চন্দ্র’মল্লিকা ২৩
লেখা : Azyah_সূচনা
আঁধার রজনীতে গলির মোড়ে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে এক পুরুষকে।চিৎকার যেনো না করতে পারে সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে।মুখ বেধে।এই নিয়ে দ্বিতীয়বার।যে পুরুষকে কেউ কোনোদিন ফুলের টোকা অব্দি দেয়নি সে পরপর দুবার হামলার শিকার হয়।ধস্তাধস্তিতে হাতে থাকা সবজিগুলো জমিনে গড়িয়ে পড়েছে।পায়ের চাপায় পৃষ্ট। ব্যথায় জর্জরিত পুরুষের নাক বেয়ে রক্ত ঝরলেই চুল টেনে ধরা হয়।
“আমার মাকে জেলে ভরার শাস্তি এটা।আগামীবার তুই আর তোর রক্ষিতা আমাদের বাড়ির দিকে তাকানোর আগে একশোবার ভাববি।”
মল্লিকার নামে বাজে কথা শুনে দুর্বল আঘাতপ্রাপ্ত হাত নিজে চড় বসায় ফরহাদের গালে।মুখের বাধন খুলে ফেলে একটানে।বলে,
“জানোয়ার এর বাচ্চা বউ আমার!মুখ সামলে কথা বলবি”
আরো চটে গেলো ফরহাদ।কয়েক কিল ঘুষিতে নিজের অপমানবোধটাকে মিটিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরে চলে গেলো।সামনেই কেউ আসছে টর্চ লাইট নিয়ে।দ্রুত পালায় ফরহাদ আর বাকিরা।ঢাকা শহরে এই গলিতে এতবড় ঘটনা ঘটলো তবে কেউ টেরই পেলো না?রহিম চাচাকে আসতে দেখে উঠে দাড়ায় মাহরুর।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।শরীর পুরো জ্বালাপোড়া করছে।রহিম মিয়া লাইট মাহরুরের মুখের দিকে ধরতেই আতকে উঠেন। দ্রুত গতিতে নিজের দুর্বল বাহু এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেন মাহরুরকে।
“ইয়া আল্লাহ!তোমারে এমনে মারলো কে মাহরুর।”
মাহরুরের চোখ জমিনে পড়ে থাকা বাজারের দিকে।ব্যথাটা গায়ে লাগছে না।কিন্তু সেগুলো দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।রহিম মিয়া বললেন,
“ওদিকে তাকায় কি দেখো?”
“বাজারগুলো চাচা।”
“তোমার এই অবস্থা তুমি বাজারের চিন্তা করো?মাথা খারাপ!”
“টাকা দিয়ে কিনেছি চাচা।”
“তুমি বাদ দাওতো।চলো বাড়ি চলো!”
রহিম মিয়া আর তাদের বাড়িতে কাজ করে সেই ছেলেটা মাহরুরকে বাড়ি এনেছে।যতক্ষণ যাবৎ মাহরুরের ব্যথাকাতর মুখ দেখছে ততক্ষন যাবৎ অস্রু জড়াচ্ছে মল্লিকা।মায়ের কান্না দেখে মিষ্টিও কান্নায় জর্জরিত। হাতে পায়ে মুখে ব্যান্ডেজ করতে লাগলো মল্লিকা।কান্না তার কিছুতেই থামছে না।
রহিম মিয়ার স্ত্রী এগিয়ে এসে বললেন,
“এই বউ তোমার মাইয়া ডরাইতাছে।ওরে দাও আমার ধারে”
মিষ্টি বলে উঠে, “আমি যাবো না।”
“আয় বেটি।দাদী লাগি তোর।মজা খাওয়ামু।আয়”
মল্লিকা নাক টানতে টানতে মিষ্টির উদ্দেশ্যে বললো, “যা দাদীর সাথে।”
মিষ্টি অনিচ্ছা সত্বেও চলে গেলো জোবেদা খাতুন এর সাথে।রহিম মিয়াও সরে গেলেন সেখান থেকে।সবার চলে যাওয়া নিশ্চিত করে মাহরুর বলে,
“এই”
উত্তর দিলো না মল্লিকা। ঠোঁট কাপছে।কি বাজেভাবে মেরেছে লোকটাকে।জায়গায় জায়গায় আঁচড়ের দাগ। মাহরুর দুহাত দিয়ে মল্লিকার গাল মুছে দিলো।বললো,
“কাঁদিস না চন্দ্র।আমি ঠিক আছি।”
“কি ঠিক আছেন দেখতেই পাচ্ছি।চোখের সামনেই আছেন।”
রাগ মিশ্রিত গলায় বলেছে মল্লিকা।বিয়ের পর প্রথম যত্নে মোড়ানো রাগ দেখে ভীষণ আনন্দও হলো বটে।লজ্জা নারীর ভূষণ।পাশাপাশি রাগ স্ত্রীর অধিকার।
মাহরুর হেসে উত্তর দেয়, “তোর আমার প্রেমটা আগের দিনের সিনেমার মতন।একবার তুই আমার জন্য চাচীর হাতে মার খেয়েছিস।তোর জন্য আমি ওই রাব্বী মিয়ার লোকের কাছে মার খেয়েছি।এখন আবার মার খেলাম তোর প্রাক্তন দেবরের কাছে। মারামারিময় প্রেম।”
মাহরুরের শেষ বাক্যে হেসে ফেলে মল্লিকা। পরক্ষনেই আবার বিষাদের ছায়া নেমে এলো মুখে। সত্যিই তার জন্য মার খেয়েছে।
চোয়াল শক্ত করে মল্লিকা বললো, “আপনি দুলাভাইকে কল করেন।বলেন সবকিছু।বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে এবার।আগে মায়া হতো এখন একদম মায়া হচ্ছে না।”
“আমার জন্য মায়া হচ্ছে?”
ঠোঁট উল্টে রইলো মল্লিকা। মাহরুর তার বাহুতে হালকা চাপড় মেরে আবার জানতে চেয়ে বললো, “বল ”
“আপনি জানেন না বুঝি?”
