চন্দ্র’মল্লিকা ২৫
লেখা : Azyah_সূচনা
মাস খানেক কেটেছে। মাহরুরের চাকরিসহ,সংসার বেশ চলছে।মিষ্টি স্কুলে মন টেকাতে পেরেছে।প্রথমবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বেশ খুশি সে।নতুন নতুন বন্ধু পাত-তেও শিখে গেছে মেয়েটা।মিষ্টি কখনো চঞ্চল কখনো চুপচাপ।বড় একটা বাড়ি ফেলে এই চিলেকোঠায় সারাদিন সময় কাঁটায়।মাঝেমধ্যে সুমাইয়া সায়মন চলে আসে এখানে।আবার মিষ্টিকে নিয়ে যায়।চলছে টোনাটুনির সংসার।সাথে একটা মিষ্টি পরী জীবনকে আলোকিত করে আছে।দায়িত্বে পিছু-পা হয়না মাহরুর। সর্বদা ঢাল হয়ে দাঁড়ায় দুইজনের জন্যে।মল্লিকা আর মিষ্টির হাসি মুখটা সামলে দেয় মাহরুরকেও।প্রথম কয়েকদিন মানিয়ে নিতে সমস্যা হলেও ইদানিং অভ্যস্ত অফিসে।ওই পরিবেশ সয়ে গেছে তারও।
মিষ্টিকে গোসল করিয়ে তৈরি করে দিচ্ছে। আজ তার মাহি বাবা বলেছে বাড়ি ফিরে বাহিরে বের হবে। আগেভাগেই যেনো ঘরের সব কাজ সেটে ফেলা হয়।দুষ্টু মিষ্টি সময় পার করছে মা মেয়ে দুজনে। মিষ্টির চুল বেঁধে দিয়ে ঘরে আসতেই ফোন বাজে।অপরিচিত নাম্বার।ফোন কি তুলবে?না তুলবে না?এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বাজা বন্ধ হয়ে গেলো।হাফ ছেড়ে বাঁচার আগেই আবার বাজে। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কল।নাহয় এতবার কেনো দিবে?
ফোন ধরেই মল্লিকা বললো, “আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কিরে স্বার্থপর সখী!”
“শশী?”
“হ্যা শশী। আগে কষ্টে থেকে আমায় ভুলে গিয়েছিলি।এখন সুখে থেকে আমাকে ভুলেছিস।তুই অনেক খারাপ মল্লিকা।”
মল্লিকা বললো, “দশ দিন আগে না তোর সাথে কথা বললাম।”
শশী ঢং করে বলতে লাগলো, “দশ দিনে কত ঘণ্টা হয় জানিস?তোর সাথে কথা বলার জন্য দিন হিসেব করতে হবে?”
“কি করবো বল!ওটা তোর শশুর বাড়ি।ভয় করে বারবার কল করতে।যদি তারা রেগে যায়।আমাদের আলাপ ঘণ্টার পর ঘণ্টা গড়ায় তুই জানিস না?তোর এত বড় সংসার। সামলাতে হয়।এই ভয়ে ফোন দেই না।”
“যুগ বদলেছে।এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ।তুইতো সেখানে নেই। নাহয় ভিডিও কল দিতাম।যাই হোক।ভয় নেই কোনো যখন ইচ্ছে কল করবি। শাশুড়ি আমার আপন খালা।খুব ভালো মানুষ।”
“আলহাদুলিল্লাহ ”
“আচ্ছা শোন না। মাহরুর ভাই কেমন রে?”
মল্লিকা নির্বোধের মতন জানতে চায়, “কেমন মানে কেমন?”
উৎসুক আগ্রহী গলায় শশী প্রশ্ন করে, “স্বামী হিসেবে কেমন?”
কাছে কেউ নেই। শশী ফোনের অন্যপাশে।তারপরও লাজুক মল্লিকা মাথা নামায়। মিনমিন করে বলে, “ভালোই”
“শুধু ভালো? বল না মল্লিকা?আমরা মাহরুর ভাইকে ছোটবেলা থেকে ভাই হিসেবে দেখেছি।হুট করে তোর স্বামী হয়ে গেলো।আদর যত্ন করেতো ঠিক মত?”
“কি বলিস শশী!কেমন প্রশ্ন করলি?তুইতো এমন ফাজিল ছিলি না?”
“হয়ে গেছি।ফাজিল জামাইর পাল্লায় পড়ে আমিও ফাজিল হয়ে গেছি। মাহরুর ভাইকে লাজুক মনে হয়। শান্তও বটে।তোদের সম্পর্ক ঠিক আছেতো?”
লম্বা একটা শ্বাস ফেলে মল্লিকা।শান্ত?লাজুক? শশীর মাহরুর সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।পাগলাটে মাহরুরকে শুধু মল্লিকাই দেখেছে।ধীরেধীরে উন্মাদনার সকল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সে।সেটা সখীর কাছে ফাঁস করা যাবে না।নিজেদের মধ্যেই থাকুক।
“তুই এসব বাদ দিবি শশী?”
শশীর হাসির শব্দ ভেসে এলো।বললো, “আচ্ছা বাদ দে।একটা সুসংবাদ নে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে একটা বাড়ি কিনেছি আমরা।অনেক সুন্দর বাড়িটা মল্লিকা পুরো আমার স্বপ্নের মতন।তুই, মাহরুর ভাই আর আমার ছেলের বউ মিষ্টি এবারের ঈদ আমাদের বাড়িতে করবি।কোনো কথা শুনবো না আমি।আর হ্যা শিরীন আপাকেও আনবি।চাচা চাচীতো আছেই এখানে।”
“অনেক অনেক শুভেচ্ছা সখী।তোর না একটা নিজের বাড়ির শখ ছিল।বলেছিলি সাজাবি নিজের মতন করে?তোর শখ পূর্ণ হলো।” ভীষণ খুশি হয়ে বলল মল্লিকা।
“হ্যা রে।নিজের মনের মতন করে সাজিয়েছি। আসবিতো আমার ঘরে?”
“ওনাকে বলে দেখবো”
“শুধু বলে না রাজি করাবি।তোর মাহরুর ভাই যে উতলা হয়ে বিয়ে করলো তোকে? একটু ভালোবেসে বললে একটা কথাও অপূর্ণ রাখবে না দেখে নিস।”
“উফ শশী!রাখলাম আমি”
“আচ্ছা আচ্ছা।আমার নাম্বারটা সেভ করে রাখিস।”
“আচ্ছা রাখছি।”
ফোন রাখে মল্লিকা। টিভিটা খট করে বন্ধ করে দিল। খুব বাজে অভ্যাস হয়েছে এই মেয়ের।সারাদিন কার্টুন।আজকাল আবার খবর দেখার শখ জেগেছে ওর।এইটুকু মেয়ে এত এত অপরাধের বার্তা শুনে হা করে রাখে।একটু কঠোরতা অবলম্বন করে মিষ্টিকে বই সামনে ধরিয়ে দেয়।বাড়ির কাজ একা একা করতে দিয়ে নিজেও চলে গেলো গোসল করতে।
মাহরুর ফিরেছে।আজ বাড়ির ভেতরের সিড়ি দিয়ে এসেছে।রহিম চাচার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে এই মাসের ভাড়াটা দিয়ে দিলো।ঘরে আসতে বললেও আসেনি। তাড়া আছে তার।ঘরে এসেই দরজা ধাক্কায়।অনেকক্ষন যাবৎ।কেউ দরজা খুলছে না।মনের মধ্যে হালকা ভয় হানা দেওয়ার আগেই পকেট থেকে আলাদা চাবি বের করলো।লোহার গেট এর তালা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে ভিন্ন পরিবেশ।মা মেয়ে দুজন অযথা খিলখিল করে হাসছে।এই হাসি এতই তীব্র দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ অব্দি তাদের কানে আসেনি।
মাহরুর এগিয়ে এলো। মিষ্টিকে বললো, “অন্যদিকে তাকা।”
মিষ্টিও অন্যপাশে ফিরতেই মাথায় থাপ্পড় পড়ে মল্লিকার। মাহরুর সামান্য রাগ দেখিয়ে বললো,
“কিরে বধির মহিলা।কতক্ষন যাবৎ দরজা ধাক্কা দিচ্ছি।শুনিস না?ভয় হতে শুরু করেছিল।”
“শুনিনি।”
শান্ত করে নিজেকে মাহরুর।পকেট হাতড়ে কিছু একটা বের করতে করতে বলল, “হাত এগো ”
“কি?”
“হাত দে”
“কেনো?”
“চন্দ্র!”
ধমকের সুরে মাহরুরের মুখে ডাক শুনে দ্রুত হাত এগিয়ে দিলো। মাহরুর পকেট থেকে একটি খাম বের করে মল্লিকার হাতে রাখলো।
বললো, “নে ”
“কি এটায়?”
“আমার বেতনের টাকা।এর মধ্যে ছয় হাজার ভাড়া দিয়ে এসেছি।”
মল্লিকা আশ্চর্য্য হয়ে বললো, “এগুলো দিয়ে আমি কি করবো?”
“তোর হক আছে না?আম্মা থাকলে আম্মার হাতে দিতাম।রাখ শুনেছি নারীরা টাকা,পয়সা যত্ন করে রাখে।অহেতুক খরচা করে না।”
হঠাৎ চাচীর কথা শুনে মনটা বিসন্ন হয়ে উঠে।এক সময় ভীষণ আদর করতো মল্লিকাকে।হটাৎ কি যেনো হয়ে গেলো তার। মাহরুর ধ্যান ভাঙায়।
বলে, “চল মার্কেটে যাবো”
“মাত্র বেতন পেলেন।এখনই?”
“টাকা যেমন বাঁচার একটা মুখ্য উপাদান,তেমনি হাতের ময়লাও বটে।মাঝেমধ্যে ময়লা পরিষ্কার করতে হয়।এতে অসুখ বাঁধে না।”
“অল্প কিছু টাকা নিয়ে যাবো তাহলে।হিসাব করে খরচ করবো।অহেতুক কিছুই না”
“দ্রুত নিজের চরিত্র বদলালি? একটু আগে বলছিলি টাকা দিয়ে কি করবি?এখন বউদের মতন হিসাব শুরু করেছিস।”
“আমি কি এখন তাকাবো তোমাদের দিকে?”
হটাৎ করেই মিষ্টি বলে উঠে কথাটা।বেচারি বাবার আদেশ মতন অন্যদিকেই ঘুরে ছিলো।মাথা ফেরাতে হবে কখন সেটাতো বলেনি। মাহরুর মল্লিকা নিজেদের কথার চলে বুঝতেই পারেনি মিষ্টি এখনো অন্যপাশে ফিরে আছে। মিষ্টির কথার ধরনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মাহরুর। মল্লিকাও মুখ ছাপিয়ে হাসছে।
মাহরুর আলমারি থেকে একটা গোলাপী শাড়ি বের করে।বলে, “এটা পড়বি আজ।দ্রুত তৈরি হয়ে নে।”
“আচ্ছা”
“মিষ্টি কাপড় বদলেছে।বাকিটা আমি করছি।সুন্দর করে তৈরি হয়ে আয়”
গোলাপি রঙের শাড়িতে নিজেকে পরিপাটিভাবে সাজিয়েছে মল্লিকা।আজ খোঁপা করলো না। বিনুনী বেঁধে নিলো মাথায়।চুল পাতলা হয়ে গেছে আগের চেয়ে।তবে দৈর্ঘ্য কমায়নি।বেধে এগিয়ে এলো ঘরের দিকে। মাহরুরের দিকে না চেয়েই আয়নার সামনে দাড়ায়।খুঁজে খুঁজে কাজলটা বের চোখে পড়তে শুরু করলো মল্লিকা। ততক্ষণে মাহরুরের চোখ নিজের দিকে টেনেছে।হালকা কাজল চোখে ছুঁইয়ে। কানে একজোড়া ছোট্ট ঝুমকা পড়ে সাজগোজ পূর্ন করে।
মাহরুর পেছনে এসে দাঁড়ায়।মিষ্টি আছে সাথেই।বেহায়াপনা দেখানো অসম্ভব।তাই বলে উঠলো, “জানিস তোকে কেমন লাগছে?”
লাজুক ভঙ্গিতে মল্লিকা জানতে চায়, “কেমন?”
“শশীর বিয়ের দিন প্রথম শাড়ি পড়েছিলি।ঠিক তেমন দেখাচ্ছে।শুভ্র,মায়াবী।”
“চলুন।দেরি হচ্ছে” সরাসরি এড়িয়ে গেলো মল্লিকা।
গলির মুখে গিয়ে সি.এন.জি নিতে হবে।দুই তিন মিনিট এর রাস্তা।হেঁটে চলেছে মল্লিকা, মাহরুর আর মিষ্টির। বাবার কোলে একের পর এক প্রশ্নের বন্যা বইছে মিষ্টির মুখে। কোথায় যাচ্ছে,কেনো যাচ্ছে,কি কি কিনবে সেখানে সব। হঠাৎ পেছন ডাকে মল্লিকা।
বলে, “শুনছেন।আমাকে একশো টাকা দিবেন?”
পকেট থেকে একশো টাকা নোট বের করে মল্লিকাকে এগিয়ে দিলো।মল্লিকা আবার বললো, “ওখানে একটা মহিলা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে।ওদের এই টাকাটা দিয়ে আসি?ওদেরও হক আছে।এতে আয়ে বরকত আসবে।”
মাহরুর স্বেচ্ছায় সম্মতি দেয়।বলে, “যা দিয়ে আয়। এটাতে অনুমতি নেওয়ার কি আছে?”
“আচ্ছা”
মল্লিকার কথায় পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েছে।এই টাকায় কেনাকাটা,খাওয়া দাওয়া,ঘুরাফেরা সবটা করতে হবে।এটাই আবদার মল্লিকার।আজ রাতের শহরটা ঘুরবে।আনন্দে।নিজেদেরকে সময় দেবে।একটা সুখী দম্পতির ন্যায় সবার সম্মুখে উপস্থাপন করবে।এলাকায় জানাজানি হয়েছে।মল্লিকা এখন মাহরুরের স্ত্রী।একেক জনের একেক প্রতিক্রীয়া হলেও তাতে কিছুই আসে যায়না মাহরুরের।তার মতে নিজে ভালো থাকলে জগৎ ভালো।প্রতিবেশের চিন্তা চেতনাকে দুরত্বে ঠেলে নিজেদের মতন করে বাঁচার চেষ্টা।
রিকশায় চড়ে কিছুদূর এগিয়ে মল্লিকার চোখ পড়ে রাস্তার দ্বারে কাপড়ের স্টল বসেছে।চোখ গাড়লো সেখানে।
বললো, “আমরা মার্কেটে যাচ্ছি?”
মাহরুর উত্তর দেয়, “হ্যা”
“সামনে দেখেন কতগুলো কাপড়ের দোকান।অনেক ভিড় এখানে।চলেন এখান থেকে কিনে নেই।”
“আমি মিষ্টিকে বলেছি ভালো কোনো মার্কেট থেকে কিনে দিবো।”
“আহহা!ভালো মার্কেটেও এমন কাপড়ই পাওয়া যাবে।আপনি চলুন না।অনেক অনেক কেনাকাটা করা যাবে এখান থেকে।দাম আর অবস্থান দিয়ে কি আসে যায়?জিনিস যদি সুন্দর হয় আর ভালো হয়?”
বাহিরে এসেছে।খোলামেলা পরিবেশে মল্লিকা নিজের বদ্ধ মনকেও খোলামেলা করছে।তার আবদারটাও আদুরে মনে হলো।আর বুদ্ধিমতীর মতন চিন্তাধারা অবাক করলো।মল্লিকার গাল টেনে রিকশাওয়ালাকে বলে সামনে থামাতে।
মল্লিকার কথা ঠিক।এখানে সুন্দর সুন্দর জিনিস পাওয়া যাচ্ছে।দামী গার্মেন্টস এর কাপড়গুলো তারা এনে এখানেই বিক্রি করে।সাথে সব ধরনের ঘরোয়া জিনিস। বাচ্চাদের খেলনাও আছে এখানে।এক এক করে গিন্নির বেশভূষা ধারণ করে কেনাকাটা সম্পন্ন করলো মল্লিকা।মেয়েদের বুঝি এই গুন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত? এগারশো টাকায় দরকারি সব কিনেছে।
হাতে ব্যাগ নিয়ে আবার রিকশায় চেপেছে।ক্লান্ত চন্দ্র তার। মাহরুর টিস্যুর সাহায্যে ঘাম মুছে দেয়।আলগোছে কোমর চেপে নিয়ে বললো,
“ক্লান্ত হয়ে গেছিস না?”
“হুম অনেক।”
“ক্ষিদে পেয়েছে?”
“হ্যা”
“সামনের লেক পাড়ে যাবো।সেখানে খাওয়া দাওয়াও হবে।আর বাচ্চাদের খেলার জন্য রাইডও আছে।”
লেকের পাড়ে মনোরম পরিবেশ। উপভোগ করছে মল্লিকা।তবে একা।কাঠের টেবিলে গালে হাত রেখে একবার আধাঁরে ঢাকা নিস্তব্ধ জলরাশি দেখছে কখনও অন্যপাশে ঘুরে মিষ্টি আর মাহরুরকে।মিষ্টিকে দোলনায় দোল খাওয়াচ্ছে।কখনো ছোট ট্রেইন।আবার কখনো বাচ্চাদের খেলার রাইডে তুলছে। দুটোই শান্তির স্থান।মিষ্টিকে খেলানোর পাশাপাশি মল্লিকার দিকেও চোখে চোখে রাখছে।দুজনই তার দায়িত্ব।কোনোটাই ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়।অন্যদিকে মল্লিকার চোখে ডান বাম উভয় দৃশ্য দৃষ্টিনন্দন। মাহরুর তার মাথার ছায়া।এই ছায়ায় চঞ্চলতায় মেতে ওই বাচ্চা মেয়েটি।এরই মধ্যে খাবার চলে এলো।
মল্লিকা গলা উচু করে ডাকে।বলে, “চলে আসুন।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
মিষ্টিকে ডান কাঁধে তুলে নিয়ে এলো।হয়রান দুজনেই।একজন খেলাধুলা করে অন্যজন তার পেছনে দৌড়ঝাঁপ করে।হাফ ছাড়লো চেয়ারে বসে।খাবার দেখে মনে পড়লো মিষ্টিরও ক্ষুদা পেয়েছে।
বলে উঠলো, “ক্ষিদে পেয়েছে।”
মল্লিকা বললো, “এত এত দৌড়ঝাঁপ করলি কেন মিষ্টি?”
“অনেক মজা লাগছিল মা।ওই দোলনায়,ট্রেনে।”
“হয়েছে।এবার ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে হবে বলে দিলাম।কোনো বায়না চলবে না।”
“আচ্ছা মা।”
মাহরুর বললো, “অযথা বকিস মেয়েটাকে।এই বয়সে বাচ্চারা আরো দুষ্টুমি করে।সেই তুলনায় আমার মিষ্টি অনেক শান্ত।তাই না মিষ্টি?”
