চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-২৯+৩০

0
442

চন্দ্র’মল্লিকা ২৯
লেখা : Azyah_সূচনা

রেদোয়ান আর শিরীন সবাইকে চমকে দিয়ে তার বাচ্চাছানাদের নিয়ে হাজির।ঈদের দ্বিতীয়দিন রাতে আসার কথা ছিলো।চলে এসেছে ভোর ছয়টায়। গভীর নিদ্রায় মগ্ন তিন দেহ ধড়ফড়িয়ে উঠেছে দরজা পেটানোর শব্দে।

মাহরুর অস্পষ্ট চোখে শিরীনকে দেখে বললো, “ভয় পাইয়ে দিয়েছিস!বাস থেকে নেমে কল করবিতো?”

শিরীন উত্তর দিলো, “বাস দিয়ে আসলে না বাস থেকে নামবো।গাড়ি ভাড়া করে এসেছি।বাস টিকেট পাইনি।”

“আগে জানাবি না বলদ মেয়ে।দাড়িয়ে থাক এখন।”

পাশে দাঁড়ানো মল্লিকা দুজনের মধ্যে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল।অবশেষে বলে উঠলো,

“পাশের ঘরের চাবি দিন।আমি ঘর পরিষ্কার করে দেই।”

মাহরুর চাবি এনে দিলো।শিরীনের উদ্দেশে বললো, “তোরা এই ঘরে দশ মিনিট বিশ্রাম কর। আম্মার ঘরে গিয়ে পড়ে ঘুমাস।”

সুমাইয়া জেগেই আছে।সায়মন মুখ হা করে ঘুমোচ্ছে।মিষ্টির অর্ধ জাগনা। মাহরুর আর মল্লিকা দুজনে মিলে ঘর ঠিকঠাক করে দিলো। ঈদ উপলক্ষে নতুন চাদর আর গোছগাছ করাই ছিলো।শুধু একটু ঝেড়ে নিলো।

মাহরুর বিছানা ঠিক করতে করতে বলল, “হিংসুটে বড় ভাবির এর মতন করে তেজ দেখিয়ে বল?আপনার বোনের জন্য এই সাজসকালে ঘর পরিষ্কার করতে হচ্ছে।”

ঘুমটা এখনও চোখ ছাড়েনি। মাহরুরের উদ্ভট কথা শুনে সোজা হয়ে দাঁড়ায় মল্লিকা।বলে,

“আমি কেনো বলবো এই কথা।শিরীন বুবু কি আমার পর?”

হাত চালাতে চালাতে মাহরুর বলে, “না পর হবে কেনো?কিন্তু এখনতো সম্পর্ক বদলেছে।শিরীন তোর ননদ।হিরা শিরীনকে সহ্য করতে পারতো না। আসলেই মুখ ফুলিয়ে রাখতো।আমি আরো অনেককে দেখেছি শশুরবাড়ির মানুষকে পছন্দ করে না। তুইওতো বউ জাতি।তোরও একটু কুটনামি করা উচিত।”

নিজেই নিজের বোনের সাথে বউয়ের ঝামেলা বাধানোর চেষ্টায়।সুখী সুন্দর সম্পর্ক বোধহয় তার পছন্দ হচ্ছে না।আগ বাড়িয়ে আগুন লাগানোর চেষ্টা।

মল্লিকা বলে, “আমি কক্ষনো এমন করবো না।আপনার প্রাক্তন স্ত্রীতো আপনাকেই পছন্দ করতো না। বুবুকে কি করে পছন্দ করবে?”

মাহরুর হেসে উত্তর দেয়, “তা অবশ্য ঠিক।আচ্ছা কাজ শেষ আয়।”

মাটির চুলোয় রান্নার রান্না হবে।এটা মাহরুরের আবদার।তার মা থাকতে প্রতি রোজায় নতুন মাটির চুলো তৈরি করতো।ঈদের দিন সেখানেই ধোঁয়া উঠিয়ে রান্না চলতো।ঘ্রাণে মো মো করতো পুরো গ্রাম। মল্লিকাকে এক কথা দ্বিতীয়বার বলতে হয়না।এখন থেকে নয় ছোটোবেলা থেকেই আদেশ মান্য করে নিত মাথা নত করে।প্রশ্ন করতো না বিপরীতে।

বিশ্রাম শেষে শিরীনও কাজে হাত লাগায়। লাকড়ি নাড়তে নাড়তে বললো,

“কিরে চন্দ্র?ভাই যা বলে এককথায় মেনে নিস।উল্টো কোনো কথা বলিস না কেনো?”

শিরীনের কথায়ও ভিন্নতা লক্ষ্য করে মল্লিকা।সকাল বেলা হিংসুটে ভাবি হওয়ার কথা বলছিলো মাহরুর।এখন শিরীন বলছে কেনো তার ভাইয়ের কথা শুনে সব?পাগল হয়ে গেলো নাতো দুজন?কেনো সুখী সংসারে আগুন দিতে উঠে পরে লেগেছে?

মল্লিকা বলে উঠে, “তোমাদের কি হয়েছে বুবু বলোতো?সকালে একজন বলছে হিংসুটে ভাবি হতে?এখন আরেকজন বলছে ভাইয়ের সব কথা কেনো শুনি?তোমরা দুজন আপন ভাই বোন হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলে কেনো?আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

শিরীন আকস্মিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।হতবাক মল্লিকা। ড্যাবড্যাব চোখ শিরীনের কারণ অজানা হাসির দিকে চেয়ে আছে।

শিরীন বললো, “চন্দ্র শোন?ভাইয়া সত্যি বলে চন্দ্র অনেক বোকা।”

কপাল কুঁচকে মল্লিকা প্রশ্ন করে, “কেনো?”

