চন্দ্র’মল্লিকা ১৯
লেখা : Azyah_সূচনা
মাসের শুরু।নতুন মাসে স্কুলে ছুটেছে মাহরুর।পাশেই মল্লিকা। সম্পূর্ণ বোরকায় আবৃত।অন্য পথে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে ভর্তি করতে।অফিস থেকে আজও অর্ধেক দিনের ছুটি নিতে হলো।মিষ্টিকে স্কুলে ভর্তি করানোটাও জরুরি।রেদোয়ান এর সাহায্যেই বাড়ির পাশে স্কুলের সন্ধান পেয়েছে।মিষ্টির সাথে নানান গপ্পো করতে করতে এগিয়ে গেলো।মল্লিকা তাদের দুজনের দিকে চেয়ে।তাদের মধ্যে মনে হলো মল্লিকার কোনো উপস্থিতিই নেই এখানে।তারা তাদের মতন মগ্ন।
হেডমাস্টার এর রুমে বসে আছে দুজনই।তিনি আসবেন হালকা নাস্তা শেষে। দশ পনেরো মিনিট সময় নিয়ে আসলেন।সালাম জানিয়ে আলাপ আলোচনার শুরু হয়। মাহরুর সাবলীলভাবে সামলে নিচ্ছে।কথার ধাঁচ দেখে মল্লিকার চোখে অত্যন্ত শিক্ষিত আর সুন্দর বাচনভঙ্গির দেখা মেলে।কি সুন্দর করে কথা বলছে! মাহরুরের পরিবর্তে মল্লিকা থাকলে আমতা আমতা করতে করতেই দিন পাড় হতো।
“দেখেন বছরের মাঝে এভাবেই কাউকে ভর্তি করানো যায় না।রেদোয়ান আমাদের পরিচিত মানুষ।যেহেতু বাচ্চাটা বাসায় পড়া এগিয়ে রেখেছে।আমরা ওকে একটা সুযোগ দিবো।”
স্কুলের হেডমাস্টার বলেই পিয়নকে ডাকলো। ভর্তির একটা ফরম পূরণ এর জন্য ফরম আনতে বললো।মিনিট পাঁচেকে সেও ফরম নিয়ে হাজির। মাহরুর কলম নিয়ে ফরমের সকল শূন্যস্থান পূরণ করে নিলো।আটকে গেলো একজায়গায়।বাবার নামে। মল্লিকাও তার থেমে যাওয়া লক্ষ করে।চোখ রাখলো কাগজটিতে।কলম নিপ বাবার নামে আটকে। প্রশ্নবিত্ত চোখ মল্লিকারও।সেও দেখতে চায় মাহরুর এই পরিস্থিতিতে কি করে?
সময় নিচ্ছে মাহরুর।আবারো হাত চালালো। ফারহান সরোয়ার নামটা লিখতে নিলে মল্লিকা থামিয়ে দিলো।চোখের ইশারায় কিছু বোঝাতে চাইছে। মাহরুর একবার হেডমাস্টারের দিকে চোখ রেখে ধীর গলায় মল্লিকাকে বললো,
“পরবর্তীতে সমস্যা হবে।ওর বার্থ সার্টিফিকেটে ফারহান এর নাম।”
“ওর বার্থ সার্টিফিকেটই নেই।”
অবাক হয় মাহরুর।এই বয়সে এসেও তার বার্থ সার্টিফিকেট নেই? হেডমাস্টার উঠে গেলো কিছু কাজে।তাদের বলে গেছে ফরম ফিলাপ করে রেখে যেতে। মাহরুর বললো,
“চন্দ্র? মিষ্টির উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার ওর বাবার।সে এখানে উপস্থিত থাকুক না থাকুক।তার রক্ত বইছে তোর মেয়ের দেহে।এই সত্যি তুই আমি আমাদের ভালোবাসা কেউ খন্ডাতে পারবে না।আমি রাজ্যের সমস্ত সুখ ওকে এনে দিলেও তার স্থান দখল করতে পারবো না।সে না থাকুক তার নামটা থাকুক।তোর মেয়ে বড় হয়ে জানুক তার দুই দুইটা বাবা।একজন যে তাকে জন্ম দিয়েছে আরেকজন পালন করেছে।সে যেমন মানুষই ছিলো না কেনো তার জীবনে।মিষ্টির মনে তার জন্য কোনোদিন যেনো ঘৃনা না জন্মায়।”
নিষ্পলক চেয়ে রইলো মল্লিকা মাহরুরের দিকে।বোঝানোর সুন্দর ভঙ্গি।অবুঝ মানুষের মস্তিষ্কেও খুব সুন্দরভাবে গেঁথে যাবে।
শেষে মাহরুর হেসে বলতে লাগল,
“দ্রুত জানা কি করবো?এক জায়গায় দুইটা বাবার নাম দেওয়া যায়না।”
“আপনি ওনার নামই দেন”
অবশেষে শূন্যস্থান পূরণ হলো।বাবার নামের জায়গায় ‘ ফারহান সরোয়ার’ নামটি বসেছে।এসব কাগজে জায়গা চায় না মাহরুর।তাদের অন্তরে জায়গা চায়। মিষ্টিকে স্কুল ঘুরিয়ে দেখিয়ে বাহিরে আসে।
মল্লিকাকে প্রশ্ন করলো, “তুই তখন আমাকে থামালি কেনো ফারহানের নাম লিখতে?”
“আমি ভেবেছিলাম আপনি কষ্ট পাবেন।”
“আমি কষ্ট পেলে আপনার কিছু আসে যায়?”
নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রন নেই। মাহরুরের ডাকে শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে।এইযে আপনি ডাকটা?নতুন!সম্পূর্ণ নতুন। মল্লিকাতো ডাকে অভিমানে।পুরোনো জমানো অভিমানে। মাহরুর ডাকে আদুরে।ডেকে ডেকে আকর্ষিত করে নিজের দিকে।তার প্রশ্নটাও তেমনি। খোঁচা দেওয়া। হাঁটতে হাঁটতে একটি পার্কে এসে থেমেছে।সামনেই বাচ্চাদের খেলার জায়গা।প্রথমে কিছুক্ষন বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নেবে বলে ভেবে নিলো। কাঠের বেঞ্চির দুই দ্বারে মাহরুর মল্লিকা। মধ্যিখানে মিষ্টি।খেলতে যাওয়ার বায়না থামাতে হাতে চিপসের প্যাকেট ধরিয়েছে।এর মধ্যে একটি বাচ্চা এগিয়ে এলো। হাতে ফুলভর্তি বালতি নিয়ে। জোরাজুরি করতে লাগলো ফুল কিনার জন্য। মাহরুর একবার মল্লিকার দিকে চায়।মহারানী ব্যস্ত আকাশ বাতাস দেখতে।
বাচ্চার কাছ থেকে দুটো ফুল কিনে মল্লিকাকে শুকিয়ে মিষ্টির উদ্দেশ্যে বললো, “জানিস মিষ্টি এই ফুলগুলোর নাম কি?”
“কি মামা?”
“এই ফুলগুলোর নাম চন্দ্রমল্লিকা।তোর মায়ের সাথে মিলে গেলো দেখি?”
মিষ্টির মুখে উৎসাহ দেখা দেয়।মায়ের নামের ফুল।মাকে ডেকে বললো, “মা দেখো তোমার নামের ফুল”
মল্লিকা চেয়েছে।লাল,সাদা চন্দ্রমল্লিকা ফুলের দিকে। মাহরুর মিষ্টির হাতে ফুলগুলো ধরিয়ে বললো, “আমার আর তোর পক্ষ থেকে তোর মাকে এই ফুলগুলো দে।”
মিষ্টি একই উৎসাহের সাথে মায়ের দিকে ফুল এগিয়ে দেয়।মল্লিকা মিষ্টি হেসে গ্রহণ করলো।মিষ্টি এবার মাহরুরের দিকে চেয়ে বলল,
“আমার নামের ফুল নেই মামা?”
“আছেতো!”
পিছনে লুকিয়ে রাখা লাল গোলাপটা বের করে আনলো। মিষ্টির চোখের আড়ালে রেখেছিলো।মেয়ের মাকে ফুল দেবে।আর মেয়েকে দেবে না তা কি হয়?
গোলাপ ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “এই ফুলের নাম মিষ্টি গোলাপ।নে”
দুজনের মুখেই বিশাল হাসি। মিষ্টিকে জড়িয়ে মাথায় মাথা ঠেকায়।অধীর চোখদুটো চন্দ্রের ফুলে মনোযোগী মুখটা দেখতে থাকলো।হাতড়ে দেখছে।যেনো ভুলকেও চন্দ্রের নরম হাত আদর করতে ব্যস্ত।সুখ দেয়।ভীষণ শান্তি দেয় এই মুখটা। ইশ!আগে যদি এভাবেই খেয়াল করতো চন্দ্রকে?
প্রেমিক অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে একটি বাক্য প্রস্ফুটিত হয়, “সুন্দর লাগে তোকে”
“হুম?”
মাহরুর মাথায় দোলায়।হেসে বলে, “কিছু না”
“আচ্ছা”
“চল কিছু খাবি।আমার আবার অফিসে যেতে হবে।”
খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুঁকেছে। মাহরুর সে বাড়িতে থাকে সেখানে দুটো সিড়ি।একটা সরাসরি ছাদ অব্দি যায়।আরেকটা বাড়ির ভেতর দিয়ে। মাহরুর সর্বদাই পাশের সিঁড়িটা ব্যবহার করে।নানান মানুষের নানান প্রশ্ন হবে।জানতে চাইবে মল্লিকার সম্পর্কে।আগে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটাতো সুস্থ করুক!তারপর নাহয় ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানানো যাবে সবাইকে। মিষ্টিকে ঘরে বসিয়ে দরজা বন্ধ করতে আসে মল্লিকা।
মাহরুর ঠিক গতবারের ন্যায় মাথা বেকিয়ে বলে, “আসি?”
মল্লিকা বরাবরের মতো উত্তর দিল, “জ্বি খোদা হাফেজ”
___
আজাদ এসে হাজির বাগানবাড়িতে। বাড়ির বাজার আর টুকটাক কাজ সেই করে এখানে।আজকাল রেহালার কোমড় ব্যথা বেড়েছে।বাড়বেই না কেনো?ঘরের সব কাজ যে নিজেরই করতে হয় এখন।বিনা বেতনে যে চাকরানী ছিলো সেতো চলে গেছে। মৌ এর সাহস বেড়েছে আগের চেয়ে। কথায় কথায় পুলিশের হুমকি দেয়।
কোমর চেপে নিচু হয়ে এগিয়ে আসলেন রেহালা বেগম।বললেন, “কি কি বাজার আনছোস?”
“আপনি যা যা কইছেন সব আনছি”
“আচ্ছা রাইখা যা।”
আজাদ আমতা আমতা করে বলল, “খালা একটা কথা কইতাম”
“ক”
“ভাবিরে দেখলাম।ঐযে হের চাচাতো ভাই আছে না মাহি? হের লগে!কি সুন্দর পার্কে ঘুইরা বেড়াইতাছে।”
রেহালা বেগম যেনো ব্যথা ভুলে গেলেন। তরতাজা হয়ে উঠেছেন।জানতে চাইলেন, “মাহির লগে ঘুইরা বেড়ায়?”