মিষ্টি ঠোঁট চেপে হেসে হেসে মাথা দোলায়।মিষ্টি আজ খাবার নিয়ে কোনো বায়না করেনি। মাহরুরের হাতে সুন্দরমত খেয়ে উঠেছে।যতটুক পারে। মাহরুর ঘড়ি দেখছে।রাত নয়টা বাজে।এবার বাড়ি ফেরার পালা।খাবারের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় আবারো একটি মেয়ে পেলো সেদিনের মতন।এক বালতি ফুল নিয়ে মুখ চেয়ে দাড়িয়ে আছে। মাহরুর দাড়ায়।বেশ কয়েকটা ফুল কিনে নিলো।
মল্লিকার কাছে এসে বললো, “আপনার জন্য।গ্রহণ করুন”
“আবার ফুল কিনলেন কেনো?”
“এত কথা বলিস কেনো তুই?নে”
আরেকটা ফুল এগিয়ে মিষ্টির দিকে দিয়ে বললো, “আর এটা আপনার”
মেয়েটি এখনও দাড়িয়ে আছে।হয়তো সুখী পরিবার দেখে থমকে আছে।হাসছে মুচকি মুচকি। মাহরুর খেয়াল করলো। মাহরুর আর কিছু টাকা মেয়েটিকে ধরিয়ে বললো,
“আমাদের একটা ছবি তুলে দিবে?”
“হ স্যার দেন।”
মোবাইল এগিয়ে দিলো মাহরুর। মিষ্টি মাহরুরের কোলে। মল্লিকাকে ডাকলে সেও সাথে এসে দাঁড়ায়।তবে দুরত্বে। মাহরুর কপাল কুঁচকায়।বাহু চেপে কাছাকাছি টেনে নিলো।
কানে কানে বললো, “দূরে দূরে থাকতে না করেছি কিন্তু চন্দ্র।”
মেয়েটি নৈপুন্য না ছবি তোলায়।তারপরও অনেকগুলো ছবি তুলেছে।বেশিরভাগ ছবি তাদের একসাথে।সবশেষে একটা ছবি মাহরুর আর মল্লিকার।অজান্তেই দুজন দুজনের দিকে চেয়ে আছে। মাহরুর হাসলো।ভীষণ মানিয়েছে তাদের দুজনকে।আর মিষ্টি সেই সৌন্দর্য্যকে দ্বিগুণ করছে।পরিপূর্ণ মনে হয় নিজেকে।আবার ভয় হয়।এই সুখটায় কারো কালো ছায়া না পড়ুক। অতিরিক্ত শান্তিও কখনো ভয়ের কারণ।সামলে নেওয়ার শক্তি প্রয়োজন।অনেক সাহস প্রয়োজন।কু নজর মোকাবেলা প্রয়োজন।মল্লিকা আর মিষ্টির উপরে যেকোনো বিপদ আসার আগে যেনো মাহরুর এসে পিঠ ঠেকাতে পারে।তবে মাহরুর এই ভেবে শান্তি পেলো অনেকটা পথ।অনেকটা অনিশ্চিত পথ পেরিয়ে উদ্দেশ্য পেয়েছে জীবনের।
বাড়ি ফিরেছে।ফেরার পথে ছবিগুলো স্টুডিওতে দিয়ে এসেছে।বাঁধাই করবে।নিজের কাছেও রাখবে।যতটা সময় এই দুইজন মূল্যবান ব্যক্তি থেকে দূরে থাকে তাদের ছবির সাহায্যে যেনো কাছাকাছি অনুভব করে।মল্লিকা আর মিষ্টি ভীষণ ক্লান্ত।ঘুমিয়ে আছে।দুজনের কপালে চুমু খেয়ে ছাদে এসে দাঁড়ালো মাহরুর।আকাশপানে চেয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষন।
আজ জন্মদাত্রী মায়ের সাথে আলাপ করা যাক?কতদিন তাকে ওই তারার ভীড়ে খোঁজা হয়না।বাবাকেও মনে পড়ে।দুজনেই যেনো আকাশ থেকে মাহরুরের চিলেকোঠার সংসারটা দেখছে।
মনে মনে বললো, “এই সস্তিটাইতো খুঁজছিলাম!আম্মা তোমার প্রতি আমার এখন কোনো রাগ নাই।হয়তো তখন বাঁধা না পেলে সুখটা দ্বিগুণ শোরগোল করে আসতো না জীবনে।তোমাকে খুব মনে পরে আম্মা।দুআ করবে নিজের ছেলের সুখী জীবনের জন্য?”
চলবে….
চন্দ্র’মল্লিকা ২৬
লেখা : Azyah_সূচনা
ছিমছাম ডেস্কটায় সুন্দর ফ্রেমে আবৃত ছবিটি রেখেছে মাহরুর।একদম নিজের চোখ বরাবর।ফোনের আওয়াজ অফিসে গুঞ্জন তুললে অনেকেই কাজে সমস্যা হয়।তাই নিয়ম সবার পার্সোনাল ফোন ভাইব্রেশন মোডে থাকবে। মাহরুর ফোনটা ভাইব্রেশন মোডে রেখে বুক পকেটে রেখেছে।যেনো বাজলে দ্রুত রিসিভ করতে পারে।মাত্রই ডিরেক্টর ফাইল দিয়ে গেলেন।বললেন এগুলো এলাইন করতে হবে।সেগুলো কম্পিউটারে টুকে রাখতে হবে।আদেশ অনুযায়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর কাজ শুরু করে।ফাঁকে ফাঁকে ছবিটিতে চোখ বুলায়;ছুঁয়ে দেয়।নিজেকে বলে উঠে সম্পূর্ণভাবে চন্দ্রমল্লিকার প্রেমে বুদ হয়েছে সে।কেমন যেনো কিশোর প্রেমিকের মতন আচরণ তার।ছেলে মানুষী করে ফেলে তেত্রিশ বছর বয়সী একজন লোক।
“মিস্টার মাহরুর ইবনাত। ফ্রেশার রাইট?”
মেয়েলি গলায় কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে মাহরুর।সামনেই দেখলো একজন আধুনিক বেশভূষায় আবৃত নারীকে।চুলগুলো ছোট ছোট বাদামি রঙের।ছেলেদের মতন কোর্ট প্যান্ট পড়েছে।
মাহরুর বিনয়ী হাসি ছুঁড়ে নিচু গলায় বলে, “জ্বি”
মেয়েটি হাত এগিয়ে দিলো।বললো, “আমি তানিয়া”
বিব্রত বোধ করে মাহরুর।এসব হ্যান্ডশেক পুরুষের সাথে গেলেও নারীর সাথে? মাহরুরকে ভাবনা চিন্তা করতে দেখে হাত সরিয়ে নিল মেয়েটি।
বললো, “ইটস ওকে।আমি আপনার টিমের। পরিচিত হতে এসেছি।কিছুদিনের ছুটিতে ছিলাম তাই আপনার সাথে সাক্ষাৎ হয়নি।”
“ওহ আচ্ছা”
“অফিস কেমন লাগছে আপনার?”