“না জানি না।”
“হচ্ছে মাহরুর ভাই”
কি হৃদয় শীতল করা ডাক! এতবছর পর ডাকটা শুনে মন বাগবাগ হয়ে উঠছে।তবে ঠিক এই অনুভূতির ভিন্ন কাজ করে বসে মাহরুর। গালেও ছোট্ট করে চড় দিয়ে বসলো।
মল্লিকা গালে হাত রেখে বলে, “মারলেন কেনো?….আজতো পুরো নামে ডেকেছি।”
“আবার বল”
“মাহরুর ভাই”
এবার চড় পড়ে ঠিক বিপরীতগালে।চোখ বড়বড় করে তাকালো মল্লিকা। আঘাতপ্রাপ্ত মাহরুরের সামনে যেনো বাঘিনী হয়ে উঠেছে।
মাহরুর বলে, “চোখ নামা।”
চোখ নামায় মল্লিকা।তার ইচ্ছে পূরণ করলেও দোষ!কি করবে সে তাহলে? মাহরুর বললো,
“ভাই ডাক বাদ দিবি।নাহয় মাথা ফাটিয়ে ফেলবো।আদর করে মাহরুর ডাকবি।সেই ডাকে যেনো মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় আমার।”
আজ চাঁদ কোথায়?আকাশে দেখা মিলছে না।হয়তো নিজের স্থান পরিবর্তন করেছে।নাহয় মাহরুরের চিলেকোঠায় এই দৃশ্য দুষ্কর।চন্দ্রমল্লিকা নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে মাহরুরকে। রেদোয়ানকে কল করেছে।কল করে বলেছে ফরহাদ এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।মল্লিকার এ রূপ বারবার থমকে দিচ্ছে মাহরুরকে। শিরীনও রাতেই এসে হাজির। সংবাদ পৌঁছেছে তার কাছেও ঝড়ের গতিতে।
বারবার বলছে রেদোয়ানকে, “আমার ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়েছে।ওকে একদম ছাড় দিবে না।কি অবস্থা করে ফেলেছে আমার ভাইয়ের।”
বোনের দিকে চেয়ে মাহরুর ভাবলো। পৃথিবী মানুষে পরিপূর্ণ।কেউ শত্রু,কেউ মিত্র।কেউ আপন কেউ পর। আপনের মধ্যেও ভেদাভেদ দেখা যায়। ব্যক্তিগত ভেদাভেদ।কেউ জীবনকে একদম নিঃস্ব করে দেয় কেউ পূনরায় গড়ে দেয়। মাহরুরের জীবন ধ্বংসকারীও আছে।আবার হাত এগিয়ে জমিনে পড়ে থাকা মাহরুরকে তোলার মানুষও আছে।দিনশেষে সস্তি। শত্রুর ভয়ে গা ঢাকা না দিয়েই কাছের মানুষের সাথে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করার সস্তি।
__
আজ রমজান চাচা আর ফরিদা চাচী আসবে।এই সংবাদটা মাহরুর দিয়েছে মল্লিকাকে।খুশিতে আত্মহারা সে। সংসারের একমাস পর বাবা মায়ের দেখা পাবে।এই ভেবেই দিশে হারা দে।শওকত ঢাকা আসছে কাজে।তাদের সাথেই তারা দুজনও আসবে।খুশির সংবাদেও খুশি হতে পারছে না মাহরুর।কি জবাব দেবে তাদের?মেয়ে আর নাতনিকে এই ছোট্ট চিলেকোঠায় রাখে?তাদের থাকার ব্যবস্থা করবে কোথায়? মাথাটা ঘুরে উঠলো।মল্লিকার মুখের হাসি দেখে আর কিছু বললো না মাহরুর।নিজের চিন্তা নিজের মাথায়ই রেখেছে।মিষ্টিকে স্কুলে দিয়ে আসে।আসার পথে মল্লিকা আনে। ফরহাদ পুলিশের ভয়ে পরদিন রাতেই দুবাই পালিয়েছে।মা আর বউকে ফেলে।নিজের জানের ভয়ে এবার মা বউয়ের ভয়টাও করেনি। খুব এসেছিল মায়ের হয়ে মাহরুরের গায়ে হাত তুলতে।
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।আমাকে যেই হালেই রেখেছেন আপনি আমার বিগত জীবনের চেয়ে হাজারগুণ ভালো।এটা আব্বা আম্মাও বুঝবে।”
পরনের শার্টটা অর্ধ খুলে হাত থেমে যায় মাহরুরের।দেয়ালের দিকে মুখ করেই এদিক ওদিক চায়।তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছে মল্লিকা।পূনরায় শার্ট গায়ে দিয়ে ফিরে তাকালো।
বললো, “তুই কি করে বুঝলি আমি চিন্তা করছি?”
“আপনার কপালের ভাজ রেখে।চিন্তার রেখা।”
মৃদু শব্দ করে হাসে মাহরুর।অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো, “চন্দ্র? তোর মাথায় এত বুদ্ধি উদয় হলো কি করে?আমার মুখ দেখে বুঝে ফেললি?তোকে আমি বোকা ভাবতাম চন্দ্র।”
মল্লিকা জানে তাকে হেয়ালি করে বলছে মাহরুর এসব।তার কি মাথায় একদমই বুদ্ধি নেই নাকি?শুধু মাহরুরের সামনে বোকা বনে যায় বলে সে বুদ্ধিহীন?যথেষ্ট বুঝশক্তি আছে তার।মনে মনে এসব ভেঙে আহত দৃষ্টিতে তাকায় মল্লিকা।
“আজকাল চোখ বড়বড় করে চেয়ে থাকিস?কি সমস্যা কি?আমি দেখতে বেশি সুন্দর হয়ে গেছি?নাকি আগের প্রেম জাগছে মনে আবার?”
” তেমন কিছুই না”
“তাহলে বলতে চাচ্ছিস আমি সুদর্শন নই?”
হতবুদ্ধি হয়ে মল্লিকা বলে, “আমিতো সেটা বলিনি।”
ঝড় নিঃশ্বাস ফেলে মল্লিকা।কোনো কথা না বলে স্থান ত্যাগ করলো।কাজ করছে আর ঘণ্টা গুনছে।কখন আসবে তারা?এতবছর নিষ্ঠুর হয়ে বাবা মার কাছে যায়নি।যেই ছোঁয়া লাগলো মাহরুরের নিষ্ঠুরতা নিঃশেষ।এখন বাবা মার দিকেও মন টানে।
দরজা দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে এসে শিরীন বললো, “আমার চাচা চাচী আমার বাড়িতে থাকবে।যদি কেউ আটকায় আমি দেখে নিবো বলে দিলাম।আম্মা মারা যাওয়ার পর তাদের এত বছর পর দেখবো।এই অধিকার যেনো ছিন্ন না করা হয়।”
ঘরে ঢুকতে দেরি!নিঃশ্বাসটা অব্দি ছাড়েনি ভালো মতন।এসেছে জানান দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।তার আগেই হুকুম চালিয়ে দিল শিরীন।সে আসবে কেউ জানত না।দেখে অনেকটা অবাক হয়।
মাহরুর শিরীনের চুলে হালকা টান দিয়ে বললো, “আসবি জানিয়ে আসবি না?”
