চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-৩৩

0
399

চন্দ্র’মল্লিকা ৩৩
লেখা : Azyah_সূচনা

শনিবার সকালটা তানিয়ার ভাগ্যে শনির দশা টেনে আনবে হয়তো।এই ভেবে আজ অফিসে তানিয়ার দর্শন হয়নি। অফিসে কদম ফেলার সাথেসাথেই ডিরেক্টরের রুমে ডাকা হয়েছে মাহরুরকে। শরিফুলের সামনে বসে গতকালের বিষয় নিয়ে কথাবার্তার শুরু হয়। মাহরুরের কথা মোতাবেক যাচাইয়ের জন্য সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলেন তিনি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তানিয়াকে মাহরুরের ডেস্ক এর কাছে। জুম করলে আরো পরিষ্কার দেখা যায় তার হাতে কাগজ।আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য কল রেকর্ডও শুনলেন শরিফুল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুরের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনি কি কোনো একশন নিতে চাচ্ছেন?কারণ এটা আমাদের অফিসের রেপুটেশনের ব্যাপার।অফিস কর্মস্থল।এখানে এসব অশোভনীয়।”

“একশন নিলে স্যার ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে।সবার মধ্যে বিষয়টা জানাজানি হবে।তাছারাও মিস তানিয়া একজন মেয়ে মানুষ।উনি ভুল করেছেন এটা আমি মানছি। তবে আমি চাইনা ওনার সম্মানহানি হোক।আপনি প্লিজ মিস তানিয়ার সাথে আলাদাভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করবেন। এতেই হবে।”

মাহরুরের চিন্তাকে সাধুবাদ জানিয়ে ডিরেক্টর শরিফুল বললেন,

“আমি নিশ্চিত করবো অফিসে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ যেনো বজায় থাকে। থ্যাংকস মিষ্টার মাহরুর।”

“ওয়েলকাম স্যার।আসি”

তরতর করে তানিয়া অফিসে এসে প্রবেশ করলো।নিজের ভঙ্গিমায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। ডিরেক্টরের রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মুখোমুখি হয় মাহরুরের সাথে।আকষ্মিক সামনে পড়লে মাহরুর হচ্কচিয়ে উঠলেও তানিয়া প্রায় বিরক্ত হলো। মাহরুর অবাক। বিরক্তিকর প্রতিক্রিয়াতো তার থাকার কথা অথচ তানিয়ার ভঙ্গি বিরক্তি মাখা।মনে হলো গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।পাশ কাটিয়ে হেঁটে নিজের ডেস্ক এর দিকে চলে গেলো মাহরুর।

শরিফুল তানিয়াকে ঝড়ের গতিতে নিজের ক্যাবিনে ডাকেন। অফিসের স্টাফ এসে জানালে তানিয়া কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও চলে গেলো ক্যাবিনের দিকে।

ডিরেক্টর শরিফুলের সামনে বসে জানতে চাইলো,

“এনি প্রবলেম স্যার?”

“প্রবলেম?আপনি জানেন না?”

“জ্বি না স্যার”

“মিস তানিয়া!এটা ভদ্র মানুষের অফিস।এখানে কাজের পাশাপাশি ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে।আপনার নামে কমপ্লেইন্ট আছে। ওয়ার্নিইং দিচ্ছি এবার।আগামীবার এমন কিছু শুনলে ফায়ার করা হবে আপনাকে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”

তানিয়া নিজের পক্ষপাতিত্ব করে বললো, “মিষ্টার মাহরুর নিজে থেকে এসেছেন আমার কাছে।আমার সাথে দেখা অব্দি করেছেন গতকাল রেস্টুরেন্টে।”

শরিফুল বাকা হেসে বললো, “আমি সব প্রমাণ দেখেশুনেই আপনাকে সাবধান করছি।মেয়ে মানুষ বলে বেঁচে যাবেন ভুল করেও এটা ভেবে ভুল করবেন না।ইউ ক্যান লিভ ”