“ভাইয়া তোর সাথে মজা করেছে।আর আমি?কথার কথা বললাম।স্বামীকে হাতে রাখতে হবে না? সব কথায় হ্যা হ্যা করবি না।”

“না না করলে বুঝি স্বামী হাতে থাকবে?উল্টো বিগড়ে যাবে।”

“এই যুগে এসে এত সরল সোজা হতে নেই।মাঝেমধ্যে ‘ না ‘ শব্দটা ব্যবহার করতে হয়।আমি জানি তুই সারাক্ষণ হারানোর ভয়ে থাকিস।ওই বদ্ধ বাড়িতে থাকতে থাকতে এমন হয়ে গেছিস।নিজেকে হাল্কা কর চন্দ্র।মনে রাগ,কষ্ট,অভিমান থাকলে প্রকাশ করবি।জমিয়ে রাখবি না।”

মল্লিকা সতেজ হেসে বললো, “বুবু।আমি জানি।কিন্তু জানো আমি কখনো ওনার কথা অমান্য করতেই পারবো না।তুমি বললে না মনের ভাব প্রকাশ করতে?আমার মন সায় দেয়না তার উপর রাগ দেখাতে,তার অবমাননা করতে।আমি হয়তো এই সমাজের কাছে অনেক পিছিয়ে গেছি।কিন্তু তোমার ভাই আমাকে শেখাচ্ছে।সে যতটা সাহসী আমাকেও ততটাই সাহসী করছে ধীরেধীরে।অনেক যত্ন করে হৃদয়ের আঙিনায় বীজ বপন করেছিলাম জানো? গাছটা অল্পতেই মারা যায়।দীর্ঘ ছয় বছর পর আবারও সেই গাছ সতেজ হয়ে উঠছে।যত্নে একদিন পরিপূর্ণ গাছ হয়ে যাবে বুবু।আমি হতে পারি ভীতু।কিন্তু তোমার ভাইয়ের সামনে সেটা আমার ভয় না।আমি স্বেচ্ছায় করি যা করি।”

মায়ের মতন করে মাথায় হাত বুলায় শিরীন।বুক ভরে আসছে মল্লিকার কথাগুলোয়।তাদের দুজনার গল্প ভিন্ন।তাদের জীবনটা ভিন্ন হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।শিরীন দুষ্টুমির ছলে বলেছিলো মাহরুর এর সব কথা যেনো না মানে।

শিরীন বললো, “এই স্বভাবটা যেনো শুধু আমার ভাইয়ের সাথেই থাকে।আশপাশের মানুষের জন্য কঠিন হতে হবে চন্দ্র।”

“তোমরা আমার পাশে থাকলে আমি পারবো।”

কথোপকথন এর মধ্যিখানে মাহরুরের রসিক কন্ঠ ভেসে এলো। দুর থেকে দুজনকে গিট্টু পেকে বসে থাকতে দেখে বললো,

“কি কু-পরামর্শ করছিস দুজনে?আমাকেও বল।শুনি?”

শিরীন একই সুরে বলে, “তোমাকে জানানো যাবে না।আমাদের মেয়েদের কথা এসব।”

মাহরুর বললো, “যেহেতু মেয়েদের আলাপ আমি নিজ থেকে পা পিছিয়ে নিচ্ছি।তোদের কথায় অনেক প্যাচ থাকে।”

দুইজনকে স্তম্ভিত করে মুখ খুলে মল্লিকা।বলে, “কে বলেছে আমাদের কথায় প্যাচ?আমরা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছিলাম।আপনি বেশি বুঝেন”

তীক্ষ্ণ নজর ছুঁড়ে মাহরুর।পাখির মুখে বুলি ফুটেছে।কিভাবে কর্কর করে জবাব দিয়ে বসলো।কথার ধাঁচে মাহরুর গোলগোল চোখে চেয়ে। শিরীন অবাক হয়।পরপর সামান্য হাসে।তার কথা অল্প হলেও মাথায় গেঁথেছে মল্লিকার।

মাহরুর মল্লিকাকে ভালোমত পর্যবেক্ষণ করলো।চোখ তুলছে আবার নামিয়ে ফেলছে মেয়েটি।কোমরে দুহাত রেখে শিরীনের উদ্দেশ্যে বললো, “তর্ক করা শিখাচ্ছিস ওকে?”

“না না ভাইয়া আমি কিছুই শিখাইনি।” বলে উঠে দৌড় লাগায় শিরীন।
মল্লিকা ঠোঁট ভেজায়।জড়োসড়ো হয়ে উঠে দাড়িয়ে মাহরুরের দিকে এগিয়ে আসলো।

বললো,

“মুখ ফুটে বেড়িয়ে গেছে।আপনি রাগ করেছেন?”

“হ্যা” স্পষ্ট জবাব এলো মাহরুরের পক্ষ থেকে।

“আর বলবো না।”

“এখন আরো রাগ বাড়ছে।”

আহত দৃষ্টিতে তাকায় মল্লিকা।বলে, “কি করলে রাগ কমবে?”

“আদর করলে কমবে”

____

অন্যদের থেকে বেশি বোধহয় মিষ্টির মনে ধরেছে শশীদের নতুন বাড়ি।পাশের গ্রামেই।তবে আসা যাওয়ার পথ অল্প।তাড়াতাড়ি টমটমে করে পৌঁছানো যায় সেখানে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ার আগেই মল্লিকা মাহরুর,শিরীন,রমজান সাহেব,ফরিদা বেগম আর শশীর পরিবার হাজির। এতএত মানুষের কণ্ঠধ্বনি দেয়ালের এপার ওপার বেজে চলেছে। আলাদা আলাদা যুগল তৈরি করে খোশগল্পে মত্ত। শশী মল্লিকাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালো।এক তলা বাড়ি।সুন্দর করে সাজিয়েছে।চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা।ছাদে একটা দোলনাও বসিয়েছে।

সেখানে দুই বান্ধুবি মিলে গল্প করতে লাগলো। দোল খেতে খেতে শশী জানতে চায়, “এখন খুশি আছিসতো?”

স্ফুরিত মুখমণ্ডল মল্লিকার।ঠোঁটের কোণে প্রস্ফুটিত রেখা ফুটিয়ে বললো, “ভীষণ রকমের শান্তি আমার জীবনে সখী।”

“কারো খারাপ নজর যেনো তোদের উপর না পড়ে।এই দুআ করি।”

“আমি তোকে কি বলতাম মনে আছে?”

“কি বলতি?”

দোল খাওয়ার গতি বাড়িয়ে মল্লিকা বলে উঠে, “বলতাম মাহরুর ভাই ভালো মানুষ।খাঁটি একজন মানুষ।আমার প্রথম প্রেম?আমার ভালোবাসা বলে নয়।সে সত্যিই যোগ্যতার অধিকারী।আমি তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছিলাম।আজ ওই ব্যক্তিত্বটাকে নিয়ে বাঁচছি।”

“মাঝেমধ্যে ভাগ্য সময় নেয়।তারপর যা দেয় সেটা হয় অত্যন্ত মিষ্ট।”

“জানিস সখী?পুরোনো কথা মনে পড়ে। আমার আগের সংসারটা?তারপর পড়ন্ত বিকেলে তার মুখ দেখি আমার চিন্তেরা দৌড়ে পালায়।”

কৌতূহলি শশী জানতে চায়, “তোর মাহি ভাইয়ের কি সবচেয়ে বেশি তোর ভালো লাগে?”