“কেনো?আমার ভাইয়ের বাড়িতে যখন ইচ্ছে তখন আসবো।”
“তোর নিজের ঘর সংসার নাই?”
“একা সংসার।স্বামী এই থাকে এই থাকেনা।তাই ডিঙি মারতে এসে পড়ি তোমার ঘরে।কেনো আমাকে ভালো লাগছে না বউ পেয়ে?”
“শুধু আজাইরা কথা। বোস ”
তাদের খুনসুটির মধ্যে ফোন বাজে মাহরুরের।অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। মাহরুর রিসিভ করে সালাম জানায়।বেশ কিছুক্ষন মুখের ভাবভঙ্গি বদলে বদলে কথা বললো।শেষ অংশে এসে মুখে হাসি ফুটে।হাসিমাখা মুখ দিয়ে মল্লিকা আর শিরীনের দিকে চায়।তারাও আগ্রহী জানতে কি তার খুশির কারণ?বিনয়ের সাথে কথা বলে ফোন রাখলো।
শিরীন আর মল্লিকার দিকে চেয়ে বলল, “মনে আছে সিভি জমা দিয়েছিলাম?ওর মধ্যে একটা কোম্পানি ডেকেছে আমায়। পরশুদিন আমার ইন্টারভিউ”
মাহরুরের একক খুশি ছড়িয়ে পড়ে শিরীন আর মল্লিকার মাঝেও।শিরীন বললো, “আলহামদুলিল্লাহ।”
মাহরুর বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।বলে, “শুধু দুআ কর”
অন্যদিকে মল্লিকা বলে উঠে, “হয়ে যাবে চাকরিটা।আপনি চিন্তা করবেন না”
মাহরুর মনে মনে বিড়বিড় করে, “আমার চন্দ্রমল্লিকা যেহেতু বলেছে আমার চাকরিটা হবেই।”
রমজান সাহেব,ফরিদা বেগম আর শওকত এসে হাজির।মেয়ের আগে ভাতিজিকে জড়িয়ে ধরলো।অনেকটা বছর।অনেক বছর এই মেয়ের দেখা মেলে না।হিংসে হলো মল্লিকার।
আজ গলা বাড়িয়ে বললো, “আমিও এখানে আছি কিন্তু”
হাসির রোল পড়ে গেলো ঘরে।এত বড় মেয়ে হিংসেতে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।মল্লিকার ভাগের আদর তাকে দিয়ে সবাই বসেছে।কেউ বিছানায় কেউ মাটিতে। শওকতকেও না খাইয়ে ছাড়বে না।মল্লিকা নিজ হাতে বাবা মায়ের জন্য মাছের ঝোল করেছে সাথে নানান রকমের ভর্তা।
চিলেকোঠার ছাদে দাঁড়িয়ে মাহরুর আর শওকত।শওকত বললো,
“কেমন আছো এখন মাহি? সুখীতো?”
“ভীষণ সুখে আছি।”
“আমার মাতো আসতে চাইছে বারবার।সাথে শশীও।”
“তো আনবে সমস্যা কোথায়?”
“আনবো সময় করে একদিন।তোমরা গ্রামে যাবে না আর?”
“যাবো।কিন্তু চাচা চাচীকে একা রাখতে চাচ্ছি না। এখানেই রাখার ব্যবস্থা করবো।”
“তোমার যা ভালো মনে হয় করো।এমনেতেই চাচা চাচীর বয়স হচ্ছে।”
“সেটাই।”
নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শেষে দুজনেই ঘরে এগোয়।রমজান সাহেব পুরো ঘরটাকে এদিক ওদিক চেয়ে দেখছেন।যা মাহরুরের দৃষ্টি গোচর হয়েছে।হয়তো তার ঘর পছন্দ হয়নি।কোনো বাবাই মেয়েকে এই অবস্থায় দেখতে চায়না।সবার সামনেই মাহরুর রমজান মিয়ার উদ্দেশে আলগোছে বলে উঠে,
“নতুন চাকরি পেলেই এই ঘরটা ছেড়ে দিবো চাচা।”
হঠাৎ মাহরুরের এহেন কথায় অবাক হলেন রমজান সাহেব।জানতে চাইলেন, “হটাৎ এমন কথা বলছিস কেনো বাজান?”
মাহরুর অপরাধীর মতন মাথা নুয়ে ফেলে।বলে, “ঘরটা ছোট আমি জানি।”
“তো কি হয়েছে?ছোট ঘরে শান্তি থাকলেই চলে।অন্তত বড় ঘরে অত্যাচারিত হওয়ার চেয়েতো লাখ গুন ভালো”
ফরিদা বেগম বললেন, “ওই জাহিলগুলা তোরে কি বাজেভাবে মারলো!কল্পনাও করতে পারছি না এমন এক সংসারে মেয়ে দিছিলাম।”
“বাদ দেন চাচী।ওর শাস্তিও ও পাবে!শুধু সময়ের অপেক্ষা।” মাহরুর বলে।
__
আজ হঠাৎ মাহরুরকে দারুন রকমের ভয় পেতে দেখা গেলো।দেখে মনে হচ্ছে কোনো বাচ্চা স্কুলে প্রথমবার পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে।ভয়ে হাতপা আসাঢ় হয়ে আসছে তার।মল্লিকা শান্তনা দেওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। চাকরিটা সে চায়। ভীষন রকমভাবে চায়।ভালো পোস্টের চাকরি।বেতনও ভালো।দু চোখের মধ্যবর্তী স্থানে আঙ্গুল চেপে বসে রইলো থম মেরে কিছুক্ষন।তাকে আর কে সামলাবে?মল্লিকা ছাড়া তার কোনো আশ্রয় আছে?
মল্লিকা পাশে এসে বললো, “সব ঠিক হবে”
মাহরুর আকষ্মিক মল্লিকার হাতদুটো ধরে বললো, “সত্যিই হবেতো চন্দ্র?আমার কিছুই নেই তোরা ছাড়া।তোদের ভালো রাখার জন্য আমার যত পরিশ্রম।”
“আপনি চাকরি না পেলেও আমরা ভালোই থাকবো।”
“এভাবে বলিস না।আমার দরকার চাকরিটা।তোর, মিষ্টির,চাচা চাচীর সব দায়িত্ব পালনের জন্য আমার দরকার।”
কাপা কাপা হাতটা মাহরুরের গালে ছোঁয়ায়। তৎক্ষনাৎ সরিয়েও নিলো।কি না কি ভাবে সে? মাহরুর আবার হাত টেনে নিজের গালে রাখলো।বললো,
“হাত সরাস কেনো? বল কি বলবি?”