অতিরিক্ত রাগে ফেটে পড়ছে তানিয়া।তাকে হাসির পাত্র করে তুললো ডিরেক্টরের কাছে?বারবার মাহরুরের ডেস্ক এর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে তাকে।কোনো স্টেপ নিতে পারছে না।অযথা নিজেই ফেঁসে যাবে।নিজের রাগকে নিজের মধ্যে সংযত করেই কাজে মনোযোগী হলো।

বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরেছে মাহরুর।আজ রিকশা করে আশায় দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হলো।ফিরে এসে শিরিনকে বাড়িতে দেখে।অনেকদিন পর বোন এলো।ঈদের পর ছেলে মেয়ের পরিক্ষার কারণে আশা হয়নি।আজ সময় নিয়ে এসেছে।সাথে সংবাদ এনেছে।ঘুরতে যাবে।ঢাকার বাহিরে কোথাও দুইদিনের ভ্রমণ।আসা যাওয়া করতে একদিন মোট তিনদিনের জন্য।এখানে এসে মিষ্টিকেও তার দলে যোগ করলো।

বাবার কাছে এসে মিষ্টি নাদান মুখে বলতে লাগলো, “মাহি বাবা ঘুত্তে যাবো”

মাহরুর সরাসরি তীক্ষ্ম নজর দেয় শিরীনের দিকে।চোখে চোখ পড়তেই শিরীন অন্যদিকে ফিরে তাকালো।সে কিছুই জানে না এমন এক ভঙ্গি।

মিষ্টির উদ্দেশে মাহরুর বললো, “নিয়ে যাবো বাবা কিন্তু এখন না”

“না এখনই! মনিরা মাটিতে যাবে”

মিষ্টির মাটি কথাটি বোধগম্য হয়নি মাহরুরের।প্রশ্ন করলো,
“মাটি?”

শিরীন উত্তরে বললো, “আরেহ রাঙামাটি।এতবড় নাম ও উচ্চারণ করতে পারে নাকি?”

মাহরুর বললো, “তুই ওর মাথায় এই ভুতটা ঢুকিয়েছিস না?”

“একদমই না মাহি ভাই।অযথা দোষারোপ করবে না।” উল্টো ঝাঁঝ দেখিয়ে বললো শিরীন।

এখানে নির্বাক শ্রোতা মল্লিকা।মুখ দর্শনে বোঝা গেলো সেও ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে ভীষণ খুশি।হাসি মুখে মিষ্টিকে সমর্থন করছে। নিঃশব্দে! মাহরুর নাকোচ করতে চেয়ে পারলো না। ইতিমধ্যে কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করলো মিষ্টিকে।কিন্তু আজ সেও বেঁকে বসে।মল্লিকার দিকে চাইলে সেও হাত তাক করে।এই ব্যাপারে সে কিছুই করতে পারছে না।

মাহরুর নাক ফুলিয়ে মিষ্টিকে বললো, “তোকে চিনি পড়া খাইয়েছে তোর মনি।মাহি বাবার কথা শুনছিস না?”

“মা বলেছে এবার তোমার কথা না শুনতে।অনেক অনেক জেদ করতে।”

আসল কালপ্রিট ধরা পড়েছে।শিরীন এসবের মাস্টারমাইন্ড।আর মেয়েকে হাত করেছে মাহরুরের চন্দ্রমল্লিকা।বাচ্চাদের মন স্বচ্ছ।সত্য বলা তাদের স্বভাব।বলতে বলতে মাকে ফেলে দিয়েছে মহাবিপদে।না জানে এবার মাহরুর যমের বেশ ধারণ করে নাকি আবার!