আকাশপানে একঝাঁক পাখি উড়াল দিচ্ছে। কিচিরমিচির শব্দে ভরিয়ে তুলছে অখিলমন্ডল। ঘোরগ্রস্ত হয় চন্দ্রমল্লিকা।ভেসে যাওয়া তুলোর মত মেঘে আচ্ছন্ন হয়।সম্পূর্ণ বেখেয়ালি।

উদাসী গলায় উত্তর দেয়, “তার কান্তিমাখা মুখের হাসিটা আছে না?সেটা আমার ভীষণ রকমের পছন্দের।”

মুচকি হেসে আবার প্রশ্ন করে শশী, “কখনো প্রকাশ করেছিস ভালোবাসা?বিয়ের পর?”

“সে একটা ভ্রম।আমি তার সামনে থাকলে ভ্রমজালে ডুবে যাই। শব্দরা ছুটি নেয়”

“মাহি ভাই প্রকাশ করে ভালোবাসা?”

“প্রতিনিয়ত অনুভব করায়।”

“মিষ্টিকে ভালোবাসে মাহরুর ভাই?”

“বোধহয় আমার চেয়ে বেশি।জানিস আমার কখনো কখনো মনে হয় সেই মিষ্টির আসল বাবা। ফারহানকে মিষ্টি পায়নি।মায়া ছিলো মেয়ের প্রতি।কিন্তু সে থাকতো সারাক্ষণ নিজের দুনিয়ায় মগ্ন।আমি তাকে খারাপ বাবা বলে কোনোদিন আখ্যায়িত করবো না।তারপরও একটা খালি স্থান ছিল জানিস?সেই স্থানটা সর্বোপরি পূর্ণ করছে মিষ্টির মাহি বাবা।”

মায়া, মোহ,ভালোবাসা আর ভ্রম সাগরে নিজেকে আবিষ্কার করছে।নীলাকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘকে নিজের সাথে তুলনা করে দিলো।আনমনে হাসলো এই ভেবে এই বিশাল অম্বর মাহরুর।সেখানে সাঁতরে বেড়াচ্ছে মল্লিকা। নির্দ্বিধায়। রাত ঘনালে যখন আধার আচ্ছন্ন হয়ে উঠবে এই আকাশ তখন চন্দ্র হয়ে চলে আসবে মল্লিকা আলো ছড়াতে।একে অপরকে পরিপূর্ণ রাখবে দিবারাত্রি সর্বক্ষণ।

অনেক সময় নিজেদের মতন সময় কাটিয়ে নিচে এসেছে শশী আর মল্লিকা।স্বামী থেকে শুরু করে শশীর শশুর শাশুড়িও অমায়িক মানুষ। দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটি এত সহজভাবে নিবেন কল্পনা করেনি মাহরুর আর মল্লিকা।খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে।

হটাৎ মিষ্টি বায়না ধরলো, “মা?মাহি বাবা?আমার এমন একটা বাড়ি চাই।আমার অনেক ভালো লেগেছে এই বাড়িটা।”

মিষ্টি পরপর শশীর ছেলে সীমান্তকে বললো, “এই তোমাদের বাড়িটা আমাকে দেবে?”

শশী বলে উঠে, “এটাতো তোরই বাড়ি।তোর ভবিষ্যৎ শশুরবাড়ি।”

মিষ্টি অবুঝ স্বরে বলল, “শশুরবাড়ি কি?”

“এটা বুঝতে বড় হতে হবে তোর।এখন চটপট খেয়ে নে।”

তাদের কথোপকথন এ সবাই হাসছে।আনন্দ পাচ্ছে বাচ্চার বাচ্চামোতে। অথচ মাহরুরের মুখে অন্ধকার। ঘোর অন্ধকার।সবার চোখ এড়ালেও মল্লিকার দৃষ্টিতে সবার আগে এসেছে।কি হলো তার?এই আধার আকাশে আলোকিত করতে হাজির চন্দ্র।

এসে জানতে চাইলো নিভু নিভু গলায়, “কিছু কি হয়েছে?”

অন্যমনস্ক মাহরুর ধ্যানে ফেরে।বলে উঠে, “হুম?…না কিছু না।”

“আপনার মন খারাপ মনে হচ্ছে।”

স্বাভাবিকতা বজায় রেখে মাহরুর বলে, “কিছু হয়নি চন্দ্র।”

“আমাকে বলবেন না?”

অবশেষে সামান্য হাসি ফুটে মাহরুরের মুখে।বলে, “পড়ে বলবো।সবার সামনে বলাটা ঠিক দেখায় না।”

“আচ্ছা”

শশীদের বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়ি ফেরা অব্দি মাহরুরের মুখ ভার।সবার অগোচরে মল্লিকার প্রতিনিয়ত নজরে পড়েছে।মন উশখুশ করছে জানার জন্য।তার মুখের কালো আঁধার কতটা কাতর করছে মল্লিকাকে সে জানে না।হাসিখুশি দেখতে চায় তার অম্বরকে।রাগ দেখাক তবে হাসিখুশি থাকুক।

শিরীনদের আড্ডা চললো মধ্যরাত অব্দি।পুরোনো ঘড়ির কাঁটা ঠিক দুইটা পঁচিশে এসে থেমেছে। কাঁথা বের করে মাহরুর ঘুমানোর জন্য উদ্যত হলে হাত আটকে দেয় মল্লিকা। মাহরুরের চওড়া হাতে নিজের হাত গুজে বাড়ির উঠোনে নিয়ে এলো।

অবাক মাহরুর।তবে জানতে চায়নি কেনো মল্লিকা তাকে এখানে আনলো।দুজনেই বসেছে উঠোনে।

মল্লিকা বললো, “মন উদাস করে আছেন কেনো?”

“এটা জানতেই এখানে এনেছিস?”

“হুম”

নভোমন্ডল এর দিকে চেয়ে তারার চিকচিক দেখতে দেখতে মাহরুর বলে, “জানিস মিষ্টির আবদারটা আমার হৃদয়ে এসে লেগেছে।”

“কোন আবদার?”

“ওর একটা বাড়ি চাই।আমার বাচ্চাটার মনে ধরেছে একটা বাড়ি।আমার মনে হচ্ছে মিষ্টি ওই চিলেকোঠায় খুশি না।আমি এমন একজন বাবা হলাম কেনো?মেয়ের মুখ থেকে কথা জমিনে পড়ার আগে কেনো পূরণ করতে পারলাম না?”