“হ। মিষ্টিরেও দেখছি।দেইখা মনে হইলো ওরাই জামাই বউ।আর আমগো মিষ্টি হেরই মাইয়া।কোলে কইরা ওরে বাচ্চাগো খেলনায় খেলাইতাছিলো।”
রেহালা বেগম কপাল কুঁচকায়।এদিক সেদিক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ভাবনা চিন্তায় পরে গেলো দাড়িয়েই।আজাদ তার মুখপানে চেয়ে।
রেহালা বেগম এক পর্যায়ে বললেন, “এক কাম কর।রহিম মিয়ার বাড়ি আছে না?ওই বাড়ির পাঁচ তালায় থাকে ওই পোলা। একটু নজড় রাখিসতো।আমারে জানাবি আইসা।”
“আচ্ছা খালা।”
আজাদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে বললেন,
“আর শোন এই টাকা রাখ।আমি যে নজর রাখবার কইছি এটা যেনো কেউ না জানে।ওই মাহি পোলাটাও জানি সন্দেহ মা করে।মিষ্টির মায়রে আবার দেখলে কইবি আমারে।”
___
মিষ্টির হাতে থাকা ফোনটা শশব্দ করে বেজে উঠলো।ভয় পেজে উঠেছে সেও।এক ঝটকায় পাশে ছুঁড়ে মারে।মেয়ের শঙ্কিত মুখ দেখে মল্লিকা কাটাকুটি বাদ দিয়েই দৌড়ে আসে।একদিকে ফোন বাজছে।অন্যদিকে মিষ্টি ভীষণ রকমের ভীত।সময়ের ব্যবধানে মেয়েকে সামলাতে পারলেও ফোনটাকে সামলানো গেলো না।কর্কশ আওয়াজে বেজেই চলেছে। অবশেষে ফোন হাতে নেয় মল্লিকা।নাম ভাসছে ‘ মাহরুর ‘।
ফোন তুলতেই অন্যপাশ থেকে আওয়াজ আসে, “কি কথা ছিলো চন্দ্র?”
“কি?”
“ফোন করিস নি কেনো আমাকে?তোকে বলেছিলাম না দুবেলা মনে করে আমাকে কল করে জানবি আমি কি করছি?”
রুষ্ট মানব তার কন্ঠ আরো বেশি রুষ্টতায় ঘেরা।তার কথামত কাজ হলো না কেনো?কেনো ফোন করে জানতে চাইলো না কিছু?কথা ছিলো বউ কম প্রেমিকার মতন আচরণ করবে।কথা রাখেনি তার চন্দ্র।
মাহরুর বলে, “অবজ্ঞা করছিস আমায়?”
“না না আপনি ভুল ভাবছেন।”
“গেট খোল”
“আপনি কোথায়?”
“দরজায় দাড়িয়ে আছি গাঁধী মহিলা!”
ফোন না কেটেই দৌড় লাগায়।এলোমেলো মল্লিকা।অনেক অমনোযোগী।এই স্বভাব নিয়ে ওই সংসার করেছে ছয় বছর?নিজেও ফোন কেটে ব্যাগে হাত রেখে দাড়িয়ে রইলো। চন্দ্র এসেছে।দরজা খুলে ঢুকতে দিল মাহরুরকে। মাহরুর ভ্রূ কুচকে তাকায় মল্লিকার দিকে।বুঝতে পারলো না মল্লিকা।বেশি বড় ভুল করে ফেলেছে?
সময় পেরোয়। মাহরুর এসে হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় আরাম করেছে।কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে রান্নার করতে উঠে যায়।সব আয়োজন করতে লাগলো।কিছু বলেনি আসার পর থেকে।মুখ গোমড়া করে আছে।মল্লিকা বুঝলো মাহরুরের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা।পাশে এসে বসে শাক বেছে দিচ্ছে।
আমতা আমতা করে জানতে চাইলো, “বেশি রাগ করেছেন?কালকে থেকে কল করবো সত্যিই”
“খুবতো প্রেম জেগেছিলো কিশোরী মনে।মানুষ প্রেমে পড়লে কি কি করে জানিস?”
“না”
“আবার উনিই আমাকে গলা বাড়িয়ে বলতো ‘ তোমাকে ভালোবাসি মাহরুর ভাই ‘।ভালোবাসা না ছাই!” মুখ ভেংচিয়ে বললো মাহরুর।
লজ্জিত বোধ করে মল্লিকা।কেমন করে?এভাবে কেউ কথা বলে।প্রেমে পড়েছিল ঠিকই। প্রেমটা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে নাকি?নিয়ে হয়েছিলো।ভুল করেই কোনোদিন স্বামীর সাথে আধ ঘন্টা শান্তিতে বসে কথা হয়েছে কিনা জানা নেই।মনে হতো সে আছে কারাগারে।আর মল্লিকা সেই কারাগারের ব্যবহার্য বস্তু।
এসব চিন্তা বাদ দিয়ে মল্লিকা সরাসরি জিজ্ঞেস করে,
“আপনি এতকিছু কি করে জানেন?”
সুযোগ পেয়ে বসে মাহরুর। ইচ্ছেকৃত জ্বালাতন করতে চায় মল্লিকাকে। রাশভারী কণ্ঠ বজায় রেখে বলে, “আমাকে তোর কি মনে হয় চন্দ্র?আমি তোর মতন বোকা? ছেলে মানুষকে প্রেম শেখাতে হয়?আমি জীবনে অনেক প্রেম করেছি।আবার ছয় বছর একজনের সাথে সংসারও করেছি।আমার কাছে এসব ব্যাপার না”
মাহরুর দুষ্টুমি করতে চায়।কিন্তু পারে না।তার চঞ্চল মানসিকতা মল্লিকার কাছে প্রকাশ পেলেই মেয়েটা আর ধরা দিবে না।একটু একটু ধমকের উপর রেখেই তাকে নিজের করে আনতে হবে।সেই সুবাদে এমনভাবেই কথাটি বলেছে যে সহজেই বিশ্বাস করে নিলো মল্লিকা।তাসের ঘরের মতন ঝনঝন করে ভেঙে গেলো বোধহয় হৃদয়। পলকহীন চেয়ে আছে মাহরুরের দিকে। মাহরুর দেখেও দেখলো না।এড়িয়ে গেলো ইচ্ছে করে।
কিছু সময় পেরিয়ে গেলে মাহরুর আবার বললো, “বোবা তুই?কথা না বলে মূর্তি হয়ে থাকিস কেনো?কিছু বললে ঝটপট উত্তর দিবি।নাহয় তোকেও আবার মিষ্টির সাথে স্কুলে ভর্তি করাবো”
অভিমানের পাড়া তরতর করে উপরে উঠে গেল।এখনই কেদে দিবে।এতবড় একটা নারীর এরকম বাচ্চামো মানায় না।তারপরও কেনো জেনো অস্রু কোনো বাধা মানলো না।গাল বেয়ে পড়ার পূর্বেই দৌড়ে পালায়। পালাবে কোথায়?জায়গা অত্যন্ত কম। চিলেকোঠার ছাদটা ছাড়া মুখ লুকানোর জায়গা নেই।
উচু দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে মল্লিকা।এখানেই তাকে দেখা যাচ্ছে না। মাহরুর খুঁজে পাবে না ভেবেই লুকিয়েছে করেছে নিজেকে দেয়ালের আড়ালে।আধাঁরে হাতের পিঠে ওই অল্পস্বল্প অস্রু মুছেই ফিরে তাকায় পাশে। মাহরুর দাড়িয়ে আছে।হাত দুটো বুকে বেঁধে।মুখে কোনো ভঙ্গি নেই।
মল্লিকা চাইতেই ভ্রূ উচু করে বলে, “কি?”
“কিছু না”
“কাঁদছিস কেনো?”
“এমনেই”
মাহরুর এগিয়ে আসে।দেয়ালে বাহু ঠেকিয়ে দাঁড়ায়।তার সুঠাম দেহের আড়ালে ঢেকে গেলো মল্লিকার অবয়ব।ছোট্ট একটা জায়গা।সিড়ি ঘরের পাশেই একটা দেয়াল।ভূতের মতন করে চেয়ে আছে মাহরুর।মুখে আবছা দেখা মিললো চরম বিরক্তি।
“আমি ঘরে যাবো”
“যা না করেছে কে?”
“না সরলে যাবো কি করে?”
“ইদুরের মতন শরীর তোর। ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যা”
মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় মল্লিকা।আজ একটু ক্রোধ দেখালো।বললো, “আপনি এমন কেনো?”
ছোট্ট করে গালে চড় পড়ে।মৃদু আর্তনাদ করতে দেখা গেলো মল্লিকাকে।এমনেতেই অতশত প্রেমের কথা বলে হৃদয়ে ক্ষত করা কম ছিল?এখন চড়ও দিয়ে বসেছে।
ছলছল চোখে মাহরুরের দিকে চাইতেই সে কঠোরভাবে জানায়,
“তুমি ডাক।”
“ঠিক আছে।এবার আমাকে যেতে দিন”
“আরো হিসেব নাকি।ঠিকঠাক মতন দাঁড়া নেতিয়ে পড়ছিস কেনো?”
“আমি ঘরে যাবো মাহি ভাই!”
“মাহরুর।পুরো নামে ডাক”
নাক টেনে টেনে বললো, “আচ্ছা মাহরুর ভাই”
আরেকদফা চড় পড়ে অন্যগালে।নাকের পাটা ফুলে ফেঁপে ওঠেছে চন্দ্রের।ঠোঁট চেপে আবার তাকায় মাহরুরের দিকে।
এখনই কান্না ঝরবে বুঝতে পারলো।আগেকার অস্রুজ্বলে ভেজা একটু মুখটা। মাহরুর নিজের দুহাত এগিয়ে দুইগাল ভালোভাবে মুছে দিয়ে নরম গলায় বলে,
“আমি তোর বর না?ভাই ডাকিস কেনো?”
চলবে…
চন্দ্র’মল্লিকা ২০
লেখা : Azyah_সূচনা
“তয় এই হইলো আসল ঘটনা!দেখছেন রহিম মিয়া?বাড়ি ভাড়া দেবার সময় খোঁজ খবর নিয়ে দিবেন না?অন্যের বউ আইনা ঘরে নষ্টামি করতাছে। আমারতো কইতেও শরম করতাছে এটা আমার ফারহানের বউ। ছিঃ!”
বাড়ির বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক রহিম মিয়া। মাহরুর বিগত পাঁচ বছর এখানে থাকে বউ নিয়ে। রেহালা বেগমের কথার ভঙ্গিতে তিনিও সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকালেন মল্লিকার দিকে। থরথর কাপছে তার সর্বাঙ্গ। মাহরুর বাসায় নেই।
রহিম মিয়া মল্লিকার উদ্দেশ্যে জানতে চাইলেন, “এই মেয়ে মাহরুরের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
মল্লিকাকে উত্তর না দিতে দিয়েই রেহালা বললেন, “ওয় কি কইবো?আমার কাছ থিকা শুনেন।এই চরিত্রহীনা আমারে পুলিশে ধরাইছে।আমি নাকি তারে অত্যাচার করি। মিথ্যে মামলা দিছে আমার নামে।এরপর নিজের আশিকের হাত ধইরা উধাও।দুইমাস পর আমগো কাজের পোলা খবর দিলো ওয় নাকি ওর চাচাতো ভাইয়ের লগে ঘুইরা বেড়ায়। বিয়াইত্যা চাচাতো ভাইরে ফাসাইছে দেখছেন কারবার?”
মল্লিকা জোর গলায় বলে উঠে, “কি বলছেন আম্মা!চুপ থাকুন দয়া করে।যেটা জানেন না সেটা নিয়ে কথা বলবেন না একদম।”
“হ তুমি নষ্টামি করবা আর আমরা কইলেই দোষ।আমার কথা শুনেন রহিম মিয়া।এই মাইয়া ওর আশিকের লগে ভাইগা যাওয়ার জন্য আমার মানহানি করছে।”
রহিম মিয়া রাগে গজগজ করে উঠলেন। মাহরুরকে ভালো ছেলে ভাবতেন তিনি। চেঁচামেচিতে পুরো বাড়ির মানুষ ছাদে জড়ো হয়েছে।একেক জন দাড়িয়ে ছিছি করছে। মাহরুরের বউ হিসেবে হিরাকেই চেনে তারা। এখন বললেও কাজ হবেনা। পরিস্থিতি হাতের নাগালে নেই।ভয়ে আড়ষ্ট মল্লিকা মনে মনে দুআ করতে লাগলো দ্রুত যেনো মাহরুর ফিরে আসে।
রহিম মিয়া এগিয়ে এসে বললেন, “এই মেয়ে মাহরুরকে বলবে আমার সাথে দেখা করতে।আর যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি খালি করবে।”
“চাচা বিশ্বাস করুন!আপনারা যা ভাবছেন তেমন কিছুই নয়।আমি সত্যি বলছি।আমি ওনার স্….”
হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয় মল্লিকাকে।বলে,
“আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলবো না। মাহরুরকে পাঠাবে।আর আপনারা সবাই যারযার বাড়িতে যান।”
একে একে সবাই চলে গেছে।মুখে পৈচাশিক হাসি নিয়ে রেহালা বেগমও প্রস্থান করেন।সে জয়ী।অপমান আর থানায় পাঠানোর প্রতিশোধ সুদে আসলে নিয়েছেন।জমিনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মল্লিকা। কেদে কেটে অবস্থা নাজেহাল।আজ শিরীন এসে মিষ্টিকে নিয়ে গেছে।এই পরিস্থিতিতে থাকলে মেয়েটার উপর কি প্রভাব পড়তো?
ঘন্টা খানেক পাড় করে মাহরুর বাড়ি ফেরে। মল্লিকাকে খুঁজতে ঘরে এসে নাম ধরে ডাকে মাহরুর। মাহরুরের আওয়াজে পিত্তি জ্বলে উঠলো।কোনদিকে না ভেবে হামলে পড়েছে বুকে।হাসবে না অবাক হবে মাহরুর বুঝে উঠতে পারলো না।
শুধু বললো, “বলেছিলাম না নিজে থেকে আসবি আমার বুকে”
তার কথার বিপরীতে পেলো মল্লিকার কান্না।ভীষণ রকমের জোরালো কান্না।যেনো বিরাট বিপদ ঘটে গেছে। চমকায় মাহরুর।মল্লিকার মুখ তুলে দেখে ভয়ঙ্কর অবস্থা।কেদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়েছে।এই কান্না স্বাভাবিক নয়।
অস্থির বিচলিত হয়ে মাহরুর জানতে চাইলো, “কি হয়েছে চন্দ্র?”
দীর্ঘ সময় নিলো মল্লিকা।কিন্তু সবটা বলেছে।কিছু মুহূর্ত আগে ঘটে যাওয়া সম্পূর্ণ বর্ণনা দিয়েছে।সবটা বলা শেষে মাহরুরের মুখের দিকে চেয়ে আরেকদফা ভয় পেয়ে উঠে মল্লিকা। রক্তচক্ষু তার।জ্বলন্ত মুখের ভঙ্গি।কপালের রগ ফুটে উঠেছে অল্প সময়ের ব্যবধানে। মুহূর্তেই অগ্নিমানবের রূপ ধারণ করলো।মল্লিকার হাত চেপে জোরেশোরে পা বাড়ায় নিচে।পাঁচ তলা থেকে দোতলায় নেমেছে।সবাইকে জানান দিয়ে। উচ্চশব্দের তার প্রত্যেকটা কদম। বাড়ির অনেক ভাড়াটিয়া দরজা খুলে দাড়িয়ে।হাতের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাঠের দরজায় আঘাত করে।একবার শব্দেই ধড়ফড় করে এগিয়ে দরজা খুলেন রহিম মিয়া।
মাহরুরকে দেখে শঙ্কিত হন।কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মাহরুর কাবিননামা এগিয়ে দেয়।হুংকার ছেড়ে বলে, “বউ আমার!কাগজে কলমে সই করে বিয়ে করেছি!আমার আগের বউ আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে।মল্লিকা আমার দ্বিতীয় স্ত্রী! কিন্তু আমার স্ত্রী।”
মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে সবার উদ্দেশ্যে আরেকদফা চিল্লায়।বলে,
“শুনেছেন!যারা শুনতে বাকি তাদের জানিয়ে দিবেন।আমরা কোনো নষ্টামি করছি না। সসম্মানে বিয়ে করে এনেছি এই মেয়েকে।আর যেই মহিলার কথা শুনে আমার স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করেছেন ওই মহিলা আমার বউকে মারধর করতো।সব প্রমাণও আছে আমাদের কাছে।সবটা না জেনে সাহস কি করে হলো আমার স্ত্রীর চরিত্রে আঙ্গুল তোলার! হ্যা!”
মাহরুর আবার বলে,
“তিলকে তাল বানানো একটা স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে আপনাদের।মানুষের সম্মানহানি করতে পেরে কি মজা পান আল্লাহ্ জানেন।আমারও ব্যক্তিগত জীবন আছে।যেহেতু আর বিষয়টা ব্যক্তিগত নেই এক কাজ করেন পোস্টার বানিয়ে এলাকায় ঝুলিয়ে দেন। মাহরুর ইবনাত দ্বিতীয় বিয়ে করেছে তাও আবার নিজের চাচাতো বোনকে। যার অলরেডি একটা মেয়ে বাচ্চা আছে।এই মেয়েটার স্বামী মারা গেছে আরো চার বছর আগে।আমি ওর দায়িত্ব নিয়েছি। আমার আগের বউও আমাকে তালাক দিয়েছে।এই প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বিয়ে কোনো পাপ নয়!আর সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন?আমি ওকে ভালোবাসি।”
মাহরুরের এই রূপের সাথে কেউই পরিচিত নয়।রহিম মিয়া নিজেও না। শিক্ষিত মানুষ। কাবিন নামাটা ভালো মতই পড়ে দেখলেন।
লজ্জিত মুখে বললেন, “আমাকে ক্ষমা করো মাহরুর আসলে ঐ মহিলা এসে এমনভাবে বললেন।আর আমরাতো তোমার স্ত্রী হিসেবে হিরাকেই চিনতাম।”
রহিম মিয়া ঝামেলাহীন মানুষ। পরিস্থিতির সাথে ব্যপারটা বুঝলেন।
মল্লিকার দিকে চেয়ে বললেন, “আমাকে মাফ করে দিও মা।”
মাহরুর কঠিন গলায় বললো, “আমরা ভাড়া ছেড়ে দিবো।”
বলে আবার টেনে নিয়ে গেল।পায়ের সাথে পা মিলিয়ে পারছে না।যাওয়ার পথে অন্য হাতে কল লাগায় রেদোয়ানকে। যেখানেই থাকুক না কেনো যেনো দ্রুত বাগানবাড়ি পৌঁছায়। মাহরুরকে দমানোর মতন সাহস নেই মল্লিকার। সিংহের রূপ ধারণ করেছে আজ।এত জেদ! বাগানবাড়ির সদর দরজায় সজোড়ে ঘুষি দিতে লাগলো।দরজা না খুললে যেনো ভেঙেই ফেলবে। রেহালা দরজা খুলেছেন।রাগে লাল টকটকে মাহরুরের মুখ দেখে ভয় পেলেন।
মাহরুর গর্জন তুলে বললো, “মহিলা মানুষ দেখে বেচে গেলেন।নাহয় আমার চন্দ্রকে লাঞ্ছিত করার দায়ে কলিজা টান দিয়ে বের করে ফেলতাম।”
“কি…কি কইতাছ!ওই ছোট বউ!ছোট বউ”
তেড়ে গেলো মাহরুর।মল্লিকা থামাতে চেয়েও পারলো না। রেহালার মুখ বরাবর দাড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে পেছনে দেখায়।মল্লিকার দিকে উদ্দেশ্য করে।
বলে, “ঐটা দেখছেন? ও বউ আমার। বিয়ে করেছি!ইচ্ছে করছে রাস্তায় নিয়ে আপনার সব কৃতকর্ম ফাঁস করে দেই।পুরা মহল্লার সামনে মান ইজ্জত ধুলায় মিশিয়ে দেই।কিন্তু কি জানেন?আমি মানুষের বাচ্চা।জানোয়ারের বাচ্চা না।”
রেদোয়ান কাছাকাছি থাকায় দ্রুত এসে হাজির। বাহির থেকেই চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনে আরো তরিহরি করে এসেছে। ভেতরের অবস্থা ভালো না।ভয়ে কাঁপছেন রেহালা। মৌও এবার একটু ভীত হলো।
রেদোয়ানকে দেখে মাহরুর বললো, “এই মহিলা ভালো কথার মানুষ না।নির্যাতন মামলার সাথে ওরে মানহানির মামলা দাও রেদোয়ান।আর যত ধরনের মামলা দেওয়া যায় যাও।ছোটোবেলা থেকে যত পাপ করেছে সব যেনো এই জীবনেই অসুল হয়।”
মল্লিকা এবার মুখ খুলে। মাহরুরের দিকে গিয়ে হাত জোড় করে বলতে লাগলো, “এমন করবেন না। দয়া করে এমন করবেন না।”
বাজখাই গলায় ধমক দেয় মাহরুর।তর্জনী আঙ্গুল দেখিয়ে বলে, “চুপ!বেশি দরদ দেখাবি তোরও খবর আছে!তোর যে সম্মানহানি হলো?তার বেলায়?মহান সাজতে চাস হ্যা?”
নিজের পায়ে আবার নিজে কুড়াল মেরেছে রেহালা বেগম। মাথায় হাত রেখে বসলেন।মহিলা কনস্টেবল আসছে।একবার সূযোগ দেওয়ায় যে এত দুঃসাহস করেছে সে সামনেও করবে।অন্যদিকে মাহরুরের এরূপ হিংস্রতায় কিংকর্তব্যিমূঢ় মল্লিকা। এমন ভয়ঙ্কর রূপও আছে তার?
___
“তোমার কাবিননামার কাগজ।আমার দরজায়ই ফেলে এসেছিলে”
রহিম মিয়া এসেছেন।রাগ আর জেদের বসে কাবিননামাটা রহিম মিয়ার ঘরের দরজায়ই ছুঁড়ে ফেলে এসেছিল।মাথা কাজ করছিলো না তখন।এখনও ঠিক নেই।গা ঘিনঘিন করে উঠে একটু পরপর।
কাবিননামা হাতে নিয়ে মাহরুর রহিম মিয়ার হাতে বাড়ি ভাড়া এগিয়ে দিল।বললো, “ভাড়াটা রাখুন।যত দ্রুত সম্ভব আমরা ঘর খালি করবো”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলেন রহিম মিয়া।টাকাটা পূনরায় টাকাটা মাহরুরের দিকে এগিয়ে দিলো। আশ্চর্য্যচকিত মাহরুর তার দিকে চায়।এরমাঝে রহিম মিয়া বললেন,
“আমার উপরে তোমার অনেক ঋণ।সেদিন তোমার চাচীরে সময়মতো হাসপাতালে না নিয়া গেলে আজ আমার ছেলেমেয়ে এতিম হইতো।আমি আমার স্ত্রী হারাতাম।হইতে পারি আমি এই বাড়ির মালিক কিন্তু তোমার ঋণ আমি সারাজীবনেও শোধ করতে পারবো না।কি জানি কি হইছিলো। মান সম্মানের কথা ভাইবা মাথা নস্ট হয়ে গেছিলো।আমারে মাফ কইরা দাও”
রহিম মিয়ার কথায় সামান্য জেদটা দমায় মাহরুর।অত্যন্ত বৃদ্ধ একজন লোক।ছেলে দেশের বাহিরে থাকে।মেয়ে বিবাহিত।দুই বৃদ্ধার সংসার।একটা আস্ত বাড়ির মালিক হওয়া সত্বেও সামান্য ভাড়াটিয়ার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে।সামান্য একটা সাহায্যের বিনিময়ে।একা স্ট্রোক করে পরে থাকা রহিম সাহেবের স্ত্রীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উপকারে তিনি আজও কৃতজ্ঞ।
মাহরুর সবিনয়ের সঙ্গে বললো, “মাফ চাবেন না চাচা।আপনি আমার বাবার বয়সের।”
“মাফ চাওয়া লাগবে।নাহয় আমি আখিরাতে ঠেকা থাকবো।কারো ইজ্জতহানি কইরা ক্ষমা না চায়াই যদি দুনিয়া ছাড়ি এই গুনাহ আমার লগে যাইবো।জবাব দিতে হইবো।”
“আচ্ছা চাচা আমি ক্ষমা করলাম।”
“হিরা চইলা গেছে এটাতো আমরা জানতাম না।তুমি অন্যজনকে বিয়ে করছো এটা দোষের কিছু না।কিন্তু আমাদের সমাজ কেমন জানোইতো।”
“জানি চাচা।”
“তোমার যতদিন মন চাইবো এখানে থাকো।তুমি না বলছিলা নিজের বাড়ি না বানানো পর্যন্ত এদিকেই থাকবা?তুমি তোমার কথা রাখো।নতুন বউরে নিয়া এদিকেই থাকো।”
“ভেবে দেখবো চাচা।”
“তুমি আমাকে ক্ষমা করো নাই তাই না? নতুন বউ কই?ডাকো ওর কাছেও ক্ষমা চাই।”
“কিযে বলেন চাচা। কোনো দরকার নেই ক্ষমা চাওয়ার।আমি বুঝতে পারছি আপনি সবার মাঝে বুঝতে পারেননি কি করবেন।…আর আমরা এখানেই থাকছি।”
বেশ তৃপ্তি নিয়েই মল্লিকার বানানো চা খেয়েছেন রহিম মিয়া। সুনামও করলেন। উঠতে উঠতে বললেন, “আসি।একদিন বউরে নিয়া যাবে আমার ঘরে।আর বাড়ির কেউ কিছু বললেন আমাকে জানাবে।”
ছোট্ট ছোট্ট কদম ফেলে বেরিয়ে আসে মল্লিকা।মিষ্টি তার কোলেই।দুজনেই চুপচাপ দূরে আড়ালে দাড়িয়ে ছিলো।রহিম মিয়ার মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিল।বুদ্ধি খাটিয়ে খট করে মিষ্টিকে মাহরুরের কোলে বসিয়ে দেয়।মল্লিকা জানে আর যাই হোক মিষ্টির সামনে সে কিছুতেই রাগ দেখাবে না।শুধু রহিম মিয়াকেই নয় তার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর মানুষ সামনে বসে।কল্পনাতেও আসতে পারছে না এমনভাবে রেগে যাবে মাহরুর।মিষ্টিকে কোলে পেয়ে তীক্ষ্ম চোখ মল্লিকার দিকে তুলে দিলো।
মল্লিকা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বললো, “এবার শান্ত হন। সবতো ঠিক হয়ে গেছে।”
“মিষ্টি খেয়েছে?”
মল্লিকার প্রশ্ন উত্তরমুখী। মাহরুর এর জবাব দক্ষিণমুখী। নতজানু হয়ে মল্লিকা বলে,
“হ্যাঁ বুবু খাইয়ে পাঠিয়েছে।”
মিষ্টিকে বালিশ ঠিক করে শুইয়ে দিলো।গায়ে কাথা টেনে দিলো। বললো, “মিষ্টি?মা?কালকে তোর জন্য টিভি ঠিক করিয়ে দিবো। টিভিতে কার্টুন দেখিস কেমন?এখন ঘুমা।”
“আচ্ছা মামা”
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মল্লিকার কাছে এসে শক্ত গলায় বললো,
“ওকে ঘুম পারা।আর খবরদার যদি নিজে ঘুমিয়ে পড়েছিস। মিষ্টি ঘুমালে সরাসরি আমার কাছে আসবি।এক সেকেন্ড দেরি হলে খবর আছে চন্দ্র!”
ঠান্ডা হুমকিতে একলাফে মিষ্টির কাছে গিয়ে বসে।বারংবার মাহরুরের দিকে চেয়ে চেয়ে মিষ্টির মাথায় হাত বুলাচ্ছে।এক মন বলছে যেনো মিষ্টি দ্রুত ঘুমায়। মাহরুর যে হুমকি দিলো? কাচ্চা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।আরেক মন বলছে যেনো না ঘুমায়। মাহরুর তাকে ঘাড় মটকে মেরেও ফেলতে পারে।
মিষ্টি ঘুমালো বিশ মিনিট সময় নিয়ে।দরজা বেয়ে বাহিরে চাইতেই মাহরুরের অবয়ব দেখা যাচ্ছে।পকেটে হাত গুজে সোজা উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে।চাঁদের আলোয় তার কালচে প্রতিচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে।
মল্লিকার উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকায় মাহরুর। বড়বড় কদম ফেলে হাত টেনে এনে নিজের সামনে দাড় করায়।
বলে,
“তুই এক বাচ্চার মা তাই না?”
আজগুবি প্রশ্নে শুধু তাকিয়ে রইলো মল্লিকা।তার নিজেরও জানা উত্তর দেবে না।
মাহরুর ঝাঁঝালো গলায় আবার বললো, “মুখ খোল চন্দ্র। বোবা হয়ে থাকবি ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবো।”
“আপনি শান্ত হন না।আমাকে কেনো রাগ দেখাচ্ছেন?”
মাহরুর শরীর এগিয়ে মল্লিকার হাতটা শক্ত করে ধরে আরো টেনে আনলো নিজের কাছে।নরম দুটো হাতের কব্জি ধরে আছে।নাক ফোলাচ্ছে বারবার। হাতে ব্যথা অনুভব করায় করুন চোখে তাকায় মাহরুরের দিকে।
মাহরুর বলে, “তোকে আজ থেকে কথা বলাও শিখাবো।কি করে মানুষকে জবাব দিতে হয় বোঝাবো।এক সেকেন্ড সময় উত্তর দেওয়ার।বল কিছু ভুল করেছি আমরা?আমরা অবৈধ সম্পর্কে আছি?”
মল্লিকা তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়ায়।বলে, “না”
“আচ্ছা! আমার কি হোস তুই?সময় এক সেকেন্ড প্রতি উত্তরের!”
“ব..বউ”
হাতে টান খায়। কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব আরো ঘুচলো।বললো, “তোতলাবি মুখ ভেঙে ফেলবো!”
মল্লিকার নজর বরাবর মাহরুরের বুকে।চক্ষু নামিয়ে আছে। মাহরুর থুতনিতে আঙ্গুল চেপে মাথা তুললেন।বললো, “চোখে চোখ রেখে কথা বলবি।পর পুরুষ না আমি।এবার বল?তোর উচিত ছিল না চিৎকার করে সবাইকে বলা তুই আমার বউ?”
“ছিলো উচিত ছিল”
“বলিস নি কেনো?”
“এত মানুষের মধ্যে সাহস পাইনি।কে বিশ্বাস করতো আমাকে বলেন?কেউতো আমাদের বিয়ের কথা জানে না”
ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো মাহরুর।শক্ত করে চোখ বুজে দ্রুত খুলে নেয়।বলে, “সাহস করতে হবে চন্দ্র!আমাদের সম্পর্কটা এমনভাবে জুড়েছে মানুষ প্রশ্ন তুলবেই।ভুল বুঝবে।আমাদের কাজ পরিষ্কার ভাষায় তাদের সব জানিয়ে ভুল ভাঙ্গানো। নাহয় সমাজে আমাদের টিকে থাকা মুশকিল।স্বামী – স্ত্রী, বৈধ – অবৈধ সবতো বুঝিস নাকি?ওইটুকু বুঝতো তোর আছে।নাকি নেই?”
কাটকাট মাহরুরের দিকে চেয়ে আছে মল্লিকা।নিচু হলেই যেনো গর্দন কর্তন করা হবে।মল্লিকা কয়েকবার পলক ঝাঁপটায়।
ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “আছে”
মাহরুরকে উত্তর দিতে না দেখে মল্লিকা জানতে চাইলো, “এবার আপনার রাগ কমেছে?”
আকস্মিক চাহনির পরিবর্তন।কাছ থেকে আরো সম্মোহনী মনে হয় চন্দ্রকে।রাগ আর পাখা ঝাপটানো অবাধ্য ইচ্ছে মিলেমিশে এক হয়।প্রিয় মানুষের প্রতি আকর্ষণ।ভীষণ রকমের আকর্ষণ। জেদে লার্ভার মতন হয়ে থাকা চোখদুটো শীতল ক্ষুদ্র আকৃতি ধারণ করে। দাপিয়ে বেড়ানো সাধনার ঢেউ।কোমড় জড়িয়ে নিজের বুকে থুবড়ে ফেলে চন্দ্রকে।
গলা নামিয়ে বললো, “কমেনি রাগ”
“কিভাবে কমবে?” সন্নিকটে দাড়িয়ে জান যায়যায় অবস্থা।তবে সময়ের বাঁধা ধরা আছে।এক সেকেন্ডে উত্তর দিতে হবে। আত্মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে উত্তর দিয়েছে মল্লিকা।
“যখন দেখবি রেগে আছি,তখন বুঝে নিবি আমার তোকে দরকার।কোনো কাজ,কোনো বাহানা ছাড়াই কাছে এসে দাঁড়াবি।যতটা কাছে এখন আছিস ততটা কাছে।”
এক সেকেন্ড কেনো এখন এক জনম সময় দিলেও মুখ ফুটে কথা বের হবেনা মল্লিকার।এর বদলে বলি চড়িয়ে দেওয়া হোক না কেনো।এখনও ফোঁসফোঁস করছে মাহরুর।বুঝে উঠতে পারলো না মল্লিকা কি করবে। মাহরুরের দেহের সাথে এভাবে লেপ্টে থাকবে তা ছিলো মল্লিকার কল্পনার উর্ধ্বে।
মাদকতায় পরিপূর্ণ এক পুরুষালী কন্ঠ থেকে ডাক আসে,
“চন্দ্র?”
অস্পষ্ট জবাব আসে, “হুম?”
“ভয় পাচ্ছিস?”
গলা বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে।একটা হাত মাহরুরের বুকে ঠেকানো।উত্তপ্ত সেখানটা। তাছাড়াও তার গাঢ় নিঃশ্বাস মস্তিষ্ক অচল করে তুলছে। মাহরুর লম্বা তারে ঝুলে থাকা সুইচটা চেপে বন্ধ করে দেয় অন্যহাতে।তাকে আরো সুযোগ দিয়ে চাঁদের আলোও কমে এসেছে। পুরোপুরি আধাঁরে ঢাকা চিলেকোঠার চাঁদ।সামনে দাঁড়ানো ভয়ানক মাহরুর।মুখটা এগিয়ে মল্লিকার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
“তোকে আমার সম্পর্কে একটা সত্যি বলি?আমি চরম পর্যায়ের বেহায়া।তার চেয়ে বহুগুণ বেসামাল আমার ইচ্ছেরা।অধিকার আর ভালোবাসা দুটোই যেহেতু আছে?হুটহাট কাছে এসে চন্দ্রবিলাস করবো।তুই কিছু বলতে পারবি না।কোনো বাধা দিতে পারবি না।”
প্রতিক্রীয়াহীন মল্লিকা শ্বাস আটকে দাড়িয়ে।এখনও নিজেকে এই পরিস্থিতির জন্য অনুকূল করে তুলতে পারেনি।এই ছোঁয়া ভিন্ন। মসৃণ গালে খরখরে গালের বিচরণ চলছে। খোঁচাখোঁচা দাড়িগুলো বিধছে বেশ।বারবার ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেও মানে না মল্লিকার নেশায় বুদ মাহরুর।
কাতর গলায় জানতে চাইলো, “কেনো পাগল করলি আমায়?তোকে ছাড়া অন্ধকার দেখি আমি।তোর ছোঁয়া পাওয়ার শখ জাগে।তুই আমাকে মাতাল ডাকবি একদিন চন্দ্র। লোকে বলবে মাহরুর চন্দ্রের মাতাল প্রেমিক।”
পিনপিনে নিস্তব্ধতা চারিপাশ ঘিরে।তবে মল্লিকার কর্ণকুহরে নয়।সেখানে ভারী নিঃশ্বাসেরা মেলা জমিয়েছে।ভিন্ন আওয়াজে জানান দিচ্ছে কতটা চায় মাহরুর তাকে।এটা মল্লিকার কিশোরী মনের চাওয়ার থেকেও দ্বিগুণ।
মাহরুর আবার ঘোর লাগানো গলায় বলে উঠলো, “আমার অনুপস্থিতিতে তোর নিজের জন্য দাঁড়াতে হবে চন্দ্র।নিজেকে শক্ত করতে হবে।ভুলে যাস না তোর কিশোরী বয়স পেরিয়েছে অনেক আগে।তুই নারী।নরম সৌন্দর্যের প্রতিমা হবি আমার জন্য।কঠোর হবি নিকৃষ্ট সমাজের মানুষের জন্য।যেখানে তোর কোনো দোষ থাকবে না সেখানে গলা উচু করবি।মাথা নামিয়ে চলবি না কোনোদিন।”
চলবে…