শিরীন হাত তালি দিয়ে বাচ্চাদের উদ্দেশে বললো, “তাহলে কাল রাতে আমরা রাঙামাটি যাচ্ছি”

হইচই শুরু করলো মিষ্টি,সুমাইয়া আর সায়মন।তাদের সাথে শিরীনও বাচ্চা বনে গেছে। মাহরুরকে এড়িয়ে মল্লিকা ছাদ থেকে কাপড় আনার বাহানায় চলে গেলো।কিছুক্ষন তার দৃষ্টি সীমানায় পড়া বড্ড বিপদজনক।কি রকম চাহনি দিচ্ছিলো?যেনো চোখ দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলবে।

বছরে দশদিন ছুটি নেওয়ার সুযোগ আছে।প্রথম চারদিন মনে হয় এই রাঙামাটি ভ্রমণেই চলে যাবে।অনেক চিন্তাভাবনা করে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ডিরেক্টরকে কল করলো।মাত্র জয়েন করেছে।এভাবে ছুটি নেওয়া ঠিক হবে?

দুরুদুরু বুক নিয়ে কল করলো। ডিরেক্টর শরিফুল কল রিসিভ করতেই মাহরুর বলে উঠে,

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম মিষ্টার মাহরুর।এই সময় কল করলেন?মিস তানিয়া কিছু করেছে আবার?”

“জ্বি না স্যার।”

“তাহলে?”

সংশয়াপন্ন গলায় মাহরুর বললো, “আসলে স্যার..আমার ছুটি প্রয়োজন চারদিনের।আমি জানি স্যার আমি নতুন জয়েন করেছি।তারপরও পারিবারিক বিষয়..আপনি যদি”

“উম!আপনি কি ছুটিতে থেকে টাইম টু টাইম কিছু ফাইল আপডেট করতে পারবেন?”

“স্যার আমার কাছেতো ল্যাপটপ নেই।”

“না সেটার প্রয়োজন নেই। স্মার্টফোনেই আমাদের কোম্পানির মেইলে পাবেন। লগ ইন করে নিবেন।আর হ্যা যথার্থ কারণ দেখিয়ে আমাকে এখনই একটা ছুটির অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিন। ফ্রেশারদের আমি ছুটি দেই না। বাট আপনাকে আমি কয়েকমাস অবজার্ভ করেছি।নিঃসন্দেহে একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তা আপনি।তাছাড়াও একটা বাজে ইনসিডেন্ট ঘটেছে আপনার সাথে অফিসে।সব বিবেচনা করে একবারেই রাজি হলাম।তবে ফিরে এসে ওভারটাইম করে কাজ পুষিয়ে নিতে হবে।আর হ্যা ছুটি নেওয়াকে নিজের স্বভাবে পরিণত করবেন না”

“শিউর স্যার। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

“ওয়েলকাম। বাট মেক শিউর ফাইলগুলো সময়মতো সকাল এগারোটার মধ্যে আপডেট করবেন।”

“জ্বি স্যার।”

“ওকে টেক কেয়ার।”

এক ঢের কাপড় হাতে নিয়ে শ্বাস আটকে সিড়ি ঘরে দাড়িয়ে। মাহরুরের দৃষ্টি সীমার বাহিরে থাকার কথা চিন্তা করে এসেছিল।অথচ অগ্নিমানব নিজে এসে এখানে হাজির। নিঃশ্বাসকেও বেগতিক চলাচল থেকে বিরত রেখেছে মল্লিকা।কোনোভাবে আচ পেলে খপ করে ঘাড় মটকে ধরবে এসে।খিঁচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে।

“আমার দৃষ্টির আড়াল হতে চাচ্ছিলেন?”

ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো সমস্ত দেহ।একদম কাছে এসে মাহরুরের নিঃশ্বাস বারি খাচ্ছে।ধরা পড়ে গেলো তাহলে?এই ছোট চিলেকোঠায় আর পালাবে কোথায়?

কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।এই মুহূর্তে মল্লিকার মুখে হাঁসি আসছে।মাঝেমধ্যে কি কর্মকাণ্ডই না ঘটিয়ে ফেলে সে? মাহরুর কাপড়ের ধের একহাতে নিয়ে পূনরায় দড়িতে ঝুলায়।সামনাসামনি দাড়িয়ে দুহাত দেয়ালে ঠেকিয়ে বন্দিনী করলো মল্লিকাকে।

সামান্য মুখ বরাবর ঝুঁকে ভারী কণ্ঠে বললো, “ঘুরতে যাবেন মিষ্টির মা?ভ্রমণ শখ জেগেছে।”

ভয় কাটিয়ে মল্লিকা বললো, “একটু নিয়ে গেলে কি হয়?আমি কক্ষনো যাইনি রাঙামাটি।”

বলে মাহরুরের দিকে চাইলো।শিখতে হবে তার চোখে চোখ রেখে কথা বলা।তাই গোলগোল চোখে চেয়েছে কালচে খয়েরী রঙের দাড়িতে আবৃত মুখমন্ডলের দিকে। মাহরুরের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে।বশ হয়ে যায় খুব দ্রুত। মাহরুরের ক্ষুদ্র চক্ষু জ্বালাতন শুরু করলো মল্লিকাকে।নিজের দৃষ্টি নত না করলে জ্বলসে যাবে।

ঠোঁট ভিজিয়ে মল্লিকা বললো, “ছুটি পেয়েছেন?”

“হুম”

“আমি কাপড় গুছাই?”

“আগে আমাকে গোছান।”

“আপনি যথেষ্ট গোছানো।এখন কি আপনাকেও ভাজ করে ব্যাগে নিবো?”

পরপর উত্তর দিয়ে গেলো মল্লিকা। হাসলোও বটে।মাহরুর চোখ পেতে দেখছে চাঁদের আলোয় বরাবরের মতন তার উপচে পড়া সৌন্দর্য্য। গভীর নেত্র কিছু সময় নিয়েই গ্রহণ করলো এই মহিমা।সে এক বিনাশিনী নারী। মন মস্তিষ্কে সম্পূর্ণ নিজের রাজত্ব বিস্তার করা এক বিশেষ ফুল।সময় অতিবাহিত করে বললো,

“এই রাঙামাটি ভ্রমণ আপনি সারাজীবন মনে রাখবেন মিসেস মাহরুর ইবনাত।”

___

রাতের বাস অগ্রসরিত হচ্ছে রাঙামাটির দিকে।পাশাপাশি দুটো সিটে দুই যুগল।তাদের সামনের সিটে যথাযথ নিরাপত্তার সাথে যুগলদ্বয়ের ছানাপোনাদের বসানো হয়েছে।তাদের মতে তারা বড় হচ্ছে।তাদের আলাদা সিট প্রাপ্য।বাবা মায়েদের কড়া দৃষ্টিতে ঠিকঠাক আছে তারা।রাতের খাবার খেয়ে বেরিয়েছিল তারা। ঘুমোনোর সময় আসলে মিষ্টি চলে আসে মল্লিকার কাছে।যত প্রিয় হোক বাকিরা মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে না ঘুমোলে শান্তি আসেনা।মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে নিজেরওতো শান্তি দরকার। মাথাটা এলিয়ে দিলো মাহরুরের কাধে।মেয়েকে সামলাবে মা আর মাকে সামলাবে মেয়ের বাবা।এটাইতো নিয়ম!
শিরীনের ঘুম ভাঙ্গে মাঝপথে।সামনের সিটে সায়মন আর সুমাইয়াকে দেখে নিয়ে চোখ যায় পাশের তিনজনের দিকে।ঘুমন্ত রেদোয়ানকে জোরেশোরে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুললো।

ধড়ফড় করা বুক নিয়ে রেদোয়ান চোখ খুলতেই শিরীন বললো,

“দেখো দেখো সুমাইয়ার বাবা এদের একসাথে কি সুন্দর দেখাচ্ছে?”

রেদোয়ান পাশে তাকায়।হাসে।পরপর নিজের স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল,

“এটা দেখানোর জন্য আমাকে এভাবে ডেকে তুলেছ তুমি?”

“হ্যাঁ!তকি?এই সুন্দর দৃশ্য মিস করে যেতে তুমি।”

রেদোয়ানও নকল করলো।শিরীনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে বললো, “এবার আমাদেরও সুন্দর দেখাচ্ছে।ঘুমাও!বাস থামার আগে কোনো ডাকাডাকি নেই।”

“দুই বাচ্চার বাপ!ঢং করে। দূরে গিয়ে ঘুমাও”

নিভু নিভু গলায় বললো, “বেরসিক মহিলা তুমি শিরীন”

আদি প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে প্রথমবার পদচারণ।চোখ জুড়ানো রূপে মুগ্ধ হতে। সবুজারণ্যে ঢাকা ওই শৃঙ্গ আর বয়ে চলা হ্রদের মিলমিশ। নৈসর্গিক এক চিত্রে নিজেদের অনুধাবন করছে তারা।মিষ্টির জন্য এটাই প্রথমবার।জন্মের পর তার শিশুকাল বলতে ছিলো একটা ঘর আর খেলার মাঠ।বাহিরের জগতের সাথে অপরিচিত। ঘোরাফেরা করেনি মল্লিকাও গ্রামের বাহিরে কখনো পা রাখাই হয়নি।যখন রেখেছে তখন অভিমানে শহরের মায়ায় জড়াতে পারেনি। মাহরুরের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।জীবনে একবার গিয়েছিল কক্স বাজার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সফরে। রাঙামাটি এই তিনজনের চোখে নতুন।

নীল রঙের ফ্রকের সাথে কালো বেল্টের জুতো পড়েছে মিষ্টি। বাস থেকে নামার আধ ঘণ্টা আগে তার মা তাকে উচু করে ঝুঁটি বেধে দিয়েছিল।পাখির মতন মাথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। কোথায় এলো?কি করে এলো?তার চোখেও সব বিভ্রম।
হোটেলে আসতেই রেদোয়ান এর ঘাড় টেনে ধরলো শিরীন।

রেদোয়ান স্ত্রীর এরূপ কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে বললো, “আমি একজন পুলিশ তুমি ভুলে যাও কিন্তু”

“চুপ থাকো।আমার মনে হয় মাহি ভাই আর মল্লিকার জন্য আমাদের কিছু একটা করা উচিত।ওদের একা সময় দরকার।”

“কি করবো?”

রহস্যময় হাসলো শিরীন।মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এঁটেছে।স্বামীর সাথে মিলে এই চিন্তাকে বাস্তব রুপ দেবে।শিরীন রেদোয়ানকে আদেশ করে যেনো তাদের ঘর থেকে দূরে মল্লিকা আর মাহরুরের ঘর হয়।যেমন চিন্তা তেমন কাজ।কিছুসময় বিশ্রাম নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার সময় বাঁধ সাধে রেদোয়ান।

বলে, “আমার পায়ে প্রচুর ব্যথা হচ্ছে।মাহি তুমি ওদের নিয়ে আজ একটু আশপাশ ঘুরে আসবে?”

“আমিতো তেমন কিছুই চিনিনা এখানকার।” উত্তর দিলো মাহরুর।

শিরীন চেচিয়ে বলে, “আরেহ আমি চিনি চলো। আজতো আর ঝুলন্ত ব্রিজ এ যাবো না।এই আশপাশের এরিয়া ঘুরে দেখবো। চলো।এই লোক পড়ে থাক হোটেলে।”

মাহরুর শিরীনের কথার উত্তর না দিয়ে রেদোয়ানকে প্রশ্ন করলো,

“তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে?আজ নাহয় থাক। কাল ঘুরবো নাহয়”

“আরেহ না ভাই শুধু পায়ের ব্যথা।তোমরা যাও।আমার ভালো লাগলে চলে আসবো।”