মহরুরের বিসন্ন মনে খানিক ভালোবাসা দরকার। দুহাত একত্র করে বসে থাকা তাকে সান্তনা দেওয়া প্রয়োজন। মাহরুরের মাথায় হাত রেখে নিজের কাধে এলিয়ে দেয় নিজে থেকেই।এখন লাজ নয় তার মন ভালো করা মুখ্য।

মল্লিকা বলে, “এক লাফে গাছে ওঠা যায় না।আমি জানি আজকে পারছেন না একদিন ঠিকই পারবেন।আমি এটাও জানি মিষ্টির মনে ধরেছে বাড়িটা।তাই বলে জেদ ধরবে না ও।আমার মেয়েটা অল্প বয়সে যা কিছু দেখেছে?তাতে আমি বলবো সে মানিয়ে নেওয়ার মতন মেয়ে।আপনি ওকে বুঝালে ও ঠিক বুঝবে।”

আবেশে প্রেয়সীর কাধে চোখ বুজলো মাহরুর।বললো, “আমি চাই না ও মানিয়ে নেক।আমি চাই ওর সব ইচ্ছে পূরণ হোক।”

“তাহলে ওকে বলেন অপেক্ষা করতে।সঠিক সময়ে সঠিক জিনিস পাবে।বাচ্চাদের না চাইতেই যদি সব দিয়ে দেওয়া হয় বড় হয়ে ওদের মধ্যে ধৈর্য্য বলতে কিছু থাকে না।”

“সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে মিষ্টিকে।সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ দিতে হবে।জন্মের পর থেকে যে ক’টা বছর তুই আর মিষ্টি অন্ধকারে ছিলি?সবটা যেনো ধুয়ে মুছে যায়।”

মল্লিকা হেসে বললো, “আপনি এত ভালো কেনো?”

“তোর ভালোবাসায়”

“আজ আমরা তিনজন কি সুন্দরভাবে পরিপূর্ণ তাইনা?”

মাহরুর কিছুক্ষণের জন্য নীরবতায় ছেয়ে যায়। সত্যিইতো পূর্ণ তারা।অপূর্ণতা ঘুচে গেছে।আর সেটা নিজে থেকে চন্দ্র স্বীকার করছে। মিনিট দুয়েক এর নীরবতা শেষে মাহরুর বলতে শুরু করে,

“আমার বিয়ের দিন তোকে ভিন্ন রূপে দেখেছিলাম।কবুল বলতে হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছিলো।আমি অন্যায় করেছি।ভীষণ রকমের অন্যায়।তারপর এলো বাসর রাত।আমি ঘরে যেতে চাইনি।আমি চাইনি নতুন ওই নারীর মুখ।তারপরও বাধ্য হয়ে গিয়েছি।হিরা অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য।রাত জেগে।তার দিকে চেয়ে দেখলাম মুচকি হাসির সাথে আমাকে দেখছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন ঘুমোতে গেলাম তখন হিরা কি বলেছে জানিস?নতুন বউকে নাকি বাসর রাতে উপহার দিতে হয়।প্রথমে মনে হলো মেয়েটি চঞ্চল।যেহেতু বিয়ে করে ফেলেছি ওর জীবন নষ্ট করার অধিকার আমার নেই।আমি আশ্বাস দিলাম পরে কিছু উপহার কিনে দিবো।পরদিন আমার মায়ের কাছ থেকে ওর বাবা যে স্বর্ণ দিয়েছিল সেটা এক প্রকার বেয়াদবি করেই ফিরিয়ে নেয়।মাকে সরাসরিই বলেছিলো আমার জিনিস আমি অন্য কারো কাছে রাখতে পছন্দ করিনা।সে আবার আবদার করে।তার স্বর্ণের চেইন চাই। খটকা লাগে আমার।নতুন পরিচিত একজন মানুষের কাছে কত সহজেই আবদার করে ফেলছে।তখনও মেনে নিয়েছি।ভেবেছি স্বামী হিসেবে হয়তো অধিকার খাটাচ্ছে।ধীরেধীরে সংসার করতে শুরু করলাম।একদিন তোকে স্বপ্ন দেখেছি চন্দ্র।তোর কান্নারত মুখ স্পষ্ট দেখেছি সেই স্বপনে।আমি সেদিন থেকে এলোমেলো।পাগল হতে শুরু করেছি সেদিন থেকেই। যার সাথে সংসার শুরু করলাম সে আমার চিলেকোঠা দেখে আমাকে এক মুহূর্তে অবজ্ঞা করতে শুরু করে।নিজের বাবাকে কল করে কান্নাকাটি করে।ওর বাবা আমাকে ফোন করে বলে যে করেই হোক তার মেয়েকে নিয়ে যেনো ভালো ফ্ল্যাটে উঠা হয়। টাকাও সাধে আমাকে।আমি নেইনি। স্পষ্ট জানিয়েছিলাম স্বামীর সংসার করতে হলে স্বামী যেভাবেই রাখুক থাকতে হবে।তারপর চলতে লাগলো আমার বিষাদে ঘেরা সংসার। চাহিদা বাড়তে থাকে হিরার।আর সেই চাহিদা যথাসাধ্য পূরণ করার চেষ্টা করি।যত দেই তত চায়।একদিন জানলাম তোর ঘরে একটা ফুটফুটে কন্যা এসেছে। কতো ছট্ফট করেছি দেখার জন্য। পায়চারি করেছি হাসপাতালের বাহিরে।সাহস করতে পারিনি।তোর বাড়ির কাছে প্রায়ই আসতাম।উকি ঝুঁকি দিতাম।তোকে পেতাম না।একদিন ফারহান এর কোলে তোর মেয়েকে দেখতে পাই।সেদিন আমি নিজেকে একজন খুশি ব্যক্তি হিসেবে আবিষ্কার করেছিলাম।জানতে উসখুস করছিলাম চন্দ্রের মেয়ে অবশ্যই চন্দ্রের মতন হবে।সময় কাটে আমার ঘরে আরো বিষাদ হানা দিতে থাকে।এক সময় ভাবলাম হয়তো একটা সন্তান আমাকে ফেরাতে পারবে।হয়তো হিরা সন্তানের মায়ায় তার লোভ ভুলে যাবে।কিন্তু!হলো না।হিরা নারাজ সম্পূর্ণ বাচ্চা নিতে।অপমান করত কথায় কথায়।তারপর কি হলো জানিস?সব শেষ!তারপর থেকে আমার জীবন শুরু।তুই আমি আর মিষ্টির নতুন জীবন।পরিপূর্ণ সুখী জীবন”

চলবে….

চন্দ্র’মল্লিকা ৩০
লেখা : Azyah_সূচনা

ঈদের ছুটি শেষ। মাহরুর মল্লিকা তিনদিন আগেই ফিরেছে ঢাকায়।বেশি ছুটি পড়লেই শরীর অলস হয়ে উঠে।নিজেকে তরতাজা করতে হবে।রেদোয়ান এর সাথে কথা বলে দোকানের জন্য মালামালের ব্যবস্থা করতে হবে। হলোও তাই।রেদোয়ান দুটো দিনের বেশি ছুটি নেয় অনেক কষ্টে।ইচ্ছে হচ্ছে না তার অলস দেহের পূনরায় সেই খাটনি খাটার। তাছাড়াও মাহরুরের একজন সঙ্গী দরকার নতুন ব্যবসার।

“টাকা যোগাড় করেছো?” রেদোয়ান মাহরুরের উদ্দেশ্যে বললো।

“ব্যাংকে থাকা টাকা দিয়ে হবে না?আমি সীমিত আকারে শুরু করতে চাচ্ছি।”

“কমপক্ষে সব মিলিয়ে এক লক্ষ টাকা দরকার।এর মধ্যে ঈদ গেলো।কিভাবে কি?”

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাহরুর জানতে চাইলো, “ভুল করে ফেললাম নাতো দোকান নিয়ে?এখন এত টাকা হাতে নেই। পঞ্চাশ হাজার আছে ব্যাংকে।”

রেদোয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বলে, “ভুল করোনি। অ্যাডভান্স দিয়েছোতো?”

“হ্যা সেটা আগেই পরিশোধ করেছি। ঈদ বোনাসের টাকা দিয়ে ঈদের খরচ চালিয়েছি সব।”

রেদোয়ান বললো, “গ্রেট।আমাদের এখন হিসাব করে কাজ আগাতে হবে।এক্সট্রা কিছু লাগলে আমি ম্যানেজ করে দিবো।”

মাহরুর সরাসরি না করে দেয়।বলে, “তুমি আমাকে ঋণী করে ফেলছ।এমনেতেই চন্দ্র হাসপাতালে ছিলো তখন টাকা দিয়েছো।”

রেদোয়ান বলে, “তুমি টাকাটা ফিরিয়েও দিয়েছো দুইদিনে।আর কত টাকা দিয়েছি আমি?এই জীবনে না খেয়ে থাকলেও তুমি সাহায্য নেবে না কারো আমি জানি।এক কাজ করো যেহেতু তোমার আত্মসম্মানে বাঁধে টাকা নিতে তাহলে দোকান শুরু করো। যা লাভ হয় আমাকে ফিরিয়ে দিও কিছু টাকা।যতদিন আমার টাকা পরিশোধ না হয় আমি তোমার ব্যবসার পার্টনার।”

মাহরুর বললো, “তুমি কি রেগে যাচ্ছো আমার সাথে রেদোয়ান?”

“রাগ করার মতোই তোমার কাজকর্ম।তোমাকে আমি ভাইয়ের মতন ভাবি।সাহায্য করা আমার কর্তব্য।আর তুমি কি আমার টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবে নাকি?আর আমি আমার টাকার গরমও দেখাচ্ছি না।সৃষ্টিকর্তা আমাকে যা দিয়েছেন তা সঠিক কাজে লাগাতে চাচ্ছি।”

অভিযোগের সুর রেদোয়ান এর।হাসলো মাহরুর।বললো, “আচ্ছা ভাই তুমি আমাকে সাপোর্ট করছো সেই হিসেবে আমি আমার আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিলাম।দরকার পড়লে তুমি আমাকে সাহায্য করো আমার নতুন কাজে কেমন?”

রেদোয়ান চলে যায় আলাপ করে।আগামীকাল দোকান গোছাবে।সব লিস্ট করে সকালেই বেরিয়ে পড়বে কেনাকাটার জন্য।সব চিন্তা ভাবনা করে এক কাপ চা নিয়ে ছাদের কোণে এসে দাঁড়ায়। চায়ে চুমুক দিয়ে মনে হলো অমৃত।প্রতিদিনই মনে হয়।তবে একটা ধন্যবাদ দেওয়া হয়না মল্লিকাকে।করা লিকারের চা।সামান্য এলাচের ঘ্রাণ ভেসে আসে। মিষ্টির ঠিকঠাক ব্যালেন্সে এই চা কে অমৃতর সাথে তুলনা একদম ভুল নয়।

“এত মজার চা কি করে করিস?”

পিছনে দাঁড়ানো মল্লিকা চমকে উঠলো। কি করে বুঝলো মাহরুর সে পিছনে দাড়িয়ে।জানতে প্রশ্ন করে, “কি করে জানলেন?”

“তোর হাতের চুড়ির আওয়াজে।”

মল্লিকা হাত তুলে দেখে।দু জোড়া চুড়ি তার দুহাতে।এতটা শব্দও করে না।তাহলে কি মাহরুরের শ্রবণশক্তি প্রখর?মল্লিকা পাশে দাড়িয়ে বললো, “এত দূর থেকে এত অল্প আওয়াজ শুনে নিলেন?”

“তোকে আমি অনুভব করি। চুড়ির আওয়াজতো একটা বাহানা মাত্র।”

মনে মনে ভাবলো মল্লিকা ‘ খাঁটি প্রেমিক পুরুষে পরিণত হয়েছে মাহরুর ভাই ‘।এতটা আগ্রহ হয়তো সেও দেখায়নি।পুরুষের প্রেম হয়তো এমনি। যথাসাধ্য উজাড় করতে পছন্দ করে।মুচকি হাসি ঠোঁটে এসে জুড়ে বসলো।এত শান্তি সামলানোর জন্য শাড়ির আঁচলও কম পড়ে যাচ্ছে।

“আগামী কাল স্টেশনারি শপটা উদ্ভোধন করবো। আশা করি সব ঠিকঠাক প্ল্যান মাফিক হবে।”

“হবে ইনশাল্লাহ।আমিও যদি কোনো কাজ করতে পারতাম?আপনার সাহায্য হতো। পড়ালেখাও বেশিদূর জানি না।নাহয় দু চারটে বাচ্চা পড়াতাম।”

“তুইতো না করলি।আমিতো চেয়েছিলাম তুই পড়ালেখা শুরু কর আবার।”