“চিন্তাটা বাদ দিন।যা হবে ভালো হবে।”
মল্লিকার গাল টেনে দিয়ে গেলো।ভালোবাসার দু চারটে বাক্য আওড়িয়ে গেছে।বারবার বলে যাচ্ছে দুআ করতে। মল্লিকাও অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পড়ে।তাকে দেখে উৎসাহিত মিষ্টিও।জানতে চাইলে মল্লিকা তাকে জানায় তার বাবা পরীক্ষা দিতে গিয়েছে।তারা যেনো দুআ করে। মিষ্টিও মায়ের ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে ছোট্ট হাতে দুআ করতে শুরু করলো।মল্লিকার মন শান্ত হয়।অন্তত এই বাচ্চা হাতের প্রার্থনা কবুল হবে।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।মল্লিকা কখনো ছাদে কখনো দরজার কাছে।একটু পরই আযান হবে মাগরিবের।এখনও আসছে না কেনো মাহরুর।মিষ্টিকে টিভি অন করে বসিয়ে দিয়েছে।নাহয় প্রশ্ন করে করে টেনশন আরো বাড়িয়ে তুলবে।শেষ মুহূর্তে চাঁদের উপর দাড়িয়ে মাহরুরকে আসতে দেখে মৃদু ছটফট করে উঠে। দৌড়ে যায় দরজায়।খুলে দেয় লোহার তৈরি গেটটা। মাহরুর এসেছে বিদ্ধস্ত মুখে।মল্লিকা মুখ পড়ার চেষ্টা করলো। চাকরিটা কি হয়েছে?জানতে চাইবে?যদি না হয়? নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে মাহরুর।
মাহরুর এসেই জমিনে ব্যাগটা ফেলে দিলো। কোমড় জড়িয়ে মল্লিকাকে শূন্যে তুলেছে।নিজেকে পা দুটো হাওয়ায় ভাসতে দেখে মল্লিকা দ্রুত হাত ঠেকায় মাহরুরের কাধে।পড়ে গেলে মাজা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। মাহরুর মুখ তুলে চেয়ে আছে মল্লিকার দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে।
মল্লিকা কিছু বলতে যাবে তখনই তাকে নামিয়ে দেয়।বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে বললো, “ভালোবাসি”
মাহরুরের মতিগতি বুঝে উঠতে পারছে না।এই মুহূর্তে বলছে ভালোবাসে?এই কথাকে পাশে রেখে মল্লিকা আমতা আমতা করে জানতে চাইলো, “চাকরিটা কি…”
মল্লিকার চুলে মুখ ডুবিয়ে ভারী কণ্ঠে বললো, “হয়েছে!বেতন জানিস কত? পঞ্চাশ হাজার।খুব ভালো পদ।তোর দুআ বৃথা যায়নি চন্দ্র।ধন্যবাদ তোকে”
মল্লিকা ভীষণ খুশি।গাল বেয়ে অস্রু ঝরলো।এতখন ভেতরে চেপে রাখা চিন্তারা হুড়মুড়িয়ে পালিয়েছে। আকষ্মিক মাহরুরের চুল খামচে ধরলো সেও।
বললো, “তোমার মেয়ের দুআ মাহরুর ভাই।তাকে ধন্যবাদ দিও”
চাকরি পাওয়ার প্রশান্তির চেয়ে মল্লিকার মুখে তার পূর্বের ডাক ফিরে পাওয়ার আনন্দ বেশি মনে হলো।জয়ী মনে হচ্ছে নিজেকে।একে অপরের উষ্ণতা ছেড়ে মিষ্টির কাছে ছুটে গেছে মাহরুর। দ্রুত গিয়ে কোলে বসিয়ে নেয়।
আদুরে কণ্ঠে বলে, “আমার আম্মা আমার জন্য দুআ করেছে?”
“হ্যা।তোমার পরীক্ষা পাস হয়েছে?”
“আল্লাহ তোমার দুআ ফিরিয়ে দিতে পারে?পাস হয়েছে মানে?একদম ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি।”
“ইয়ে!”
“তোর জন্য কি এনেছি জানিস?”
“কি?”
মাহরুর মল্লিকাকে বললো দরজার কাছ থেকে তার ব্যাগটা নিয়ে আসতে।আনন্দে ব্যাগটা সেখানেই ফেলে এসেছে। মল্লিকাও দ্রুত গিয়ে নিয়ে আসলো।একটা গোলাপী রঙের ছোট্ট পুতুল বের করে মিষ্টির হাতে দিয়ে বলল,
“এটা তোর।আর সামনের মাসে তোকে নিয়ে মার্কেটে যাবো।তুই যেটা কিনতে চাইবি সব তোর।”
“মাহি বাবা আমি একটা বড় পুতুল কিনবো,একটা পেন্সিল বক্স কার্টুন ওয়ালা আর একটা পরী ড্রেস সাদা রঙের।আরো অনেক কিছু কিনবো।”
“তোর যা ইচ্ছা সব কিনিস মা”
বাবা মেয়েকে ফেলে মল্লিকা শিরীনকে কল করে।জানান দেয় তার ভাইয়ের চাকরির কথা।সে একবিন্দু সেখানে থাকতে রাজি নয়।মল্লিকার বাবা মাকে নিয়ে এখনই ছুটে আসছে বললো।রমজান সাহেব আসার পথে মিষ্টি এনেছেন।সবাইকে মিষ্টি মুখ করিয়ে শিরীন বুদ্ধি দিল আজ তারা সবাই এখানে থাকবে।চিলেকোঠার ছাদে বিছানা পেতে ঘুমাবে। রেদোয়ানও আসছে।পুরোনো দিনে কারেন্ট চলে গেলে যেমন উঠোনে আসর বসতো আজ আসর বসবে ছাদে।সব আয়োজন একাই করে নিলো শিরীন। রেদোয়ানকেও বাকি কাজ বুঝিয়ে সবাই একে একে এসে বসলো খোলা আকাশের নিচে।যেথায় জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্ররা।একটা বিশাল চাঁদ।আর ঘর ভরা আনন্দ।কোমড় ধরে দাড়িয়ে সবাইকে হাসিখুশিতে মেতে থাকতে দেখে ভাবলো।
“একেই হয়তো বলে সুখী-সুন্দর পরিবার।”
চলবে…
চন্দ্র’মল্লিকা ২৪
লেখা : Azyah_সূচনা
সকাল বেলায় তিন নারী নাস্তার ব্যবস্থা করছে।খুদের ভাত করবে আজ। বুদ্ধিটা শিরীনের।বাচ্চাদের বাবারা হাতের বাবার কাছে হাত মুখ ধুয়ে নিয়েছে।শওকত আজ গ্রামে ফিরে যাবে।সাথে রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগমও। মাহরুরও মেনে নেয়। চাকরিটা একটু সামলে নেক তারপর নিয়ে আসবে তাদের।নতুন ঘর দেখবে।এখন এত বিলাসিতা করা ঠিক হবে না।খুদের ভাত আর ভর্তা তৈরি করেই খোলা আকাশে রোদের উষ্ণতায় সকলে বসেছে। পাটি পিছিয়ে।জমিনে পা মুড়িয়ে বসেই উপভোগ করবে গরম গরম সকালের ভোজন।
ফরিদা বেগম এগিয়ে আসলেন বিদায় বেলায়।মেয়ের হাতে তিন চারটে শাড়ি দিয়ে বললেন, “আমি জানি তুই মন দিয়ে সংসার করবি।কিন্তু এই সংসারটা একটু অন্য রকম হবে।তারপরও মাহি এমন সময় এসে তোর হাত ধরেছে যখন তুই সর্বহারা ছিলি।ওর কথা মানবি।আদেশ পালন করবি।”
রমজান মিয়াও আরো কয়েক বাক্য বাড়িয়ে বললেন, “মাহি কিন্তু আমার ভাতিজা না আমার ছেলের মতন। ও একটা দায়িত্বশীল ছেলে।আমি চাই তোরা তিনজন ভালো থাক সুখে থাক।ভালো থাকিস মা।নিজের,মাহির আর মিষ্টির যত্ন নিস।আসি।”
কেদে কেটে বিদায় দিলো মল্লিকা বাবা মাকে। অদ্ভূত মিষ্টি আর তার বন্ধনও।মাকে কাদতে দেখলে সে নিজেও কাঁদে।জানতে চায় না কান্নার কারণ।বুঝে না।শুধু এতটুক জানে কান্না মানুষ এর কষ্ট থেকে আসে।নানা,নানি চলে যাচ্ছে তাই বুঝি মা কাদঁছে।সেও বুক ভাসায় কেঁদে।
রমজান সাহেব আর ফরিদা বেগমকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে এসেছে মাহরুর।মিষ্টিকে তৈরি করে স্কুলের পথে ছুটলো।মেয়েটা সাহসী হয়েছে আজকাল।স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারাও বেশ যত্নবান।প্রত্যেকটা বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখে।সকাল দশটায় দিয়ে আসে গিয়ে।আজ বের হতে দেরি হয়ে গেছে।ফিরে এসেই দেখলো ভিন্ন চিত্র।মল্লিকা শাড়ি পড়েছে। গামছায় মোড়ানো চুলগুলো।সদ্য গোসল করে বের হয়ে কাপড় মেলছে দড়িতে।উল্টো ঘুরে থাকায় পিঠের কিছু অংশ দৃশ্যমান।এরূপ দৃশ্যে কোনো প্রেমিক পুরুষ নিজেকে ঠিক রাখতে পারে?একহাতে দড়িতে ঝোলানো কাপড় সরিয়ে এগিয়ে গেলো।প্রেমটা আবার মাথায় চড়ছে।এই মেয়ে তাকে এক মুহুর্ত সস্তি দিবে না। ঘায়েল করবে নানানভাবে।এই অহেতুক সকাল সকাল ঘায়েল করার শাস্তি দিতেই এগিয়ে গেলো মাহরুর।
পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে হুট করে হেঁচকি তুলে মল্লিকা। ভয় পাইয়ে দিয়েছে তাকে। মাহরুর বললো, “হঠাৎ নতুন রূপে সামনে এলি কেন?আমাকে মেরে ফেলার ধান্দায় আছিস?”
মল্লিকা আশপাশের বিল্ডিংগুলোতে তাকাচ্ছে।কেউ যদি তাদের দিনের আলোয় এভাবে দেখে ফেলে?ভীষণ লজ্জার বিষয়। মাহরুরের বাধন থেকে ছাড়া পাওয়ার প্রয়াস করতে করতে বলল, “আপনিইতো বলেছেন শাড়ি পড়তে”
“উম! হ্যা।ভুলে গিয়েছিলাম।”
“এখন ছাড়েন কেউ দেখে ফেলবে”
“তো?দেখুক!”
“আপনি বুঝতে পারছেন না।”
“আমি সব বুঝতে পারছি চন্দ্র।তোর সান্নিধ্য ছাড়া আমার টিকে থাকা মুশকিল।আমাকে এত টানিস কেনো নিজের দিকে?কি আছে তোর মধ্যে বল আমায় আজ!”
মল্লিকা মিনমিনে গলায় বললো, “আমি কি করলাম?আপনি…”
“শোন!আগামী ছয়দিনের জন্য তোর কাছে আছি।সারাদিন,সারারাত!কিভাবে খাতিদারি করবি করে নে।এরপর নতুন চাকরিতে যাওয়া লাগবে।প্রতিদিন কত ঘণ্টার দূরত্ব মেনে নিতে হবে জানিস?নিজের জড়তা কাটিয়ে এখনই ভালোবেসে পুষিয়ে দে”
হাত টেনে ধরে এনেছে।ঘরে অতশত কাজ ফেলে রেখে মাহরুরের শখ চড়েছে চন্দ্রবিলাসের। মল্লিকাকে মূর্তির মতন বসিয়ে রেখে কোলে মাথা পাতে আবারো।আদেশ ছুঁড়ে কঠোরভাবে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে হবে।যতক্ষণ মাহরুরের ইচ্ছা ততক্ষন।মল্লিকা বাধ্য,বাঁধা তার হাতে। অতিরিক্ত ভালোবাসা সামলে উঠতে পারছে না। পারবেই বা কি করে?কখনো ছিলো ভাগ্যে এমন ভালোবাসা? সবইতো নতুন তার জন্য।
“আমাকে এত ভালোবাসলেন কিভাবে?”
“এভাবেই ”
“প্রথমবারে ভালোবাসলে কি হতো?আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে কষ্ট দিয়েছেন একবার।অন্যকারো সাথে ঘর বেঁধেছেন।এখন আবার এমন আচরণ করছেন?”
“তুই বাধিস নি?সম্পূর্ণ সত্যটা না জেনেই ঢেং ঢেং করে অন্যকে বিয়ে করে নিলি।এখন সহ্য কর আমার অত্যাচার।”
“অত্যাচার করবেন আমাকে?”
“যুগে যুগে পুরুষেরা নারীদের উপর অত্যাচার চালিয়ে এসেছে।আমি কেনো পিছিয়ে থাকবো।আমিও করবো অত্যাচার।”
“আগে যা করেছেন সেগুলো কি যথেষ্ট নয়?”
“পুষিয়ে দিতে চাচ্ছি”
“মানে?”
“ভালোবেসে,আদর করে।এগুলো তোর কাছে কোনো অত্যাচারের থেকে কম মনে হবে না”
ভালোবাসা আর অত্যাচার দুটো একসাথে?থাক!আর কথা বাড়াবে না মল্লিকা। মাহরুর লাগামহীন।সেটা হারেহারে টের পাচ্ছে মল্লিকা।হুটহাট কাছে এসে তার মস্তিষ্ক অচল করতে সক্ষম। সেওতো প্রেমে পড়েছিল মাহরুরের।প্রেমিক হিসেবে চন্দ্রের মাহরুর ভাই কি রকম সেটা ভাবতেও পারেনি।আজ যখন চোখের কাছে বিশ্বাস হচ্ছে না।মিলিয়ে নিচ্ছে পুরোনো মাহরুরের সাথে।
আধ ঘণ্টায় মাহরুর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।এই সুযোগ!পালাবার। আস্তে ধীরে হাতটা মাহরুরের মাথার নিচে রেখে নামিয়ে নিলো। সাবধানতার সাথে বালিশ রেখেছে মাথার নিচে।উঠে যাওয়ার চিন্তাটা এক মিলি সেকেন্ডে ভেস্তে যায়।ঘুমের অভিনয় করে থাকা মাহরুরের জ্বলজ্বল করা চোখ দেখে শুকনো ঢোক গিলে মল্লিকা।
“পালাস কেনো তুই? বেঁধে ফেলেছি একেবারের জন্য ভুলে গেছিস?”
হেঁচকা টানে নিজের কাছাকাছি এনে হাজির করলো।মল্লিকার মাথা বালিশে ঠেকিয়ে ঘাড়ে মুখ গুজে শুয়ে পড়লো মাহরুরও। আত্মা উড়ে গেছে মল্লিকার।এত ভারী একটা মানুষ দেহের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে আছে তার উপর। হৃদয় মনে হয় এই ভারেই বিস্ফোরিত হবে। হাড়গোড় সব ভেঙে চুরমার।মাথা কাজ কথা বন্ধ করে দিল।
মাহরুর মুখ তুলে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো, “খাওয়া দাওয়া করিস না ঠিকমতো?এই অবস্থা কেনো তোর?হাড্ডি আর হাড্ডি!”
মল্লিকা ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে ফিরে রইলো।একদম কথা বলবে না আধ পাগল উন্মাদ লোকের সাথে। হুটহাট উদ্ভট কান্ড ঘটায়।পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে মাহরুর আবারো একই ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে
বলে,
“হোক হাড্ডি আমার কি।আমার আত্মিক প্রশান্তি দরকার।সেটা এখানে পাচ্ছি।নড়চড় করলে শাস্তি দ্বিগুণ করবো চন্দ্র।এমনেতেই বিনা অনুমতিতে পালানোর চেষ্টা করেছিস।আমাকে রাগাস না বলে দিলাম।নাহয় এমনকিছু করবো যেটা সহ্য করতে পারবি না।”
উপায় বাকী রাখে? মুখের শব্দ, বাক্যতো কেড়ে নেয়ই।এখন নড়চড় এর উপরও কারফিউ জারি করেছে।এখন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ারও কায়দা নেই। নির্ঘাত চ্যাপটা হয়ে যাবে।
___
চোখের পলকে ছয়দিন কেটে গেছে।মাসের শুরু।এক তারিখ।আজ থেকে মাহরুরের নতুন চাকরিতে যোগদান।নতুন জায়গার পরিবেশের সাথে মানানসই কাপড়ও কিনে এনেছে।যেদিন ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল সেদিনই চোখে পড়ে তাদের তাদের রহন-সহন অনেকেই উচু মাপের মানুষ। পরিচ্ছন্ন সুন্দর অফিস। চব্বিশ ঘন্টা এসি চলে।রেগে ছিলো মাহরুর।মল্লিকা এই ছয়দিন তার কোনো খাতিরদারি করেনি।কাছে আসতে নিলেই দূরে পালায়। হাল ছেড়ে দেয় মাহরুরও।নতুন শার্ট, প্যান্ট,ঘড়ি এগিয়ে দিয়ে দাড়িয়ে রইলো। মাহরুরের এক চোখ কাপড়ে অন্য চোখ মল্লিকার উপর।
চুল মুছে আয়নার সামনে দাড়িয়েই বলল, “এখন কি তোর সামনেই কাপড় বদলাবো আমি?”
মল্লিকা চট করে উত্তর দেয়, “না সেটা হবে কেনো?”
“তো সং সেজে দাড়িয়ে আছিস কেনো সামনে।বাহিরে যা।ইচ্ছে থাকলে থাকতেও পারিস।না করবো না।”
“পাগল!বদ্ধ পাগল।”
বলে বিড়বিড় করতে করতে পর্দা টেনে বাহিরে চলে গেলো মল্লিকা। মাহরুর ঠোঁট কামড়ে হাসলো।নিজের উপর সেও ভীষণ অবাক হয়।মনের অবাধ্য ইচ্ছেগুলো এভাবে প্রকাশ করে ফেলবে মল্লিকার কাছে নিজেও কল্পনায় আনতে পারেনি।
মাহরুর তৈরি।শার্ট প্যান্ট পরে ফরমাল লুকে মল্লিকার সামনে এসে দাঁড়ায়।মল্লিকা এক দেখায় মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে।চওড়া গরণ তার।তবে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান নয়।বয়সের ভারে সামান্য পেট বেরিয়েছে তবে চোখে পড়ার মতন না।হালকা বাদামি দাড়িগুলো নিজের মুখের অনুযায়ী ছাটাই করে রাখে।এক গভীর সমুদ্রের মতন মুগ্ধ নেত্র।খয়েরী রঙের শার্টে বেশ মানিয়েছে গায়ের উজ্জ্বল বর্ণে।আগেও দেখেছে অফিসের পোশাকে।আজ ভিন্ন।আজ একটু নিজেকে বেশিই ফিটফাট করে সাজিয়েছে মাহরুর।
মল্লিকার মুখের কাছে তুড়ি বাজিয়ে মাহরুর বললো, “টাই বাঁধতে জানিস?”
মল্লিকা মাথা দোলায়।সে জানেনা কি করে টাই বাঁধতে হয়।কখনো বাঁধা হয়নি।গ্রামে এসব সাহেবী বেশভূষা নিয়ে কেউ চলে না। মাহরুর হতাশ হয়।বলে,
“ভেবেছিলাম তোকে এই ডিউটি দিবো। তুইতো এটাও পারিস না। অকর্মার ঢেঁকি!”
“শিখে নিবো”
মল্লিকার এরূপ কথায় আগ্রহ প্রকাশ পায়।বুঝলো মাহরুর।সে রাজি প্রতিদিন টাই বেধে দেওয়ার ডিউটি করতে। মাহরুর বলে,
“দেখ কি করে বাঁধি।ধীরেধীরে শিখে নিবি।”
“আচ্ছা”
মল্লিকার সামনে দাড়িয়েই গলায় তাই বেধে নিলো।খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো।কিন্তু কিছুই বুঝেনি। বড্ড প্যাঁচ এখানে।মাথাটা ঘুরে গেছে প্রথম দেখায়।কিছু না বুঝে কয়েকবার দ্রুত গতিতে পলক ঝাপটায় মল্লিকা। মাহরুর পরিপূর্ণভাবে তৈরি।
জানতে চাইলো, “কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?”
মল্লিকা মাথা নুয়ে উত্তর দেয়, “সুন্দর”
“আর?”
“আর কি? সুন্দরই দেখাচ্ছে।”
“তুই বড্ড বেরসিক চন্দ্র।মিষ্টিকে তৈরি কর।বের হবো।”
মিষ্টিও রেডি।এবার দুজনেই বের হবে।বাকিটা সময় একা থাকতে হবে মল্লিকাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসি মুখে বিদায় দিতে গিয়ে মাহরুর থেমে যায়।
বলে, “ভয় করছে রে?অনেক বড় অফিস।আমার মতন মানুষকে….”
“যেহেতু সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে আপনাকে সুযোগটা দিয়েছে।সেই এগিয়ে নিয়ে যাবে।আপনি মন দিয়ে কাজ করবেন।কোনো চিন্তা করবেন না।”
মল্লিকার কথায় সস্তি পায়।আদুরে গলায় প্রতিদিনের ন্যায় অনুমতি চায় মল্লিকার কাছে।বলে, “আসি?”
“আসুন খোদা হাফেজ।” হাসি মুখে বিদায় দেয় মিষ্টি আর মাহরুরকে মল্লিকা।
তারা যাওয়ার সাথে সাথে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাড়ায়। জানা আছে।যাওয়ার পথে একবার হলেও ফিরে তাকাবে। হলোও তাই।এক মিনিটের মধ্যে পিছু ফিরে মাহরুর। উভয়ই হাত নেড়ে বিদায় জানায় মল্লিকাকে।দুজন দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেলে শূন্যে চোখ তুলে মল্লিকা বললো,
“সব যেনো ঠিক থাকে।আর কষ্টের চিহ্ন চাই না এই জীবনে।”
__
“আপনিই মিস্টার মাহরুর ইবনাত?”
“জ্বি স্যার”
ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “ফার্স্ট ডে রাইট?”
“জ্বি স্যার।”
“দেখেন প্রথমদিন।আজই কাজে হাত দেওয়ার দরকার নেই। অফিসটা ঘুরে দেখুন।সবার সাথে পরিচয় হন।আপনার ডিরেক্টর আছেন একজন সে আপনাকে সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে সব কাজ বুঝিয়ে হ্যান্ড ওভার করে দিবে।”
“জ্বি”
মাহরুরের সিভিটা আবারো চেক করছেন ম্যানেজার সাহেব।দেখে জানতে চাইলেন, “সাত বছর আগের কোম্পানিতে চাকরি করেছেন?কখনো ইচ্ছে হয়নি জব সুইচ করার?”
“জ্বি স্যার আসলে!”
“ডোন্ট হেজিটেড।বলে ফেলুন।আমি সত্যবাদী লোক পছন্দ করি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর বলে, “আসলে স্যার আমি গ্রামের ছেলে। পড়াশোনা সেখানেই শেষ করেছি।টানাপোড়ন এর সংসার এগোতে যে কাজটা পেয়েছি সেটাই করেছি।আমি জানতাম না আমার কাছ থেকে মিথ্যে বলে এগ্রিমেন্ট সাইন করানো হয়।যেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।তাই এতদিন সেখানে ছিলাম।”
ম্যানেজার মাথা দোলান।বলেন, “আই সি…শোনেন মিষ্টার মাহরুর।এখানে চাকরি করতে হলে এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে হবে।তার পাশাপাশি চালাক হতে হবে। আশা করি পূর্বের বোকামি থেকে শিক্ষা নিয়েছেন।এখানে কাজের প্রতি সৎ থাকার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তা খাটাতে হবে। আই থিঙ্ক ইউ ক্যান ডু ইট।বেস্ট অফ লাক।”
বলেই হাত এগিয়ে দেয় ম্যানেজার। মাহরুরও সভ্যতার সাথে হাত এগিয়ে হ্যান্ড শেক করে বেরিয়ে পড়ে। ডিরেক্টর তাকে অফিস দেখাচ্ছে।তার ছোট্ট ডেস্কটাও দেখিয়ে দিল। বিলাসবহুল অফিস।কাঠের টেবিল এর সাথে আরামদায়ক চেয়ার।পুরোই স্বপ্নের মতন।তবে ভয় আছে পা পিছলে যাওয়ার। শখ পূরণ করতে চায়। তবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিলাসিতায় অভ্যস্ত হতে ইচ্ছুক নয়।তার টিমের আরো কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয় মাহরুর।সব শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের ডেস্কএ কম্পিউটার এর কাছে বসতেই ফোন বেজে উঠে।বড় একটা নাম ভেসে আসছে। ‘আমার চন্দ্রমল্লিকা’।
“হ্যালো”
“হুম?”
“কি হুম? জানতে চাইবি না কিছু?”
“হ্যাঁ।খেয়েছেন?”
“হ্যা।তুই খেয়েছিস?আর মিষ্টি?স্কুল থেকে আনতে কোনো সমস্যা হয়নিতো?”
“না।আর আমরা খেয়েছি।”
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মাহরুর।এভাবে সেলফোনে একে ওপরের খোঁজ নেওয়াটাও একটা ভালোবাসা।এখন লাঞ্চ আওয়ার।কোনো কাজ নেই। মাহরুরের আজ কোনো কাজই নেই।
গাঢ় গলায় জানতে চাইলো মাহরুর।বললো, “তো বলেন আপনারা মা মেয়েরা কি করছেন?একা অনুভব করছেন নাতো?”
আপনি ডাকে মুচকি হাসলো মল্লিকা। মিষ্টিকে চেপে ধরে নিজের সাথে বললো, “মিষ্টিতো সারাদিন টিভি নিয়ে পড়ে থাকে জানেন না? পড়তেই চায় না।আর একা অনুভব করার কি আছে।আপনিতো প্রতিদিন এই সময় কাজে থাকেন।”
“আপনার মতে আমার সবসময় আপনার সাথে থাকা উচিত?”
“না সেটা হবে কেনো?”
“তাহলে কি দূরে থাকা উচিত?”
আপনাআপনি মল্লিকার মুখ ফুটে বেড়িয়ে আসল, “না কেনো? দূরে কেনো….”
বলতে বলতে থেমে যায়।ফোনের অন্যপাশে মাহরুরের হাসিটা আর চোখে পড়লো না। নিস্তব্ধতায় থেকে যায় দুজনেই কিছুক্ষণ।
মল্লিকা আবার বললো, “বিরক্ত করছি?”
“না।ফ্রি আছি”
“ফিরবেন কখন?”
“আপনি কখন দেখতে চান আমাকে?”
“আমি চাইলেই হলো নাকি? অফিসতো আমার মোতাবেক চলবে না।”
“চালিয়ে নিবো দরকার পড়লে।একটা বিষয় কি জানেন?এই অফিসে দুইদিন ছুটি।শুক্রবার আর সোমবার।কিন্তু একটা খারাপ বিষয়ও আছে।”
“সেটা কি?” মল্লিকার কন্ঠ উৎসুক শোনালো।
“যেখানে চারটা পর্যন্ত কাজ করতাম সেখানে পাঁচটা পর্যন্ত করা লাগবে।”
মুখ চুপসে গেলো। হাতে গুনে হিসাব করতে লাগলো।এই অফিসটা দূরে। পাঁচটায় বের হলে আসতে আসতে আরো বেশি সময়।মল্লিকা বুঝে উঠতে পারল না দুইদিন বন্ধে খুশি হবে নাকি এক ঘন্টা দেরিতে মাহরুর ব্যতীত থাকবে সেটায় কষ্ট পাবে।
আকস্মিক ডিরেক্টরের ডাকে মাহরুর বললো, “আমাকে ডাকছে।রাখি সাবধানে থাকিস”
“আচ্ছা।সাবধানে ফিরবেন”
মাহরুর এসেছে সন্ধ্যা ছয়টায়।এসেই একের পর এক হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে।চোখের সাদা অংশ লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে।নাকের ডগাটাও কম যায় না। টকটকে লাল। কখনও রুমাল চেপে হাঁচি কাশির বন্যা বইছে কখনো নাক ঘষছে।এতটা ঠান্ডা লাগলো কি করে? চিরচিরা মেজাজ।প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।ঠান্ডা লাগলে কতটা বিরক্ত লাগে সেটা মল্লিকাও জানে।
আদা চা করে দিলো ফটাফট।গরম ধোঁয়া তোলা চা মাহরুরের দিকে এগিয়ে বললো, “চা খেয়ে নিন।আরাম পাবেন।”
নাক টানতে টানতে চায়ের কাপ হাতে নেয় মাহরুর।দুয়েক চুমুক দিয়ে বলতে লাগলো, “জীবনে প্রথমবার এত ঘণ্টা এসির নিচে থেকেছি।পুরো মাথা ধরে আছে।চোখ,নাক জ্বলছে।পুরো শরীর ম্যাজম্যাজ করছে।মানুষ যে কি করে করে এত ঠান্ডায় কাজ।”
এবার ঘটনা বুঝতে পেরেছে মল্লিকা। এতসময় এসির নিচে থাকার ফল।তাও প্রথমবার।আগে থেকেই মাহরুরের ঠান্ডার জোর বেশি। চাচীকে দেখতো আদা চা করে দিতে প্রায়ই।
মল্লিকা বললো, “ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।আমি তেল গরম করে আনি? হাতে,পায়ে আর মাথায় দিয়ে দেই।”
“দে”
মাহরুর চায়ের কাপটা শেষ করতে করতে মল্লিকা কাপড়ে মুড়িয়ে গরম তেল আনলো। সরিষার তেলে ঠান্ডা একটু হলেও নিবারণ হবে।মিষ্টি বসে বসে মাহরুরের চুল টেনে দিচ্ছে।মা,মেয়ে দুজনকেই নিজের যত্নে লাগিয়ে দিলো।
মল্লিকা মাহরুরের পায়ে হাত দিলেই মাহরুর বলে উঠলো,
“পায়ে হাত দিবি।কেমন অদ্ভুত দেখায় না?বাদ দে।”
“কিছুই অদ্ভুত দেখায় না” নিচু গলায় বললো মল্লিকা।
মল্লিকার মুখ দর্শন করে মাহরুর ভাবলো হয়তো মেয়েটা চায় তার সেবা করতে।বললো, “আচ্ছা দে”
পরপর মাহরুর মিষ্টিকে আদেশ দেয়, “মিষ্টি হয়েছে।আর চুল টেনে দিতে হবে না। কাল স্কুল আছে না? ঘুমা।”
যত্ন করেই মাহরুরের হাত,পা,মাথায় তেল মালিশ করে দিতে লাগে মল্লিকা।একটু সস্তি পাচ্ছে।পেতেই হতো।বেশি অসুস্থ হলে চলবে না।একদিন কাজে গিয়েই এই অবস্থা হলে বাকিতো দিন আছে পড়ে।এই চাকরিটা কোনমতে হাতছাড়া করা যাবেই না। মাহরুর এর সেবা আর ঘরের কাজ এটে সময় গড়ায় রাত বারোটা।আজ মাহরুর বিছনায়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।তাকে আর ডাকলো না।বিছানার অন্যপাশে গিয়ে শুয়ে পড়তেই মাহরুর ডাকে।
ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে, “আমার পাশে আয়।”
“হুম?…জায়গা হবেনাতো।”
“হবে আয় তুই”
মিষ্টি শুয়ে আছে দেয়ালের দিকটায় সাবধানে।পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।তার পাশেই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া তার মা।পেছনে জায়গা কম।তারপরও নিজেকে এটে নিয়েছে মাহরুর।মিষ্টি আর মল্লিকাকে কাথা উড়িয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো মল্লিকাকে আকড়ে ধরে।
মাহরুর বললো, “তোর উষ্ণতায় দেখবি কাল সকালেই আমার সর্দি কাশি সব গায়েব।”
চলবে..গল্পের