“জ্বি খুব সুন্দর”
আলাপ আলোচনা দীর্ঘ করলো মেয়েটি।পরিচিত হলো একে অপরের সাথে।কিছু আলাপ কাজ সম্পর্কে,কিছু অন্যান্য বিষয়ে।শেষমেশ মেয়েটির চোখ পড়ে ডেস্ক এর কোনায় ছবিটিতে। অনুমতিবিহীন হাতে তুলে নেয় ফ্রেমটি। মাহরুর বিজড়িত অবস্থায় পড়ে যায়।তার এসব পছন্দ না।কারো অনুমতি ছাড়া কিছু স্পর্শ করা বেয়াদবির কাতারে ফেলে সে।
মেয়েটি ভ্রূ উচু করে জানতে চায়, “ফ্যামিলি?”
“জ্বি হ্যাঁ।আমার স্ত্রী আর মেয়ে।”
“ওহ মায় গড!আপনি একজন মেয়ের বাবা? আই কান্ট বিলিভ।”
“কেনো?”
“ইয়াং মনে হয়।”
“হয়তো।কিন্তু এটা সত্যি আমি পাঁচ বছর বয়সী একজন মেয়ের বাবা।”
ফ্রেমটি খট করে টেবিলে রাখলো তানিয়া।বললো, “নাইস। সি ইউ সুন।”
নিশপিশ করে ফ্রেমটি হাতে নিলো মাহরুর।কপাল কুঁচকে আছে। হাতের সাহায্যে ভালোমত মুছে তার ঠিক জায়গায় রেখে দিলো।ফোন বাজছে।নাম পাশের বুক পকেটে ফোনের কম্পন জানান দিলো তার হৃদয়ের কম্পন তাকে মনে করেছে।
ফোন রিসিভ করেই গলা নামায় মাহরুর।শীতল কণ্ঠে বললো,
“বলেন?”
“জানেন মিষ্টির রেজাল্ট দিয়েছে।”
“কি? সত্যিই।কি হলো রেজাল্ট?”
“ক্লাসে চতুর্থ হয়েছে আপনার মে…” বলতে বলতে থেমে যায় মল্লিকা।
“থেমে গেলি কেন?পুরো বাক্য শেষ কর চন্দ্র।এসির বাতাসে বসে মাথা গরম করতে চাচ্ছি না।”
“আপনার মেয়ে।”
“আবার পুরো লাইন বল।”
“ক্লাসে চতুর্থ হয়েছে আপনার মেয়ে” বলে হাফ ছাড়ে মল্লিকা।
“ভেরি গুড।”
“মিষ্টি কথা বলবে।”
“দে”
মিষ্টি এক প্রকার কেড়ে নিয়েছে হাত থেকে ফোন।যতক্ষণ মল্লিকার হাতে ছিলো টানাটানি করছিলো।কথা না বলে শান্তি নেই।মল্লিকা মিষ্টির কানে ফোন ধরলো।
মিষ্টি চঞ্চল ভঙ্গিতে বললো,
“মাহি বাবা”
“বল বাবা?তুই নাকি চতুর্থ হয়েছিস?”
“হ্যা..আমার ক্লাস টিচার বলেছে গুড গার্ল।পরের পরীক্ষায় আরো ভালো করে পড়তে।তখন ফার্স্ট হবো।”
“ইনশাল্লাহ।কিছু আনবো তোর জন্য?”
“হ্যা হ্যা ঐযে টিভিতে দেখায় ডেইরি!ডেইরি চকলেট।ঐটা”
“ডেইরি মিল্ক?”
“হ্যা।”
“একটা না দুইটা নিয়ে আসবো।কিন্তু একটা শর্ত আছে?”
“কি মাহি বাবা?”
“রাতে মা ভাত খাওয়াতে বসলে কোনো বায়না করা চলবে না। সব ভাত পেট পুড়ে খেলেই চকোলেট পাবি।ঠিক আছে?”
“আচ্ছা আচ্ছা।রাজি”
“মাকে দে ফোনটা।”
মল্লিকা এতক্ষন দুজনের কথা ফোনের সাথে কান চেপে শুনছিল। হটাৎ মিষ্টি সরে গিয়ে ফোন এগিয়ে দেয়।মল্লিকা বললো,
“হুম?”
“খেয়েছিস তোরা?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা রাখি তাহলে।”
“আপনিও খেয়ে নিয়েন।অপেক্ষা করবো।”
বিশ্বজয়ের হাসি ফুটলো মাহরুরের মুখে।এই প্রথম অপেক্ষা করবো বাক্যটি যথাযথ বলেছে।এতদিন প্রেমিকা হওয়ার পাঠদান আজ কাজে লাগালো।তবে সময় থাকতেই কাজে লাগিয়েছে। মাহরুরের উত্তর দেওয়ার পূর্বেই ফোনটা রেখে দিল মল্লিকা। হবে!এই হিসেবও বাড়ি গিয়ে হবে।তবে কোনো শাস্তি নয়।ভালোবেসে হিসেব হবে।
__
প্রতিদিনের নিয়মমাফিক ঠিক টাইমেই বাড়িতে অবস্থান মাহরুরের।আর দিন কয়েক পাড় হলেই রোজার ঈদ।বাজারের লিস্ট করতে হবে। একমাসের রোজার জন্য সব কেনাকাটা করতে হবে সময় বের করে।আজ রবিবার।আগামীকাল তার ছুটি।ছুটি?এই শব্দটায় অলসতা ধরে গেলো শরীরে।ক্যালেন্ডার দেখে সময় মিলিয়ে নিলো।এই শুক্রবারেই রেদোয়ানকে নিয়ে বড় বাজারে যাবে।কেনাকাটা একবারে করে নিয়ে আসবে।রাতের খাবারের পর মাহরুর এককাপ চায়ের আবদার করলো।হুটহাট রাতের বেলা চা খাওয়ার ভুত চাপে। মল্লিকা দ্রুত বানিয়ে হাজির করলো তার সামনে।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “কি কি করলি সারাদিন?”
হাতের চুড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে মল্লিকা বলে, “আমার আর কি কাজ!রান্না করি আর বাকি সময় মিষ্টিকে নিয়ে পাড় হয়।”
“তোর একা লাগে চন্দ্র?”
“না।উম! হ্যাঁ ”
“আমি না থাকলে একা লাগে?”
“সেটাতো স্বাভাবিক…”
সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে প্রকাশ করে না মেয়েটি।আর কত সময় দেবে?আর সেই বা কত সময় নেবে অধিকার খাটাতে।বিয়ের কম সময়তো হয়নি!
“চন্দ্র তুই আমাকে মেনে নিস নি তাই না?”
বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় মল্লিকা।বলে, “এভাবে বলছেন কেনো?এমন কিছুই না।”
“নিজেকে সচ্ছ কাচের মতন আমার সামনে তুলে ধর তাহলে।আমি যেনো তোর দিকে চেয়ে,তোর কথা শুনে তোর অন্তর অব্দি ঝাঁকতে পারি।”
মল্লিকা তুচ্ছ হাসে।সময় নিয়ে বলে উঠে, “আমাকে কখনো কেউ জড়তা কাটিয়ে তুলতে সাহায্যই করেনি।বয়সে আমি পঁচিশ বছরের একজন নারী।কিন্ত কি জানেন?আমি এখনও ওই গ্রামের কিশোরী মল্লিকাতেই পড়ে আছি।ছোটোবেলা থেকে মেয়ে বলে বেড়াজালে বেধে রাখা হয়েছিল।হুট করে যখন প্রেম জন্মায় তখন আবার হারিয়ে ফেলি।আবার যখন নতুন জীবন শুরু করলাম?সেখানে আমার মতামত প্রকাশের কোনো সুযোগই ছিলো না।আমার হৃদয়টা সর্বক্ষণ বদ্ধ ঘরেই আবদ্ধ রয়েছে মাহরুর ভাই ”
মল্লিকার হাত চেপে মাহরুর বললো, “আমি দিচ্ছি মতামত প্রকাশের সুযোগ।তোর জন্য সমস্ত দরজা খোলা।কি চাই তোর?কি ইচ্ছে? বল চন্দ্র!আমি সব পূরণ করে দিবো।”
“সবতো পূরণ করছেনই।”
“তাহলে কেনো জড়তা?”
“তোমার নতুন রূপ একটা ভ্রমজাল আমার কাছে মাহরুর ভাই। শ্বাস আটকে আসে।বারবার মিলিয়ে নেই তুমিই কি সেই মাহরুর ভাই?যাকে আমি ভালোবাসতাম?”
করুন চক্ষু চন্দ্রের দিকে ছুঁড়ে মাহরুর বললো, “বাসতি?এখন বাসিস না?”
“ভুল ভাবছো।আগের ভালোবাসা ভিন্ন ছিলো।এখন ভিন্ন।”
“ভালোবাসিস?”
“হুম”
সময় ব্যয় না করেই কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় মাহরুর।শক্তি সহকারে ঠোঁট চেপে রাখলো মল্লিকার কপালে।তাকে উল্টো ঘুরিয়ে বুকের সাথে পিঠ ঠেকায়।বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় এই পূর্ণিমা রাতে।ছাদের এক কিনারায় মাদুর পেতে বসে আছে তারা।পরিবেশ মনোরম। স্বেচ্ছায় মাহরুরের হাতের উপর হাত ছোঁয়ায় মল্লিকা।আবার দ্রুত গতিতে সরিয়েও নিলো।
বললো, “জানেন শশীরা নতুন বাড়ি কিনেছে।আমাকে দাওয়াত করে বললো এবার ঈদ গ্রামে ওদের বাড়িতে করতে।আপনি কি যাবেন?”
“তুই আবার ওই গ্রামে যেতে চাচ্ছিস?যেখানে তোকে এতকিছু সহ্য করতে হলো?”
“খারাপ কথা মনে রেখে কি করবো?সেখানে আমরা একটা ভালো সময়ও কাটিয়েছি।মনে পড়ে?”
মল্লিকার কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে মাহরুর চোখ বুজে। নিঃশ্বাস ফেলে।ঝড় নিঃশ্বাস।সবই মনে পরে তার।কি করে ওই মফস্বলে বাল্যকাল থেকে যৌবন পেরিয়েছে।মধ্যে এক ঝড় এসে লন্ডভন্ড করেছে।
মল্লিকা আবার ধীমা গলায় জানতে চায়, “যাবেন?আগের মতই সবাই মিলে ঈদ পালন করবো।”
মল্লিকার দেহের মেয়েলি ঘ্রাণে নিজেকে জড়িয়ে বললো, “হুম যাবো।তুই যেসব কাজে খুশি থাকবি সবটাই করবো”
“ছুটি পাবেন কতদিন?”
“পঁচিশ রোজা থেকে ছুটি শুরু। ঈদের পর এক সপ্তাহ।”
“আমরা তাহলে পরদিনই চলে যাবো গ্রামে। বুবু,দুলাভাই,সায়মন, সুমাইয়াকেও নিবো।”
দুজনার একান্ত সময় আছে।এক পুরুষ প্রাণের সমগ্র দায়িত্ব পালনে দিন কাটে। ‘দায়িত্ব’ শব্দের ভেজায় ভার।ইচ্ছে হয়না কখনোকখনো।ইচ্ছে করে সারাদিন নিজের দেহকে আরাম দিতে।সমস্ত রীতিনীতি ভেঙে মন ভ্রমরা যেই ইচ্ছে পোষণ করছে তাকেই প্রাধান্য দেক।হয়না।মানুষ মানুষের কাছে বাঁধা।হারে খাটুনির পর ফিরে এসে একটু দম নেয়। অপরপক্ষে আরেক নারীও বাধ্যতায় আবদ্ধ। চুলোচকি,সংসার সামলানো আর কারো অপেক্ষা ছাড়া আছেই কি?সবই সুখে থাকার জন্যে প্রতিনিয়তর লড়াই।এই রজনীর দমকা হাওয়ায় নিজেদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত সময়টাও বের করে নিতে হয়।
গল্প চলছে যুগলের। এরইমধ্যে বাচ্চা স্বরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে ঘর বেয়ে ছাদে। কন্ঠ পরিচিত। উদ্বেগ প্রতিক্রিয়ার তৈরি হয় মল্লিকা মাহরুরের মধ্যে।একলাফে একে অপরের উষ্ণতা ছাড়িয়ে বড়বড় কদম ফেলে ঘরের দিকে কদম তোলে।দুজনার গতিই চটপটে।কেনো কাদঁছে এই চিলেকোঠার আলো? উদ্বেজনে পরিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিত্ত। ক্রন্দনরত মিষ্টির গায়ে হাত পড়লেই বুঝা গেলো ভারী জ্বরে পুড়ছে সে।নিদারুণ ত্রাসে একে অপরের দিকে চাইছে।মিষ্টি ঘুমিয়েছে অনেক সময়।তখন এই তাপ ছিলো না। হঠাৎ কি করে জ্বর এলো?
মাহরুর তরহরি পায়ে জলপট্টি এনেছে। মল্লিকাকে দায়িত্ব দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে লাগলো ঔষধ। পেয়েছেও বটে।তবে লাভ কি?মিষ্টি ছোট সে পারবে না টেবলেট জাতীয় কিছু খেতে। মাথায় চিন্তার ভার হতে শুরু করলে মাহরুর বলে,
“আমি নিচে যাচ্ছি।দেখি কোনো ওষুধের দোকান খোলা আছে কিনা।মিষ্টিকে একা সামলাতে পারবি চন্দ্র?প্লিজ!আমি যেভাবেই হোক ঔষধ নিয়ে আসবো।”
অস্থিরতায় আবৃত মল্লিকা বললো, “অনেক রাত হয়েছে এখন ঔষধ পাবেন?”
মল্লিকার কথাও ঠিক।আসলেই অনেক রাত হয়েছে।এই এলাকায় রাত এগারোটার পর সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতাল এর দূরত্ব অনেক। মাহরুর হাল ছাড়লো না।বললো,
“পাবো।ফোন কাছে রাখ।আমি কল করলে দ্রুত ধরবি।”
মাহরুর ছুটে বাহিরে।মল্লিকা উচু গলায় বলতে লাগলো, “দেখে শুনে সাবধানে যাবেন।”
অন্যদিকে কুকিয়ে ওঠা মিষ্টির লালচে মুখ দেখে আহত হচ্ছে মল্লিকা বারবার।যেনতেন জ্বর নয়।ভারী জ্বর এসেছে।নরম হৃদয়ের মল্লিকার হৃদয় যেনো ধড়ফড় করা থামাচ্ছেই না।একদিকে তার কলিজার টুকরো মেয়ের জ্বর অন্যদিকে এতরাতে কোথায় ছুটলো মাহরুর?মেয়ের মাথায় গালে হাত বোলাতে বোলাতে দুআ পড়তে শুরু করলো।
পিনপিনে নিস্তব্ধতা সারা মহল্লা জুড়ে।কুকুরের দল আর ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়া আর কোনো মানুষের উপস্থিতি এখানে নেই।ভয়ানক নিশ্চুপ চারিপাশ।যতদূর চোখ যাচ্ছে মাহরুরের হেঁটে চলেছে।দ্রুত হাঁটার ফলে হৃদপিণ্ড তার উঠনামার গতি দ্বিগুণ করেছে।
আশার আলো বুঝি ফুটলো।হাটতে হাটতে কখন পুরোনো ফার্মেসি এর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নিজেও জানে না।বুকে নাম হাত ছেলে শ্বাস নিলো। ভেতরে ঢুকেই দোকানিকে বললো,
“আমার!আমার মেয়ের জ্বর।জ্বরের সিরাপ আছে না?আর থার্মোমিটার?”
দোকানী চোখ বড় করে তাকালো মাহরুরের দিকে।তার হাপানো দেখে দ্রুত এক বোতল পানি এগিয়ে তার সাথেই বললো, “আছে।বাচ্চার বয়স কত? সাড়ে পাঁচ অথবা পাঁচ বছর আট নয়মাস হবে।”
“কখন থেকে জ্বর?”
“ঘন্টাখানেক।হটাৎ জ্বর এসেছে তীব্র।ডাক্তার এর কাছে নিতে হবে ভাই?”
দোকানী বাচ্চাদের জ্বরের সিরাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই সিরাপ খাইয়ে দিন।যদি জ্বর না কমে কাল ডাক্তার দেখাবেন।আর হ্যা থার্মোমিটার দিচ্ছি।”
থার্মোমিটার দিতে দিতে দোকানি আবার বললেন পানি খেয়ে নিতে। চিন্তিত মাহরুরকে দেখে মায়া হয়েছে তার। মাহরুর টাকা মিটিয়ে বাড়ির দিকে এক প্রকার দৌড় লাগায়।না জানে বাচ্চাটি জ্বরে কত কষ্ট পাচ্ছে?
লোহার দরজা টপকে মাহরুর ঘরে আসে।মিষ্টিকে মল্লিকার কাছ থেকে নিয়ে বুকে জোরালো।বললো, “আম্মা?কি হয়েছে আমার মা’র?দেখি?”
মিষ্টি জেগে।ঠোঁট উল্টে মাহরুরের দিকে চেয়ে রইল।কি অদ্ভুত অনুভূতি!নিজের রক্তের বন্ধন নেই। অথচ লাল আভা ছড়ানো মুখটা মাহরুরের অন্তর বিক্ষত করছে।কোনো রকম ঔষধ খাইয়েছে মিষ্টিকে।মুখেই তুলতে চাচ্ছিলো না।অল্প সময়ের ব্যবধানে পানি খাওয়ালো।
মাহরুর প্রশ্ন তোলে মল্লিকার দিকে, “জ্বর এলো কি করে?”
“আমিতো জানি না।”
“আবহাওয়াও ঠিক আছে।এই সময় জ্বর আসার কথা নয়।”
মল্লিকা আমতা আমতা করে বলল, “আজ স্কুল ছুটির পর দুটো আইস্ক্রিম খেয়েছে।জেদ করে।হয়তো সেই জন্যে।”
“খেয়াল রাখবি না!বললেই দিয়ে দিলি?ঠান্ডাও আছে দেখছি।”
“ভুল হয়ে গেছে”
নির্ঘুম রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে।জ্বলজ্বল জ্বলছে দুই জোড়া চোখ।অনেক হাঁসফাঁস করে মিষ্টি ঘুমিয়ে পড়ে।ঘেমে পুরো শরীর ভিজে গেলো মিষ্টির।জ্বর ছেড়ে দিয়েছে।মল্লিকা ভেজা কাপড়ে শরীর মুছিয়ে বসে রইলো তার পাশেই।সকাল আটটায় মাহরুর মিষ্টিকে কোলে করে ডাক্তারের কাছে গেলো। কোনপ্রকার রিস্ক নেওয়া যাবেনা তার সাথে। ডাক্তারের চেকআপ শেষে ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফেরে। মল্লিকাকে মিষ্টিকে ঠিকঠাক দেখে রাখার বিশাল ভাষণ দিয়েছে সময় নিয়ে।
___
রমজান শুরু হতে মাত্র দুইদিন বাকি। মাহরুর আর রেদোয়ান জুম্মার নামাজ শেষে বাজারে এসেছে।অনেক কেনাকাটা।কি কি লাগবে সবটাই দুজনে লিস্ট করে এসেছে। দুর থেকে দেখলে দুজনকেই পাক্কা সাংসারিক পুরুষ বলে মনে হবে। তারা সাংসারিকও বটে।বাজার করতে করতে মাহরুর জানতে চায়,
“তোমার ঈদে ছুটি আছে রেদোয়ান?”