বোঝানোর সুরে মল্লিকা জবাব দেয়, “দেখেন মিষ্টি সবে স্কুলে ভর্তি হলো।আপনার নতুন চাকরি হয়েছে আর কতদিন? তারমধ্যে এই নতুন দোকানটা।সব মিলিয়ে অনেক চাপ আপনার উপর।সবকিছু একটু চলমান হোক?তারপর নাহয় আমিও পড়া শুরু করলাম।”

“হুম।ঠিক বলেছিস।চাচা চাচীকে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।”

“সব হবে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”

দিক পরিবর্তন করে ঘুরে তাকায় মাহরুর।চন্দ্রের দিকে এক পলক তাকায়।কি সংজ্ঞা হয় এই নারীর? প্রতিনিয়ত প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয় কেনো?যুবক বয়সে নারী সঙ্গ পছন্দ ছিলো না মাহরুরের।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে খুব চাপা স্বভাব নিয়ে। অথচ মল্লিকার কাছে শক্তিশালী বাঁধনে আটকা পড়ে গেছে।

“আপনি সেদিন বলেছিলেন না?আপনি অনেকগুলো প্রেম করেছেন সেগুলো কি সত্যি?”

মল্লিকার প্রশ্ন কাকতালীয়ভাবে মাহরুরের মস্তিষ্কে চলা চিন্তার সাথে মিলে গেলো।বুকে হাত বেঁধে মল্লিকার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, “তোর কি মনে হয়?”

মল্লিকা মিনমিনে গলায় উত্তর দেয়, “হতেও পারে।আপনি শহর অঞ্চলে গিয়ে পড়াশোনা করেছেন।চাকরির জন্য ঢাকা থাকতেন। এখানেতো কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে।”

“অবশ্যই হতে পারে।আমি দেখতে কি খারাপ?”

“তাইতো জানতে চাইলাম।”

“আমি দেখতে কেমন চন্দ্র?”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নেয় মল্লিকা। তালা আটলো।নিজেকে স্বাভাবিক করছে ধীরেধীরে।তবে সরাসরি বলার সাহস নেই যে মাহরুর সুদর্শন।

মাহরুর পূনরায় প্রশ্ন করে, “বল আমি দেখতে কেমন?”

উত্তর না পেয়ে মাহরুর আবার বলে, “মেজাজ খারাপ করিস না চন্দ্র।তোকে বলেছিলাম না বোবা হয়ে থাকলে ছাদ থেকে ফেলে দিবো।”

ফটাফট মল্লিকা জবাব দিয়ে বসে, “আমার চোখে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ”

তাড়াহুড়ো করে বলেছে। জ্বিভ কাটে মল্লিকা বলেও।বেশি বলে ফেললো নাকি?এই নিয়ে চিন্তাভাবনার সমাবেশ জমতে শুরু করলো। মাহরুর মাথা নুয়ে হেসে উঠলো। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের হাসি।কয়েক সেকেন্ডে হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেছে।মুখটা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক।হলদে আলোয় মাহরুরের মুখে হালকা বাদামি দাড়িগুলো বেশ ফুটে উঠেছে।এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মল্লিকা।

আকস্মিক মাহরুর বললো, “কাছে আয়”

“কেনো?”

“ভালোবাসবো”

নিদারুণ চাওয়া। মাহরুরের মধ্যকার প্রেমিক হৃদয় হুটহাট জ্বলে উঠে।কাছে পেতে চায় দুঃসাধ্য সাধন করে জিতে নেওয়া প্রিয়তমাকে। মল্লিকা নিজ থেকে আসবে না।নারী ভালোবাসা চাইলেও প্রকাশ করতে লাজে ঢেকে যায়।প্রথম ধাপ অতিক্রম করতে হয় অবাধ্য পুরুষকেই।নিজের কাছাকাছি টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকায় মাহরুর।

বলে, “এই সময়টা আমাদের একান্ত।”

সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর আবার বললো, “সুখে আছিসতো?”

মল্লিকা দ্বিধা দ্বন্দ ভুলে বললো, “ভীষণ”

“সুখে থাকার মাশুল দিতে পারবিতো?”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে মল্লিকা বললো, “কিভাবে?”

চন্দ্রমল্লিকার সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক শূন্য করা হয় চাঁদনী রাতে।নতুন রকমের অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে।ঝড়ের গতিতে অধর ছুঁয়েছে মাহরুর।যত দ্রুত কাছে এসেছে তত দ্রুত সরেও গেছে।মল্লিকার সহনশক্তি কম।অজ্ঞান হয়ে গেলে বিপদ।

মাহরুর বললো, ” প্রেমরোগে শিরা উপশিরা টগবগ করছে। দ্রুত এসে বুকে মাথা রাখ।নিজের লজ্জাটাও নিরাবরণ করতে পারবি।”

মল্লিকা কোনোকিছু না ভেবেই মুখ লুকায় মাহরুরের বুকে।হেসে চলেছে সে। ঘনিষ্ঠতা সহ্য করতে না পেরে মূর্তি বনে থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“আমার সাথে স্বাভাবিক হতে হবে চন্দ্র।আমি তোর চাচাতো ভাই ছিলাম এক সময় সেটা ভুলে যা।স্বামীর চোখে দেখ।দেখবি সহজ হয়ে উঠেছে।নাহয় মিষ্টি একাই রয়ে যাবে।ওর খেলার সাথী থাকবে না কোনো।বড় হয়ে জানতে চাইবে ওর কোনো ভাইবোন নেই কেনো?”

মল্লিকার কাছ থেকে জবাব আশা করেনি মাহরুর।মাথা তুলে হালকা।তাকে তাক লাগিয়ে মল্লিকা আমতা আমতা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি এখনই…. ভাবছেন…”

কথার অর্থ বুঝে মাহরুর উত্তর দেয়, “না।সবার আগে তোকে আবার পড়াবো।তারপর মিষ্টির জন্য একটা বাড়ি করবো।তারপর নতুন কারো আগমন ঘটবে।….জানিস আগে ভাবতাম সময় শেষ।এখন মনে হয় সামনে লম্বা একটা জীবন পড়ে আছে।….. উম!নাহ।তবে ওই একটা ব্যাপারে কোনো গ্যারান্টি নেই।নতুন কারো আগমন আগেও হয়ে যেতে পারে। আমাকেতো জানিসই।তুই কাছে থাকলে খারাপ হয়ে উঠি।কাছে আসা থেকে কোনোভাবে বাঁধা দিতে পারবি না।অনেক অপেক্ষা করেছি আর না।তোকে শীগ্রই তোকে এক নতুন মাহরুরের সাথে পরিচয় করাবো। শুধু সময় সুযোগের অভাব বুঝলি।” বলে চোঁখ টিপে মাহরুর।

