চন্দ্র’মল্লিকা ১৬
লেখা : Azyah_সূচনা
শওকত হাতাহাতি করেও পারছে না।তাকে আটকে রেখেই রাতের আধারে কয়েকজন লোক মাহরুরকে বেধড়ক মেরে যাচ্ছে।দুজন মানুষের বল পাঁচ ছয়জনকে আটকে রাখা সম্ভব?চিৎকার চেঁচামেচি করতে চাইলে মুখ চেপে ধরা হয়। রক্ত ঝরছে চোখের কোণ বেয়ে।ঠোঁট, নাকও বাদ যায়নি।এত ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যেও বুঝতে পারলো এটা রাব্বী মিয়ার লোকজনের কাজ। হয়তো সকালের কথা তাদের বিশ্বাস করাতে পারেনি।মুখে রুমাল বেধে ইচ্ছে মত লাঠিপেটা করে ফেলে রেখে গেলো মাহরুরকে। শওকতকে ছেড়ে দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে পালায়।
গলার আওয়াজ তুলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো শওকত।তাদের গালি দেওয়া শেষে মাহরুরের কাছে আসে।
বলে,
“ভাই তোর অবস্থা ভালো ঠেকছে না একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা কর।”
মল্লিকাদের বাড়ি থেকে অনেকটা কাছেই এই ঘটনা ঘটেছে।বাঘের গর্জনের মতন আওয়াজ তোলে শওকত।ডাক লাগায় ‘ রমজান চাচা ‘ বলে।গভীর রাতের নীরবতায় শওকতের গলার ধ্বনি চলে গেলো মল্লিকাদের ঘর অব্দি। ধড়ফড়িয়ে উঠেছে মল্লিকা।সাথে রমজান মিয়াও।এতরাতে বারংবার ডাকছে শওকত। নিশ্চয়ই কোনো বিপদ!মল্লিকা কেশ ছড়িয়ে দৌড় লাগায়।ভয়টা ইদানিং মগজে গেঁথে গেছে।রমজান মিয়াও দ্রুত পায়ে উঠোনে হাজির।
শওকতের পায়ে মাথা রেখে মাহরুর অস্পষ্ট গলায় বলে উঠে, “আমার চন্দ্র কে ডাক… ও…কে দেখবো আমি”
রমজান সাহেব এসে হাজির।মল্লিকা দাড়িয়ে আছে সদর দরজায়।সামনের কিছুই তার কাছে পরিষ্কার নয়। ভাতিজাকে রক্তাক্ত জমিনে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন। ছুটে আসেন তাদের দিকে।
শওকত বললো,
“চাচা এখন কোনো প্রশ্ন কইরেন না।আপনার ভ্যান এর চাবি দেন।ওরে হাসপাতালে নিতে হবে।”
“এই মল্লিকা!মল্লিকা!আমার ড্রয়ার থেকা ভ্যানের তালার চাবি দে।….আমার মাহি-র কি হইলো?ওরে এমনে কে মারলো।”
ফরিদা বেগম চাবির কথা শুনে ছুটে গেছেন ঘরে।ভ্যানের তালা খুলে নিজেই টেনে এগিয়ে দিলেন শওকতের কাছে।মল্লিকার পা জোড়া আর স্থির থাকতে পারলো না।রাত দিনের হিসেব না করেই চলে গেছে সদর দরজা পেরিয়ে।জমিনে পা গুটিয়ে বসেছে মাহরুরের সন্নিকটে!রক্তে ভেজা মুখটা তার দিকে চেয়ে। বিষদায়ক এই চাহনি।কোনো কথা,বাক্য আদান প্রদান এর আগে হাজির শওকত। দুজন মিলে তুলে নিলো মাহরুরকে ভ্যানে। দুঃসাহস দেখিয়ে বাবার সামনেই মেয়ের হাত চেপে ধরেছে মাহরুর।বলতে চাইতে সাথে আসতে।
মাহরুরের অব্যক্ত কথার অর্থ বুঝে মল্লিকা বললো, “আসছি আমি।আপনি চিন্তা করবেন না”
আঘাত অনেক। তবে গুরুতর কিছুই হয়নি। উপরিভাগের ক্ষত ড্রেসিং করে দেওয়া হয়েছে।রাতের বেলায় ডাক্তার পাওয়া গেলো এটাই অনেক বড় সৌভাগ্য। ব্যান্ডেজ করে দিয়ে আজ রাত মাহরুরকে হাসপাতালে রাখবেই বলা হলো। ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়েছে। পীড়ায় আড়ষ্ট মাহরুরের চোখ মল্লিকার সন্ধানে।আরো পাঁচ ছয়জন রোগীর কোলাহলের মধ্যে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পাওয়ার রোগটা বেশী জোরালো।সামনেই শওকত আর রমজান সাহেব আলোচনায় মগ্ন।ঘোর আলোচনা।কে করেছে?কেনো করেছে?এটাই তাদের আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু। তাতে মাহরুরের কি?মার দিয়েছে, মার খেয়েছে। শোধবোধ!
মিনিট পাঁচেক পর মন বাগানে চন্দ্রমল্লিকার আগমন ঘটে।এসেই ধীমা গলায় জানতে চাইলো, “কেমন লাগছে এখন?”
রমজান সাহেব আর শওকতের নিরাপদ দূরত্ব দেখে মাহরুর উত্তর দেয়, “ভালো নারে।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে চন্দ্র”
“তাহলে কেনো গেলেন মারতে জহিরকে?আপনি চেনেন না রাব্বী চাচাকে?”
মুখের ভঙ্গিতে পরিবর্তন হলো।যেখানে নিজের বেদনার কথা বলে মুখটা পরিশ্রান্ত হয়ে উঠেছিল সেখানে অত্যুগ্র হয়ে উঠে।
বলে, “সাহস কি করে হয় ওর তোর দিকে খারাপ দৃষ্টি দিতে?ওকে ওর যোগ্য শাস্তি দিয়েছি।ওকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেও আঘাত পেয়েছি।কিন্তু জানিস একটা কথা?”
“কি?”
গভীর চোখে মল্লিকার দিকে চেয়ে বলল, “দেহের ব্যথার চেয়ে তুই আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস এই ব্যথা দ্বিগুণ।আমি এত বেহায়া কি করে হলাম?”
“বিশ্রাম করুন”
“কাল বিয়ে করবো আমরা ঠিক আছে?”
চলে যাচ্ছিলো পিঠ দেখিয়ে। নিদারুণ চাওয়ায় বেশিদূর এগোতে পারেনি।আদুরে গলায় ডেকে বলছে বিয়ে করবে।গোলগোল চোখে চাইলো মাহরুরের দিকে।মল্লিকা রাজি না জানা সত্ত্বেও কি করে আবদার করে ফেললো?
“আমার বউ সাজবি না চন্দ্র? মাহরুর ইবনাতের বউ চন্দ্রমল্লিকা”
কিশোরী মনে যেই ঝড়টা তুলতো এখনও ঠিক সেই রকম তুফান উঠেছে।তার কথা,তার চলাফেরা,তার মুখখানা।আজও তেমনি আছে।ভিন্নতা এসেছে তার ইচ্ছেগুলোতে।তার কাছ থেকেই তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রয়াস করে যাচ্ছে।এটা মাহরুরের নতুন রূপ।কয়লা পুড়িয়ে স্বর্ণ বেরিয়ে আসার মতই।নিত্যনতুন চালচলনে আশ্চর্যের চরম সীমায় এনে একাকী দাড় করিয়ে দিচ্ছে মল্লিকাকে।
___
“আমার ভাতিজাকে অযথা কেনো মারা হলো?আমি জানি আপনার লোকেরাই করেছে এই কাজ রাব্বী ভাই”
আজও গ্রামে পঞ্চায়েত বসে।সালিশ বিচার হয়।ঠিক তেমনি আজও বসেছে। জহির উপস্থিত সেখানে।রমজান সাহেবের প্রশ্নে রাব্বী মিয়া উত্তর দিলো,
“আপনার ভাতিজা কি করেছে শুনেননি?আমার ছেলেকে যে অযথা মারলো?”
“আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে আমার ভাতিজা মেরেছে জহিরকে?”
রাব্বী মিয়া মাহরুরের মানিব্যাগটি ছুঁড়ে দিলো রমজান সাহেবের দিকে।নিজের হারানো মানিব্যাগ দেখে দৃষ্টি তুললো মাহরুর।সেদিন ভরে ধস্তাধস্তি করতে গিয়েই পড়ে গেছে হয়তো।
রাব্বী মিয়া সবাইকে দেখিয়ে বললো, “এইযে রমজান ভাইয়ের ভাতিজার মানিব্যাগ।আমার গ্যারেজ থেকে পেয়েছি।এখন আমি জানতে চাই কেনো আমার ছেলের সাথে এই মারামারির শুরু হলো”
পঞ্চায়েতের এক গুরুজন জানতে চাইলেন, “বলো মাহি কেনো মেরেছো?”
মুখ শক্ত করে মাহরুর উত্তর দেয়, “ওনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন!রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করে।পথ আটকায়।বাজে ইঙ্গিত দেয়।জিজ্ঞেস করেন ওকে মল্লিকাকে আজেবাজে নোংড়া কথা বলেনি?ঠিক সময়ে শওকত না আসলে হয়তো তাদের ক্ষতিও করতে পারতো।”
মাহরুরের কথায় সকলে জহিরের দিকে চায়।নিজেকে রক্ষা করতে জহির বলে উঠলো, “মল্লিকা আমাকে নিজে ওর কাছে ডাকছে আব্বা।আমি যেতে চায়নি।আব্বা এই মাইয়ার নিয়ত ভালো না শওকত ভাইরেও নিজের পেছনে নাচায়।এখন ওর কারণে আমি মার খেলাম।এখন দেখছি মাহি ভাইও ওর জন্য উতলা।বুঝতে পারছেন আপনারা কতগুলা পুরুষরে হাত করে রাখছে?আমার কাছেও এভাবেই আসছিলো।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় মাহরুর।ব্যান্ডেজ করা নড়বড়ে হাত পা দিয়েই তেড়ে গেলো জহিরের দিকে।শওকত আর রমজান সাহেব এসে থামিয়ে দেয় তাকে।আঙ্গুল তুলে জেদী গলায় বলতে লাগলো,
“জবান টান দিয়া ছিড়া ফেলবো জানোয়ারের বাচ্চা!তুই নষ্ট!তুই কুলাঙ্গার।ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে নিজের দোষ মল্লিকার উপর দিচ্ছিস।মেয়েদের উপর দোষ নিয়ে নিজে বেচে যাবি বলে?”
রাব্বী মিয়া সবার মধ্যে বলে উঠেন, “দেখেছেন?দরদ দেখেছেন?আমার ছেলে যা বলছে তাতো ঠিক প্রমাণিত হলো।তেজ দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে কিছু চলে।এসব মেয়ে গ্রামে থাকা মানেই আমগো পোলাপানের উপর খারাপ প্রভাব পড়বো।স্বামী হারা মাইয়া কারো গলায় ঝুলতে পারলেই বাঁচে।এদের বাইর করে দেন গ্রাম থেকে”
“বের করে দিবে মানে?এই গ্রামে আমার আব্বা আর মল্লিকার আব্বার পৈতৃক ভিটা।এক পাও নড়বে না কেউ এদিক থেকে।আর আমরা কোনো ভুল করি নাই আমরা কেনো গ্রাম ছাড়বো।আপনারা গুণীজন!কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক যাচাই করেন।আর মল্লিকার সাথে আমার কি সম্পর্ক এটা নিয়ে আপনাদের না ভাবলেও চলবে।রাব্বী সাহেব বাড়াবাড়ি করলে আমিও করবো!” বলে বলে গেলো মাহরুর।
মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে লড়ায়ে জয়ী হয়েছে মাহরুর। ধৈর্যশীল পুরুষের মাঝে চাপা হাসি।কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। ফরিদা বেগম বেঁকে বসেছিলেন।হাত পা জোর করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো হয়েছে।এলাকার মানুষের আড়ালে কাজী সাহেব এসে হাজির।সম্পূর্ণ লুকিয়ে ছাপিয়ে চন্দ্রকে নিজের নামে লিখিয়ে নেবে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা মল্লিকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আগে বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে।শওকত আর শশী এসেছে। মিষ্টি অনেকটা অবাক।কি হচ্ছে এখানে?তাকে শুধু এটাই বলেছে মাহরুর।আজ থেকে সে তার মামা নয়।বাবা বলে ডাকার আবদার করেছে ওই বাচ্চা মেয়েটির কাছে।যেকিনা বাবা শব্দের অর্থই জানেনা।নিজের বাবাকে কখনো দেখেইনি।বুঝেনি।তিন কবুলে চোখের পলকে বিয়ে হয়ে গেল।মল্লিকা এখনও স্তব্ধ।সবচেয়ে বেশি সময় সেই নিয়েছে।বিশ মিনিটে কাজী সাহেবকে সামনে বসিয়ে আবারো একবার ছক কষেছে।যা করছে ঠিকতো? স্বার্থপর বলে তাকে সমাজে ধিক্কার দেওয়া হবে নাতো।সমাজ বলবে নাতো পুরোনো প্রেমে নতুন করে মত্ত হয়েছে?বাবার অনুরোধে মিষ্টির কথা ভেবে বিয়েতো করে ফেললো।এখানে আগের মতোন ভালোবাসা কোনোদিন আসবে না।কক্ষনো না!
সাধাসিধে মল্লিকা।মুখে পরনে কোথাও বধূর সাজ নেই।মাত্র যে মাহরুরের বউ হয়েছে সেই ছাপ নেই। মাহরুরের অবস্থাও ভিন্ন। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে চন্দ্রকে।মনের প্রশান্তির কাছে এই শারীরিক যন্ত্রণা তুচ্ছ অত্যন্ত তুচ্ছ।অন্য ঘরে বসে মাহরুরকে মেনে নিয়েছে চন্দ্র এটাই কি বড় পাওয়া নয়?
মাহরুর বললো, “আমি রাতে চন্দ্র আর মিষ্টিকে নিয়ে ঢাকা ফিরতে চাচ্ছি”
“আর ক’টা দিন থেকে যা বাজান?”
“না চাচা! আমি আমার স্ত্রী আর বাচ্চার সম্মানহানি এক মুহুর্ত এখানে সহ্য করবো না।আগে সহ্য করেছি কারণ অধিকার ছিলো না সাথে ছিলো পুরোনো কিছু ভুল।অনেক সহ্য করেছে ওরা।আর না।”
মাহরুরের কথাগুলো শুনে ঠান্ডা হলো রমজান সাহেবের হৃদয়। মিশ্র অনুভূতির মধ্যে দিয়ে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কিন্তু পূর্ণ বিশ্বাস মাহরুরের প্রতি।আর যাই করুক নিরাশ করবে না।
মাহরুর আবার বললো, “আমাকে একটু গোছাতে দেন সবকিছু। আপনাদেরও এখানে রাখবো না।এসব নিচু মানসিকতার মানুষের মধ্যে থাকার কোনো দরকার নেই।কয়েকমাস সময় দেন আমাকে।”
___
রাত এগারোটার বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলো। ভোর পাঁচটায় শহরে এসে পৌঁছায়।পুরো ছয়ঘণ্টা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ চন্দ্রকে দেখেছে মাহরুর।গুটিসুটি হয়ে বাসের এক কোনে জমে ছিলো বরফের মতন।অধিকার থাকা সত্বেও মাহরুর জানতে চায়নি এই নীরবতার কারণ।আনমনে ভেবে বসে ছিলো হয়তো আকস্মিক বিয়ে সে মেনে নিতে পারেনি।সবকিছু এত দ্রুততার মধ্যে ঘটে গেলো যার কারণে মস্তিষ্ক প্রায় অচল। মিষ্টিকে ঠিক আগের মতই কোলে জড়িয়ে হাঁটছে মাহরুর।অন্যহাতে ভারী ব্যাগটা।পাশেই হাঁটছে তার সহধর্মিণী,তার প্রতীক্ষার ফল চন্দ্র।অল্প স্বল্প মানুষের চলাফেরা আছে রাস্তায়।হেঁটে চলা মল্লিকার পা আকস্মিক থেমে যায়। বাগানবাড়ির দিকে নজর পড়লে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়।এখানেই কাটিয়েছে বিগত ছয়টা বছর।খুব সুখ যে ছিলো তা নয়।কষ্টের মাঝেও মায়ায় জড়িয়ে ছিলো এই বাড়ির সাথে।
কোমল হাতে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখের পলক ফেলে মল্লিকা। স্বয়ং মাহরুর তার হাত আগলে নিয়েছে।বললো,
“ভুলে যা এই বাড়িকে।একটা কালো অতীত ভেবে ঝেড়ে ফেলে দে।এখন তোর জন্য আমার চিলেকোঠার ঘর অপেক্ষা করছে।”
বললেই ভুলে থাকা যায়না।এই কথাটাই মনে বাজলো মল্লিকার। মাহরুরের পাশ ঘেঁষে তার ছোট্ট ঘরে এসে কদম রেখেছে।সব এলোমেলো।একা ছেলে মানুষের ঘর বলে কথা। মিষ্টিকে মল্লিকার কাছে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সবটা দুহাতে গোছগাছ করে নিচ্ছে।
কোনরকম বিছানার উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নিয়ে হাত এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আয় আমার ঘরে”
মাহরুরের এক বুক আশাকে ভঙ্গ করে দিয়ে হাতটা ধরে নি মল্লিকা। মেয়েকে নিয়ে ঘরে এসে দাড়িয়ে আছে। মাথা ঝুঁকিয়ে হাসলো মাহরুর।তার চন্দ্রের কষ্ট,অভিমান দুদিনের নয়।অনেক সময় নিজেই নিজেকে দগ্ধ করেছে অদৃশ্য অগ্নিতে।এত সহজেই সস্তির বৃষ্টি নামবে?
“ঘুমিয়ে পড়।জার্নি করে এসেছিস ক্লান্ত।”
মল্লিকা মিষ্টিকে শুইয়ে দিলো।এক নজর রাখলো মাহরুরের উপর।হয়তো চোখের ভাষায় বোঝাতে চাচ্ছে সে কি করবে? ঘুমাবে নাকি জেগে থাকবে?অব্যক্ত মনের ভাষা বুঝে মাহরুর আলমারি থেকে আলাদা চাদর বের করে জমিনে পেতে শুয়ে পড়লো।
বললো,
“এবার শান্তিতে ঘুমো।”
শরীর ক্লান্ত ভীষণ রকমের।বিছানায় পিঠ ঠেকতেই ঘুমেরা ঝেকে বসেছে চোখে।মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে মল্লিকা।নিচে সমতল জমিনে শুয়ে চন্দ্রের উপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করতে করতে চোখ লেগে আসে মাহরুরেরও।
মাত্র তিন ঘণ্টার ঘুম শেষে উঠে পড়তে হয়।গোসল সেরে গায়ে পোশাক জড়িয়ে নেয় মাহরুর।অফিস কামাই করেছে অনেকদিন।আজ না গেলেই নয়।গলায় টাই পড়তে পড়তে ঘুমন্ত মা মেয়েকে দেখে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে।এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত চন্দ্রের দিকে এক দৃষ্টিতে চায়।ঝুঁকে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“অভিমান কমানোর চেষ্টা করবো চন্দ্র”
ঘুম পাতলা মল্লিকার।অল্প আওয়াজেই নড়েচড়ে উঠলো। মাহরুর সরে যায়। একটু জোরেই মল্লিকাকে ডেকে তুলে।বলে, “আমি অফিসে যাচ্ছি চন্দ্র। রুটি আর ভাজি এনে রেখেছি সকালের নাস্তা।যাওয়ার পথে রবিনকে বলে যাবো দুপুরের খাবার দিয়ে যেতে মোল্লা হোটেল থেকে।রাতে এসে রান্না করবো। সাবধানে থাকিস।”
ঘুমঘুম ঘোর লাগানো গলায় মল্লিকা জানতে চাইলো, “আর আপনি?”
“আমি খেয়ে নিবো অফিসে গিয়ে।”
ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়েছে। এখনই বের হবে। অন্যদিকে কাথা গায়ে পেঁচিয়ে বসে মল্লিকা।জুতো পড়ে বাহিরে যাওয়ার আগে মাহরুর বলে উঠলো, “বাড়ির কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে নিজের পরিচয় দিবি।”
“কি পরিচয়?”
কপাল কুঁচকে নেয় মাহরুর।বুকে হাত বেধে বললো, “স্পষ্ট শব্দে বলে দিবি আমি মাহরুরের বিবাহিত স্ত্রী।”
পুরুষ মানুষ বদলায়।প্রেমে ভীষণ রকম বদলে যায়।তাদের প্রত্যেকটা শব্দ,প্রতিটা অক্ষরে ব্যক্ত হয় সেটা। মাহরুরের বদলে যাওয়া ভাবভঙ্গিও সেখানেই ইঙ্গিত করছে।এই প্রেমের অনুভূতি থেকে মল্লিকার মনও বিরত নয়।সেও এককালে যা প্রখরভাবে অনুভব করেছিলো চন্দ্রের মন সেই অনুরাগ মাহরুরের চোখেও স্পষ্ট।
চলবে…