“আমাদের আর ছুটি!পুলিশের জীবনে এসব উৎসব আমেজ বলতে কিছু নেই।আছে শুধু ডিউটি।”
“না মল্লিকা বলছিলো গ্রামে ঈদ করবে এবার।ঐযে শওকত এর বোন আছে না?শশী? ওরা বাড়ি কিনেছে।আমাদের সবাইকে দাওয়াত করলো।”
রেদোয়ান বলে, “আমারও ইচ্ছা গ্রামে যাওয়ার অনেকদিন যাই না।”
“এবার চলো নাহয় ম্যানেজ করে।”
“চাঁদ রাতে ডিউটি শেষ আমার।ঈদের চতুর্থ দিন আবার ডিউটি।”
সব বাজার একটা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে মাহরুর টাকা পরিশোধ করে। মানিব্যাগ পাঞ্জাবির পকেটে রেখে বললো, “সমস্যা কি?ঈদের নামাজ পড়ে চলে আসবে।সবাই মিলে একসাথে একটা ঈদ করাই যায়।ঈদের দ্বিতীয়দিন নাহয় চলে গেলে।একদিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর ডিউটি।”
“আমি আজ গিয়ে শিরীনের সাথে কথা বলবো।”
“আচ্ছা।চলো মোল্লা হোটেলে গিয়ে হালকা নাস্তা করি।”
বাড়িতে শিরীন আছে।তাই কোনো চিন্তা নেই বাড়ি ফেরার তাড়াও নেই।হোটেলে চা নাস্তা অর্ডার করে একবার ফোন করে নিয়েছে মাহরুর।কিছু লাগবে কিনা জানতে।আর চার পাঁচটা সংসারের মতই এখন মাহরুরের সংসারও চলছে।আগের চেয়ে ভালো সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানীতে।
রেদোয়ান এর ফরহাদ এর কথা মনে পড়তেই বলে উঠলো, “ওই পলাতক অসভ্য ফরহাদকে ধরতে পারলাম না। হুটহাট মনে পড়লেই মেজাজ বিগড়ে যায়।”
মাহরুর হাসে।বলে, “বাদ দাও।এক না একদিন দেশে ফিরবে।তখন ধরবে”
“মাহরুর।শুনো জীবনে এগোতে হবে।আমি তোমাকে আমার ভাইয়ের মতন ভাবি।তাই এই উপদেশ দিচ্ছি। ব্যাংকে টাকা জমাও।একদিন বলেছিলে তোমার স্বপ্ন একটা নিজস্ব ঘরের।যেটা তোমার একান্ত হবে?এখন থেকেই সেই স্বপ্নের জন্য তোমার প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।তোমার ঘরে এখন কোনো কষ্ট নেই।সুখ এসেছে। মল্লিকার পদচারণ সত্যিই অনেক লাকি।”
মাহরুর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে টেবিলে রাখলো।বললো, “একবার আমিও ভেবেছিলাম।পড়ে ভাবলাম অতিরিক্ত লোভ করে ফেলছি নাতো?”
“কিসের লোভ?নিজের একটা ঘর হবে সেটা লোভ না মাহরুর।আজকাল হোম লোন দেয়।দেখো তোমার একটা ছোট্ট নীর হবে।তোমার,মল্লিকার আর মিষ্টির একান্ত।”
পরপর ঠোঁটে দুষ্টু হাসি চেপে রেদোয়ান আবার বলে, “ততদিনে যদি ঘরে আরো একজন অতিথি আসে?তাহলে কিন্তু মন্দ হয়না।”
লাজুক হেসে রেদোয়ানকে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “ফালতু কথা!”
“ওমা!কিসের ফালতু কথা?আমি চাই তোমার আর মল্লিকার একটা ছেলে হোক।পরিপূর্ণ পরিবার।”
নিজের হাসিকে সামলায় মাহরুর।মিথ্যে রাগ দেখিয়েও পারছে না।বললো, “এখন এইসব নিয়ে ভাবছি না রেদোয়ান।অনেক পথ বাকি।”
“দেরি করে ফেলো না আবার।”
“তুমি কিসব কথা নিয়ে বসলে রেদোয়ান বলোতো!আমি তোমার বউয়ের বড় ভাই হই ভুলে গেছো।”
“বড়ো ভাই বাড়িতে।বউয়ের সামনে। এখন আমরা দুজন দুজনের সমবয়সী।বন্ধু সুলভ।”
মাহরুর ঠোঁটে হাঁসি ঝুলিয়ে মাথা দোলায়।মনে মনে বলতে লাগে, “আমার বউ একটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে সারেন্ডার করেছে।এখন ধরা দিতে চায় না।নতুন অতিথি কি আকাশ থেকে পড়বে?”
রেদোয়ান খুক খুক কেশে ধ্যান ভাঙ্গে মাহরুরের।বলে, “কি ভাবছো ভাই?”
“না কিছু না।চলো বাড়ি যাবে না?তোমার বউতো নাহয় রেগে যাবে।”
উভয়ই বাড়ি ফিরেছে।বাজার আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে যারযার বাড়িতে পরিচিত লোক দিয়ে।এবার শিরীনদের ফেরার পালা।তারা চলে যাওয়ার পর মাহরুর মল্লিকাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।চুলোর পাড়ে বসে তার চন্দ্র। মাহরুরের পুরোনো বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।পড়ার চেষ্টা করছে।আশেপাশে কি হচ্ছে তাতে তার কোনো মনোযোগ নেই। ভাত বসিয়েছে চুলোয় হয়তো সেটাও ভুলে গেছে বইয়ের মধ্যে হারিয়ে।ভাতের ফেনা উত্রে পড়তে নিলে দৌড় লাগায় মাহরুর। চুলোর আচ কমিয়ে দেয়।এবার হুশ ফিরে মল্লিকার।
বলে, “খেয়াল ছিল না।”
“কি এমন পড়ছিলি বইয়ে?”
“না এমনেই দেখছিলাম।এত ভারী বই?এত কঠিন শব্দ কি করে পড়তেন আপনি?”
“এমনেই পড়তাম।”
“আমার দাত ভেঙে যাচ্ছে।”
মাহরুর কিছুক্ষন বিনা শব্দে দাড়িয়ে রইলো।কিছু একটা ভাবছে মনেমনে।মুখে ভাব দর্শন।ভাবনা শেষে মল্লিকার পাশে বসে সরাসরি বললো,
“চন্দ্র তুই পড়তে চাস? কলেজে ভর্তি হবি?”
চলবে…