#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৭)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি
‘চন্দ্রকুঠির’ বাহিরে বের হয়ে দু’জনেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মুনের ততটা সমস্যা নাহলেও রিয়াদ ধরা খেতে খেতে বেঁচে গেছিলো।
তখন রিয়াদ নিজের প্লান অনুসারে কাজ করার জন্য এগোতে একটি লোক এসে বললো, ” এখানে তো তিনজন থাকার কথা চারজন কেন?”
লোকটির প্রশ্ন শুনেই রিয়াদ থ মেরে গেলো। ভেবেছিলো ধরা পড়ার আগে কেটে পড়া ভালো। বেঁচে থাকলে আবার আসা যাবে এবং জানা যাবে রহস্যের কথা। লোকটি আরো কিছু বলতে যাবে এর আগে রিয়াদ বললো, ” আসলে পিছন থেকে ভালোভাবে উপভোগ করতে পারছিলাম না তাই এখানে এসে বসলাম। এখানে তো সিট ফাঁকাই ছিলো।”
লোকটি সন্দিহান চোখে রিয়াদের দিকে তাকালো। রিয়াদ সন্দেহ দূর করতে আবার বললো, ” কেন এখানে বসলে কোন সমস্যা আছে?”
” না তেমন কিছু না। এখানে একটু সমস্যা আছে আপনি নিজ সিটে যান।”
রিয়াদ আচ্ছা বলে চলে আসলো। বেশি কথা বাড়ালেই কেস খেতে পারে তাই চুপচাপ চলে গেলো। এরমাঝে মুনও ছবিটি নিয়ে চলে এলো। কোনরকম ছবিটি ভাঁজ করে হাতে নিয়ে, তার উপর ওড়নাটা ফেলে চলে এলো। কিছুক্ষনের মাঝে মঞ্চনাট্য শেষ হয়ে গেলো, ভিরের মাঝ দিয়ে ওরাও বেরিয়ে এলো।
রিয়াদ মুনের হাতের দিকে লক্ষ্য করে বললো, ” হাতের উপর এভাবে ওড়না দিয়েছেন কেন?”
মুন উত্তর না দিয়ে হাত থেকে ছবির ভাজটি বের করলো। রিয়াদ বললো, ” এটা কি?”
ছবির ভাজ মেলে ছবিটি রিয়াদের সামনে তুলে ধরলো। রিয়াদ ছবিটির দিকে তাকিয়ে বললো, ” আপনার শাড়ী পড়া ছবি দেখে আমি কি করবো? যদি দেখাতেই চান তবে একদিন শাড়ী পড়ে সামনে আসলেই তো হয়।”
” ছবিটি ভালোভাবে দেখুন, এটা আমি নই।”
” কি? দেখতে পাচ্ছি আপনার ছবি আর আপনি বলছেন এটা আপনার ছবি নয়।”
সন্দিহান চোখে তাকালো রিয়াদ। মুন রিয়াদের তাকানো অগ্রাহ্য করে বললো, ” ছবিটিতে থাকা মুখটির পাশাপাশি আশ পাশটাও একটু লক্ষ্য করুন। ছবিটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি অনেক আগের ছবি, সেই সাথে ছবিটি যেখান থেকে তোলা হয়েছে সেই যায়গাটি লক্ষ্য করুন। আমরা যে চন্দ্রকুঠি বাড়ি থেকে মাত্র বেরিয়ে এসেছি সেই বাড়ির সামনে বসে তোলা। এবার আপনি বলুন ছবিটি আমি কখন তুললাম?”
রিয়াদ অবাক হয়ে ছবিটির দিকে তাকালো। মুনের বলা কথাগুলো সত্যি। মুন আবার বললো, ” এই ছবিটি আপাত দৃষ্টিতে আমার মনে হলেও ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন, ছবিটিতে থাকা মেয়েটির ঠোঁটের নিচে একটি তিল আছে যেটা আমার নেই।”
” বুঝলাম এটা আপনি নন। কিন্তু আপনার মতো দেখতে এ কে?”
” সেটার উত্তর তারাই দিতে পারে যারা আমাকে প্রথম দেখে চমকে গিয়েছে।”
” মানে?”
” হয় রেবেকা, সেই বৃদ্ধ মহিলা কনস্টেবল নয়তো আজকের লোকটি।”
” কি বলছেন আপনি? আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।”
তারপর মুন গ্রামের সেই লোকটির কথা মনে করিয়ে দিলো রিয়াদকে। রিয়াদ আর মুন এখন সেই লোকটির বাড়ি খুঁজছি। মুনের ধারনা সত্যি হলে লোকটিই বলতে পারে কে এই মেয়েটি, যাকে মুনের মতো দেখতে। প্রথম দেখায় যে কেউ মুন আর এই মেয়েটি আলাদা করতে অক্ষম হবে।
________
অন্ধকার ঘরে হাঁটু গেড়ে বসে কান্না করছে মাধুরি। এ কোন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে সে। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় নেই নাকি। মাধুরির কানে শুধু একটি শব্দই বারবার বেজে চলেছে, ” তোর এই পরিনতির জন্য দায়ী তোর মা। হ্যাঁ তোর মা। তোর মা যদি নিজের অহংকার, সততা বঝায় রাখতে সেদিন আমার মুখে থুথু না ফেলতো তাহলে আজ তুই ভালো থাকতি। তোর জীবন সুন্দর কাটতো।”
মাধুরি মনেমনে ভাবছে, ” যেই মাকে জীবনে কখনো দেখেনি সেই মায়ের জন্য এই যন্ত্রণাময় জীবন।”
পরক্ষনেই আবার বলছে,” লোকটি তো বললো আমার মা সৎ ছিলো। তাহলে নিশ্চয়ই লোকটির খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো। এখানে মায়ের দোষ দিয়ে কি করবো দোষ তো ভাগ্যের! শুধু একটাই আফসোস আমার জন্য রাফি বিপদে পড়ছে। রাফি সুস্থ আছে এই কথাটি জানতে পারলেও শান্তি পেতাম।”
মাধুরির ভাবনাজুরে নানা কথা। গত দু’মাস ধরে সে এখানে বন্দি। সে জানে না এখান থেকে কোনদিন মুক্তি পাবে কিনা! শুধু জানে সে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। এই অন্ধকার থেকে তার নিস্তার নেই।
___________
অবশেষে সেই লোকটির বাড়ি খুঁজে পেতে সফল হলো রিয়াদ এবং মুন। মুন আস্তে করে ডাক দিলো, ” কেউ আছেন বাড়িতে?”
ডাক শুনে ঘর থেকে একজন মহিলা বেরিয়ে এলো। মহিলাটিকে দেখে মনে হলো গৃহবধূ। হয়তো লোকটির ছেলের বউ হবে। কারন লোকটি যে তুলনা বৃদ্ধ সে তুলনা তার বউ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
” কি চাই?”
” মতিন সাহেব আছেন?”
রিয়াদ বললো। লোকটি বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এই নামটিই জানা গেলো। তাদের বর্ননা শুনে একজন মতিন নামটাই বললো। মহিলাটি বললেন, ” জ্বী ভিতরে আছেন। আপনারা কারা?”
” আমরা একটু তার সাথে দেখা করতে চাই।”
” আচ্ছা আসুন।”
মুন আর রিয়াদ ভিতরে প্রবেশ করলো। লোকটি অর্থাৎ মতিন সাহেব বিছানায় শুয়ে আছেন। কারো প্রবেশের আবাস পেয়ে উঠে বসলেন।
” কে এসেছে বৌমা?”
মতিন সাহেবের কথার জবাব দেওয়ার আগে মহিলাটি ঘরের সুইচ অন করে দিলো। মতিন সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” কারা আপনারা? কি চাই?”
মতিন সাহেবের কথার প্রতিত্তোরে মুন মাথা থেকে ওড়নাটা নামিয়ে দিলো। মুন এখনো জানে না মেয়েটি কে! আর তাকে কে কে চেনে! সেই হিসাবে মুনকে দেখে কে বা কারা চমকাবে সেটা সে জানে না, তাই ওড়নাটা ঘোমটা আকারে দিয়ে মুখটা কিছুটা অস্পষ্ট করে রাখলো। মতিন সাহেব মুনকে দেখে এবার চমকালেন না। শান্তভাবে বললো, ” কি জানতে চাও?”
মুন মতিন সাহেবের সামনে ছবিটি রাখলো। ছবিটি দেখে মতিন সাহেব কিছুটা চমকালো। মুন মতিন সাহেবের উদ্দেশ্য বললো, ” এই মেয়েটি কে? আপনি নিশ্চয়ই এর জন্য আমাকে দেখে চমকে গেছিলেন?”
” ছবিটি কোথায় পেলে?” মতিন সাহেব
” চন্দ্রকুঠি থেকে।”
” বসো তোমরা। আমি বলছি।”
কথাটি বলে মতিন সাহেব বৌমাকে চেয়ার টেনে দেওয়ার ইশারা করলেন। মহিলাটি ওদের জন্য দুটো চেয়ার এনে দিলো। মুন এবং রিয়াদ বসে পড়লো। মতিন সাহেব বললেন, ” তোমার নাম কি?”
মুনের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করা বুঝতে পেরে মুন বললো, ” মুনতাহার মাহযাবিন।”
” ওহ। ছবিটিতে যাকে দেখছো এর নাম চন্দ্রাবতী। সবাই তাকে চন্দ্র বলে ডাকতো। আমি জানতাম তুমি ঠিক আসবে। তোমার মুখটি কেন চন্দ্রর মতো দেখতে তা আমি জানি না। তবে আমার ধারণা হয়তো তুমি আমার চন্দ্রের মেয়ে তাই ওর মতো দেখতে।”
‘মেয়ে’ শুনে মুন চমকে উঠলো। মুন এই ছবির মেয়েটির মেয়ে। মুন ভাবতে পারছে না। চমকানো মুখেই বললো, ” কিন্তু আমার মায়ের নাম তো চন্দ্রাবতী নয়, আমার মায়ের নাম মেহেরজান।”
মতিন সাহেব বললেন, ” তোমার মা কি বেঁচে আছেন?”
” না। আমি আমার মাকে কখনো দেখেনি।”
” তোমার বাবার নাম কি?”
” আরিফ হাওলাদার।”
” হাওলাদার?”
কথাটি বলে মতিন সাহেব ভ্রু কুচকালেন। তার হিসাব তো মিলছে না। আরিফ নামটি মিললেও হাওলাদার এবং মেহেরজান শব্দ দুটো তার ভাবনাকে মিথ্যে করে দিলো। মতিন সাহেব কিছুক্ষন ভাবলেন। তারপর যা বোঝার বুঝে গেলেন।
রিয়াদ এতক্ষন নিরব ছিলো। এবার সে বললো, ” আচ্ছা মুনের সাথে চন্দ্রের কি সম্পর্কে সেটা নাহয় পরে জানা যাবে, আগে আপনি আমাদের চন্দ্র বলে মানুষটি সম্পর্কে জানান।”
মুনও রিয়াদের কথায় সায় দিলো। মতিন সাহেব ওদের কথা বুঝতে পেরে বললো, ” আচ্ছা বলছি।”
” হ্যাঁ বলুন।”
” তোমরা নিশ্চয়ই ‘চন্দ্রকুঠি’ বাড়িটি দেখেছো। বাড়িটি বিশাল বড়।”
” এই বাড়ির সাথে চন্দ্রাবতীর কি সম্পর্কে?”
মুন প্রশ্নটি করলো। মতিন সাহেব বললেন, ” সম্পর্ক হলো, এই বাড়িটি চন্দ্রর। চন্দ্রর দাদু ছিলেন আগেরকার সময়ের জমিদার। এই বাড়িটিই ছিলো জমিদার মহল। চন্দ্রের দশতম জন্মদিনে এই মহলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় চন্দ্রকুঠি। জন্মদিনের উপহার সরুপ চন্দ্র এই বাড়িটি পেয়েছিলো।”
” একটু পরিষ্কার করে সব বলবেন।”
” হ্যাঁ বলছি।”
” চন্দ্রাবতীর বাবা-মা কেউ ছিলো না। ছোট বেলায় দু’জনেই এক দূর্ঘটনায় মারা যান। চন্দ্রের বাবা-মা না থাকায় তার দাদু তাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। ভালোবাসা সরুপ তিনি তার সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক চন্দ্রের নামে করেন বাকি অর্ধেক তার ছোট ছেলের নামে। সম্পত্তির পাশাপাশি মহলটি চন্দ্রের নামে করে দেন। চন্দ্রের নামের সাথে মিলিয়ে মহলটির নাম রাখা হয় চন্দ্রকুঠি। আমি আর আমার স্ত্রী চন্দ্র এবং ময়নামতি(চন্দ্রাবতীর ছোট কাকার মেয়ে) দেখাশোনার দায়িত্ব ছিলাম। কারন ময়নার বাবা-মা বিভিন্ন কাজে বেশিরভাগ সময় বাহিরেই কাটাতেন। চন্দ্রকুঠি নামটি রাখারা দুই বছর পর চন্দ্রের দাদু মারা যান। তারপর চন্দ্র যখন ষোলো বছরের কিশোরি তখন তার বিয়ে হয়।”
এটুকু বলে মতিন সাহেব থামলেন। মুন বললো, ” এত অল্প বয়সে বিয়ে?”
” তখনকার সময়ে এটাই অনেক বেশি বয়স ছিলো।”
” আচ্ছা তারপর কি হলো চন্দ্রের?”
” বিয়ের পর চন্দ্র খুব সুখীই ছিলো। সে তার সুখের গল্প আমাদের সাথে করতো। জেনে রাখা ভালো বিয়ের পরও চন্দ্র চন্দ্রকুঠিতেই থাকতো। এই নিয়ে তার শশুড়বাড়িতে কোন ঝামেলা হয়নি। বরং শশুড়বাড়ির লোকেরাও এখানে এসে থাকতো। তারপর হঠাৎ একদিন সব বদলে যায়। আমি আজো বিশ্বাস করতে পারছি না এসব সত্যি।”
কথাটি বলে মতিন সাহেব কেঁদে দিলেন। মুন এবং রিয়াদ চমকালো। কি এমন ঘটেছিলো যা ভাবতেই মতিন সাহেব কেঁদে দিলেন! মতিন সাহেব আবার বলতে লাগলেন, ” তখন চন্দ্র তিন মাসের গর্ভবতী ছিলো। আমি বাজারে গেছিলাম। বাজার থেকে ফিরে এসে দেখি চন্দ্রের হাতে হাত-কড়া। পুলিশ ওকে নিয়ে যাচ্ছে। চন্দ্র বারবার বলছিলো আমি কিছু করিনি। তবুও পুলিশ ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। ”
মুন বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো, ” পুলিশ? পুলিশ কেন নিয়ে গেছিলো? কি করেছিলো চন্দ্র?”
মতিন সাহেব বললেন, ” চন্দ্রর দিক থেকে নজর সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম, ময়নামতি, ময়নামতির স্বামী, ময়নামতির বাবা মানে ছোট সাহেব সকলের লাশ পড়ে আছে। তারপর জানতে পারলাম এদের খু**ন করার জন্যই চন্দ্রকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
” কি?”
মনু এবং রিয়াদ দুজনেই বলে উঠলো।
মতিন সাহেব আবারো বললেন, ” আজো জানি না সত্যি ওখানে কি ঘটেছিলো? আদালতে চন্দ্র দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তবে মৃত্যুদন্ড বাচ্চা প্রসব করার পর কার্যকারী হবে এরকম ই শুনেছিলাম। তবে জানি না চন্দ্রের জন্ম দেওয়া সেই বাচ্চাটি কোথায় আছে? আরিফ তালুকদারই বা কোথায় গেলো?”
মুন বললো, ” আরিফ তালুকদার?”
” হ্যাঁ চন্দ্রের স্বামী। তার এবং তার পরিবারের স্বীকারোক্তিতেই চন্দ্র দোষী প্রমাণিত হয়। আমি আজও জানি না চন্দ্র কেন খু**নগুলো করেছিলো? চন্দ্রকে খুনি ভাবতেও পারছি না অন্যদিকে আরিফ মিথ্যে বলবে চন্দ্রর ব্যপারে এটাও মানতে পারছি না। কারন আর কেউ জানুক আর না জানুক আমরা(ওনার স্ত্রী আর ওনি) জানতাম আরিফ চন্দ্রকে ঠিক কতটা ভালোবাসতো।”
মুন বললো, ” খুব ভালোবাসতো কি?”
মতিন সাহেব বললেন,” ভালোবাসার সংঙ্গা অনেক ধরনের হয়। সেসব সংঙ্গাকে ছাড়িয়ে যে ভালোবাসা হয় সেটাই আরিফ আর চন্দ্রর ভালোবাসা। যার সংঙ্গা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।”
এবার রিয়াদ বললো, ” এখানকার তালুকদার বাড়ির সদস্যরাই কি তারা?”
” হ্যাঁ তারাই।”
মুন কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করলো, ” আচ্ছা চন্দ্রের কি দু’জন সন্তান? মানে সে কারাগারে যাওয়ার আগে তার আরো কোন সন্তান ছিলো?”
” না।”
মুন এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। হিসাব মিলতে গিয়েও মিললো না। মুন এবার আস্তে করে বললো,” আচ্ছা আপনি কি কিছু জানাতে ভুলে গেছেন? মানে সবকিছুই বলেছেন তার মাঝে কিছু কি মিসিং গেছে? হতে পারে ভুলে গেছেন?”
লোকটি ভেবে বললো, ” সেরকম কিছু মনে পড়ছে না রে মা।”
আসলেই কি মতিন সাহেব কিছু ভুলে যাননি নাকি ভুলে গেছেন।
চলবে,
#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৮)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি
মতিন সাহেবের থেকে চন্দ্রাবতীর কথা শুনে সবাই কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। মুন একধ্যানে ছবির চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। চন্দ্রর ছবির দিকে নিক্ষেপ করা মুনের মায়াময় দৃষ্টি দেখে মতিন সাহেব কিছুটা নিশ্চিত হলেন এটা চন্দ্রর ই সন্তান। চন্দ্রর মুখ নিয়ে জন্ম যার , তার সাথে চন্দ্রর সম্পর্ক না থেকে পারে! মুন এবং রিয়াদও কিছুটা ধারণা করলো এটা মুনের ই মা। কিন্তু আরিফ হাওলাদার আর তালুকদার এর রহস্যটা ঠিক কি! ধরে নেওয়া যাক কোন কারনে আরিফ পদবী বদলে নিয়েছে কিন্তু তার মায়ের নাম। এটাও কি বদলানো হয়েছে! কিন্তু কেন! রিয়াদ নিরবতার ভেঙে মুনকে বললো, ” এবার আমাদের করনীয় কি?”
” তালুকদার বাড়ি যাওয়া।”
” কিন্তু সেখানে গিয়ে কি কোন লাভ হবে?”
” হবে। সেখানে গেলেই চন্দ্রকুঠির ভিতরে প্রবেশ করার সেই সবুজ কার্ডটি পাওয়া সম্ভব বলে আমার ধারনা।”
” কেন এরকম মনে হচ্ছে?”
তারপর মুন আস্তে করে তার মাথায় যা যা ঘুরছে সব বললো। যদিও মুনের রিয়াদকেও সন্দেহ হয়। তবুও রিয়াদ ছাড়া এখন ভরসা করার মতো কেউ নেই। কিছু একটা ভেবে রিয়াদ বললো, ” কিন্তু আপনি ওখানে যাবেন কিভাবে? আপনাকে দেখে যদি সবাই চন্দ্র ভাবে তো?”
রিয়াদের কথায় মুন কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। এরকম সময় আশার আলো হয়ে রহিমা ফোন করলো। এখানের আসার অনেক আগেই মুন রহিমার সাথে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে নিয়েছে। মুন ফোনটি রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই রহিমা বললো, ” একটা খবর জানানোর জন্য ফোন করা?
” কি খবর?”
” রাফির খোঁজ পাওয়া গেছে। রাফি তাদের বাড়িতে। রাফির বাবা মাত্র জানালো।”
” রাফি ভাইয়ার সাথে কথা হয়নি?”
” না। তার সাথে কথা হলে তো মাধুরি ব্যপারে খোঁজ নিতাম।”
” তা রাফি ভাইয়ার বাবা কি কি বললেন?”
” বললো রাফি অসুস্থ। সুস্থ হলে রাফি ফিরে যাবে।”
” ওহ আচ্ছা।”
” আরো একটা কথা?”
” হুম বলুন।”
” রাফির পরিবার কিন্তু তার নিখোঁজ হওয়ার কোন কথাই বলেননি। তাদের মতে রাফি এতদিন ছুটিতে ছিলো যেটা আজিজ স্যার জানতো।”
” ছুটিতে ছিলো?”
” হ্যাঁ তেমনি তো বললো।”
রহিমার সাথে কথা বলা শেষ করে মুন বেশ ভাবনায় পড়লো। রাফিকে বেঁধে রেখে কেউ মাধুরিকে ‘চন্দ্রকুঠি’ ডাকলো। রাফি ফিরে এসেছে, রাফি তালুকদার বাড়ির ছেলে। সবকিছু কেমন ঝট পাকিয়ে যাচ্ছে।
_______
রাফি বাড়ির পাশে এক বাগানে বসে আছে। বাগানের এই নিরিবিলিতে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। আকাশের পানে তাকিয়ে জীবনের হিসাবটা মেলানোর চেষ্টা করে চলেছে রাফি। হঠাৎ চেনা কন্ঠে ডাক শুনে পিছনে ঘুরে তাকালো রাফি।
” রাফি ভাইয়া।”
ডাক শুনে পিছনে তাকিয়ে মুনকে দেখে কিছুটা চমকালো রাফি। রাফির চমকানো মুখটা আড়াল হলো না মুনের থেকে। রাফি নিজেকে সামলে বললো, ” মুন তুমি এখানে?”
” হুম। কেন আসতে পারি না বুঝি?”
” তা নয় কিন্তু তুমি এখানে কেন এসেছো?”
” আমার বন্ধুর সাথে ঘুরতে এসেছি। আসলে সুযোগ পেলাম তাই কাজে লাগিয়ে নিলাম।”
” মানে? কি সুযোগ?”
” এইতো মাধু আপু নেই, বাবাও তার বন্ধুর বাসায় ঘুরতে গেছে। ভাবলাম এই তো সুযোগ জীবনটাকে নিজের মতো উপভোগ করার। বন্ধু বললো কদমতলী গ্রামটি খুব সুন্দর, সেই সাথে ‘চন্দ্রকুঠির’ মঞ্চনাট্যও খুব বিখ্যাত। তো চল ঘুরে আসি।”
” বারবার বন্ধু বলছো কিন্তু বন্ধুটা ঠিক কে?”
” কেন আমাকে চোখে পড়ছে না?”
একটি গাছের পিছন থেকে রিয়াদ বেরিয়ে এলো। রিয়াদকে দেখে রাফির চেনা চেনা লাগছে তাই বললো, ” আপনি কি এখানে আগেও এসেছেন?”
” হ্যাঁ। আট মাস আগেই তো এলাম। তখন তো আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। মনে নাই আপনার?”
” ঠিক খেয়াল নেই। তবে আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।”
” যাই হোক এবার চিনে নিন। আমি রিয়াদ রায়হান, মুনের বন্ধু।”
” শুধু বন্ধু্?”
রিয়াদ কিছু বলার আগে মুন বলে উঠলো, ” সেসব কথা পরে হবে, এবার বলো আমাদের তোমার বাড়ি নেবে তো?”
” তার আগে বলো তুমি জানলে কি করে আমি এখানে আছি?”
” আসলে আমরা রাত্রী যাপনের জন্য বেশ চিন্তিত ছিলাম, এমন সময় একটি বাচ্চার সাথে দেখা। সেই তো আমার ফোনে তোমার আর আপুর ছবি দেখে তোমাকে চিনে ফেললো। তার থেকেই এই অব্দি এসেছি আমরা।”
” কিন্তু সেই বাচ্চাটি কে?”
” জানি না। তবে বললো তুমি তাকে চেনো। নাম বললেই চিনবে। তার নাম রবি।”
” রবি? মানে আমাদের রবি।”
” তোমাদের রবি বলতে?”
” আমার ভাইয়ের ছেলে।”
” ওহ। তা আমাদের যায়গা হবে তোমার বাড়ি?”
” হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”
রিয়াদ বললো, ” তা কি পরিচয়ে নিবে?”
মুন ঝটপট বলে উঠলো, ” কি পরিচয়ে আবার? তার হবু শালিকা আমি, সেটা বলেই নিবে।”
মুন এবং রিয়াদকে অবাক করে দিয়ে রাফি হেঁসে উঠলো এবং বললো, ” সেটা আর হওয়ার নয়।”
” কেন হওয়ার নয়?” রিয়াদ বললো
” কারন মাধুরি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। মুন তুমি হয়তো ভাবছো তোমার বোন আমার সাথে এসেছে কিন্তু এটা সত্যি নয়।”
মুন বেশ চমকে বললো, ” মানে?”
এরপর রাফি যা দেখালো তা দেখে মুন এবং রিয়াদ দু’জনেই বেশ অবাক হলো। রাফির ফোনে মাধুরির একটি ভিডিও। যাতে মাধুরি এবং একটি ছেলে বেশ হাসি-খুশি মুখে রাফিকে তাদের নতুন সংসারের কথা বলছে। ভিডিওটি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মাধুরি রাফিকে নয় ঐ ছেলেটাকে ভালোবাসে এবং তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে চলেছে। মাধুরি খুব হাসি মুখেই রাফিকে তাদের বিয়ের বর্ননা দিচ্ছে।
ভিডিওটি দেখা শেষে রাফি বললো, ” আমি জানি তোমরা আমাকে খুঁজতেই এখানে এসেছো। তোমাদের মতে আমি আর মাধুরি সংসার করছি হয়তো কিন্তু এটা যে সত্যি নয় তা তো দেখতেই পেলে। আমি এক ব্যর্থ প্রেমিক। যার ভালোবাসাটা এতটাই ঠুনকো ছিলো যে প্রিয় মানুষটি অন্যকারো বুকে ভালোবাসা খুঁজে নিয়েছে।”
কথাটি বলার সাথে সাথে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রাফির চোখ থেকে। অন্যদিকে মুনের হিসাব আবার তাল-গোল পাকিয়ে গেলো।
রাফি নিজেকে সামলে বললো, ” যাই হোক আমার বাসায় তোমরা বেড়াতে যেতেই পারো। আর চিন্তা করো না বাসায় বলবো তোমরা দু’জনই আমার বন্ধু।”
রিয়াদ বললো, ” গ্রামে ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক কেউ নিবে?”
” আমার পরিবার নেবে। আমাদের পরিবার তেমন নয়। তারা জানেন শহরের ছেলে-মেয়েদের বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই।”
” তাহলে যাওয়াই যায়।”
এবার মুন বললো, ” আমরা কিন্তু বেশ কিছুদিন থাকবো। গ্রামের সৌন্দর্য, মঞ্চনাট্য সব দেখে তারপর যাবো। আর আপুর সম্পর্কেও আপনাকে কিছু বলার আছে ভাইয়া।”
” আচ্ছা তাহলে চলো। আমাদের বাড়ি এখান থেকে কাছেই। মাত্র দু’ মিনিট লাগবে।”
” হুম চলুন।”
_________
আরিফ সাহেব খাবারের সামনে বসে আছেন কিন্তু খাচ্ছেন না। খেতে ইচ্ছে করছে না। গত আঠারো বছরে খুব কম দিন এমন গেছে যেদিন তিনি তার মেয়েদের ছাড়া একা খেয়েছেন। মেয়েরা তো তার হাতে খাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যেই বায়না ধরতো। কত সুন্দর ছিলো সেসব দিন। কতই না রঙীন। দিনগুলো হয়তো আর ফিরে পাওয়া হবে না। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মাধুরি আর মুনের সেই হাসিমুখ, যে মুখের দিকে তাকিয়ে আরিফ সাহেব হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারেন।
আরিফ সাহেব মনেমনে হেঁসে উঠলেন মেয়েদের ছেলেবেলার কথা মনে করে। তখনি আরিফ সাহেবের বন্ধু সেখানে উপস্থিত হলেন। আরিফ সাহেবকে হাসতে দেখে তিনিও খুশি হলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন হয়তো পুরনো স্মৃতি মনে করেই আরিফ সাহেব হাঁসছেন। তবুও তিনি খুশি।
“বাস্তবে না হোক কল্পনাতে তো সুখী। মাঝেমাঝে কল্পনায় সুখী হতেও ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে।”
________
রিয়াদ এবং মুন দাঁড়িয়ে আছে তালুকদার বাড়ির প্রবেশ দরজায়। বাড়ির ভিতরে পা রাখার আগে মনেমনে একবার ভেবে নিলো কি কি বলতে হবে এবং কি কি করতে হবে! মুন এবং রিয়াদ ভিতরে ডুকতেই রাফির দাদু, বাবা, কাকা, কাকিমা এবং ভাবীকে দেখতে পেলো। তারা সবাই বসার ঘরেই বসে ছিলেন। তারা মুনকে দেখে কিছুটা যে চমকাচ্ছেন তা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রাফি সবার কৌতূহল মেটাতে বললো, ” এরা আমার বন্ধু। গ্রাম দেখতে এসেছে। কিছুদিন এখানে কাটাবে।”
তাদের চমকানোটা হয়তো রাফিকে বুঝতে দিতে চাননি তাই রাফির বাবা বললেন, ” রাফি তুমি উপরে যাও, তোমার মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। তিনি তোমার খোঁজ করছিলেন।”
” হ্যাঁ বাবা। কিন্তু ওদের থাকার….”
রাফিকে কথা বলতে না দিয়ে তিনি বললেন, ” সেটা আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি। যেহেতু আমাদের বাড়িতে থাকবে সেহেতু আমাদের ও চিনে রাখা উচিত। তো আমরা পরিচিত হই ততক্ষনে তুমি মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসো।”
রাফি আচ্ছা বলে উপরে চলে গেলো। রাফি সিঁড়িতে উঠতে উঠতে রাফির পরিবার তাদের পরিচয় দিলেন। তাদের সাথে রাফির সম্পর্কে কি সেটা বললেন। এবার রিয়াদ এবং মুনের বলার পালা। রিয়াদ প্রথমে শুরু করলো, ” আমি রিয়াদ এবং ও মনু। আমাদের বাসা….( ওদের বাড়ির আশপাশ থেকে যথেষ্ট দূরের ঠিকানা।)
” তোমরা একে-অপরের কি হও?”
প্রশ্নটি করলেন রাফির দাদু। রিয়াদ কোন রকম সংকোচ ছাড়াই, ” আমরা একই বিল্ডিং এ থাকি। আমাদের মায়েরা একে-অপরের খুব ভালো বন্ধু এবং আমরা একে-অপরের খুব ভালো বন্ধু।”
শুধু রাফির ভাবী ছাড়া সবাই চমকালো। রাফির কাকা মুনের উদ্দেশ্যে বললো, ” তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর।”
মুন বোধহয় এরকম একটি প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সাথে সাথে বললো,” সবি ডাক্তারের কৃপায়।”
” মানে?”
এবার রিয়াদ বললো, ” আসলে ওর মুখে সার্জারী হয়েছিলো তো তাই বললো।”
” সার্জারী হয়েছিলো মানে?”
” আসলে এটা ওর আসল মুখ না। ওর আসল মুখটিও সুন্দর ছিলো তবে এতটা নয়। সে যাই ওর মুখটি বিশ্রিভাবে পুড়ে গেছিলো তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ায় ডাক্তার এই মুখ করে দেয় সার্জারী করে।”
” মানে? এভাবে অন্যমুখ বসিয়ে দিলো? আগের মুখের ছবি ছিলো না সেটা দিয়ে তো আগের মতোই করতে পারতো?”
” আসলে ডাক্তার বিক্রি হয়ে গেছিলো। কোন এক আরিফ নামের লোক টাকা দিয়ে এই মুখটি বসাতে বলেছিলো। কিন্তু কেন তিনি এমন করেছেন সেটা আজও জানি না আমরা!”
কথাটি বলে রিয়াদ একটু দুঃখী দুঃখী মুখ করে ফেললো।
রিয়াদের কথা শুনে রাফির দাদু বললো, ” ওদের ঘর দেখিয়ে দেও।”
মুনদের নিয়ে রাফির ভাবী উপরে গেলো। উপরের শেষের দিকের দুটো রুম ওদেরকে থাকতে দেওয়া হলো। মুন জানে ওরা কথাগুলো ততটা হজম না করলেও কিছুটা যে করবে সেটা নিশ্চিত।
চলবে,,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন।]