“ঠিক তো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও”

শিরীন একপলক চাইলো রেদোয়ান এর দিকে।এত বছর সংসার করেছে।চোখের ভাষা বুঝবে না?এমন হয় কি করে? ইশারা মোতাবেক কাজে লেগে পড়লো।অত আলিশান হোটেলে আসেনি তারা।খুবই সাধারণ একটা হোটেল। ছিমছাম পরিবেশ। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে তাদের এক ফ্লোর উপরে একটা ঘর কোনো রকম ম্যানেজ করেছে।পা ব্যথার মিথ্যে বাহানা জেনো ধরা না পড়ে যায় সেই জন্য মুখে মাস্ক পড়ে বেরিয়ে গেলো।মার্কেট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হাটতে হাটতে এবার বোধহয় সত্যি পায়ের ব্যথা উঠবে।অবশেষে মার্কেট পেয়ে নিঃশ্বাস ফেলে রেদোয়ান।ফুল নিয়েছে অনেকগুলো।হোটেলে ফিরে মাহরুর মল্লিকার ঘর সাজিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।নাহয় তার বউ তাকে আস্ত রাখবে না।

সন্ধ্যার সময় ফিরে আসে মল্লিকা মাহরুর আর বাকিরা।একটু পরেই সবাই রাতের খাবারের জন্য বের হবে।মল্লিকা মাহরুর তাদের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে রেদোয়ান বললো,

“মাহি ওই রুম না।তোমাদের রুম উপর তলায় শিফট করা হয়েছে।”

মাহরুর বলে উঠলো, “কেনো?হটাৎ?”

“তোমরা বাহিরে গিয়েছিলে না?তখন হোটেলের ম্যানেজার এসে বললো এই রুমের ওয়াশরুম এর নল নষ্ট আবার ঘরে কিছু রিপেয়ারিংও দরকার।ক্ষমা চেয়েছে বিরক্তির জন্য।তোমাদের লাগেজ আমি উপরে রেখে এসেছি চিন্তা করবে না।”

মাহরুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “পাশাপাশি রুমই ভালো ছিলো।”

“কি করার আর?” হেসে বললো রেদোয়ান।

“আচ্ছা রুমের চাবি দিয়েছে?দাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।”

“না না” বলে চেচিয়ে উঠে রেদোয়ান।

“কেনো?”

“না মানে এখন উপরে গিয়ে করবে।আমাদের ঘরেই হাত মুখ ধুয়ে নাও।তারপর রাতের খাবার খেতে যাবো।”

“আচ্ছা চলো”

ফ্রেশ হয়ে খাবারের স্বাদ নিচ্ছে সকলে।পাহাড়ি অঞ্চলে স্বাদের কিছু ভিন্নতা।তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।বড়দের মধ্যে কোনো বাছবিচার না থাকলেও বাচ্চারা বিরক্ত করলো বেশ। খাওয়ায় অরুচি।এক পর্যায়ে রাগ দেখাতে বাধ্য হয় মল্লিকা আর শিরীন।হালকা ধমকে দিয়ে খাইয়ে দিলো।

খাবারের পর্ব লুকিয়ে অলস হয়ে উঠে শরীর।ঘরের দিকে এগোলে শিরীন মিষ্টিকে কেড়ে নিলো।বললো,

“আমাদের ঘরে দুটো বেড।মিষ্টি আমাদের সাথে থাকবে।”

মাহরুর সরাসরি উত্তর দেয়, “না।আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে”

সুমাইয়া বললো, “মামা! মামা! দাও না মিষ্টিকে আমি ওকে দেখে রাখবো।”

“তুইতো নিজেই ছোট বুড়ি।”

“না মামা আমি পারবো তুমি দিয়েই দেখো না।”

মাহরুর ঝুঁকে মিষ্টিকে প্রশ্ন করে, “থাকবি আপু আর ভাইয়ার সাথে?”

মিষ্টি সুমাইয়ার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলো, “গপ্পো শোনাবে?”

“হ্যাঁ আমি রাখালের গল্প জানি।”

“মাহি বাবা আমি আপার সাথে থাকবো।”

মাহরুর শিরীনের উদ্দেশে বললো, “দেখে রাখিস।কান্না করলে আমাকে কল করিস নিয়ে যাবো।”

মল্লিকার কাধে হাত রেখে তিনশত ছয় নম্বর রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে।জার্নি, ঘুরাফেরা সবটা মিলে শরীরের অবস্থা কাহিল। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ কপালে উঠে সামনের অবস্থা দেখে।লাল সাদা গোলাপের পাঁপড়ির ছড়াছড়ি।দেখে বোঝা গেলো সময় স্বল্পতায় কেউ শুধু পাঁপড়ি ছিটিয়ে রেখেছে বিছানা আর মেঝেতে।

মাহরুরের হাত খামচে দাড়িয়ে মল্লিকা বললো, “ভুল ঘরে এসে পড়েছি বোধহয়।চলেন”

“তুই কি বোকা?ভুল ঘরে আসলে দরজা খুলতো কি করে এই চাবি দিয়ে?আমার মনে হচ্ছে এগুলো রেদোয়ান আর শিরীনের কাজ।”

লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো মল্লিকা।হাত ছেড়েছে মাহরুরের।রেদোয়ান আর শিরীনের কাজ?বুঝতে বাকি নেই এই সাজসজ্জা তাদের দুজনের জন্যেই।গলা বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলো।

মাহরুর দুষ্টু গলায় বললো, “ভালোই হয়েছে।আমাদের তো বাসর হয়নি।”

মল্লিকার হাত ধরে ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয় মাহরুর। লাইটটা আকস্মিক বন্ধ করে দিলে ভরকে উঠে মল্লিকা।নাহয় এই মেয়ে কাপতে কাপতে অক্কা পাবে।কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে কপালে চুমু খেয়ে মাহরুর বললো,

“ভালোবাসি”

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে মল্লিকা। মিনমিনে কন্ঠে বলে, “আমিও আপনাকে ভীষন রকমের ভালোবাসি।আগে যতটুকু বাসতাম তার চেয়ে বেশি ভালোবাসি।আমরা এভাবেই থাকবোতো সারাজীবন?”

“কেনো থাকবো না চন্দ্র?”

“ভয় করে।”

“তোর ভয়কে আমি ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিবো। যত্নে রাখবো তোকে আর মিষ্টিকে।আমাদের সম্পর্কে ভঙ্গুর ধরবে এমন কোনো কাজ করবো না।আমাদের এবার সম্পর্কে এগোনো উচিত চন্দ্র।”

মাথা নুয়ে মল্লিকা ছোট্ট বলে, “হুম”

“হু হা করলে চলবে না চন্দ্র।আজ সময় সুযোগ দুটোই আছে।ভালোবাসার পরশ চাই আমি।”

নেত্রবিশেষ তুলে তাকালো মাহরুরের দিকে।আনমনে নিজের একান্ত পুরুষের প্রেমে ধরে গেছে চক্ষু।যতবার মুখপানে চাওয়া হয় তার বিশ্বাস হতে কষ্ট হয় নিজেরই।পেয়েছে তাকে নিজের করে?স্বপ্ন নয়তো।তার বাকা হাঁসি বিশ্বাস যোগায়।অতি নিকটে দাড়ানো পুরুষকে হারিয়ে ফিরে পেয়েছে। মাহরুরের ইচ্ছেকে সম্মতি দিয়ে পায়ের তালু উচু করে কপালে অধর ছুঁয়ে দিলো।

মাহরুর কপাল কুঁচকায়।বলে, “এই অল্পস্বল্প ভালোবাসায় আমার পোষাবে না।তোর মাহরুর লজ্জাহীন;অবাধ্য।তার আসক্তি দ্বিগুণ!”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে