চন্দ্র’মল্লিকা পর্ব-১৭+১৮

0
444

চন্দ্র’মল্লিকা ১৭
লেখা : Azyah_সূচনা

মিষ্টি ঘুম থেকে উঠে অবাক।নিজেকে আবিষ্কার করলো ঘরে।ঘুমোনোর আগে বাসে ছিলো সে। হঠাৎ ঘরে এলো কি করে?তাও আবার তার মাহরুর মামার ঘরে।চোখ কচলে মায়ের কাছে এসে জানতে চাইলে মল্লিকা কিছু বললো না।শুধু হাত ধরে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দিয়েছে।এই ঘরটা মল্লিকার জন্য নতুন।ঘাপটি মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।যাওয়ার আগে মাহরুর ছাদের দরজায় তালা দিয়ে গেছে।বলে গেছে রবিনই ডাকবে খাবার নিয়ে এসে। মিষ্টিকে নাস্তা খাইয়ে বই খাতা ধরিয়ে দিল।অনেক হয়েছে ঘুম।নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে পড়ায় যেনো কোনো ঘাটতি না পড়ে।উঠে দাঁড়ায় এলোমেলো ঘরটা গোছানোর জন্য। যত কাজে হাত এগোচ্ছে ততই অদৃশ্য বাঁধা অনুভব করলো মল্লিকা।এক মন বলছে কাজ করতে আরেক মন বারণ করছে।

নিজেকে নিজে আশ্বাস দিয়ে বললো, “মেনে নে মল্লিকা।হয়তো এটাই তোর শেষ ঠিকানা।”

‘ ভাবি, ভাবি ‘ চেচিয়ে উঠলো কেউ একজন। ঘর গোছানো বাদ দিয়েই মাথায় কাপড় টেনে দরজার দিকে গেলো। রবিন দাড়িয়ে।দরজার উপর দিয়ে খাবারের প্যাকেট দিয়ে বললো,

“ভাবি মাহি ভাই পাঠাইছে।”

“দিন”

মল্লিকা আবার বলে উঠে, “আর টাকা?”

“ভাই দিয়া গেছে সকালে।”

“আসসালামু আলাইকুম ভাবি।গেলাম”

যতদিন থেকে মল্লিকাকে চেনে ততদিন যাবতই ভাবি ডাকে তাকে রবিন।সে ছাড়াও এলাকার প্রায় অনেকেই এই ডাকে সম্বোধন করে তাকে।ভাবি ডাকে বিশেষ কোনো ভাবলেশ দেখা গেলো মা মল্লিকার মধ্যে।

ঘরে এসে খাবারগুলো বাটিতে রেখেই মেয়ের প্রশ্নের শিকার।মিষ্টি বলে উঠে, “ও মা?আমরা কি এখানেই থাকবো?”

“হুম”

উৎসুক গলায় আবার প্রশ্ন করে মিষ্টি, “মামাও থাকবে আমাদের সাথে?”

সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দিলো না মল্লিকা।সময় নিয়ে বলে, “হ্যা”

“আমার মামাকে খুব ভালো লাগে মা।আমার সুমাইয়া আপু আর সায়মনকেও ভালো লাগে।তুমি বলো না তাদেরও এখানে এসে থাকতে।আমরা সবাই একসাথে থাকবো মা”

মেয়ের বাচ্চাসুলভ কথায় না হেসে পারলো না মল্লিকা।সবাইকে নিয়ে থাকবে?এটাও সম্ভব!হেসে উড়িয়ে দিলো তার কথা।নিজেকে আজ পুরোপুরি ভ্রমের মধ্যে মনে হচ্ছে।কি থেকে কি হয়ে গেল।কি হতো যদি কবুল বলার সময় মল্লিকা না করে দিতো?বিয়ে করতো না মাহরুরকে?আজ সেখানেই পড়ে থাকত।গ্রামের মধ্যে মানুষের বাজে ব্যবহার সহ্য করতো।

“মা ক্ষিদে পেয়েছে”

মিষ্টির কথা শুনে ভাত বেড়ে দিয়ে আসলো।মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে।পাতে ইলিশ দেখে মিষ্টির মুখ খুশিতে আটখানা। মাহরুর তার পছন্দটাকেও মনে রেখেছে।মেয়েকে পেট পুড়ে খাইয়ে দিয়েছে।
সময় পেরোলো।ঘড়িতে চারটে বাজে। মাহরুর আসবে বিকেলে বলে গেছে।মিষ্টির হাত ধরে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। রেলিংয়ের উচ্চতায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না মিষ্টি।বায়না করলো কোলে চড়বে।মেয়ের আবদারে কোলে তুলতেই চেচিয়ে উঠলো মিষ্টি।

“মামা মামা” বলে ডেকে উঠলো। মল্লিকারও চোখ যায় নিচে।ক্লান্ত দেহটা এগিয়ে আসছে ঘরের দিকে।মিষ্টির ডাকে যেনো চাঙ্গা হয়ে উঠলো।দুরত্বে হেসে দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠে গেলো। মায়ের কোল ছেড়েছে।নেমে দৌড়ে গেলো মাহরুরের দিকে।

ব্যাগ মাটিতে ফেলে মিষ্টিকে কোলে তুলে গালে চুমু বসিয়ে জানতে চাইলো,

“আমাকে মনে করেছিস?”

“হ্যা মামা”

“মামা?”

“হ্যা!”

মাহরুর হাসলো।মামা থেকে বাবা হওয়ার যাত্রাটা ছোট্ট মিষ্টির অজানা।হাসি থামিয়ে মল্লিকার দিকে এগিয়ে এসে মলিন সুরে জিজ্ঞেস করলো, “দুপুরে খেয়েছিস?”

“হুম?…. হ্যা।”

“সত্যি?”

মিথ্যে ধরার কোনো অদ্ভুত শক্তি আছে তার? চট করে মুখের দিকে চেয়ে ভুলটা ধরে ফেলে। মিথ্যে শুধরে নেওয়ার সময়ও দেয়।তবে তখন আর মল্লিকার মুখ থেকে কথা বের হলো না।চুপ বনে রইলো মাথা নামিয়ে।

“খাবি আয়।আমারও ক্ষিদে পেয়েছে।”

কথার ধাঁচে বোঝা গেলো সেও না খাওয়া। মল্লিকাও পিছু এসেছে। মিষ্টিকে রেখে হাত মুখ ধোয়ার জন্য চলে গেলো। ততক্ষণে দুপুরের খাবার গরম করে প্লেটে সাজিয়ে দেয়।তারপরও হাসফাস করছে মল্লিকা।নিজের মতন করে প্লেট সাজিয়েছে। মাহরুরের মন মত যদি না হয়?

অফিসের কাপড় ছেড়ে বিছানায় বসে বললো,

“এক প্লেট কেনো?”

“আপনি খান।আমি পড়ে খাবো।”

তীর্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে মাহরুর।বলে, “খাবার নেই?”

“আছে”

“তাহলে?দ্রুত প্লেটে খাবার নিয়ে এসে সামনে বোস”

মাহরুর রাগ দেখিয়ে কথা বলে নাকি অধিকার খাটিয়ে! পুরোনো সব ঘটনার প্রেক্ষিতেতো রাগ মল্লিকার দেখানোর কথা।উল্টো মাহরুর দেখাচ্ছে?তার আদেশ মান্য করেই খাবার নিয়ে বসে পড়লো তার মুখোমুখি।অসস্তি হচ্ছে মল্লিকার। অন্যদিকে সস্তিতে ভাসছে মাহরুর।কি করে অনুধাবন করবে এই সময়টাকে।দুর আকাশে হারিয়ে যাওয়া চন্দ্রকে পূনরায় ধরে নিজের ঘরে এনেছে।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরেই মাহরুর বসেছে চুলোর কাছে। রাতের খাবার এখনই তৈরি করে একটু বিশ্রাম নেবে।

“আমি রান্না করতে জানি”

চাল ধুয়ে চুলোয় বসানোর সাথেসাথেই কানে ভেসে এলো চন্দ্রের কন্ঠ।পিছনে দাঁড়িয়ে বলতে মাহরুরকে।তার কথার উত্তরে বললো,

“ছয় বছর গাধার খাটুনি খেটেছিস।আর আমি বসে বসে খেয়েছি।কিছুদিন আরাম কর পড়ে সব তোরই সামলাতে হবে।”

“আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“তাই নাকি?…ঠিক আছে ডিম ভাজ তাহলে।আমি কাচা মরিচ,পেঁয়াজ কেটে দিচ্ছি”

“আমি কাটতে পারবো”

মাহরুর বারণ করলো না।সে জানে তার চন্দ্র কাজে পটু।পুরো একটা সংসার একহাতে সামলানো মুখের কথা নয়?তাও এতবড় বাড়ি।আর মাহরুরের?ছোট্ট একটা ঘর।তিনজন মানুষ সেখানে। কতই কাজ হবে। চন্দ্রকে একটি বিশ্রাম দেওয়ার জন্য নিজেই কাজে হাত দিয়েছিল। মাহরুরের দিকে দৃষ্টিপাত করে কাটাকুটির কাজ করতে গিয়ে অঘটন ঘটায় মল্লিকা। ধারালো বটিতে হাত লেগে গড়গড় করে রক্ত পড়তে শুরু হলো। আকষ্মিক হাতে রক্ত দেখে মাহরুরও ভরকে উঠে। বিচলিত চিত্তে হাত টেনে নিলো নিজের দিকে।ঠোঁটের স্পর্শে শুষে নিতে শুরু করলো রক্ত।হাত কেটেছে মাথা থেকেই হাওয়া হয়ে গেলো।মূর্তির মতন জমে মাহরুরের দিকে চেয়ে আছে।গোলগোল চোখে।ভারী দুয়েক নিঃশ্বাস ফেলে নিজের হাত সরিয়ে ফেললো। ওড়নায় গুজে নত চোখে জড়ো হয়ে বসে আছে।

“না করেছিলাম না?এখন হলোতো বিপদ!”

মাহরুরের ধমকে শিউরে উঠে।আরো আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলো। মাহরুর উঠে গেছে। ড্রয়ার হাতড়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। খোঁজাখুঁজির অভিযান শেষে একটি ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ এনে বলে,

“হাত দে”

আলতো হাতে ব্যান্ডেজটি আঙ্গুলে পেঁচিয়ে দিলো।কপালে গাঢ় ভাজ ফেলে বললো, “তোর ডিম ভাজা লাগবে না।গিয়ে খাটে বস।এক পা নামাবি না”

___

আঁধার নেমেছে চিলেকোঠা জুড়ে। ব্যস্ত নগরীর আকাশ জুড়ে সচ্ছ- শুভ্র শশাঙ্ক। আলো নিচ্ছে জমিনে শুয়ে থাকা মাহরুরের গায়ে।একই ঘরে উপস্থিত আছে তার মনের ঝড়।ভীত চকচক করা নেত্রজুগল।কখন তার বেহায়া হৃদ পুষে রাখা ভালোবাসা উজাড় করতে তোড়জোড় শুরু করবে। মাথার পেছনে হাত রেখে ভেবে চলেছে। ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব। চন্দ্রকে ভালো রাখার দায়িত্ব সাথে মিষ্টির ভবিষ্যতেরও।এতদিন ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে সব প্রয়োজন মিটিয়েছে।এরপর কি হবে?

মাঝরাতে হুটহাট ঘুম ভাঙ্গে মল্লিকার।কখনো ভয়ে আবার কখনো কোনো কারণ ছাড়াই।নতুন জায়গায় অসস্তি হচ্ছে।শুকিয়ে যাওয়া গলার তৃষ্ণা মেটাতে চোখ খুলে তাকায়। ডান পাশে তাকাতেই বড়সড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে।ভয়ে চিৎকার করতে চাইলে মুখ চেপে ধরে মাহরুর।চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে আসবে ভাব মল্লিকার।জমিনে বসেই এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা মাহরুরকে হঠাৎ দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে তার মুখখানা।

মাহরুর মল্লিকার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললো, “চিৎকার করিস না।মিষ্টি উঠে যাবে”

ভরকিত গলায় মল্লিকা বলে, “আপনি এভাবে চেয়ে কি করছিলেন?”

“চন্দ্রবিলাস”

বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায় মাহরুর।অন্যহাতে মল্লিকাকেও সাথে নিয়ে হাটা শুরু করলো। এতরাতে অর্ধঘুম মানুষটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বিস্মিত মল্লিকা বোকার মতন পিছুপিছু হাঁটছে। অতিরিক্ত বিস্ময়ে বোবা হয়ে উঠে মল্লিকা।দুই জোড়া পা এসে থামলো ছাদের একদম কোণায়।

কিছুসময়ের নীরবতা শেষে মাহরুর বললো, “কি করলে তোর অভিমান ভাঙবে চন্দ্র?”

“আমার কোনো অভিমান নেই।কতবার বলবো মাহি ভাই?”

মাহরুর ফিরে তাকায় মল্লিকার দিকে।দুজন মানুষ একে অপরের মুখোমুখি দাড়িয়ে। মধ্যিখানে তাদের দুরাকাশের চাঁদ। মাহরুর বলে উঠে,

“তাহলে আমাকে পুরো নামে ডাক।তুমি বলে ডাক”

এই আবদার রাখা সম্ভব নয়।কিছুতেই সম্ভব নয়।ওই ডাক ছেড়েছে অনেক আগেই।এখন হাজার চাইলেও ফিরে আসবে না। মাহরুরের জবাবে নীরবতাকে বেছে নিলো।

মল্লিকাকে তাক লাগিয়ে হাত ছুঁয়েছে। গভীরভাবে। মাহরুরের স্পর্শের সাথে বরাবরই অপরিচিত মল্লিকা। শিরশির করে উঠে সর্বাঙ্গ।হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মাহরুর বলে,

“প্রেম করবি আমার সাথে চন্দ্র?বৈধ প্রেম, পবিত্র প্রেম?তোর সাথে ওই সময়টুকু আবার উপভোগ করতে চাই যা আমার দোষে হাতছাড়া হয়েছিলো”

প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে।তাও আবার নিজের স্ত্রীকে?অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে উত্তরের আশায় মুখ চেয়ে আছে মাহরুর।সে নিজেও জানে এই উত্তর আসবে না তার চন্দ্রের কাছ থেকে।তারপরও যন্ত্রণা দিলো,বিস্ময় আচ্ছাদিত করে দিলো হৃদয়কে।

মল্লিকার একহাত নিজ বুকের বামপাশে রেখে মাহরুর আবার বললো,

“তীর্থের কাকের মতো অবস্থা আমার। হৃদয় শুকিয়ে মরুভূমি। সস্তি দিবি?আবার ভালবাসবি চন্দ্র?তোর শুদ্ধ ভালোবাসা পেতে কাতরেছি বিগত ছয় বছর। মিথ্যে সংসার করেছি।জোর জবরদস্তির সংসার।”
পরপর আকাশের দিকে মুখ তুলে মাহরুর।মল্লিকার উত্তরের কোনো অপেক্ষা নেই।বিশাল আকাশের একাকী চাঁদের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, “ওই আকাশের একটা চাঁদ আছে।আমারও একান্ত একটা চাঁদ আছে।যাকে আমি হারিয়ে ফেলার পড়ে ভালোবাসতে শিখেছি। ভাগ্যের পরিবর্তনে আজ ওই চাঁদ আমার বুকে হাত রেখে হৃদয়ের গতিবেগ ওলোট-পালোট করে দিচ্ছে”

আলগোছে নিঃশ্বাস ফেলে মল্লিকা।সাহস যুগিয়ে নেয় মনে। কাপা কাপা গলায় জানতে চায়, “ভালোবাসেন?”

“বুকে মাথা পেতে দেখ।অনুভব করতে পারিস।এটা ভালোবাসা নাকি ভ্রম?”

জোৎস্না স্নাত নিশিতে দুজন মানব মানবীর দেহ একে ওপরের সাথে লেপ্টে।সময়ের দীর্ঘতা অনেক ছিলো।অনেক বছর। মরুভূমির মতন খাখা করতে থাকা বক্ষস্থলের অদ্ভুত তৃপ্তি। একি নব প্রেমের সূচনা?নাকি অতীতের অনুরাগের পুনরাবৃত্তি।কখনো কিশোরী মানবী মেতেছিল নতুন ভালোবাসার জোয়ারে।আবার কখনও হারিয়ে যাওয়া পুরুষ উপলদ্ধি করতে শিখেছিল। লোকে বলে ভালোবাসা দুর্বল।এখানে চলে আবেগের বশবর্তীতা।একে অপরকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ হয়।ফিরে পাওয়া কতজনের ভাগ্যে লিখিত থাকে?জীবন তাসের দান খেলে।কখনো মাথায় তোলে কখনো আঁচড়ে ফেলে।সবশেষে জয়ী হয় কে?মানুষ নাকি জীবন?

শীতলতায় পরিপূর্ণ অন্তর হাসি মুখে চোখ বুজে আছে। ভিন্নপাশের মানুষের অনুভূতিও ভিন্ন।মূর্তির মতন দাড়িয়ে অনুভব করছে টগবগ করতে থাকা একটা হৃদপিণ্ডকে।

মাহরুর বললো, “একদিন নিজ থেকে আমায় জড়িয়ে ধরবি চন্দ্র।সেদিন আমার কাছে টেনে নিতে হবেনা।ডেকে বলবি ভালোবাসি তোমাকে।”

আবার বললো, “চন্দ্র!আমি কোনোদিন আসবো না মিষ্টির বাবার জায়গা নিতে।সে তার জায়গায় কায়েম থাকবে।আমাকে আলাদা জায়গা দিস তোদের জীবনে।শেষ জীবন অব্দি একজোট হয়ে থাকবো তিনজনে।মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে একে অপরের মৃত্যুর সঙ্গী হবো।যেদিন চন্দ্র হারিয়ে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে মাহরুরের অস্তিত্ব মুছে যাবে এই পৃথিবী থেকে”

___

পুরোনো দিন চারিতায় অভ্যস্ত হতে হবে।এবারের মাইনে কাটবে বলে অফিসের ম্যানেজার জানিয়েছে। বেশকিছু দিন ওভার টাইম করলেও বিশেষ কাজের দিনগুলোতে মাহরুর ছিলোনা।কোনো ছাড় দেওয়া হলো না তাকে। ওভার টাইম এর টাকা আর কতটুক।যত বেতন কেটে নিবে সেই সম পরিমাণই।আরো কয়দিন বাকি দুই তিন ঘণ্টা করে বেশি কাজ করলে পুষিয়ে যেতো।সেটা কি আর এখন সম্ভব?সহজ ভাষায় ঘরে এখন বউ বাচ্চা আছে।সময় দরকার তাদেরও।ফোনের স্ক্রিনে ব্যাংকে থাকা টাকাটা একবার চেক করে নিলো মাহরুর।তারপর চলে গেলো রেডি হতে।কাপড় বদলে চন্দ্রের দিকে নজর পড়তেই দেখা গেলো রক্তিম আভা।লাল টকটকে হয়ে আছে মুখটা।এত নতুন দৃশ্য। প্রেমময়ী চন্দ্রকে দেখেছে।লাজুক চন্দ্রকেতো কখনো দেখেনি।লাজের মাঝেও কেমন যেনো আড়ষ্টতা।মুখে সাফ বোঝা যাচ্ছে এখনও পূর্ণ রূপে মেনে নিতে পারছে না মাহরুরের নবরূপে তার জীবনে।

মাহরুর কিছু সময় অপেক্ষা করলো।একরকম একে পরের সামনাসামনি বিনা বাক্যে কতক্ষন থাকা যায়?মল্লিকা জানতে চেয়ে বলে, “নাস্তা করবেন না?”

“বাটিতে করে নিয়ে নিয়েছি।অফিসে গিয়ে খাবো”

“নাস্তা কে বানালো?”

“আমি।তোদের জন্যও তৈরি করে ঢেকে রেখেছি

মল্লিকার মুখ আধাঁরে ঘনায়।এতটা দায়িত্বহীন হলো কি করে?আজকাল ঘুম ভাঙ্গে না তার। মাহরুর উঠে নাস্তা তৈরি করে ফেলেছে।এখন অফিস যাওয়ার জন্যও প্রস্তুত।এই কাজটাতো তার। মাহরুর মিষ্টিকে আদর দিয়ে মল্লিকার কাছে এসে বসে।জমিনে হাঁটু মুড়ে।মাথা বাঁকায় তার নত মুখখানা দেখবার জন্য।

দৃষ্টি শীতল করে আদুরে গলায় অনুমতি চাইলো, “যাই?”

“হুম?… কোথায়?”

“অফিসে? যাবো?”

এমনভাবে প্রশ্ন করছে যেনো মল্লিকা না করলেই রয়ে যাবে।নরম গলায় অনুমতি চাইছে।এই কণ্ঠে অনেক অনুভিতিমিশ্রিত।মল্লিকা মাথা দোলায়। বলে, “আচ্ছা। খোদা হাফেজ।”

মুচকি হেসে মাহরুর বলে, “আজও খাবার দিয়ে যাবে।”

“আমি রান্না করি?” চট করে প্রশ্ন করে মল্লিকা।

“আপনি যে কাল রাতে হাত কেটেছেন?সেটা মনে আছে?আর ঘরেতো বাজারও নেই।কি রান্না করবেন?”

আপনি ডাকেও কারো হৃদয়ে দোলা দিতে পারে?কি মিষ্টি ভাষায় বলছে।কর্ণ,হৃদয় সবটাই প্রসন্নতায় ভরে উঠলো।নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মল্লিকা।বরাবরের মতই উত্তর দেবে না বলে ঠিক করে।

“আসার সময় বাজার করে আনবো।রাতে রান্না করবো বেশি করে যেনো পরদিন দুপুর অব্দি চলে।আসি।সাবধানে থাকিস”

পিছু ডাকে মল্লিকা।জানতে চেয়ে বললো, “কখন আসবেন?”

“চারটায় বের হই অফিস থেকে।হেঁটে আসতে পনেরো বিশ মিনিট লাগে।আজ একটু দেরি হবে বাজারে যাবো।চিন্তা করিস না শিরীন আসবে দুপুরে।”

মাহরুর চলে গেলো।সুযোগ বুঝে মল্লিকাও বেরিয়ে আসে। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চেয়ে রয় মাহরুরের যাওয়ার পানে। কাল রাতের কথা চিন্তা করে আনমনে মল্লিকা বলে উঠলো,

“এই তুমিটাকেইতো ছয় বছর আগে চেয়েছিলাম মাহরুর ভাই।ভীষণ দেরি করে ফেললে যে আমায় ভালোবাসতে।”

চলবে…

চন্দ্র’মল্লিকা ১৮
লেখা : Azyah_সূচনা

শিরীন এসেছে।এসেই মল্লিকাকে জড়িয়ে ধরলো।মুখ দেখে মনে হলো অনেক খুশি।ঝাঁঝালো মানুষের এত ভালোবাসা দেখে অবাকের পাশাপাশি খুশিও হলো মল্লিকা।সুমাইয়া আর সায়মন এসেই সালাম জানিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠে।মল্লিকার দুগাল দুহাতে জাপটে ধরে শিরীন বললো,

“আমি অনেক খুশি অনেক।আমার ভাইটা অবশেষে তোকে পেয়েছে।ওই লোভী নারীর হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে।আর তুইও নরক থেকে আমার ভাইয়ের ছোট্ট চিলেকোঠায় এসেছিস।সৃষ্টিকর্তা কাউকে তার সহন ক্ষমতার চেয়ে বেশি কষ্ট দেয়না চন্দ্র।দেখ কতটা কষ্ট দিয়ে তোদের সুখের দিন ফিরিয়ে দিয়েছে!”

“হুম” ছোট উত্তর দিলো মল্লিকা।

“তুই খুশিতো বোন আমার?আমার ভাইটা কিন্তু তোকে অনেক ভালোবাসে।”

ভালোবাসার প্রকাশতো কাল নিজেই করেছে মাহরুর।তার ভালোবাসার খবর দেখছে শিরীনও জানে। শুধু মল্লিকাই বোধহয় অজানা ছিলো।

বোনকে মনের কথা উজাড় করে বললো,

“বুবু আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না জানো?আমি ভুল করিনিতো?মানুষ আমাদের খারাপ কথা বলবে নাতো?”

“কেনো?কেনো বলবে খারাপ চন্দ্র?তোরা কি অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত?সসম্মানে ভাই তোকে বিয়ে করে এনেছে।গ্রামে কি হয়েছে সবই জানি আমি।ওরা নিচু চিন্তার মানুষ চন্দ্র।মানুষ যাই বলুক তুই এসব মাথায় নিবি না।”

“নিতে চাইনা বুবু।কিন্তু আজ না হোক কাল মানুষ কটু কথা বলতে পিছু হটবে না।মাহি ভাইকে বলবে বউ যেতে না যেতেই অন্যকে ঘরে তুলেছে।আমাকে বলবে স্বামীমরা মেয়ে অন্যের ঘাড়ে ঝুলেছে।আমি এসব সহ্য করতে পারিনা বুবু।এই সমাজটা অনেক খারাপ”

মল্লিকাকে পাশে বসায় শিরীন।হাত ধরে বুঝানোর ভঙ্গিতে কিছু মূল্যবান কথা বললো, “জানিস চন্দ্র জীবনে বাবা মা ভাই বোন ছাড়াও একটা জিনিস খুব প্রয়োজন।সেটা হচ্ছে একজন ভালো সঙ্গী।যেখানে আমাদের আশ্রয় হবে।তোর যে সমস্যার সমাধান বাবা,মা পরিবার পরিজন করতে পারবে না।সেই সমাধান তুই তোর পাশে থাকা মানুষটির কাছে পাবি। পাছে লোকে কিছু বলে।মানুষের কথায় মাঝেমধ্যে কান দিতে নেই।”

“বুবু হিরা ভাবি কেনো তালাক দিলো?সত্যি করে বলবে?আমি জানতে চাই। লুকাবে দয়া করে”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে শিরীন বললো, “বাদ দে না।মানুষের গীবত গেয়ে কি লাভ?তবে এতটুকু জেনে রাখ হিরা ভাবীর সাথে মাহি ভাই কোনো অন্যায় করেনি। উল্টো হিরা ভাবি তাকে ঠকিয়েছে।”

কত রকমের অনুভবের মধ্যে দিয়ে যাবে মল্লিকা?একের পর এক নতুন হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে বারেবারে।বিয়ের পর থেকে একঢালা ছিলো জীবন।স্বামীর প্রতি প্রেম ভাবটা আনার পূর্বেই তার অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে।যতদিন জানতে চেয়েছে তার অপরাধ কি?ততদিন আরো দ্বিগুণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে মল্লিকাকে।অযথা অহেতুক কেনো নির্যাতন?এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা।তবে কেনো ফারহানের মৃত্যুতে কেঁদেছিল মল্লিকা?মেয়ের বাবা বলে?কষ্টের সময় পেরিয়ে হঠাৎ এত যত্ন কুলিয়ে উঠতে পারছে না বলেই এতটা অসস্তি। অবচেতন মনকে এখনও অব্দি বিশ্বাস করাতে পারেনি।যাকে চেয়েছিলো খুব করে সে আছে।তার কাছেই আছে। খুব আপন সে।তার একান্ত, ব্যক্তিগত।

মিষ্টি এসে হাজির।সুমাইয়া তার ছোট চুলে ঝুটি করে দিয়েছে।সেটাই দেখাতে এসেছে।মাকে দেখিয়ে শিরীনের উদ্দেশ্যে বললো, “মনি?তোমরাও আমাদের সাথে থাকবে?আমি,মা,মামা আর তোমরা একসাথে থাকবো?”

শিরীন মিষ্টির কথার উত্তরে বললো, “আমরা এখানে থাকবো নারে মা।কিন্তু আসবো প্রতিদিন ঠিক আছে?”

“থাকো না মনি।আমি একা থাকতে পারিনা।”

বাচ্চা মেয়ের আদুরে আবদারে তাকে কোনরকম আশ্বাস দিলো, “আচ্ছা থাকবো আমরা।তুই মন খারাপ করিস না।”

মিষ্টি চলে যেতেই শিরীন কনুই দিয়ে মল্লিকার হাতে ধাক্কা দেয়। ভ্রূ উচু করে রসিকতা করে বললো, “কিরে?তোর বরকে দেখছি তোর মেয়ে মামা বলে ডাকে।সম্পর্ক উল্টোপাল্টা হয়ে যাবে কিন্তু চন্দ্র। শুধরে নিস”

শিরীনের ঠাট্টায় দারুণভাবে লজ্জা পায় মল্লিকা। দূরে সরে গিয়ে বললো, “তুমিও না বুবু!”

“এমা?আমিতো ভালোর জন্য বললাম।আমার ভাই বাপ হয়েছে।বাপ ডাক শুনবে। কিসব মামা ডাক শিখিয়েছিস!”

ছোটোখাটো মশকরায় কান গরম হয়ে উঠেছে মল্লিকার। মাহরুরের বারণ করা সত্ত্বেও চুলোয় চা বসালো।খালি মুখে ফেরানো যায়? বাচ্চারাও সাথে এসেছে।সন্ধ্যার নাস্তা তারাই সাথে এনেছে।শেলফ ঘেঁটে আরো হালকা নাস্তার টুকটাক জিনিস পেয়েছে।তাই সাজিয়ে দিলো। সব মিলিয়ে জমে উঠেছে বিকেল।অনেকদিন পর মন খুলে হাসছে মল্লিকা।বোনের সাথে খোশগল্পে মেতে হালকা মনে হচ্ছে।

___

“তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে মাহি।এখন কিসের এর চিন্তা?সব চিন্তাতো চুকে গেছে তাই না।”

দুজন সাংসারিক পুরুষ বাজারে ঘুরছে।নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনাও করছে টুকটাক। রেদোয়ান এর ডিউটি এই সময় প্রায় শেষ হয়। ছুটে আসে মাহরুরের কাছে। কথাবার্তা বলে বাড়ি চলে যায়।আজকের সেই নিয়মমাফিকই চলছে। পুলিশি পোশাকে নিজের সংসারের জন্যও কেনাকাটায় ব্যস্ত রেদোয়ানও।

ফর্সা মুখটা ঘেমে একাকার।ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছে একটু পরপর। রেদোয়ান এর প্রশ্নের উত্তরে বললো, “মনের চিন্তা চুকেছে।মাথায় অনেক টেনশন। গতদিনগুলোকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে যেভাবে উড়িয়েছি। এরমধ্যে কাজে যাইনি। মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে।মাত্র দুইমাস হয়েছিলো গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়। হঠাৎ করে আবার ঢাকায়।একটা ভালো স্কুলের সন্ধান দিও।বেতন যেমনি হোক আমি চাই মিষ্টি একটা ভালো পরিবেশ পাক।”

“সায়মন যে স্কুলে পড়ে সেখানে ভর্তি করিয়ে দাও।”

“সায়মনের স্কুলটা এখান থেকে দূরে।আনা নেওয়া কে করবে?আমি চন্দ্রকে এই এলাকায় একা ছাড়তে চাইনা।মানুষের কানাঘুষার ভয়ে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছি।এখানে ওকে অনেকেই ফারহানের বউ হিসেবে চেনে।”

“তকি?ফারহান দুর্ভাগ্যবশত বেচে নেই।সবার অধিকার আছে নতুনভাবে বাঁচার।সবাই এখন মাহরুরের বউ হিসেবে চিনবে।”

অতশত চিন্তার মাঝেও স্মিথ হাসলো মাহরুর।কি মাধুর্য মিশ্রিত কথাটি ‘ মাহরুরের বউ ‘ তার চন্দ্রমল্লিকা ফুল। শুদ্ধ পুষ্প।মাছ ওয়ালার চেঁচামেচি তার সুন্দর কল্পনাকে ভাঙ্গে। হাত বাড়িয়ে মাঝারি সাইজের একটা ইলিশ কিনে নিল।

“মাহি একটা নতুন চাকরি খুঁজো।এভাবে হয় না।তোমার এগ্রিমেন্ট এর কাগজটা আমায় দিও।দেখি কি করা যায়।”

“নতুন চাকরি পাবো কোথায়?”

“আমি কয়েক জায়গায় বলে রাখি।একটা সিভি দিও।”

কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুরে মাহরুর বলে, “তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দিবো আমি জানি না।কত করবে আমার জন্য?”

বাজার শেষ।একই জায়গায় উদ্দেশ্যে দুজন পা বাড়ায়। রেদোয়ান বলে, “আমাকে সুন্দর টুকটুকে একটা জীবনসঙ্গী দিয়েছো।সে শুধু আমার না আমার বাবা মাকেও মাথায় তুলে রেখেছিলো।আব্বা আর আম্মা মারা যাওয়ার সময় আমার চেয়ে বেশি সে কেঁদেছে।আমার বাচ্চার মা সে।বিশ বছরের এক কন্যা আমার ঘরকে এমনভাবে সামলেছে যে আমার এখন আর কোনো চিন্তাই নেই।সারাজীবন তোমায় সাহায্য করেও এই ঋণ শোধ করতে পারবো না।”

বোনের সম্পর্কে ভালো কিছু কথায় মন প্রতফুল্লোতায় ভরে উঠে মাহরুরের।একটু জেদ আর অগাধ ভালোবাসার প্রতিমা সে।যারা জেদ বেশি তাদের মন অত্যন্ত নরম।এই কথার যৌক্তিক সংজ্ঞা শিরীন।হাটতে হাটতে বাড়ির দিকে এসেছে।হোটেল থেকে কিছু নাস্তা নিয়ে ফিরে এলো। মাহরুরের আওয়াজে সর্বাঙ্গ জুড়ে বিশেষ নড়চড় আজকের নয়।এখনও ঠিক আগের মতই। বোনের সাথে হাসি খুশিতে মেতে থাকা মল্লিকা জড়োসড়ো হয়ে বসে।চক্ষু নামায় সামান্য।

মাহরুর এসে বললো,

“চন্দ্র কাচা বাজার আর মাছ ফ্রিজে রাখবি?”

“জ্বি রাখছি”

মাহরুর বাকি সবার দিকে চেয়ে বলল, “আমি গোসলটা সেরে আসি।তোরা বস”

মল্লিকা বাজার সব এক হাতে ফ্রিজে রেখে দিলো।বাকি শুকনা বাজারগুলো একেক করে তাকে রেখেছে।হাত মুছে রেদোয়ানকে চা আর নাস্তা দিয়ে প্রশ্ন করলো,

“দুলাভাই?”

“হ্যা মল্লিকা বলো”

“আম্মাকে ছেড়ে দিয়েছেন?”

“আম্মা কে?”

“আমার শ্বাশুড়ি?”

“হ্যাঁ ছেড়ে দিয়েছি।হুমকি দিয়েই ছেড়েছি।তাছারাও ওনার ছোট ছেলে কল করেছিলো।ক্ষমা চেয়েছে।আশ্বাস দিয়েছে উনি আর এমন করবেন না। তোমাকেতো পাবেই না আর ছোট বউয়ের সাথেও এমন আচরণ করবে না।দেখা যাক কথা রাখে কিনা”

“ধন্যবাদ দুলাভাই।আর ওনাদের সাথে ঝামেলা করার দরকার নেই।আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি”

“আচ্ছা আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না”

মল্লিকা সস্তি পেলো। রেহালা বৃদ্ধ মানুষ।যতই নিচু মস্তিষ্কের হোক না কেনো এই বয়সে জেলে দিন কাটানো ঠিক হবে না।যেই কারণে তাকে মামলা দেওয়া হয়েছিল সেই কারণটাই আর অবশিষ্ট নেই।মল্লিকা চলে এসেছে বেশকিছুদিন।নতুন ঘর বেঁধেছে।আর কোনো নির্যাতন, অত্যাচারের শিকার হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

__

দিবার শেষে প্রতিবারই রাত্রি আসে।ঘুমন্ত নগরী তাদের দিনের ক্লান্তি মেটায়। গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে অপূরণীয় স্বপ্ন দেখে।রাতটা কাটে একেক জনের একেক রকমভাবে। মাহরুরের কাটে প্রায় নির্ঘুম।কতকাল কেটেছে বেদনায়।এখন সুখের উচ্ছাসে ঘুম উবে গেছে।কি জ্বালা! চন্দ্রের পাশের দিকে জমিনে ঠায় হয়েছে মাহরুরের। চৌকির উচ্চতা অতটা নয়।চোখ তুললেই কাছ থেকে অনুভব করা যায় তার চন্দ্রের অস্তিত্ব। মাহরুর ফিরে তাকালো।আভাস পেলো তার চন্দ্রের চক্ষু জ্বলজ্বল করে জেগে আছে।

মাহরুর ডাকে।বলে, “চন্দ্র?”

মেয়েলি গলায় জবাব এলো, “হুম?”

“ঘুমাস নি?”

“ঘুম আসছে না”

মাহরুর হাত সামান্য উচু করে ধরে।বলে, “হাতটা দে”

সংকোচ মল্লিকার।কেমন যেনো মাহরুর ভাই?স্পর্শ করলেই ভূমিকম্প শুরু হয়।পুরুষালি স্পর্শ তার কাছেতো নতুন নয়।তাহলে মাহরুরের সামান্য হাত ছোঁয়া কেনো তাকে দ্বিধায় ভোগায়।অধিকার খাটিয়ে হাতড়ে মল্লিকার হাতটা টেনে নিলো। আধাঁরে আচ্ছন্ন ঘরে জমিনে শুয়ে থাকা মানবের হাতে হাত রেখে উচু চৌকিতে মল্লিকা। দূরত্বটা এতটুকুই।

মাহরুর বললো, “আমি কিছু বললেই এমন চুপসে যাস কেনো?ভয় পাস?”

“উহু”

“ঘুরে তাকাতো আমার দিকে”

মল্লিকা চার পায়ার একদম কোনায় মুখটা আনে।তাকাতে চায়নি।হাতের টানে আসতে বাধ্য হয়েছে। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি মিয়ে গেলো।

“তুই কি আমার প্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করেছিস? বললি না যে?”

মল্লিকার নিরুত্তরে মাহরুর রেগে যায়।গলার আওয়াজে সেটা পরিষ্কার বুঝিয়ে বললো, “বোবা তুই?কথা বলতে জানিস না?”

হাতের পিঠে বৃদ্ধাঙ্গুল এর ঘর্ষণ অনুভব করে মল্লিকা।এই অনুভূতিতো গলায় শব্দ দলা পাকিয়ে ফেলছে। মাহরুর আবার বলে, “তুই গ্রহণ করিস না করিস আমি তোর প্রেমিক আজ থেকে।তোর প্রেমিকা হিসেবে কি কি করতে হবে জানিস?”

অস্ফুট কন্ঠে জানতে চাইলো মল্লিকা, “কিহ্?”

হুট করে ধড়ফড়িয়ে উঠলো মাহরুর।যেনো বিরাট কিছু ঘটেছে।মল্লিকার দিকে গোলগোল চোখে চেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “চন্দ্র তুই কি সব সবজি ফ্রিজে রেখেছিস?”

ভরকিত মাহরুরের দিকে চেয়ে মল্লিকা বললো, “হ্যা ”

মাহরুর জমিন কাঁপিয়ে হেঁটে গেলো ফ্রিজের দিকে। শাক সবজি হাতড়ে একদম নিচে ডেবে থাকা বক্স বের করে আনলো।মল্লিকার সামনে বসে মাথায় বারি দেয় হাতের সাহায্যে।

বলে উঠে, “গাঁধী মেয়ে! দেখবিতো ব্যাগের মধ্যে শুধু সবজি নাকি অন্যকিছুও আছে!”

ফোনের বাক্সটা ফ্রিজের ঠান্ডায় জমে গেছে। মাহরুর দ্রুত বের করে কাথা দিয়ে মুছতে লাগলো।নতুন বাটন মোবাইল।এবার ঘটনা বুঝতে পেরেছে মল্লিকা। কাচা বাজারের সাথে ফোনটাও ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল।নিজের বোকামিতে একহাত ঠোঁটের উপর রেখে হেসে উঠে।তার হাসিতে বোকামিতে সামান্য রাগ ভাবটা হাওয়ায় মিশে যায় মাহরুরের।বেহায়া মন সুযোগ দিলো না।হাত টেনে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় ঝড়ের গতিতে। ড্যাবড্যাব চোখ আর আকস্মিক কম্পিত শরীরে হাসি উধাও।

“হাসবি না বুকে লাগে।”

কান্ড ঘটিয়ে সস্তি মাহরুরের। ফোনটাকে অন করে দেখলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা।উঠে গিয়ে নিজের ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে পুরোনো সিম এনে পূনরায় এক পা গুটিয়ে বসে স্থির মল্লিকার কাছে। একপলক তাকে দেখে হেসেছেও বটে।সিম ফোন ইনস্টল করে দিয়ে।

বললো,

“এখানে আমার, শিরীন- রেদোয়ান, চাচা চাচী সবার নাম্বার সেভ আছে। শশীর নাম্বার শওকতকে বলে ম্যানেজ করে দিবো।কিন্তু তোর এই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কি জানিস?”

মল্লিকা মাথা উপর নিচ করে বোঝায় জানতে চায় সে কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পুরুষালি ভরাট গলায় নিজেকে দেখিয়ে মাহরুর বলে, “এইযে তোর প্রেমিককে দেখছিস?তাকে দুপুর বারোটায় একবার কল করবি।জানতে চাইবি ঠিকঠাক অফিসে গিয়েছি কিনা?নাস্তা করেছি কিনা?আবার দুপুরে কল করবি জানতে চাইবি খেয়েছি কিনা?খাবার শেষে জানতে চাইবি কখন ফিরবো।শেষ কথা কি বলবি জানিস?”

“কিহ?”

“তুমি করে ডেকে বলবি ‘ তাড়াতাড়ি ফিরবে।আমি অপেক্ষা করছি ‘।এগুলো বউদের কাজ।তুইতো আমার বউ আর প্রেমিকা দুটোই।তোর ডাবল দায়িত্ব”

কি অদ্ভুত!বউকে প্রেম শেখাচ্ছে।কিভাবে স্বামীর সাথে প্রেম করবে সেই পাঠদান করাচ্ছে। হাতে ধরে লাইন বায় লাইন। মাহরুর ভাই ঠান্ডা মস্তিষ্কের।সবসময় মাথা নত করেই মানুষের সাথে চলাচল করেছে।রাগ তার দেখেছে শুধু ঘরের মানুষ।আজ ঘরের চার দেয়ালে তার অদ্ভুত পাগলামো টাইপ রূপটাও দেখা হয়ে গেলো।স্বাভাবিক সুরে অস্বাভাবিক বাক্য ছুঁড়ে মল্লিকার দিকে।

এবার চোখ তুলে জানতে চাইলো, “তোর কিছু বলার আছে?”

“নাহ”

“আচ্ছা শোন। অন্য প্রেমিকারা প্রেমিক বয়সে যত বড় হোক না কেনো রাগ দেখায়,জেদ দেখায়।তুই দেখাবি না কিন্তু।আমি রাগ সহ্য করবো না।আমি রাগ দেখাবো শুধু।”

“এটা কেমন কথা?” মল্লিকার মুখ ফুটে আপনাআপনি কথাটি বেরিয়ে আসে।

“উফ!তোর জন্য আরেকটা উপায় আছেতো।অভিমান করবি মিছেমিছি অভিমান।আমি ভাঙ্গাবো।কারণ চন্দ্র হয় শুভ্র।সূর্যের মতন তেজী হয়না।আর চাঁদ মাঝেমধ্যে অভিমান করে মেঘের আড়ালে হারায়”

কথার অর্থ বোঝার মতন হলেও মল্লিকার মাথায় কিছুই ঢুকলো না। মাহরুরের মাথাটা গেছে এটাই ধরে নিলো।কোনো প্রতিক্রীয়া দিলো না। মাহরুর মল্লিকার এলোমেলো চুল দুহাতে ঠিক করে দিয়ে বললো,

“চন্দ্রকে অভিমানে মানায়।আমার অভিমানী চন্দ্রমল্লিকা। লুকোচুরি খেলবি।আমি ঠিক খুঁজে নিবো।কিন্তু আমার হৃদয়ের আকাশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিস না।তুই আমাকে যেতে দিয়েছিলি।আমি কিন্তু দিবো না চন্দ্র। মাহরুর শব্দের অর্থ জানিস?গরম! যেহেতু পুরোপুরি তোর প্রেমে পাগল হয়েছি।সূর্যের ন্যায় এবার সত্যি সবটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবো।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে