চন্দ্র’মল্লিকা ২১
লেখা : Azyah_সূচনা
সূর্যের তেরছা রোশনি পর্দা চিরে ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে প্রবেশ করছে।পাখির কিচিরমিচির জানান দিচ্ছে প্রভাতের।আজ প্রায় পুরো নগরী ঘুমন্ত।সারা সপ্তাহের ক্লান্তি মেটাচ্ছে।সুন্দর একটা দিন তাদের।ছুটির দিন।আরামের দিন।সূর্যের আলো এসে পড়ছে মাহরুরের পিঠে।তারপরও ঘুমে কোনো তারতম্য হলো না। বলিষ্ট হাতজোড়া মল্লিকার বাহুকে আবদ্ধ করে আছে।আঙ্গুলের ভাজে আঙ্গুল রেখে পুরো চন্দ্রমল্লিকাকেই আবদ্ধ করে রেখেছে নিজের হৃদগহ্বরে।অন্যদিকে মমতাময়ী মা।তার মেয়েকে নিজের বুকে লেপ্টে নিয়ে আরামদায়ক ঘুমে।হুশ নেই,টের পায়নি।তাকে পেছন থেকে কেউ এভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে।
হাতের উপর ভার অনুভব করায় সামান্য নড়চড় করে উঠে মল্লিকা। হাঁসফাঁস লাগছে। ছট্ফট করার গতি বৃদ্ধি পেলে ঘুমঘুম কন্ঠ ভেসে আসে,
“উম! নড়চড় করিস না।”
ফটাফট মল্লিকার চোঁখের ঘুম উধাও।আওয়াজ তার পিছনে খুব কাছ থেকে আসছে।বুঝতে বাকি নেই কে এখানে। মাহরুর আরো গা ঘেষে রইলো।মল্লিকা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। আঙ্গুলের ভাঁজ থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মাহরুরের ঘুম ভেংগে গেল।
বিরক্তি নিয়ে বললো, “কি সমস্যা?”
“উঠবো”
পিঠে ছড়িয়ে থাকা কেশমালা একহাতে পেঁচিয়ে ধরলো মাহরুর। আলতো টানে ঘ্রাণ শুকে নিচ্ছে।ঘ্রাণে মাতোয়ারা হওয়া শেষে বলে উঠলো,
“পড়ে উঠ।আজ শুক্রবার”
“আমি আজ রান্না করবো।রহিম চাচাদের বাড়িতে রেধে পাঠাবো।উঠতে দিন”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর।কিছুই করার নেই।ভালো চিন্তা এনেছে মাথায়।আটকানো যাবে না।মেয়ের মাকে বাদ দিয়ে মেয়েকে জরিয়ে আবার ঘুমের জগতে ডুবে যায় মাহরুর।কম খাটাখাটনি যায় না শরীরের উপর।অফিস,অফিস থেকে আবার রান্না করা।দৌড় ঝাপ করতে করতে বিশ্রাম নেওয়ার সময় কোথায়?ঘরে চাঁদ এনেছে। চাঁদকে দিয়ে কাজ করানো তার শানের পরিপন্থী।
হাতে সোনালী রঙের চুরি চকচক করছে।নাকেও আছে পুরোনো একটা নাকফুল।খোঁপা সামান্য ঝুলে আছে পিঠের দিকে।নাকে ঘাম চিকচিক করছে তারপরও কাজে কোনো অলসতা নেই।অনীহা নেই। শুক্রবার সাপ্তাহিক ঈদের দিন। মাহরুর পোলাও চাল এনেছিল।সাথে মুরগির গোস্ত।দুটোই রান্না করবে সাথে সালাদ। মাহরুরের ঘুম ভাঙ্গে এগারোটায়।একবার মুগ্ধ চোখে মল্লিকার দিকে চেয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
তাওয়ালে হাত পা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসেছে মাহরুর।এসেই বলল, “নাস্তা কি পাবো?নাকি নিজেই বানিয়ে খাওয়া লাগবে।”
মল্লিকার কাছে কটাক্ষের মতন লাগলো। হন্তদন্ত হয়ে বললো,
“বানিয়েছি নাস্তা।একটু অপেক্ষা করুন ডিম ভেজে দেই।”
“চা আর পরোটা খাবো।”
“আচ্ছা দিচ্ছি”
মাহরুর পাশে এসে বসলো।জানতে চাইলো, “আপনি খেয়েছেন?”
আবারো সেই আপনি ডাক।অভ্যাস হয়ে যাবে মাহরুরের সবকিছুই।এটা ভেবে মল্লিকা উত্তর দেয়, “না।মিষ্টি উঠলে খাবো ”
“আমার সাথে বসে খাবেন আজ?”
এইযে বারবার হৃদয়ে ঝংকার উঠে?এর কোনো ঔষধ নেই।মল্লিকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।আজ তার সাথে বসেই খাবে। মাহরুরের মন প্রসন্ন হয়।হাসি মুখে চুলোয় চড়িয়ে রাখা লিকার নামিয়ে কাপে ঢালতে লাগলো।অন্যদিকে আগে থেকে বানিয়ে রাখা পরোটা চুলোয় দিয়ে ভেজে নিলো মল্লিকা।
চুলোর দ্বারেই সকালের নাস্তা করছে মাহরুর মল্লিকা।কয়েকবার মাথা ঘুরিয়ে মেয়েকেও দেখে নিলো।ছোটোবেলা থেকেই ঘুম কাতুরে তার মেয়ে।খাবার না দিয়ে ঘুমোতে দিলে সে কোনো অভিযোগ করবে না।আজ জুম্মা।নামাজ আছে।সাথে অনেক রান্নাও।
মাহরুর বললো,
“আমি খাইয়ে দিচ্ছি।তুই তোর কাজ কর”
পরম যতনে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। মাহরুরের আঙ্গুলের স্পর্শ ঠোঁটে লেগে যত অসস্তিতে পড়ছে মল্লিকা ততই চন্দ্রের ওষ্ঠ স্পর্শন দামাল হৃদয়ের জন্য প্রশান্তিদায়ক। মাহরুর ভাবে।কাবু করার মন্ত্র বোধহয় মায়ের পেট থেকেই শিখেছে এই মেয়ে।নাহয় কেনো তার অল্পস্বল্প প্রকাশ্য অনুভূতি মাহরুরকে তাড়া করবে?তাও ক্ষণিক সময়ের প্রেমের হাওয়া ছিলো সেখানে।
মাহরুর গোসল সেরে শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে।চুলগুলো এখনও ভেজা।গায়ে আতর মেখে ড্যাবড্যাব চোখে আবডালে চেয়ে থাকা চোরকে ধরে ফেললো।লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে পুরুষের সৌন্দর্য্য লুফে নিচ্ছিলো।কাছে ডাকলো।
বললো, “চুল মুছে দিয়ে যা”
“আমি?”
“তো কে?চন্দ্র তোতলানো বারণ, নিশ্চুপ হয়ে থাকা বারণ পাশাপাশি আমার আদেশ পালন করার বিষয়ে এক সেকেন্ড দেরি করা যাবে না।দ্রুত আয়”
তোয়ালে হাতে মাহরুরের সামনে দাঁড়িয়েছে মল্লিকা। মাহরুর বিছানায় বসে। পিছনে মিষ্টিও উঠে দাড়ালো।এখন কি হতে চলেছে সে দেখবে আগ্রহ নিয়ে।মল্লিকা আলগোছে চুল মুছতে লাগলো। তোয়ালের আড়ালে আড়ালে মল্লিকার স্তব্ধ মুখটা দেখে দারুণ ইচ্ছে জাগে।যাহার পূর্ণতা দেওয়া অসম্ভব।এখানে যদি মিষ্টি না থাকতো? চন্দ্রের সাথে তার সম্পর্কটা আরেকটু মজবুত হতো? চট করে চুল মোছার বাহানায় তাকে কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিত।তার আর উপায় নেই।নিজের ইচ্ছেকে এখানেই মাটিচাপা দেয়।
মিষ্টি বলে উঠলো, “আমাকেও মা এভাবেই চুল মুছে দেয় মামা। আজ তোমাকে দিচ্ছে।”
“তুইও আয়।মেয়ে হওয়ার দায়িত্ব পালন কর।চুল মুছে দিতে মাকে সাহায্য কর।”
দায়িত্ব পালন শব্দের অর্থ বুঝলো না মিষ্টি।শুধু এতটুকুই বুঝলো তাকেও ডাকা হচ্ছে।সেও মায়ের সাথে হাত মেলাবে। বাচ্চা হাতে জোর চালালো।চুল মুছে দেওয়ার বদলে অত্যাচার করছে বেশি। মাহরুর মাথা নাড়ায়।
বলে, “হয়েছে হয়েছে আর লাগবে না।আমার সব চুল ঝড়ে যাবে নাহয়।”
মিষ্টি প্রতিউত্তরে বলে, “তুমিতো এত বড় তুমিও কি আমার মত চুল মুছতে জানো না মামা?”
মাহরুর মনে মনে বলে উঠে, “জানিরে মা।কিন্তু কি করবো বল?তোর মা আমাকে ধরা দেয় না।তাই তাকে একটু জ্বালাই।”
মনের কথা মনের সিন্দুকেই রাখে মাহরুর।তবে মুখে বললো, “নারে মিষ্টি পারি না।”
“ওহহো”
মিষ্টির কথায় হেসে ফেলে মাহরুর মল্লিকা দুজনেই। মিষ্টির নাক টেনে দিয়ে মাহরুর জানতে চায়, “কি খাবি বল?কি আনবো আসার পথে?”
“জিলাপি খাবো”
“আচ্ছা।আর শোন আমার জন্য অপেক্ষা করবি।আমি বাড়ি আসলে তিনজনে মিলে একসাথে বসে খাবো।”
মিষ্টি সামান্য লাফিয়ে বললো, “আচ্ছা মামা। টাটা”
মাহরুর হতাশ হয়ে নিঃশ্বাস ফেলে।মাথা দুদিকে নাড়িয়ে আবছা স্বরে বলল, “মামা!হাহ!”
__
জুম্মার নামাজ শেষে দুজোড়া পা রাস্তায় চলছে।দুজন পূরুষের সাদা পাঞ্জাবি ঘামে ভেজা।কেউ বলবে না গোসল সেরে বেরিয়েছে তারা। মাহরুরের পাশে রেদোয়ান।দুজনই যারযার বাড়ি যাবে।মিষ্টির আবদারের জিলাপি আর কিনতে হলো না।আজ মসজিদেই নিমকি জিলাপি দিয়েছে।
রেদোয়ান ঠাট্টা করে বললো, “বাবার মতন আচরন করছো মাহি।নিজে না খেয়ে মেয়ের জন্য নিমকি জিলাপি নিয়ে যাচ্ছো বাড়ি।দৃশ্যটা আজ প্রথম দেখলাম।”
মাহরুর হাসে।বলে, “ওকে খেতে দেখে যে তৃপ্তিটা পাবো সেটা সারা দুনিয়া খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।”
মাহরুরের বুক চাপড়ে বললো, “এটা বাবার হৃদয় মাহি।এই জায়গায় বাবা হওয়ার অনুভূতি জাগ্রহ হচ্ছে।”
“হোক আমি চাই হোক!”
রাস্তার দ্বারে দাড়ায় মাহরুর আর রেদোয়ান।একটা একটা করে সফট ড্রিংক এর বোতল কিনে নিলো দুজনেই।জুম্মার দিনে দাওয়াত এর আমেজ।পোলাও মাংস খেয়ে হজম করতে হবেতো?দোকানের পাশে একটা মহিলাকে চুরি,কানের দুল বিক্রি করতে দেখলো মাহরুর।দ্রুত পকেট হাতড়ে দেখলো টাকা আছে কিনা।দেড়শো টাকা আছে। এতে আরামসে মেয়ে আর মেয়ের মার জন্য উপহার কেনা হয়ে যাবে। রেদোয়ান দাড়িয়ে হাসলো।লোকটা অল্প দিনেই অনেক পরিবর্তিত। সাংসারিক ছিলো।কিন্তু আগের সংসারে সুখের চেয়ে দুঃখের ছায়া মুখে থাকতো সবসময়।
রেদোয়ান প্রশ্ন করে, “মাহি ব্যাংকে কত টাকা আছে?”
মুখটা মলিন হয়ে যায় মাহরুরের।দুঃখী মনে বললো, “ছিলো সত্তর হাজারের মতন।এখন চল্লিশ পয়তাল্লিশের মতন আছে।কেনো?”
“তুমি কি ব্যবসার কথা ভাববে?”
“এই অল্প ইনভেস্টমেন্ট এ ব্যবসা সম্ভব না।”
“আমি দিতে চাচ্ছি সেটাও নিবে না।বললাম লাভ হলে ফিরিয়ে দিও।তুমিতো কমার্সের স্টুডেন্ট।তোমার সাথে ব্যবসাটা যায়।আর তোমার এগ্রিমেন্ট চেক করেছি।এটা তোমাকে ভয়ে রাখার পাঁয়তারা।তুমি বললে ম্যানেজারের ঘাড়টা ধরে বসি?”
“আরেহ না ভাই।যাও চাকরিটা আছে সেটাও থাকবে না।নতুন চাকরি খুজবো পাকাপোক্তভাবে তারপরই ছাড়বো এটা।এর আগে নয়।”
“কতোটা বছর তোমাকে বোকা বানিয়ে রেখেছে মাহি।বুঝতে পারছো।এক জায়গায় থেমে আছো শিক্ষিত হওয়া সত্বেও।আমি তোমাকে উৎসাহ দিচ্ছি।মনে করো না খোচা দিয়ে বলছি।তোমার এবার অন্যকিছুতে এগোনো দরকার।আমাদের পুরুষদের নিজেকে নিয়ে কি চিন্তা?যত চিন্তা বউ বাচ্চার”
মাহরুর মাথা দোলায়।বুঝেছে রেদোয়ান এর কথা। দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিল এই নিষ্ঠুর শহরের জন্য তারও কঠোর হতে হবে।অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।কথা শেষে রেদোয়ানকে ডাকলো। আজ দুপুরে তাদের সাথে খেয়ে যেতে।সে রাজি হয়নি।তার স্ত্রীও তার জন্য অপেক্ষায়।তাই বলে চলে গেলো।
___
শুভ্র পাঞ্জাবি দড়িতে টানিয়ে খেতে বসেছে তিনজন।পরনে সাদা বডি অয়ের।হাতের সম্পূর্ণ অংশই খোলামেলা। অনিচ্ছায় চোখ চলে যায় মল্লিকার।লজ্জাবোধ করে সাথে সাথেই।সেখানে খেয়াল নেই মাহরুরের।পোলাও গোস্ত মাখিয়ে মিষ্টিকে খাইয়ে দিচ্ছে।সামনে বসে মল্লিকা খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মিষ্টির মুখে আরেক লোকমা পুড়ে দিয়ে মাহরুর বললো,
“চেয়ে না থেকে খাবার শেষ কর”
থতমত খেয়েছে মল্লিকা।তার দিকে না চেয়েই কি অবলীলায় বলে ফেললো।লজ্জা দিলো মল্লিকার দৃষ্টিশক্তিকে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে মল্লিকা গিয়েছে দোতলায়।ভুলেই গিয়েছিল বাড়িওয়ালা রহিম চাচাকে খাবার দিতে হবে।খাবার খেয়ে নাকে মুখে দৌড় লাগিয়েছে। মাহরুর যায়নি সাথে।একা চলতে শিখুক।অন্যের সাথে কি করে ডিল করতে হয় মল্লিকার শেখা প্রয়োজন।সময় নিয়েই ফিরে এসেছে মল্লিকা। হাঁপাচ্ছে রীতিমত।
ঘরে ঢুকে মিষ্টির পায়ে নূপুর দেখে অবাক হলো।এটাতো ছিলো না আগে? কোথা থেকে এলো? মিষ্টি আর মাহরুরের উদ্দেশ্যে মল্লিকা বলে উঠে, “নূপুর আসলো কোথা থেকে?”
“মামা…”
বলতে বলতে থেমে যায়।থামিয়ে দেয় মাহরুর তাকে “উম?” শব্দ করে। মিষ্টিও যেনো তার ইশারা বুঝে গেছে।
বলে উঠলো,
“বাবা দিয়েছে”
ফোনে মনোনিবেশ করা মাহরুর বাকা হাসলো।মল্লিকা অবাক হবে নাকি খুশি হবে দ্বিধদ্বন্দ্বে ভুগতে শুরু করলো।মল্লিকার ঠোঁটজোড়া আপনাআপনি কিঞ্চিত ফাঁকা হয়ে আছে।এই অল্প সময়ে বুলি পরিবর্তন করে ফেলেছে?তার সাথে সাথে তার মেয়েকেও জব্দ করছে ধীরেধীরে।এই জব্দ হওয়াতে কোনো বাঁধা নেই।হাসির মাধ্যমে এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ করলো মল্লিকা।
মিষ্টি মাকে নূপুর দেখিয়ে বললো, “মা? মামা..না বাবা বলেছে সে আমার বাবা।আমরা আজ থেকে সবসময় একসাথে থাকবো।আর বলেছে আমাদেরকে একটা বড় বাড়ি বানিয়ে দেবে।সেখানে অনেক খেলনা থাকবে।আমারও মামা বাবাকে ভালো লাগে মা।আমরা একসাথে থাকবো?”
অদ্ভুত ডাক। মামাবাবা!খিলখিল করে হেসে উঠে দুজনেই।এতগুলো কথা বলে ছোট্ট মিষ্টি হাপিয়ে উঠেছে।ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়লো।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে শুয়েও পড়েছে।বুঝতে বাকি রইলো না ঘুম পাগলী মেয়ে আবার ঘুমের সাগরে তলাবে। মাহরুর হাত এগিয়ে বিলি কাটতে লাগলো মিষ্টির কোকড়া চুলে।বিশ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পরে মিষ্টি।
তার নিস্পাপ মুখখানা দেখে মাহরুর মল্লিকার উদ্দেশ্যে বললো, “তোর মেয়েটাও তোর মতন জানিস?তোরও এই বয়সে কোকড়া চুল ছিলো।সারাদিন চাচীর কোলে ঘুমিয়ে থাকতি ”
“আপনার মনে আছে?”
“হুম।তোর আর শিরীনের ছোটোবেলা আমার সামনেই কেটেছে।মনে থাকবে না?”
“আচ্ছা আমি থালা বাসন গুছিয়ে নেই।”
“এই দাঁড়া!”
মাহরুর উঠে আসে মল্লিকার দিকে।এগিয়ে আসার গতি দেখেই হৃদপিণ্ড আটকে যাবে।না জানে আবার কি বলবে?কি আদেশ দিবে? মল্লিকাকে টেনে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। আয়নায় মল্লিকার লাজুক মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে চুল সরিয়ে নিল ঘাড় থেকে।পকেট থেকে সোনালী রঙের একটা চেইন বের করে পড়াতে শুরু করে। ঘাড়ে মাহরুরের আঙ্গুলের স্পর্শে কম্পিত বদন।বারবার নিজেকে একই প্রশ্ন করতে বাধ্য করে?কেনো মাহরুর কাছে এলেই এমন অনুভূতি!
পিঠটা মাহরুরের বুক ছুঁই ছুঁই।কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাহরুর বললো, “চোখ খোল”
চোখ খুলে সর্বপ্রথম মাহরুরের মুখটা চোখে পড়লো মল্লিকার।কল্পনা করলো সেইদিনগুলোর।স্বপ্ন মনে হয় সবটা।একসময় ছিলো অগাধ ভালোবাসা আর বিশাল দূরত্ব।আজ এতটা ভালোবাসা কুলিয়ে উঠতে পারছে না মল্লিকা।তারপর চোখ গেলো গলায় চেইনটিতে।সোনালী চেইন এর মাঝে একটি অর্ধচন্দ্রের লকেট।বেশ সুন্দর।
মল্লিকাকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাহরুর।মল্লিকার মাথার ডানদিকে নিজের মাথা এলিয়ে বললো, “স্বর্ণের না।কিন্তু আমার মনে হলো তোর গলায় এটা মানাবে বেশ।”
“আমার ওসব দামী কিছু চাইনা।”
“কিন্তু আমি চাই চন্দ্র!একদিন স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে রাখবো তোকে।তুই শুধু দুআ কর আর আমাকে ওই কিশোরী চন্দ্রের মতন ভালোবাস।”
“আপনি অনেক ভালো মানুষ।”
এতদিনে নিজের খোলস ছাড়লো মল্লিকা।ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ছড়ায়। কিছুতো বলেছে এই ননীর পুতুল!নাহয় এক সময় মাহরুর ধরেই নিত চন্দ্র সেই আকাশের চন্দ্রের মতই বোবা।
“এই ভালো মানুষের একটা ভুল আবদার রাখবি?”
“কি রকম?”
পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মিষ্টিকে দেখে নিলো।নাহ বিভোর সে ঘুমে। মাহরুর আবার মনোযোগী হয় মল্লিকায়।বলে,
“তোর ঘাড়ের তিলটায় ঠোঁট ছুঁয়ে দেই?প্লিজ!একবার।দেখ কি বাজেভাবে টানছে আমাকে।আমিও পুরুষ মানুষ!নিজেকে সামলাতে পারি না তোর কাছে থাকলে।আর সে যদি হয় তিলেতিলে আমার হৃদয়ে ছেয়ে যাওয়া নারী?তাহলে আরো সামলানো যাচ্ছে না।”
মল্লিকা ছিটকে দূরে সরে যেতে চাইলো।লোকটা তাকে মেরেই ফেলবে।কি রকমভাবে আবদার করছে।তাকে তার ইচ্ছে পূরণের অনুমতি দিলে দাড়িয়ে দাড়িয়ে নিজের প্রাণ হারাবে সে।মল্লিকার ভাবসাব বুঝলো মাহরুর।এবার বেঁকে বসে নিজেও।
বলে, “অনুমতি নিচ্ছি?কেনো?অধিকার আছে খাটাবো না?তুই আমার মতন এক তাগড়া যুবককে ভালোবাসার আগে অনুমতি নিয়েছিলি?ভাই সমতুল্য লোকের দিকে কু দৃষ্টি দিয়েছিলি চন্দ্র। শাস্তি ভোগ কর।”
বিদ্যুতের ঝটকা দিয়েছে এক মুহুর্তেই। উন্মুক্ত ঘাড়ে মুখ ডুবায়। অস্থিরতা ভরা চিত্তে খিঁচে চোখ বন্ধ করে নিলো মল্লিকা।এটা নিশ্চিত একদিন এই মাহরুরের হাতেই বধ হবে। মিনিট খানেক পর ছাড় দিল মল্লিকাকে। ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“আমার মেয়েটা জেগে যাবে বলে ছেড়ে দিলাম। আগামীবার!”
অর্ধপূর্ন বাক্যে মুখ শক্ত করে থেমে গেলো।বাকি কথা পূর্ন করলো না মাহরুর।মল্লিকা একটা মোম।যত জ্বালাবে গলতে থাকবে।আজকে এতটুকুই তার জন্য যথেষ্ট এর চেয়ে বেশি।মল্লিকা নিঃশ্বাস ফেলে নিচু গলায় আওড়ায়,
“পাগল!উন্মাদ!”
চলবে…
চন্দ্র’মল্লিকা ২২
লেখা : Azyah_সূচনা
“আপনাকে ফোন করে আমার মায়ের হয়ে ক্ষমা চেয়েছি।আপনি তারপরও তাকে এভাবে ধরে আনলেন?কই আপনাদের থানার ওসি কোথায়?আমি কথা বলতে চাই!”
ফারহানের ছোট ভাই ফরহাদ এসেছে। সুদূর দুবাই থেকে কয়েক দিনের মধ্যে মায়ের জেল খাটার সংবাদে দৌড়ে আসে। রেদোয়ান এর সামনে থানায় এসে বসে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।
রেদোয়ান হাসে।বলে, “ওসি সাহেবের আদেশেই হচ্ছে যা হচ্ছে।শুনতে খারাপ লাগবে আপনার তারপরও বলি আপনার মা নারী নামের কলংক”
ফরহাদ এবার দ্বিগুণ রেগে গেলো।বললো, “মুখ সামলে কথা বলুন অফিসার।আমার মাকে ছেড়ে দিন।”
“ঘরে স্বামীহারা ছেলের বউকে নির্যাতন করলে কি হয় জানেন?তাছারাও সেই নারী এখন অন্যজনের বউ।আপনার মা আবার তার সম্মানহানি করার চেষ্টা করেছে।একবার সুযোগ দিয়েছি। দ্বিতীয়বার ওই নারীর স্বামী মামলা দিয়েছে।”
“কে তার স্বামী?”
“আপনাকে সেটা বলতে আমি বাধ্য নই।যদি সে মামলা তুলে নেয় আমরাও আপনার মাকে ছেড়ে দিবো”
ফরহাদ আবার জানতে চাইলো, “আপনি বলেন কে মল্লিকা ভাবির স্বামী?আমি ওনার সাথে কথা বলে ব্যপারটা মীমাংসা করার চেষ্টা করবো”
“মাহরুর ইবনাত ”
সরাসরি জবাব দেয় রেদোয়ান।ফরহাদের কপাল কুঁচকে আসলো।নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় শুনেছে কোথায় শুনেছে এটা ভাবতে কিছু সময় নিলো। চট করে পিত্তি জ্বলে উঠে।সেতো মল্লিকার চাচাতো ভাই। ফরহাদ উঠে দাড়ায়। রেদোয়ান এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।রাস্তায় দাড়িয়ে ভাবতে লাগলো কি করবে?
দরজায় টোকা পড়লে মাহরুর চেচিয়ে জানতে চায়, “কে?”
“আমি…ফরহাদ”
ফরহাদ নাম শুনে মল্লিকা উঠে দাড়ায়।বসে বসে মেয়েকে পড়াচ্ছিলো।সে চেনে তাকে। মাহরুরকে একটু দ্বিধায় মনে হলো। তারপরই এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। ফরহাদসহ আরো দুজন পুরুষ দাড়িয়ে।
“আপনার পরিচয়?”
“আমি ফারহান ভাইয়ের ছোট ভাই”
পুরোপুরিভাবে চিনতে পারে মাহরুর।গেট খুলে দিলো। ফরহাদসহ বাকি দুইজন পুরুষ ঢুকে পড়ল। মল্লিকাকে চোখের ইশারায় সরে যাওয়ার আদেশ দেয় মাহরুর। মল্লিকাও মিষ্টিকে নিয়ে সরে গেলো।
মুখোমুখি বসে মাহরুর জানতে চাইলো, “বলেন”
“আপনি বুঝতেই পারছেন আমি কেনো এসেছি।”
“হ্যা বুঝেছি”
“দেখেন আম্মা যেটা করেছে অনেক বড় ভুল।সত্যি বলতে আমরা কেউই চাইতাম না মল্লিকা ভাবি আমাদের সাথে থাকুক।”
“এখন নেই।তারপরও আপনার মা আমার স্ত্রীকে এতগুলো মানুষের সামনে অপমান করেছে।”
ফরহাদ দৃষ্টিনত করে বললো, “বয়স হয়েছেতো তাই মাথাটা কাজ করে না আম্মার।”
মাহরুর তুচ্ছ হাসে।বলে, “এটা বয়সের দোষ না ভাই।”
“যা হয়েছে বাদ দেন।শেষ ভুল বলে ক্ষমা করে দিন।আগামীবার এমন কিছুই হবে না।আমি গেরান্টি দিচ্ছি।মামলাটা তুলে নিন।এই টাকাটা রাখেন।” ফরহাদ একটা মোটা খাম এগিয়ে দিল।
ভ্রূদ্বয়ের মধ্যিখানে গাঢ় ভাজ পড়লো মাহরুরের। এমনেতেই নিজের জোরে একা আসেনি।সাথে দুজন পুরুষ আর টাকার জোর এনেছে। মাহরুর মুখ শক্ত করে বললো,
“আপনার প্রথম কথাগুলোর জন্য আমি একবার ভেবে দেখতাম।কিন্তু আপনি যে শেষে আমাকে টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করলেন?আমার মত বদলে দিলেন।”
“এটা কেমন কথা!টাকা সবার প্রয়োজন।”
“আমি টাকা নিয়ে মামলা তুলে দিবো?এতটা লোভী মনে হয় আমাকে।”
ফরহাদ মাহরুরকে খোঁচা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরের চারপাশ চোখ বোলায়।দেখা শেষে হতাশ ভাবভঙ্গি দেখা গেলো তার মুখে।এবার ফরহাদও শক্ত ভঙ্গিতে বললো,
“মামলাটা তুলে নিন”
“ভেবে দেখবো”
ফরহাদ উঠে দাড়ায়।বলে, “অনেক দেমাগ আপনার!”
ভাবলেশহীন মাহরুর বলে উঠলো, “দেমাগ না। ব্যক্তিত্ব;আত্মসম্মানবোধ।টাকা আর সাথে দুয়েকজন মানুষ এনে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা আপনার ব্যক্তিত্ব।ঠিক তেমনই”
উত্তরটা পছন্দ হয়নি ফরহাদের।চোখে মুখে হলকা ক্রোধের আভাস দেখা গেলো।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চলে গেলো সেখান থেকে। ফরহাদ চলে যেতেই বেরিয়ে আসে মল্লিকা।এসেই বরাবর দাঁড়ালো মাহরুরের সামনে।
বললো, “আপনি আজও রেগে?”
রাগ টাগ কিছুই নেই।এমন অনেকে এসেছে।অনেকে আসবে।অভাবের সংসারে হতাশা দেখিয়ে সাহায্যের নামে অপমান করবে।কিন্তু মনে হলে এই মুহূর্তে মল্লিকাকে বিরক্ত করা উচিত।
বললো, “রাগ করবো নাতো কি?ওই লোক আমাকে টাকার বাহাদুরি দেখাতে এসেছে।আমার আত্মসম্মানে লেগেছে!”
“আমি ক্ষমা চাইছি তাদের হয়ে”
এতক্ষন মিছেমিছি রাগ দেখালেও এবার সত্যি রাগ হলো। মাহরুর বললো, “তুই ক্ষমা চাচ্ছিস কেনো?”
“আমার কারণেইতো হচ্ছে সব।আমিও ওই পরিবারের একজন ছিলাম।ওই সুবাদে এই দায়ভার আমারও।”
মন বলছে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে। নেহাত মিষ্টি সামনে। মাহরুর দাতে দাত চিবিয়ে বললো, “তোর সাথে হিসেব নিকেশ রাতে হবে”
___
নতুন নতুন জায়গায় সিভি ড্রপ করছে মাহরুর।নিজের যোগ্যতার সাথে যায় এমন সব জায়গায়।রেদোয়ান এর ল্যাপটপে বসে কাজটি সেরে ফেললো।আজ শিরীন দাওয়াত করেছে।অফিস থেকে সবে ফিরলো মাহরুর।রেদোয়ান এর অফ ডিউটি।নানান আলোচনায় মগ্ন পুরুষ দুজনেই। বাচ্চারা খেলছে।মল্লিকা শিরীনের সাথে রান্না ঘরে তাকে সাহায্য করছে রাতের খাবারের জন্য।
মাহরুর বললো, “আমি চাইছি চাচা চাচীকেও ঢাকা আনবো।”
বুদ্ধি খেলে গেল রেদোয়ান এর মাথায়।বললো, “মাহি একটা আইডিয়া আছে।”
“কি?”
“চাচা চাচী ঢাকা আসলে তারা যেই বাড়িটায় থাকেন সেই জায়গাটা ভাড়া দিয়ে দেক।সাথে তোমাদের বাড়িটাও। এতে করে আলাদা ইনকাম হবে। তোমারও সুবিধা।তুমি যেহেতু পিতৃ ভিটা বিক্রি করতে চাও না। ভাড়া দিয়ে দেওয়াই ভালো।”
মাহরুরের কাছে ভালো লাগলো বুদ্ধিটা।তারপরও বললো, “আমাদের গ্রামটা বেশিই ভিতরের দিকে।ভাড়া আর কতই বা হবে?”
“যতই হোক মাহি।তোমাদের সংসারে কি এত খরচ?তাছারাও তুমি নতুন চাকরি খুঁজছো।আমার বিশ্বাস পেয়ে যাবে।”
মাহরুর মাথা দোলায়।দুহাতে খাবারের বাটি নিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে আসলো শিরীন।বাচ্চাদের একে একে ডেকে নিলো। সর্বশেষে ডাক পড়লো রেদোয়ান আর মাহরুরের।খাবার তৈরি খেয়ে নিবে।খাবার টেবিলে বসেও পুরুষের আলাপের শেষ নেই।শিরীনের ঝাঁঝালো গলায় থেমে যায় দুজনেই। মাহরুরের চোখ পড়ে মুখোমুখি বসে থাকা চন্দ্রের উপর।একহাতে খাচ্ছে অন্যহাতে গলার চেইন টানছে।এই মেয়েটাকে দেখলেই প্রেম প্রেম পায়।ইচ্ছে হয় সারাদিন জড়িয়ে বসে থাকুক। নিতান্তই ছেলে মানুষী।এই বয়সে এসব মানায়?বয়সের তোয়াক্কা না করেই টেবিলের নিচ থেকে পা এগোয় মল্লিকার পায়ে। আকষ্মিক পায়ে পা পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো মল্লিকা।
শিরীন বললো, “কি হলো তোর?”
বোকা বনে থাকা মল্লিকা আমতা আমতা করে বলল, “নাহ কিছুনা।”
ততক্ষণে বোধগম্য হয়েছে মল্লিকার এই পায়ের মালিক কে হতে পারে।তার সামনে বসে শীতল দৃষ্টি ছড়ানো মাহরুরের।খাওয়ার মাঝেমাঝেই দৃষ্টি তুলে তাকাচ্ছে।বিশাল পায়ের পাতা দিয়ে পৃষ্ট করে রেখেছে মল্লিকার পা।এই দৃষ্টির অর্থ কি?কিছু বলতে চায়?নাকি অযথাই?ভাই আর মল্লিকার এরূপ চোখে চোখে প্রেম দেখে মিটিমিটি হাসলো শিরীন।
বললো, “আজ কিন্তু তোমরা থাকছো এখানে।তাই না মিষ্টি?”
মিষ্টি সর্বদা প্রস্তুত।সুমাইয়া,সায়মনের সাথে ভালো খাতির জমেছে।কিন্তু বেঁকে বসে মাহরুর।বলে, “আমার অফিস আছে শিরীন”
“থামো কালকে সারাদেশে সরকারি ছুটি।তোমার কিসের অফিস শুনি?”
মাথায়ই ছিলো না কথাটা। মাহরুর তারপরও উপায় খুজেঁ না করার।সে থাকতে চায় না।শিরীন কোনো কথাই শুনলো না।যেহেতু বলেছে রাখবে রেখেই ছাড়বে।নতি স্বীকার করে মাহরুর। তবে বিপত্তি বাঁধে এক জায়গায়। মাহরুরকে এক ঘরে একা ফেলে রেখে অন্যঘরে বাচ্চাদের নিয়ে গেছে শিরীন।সাথে মল্লিকাও আছে।রেদোয়ান এর নাইট ডিউটি।সে খাওয়া দাওয়া শেষে চলে গেছে।পুলিশের সরকারি ছুটি হয়না।বন্ধের দিনগুলোতে তাদেরই কাজ থাকে বেশি। দশ মিনিট,আধ ঘন্টা থেকে পুরো এক ঘন্টা হতে চললো।তাদের আড্ডার শেষ নেই।কি এমন পুরোনো যুগের ঝুড়ি খুলে বসেছে?কতক্ষন অপেক্ষা করা যায়?বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো।পা বাড়ায় শিরীনের ঘরের দিকে।দরজা দিয়ে উকি দিতেই দেখলো লুডো খেলায় ব্যস্ত তারা।দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মাহরুরের দিকে চোখ পড়ে শিরীনের।
গলা উচু করে জানতে চায়, “কি চাই?”
“বউ চাই” কথাটি ঠোঁটের ডগায় এসে বসে আছে।বোনের সামনে কি নির্লজ্জ হওয়া যায়?গলা পরিষ্কার করে বললো,
“চন্দ্র আর মিষ্টি ঘুমাবে না?এখনও আসছে না যে?”
“না ওরা আজকে এখানে ঘুমাবে।আমার সাথে”
মাহরুর নিজেকে সামলাতে পারলো না।বললো, “এটা কেমন কথা!”
মাহরুরের গলার স্বরে গোলগোল চোখে চাইলো মল্লিকা। শিরীন নিজের হাসি থামানোর চেষ্টা করতে চেয়েও পারলো না।ভাইকে লজ্জা দিয়ে হেসেই ফেললো।
মাহরুর নাক ফুলিয়ে বললো, “আমি গেলাম ঘুমাতে।”
শিরীন মিষ্টির উদ্দেশে বললো, “মা আজ সুমাইয়া আপু, সায়মন ভাইয়া আর মনির সাথে ঘুমাবে?তোমায় গল্প শুনাবো।”
“হ্যা মনি।কিন্তু মা?”
মিষ্টির প্রশ্নের উত্তরে শিরীন বললো, “তোমার মাহি মামার মাথা ব্যথা।তোমার মা মামাকে ওষুধ দিয়েই চলে আসবে।তুমি থাকবে আমার সাথে?”
“মামা না বাবা।মাহি বাবা।আমি থাকবো মনি।মা তুমি বাবাকে ওষুধ দিয়ে আসো।”
বাবা ডাক শুনে ঠোঁট চেপে হাসে শিরীন। বুলিটা ভালোমতই জব্দ করেছে মিষ্টি।মিষ্টির গাল চেপে চুমু বসিয়ে দেয় শিরীন।
মল্লিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “যা রেগে যাবে নাহয়।”
“বুবু আমি এখানেই থাকি?”
“চুপচাপ ঘরে যা। মিষ্টিকে দেখছি আমি।দুই দুইটা বাচ্চা একা হাতে মানুষ করেছি। পারবো না তোর মনে হয়?”
“কিন্তু বুবু।”
“যাতো চন্দ্র”
পা টিপে টিপে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়ায় মল্লিকা।দরজা ভেড়ানো।ভেতরে সম্পূর্ণ অন্ধকার।ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় মাহরুরকে কোথাও খুঁজে পেলো না।দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে আসে মল্লিকা। আধাঁরে চোখদুটো খুঁজতে লাগলো মাহরুরকে।ঝড়ের গতিতে এক শক্তপোক্ত হাত উড়ে এসে মল্লিকাকে ভেতরে টেনে নিলো।দরজা বন্ধ করেছে। সিটকিনি লাগিয়ে মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় মাহরুর।অতি নিকটে।দেয়ালের সাথে পিঠ ছুঁই ছুঁই মল্লিকা মাহরুরের নিঃশ্বাস চিনতে ভুল করলো না।
রাশভারী গলায় আদেশ আসলো, “চুল খোল ”
“কিহ্!”
“চুলের বাধন খুলতে বলেছি”
মল্লিকাকে কোনো প্রতিক্রীয়া করতে না দেখে নিজেই হাত বাড়ায়।খোঁপা খুলে দিল একটানে।ঠান্ডা হাত ঘাড় বেয়ে মাথায় উঠে গেল দ্রুত।সঙ্গেসঙ্গে মুঠ করে ধরেছে। শক্তি প্রয়োগ করলে মল্লিকা মৃদু আর্তনাদ করে উঠে।
মাহরুর মুখটা মল্লিকার মুখের আরও কাছাকাছি এনে বললো, “খুব শখ না আমার কাছ থেকে দূরে পালানোর?বাড়িতে থাকলেও ধরা দিস না।এখানেও!সাহস কি করে হলো আমাকে ফেলে অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করার?”
“বুবু বলেছে”
“বুবু বলেছে?তোর নিজের বুঝ শক্তি নেই?বুঝিস না আমাকে সময় দেওয়া উচিত তোর?সারাদিন অফিস করি।বিকেলে বাড়ি ফিরলে তোর কাজের শেষ থাকে না।সারাদিন অযথা হাড়ি পাতিল নিয়ে ঘষামাজা করিস।রাতে সময়টুকু পাই না।পড়ে পড়ে ঘুমাস।আমি তোকে চাই চন্দ্র এটা মাথায় ঢুকে না তোর?”
কম্পিত গলায় মল্লিকা উত্তর দেয়, “আগামীবার থেকে খেয়াল রাখবো”
“তুই এমন কেনো করিস? বলনা চন্দ্রমল্লিকা?আমাকে ভালো লাগেনা?”
নত চোখ তুলে দিলো মাহরুরের মুখপানে। ভীষন অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ ঠিক নেই।মল্লিকা নিচু গলায় বললো,
“আমার বারবার মনে হয় আমি কোনো অপরাধ করেছি।আবার বিয়ে করে মিষ্টির বাবার সাথে অন্যায় করছি নাতো?”
ব্যথিত হলো মাহরুরের হৃদয়।তবে নিজেকে সামলে নেয়।তাদের বর্তমানে তাদের দুজনের অতীত আসবেই।আজ মিষ্টির বাবা এসেছে। কাল হিরা আসবে।একটা অদৃশ্য বাঁধা থাকবে। মাহরুর নিজের সুবুদ্ধির ব্যবহার করে মাথা ঘামালো না এই বিষয়ে। পাজাকোলে তুলে নিলো তার চন্দ্রকে।দাড়িয়ে যেনো ক্লান্ত সে। মল্লিকাকে বিছানায় বসিয়ে কোলে মাথা পাতলো।
আস্তেধীরে বলতে লাগলো, “কোনো অন্যায় করছিস না।অন্যায় হতো যদি মিষ্টির বাবা বেঁচে থাকতো।আমারও অন্যায় হতো যদি হিরাকে আমি নিজে তালাক দিতাম।আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয় অন্য পাঁচটা সম্পর্কের মতন।কিন্তু আমরা চাইলেই পারবো।কেউ এই সত্য খন্ডাতে পারবে না ফারহান মিষ্টির বাবা।আর হিরা আমার ছয় বছরের সঙ্গিনী ছিলো।কিন্তু জানিস চন্দ্র ওই সম্পর্কে ভালোবাসা ছিলো না।সত্যি করে বল ফারহান তোকে ভালোবাসতো?”
পুরোনো স্মৃতির কথা মনে পড়লেই আত্মা কেপে উঠে।ফারহানের মল্লিকার প্রতি অনীহা,খারাপ আচরণ মনে করতে চেয়েও করলো না।মৃত মানুষের প্রতি কিসের আক্ষেপ?মল্লিকার নীরবতা বুঝলো মাহরুর।
বললো, “জীবন আমাদের পরীক্ষা নিয়েছে চন্দ্র।অনেক কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে।অতীতের কিছু স্মৃতি বহন করেই জীবনে এগোতে হবে।তোর কি মনে হয় আমার মনে হয় না আমি অন্যায় করছি?কিন্তু যে অন্যায় করেছে;দেখ তাদের কোনো আক্ষেপ নেই।তারা দিব্যি আছে।তাহলে আমরা কেনো পিছিয়ে থাকবো।তুই,আমি, মিষ্টিও ভালো থাকবো সুখে থাকবো।”
উঠে বসে মাহরুর।গলার করুনতা কাটিয়ে শীতল কন্ঠ টানে।বলে,
“বাদ দে পুরোনো কথা।আমার দিকে মনোযোগ দে দেখি?”
মল্লিকা একবার তাকায়।আবার চোখ নামায়।তাকিয়ে থাকা দায় মাহরুরের চোখে।লজ্জাবতী গাছের মতন নেতিয়ে থাকে তার সান্নিধ্যে। মাহরুর হুট করে কাছে এসে নাকে নাক ঘষে দেয়।
গভীর গলায় বলে, “তোর লজ্জা আমাকে জ্বালায়।”
সাহস নিয়ে মল্লিকা বললো, “আপনি অনেক বদলে গেছেন।”
নেশা ধরে কাছে আসলে।চন্দ্রের দেহে মাতাল করা সুভাষ রয়েছে।বুকে এসে বিধে।বেহায়া চাওয়া পাওয়া টেনে নিয়ে যায়।মল্লিকার কথার জবাবে কপালে সরু অধরের স্পর্শ উপহার দেয় মাহরুর।আর কোনো কথা শুনতে ইচ্ছুক নয় মল্লিকার মুখে।তাকে নির্লিপ্ত করতেই এই পন্থা।দুরুদুরু বক্ষস্থল কাপছে। শীতলতা শিরদাঁড়া বেয়ে চলছে মল্লিকার।পেছনে ঢলে যায় বারবার।তার দুটো হাত আবদ্ধ মাহরুরের এক হাতে।
অশান্ত চন্দ্রের উদ্দেশে মাহরুর বলে উঠে মাতাল গলায়, “আমার ছোঁয়ায় অস্থির হচ্ছিস কেনো?এই ছোঁয়াতো তোর পরিচিত”
এমন কথায় মল্লিকা চটজলদি ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলো, “কি বলছেন?আপনি কবে ছুঁয়েছেন আমায়?”
মাহরুর ঘাড় বাঁকায়।বলে, “মিষ্টির বাবা স্পর্শ করেনি তোকে?”
মাহরুরের কথায় চুপ বনে গেলো মল্লিকা।দুটো স্পর্শই ভিন্ন।মিষ্টির বাবার স্পর্শে কোনোদিন ভালোবাসা অনুভবই করতে পারেনি সে।অন্যদিকে মাহরুর হাওয়ায় ভাসায় তাকে। বাকশক্তি কেড়ে নেয়।উত্তর মাহরুরও জানে।
মাহরুর বলে উঠলো,
“আমিও অন্য নারীকে ছুঁয়েছি।তোকেও ছুঁয়েছে অন্য পুরুষ।সেই ছোঁয়া তখন পবিত্র ছিলো।এখন আমার ছোঁয়া পবিত্র মন থেকে অনুভব করবি চন্দ্র।বিরক্ত বোধ করলে চলবে না।তোর আশপাশ এখন সম্পূর্ণ আমাকে ঘিরে হতে হবে চন্দ্র।তোকে আর তোর মেয়েকে আমি সামলে নিবো।”
হাতের স্পর্শে চুলগুলো সরিয়ে নেয় মল্লিকার মুখের সামনে থেকে। চন্দ্রের শুভ্র মুখ দর্শনে বাঁধা দিচ্ছিল।ভিন্ন তার দৃষ্টি। মাহরুরের মুখটাও নজর এড়ায়নি মল্লিকার।এলোমেলো ছোট চুলগুলো ঝাঁকড়া বেধে কপালে নুয়ে আছে।আগের থেকে স্বাস্থ্যবান হয়েছে মাহরুর।ঠোঁটগুলো বাদামী। মাঝেমধ্যে ধূমপান করায় এই অবস্থা।মল্লিকা তার নির্লজ্জ চোখদুটো সরায় মাহরুরের ওষ্ঠ থেকে।
“আজ মিষ্টি নেই সাথে।তোর ভয় করছে না?আমিতো পাগল!যদি অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়ি?কি করবি? কোথায় পালাবি?”
“আমি..আমি ঘুমাবো ”
নিঃশব্দে হাসলো মাহরুর। বোকার মতন কথাবর্তা বলে এই মেয়ে।বয়স যথেষ্ট।সাথে এক বাচ্চার মা।এখনও এত জড়তা কথায়? পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে জানেনা।
“শোন?”
“হুম?”
“শাড়ি পড়বি এখন থেকে।”
“আচ্ছা”
আচ্ছা?আচ্ছা বলেই শেষ! শাড়িটা পাবে কোথায় এটাও জানতে চাইলো না। মাহরুর নিজেকে শান্ত করে। লম্বা শ্বাস টেনে ছেড়ে দেয়।বিছানার ডান দিকে সোজা হয়ে শুয়ে একহাত ছড়িয়ে রাখলো।অন্যহাতে মল্লিকাকে টেনে পাশে শুইয়ে দিলো। খুব যত্নে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“পুরোনো প্রেম নতুনভাবে ধরা দিচ্ছে। তুইও ডুব দিবি এই রুপসাগরে।শুধু একটু সময়ের ব্যাপার চন্দ্র।ধীরেধীরে নিজেকে তোর মধ্যে মিশিয়ে নেবো।তুইও জানবি মাহরুরের ভালোবাসার গভীরতা কতটুক”
চলবে…