি এনেছে অনেকটা। ত্বকে ধারালো নখের আঁচড় লাগতেই কেপে উঠলো মল্লিকা। মাহরুর ওষ্ঠের কাছাকাছি এসে চোখ বুজলেই দ্রুত গতিতে নড়চড় শুরু করলো। তৎক্ষনাৎ চোখে খুলে মাহরুর।
বলে, “কি সমস্যা তোর? স্থির থাকতে পারিস না?”
মল্লিকা দ্রুত মাথা ডানে বামে দোলায়।তড়িৎ গতিতে বললো,
“আর করবো না”
নিজেকে সংযত করে।বুক ভর্তি সাহস জুগিয়ে মাহরুরকে জরিয়ে ধরে।ভালোবাসা চেয়েছে সে।নিজ থেকে সামান্য কাছে এসে ভালোবাসার প্রকাশ করতে চাইছে।যেনো মাহরুর শান্ত হয়।রেগে না যায়।শার্ট জাপ্টে ধরে মুখ লুকায় বুকে।
সময়ের ব্যবধানে অধীরতা বেড়ে উঠছে তার ব্যাপকমাত্রায়। মল্লিকাকে শূন্য, বোধহীন করে তুলতে লাগলো। উন্মাদনা সমস্ত উজাড় করতে শুরু করেছে মল্লিকার কণ্ঠদেশে। অসহিষ্ণু মাহরুর। জ্ঞানশূন্য চন্দ্রমল্লিকা।এই স্পর্শে ভিন্ন রকমের ভালোবাসা আছে।যা বারবার মল্লিকাকে প্রশ্নবিত্ব করে।আসলেই এতটা ভালোবাসা পেয়েছে সে?কোনো স্বপ্ন নয়তো?যে মানুষটিকে ভুলেভালে চেয়েছিলো।সে আজ তার কাছে এতটা ব্যাকুল।মাহরুর আরো অধৈর্য হয়।এক নতুন প্রণয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়ে যায় দু মানব মানবী।নিজেদের মধ্যকার ভালোবাসার ঝড় শান্ত হয় শুদ্ধ স্পর্শে। এ ছোঁয়া পবিত্র,সচ্ছ।ভালোবাসায় ভরপুর। অনুভূতির এক বিশাল সাগর।অতলে ভেসে বেড়ানো দুজন।অদৃশ্য বাঁধা কাটিয়ে বিলীন হয়েছে মাহরুরের মধ্যে।প্রেম কয়ে বলে আসেনি।অনুভব করেছে,হারিয়েছে আবার পূনরায় পেয়েছে।এই পাওয়ার স্বাদ ভিন্ন।এক বিশাল সময়ের রোষাবেশ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম।
প্রভাতের প্রারম্ভিক অংশে,
“আপনি আমাদের যত্ন নেন কিন্তু নিজের যত্নটাই নেন না।চুলের কি অবস্থা দেখেছেন?”
ঘুমন্ত মাহরুরের চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে বিড়বিড় করছে মল্লিকা। প্রেয়সীর উষ্ণতা ছেড়ে ঘুমিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো।উপুড় হয়ে শুয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে বারেবারে।মল্লিকা জেগে। সম্পূর্ণ ঘর দ্রুত উঠেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছে। নিদ্রায় বিভোর মাহরুরের পাশে বসে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগে। চুলগুলো একদম রুক্ষ।কিছু কিছু চুলে পাক ধরেছে।মুখটাও তেমনি মলিন অযত্নে।
“আমি কত স্বার্থপর না মাহরুর ভাই?শুধু এক তরফা ভালোবাসা নিয়ে যাচ্ছি। আপনার দিকে নজর দেওয়ার সময় আজ হলো।অনেক খারাপ আপনার চন্দ্র।”
সামান্য উঠে মল্লিকার কোলে মাথা রাখলো মাহরুর।তার এরূপ জেগে থাকা একদম আশা করেনি মল্লিকা। কোমড় পেচিয়ে আবার ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে যেনো।
ঘুমমিশ্রিত গলায় মাহরুর বলে উঠে, “উহু”
“আপনি জেগে আছেন?”
মাহরুর মাথা দোলায়। হ্যা সূচক উত্তর দেয়। পুরোপুরি জেগে না থাকলেও মল্লিকার প্রত্যেকটা কথা এসে কানে বারি খেয়েছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রইল মল্লিকা। শক্ত মনস্থির করে।লজ্জা কাটিয়ে সর্বোচ্চ যত্ন দরকার এই লোকের।
এরই মাঝে মাহরুর আবার বিড়বিড় করে।বলে, “চুল টেনে দে।”
চুলের গভীরে পূনরায় হাত ডুবিয়ে মল্লিকা বলে উঠে, “একদম রুক্ষ হয়ে গেছে চুলগুলো।আগে কত সুন্দর ছিলো।যত্ন নেন না তাই না?”
আড়মোড়া দিয়ে মাহরুর নিষ্প্রতিভ ধ্বনিতে বললো, “তোর.. শোকে মূহ্যমান হয়ে গিয়েছিল চুলগুলোও ”
নম্র হাস্য ঠোঁট জুড়ে এসেছে।বলে ফেললো, “আমিতো এখন কাছেই আছি।তাহলে অযত্ন কেনো?”
মাহরুর মাথা তুলে মল্লিকার দিকে নিভু নিভু নেত্রে চায়। লালাভ বর্ণ ধারণকৃত চক্ষু মল্লিকাকে নির্জিত করে।ভয় পাবে না,লজ্জা পাবে না এই অভিপ্রায় মুহুর্তেই পালালো দৌড়ে।শেষ রজনীর কথা পুনরাহ্বান হতেই লাজে রাঙে আনন। ভিন্নপাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই মাহরুর বলে,
“এমন একটা বউ এনেছি যেকিনা সারাদিন ভয় পায়,লজ্জা পায়।সে আমার যত্ন করে না।সে একজন লোভী মহিলা।শুধু ভালোবাসা নেয়।দেয় না।তাই আমার এই অবস্থা।যাকে এনেছি আমাকে আদর যত্ন করে ভালো রাখার জন্য সেতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়।”
“এভাবে বলেন কেনো?আমি করবোতো যত্ন।”
“দেখবো”
“দেখিয়েন”
মল্লিকার ফুলবানুর মতন ফুলে থাকা গাল দুহাতে চেপে নিজের দিকে টেনে আনে।হালকা গোলাপি আভায় রাঙানো অধর ছুঁয়ে মাহরুর বলে,
“তোর গাঢ় নিঃশ্বাস এখনও আমার সমস্ত দেহে লেপ্টে আছে চন্দ্র।আমাকে স্বর্গীয় সস্তি দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।এমনেতেই বশ করে আছিস আমাকে।এখনতো আরো কাবু হয়ে গেলাম।তুই আমার একটা প্রিয় ফুল চন্দ্রমল্লিকা।”
মাহরুরের কথার বিনিময়ে ভাব প্রকাশের আর কি আছে?এক লাজুক হাসি ছাড়া?পলক নামিয়ে পাঁপড়ির আড়ালে লুকিয়ে ফেলা সাদার মধ্যেকার অংশে কালো মণিটা?বুকে দোলা দিতে আর কিছু প্রয়োজন আছে?হাসিতে প্রসারিত হওয়া ওষ্ঠধর বেকাবু করে প্রেমিক পুরুষ এর চক্ষুকে।
ডেকে বলে, “ও চন্দ্র?এভাবে হাসলে বুকে লাগে তো”
__
শিরীন আর রেদোয়ান এর মিটিমিটি হাসিতে চরম বিরক্ত মাহরুর।শান্তিমত সকালের নাস্তা করতে দিচ্ছে না।মাত্র এক টুকরো রুটি মুখে দিয়েছে তাদের এরকম তেরছা দৃষ্টিতে সেটাও গলা দিয়ে নামছে না।হাজার হোক আপন ছোটো বোন।ছোট! কাল যে কাজটা করেছে সেটায় মাহরুর মনে মনে অত্যন্ত খুশি হলেও শিরীনের এমন লজ্জা দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলো না।মল্লিকা শক্ত স্তম্ভের মতন বসে।পাখির মতন কুটুরকুটুর করে খাচ্ছে।সামনে ঝুঁকে থাকা চুলগুলোর বিরক্তিতে হাঁসফাঁস করছে।কানের পেছনে নিতে নিতে হয়রান।
মাহরুর এক পর্যায়ে বলে উঠে, “এই তোর চুল বাঁধ”
চোখ প্রসারিত করে তাকায় মল্লিকা।একজনের রাগ অন্যজনের উপর কেনো? মাহরুরের গলার ঝাঁঝ দেখে রেদোয়ান দমে গেলেও আজন্ম ঘাড়ত্যাড়া শিরীন তার কার্যে অটল।হাসি যেনো মুখ ছাড়ছে না।
সীমা অতিক্রম হলে মাহরুরের হাতে থাকা রুটির টুকরো প্লেটে রাখে জোরালো গতিতে।
শিরীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“চড় খাবি?”
শিরীনও বিদ্যুতের গতিতে উত্তর দেয়, “ওমা কেন?”
“মুখের অঙ্গিভঙ্গি এমন কেনো?চোখ নামিয়ে খা।হাসতে দেখলে দাঁতের পাটি তুলে ফেলবো।”
শিরীন মুখ ভেংচে উত্তর দেয়, “ঢং!আমরা যেনো কিছু বুঝি না।”
“আবার কথা বলিস!লজ্জা শরম কিছু আছে তোর?চুপচাপ খা।”
মুখ তালাবদ্ধ করে রাঙ্গামাটি শহরের তবলছড়ি থেকে সি এন জি করে ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে রওনা হয় তারা।মিষ্টি মাহরুর আর মল্লিকা এক সি এন জিতে আর শিরীন,রেদোয়ান এবং তার ছেলে মেয়ে অন্যটায়। সাই সাই বাতাসের ঝাপটা এসে পড়ছে ছোট্ট মিষ্টির মুখে।দ্রুত নিজের ছোট্ট দুহাতে মুখ চেপে ধরলো। সি এন জি এর দ্রুতগতিতে মাহরুরের কোলে বসে বলতে লাগলো,
“মাহি বাবা?”
“হ্যাঁ মা?” দ্রুত গলায় জানতে চাইলো।কি বলতে চায় মিষ্টি?
“আংকেলকে বলো আস্তে যেতে।আমি বাতাসে উড়ে যাবো একদম”
হালকা শব্দ করে হাসে মাহরুর।সাথে মল্লিকাও।ছোট মেয়েটি বাতাসের জোরে উড়ে যাওয়ার ভয়ে আছে। মাহরুর সি এন জি চালককে বললো গতি সামান্য কমাতে।অন্যদিকে মল্লিকা শাড়ির আঁচলে আগলে নেয়।নাক মুখের উপর হালকা কাপড় নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করলো মেয়েকে সাবধানে রাখার। মাহরুর একহাতে মিষ্টিকে অন্যদিকে মল্লিকার বাহু চেপে।মিষ্টির জন্য সামান্য বেঁকে বসলো। বাবা মায়ের দুপাশের প্রাচীরে নিরাপদ মিষ্টি।
মল্লিকা জানতে চেয়ে বললো, “এখন ভয় হচ্ছে তোর মিষ্টি?”
“না মা”
ঝুঁকে মিষ্টির গালে চুমু খেয়ে মল্লিকা আবার বলে, “আমরা কোথায় যাচ্ছি জানিস?”
“কোথায় মা?”
“ঝুলন্ত ব্রিজ।অনেক সুন্দর জায়গা।”
“ওখানে বাঘ আছে মা?”
মিষ্টির অদ্ভুত প্রশ্নে আরেকদফা হাসি উঠে মল্লিকা মাহরুরের ঠোঁটে।মল্লিকা বলে, “না এখানে বাঘ থাকে না।থাকলেও তোর মাহি বাবা বাঘকে মেরে তাড়িয়ে দিবে।”
মিষ্টি মাহরুরের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলো, “তাই মাহি বাবা?”
মিষ্টির উৎসুক প্রশ্নের সাথে তাল মিলিয়ে মাহরুর বলে উঠে, “হ্যা অবশ্যই।মাহি বাবা থাকতে বাঘ মিষ্টিকে একদম কিছু করতে পারবে না।”
এইটুকু মেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে।সস্তি পেলো বোধহয়।মনে মনে ধরে নিয়েছে এখন আর বাঘ তাকে কিছু করতে পারবে না।মাথা এলিয়ে দিলো মাহরুর মল্লিকার একত্রিত বাহুতে।মাথা দোলায় লাগলো আনমনে।ঘুরতে আসার আনন্দ মুখে ঝলকাচ্ছে।
সেই সুযোগে মাহরুর মল্লিকার কানের কাছে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “মিষ্টিকে চুমু দিলি মিষ্টির বাবাকে দিবি না?”
মাহরুরের কথায় মল্লিকা চোখ বড় করে চেয়ে বলে, “কিসব বলছেন আজেবাজে?”
“কি বলছি আবার?”
“চুপ থাকুন”
“গতরাতে স্বেচ্ছায় হাজার শত চুমু খেয়েছিস।তখন কি আমি বলেছিলাম চুপ থাকতে?”
কান গরম হয়ে আসলো মল্লিকার।এসব অসভ্য কথাবার্তা মাহরুর বলে আসছে বিগত রাত থেকে।মাথা খারাপ হয়েছে তার।মল্লিকা কান চেপে বললো,
“দোহাই লাগে চুপ থাকুন।সাথে মিষ্টি আছে।সামনে সি এন জি চালক।শুনে ফেললে মান সম্মান কিছুই থাকবে না।”
লুকিং গ্লাসে সি এন জি চালকের দৃষ্টি কোথায় সেটা পর্যবেক্ষণ করে নেয় মাহরুর।আরো কাছাকাছি এসে কানেকানে বললো, “তোর কি মনে হয় সি.এন.জি চালক তার বউকে চুমু খায় না?সবাই তোর মতন চন্দ্র? ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে ওনার তিন চারটে বাচ্চাকাচ্চা হবে”
দাঁতে দাঁত চেপে মল্লিকা এবার খানিক ধমকের সুরেই বলে উঠলো, “মাহরুর ভাই!”
মাহরুর ঝড়ের গতিতে মুখ সরায়।ভাই ডাকটা কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতন পড়ে প্রতিবার।বারবার।বাহিরে হাওয়া বাতাস দেখতে দেখতে বলতে লাগলো,
“তোরা নারীরা যেমন পুরুষকে বশ করতে জানিস তেমনি এক মুহূর্তে মেজাজ নষ্ট করতেও জানিস।”
ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে এসে বাজলো বিপত্তি।মা মেয়ে বেঁকে বসেছে।যাবে না এই ব্রিজে।দেখেই নাকি তাদের ভয়ে হাত পা কাঁপুনি দিচ্ছে। মাহরুর কখনও মিষ্টিকে,কখনো মল্লিকাকে বোঝানোর চেষ্টায়।প্রথমবার দুচোখ এমন কিছু দেখে যত আপ্লুত তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত।নড়চড় করতে থাকা ব্রিজ তাদের ভয়ের মুখ্য কারণ।অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই সময়টায় পানি অনেকটা উচুতে।প্রায় ব্রিজ ছুঁই ছুঁই।
এক পর্যায়ে এসে মাহরুর রেগে গিয়ে বললো, “এবার কিন্তু দুটোকে তুলে নিয়ে যাবো!”
“আমি যাবো না মাহরুর ভাই!” মল্লিকা কাতর গলায় বললো।
চোয়াল শক্ত করে মাহরুর বলে, “তোর ভাইয়ের….!”
বাকি কথা পূর্ন করার জন্য এখানকার জায়গা ছোট। আত্মসম্মানের ভয় আছে।শক্ত করে মল্লিকার হাত চেপে ধরে।রেদোয়ান কে আদেশ করলো,
“রেদোয়ান ছোটটাকে নিয়ে যাও।আমি বড়টাকে শায়েস্তা করে আনছি।”
রেদোয়ান চট জলদি মিষ্টিকে ঘাড়ে চড়িয়ে নেয়।বুঝ দিতে থাকে ফুপার কাধে থাকলে তাকে পানি ছুঁতে পারবে না।অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করার পরও রেদোয়ান এগিয়ে গেলো ব্রিজের দিকে।
মাহরুর মল্লিকাকে টানতে টানতে বললো, “তুইও ঘাড়ে চড়বি?”
“না না আসছি।”
“ভীতু মহিলা”
“মহিলা বলবেন না আমাকে।আপনি কিন্তু আমার চেয়ে বয়সে বড়।আমি মহিলা হলে আপনি…”
“কি আমি?আমি পুরুষ! পুরুষ শব্দে আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“আপনি বুড়ো”
“বুলি ফুটেছে না?আজও আমি মিষ্টিকে রেদোয়ানদের ঘরে রাখবো।তারপর দেখিস তুই”
অকস্মাৎ মল্লিকার রূপ বদল।বেশি সোহাগে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভীতু আশয় পাল্টে জেদীতা দেখানো শুরু করে দিলো?এর চেয়েতো দূরেই ভালো ছিলো?ভয় দেখালে ভয় পেত।এখন তর্কে নামছে।কিছু সময় পর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে।মেয়ে জাতি ভীষণই অদ্ভুত মাহরুরের মতে।একটু সুযোগ পেলেই ভেজা বেড়াল থেকে বাঘিনী হতে বিন্দুকায় সময় নেয়না। স্বাভাবিক হলেও জ্বালা,লজ্জায় দূরে থাকলেও বিপদ। মাহরুর ভেবে নেয় আজ এই মল্লিকাকে এই পানিতে ভাসিয়ে জীবনভর চিন্দ্রবিলাস এর পরিবর্তে দুঃখ বিলাস করবে। সামনেতো ভারী বিপদ ঘনাচ্ছে!
এক নারীর ব্যবস্থা করে অন্য নারীর অবস্থা দেখে মাহরুর কপাল থাপ্রায়।রেদোয়ান হাঁপিয়ে উঠেছে শিরীন আর তার বাচ্চা ছানাদের ছবি তুলে দিয়ে।সুযোগ হয়নি তার সেই ছবিটা নিজেকে আনার।স্বামী আর বাবা হওয়া সত্বেও।
ঘামে ভেজা রেদোয়ানকে দেখে মায়া হলো।মাথা দুলিয়ে মাহরুর বলে উঠলো, “সব পাগল!সব পাগল! বাপের জনমে প্রথম ঘুরতে এসেছে যেনো”
হাসি দিয়ে পোজ দিচ্ছিলো।শিরীনের মুখটা ত্যাড়া হয়ে গেলো।বললো,
“সকালে তোমাকে আর তোমার বউকে দেখে হেসেছি বলে ক্ষেপে আছো তুমি না?স্বল্প বয়সী প্রেমিক প্রেমিকার মতন একে অপরের সাথে চিপকে থাকলে দোষ নেই।আমরা একটু দুষ্টুমি করলেই যত দোষ”
“কিসের মধ্যে কি? পান্তা ভাতে ঘি!….তোর যত মনে চায় ছবি তোল।আমরা হোটেলে ফিরে যাচ্ছি।”
“হ্যাঁ যাও যাও।আমি চন্দ্র নই বুঝলে।তোমার কথায় উঠবো বসবো।”
“ঝগড়াটে কোথাকার!”
মল্লিকা আজ বোকার মতোন তাকিয়ে নেই।মুখে হাত চেপে হাসছে।ভাই বোনের ঝগড়া অনেক অনেক বছর পর দেখা মিললো। এমনও সময় গিয়েছে অতীতে মল্লিকাকে মধ্যিখানে বসিয়ে দুজন অহেতুক কারণে চুলোচুলি করেছে।ছোট থেকে ভালোবাসা থাকলেও ছোটোখাটো বিষয়ে তাদের তর্ক গড়ায় বহুদূর।দুজন মারামারি করে চাচীর হাতে উত্তম মধ্যমও খাওয়া থেকে রেহাই পায়নি।
রেদোয়ানও পিছু নিচ্ছিলো মাহরুরের।শিরীন বাজখাই গলায় ডাকলো।বললো, “তুমি আমার জামাই নাকি মাহি ভাইয়ের?এক সেকেন্ডে ফিরে এসো।আমার ঘুরা শেষ হয়নি।”
রেদোয়ান মুখ বেঁকিয়ে তুচ্ছ হাসে।রেদোয়ানকে বললো, “পুলিশ হয়েও কোনো লাভ হলো না।বউকে কন্ট্রোল করা আমার থেকে শিখো।”
শিরীন আবার চেঁচায় উচ্চ আওয়াজে।বলে, “আসবে না তুমি?”
মাহরুর হাঁটছে।এবার মিষ্টি তার কোলে।প্রথমে যত ভয় করছিলো তার চেয়ে বেশি উপভোগ করেছে।লাফিয়ে বেরিয়েছে ঝুলন্ত ব্রিজ এর এদিক ওদিক।মল্লিকার ভয় সামান্য কাটলেও মনে অল্পস্বল্প শঙ্কা রয়েই গিয়েছিল।সেটাও উধাও হয়ে গেল শিরীন আর মাহরুরের ঝগড়া দেখে।ভীষণ মজা পেয়েছে এই দৃশ্যে।পুরোনো দিনের এক কথা মনে এসেছে।হেসে কুটিকুটি হতে দেখেই মাহরুর থামে।
বলে, “খুব মজা লাগছে?”
অন্য সময় মল্লিকার এই হাসিকে নিয়ে কাব্য রচনা করতো।এখন মাথাটা চড়ে আছে।রুক্ষ মুখে দাড়িয়ে।মল্লিকা হাসি থামিয়ে বললো,
“মনে আছে চাচী যে আপনাকে আর বুবুকে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলো?”
বলেই অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো মল্লিকা।ঠিক সেদিনের মতন হাসছে যেদিন লিজা বেগম এই দুঃসাহসিকতার দেখিয়েছিলেন।অযথা দুই ভাইবোন এর ঝগড়া হঠাৎ মারামারির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।দুজনকে থামাতে না পেরে আর তাদের প্রতিনিয়ত এই ঝগড়া দেখে তপ্ত গরমে খোলা আকাশের নিচে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। ডাব গাছের দুইপ্রান্তে।সেদিনের পর থেকে একটু আধটু শিক্ষা হয় তাদের।তবে হাসির দায়ে মল্লিকা মাহরুরের আক্রমণের শিকার হয়। পিঠে কিল দিয়ে হাসির প্রতিশোধ নিয়েছিলো।
“খুব হাসি পাচ্ছে তাই না মিষ্টির মা?”
মল্লিকা আবার বললো, “আমাকে কিল দিয়েছিলেন আপনি”
“আজ তার চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু করি?”
“কি?”
“এই বিশাল জলরাশিতে ফেলে দেই?”
“আপনি খারাপ!”
“তোর মধ্যে শিরীনের আত্মা ভর করেছে আমি বুঝেছি।সমস্যা নেই মাহরুর নামের ওঝা সব জ্বীন ভূত আত্মা ছাড়িয়ে দেবে।চল”
___
“দুঃখ আমার, গেল সরে
স্বপ্ন সুখে, দিয়েছো ভরে
কতো আশার,ছোট্ট এই ঘরে
ভালোবাসার, শান্তি ঝরে
তুমি আশা ভালোবাসা..
রয়েছো হৃদয় জুড়ে…
জীবনের সঙ্গী তুমি…
কাছে রেখো মরণও পরে”
চন্দ্রে অভিমান জমেছে।কালো আধাঁরে ঢাকা সেই শুভ্র মুখ। অতশত ভালোবেসে আবার এত এত রুঢ় ব্যবহার করার কোনো মানে আছে। আজ কথা বলবে না।রাগ কি তার একারই আছে।চন্দ্রের রাগে মাহরুরের আকাশে আধার ঘনাবে।যা মাহরুরের গলায় গান শুনেও কমলো না।
মিষ্টি তালি দিচ্ছে মাহরুরের সুরালো আওয়াজ শুনে।বিছানায় অর্ধ শুয়ে জোরেজোরে গান গেয়ে শোনালো মল্লিকাকে।তাতে মল্লিকার কি?জানালার দ্বারে সিংহাসন গ্রহণ করেছে।
মাহরুর বললো মিষ্টিকে, “তোর মা হলো শাবানা।তার অনেক কষ্ট।আর আমি?আমি হলাম আলমগীর।”
“এরা কারা মাহি বাবা?”
“তুই চিনবি না আম্মা। শোন তোর মা’র মাথায় একটু সমস্যা আছে।দেখ চেয়ে কেমন মূর্তি হয়ে জানালার কাছে দাড়িয়ে আছে।আমরা যদি রাতে ভুত ভেবে ভয় পাই?”
মিষ্টি মল্লিকাকে ডাকলো।বললো, “ও মা আমরা ভয় পাবোতো”
মল্লিকা গলা উচিয়ে বললো, “পেতে থাক ভয়।”
মাহরুর আবারো রসিকতার ছলে বললো, “তোর মা আমাকে আর তোকে একটুও ভালোবাসে না।”
মিষ্টি এবার মায়ের পক্ষ হয়ে উত্তর দেয়, “ভালোবাসে,আদর করে।”
“উহু একদম আদর করে না।একদম না”
মিষ্টি অবুঝ। মাহরুরের কথার আড়ালে ধৃষ্টতা বোঝার মতন বয়স না তার। নিষ্পাপ বাচ্চা।বলে উঠলো আবার মায়ের উদ্দেশ্যে, “মা? ও মা?মাহি বাবাকে আদর দিয়ে যাও।”
নাক ফুলেফেঁপে উঠলো মল্লিকার।দ্রুত জেদী নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো, “চুপ করে ঘুমো মিষ্টি।আসলে বকে দিবো।”
মিষ্টির গায়ে পাতলা কম্বল উড়িয়ে দিলো মাহরুর। লাইট নিভিয়ে দিলো মল্লিকাকে কোনো পাত্তা না দিয়েই।আরো একটু রাগিয়ে দিয়ে তাকে শুনিয়ে মাহরুর বললো,
“আয় আমরা ঘুমাই।তোর জন্য নতুন মা এনে দিবো।এই মা ভালো না।”
কাটকাট দাড়িয়ে কথাগুলো হজম করছে।নিজেকে শক্ত করছে।এই রাগের দৈর্ঘ্য অন্তত দুইদিন।এর আগে মাহরুরের সাথে কথা বলবে না।তাকাবে না অব্দি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে কোমরের বারোটা বেজে যাচ্ছে।বসার সুযোগ আছে।তবে বসবে না। মাহরুর আচ পেলেই কথা শুনাতে পিছুপা হবে না একফোঁটা।রাগলে কায়েম রেখে ঠায় দাড়িয়ে রইলো।
ঘাড়ে লেপ্টে থাকা চুল সুঠাম হাতের স্পর্শে সরে গেছে।উন্মুক্ত হয় গ্রিবাদেশ। সুপরিচিত ছোঁয়া। তারপরও কম্পন ধরায়। মসৃণ গর্দনে নাক ডুবিয়ে আবদ্ধ করে ফেললো চওড়া কায়ায়। সরু অধরোষ্টের একের পর এক প্রগাঢ় স্পর্শনে উন্মত্ত করে। ভেলায় ভেসে চন্দ্রমল্লিকা হাত খামচে ধরে মাহরুরের।এক মুহুর্ত নিঃশ্বাস নিতে দেবে না এই পাগলাটে পুরুষ।তার ছোঁয়ায় সত্যিই একদিন মৃত্যু হবে।
মল্লিকাকে নিজের সম্মুখে ঘুরিয়ে ঘোর লাগানো কন্ঠ তুলে বললো,
“এসে গেছি অভিমান ভাঙাতে রূপবান”
চলবে…