____

সকাল সাতটায় বেরিয়েছে রেদোয়ান আর মাহরুর।তাদের সাথে খুব আগ্রহ দেখিয়ে দুলালও যোগ দেয়।ছোট্ট স্টেশনারি শপের উদ্ভোধন আজই।সকাল সাতটায় গিয়ে এগারোটায় সব মালামাল এনে দোকানে সাজানো শুরু করেছে তিনজনে মিলে।দাড়িয়ে তদারকী করছেন রহিম মিয়াও।এক সময় তার মুদি দোকান ছিল।অভিজ্ঞ তিনি এসব ব্যবসায়।

মল্লিকার মাথায় চিন্তার শেষ নেই।খেয়ে বের হয়নি মাহরুর।তার সাথে বাকি দুজনও অভুক্ত।দুই চুলোয় রান্না বসিয়েছে।আজ হাতে কাজ বেশি।এলাকার কিছু মানুষকে খাবার দিতে হবে। হঠাৎ আওয়াজ এলো রহিম চাচার স্ত্রীর।

“বউ! ও বউ!ঘরে আছো?”

হাত মুছে দৌড় লাগায় মল্লিকা।কোমড় ধরে দাড়িয়ে আছেন রহিম চাচার স্ত্রী। স্বাস্থ্যবান হওয়ায় সিড়ি বেয়ে উঠে হাঁফিয়ে গেছেন।মল্লিকা বললো, “চাচী আমাকে ডাকতেন?কষ্ট করে সিড়ি বেয়ে আসলেন?”

“আরেহ আইছি এমনেই।কতদিন ছাদের হাওয়া বাতাস নেওয়া হয়না।তুমি কি করতাছো?”

“আজকে ওনার দোকানের উদ্ভোধন।এলাকায় কিছু মানুষ খাওয়াবে।সাথে ওনারাও খাবে।রান্না করছিলাম চাচী।”

“ওহ হ!তোমার চাচা কইছিলো। মৌলভী দিয়া মিলাদ পরাইবো।”

“হ্যা চাচী।”

“মিঠা কিছু রানছো?”

মিষ্টি কিছুর কথা শুনে মাথা ঘুরে গেলো মল্লিকার।এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কি করে তার মাথা থেকে বেরিয়ে যায়?মিষ্টি অত্যাবশকীয় এখানে।কপালে হাত রাখে মল্লিকা।জোবেদা খাতুন হাসলেন।

বললেন,
“আন্দাজ করছিলাম। আহো আমার লগে”

জোবেদা খাতুন মাহরুরের ঘরে ঢুকে মিষ্টিকে বললো, “কিরে বুড়ি?ভালো আছোস?”

মিষ্টি লম্বা চওড়া করে সালাম জানায় তাকে।উত্তরে বলে,
“জ্বি জ্বি”

“আইচ্ছা।আমার ঘরে আসিস মজা খাওয়ামু।”

মিষ্টি মাথা দোলায়।জোবেদা খাতুন বললেন, “ঘরে দুধ আর পোলাও চাইল আছে না?”

“হ্যা চাচী আছে।”

জোবেদা খাতুন চুলোর কাছে পিঁড়িতে এসে বসলো।বললো, “দাও দেহি।ফিরনি বানাই।চিনিও দিও লগে।”

“চাচী আপনি কষ্ট করবেন না।আমি বানিয়ে নিবো।”

“চুপ করোতো ছেমরি।এই শরীর এহনো তাগড়া আছে। ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ার এই যত রোগ বালাই।নাইলে আমি একলা পুরা এলাকার রান্দা পারতাম।আমার হাতের ফিরনি খাইলে সারাজীবনেও স্বাদ ভুলতে পারবা না।আমার মাইয়া পুত যেই শখ কইরা খাইতো।”

মল্লিকার কোনো কথা শুনেননি জোবেদা খাতুন।বাধ্য হয়ে এক এক করে সব এগিয়ে দিতে হচ্ছে তাকে।এক ঘন্টার মধ্যে সারাঘরে ফিরনির সুভাষ ছড়িয়ে পড়ে।মিষ্টির মিষ্টি ভীষণ পছন্দ।দাত বের করে হাসতে হাসতে বাটি নিয়ে হাজির হলো।

বললো, “আমাকে দাও।আমি খাবো।”

জোবেদা খাতুন গরম গরম ফিরনি তুলে মিষ্টির পাতে দিয়ে বললো, “ঠান্ডা কইরা খাইস বুড়ি। জ্বিভ পুইড়া যাইবো নাহয়।”

মল্লিকা বলে, “চাচী আপনি এবার উঠেন। বিছানায় গিয়ে একটু বসেন।ক্লান্ত হয়ে পড়েছেনতো।”

আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ান।বলেন, “হ শরীর এলাই একটু।”

সব রান্না প্রায় শেষ।মল্লিকা একে একে বাটিতে ঢেলে তৈরি করে নিলো।জোবেদা খাতুন অনুরোধ করলো আজ দুপুরে তাদের সাথেই যেনো খেয়ে নেয়।মিষ্টির সাথে খোশগল্পে মেতে তিনি রাজি হন।এরই মাঝে মল্লিকা ফোন হাতে নিয়ে মাহরুরের নাম্বারে কল করে।

“হ্যালো…. বল!”

“হাপাচ্ছেন কেনো?” মাহরুরের ব্যস্ত কন্ঠস্বর শুনে বলে উঠলো মল্লিকা।

“আরেহ অনেক কাজ।মালামাল গুছাচ্ছি।”

“খাবার রেডি।খিচুড়ি আর গরুর গোস্ত সাথে চাচী ফিরনি রান্না করেছে।খাবেন না?সকাল থেকে না খেয়ে আছেন।”

“আচ্ছা ভালো করেছিস।আমি দুলালকে পাঠাই সবার জন্য পাঠিয়ে দে।”

মিনিট দশেক এর মধ্যে দুলাল এসে হাজির।তার ঘামার্ত মুখ দেখে মনে হলো আসলেই অনেক খাটুনি যাচ্ছে সবার উপর দিয়ে।মল্লিকা নিজেও দুলালের সাথে খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।সাথে থেকে খাইয়ে দিয়ে আসবে।কাজের ব্যস্ততায় খাওয়া দাওয়া নিশ্চয়ই এড়িয়ে যাবে মাহরুর।মাথায় ভালোভাবে কাপড় টেনে বেরিয়েছে।নতুন স্টেশনারি শপ এর সামনে এসেই মুখে হাসি ফুটলো।বেশ সুন্দর করে সাজানো। মৌলভী সাহেব এর সাথে ছোটছোট কিছু বাচ্চারাও আছে।এদের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।ঘামে ভেজা মাহরুরের অবস্থা অবসন্ন।হাসিটা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল।

ভদ্রতাসহিত নিচু গলায় বললো, “খাবার এনেছি।”

মাহরুর ফিরে তাকায়। ময়লায় আবৃত হাত পরিষ্কার করতে করতে মাহরুর সামনে এসে বললো, “তুই এলি যে?”

“দেখতে এসেছি। কাজতো শেষ দেখা যাচ্ছে খেয়ে নিন।”

মাহরুর মৌলভী আর বাচ্চাদের দেখিয়ে বললো, “আগে হুজুর আর বাচ্চাগুলো খেয়ে নেক তারপর খাবো।মিষ্টিকে নিয়ে আয় যা।”

মেয়েকে ছাড়া নতুন কিছুর সূচনা সম্ভব?ঘরের প্রদীপকে নিয়েই নতুন পথে পা বাড়াবে মাহরুর।সফল হোক বা অসফল। সততার সাথে এগিয়ে চলার পণ করেছে মনে।স্ত্রী আর সন্তানের ইচ্ছে পূরণের প্রবল ইচ্ছে।মিষ্টিকে লাল টুকটুকে ফ্রক পড়িয়ে নিয়ে এসেছে।কোনোকিছু না ভেবে ‘ মাহি বাবা ‘ বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলো মাহরুরের কাছে।

মাহরুর বলে উঠে, “এখন না বাবা।আমার হাতে ময়লা।হাত মুখ ধুয়ে তোকে কোলে নিবো কেমন?”

মিষ্টি মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা।”

“তোর পদচারণায় আমার নতুন সূচনা শুভ হোক মা।তুই আমার ঘরের জান্নাত”

“বুঝিনি মাহি বাবা” অবুঝের মতন আওড়ায় মিষ্টি

“বড়ো হয়ে বুঝবি।বাবার হাত ধরে থাকবিতো সবসময়?”

“হ্যাঁ থাকবো থাকবো”

মাহরুর,রেদোয়ান আর দুলাল একে একে ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে এসেছে।জোবেদা খাতুনকেও ধরে নিয়ে এসেছে।এসে মাহরুর বললো,

“খুবই ছোট আয়োজন।কিন্তু এখানে অনেক আশা আর খুশি জড়িত।সবাই দুআ করবেন।”

ছোটোখাটো দুআ মাহফিল এর মাধ্যমে স্টেশনারি শপের উদ্ভোধন হয়।জমিনে পাটি বিছিয়ে একে একে সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে মাহরুর আর রেদোয়ান।মুখে একফোঁটা বিরক্তির ছাপ নেই কারো। মাহরুরের মুখ ভঙ্গি অন্য।সব আয়োজন ভালোয় ভালোয় মিটে যাওয়ার পর মাহরুর সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।মনের মাঝে অগাধ তৃপ্তি অনুভব করছে।

সবাই চলে গেলে মল্লিকা এসে বললো, “এবার আপনারা খেয়ে নিন।”

একটা আস্ত দিন এর খাটুনি শেষে ঘরে এসে গা এলিয়ে দেয় মাহরুর।হাত পা ভীষণ রকমের ব্যথা করছে।আগেও পরিশ্রম করেছে।তবে সেটা ভিন্ন।অফিসে বসে মস্তিষ্ক ক্ষয় করেছে।আজ শারীরিক ধকল গেলো।মিষ্টি ফিরনি পেয়ে বেশ খুশি। একটু পরপর এক চামচ করে খেয়ে সুনাম গাইছে অনেকবার।মল্লিকা তেল নিয়ে আসলো। মাহরুরের পায়ের কাছে বসে বললো,

“দেখি পা এগিয়ে দেন।”

মাথায় হাত রাখা মাহরুর মল্লিকার দিকে চায়।বলে, “কি করবি?”

“দাড়িয়ে কাজ করেছেন।দোকানে দুলাভাইকে বলছিলেন পা ব্যথার কথা।মালিশ করে দেই আরাম পাবেন।”

মাহরুর বললো, “তোর কষ্ট হয়নি?একা হাতে এতগুলো মানুষের রান্না করেছিস।”

“হয়নি।আপনি পা দেন।পরশুদিন থেকে আপনার অফিস। অসুস্থ হলে কিভাবে হবে?”

“মাহরুর এত সহজে ভেঙে পরে না।”

বুক ফুলিয়ে বললো মাহরুর।পরপর হেসেও উঠলো।মল্লিকা তার কথার বিপরীতে মাথা দুলায় দুপাশে।তার ভেঙে পড়া অন্য করো না হোক মল্লিকার চোখে ঠেকেছে।কতটা কাতর আর ব্যাকুল হতে পারে সে মল্লিকা দেখেছে।নিজে থেকেই পায়ে তেল মালিশ করে দিতে লাগলো।

আর বললো, “কালতো দুলালকে সব কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আমি কিছুক্ষন পর খাবার গরম করছি। দ্রুত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন”

মাহরুর বললো, “তোর সাথে একান্ত সময় কাটাবো না?”

একটু জোর খাটায় মল্লিকা অথচ চক্ষু নত করে বললো, “আপনি না বললেন সামনে একটা লম্বা জীবন পড়ে আছে।একান্ত সময় কাটানোর জন্য অনেক সময় আছে।আপনি আজ ঘুমোবেন!”

ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তিনজন।আজ মল্লিকাকে ছুটি দিয়েছে।মিষ্টিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে মাহরুর।রাত তিনটে।ফোন বাজছে অনবরত। মাহরুর একলাফে উঠে ফোন সাইলেন্ট করে।পরপর রিসিভ করে নেয়।

“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম ”

কোনো উত্তর এলো না।কিছু সময় অপেক্ষা করে মাহরুর আবার বলে, “কে বলছেন?”

মাহরুর আবার বললো, “ফোন দিয়ে কথা বলছেন না কেনো?”

এবারও ফোনের অপরপাশ নিঃশব্দ।এত সময় অপেক্ষা করে বিরক্তি ধরে যাচ্ছে। মাহরুর পূনরায় কিছু বলার জন্য মুখ খুললে খট করে ফোন কেটে দিলো সেই আগন্তুক।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে