চন্দ্র’মল্লিকা ১৩ + ১৪
লেখা : Azyah_সূচনা
“আমাকে চিনতে পেরেছিস?এককালে তোর জীবনে শশী নামের একজন ছিলো।তোর সখী ছিলো।আজ,এই মুহূর্তে খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে তাই না?”
তীর্যক বাক্যসমূহ। রোষাবেশে পরিপূর্ণ।সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে পুরোনো দিনের বন্ধুত্ব মনে পড়ছে।তার একজন ছোটবেলার বন্ধু ছিল সেটা বুঝি ভুলতে বসেছে।
মল্লিকা এগিয়ে আসে।জড়িয়ে ধরবে বলে।শশী থামিয়ে দেয় তাকে।আক্রোশ দেখাচ্ছে। দেখানোও জায়েজ।অন্তত তার সাথে যোগাযোগ করা উচিত ছিল।
“তুই আসবি বলে নিজের ঘর সংসার ফেলে এসে গেছি একদিনে।তোর বিয়ের দিন তোকে আমার নাম্বার দিয়েছিলাম।ওই নাম্বারটা এখনও খোলা আছে।মন বলতো একদিন কল করবি। তা আর হলো কই?তুইতো স্বার্থপর লোক মল্লিকা!”
নরম হৃদয়ে বিধেছে কথা। ঝরঝর করে কেদে ফেলে।শশী?এই বদলে যাওয়া মেয়েটা শশী?কান্না দেখে শশীর শক্ত হয়ে থাকা মুখটা একটু স্বাভাবিক হয়।তারপরও রুষ্টতা আছে এখনও।
মল্লিকা আবার এগিয়ে এসে বললো, “মাফ করে দে। পরিস্থিতি এমন ছিলো যে আমি আমার বাবা মার সাথেও ঠিকঠাক কথা বলতে পারতাম না।”
“বলে না তাড়াহুড়োর কাজ শয়তানের।তোর ক্ষেত্রেও তাই। মাহি ভাইয়ের উপর অভিমান করে না জেনে না বুঝেই এমন একজনকে বিয়ে করেছিস!দেখ কি হলো তোর জীবনে?”
“তুই কি করে জানলি?”
“চাচী মাকে বলেছিলো।আমি মায়ের কাছ থেকেই জেনেছি”
এবার বাধা দেয়নি। নির্দ্বিধায় জড়িয়ে ধরলো মল্লিকাকে।দুজনেই কেঁদে এতদিনের বিচ্ছেদের আপোস মিটিয়ে নিচ্ছে। শশীর পাশেই একটা ছোট্ট ছেলে দাড়িয়ে। মান অভিমানের পালা মিটিয়ে চোখ যায় তার দিকে।বুঝতে দেরি করেনি মল্লিকা।এটা তার শশীর ছোট পুঁচকে।
মল্লিকা ঝুঁকে বসেছে। গালে আদর দিয়ে জানতে চাইলো, “কি নাম গো তোমার?”
“সীমান্ত”
“বাহ্ বেশ সুন্দর নাম।আমি কে জানো?”
“মল্লিকা খালামণি।”
চক্ষু কপালে উঠেছে মল্লিকার।চট করে বলে ফেলে সীমান্ত।কি করে চিনলো তাকে?আনন্দে আটখানা।অন্যদিকে শশী মিটিমিটি হাসছে।
মল্লিকা বললো, “এ বাবা?তুমি আমাকে কি করে চিনলে?”
“মা আমাকে তোমার ছবি দেখিয়েছে।বলেছে তুমি নাকি মার সবচেয়ে প্রিয় সখী। মানে বন্ধু।তোমার গল্প শুনেছি।”
চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে মল্লিকার ঠোঁটে।কি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা।পুরোটাই যেনো শশীর চাপ। শওকত ভাইও বিয়ে করেছে।তার ঘরেও সন্তান আছে। মেয়ে সন্তান।মিষ্টি দৌড়ে এলো।অজ্ঞাত দুজনকে দেখে মায়ের ওড়না চেপে পিছনে দাড়ায়।
মল্লিকা মিষ্টিকে দেখিয়ে সীমান্ত এর উদ্দেশ্যে বললো, “দেখো সীমান্ত এটা তোমার মল্লিকা খালামনির মেয়ে।তোমার বোন”
ফোড়ন কাটে শশী।মিষ্টিকে কোলে তুলতে তুলতে বললো, “খবরদার বোন বানাবি না।ওকে আমি আমার ছেলের বউ করবো।”
“তোর ছেলের বয়স কত রে?”
“তোর বিয়ের সময় সীমান্ত আমার পেটে ছিলো।কিন্তু তোকে ওই সংবাদ দিতেই পারিনি।আমিও জানতাম না।সেই হিসেবে আমার সীমান্ত তোর মেয়ের বড়ো।তাই তাদের বিয়েতে বয়সের সমস্যা হবে না।”
বলে হেসে উঠে শশী।তার সাথে মল্লিকাও।বোকার মতন মিষ্টি আর সীমান্ত একে ওপরের দিকে চেয়ে।কি বলছে তাদের মায়েরা?সবতো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।সেখানে কান দিলো না তারা।দুজনের সাথে পরিচিত হতে লাগলো।এতখন যাবৎ আড়ালে চন্দ্রের বাধাহীন হাস্যোজ্জ্বল মুখটা গভীর নয়নে পর্যবেক্ষণ করছিলো মাহরুর।অজান্তে নিজেও হেসেছে। কেমন অদ্ভুত সস্তি আছে এই হাসিতে। গুঞ্জনে শীতল করতে হৃদয়।
“ছেলে মেয়ের বিয়ের প্ল্যান চলছে?”
অপ্রস্তুত শশী আর মল্লিকা।পিছু ফিরে তাকায়। মাহরুর তাদের দিকেই আসছে।মল্লিকার হাসি মিয়ে যায়।অন্যদিকে শশী বুঝতে পারলো না কি প্রতিক্রীয়া দেবে?কুশল বিনিময় করবে নাকি এড়িয়ে যাবে তার সখীকে ধোঁকা দেওয়ার দায়ে।
“কেমন আছিস শশী?”
“ভালো মাহি ভাই।আপনি?”
“আছি..”
এই উত্তরটাইতো দেয় মাহরুর। ‘ আছি ‘ অর্থাৎ আছে কোনরকম বেচে।না থাকার মতন করেই।তিনজনের মধ্যে অদ্ভুত নীরবতা বয়ে গেলো।সঠিক সময়ে বেখাপ্পা পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে আগমন ঘটে রমজান সাহেব এর।
এসেই মাহরুরের উদ্দেশ্যে বললেন, “মাহি? কাল খেতে আসলি না কেনো?”
“কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম চাচা।এই একটু আগে ঘুম ভেঙেছে।”সরাসরি মিথ্যে উত্তর দেয় মাহরুর।
“আচ্ছা..আয় ভেতরে আয়।এই শশী তুইও আয়।কতদিন পর এলি এই বাড়িতে।”
___
ইচ্ছের বিরুদ্ধে জীবনযাপন করতে হয়।দিনের পর দিন ইচ্ছের বিরুদ্ধেই করে আসছে।এইযে এখন?একবিন্দু ইচ্ছে নেই ঢাকা যাওয়ার।যেদিকে এই গ্রামীণ পথ ভুলে বসেছিলো।এখন থাকতে চাইছে।কারণ চন্দ্র।একমাত্র চন্দ্রমল্লিকা।তাকে নিজের করেতো এই জীবনে পাওয়া হলো না।হবে না।একটু দেখেই নাহয় শান্তি অনুভব করা যেত?তার হাসি,তার নতুন জীবন,বাবা মায়ের সাথে আনন্দে ভরা সময়গুলো।নিজের চোখের ফ্রেমে আবদ্ধ করে রাখতো?
শশী বাড়ি ফিরে গেছে। মাহরুর এখানেই।ফিরবে একটু পরে।বাস রাত নয়টায়।তখনই ছুটবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।আবার জীবন চলবে নিরসভাবে।মনে করে তার চন্দ্রকে ধুকেধুকে মরবে। ফেসবুক ব্যবহার করেনা এমন মানুষ কমই আছে।এর মধ্যে মাহরুরও ছিলো।নিজেকে গেঁয়ো ভাবতো!ভাবতো এসব শহুরে মানুষের ব্যবহার্য জিনিস।তবে প্রয়োজনের তাগিদে সেও এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।সেখানেই চোখে পড়লো বিরাট আয়োজন।এলাহী কান্ড!ঢাকার নামকরা কমিউনিটি হলে বিয়ে হচ্ছে।আর বিয়ের পাত্রী তারই সাবেক স্ত্রী হিরা। এতদিনে বোধহয় চলেও গেছে কানাডা?আকষ্মিক রাগ মাথা চড়া দিয়ে উঠলো।ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও আটকে যায়। মধ্যবিত্তের এসব জেদ মানায় না। দ্রুত হাতে ব্লক অপশনে ক্লিক করে চিরতরে বিদায় করেছে হিরাকে। ফোঁসফোঁস করতে থাকা মাহরুরের চোখ যায় তার আনা কাপড়গুলোর দিকে।চন্দ্র আর মিষ্টির জন্য এনেছিল।ছুঁয়েও দেখেনি সে?উল্টো আলাদা করে দূরে রেখে দিয়েছে।যেনো ফেলনা জিনিস?
ফরিদা বেগম এর চলে যাওয়ায় সুযোগ বুঝে মাহরুর বললো, “কাপড়গুলো ফেলে রেখেছিস কেনো?”
সময় নিয়ে মল্লিকা উত্তর দেয়, “আমার এসবের দরকার নেই।ঘরে পুরোনো কাপড় আছে।
“তুই আগের কাপড় পড়বি?গায়ে আসবে?আর মিষ্টিকে কি পড়াবি?তোর পুরোনো কাপড়?এগুলো যে কিনে আনলাম?তুই বলছিস তোর লাগবে না। আগেতো যে উপহার দিতাম সাদরে গ্রহন করতি।”
কণ্ঠের পরিবর্তনে বিষম খায় মল্লিকা।চোখে মুখে মৃদু রাগের আভাস।নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই মল্লিকা বললো,
“আগের দিন নেই”
“আর আমি আগের মাহরুরও নই।বদলে গেছি।আর অনুভূতিহীন যন্ত্র না আমি”
কথার অর্থ বুঝেছে?একটু একটু অবশ্যই বুঝেছে মল্লিকা।সেতো এখন আর কিশোরী নয়।না বলে বোঝালো তার মধ্যে অনুভূতি আছে। প্রখর অনুভূতি। মাহরুর লুকিয়ে মানিব্যাগটা বের করে।সেখান থেকে চন্দ্রের সেই ছবিটা বের করে এগিয়ে দিলো।
বললো, “চেয়েছিলি আমার কাছে। বলেছিলি ছবিটা বাঁধাই করে দিতে। প্রিন্ট করে রেখেছিলাম!কিন্তু তোকে পাইনি দেওয়ার জন্য।নে!”
একের পর এক চন্দ্রকে অবাক না করলেই নয়। ছবিটা হাতে নিয়ে বিস্মিত হয়।এটা সেদিনের ছবি যেদিন মাহরুর নতুন ফোন কিনেছিল। সর্বপ্রথম ছবিটা তারই তুলে। পিঠা খাওয়াতে খাওয়াতে আবদার করেছিলো যেনো ছবিটা বাঁধাই করে রাখে। স্পষ্ট মনে আছে তার।কথা রেখেছে মাহরুর।এই ছবিটা বুঝি ছয় বছর সাথে নিয়ে ঘুরেছে?বেশ পুরোনো দেখালো।
“ছবিটা রাখবি নাকি ফেরত দিয়ে দিবি?”
নিজের পুরোনো রূপটা দেখে বেশ ভালোই লাগছিলো মল্লিকার। প্রানবন্ত মুখ।হারিয়ে গেছে এখন বাস্তবের চাপে। মাহরুরের কথায় উল্টো প্রশ্ন করে বসে মল্লিকা, “রাখবো?”
“তোর ইচ্ছে।”
নাদান মুখ নামিয়ে মল্লিকা বললো, “রেখে দেই?”
“রাখ”
আগের কথা তুলতে চায়না।কিন্তু কৌতুহল থাকে মানুষের অন্তরে অন্তরে।জানতে চাচ্ছে ফারহানের মৃত্যুর কারণ। জানাটা প্রয়োজন।গলা পরিষ্কার করে মাহরুর প্রশ্ন করে, “আমাকে বলবি ফারহান কি করে মারা গেলো?….না মানে শুনেছি হুট করে মারা গেছে।”
বিষাদভারাতুর মুখে মল্লিকা বলে, “জেনে কি করবেন?”
“কিছু করার আছে?নেই! শুধু জানতে চাইছি।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর আসে, “রাতে বাড়ি ফিরছিলো।ছিনতাইকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে। হাতাহাতি করলে এক সময় ছুরি চালিয়ে দেয় বুকে”
শেষ কথা বলে কেপে উঠলো চন্দ্র। চোখে পড়েছে মাহরুরেরও।তবে কিছুটা সত্য সেও জানে।বাড়ি ফেরার পাশাপাশি নির্ঘাত নেশাগ্রস্ত ছিলো। প্রতিরাতে তাকে ওই এলাকায় মাতলামি করতে দেখা গেছে।নতুন কিছুই নয় এটা।কিন্তু মৃত মানুষ আর চন্দ্রের অবস্থা দেখে কথা বাড়ালো না মাহরুর।
“আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি চন্দ্র?”
“কিহ প্রশ্ন?”
“ভালোবেসেছিলি ফারহানকে কখনো?কোনো একটা মুহূর্তে?”
কঠিন হয়ে মল্লিকা জবাব দেয়, “আমার সন্তানের বাবা সে। অবশ্যই ভালোবাসতাম তাকে।”
চন্দ্রের কথার ধাঁচেই মাহরুর উত্তর দেয়, “মায়া বলে সেটাকে।ভালোবাসা না”
“হুম। আপনার চেয়ে ভালো এটা আর কেই বা বলতে পারবে।”
মাহরুরের মুখের বাক্যরা তেড়ে আসছিলো। যথাযথ উত্তর দিতে যাচ্ছিলো।এর আগেই থামিয়ে দেয় মল্লিকা।কপাল কুঁচকে বলে উঠলো, “আমি এসব ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি না মাহি ভাই।”
একে অপরের দিকে প্রশ্ন উত্তর ছুড়াছুড়ি সমাপ্ত হয়। সময়ের ঘাটতি।রওনা হতে হবে মাহরুরকে।অবাধ্য,বেহায়া মনের বোঝা বয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে সেখানে। ভুলিয়ে ফুঁসলিয়ে মন জানতে চাইলো চন্দ্র কি তাকে আটকাবে? বলবে আরেকটু থেকে যেতে?এত সরাসরি নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।একেক সময় একেক গান গায় হৃদয়।এভাবে ডুবেছে চন্দ্রমল্লিকায়?তার অপ্রাপ্তি তারই শাস্তি।ভোগ করতে থাকুক বিষাদে।
ব্যাগ কাঁধে তুলে বললো, “আসি”
মিষ্টি মাহরুরের হাত টেনে বলে উঠে, “মামা চলে যাবে?আরেকটু থাকো”
মা না হোক।মেয়ে ঠিকই মাহরুরের সুপ্ত ইচ্ছের পূর্ণতা দিয়েছে।তাকে কি করে বলবে সেও থাকতে চায়।কিন্তু সম্ভব না। মাহরুর ছোট মিষ্টিকে বললো,
“আবার আসবো মামা।তুই ভালোমত থাকিস।দুষ্টুমি করিস না।”
“আমি দুষ্টুমি করি না মামা।”
“এইতো ভালো মেয়ে।আসি”
মল্লিকা ভাবলেশহীন।মূর্তির মতন দাড়িয়ে আছে।এক পলক দেখে নিলো তাকে।তবে মন ভরলো না।এই স্বাদ মিটবে না আজন্ম দেখেও।মনে মনে ভাবলো এই পুরুষের মনে তুই যে ঝড় তুলে দিলি? থামাতেও আসলি না। সারাজীবন বোধহয় এটাই বুকে দিয়ে বাঁচতে হবে।আবার কবে না কবে আসা হয়।এখন বারবার গ্রামে আসলে লোকে কেনো বাড়ির মানুষই সন্দেহের চোখে দেখবে। মাহরুরের দৃষ্টিকে কুৎসিত বলে আখ্যা দিবে।এই উপায়টাও নিজের হাতেই মাটিচাপা দিয়েছে।কেনো আসবে বারবার?কি করতে?
দরজায় দাঁড়িয়ে রমজান সাহেব এর হাতে কিছু টাকা গুজে দেয়।বলে, “মিষ্টিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েন চাচা।এখন ওর পড়ার বয়স।”
“বাপ!আমার ব্যাংকে কিছু টাকা রাখছি।ওই টাকা দিয়েই হইবো।তুই এত চিন্তা করিস না।”
“চাচা!আম্মা থাকতে আম্মার জন্য করতাম।এখন আপনারা আমার মুরব্বী।আমার দায়িত্ব আছে।আব্বার মতইতো আপনিও।”
“তারপরও মাহি তুই আর কত করবি?তোর একটা ভবিষ্যৎ আছে।বউ আছে।সংসার আছে।”
“নাই”
“মানে?”
“কিছুনা চাচা।টাকাটা রাখেন।ভালো থাকেন আর কোনো দরকার পড়লে কল দিবেন।”
“আচ্ছা বাবা সাবধানে যাস। ফিয়ামানিল্লাহ”
যেভাবে এসেছিল ঠিক সেইভাবেই ফিরে যাচ্ছে।শুধু পাশের সিটে শূন্যতা। অদ্ভুতভাবে পরিস্থিতি তার সাথে ঠাট্টা করেছে। বাসের মোটামুটি সব সিটে দুজন বসা। মাহরুরের পাশের সিটটাই খালি।তার একাকিত্বকে আঙ্গুল তুলে বারবার অনুভব করানো হচ্ছে।ভিন্ন দৃশ্য অম্বরেও। লুকোচুরি খেলছে চাঁদ মেঘের আড়ালে। সবই নিজেকে ঘিরে ধরে নিলো মাহরুর। তপ্ত নিশ্বাসের সাথে চোখ বুজে নেয়।
“সাধ্য থাকলে আজ,এই মুহূর্তে তোকে জরিয়ে নিয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতাম।কোনো আক্রোশ থাকতো না জীবনের প্রতি। শান্তিময় বিদায় হতো আমার”
চলবে…
চন্দ্র’মল্লিকা ১৪
লেখা : Azyah_সূচনা
“এই বয়সেই বিধবা হইলি।তোর জন্য মায়া হইতাছে মল্লিকা।কেমনে জীবন কাটবো তোর।আর তুইতো মাইয়ার মা।ছেলে হইলে একটা কথা। মায়েরে কামাই কইরা খাওয়াইতো।”
“সবই আল্লাহর ইচ্ছা চাচী।”
“কি যে হইবো ভবিষ্যতে।চিন্তা হইতেছে তোর জন্য।”
“দেখা যাক চাচী।”
মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে এসেছে।বেশ খুশি মল্লিকা,মিষ্টি দুজনেই।শওকতের সাহায্যে ভর্তির সকল কার্যক্রম পূরণ করে এসেছে।নিজে বেশি শিক্ষিত না হওয়ায় ভরসা যোগ্য একজনকে নিয়েই গেছে।অনেক পরিচিত মুখ দেখলো।একেকজনের একেক প্রশ্ন।স্কুলের পোশাকের মাপ দিতে গিয়ে রুনা চাচীর দেখা মেলে। হায় হুতাশ করছে মল্লিকাকে দেখে।
শওকত কথার ছলে বললো, “মেয়ে হইছেতো কি চাচী।আজকাল মেয়েরাও চাকরি করে।”
“হ কইছে!তোমাগো চোখ ফুটছে বোনরে বড়লোক জামাইর কাছে বিয়া দিয়া।বউরে পড়ায়,চাকরি করবার দেয়।কিন্তু শেষমেশ মহিলা মানুষের ঠায় ওই চুলার পাড়েই।”
“আমার বোন জামাই ভালো মানুষ।”
“এত আধুনিক হইতে হয় না আবার।”
শওকত ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ।বুঝলো এখানে কথা বাড়ানো অহেতুক।ছোট্ট উত্তর দিল, “হয়তো!আসি।চল মিষ্টি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি খাই”
রুনার সইলো না। অগোচরে তাদের শুনিয়েই শওকতকে বললো, “নিজের ঘরের দিকে নজর দে শওকত।অন্যের প্রতি দরদ দেখাস না এত। ঘর টিকবো না।”
বেশ বাজে রকমের ইঙ্গিত করেছে সে। খুবই জঘন্য। শওকত রেগে গেলো।মল্লিকার পাশাপাশি সে আকার ইঙ্গিতে শওকতের চরিত্রেও আঙ্গুল তুলছে। শশী আর মল্লিকা তার বোন।আপন না হোক তার দিকে ভিন্ন নজর দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা।পেছন ফিরে উত্তর দিতে চাইলে মল্লিকা থামায়।
বলে, “শওকত ভাই বাদ দেন।এদের সাথে কথা বললে নিজের সম্মান নষ্ট।”
“বাজে কথা বলছে মল্লিকা।”
“এবারের মতন বাদ দেন।আবার কিছু বললে জবাব দিয়েন।”
অন্যের জীবনের প্রতি মানুষের অনেক আগ্রহ।যেই উৎসাহ নিজের জীবন নিয়েও থাকেনা।অন্যের সমস্ত ব্যপারে নাক গলিয়ে বিশেষ ধরনের আনন্দ পায়।নিজের ঘর,নিজের সংসার ভেস্তে যাক।তাতে কি?অপরের কি করা দরকার সেটা সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে চলেছে দিনের পর দিন।বয়স বাড়তে থাকলে মানুষের মধ্যে যেনো নূন্যতম বোধগম্যতার অভাব দেখা দেয়।সামান্য একটা কথাকে টেনে লম্বা করেই ক্ষ্যান্ত হলো রুনা বেগম।এসে হাজির হয়েছে শশীদের বাড়ি।নানা আলোচনা।মুখ্য বিষয় কথার ছলে খোচা দিবেন।
শশীর মা রোকেয়াকে বললেন, “নিজের পোলারে হাতে রাইখেন ভাবি।বউ রে কইয়েন দেইখা দেইখা রাখতে।”
রোকেয়া অবাক হয়।কি এমন হয়েছে?সাথে শওকতের স্ত্রী রাত্রিও এসে হাজির।তার সামনেই নিম্নতর মস্তিষ্কের পরিচয় দিয়ে বললো, “জুয়ান মাইয়া বিধবা হইছে।এখন অনেক পোলার চোখ পড়বো। মাইয়াও চাইবো নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কইরা কারো না কারো ঘাড়ে ঝুইলা যাইতে।”
রাত্রি কপাল কুচকে জানতে চাইলো, “কি বলতে চাচ্ছেন চাচী?”
“আরেহ রমজানের মাইয়ার কথা কই।তোমার স্বামীরে চোখে চোখে রাইখো।বেশি মিশতে দিও না মল্লিকার লগে।কহন কি ঘটে?আজকা দেখলাম ওর মাইয়ারে স্কুলে ভর্তি করায় আইলো।আবার খাওয়াইছে ফুচকা, আইস্ক্রিম।”
রাত্রি মনে মনে রেগে উঠে। নোংরা কথা শুনে জেদ চাপছে।সে জানে তার স্বামী মল্লিকার সাথে গিয়েছিল।মিষ্টিকে ভর্তির কাজে সাহায্য করতে।চোয়াল শক্ত করে বললো, “আমি আমার স্বামীরে চিনি চাচী।আর আম্মার কাছে মল্লিকার সম্পর্কেও জানসি।আপনার এসব নিয়া মাথা ঘামানো লাগবে না।আপনি নিজের মেয়ের দিকে খেয়াল দেন।”
রুনা আরো অপমানিত বোধ করলেন।অন্যদিকে রোকেয়া নিশ্চুপ।উচিত উত্তরে সেও সায় দিলো বিনাশব্দে। মল্লিকাকে নিয়ে বাজে বকছে?সেতো তার আরেক মেয়ে।রুনা বেগম তেতে উঠেন। রোকেয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
“দেখছেন আপনার বউয়ের চোপা?লাগাম টানেন না?”
রোকেয়া বললেন, “ভুলতো কিছু বলে নাই?ওইদিন দেখলাম আপনার মাইয়া জহিরের লগে ঘুরতাছে মেলায়।”
শওকত স্ত্রীর কাছে রুনা বেগমের নিচু কর্মকাণ্ডের কথা শুনে হতভম্ব।ছোট্ট একটা বিষয়!অত বড়োও না। অপমানিত বোধ করার মতন করেও সে কিছু বলেনি তাকে।এই সামান্য কথা বাড়ি অব্দি বলেছে? রাত্রির দিকে চাইলো শওকত।হয়তো এখন সেও স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছে কথাগুলো। কানাঘুষা হতে হতে একদিন সেও ঠিক বিশ্বাস করে নিবে।নারী মন।নিজের স্বামীর নাম অন্যের সাথে জড়ালেই কেলেঙ্গারী হয়ে যায়।রুনা বেগমকেও চেনা আছে।মুখের উপর উত্তর দেওয়ার দায়ে পুরো মহল্লা ছড়াবে। মিথ্যেচারিতায় লিপ্ত এই নারী।মানুষ তাকে সহ্য করতে না পারলেও তার বলা কথাগুলো শুনে বেশ মনোযোগ দিয়েই।পাঁচ ছয়দিন হয়েছে মল্লিকা এখানে আসলো।এতেই এই অবস্থা।বাকিদিন আছেই পড়ে।
“তুমি কি আমাকে ভরসা করো না রাত্রি? দীঘির দিব্যি মল্লিকা আমার বোন।যেমন শশী।এই মেয়েটা জীবনে অনেক কষ্ট দেখেছে।তাই বড় ভাই হিসেবে সাহায্য করছি।” মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল শওকত।
রাত্রি আশ্বাসের হাত বাড়িয়ে বললো, “কেনো চিন্তা করছো এত?আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।আর রুনা চাচী? ওনাকে বিদায় করেছি উচিত কথা বলে আমি আর আম্মা।আর এইদিকে নজর দিবে না।”
শওকত সস্তি পায়।তবে মাথার মধ্যে একটা চিন্তা রয়েই গেলো।মল্লিকা।তার নিজের বদনাম হবেনা।হবে মল্লিকার।বিনা দোষে ফেঁসে যাবে মেয়েটা।তার চরিত্রে কাদা ছুঁড়তেও এক সেকেন্ড সময় নিবে না পাড়ার লোকেরা।
__
দুইমাস পর,
একেবারেই পড়ালেখা জানে না তেমনটাও নয়।মেয়ের হাতেখড়ি শেখানোর মতন সামর্থ্য আছে মল্লিকার।প্রতিদিন স্কুলে আনা নেওয়া থেকে শুরু করে অনেকটা চঞ্চল হয়েছে।চলার পথে অনেকের অনেক রকম কথা শুনতে হয় বলে বোরকা পড়া শুরু করে মল্লিকা।অন্যদিকে মাহরুর আগেকার নিয়ম অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে কল করে খোঁজ খবর নেয়।তবে মল্লিকার সাথে কোনো কথা হয় না।সে কি জানে কতটা ব্যথিত সে?বুঝবে কি করে।আগে বিনা শব্দে কথা বুঝে যাওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে তার চন্দ্র। রুষ্ট হয়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে আর কত বোঝানো যায় মাহরুর কথা বলতে ইচ্ছুক?
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পঁয়তাল্লিশ এ এসে হাজির। বারোটায় মিষ্টির স্কুল ছুটবে।বেরিয়ে দরজায় মাকে না দেখেই কান্না জুড়ে বসবে।ভয় পায় সেই ছোট্ট হৃদয়টাও।মাকে চোখের আড়াল করে স্কুলে বসতেই চায়নি।সাহস জোগাতে কাঠখড় পোহাতে হয়েছে মল্লিকাকে।বোরকা গায়ে দিয়েই পায়ের গতি বাড়ায় স্কুলের উদ্দেশ্যে।
“কিরে মল্লিকা?”
জহিরের গলার আওয়াজে থমকে দাঁড়ায় মাঝ রাস্তায়।পা ঝুলিয়ে ভ্যানে বসে আছে। মল্লিকাকে থামতে দেখে এগিয়ে এলো।বললো,
“কি অবস্থা তোর?”
“জ্বি… ভালো!”
“তোকে বোরকার আড়ালেও চিনে ফেললাম দেখলি?তোর শরীরের গঠনও আমার চেনা”
জহিরের কথা পছন্দ হয়নি মল্লিকার।বরং বাজে আভাস পেলো।ছেলেটা এলাকায় খারাপ মানুষের তালিকায় পড়ে।রুনা চাচীর মেয়েকেও দেখেছে তার সাথে কয়েকবার।
এখান থেকে চলে যাওয়া উত্তম মনে করে মল্লিকা বললো, “জহির ভাই মিষ্টির স্কুল ছুটে যাবে।আমি আসি?”
বাঁকা হেসে জহির বললো, “আসবি?আয়!আমি অপেক্ষা করবো।তোর জন্য অলটাইম জায়গা খালি।”
আকার ইঙ্গিতে উল্টোপাল্টা বলে যাচ্ছে। নির্বোধ নয় মল্লিকাও।হাতপা শিরশির করে উঠছে।দ্রুত পায়ে চলে গেলো সেখান থেকে।একা নারী মানেই বিপদ।মানুষের কু দৃষ্টি এড়াতে পারবে না কখনো।তার চেয়ে ভালো এড়িয়ে যাওয়া।
মায়ের দেখা না পেয়ে অস্রু ঝরঝর করে পড়ছে মিষ্টির গাল বেয়ে।মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে। রাস্তায় জহির না আটকালে এই দেরিটা হতো না।দৌড়ে এসে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে।
বলতে লাগলো,
“এইযে মা?কান্না করছিস কেন বলতো?”
“তুমি দেরি করেছো কেনো মা?আমার ভয় করে।”
“কিসের ভয়?মা আছি না।আজকে একটু দেরি হয়ে গেছে।”
“তুমি যাবে না মা।বাহিরে বসে থাকবে।”
“আচ্ছা আচ্ছা।কালকে থেকে বসে থাকবো।”
আসার পথেও সেই একই কান্ড।রাস্তার দ্বারেই ছেলেপেলেদের নিয়ে বসে জহির।মুখে কুটিল হাসি।তার দৃষ্টিতে ভালো কিছুর আভাস পাচ্ছে না।দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে নেয় মল্লিকা। জহির সটাং করে এসে দাঁড়ায় আবারো সামনে। মল্লিকাকে ভরকে দিয়ে মিষ্টিকে ছিনিয়ে নিলো।
গাল চেপে বলতে লাগলো, “মল্লিকা তোর মেয়েটাও তোর মতই সুন্দর হয়েছে দেখি।তোর জামাইর জন্য খারাপ লাগছে।ইস!কি জিনিস ফেলে রেখে অক্কা পেলো।”
যেনো খুব মজার বাক্য বলেছে।সে সহ তার সাথের ছেলেগুলোও হোহো করে হেসে উঠে। নিরব জায়গাটায় কারখানা।তেমন পথ চলতি মানুষের আনাগোনা নেই। মিষ্টিকে পূনরায় নিজের কাছে নিতে চাইলে মল্লিকার হাত ছুঁয়ে দিলো জহির। বিশ্রী স্পষ্ট! ঘেন্নায় পুরো শরীর একাধারে কাপছে।
জহির বললো, “এত তাড়া কিসের?আয় তোদের হাওয়াই মিঠাই খাওয়াই।”
ভয়ে চুপসে থাকা মিষ্টির চোখ মায়ের দিকে।দুয়েকবার হাত এগিয়ে মল্লিকার কাছে যেতেও চেয়েছে।লাভ হয়নি।পুরুষ মানুষের শক্তির সাথে সে ছোট বাচ্চা পেরে উঠেনি।
মল্লিকা শক্ত গলায় বললো,
“মিষ্টিকে দিন জহির ভাই!”
“তেজের আভাস পেলাম তোর গলায় মনে হলো? স্বামিহীন বিধবার এত তেজ দেখাতে নেই।”
এতগুলো ছেলের মধ্যে নিজেকে জড়ো বস্তু মনে হলো মল্লিকার।এখানে তার বাড়াবাড়ি চলবে না।গলা উচু করলে তিলকে তাল বানাতে সময় নিবে না কেউই।কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আরেকটি পোক্ত হাত এসে মিষ্টিকে জহিরের কোল থেকে কেড়ে নিলো।
“এসব বাদ দিয়ে কাজ কামে লাগ জহির।কতদিন বসে খাবি?”
মিষ্টিকে মল্লিকার কাছে হস্তান্তর করে বললো শওকত।
“আমার বাপ যথেষ্ট কামাই করে রাখছে ভাই।”
“বসে খাইলে রাজার ভান্ডারও ফুরায় যাবে।”
__
“একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে ফেলছিস মাহি।”
অফিসে বেজায় কাজের চাপ।মূলত অতিরিক্ত কাজ করে নিজের উপর ইচ্ছেকৃত জুলুম চালাচ্ছে মাহরুর।কি করবে?ঘরে ফিরবে?কিসের জন্য?একাকী থাকতেওতো দম বন্ধ হয়ে আসে।তাই আজকাল ওভার টাইম করে।টাকাও বেশি আসবে।সময় পাড় হবে।
শওকতের আকস্মিক কলে চালিত কলম থামায়।বলে, “কি হয়েছে?”
“তুই জানিস এটা গ্রাম।এখানে সবকিছু মুখে মুখে উন্নত।কিন্তু মানুষের ধ্যান ধারনা আগের মতোই রয়ে গেছে।”
মাহরুর কথার অর্থ না বুঝে বললো, “পরিষ্কার করে বলতো শওকত কি হয়েছে? চন্দ্র?ঠিক আছে ও?”
“মল্লিকার কথা বলার জন্যই কল করেছি”
আরো একটু নড়েচড়ে বসে মাহরুর। মনোযোগটা এখন পুরোটাই শওকতের কথায় স্থাপন করতে হবে।থমথমে গলায় মাহরুর বললো, “বল”
“এলাকার রুনা চাচী খেয়ে না খেয়ে মল্লিকার পেছনে পড়েছে।সে ছাড়াও আরো অনেকে সহানুভূতি দেখানোর সুযোগে উল্টোপাল্টা কথা বলে। আজকেতো বেশিই হয়ে গেছে।জহির আছে না?রাব্বি চাচার ছেলে?রাস্তা আটকে দাড়িয়ে ছিলো মল্লিকার।মনে হচ্ছিলো বাজে কিছু বলেছে।এভাবে চলতে থাকলে মল্লিকা কিভাবে টিকবে এখানে?এরচেয়ে ভালো তোদের সাথে ঢাকায় থাকতো। অন্তত এসব সহ্য করতে হতো না ওর।”
হাতে রাখা বলপেন বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে মুচড়ে ভেঙে ফেলে।শরীরে ঐশ্বরিক জোর এসেছে যেনো। শওকতের প্রত্যেকটা কথা পরিষ্কার শুনে উত্তর দিলো,
“ফোন রাখ”
___
এলাকায় হইচই পড়েছে।রাব্বি মিয়া রাগে ক্ষোভে আগুনের গোলা হয়ে ঘুরছেন এদিক ওদিক।ছেলে ভর্তি হাসপাতালে।মেরে আধমরা করেছে কেউ রাতের আধাঁরে।তলব করছেন সবার বারিবারি গিয়ে।সালিশ ডেকেছেন।খোজ নিতে কার এত বড় দুঃসাহস।আধাঁরে চোরের মতন তার ছেলেকে এভাবে মারলো? ছেলের কাছে জানতে চেয়েও পারেনি।শুধু এতটুকুই জেনেছে রাতে গ্যারেজে আড্ডা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেখানেই। ভোরের দিকে আকস্মিক হামলা চলে তার উপর।আশপাশে থাকা তার চ্যালাদেরও সেখানে দেখতে পায়নি।
অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে স্লোগান দেওয়ার মতোন করে বলে যাচ্ছেন, “একবার যদি ধরতে পারি আমার ছেলের এই অবস্থা কে করেছে?ওর চৌদ্দ গুষ্টিকে জেলের ভাত খাওয়াবো”
রাস্তায় দাড়িয়ে হুংকার শুনছেন রমজান মিয়াও।কে করেছে কে জানে?রমজান সাহেব নিজেও অবাক।ভাবনা চিন্তা শেষ করে রওনা হলেন বাজারের দিকে। রেশন শেষ ঘরে।টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনবে। হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটছেন রমজান মিয়া।বড় ভাইয়ের বাড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে যেতেই ভিন্নতা লক্ষ করেন।ভেতরে ঢুকে যান নিশ্চিত হওয়ার জন্য।দরজায় তালা নেই।কিন্তু সেতো ভালোভাবে তালা দিয়ে রাখেন।প্রতি রাতে এসে দেখেও যান।তাহলে?চোর পড়লো নাতো? দরজায় হাত রাখতেই খুলে গেলো। ভেতরে চোখ পড়তেই অবাক হন অভ্যন্তরের দৃশ্যে। মাহরুর ঘুমিয়ে আছে বিছনায় উপুড় হয়ে।সে কখন এলো?এই প্রশ্নটাই রমজান সাহেবের মনে সর্বপ্রথম আসে।
মাহরুরের বাহু ধাক্কা দিয়ে তাকে জাগায় রমজান সাহেব। আড়মোড়া হয়ে উঠতেই রমজান সাহেবকে দেখে মাহরুর বললো, “আসসালামু আলাইকুম চাচা”
বিহ্বল রমজান সাহেব বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।তুই বাড়ি কখন আসলি?”
ফোনে সময় চেক করে মাহরুর বললো, “সকাল আটটায় এসেছি।”
“ওহ আচ্ছা!জানাবি না তুই আসবি।এভাবে হুট করে আসলি। বাড়িও গেলি না।”
“চাচা সকালে বিরক্ত করতে চাইনি।…..বাহিরে হইচই কিসের?”
“ওই আর বলিস না। ভোর চারটা পাঁচটার দিকে রাব্বি সাহেবের ছোটো ছেলেরে কে জানি মারধর করছে।বেচারা হাসপাতালে ভর্তি।”
ঘুমের রেশ কাটেনি।এই কথাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো না।ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “ওহ”
মাহরুর এসেছে শুনে হুট করে পা জোড়া চলতে লেগেছিল মল্লিকার।ঠিক দরজার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে থেমে গেলো।নিজেকে নিজে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।কেনো এতো তাড়াহুড়ো দেখালো? মাহরুরকে দিয়ে তার কি কাজ?তার আগমন কি আদৌ এত গুরুত্বপূর্ণ?সারাদিন ঘুম শেষে এসেছিল মাহরুর।রাতে খেয়ে দেয়ে বিদায় নিল।চোখদুটো চন্দ্রবিলাস করতে পারেনি। তৃষ্ণার্ত চাতকের মতই ফিরে গেলো বাড়ি।তার চলে যাওয়া নিশ্চিত হয় মিষ্টির মাধ্যমে।এতখন মাহরুরের সাথেই ছিলো।তাকে ঘুম পাড়িয়ে জানালার দ্বারে দাড়াতেই ভুত দেখার মতন চমকে উঠলো।ভয়ে দুয়েক কদম পিছিয়ে যায় মল্লিকা।আধাঁরে জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের অধিকারীকে চিনতে ভুল করেনি।
গম্ভীর গলা থেকে প্রশ্ন আসলো, “কেমন আছিস?”
ভয় দুর হতেই মল্লিকা এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।বলে, “আপনি এখানে কি করছেন?”
“এমনেই দাড়িয়ে আছি”
“আচ্ছা”
জানালার গ্রিলে হাত রাখতেই আর্তনাদ করে উঠে মাহরুর।হাত ঝাড়া দিচ্ছে বারবার। ব্যথায় নীলচে হয়ে যাওয়া হাত দেখে হৃদয় কেপে উঠে মল্লিকার।জানতে চাইলো,
“ব্যথা পেলেন কি করে?”
“মারামারি করেছি।জীবনে প্রথম কাউকে মনের স্বাদ মিটিয়ে পিটিয়েছি।ভালো লাগছে।”
মল্লিকার চক্ষু রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো। ঘটনা এক এক করে জুড়ে যাচ্ছে।আরো এগিয়ে এসে নিচু শব্দে জানতে চাইলো, “জহিরকে আপনি মেরেছেন?”
“হ্যা!”
কি স্বাভাবিকভাবেই না বলছে মাহরুর।ভনভন করে উঠলো মাথাটা।কথা নেই বার্তা নেই এসে একজনকে মেরে হাসপাতালে পাঠালো?
“কেনো মেরেছেন?”
“আমার ইচ্ছে!তুই এত কথা বলিস কেনো?”
“কিন্তু…”
“চুপ! আর শোন?রমজান চাচার সাথে কথা বল।তোকে ঢাকা ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। মিষ্টিকে ওখানেই কোনো সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো।”
আকাশ থেকে পড়লো মল্লিকা।হুটহাট এমন কথার মানে কি?নিজেই ফিরিয়ে এনে নিজেই বলছে ঢাকা নিয়ে যাবে?তবে মাহরুরের মুখ দেখে মনে হলো না সে মজা করছে।মুখে স্পষ্টতার ছাপ।ভিন্ন দেখাচ্ছে তাকে।
“কেনো যাবো ঢাকা?”
“আমি বলেছি তাই!”
“কোন অধিকারে বলছেন আপনি?আপনি বললেই চলে যাবো নাকি?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহরুর।মুখের কাঠিন্য কমিয়ে আনলো তৎক্ষনাৎ।আবদারের সুরে আকাশ ছোঁয়া আবদার করে ফেললো,
“আমার বউ হয়ে যাবি?”
চলবে…