#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১৩)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি
আরিফ সাহেব মুনের দিকে তাকালান। মুনের চোখ চোখ রেখে বললেন, ” মাধুরি আমার নিজের মেয়ে নয় এটা সত্যি। তবে মাধুরি আমার কাছে নিজের সন্তানের থেকে কম নয়”।
একটু থেমে আবার বললেন,” যাই হোক। প্রথম থেকে সবকিছু বলছি শোন,
অতীত,
বাবা-মায়ের সংসারে আমরা তিন ভাই ছিলাম। আমার বড় দুই ভাইয়ের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে, সেই সাথে তাদের ঘর আলো করে সন্তানের আগমনও ঘটলো। তখন বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। আমার তখন বিয়ে জিনিসটার প্রতি আগ্রহ ছিলো না। ভাই ভাবীদের জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েই মেয়ে দেখতে যাই। অনিচ্ছা নিয়ে মেয়ে দেখতে গেলেও মেয়েকে দেখে আমার অনিচ্ছা, ইচ্ছেতে বদলে গেলো। চন্দ্রকে দেখার পর আমি আর বিয়েতে না করতে পারিনি। কারন চন্দ্র খুব রুপবতী ছিলো তাকে দেখার পর অপছন্দ করবে এরকম পাত্র পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।
যাই হোক বাবা-মায়ের সম্মতিতে বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। বিয়ের পর আমরা আমাদের নিজেদের বাড়িতেই থাকতাম। চন্দ্রের নিজের বাবা-মা না থাকায় সে আমার বাবা-মাকে খুব সহজেই আপন করে নিয়েছিলো। আমাদের সংসার জীবন ভালোই চলছিলো। বিয়েটা রুপের মোহে পড়ে করলেও ধীরে ধীরে আমি চন্দ্রকে খুব ভালোবেসে ফেলি। একসময় চন্দ্রও আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলে। আমাদের সম্পর্ক খুব সুন্দর ছিলো। এরপর হঠাৎ একদিন চন্দ্রর দাদুর মৃত্যুর খবর আসে। আমরা সেখানে যাই। দাদুর মৃত্যুতে চন্দ্র খুব ভেঙে পড়ে। আমি যতটা সম্ভব তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। চন্দ্রের কাকীমার কথা অনুসারে চন্দ্রর দাদুর ইচ্ছে ছিলো চন্দ্র তার পরিবার নিয়ে ‘চন্দ্রকুঠিতে’ থাকবে। চন্দ্রকুঠি যেটা চন্দ্রর নিজের বাড়ি। চন্দ্রের দাদু এই বাড়িটি ছাড়াও তার সম্পত্তির বেশিরভাগটাই চন্দ্রর নামে করে যান। এর অবশ্য কারন ছিলো। যেটা আমি পরে জানতে পারি৷ তাহলো চন্দ্রই তার সম্পত্তির প্রকৃত উত্তরাধিকার ছিলো। তার ছোট ছেলে অর্থাৎ চন্দ্রর কাকা সে তার পালিত সন্তান ছিলো। যাই হোক চন্দ্রর দাদুর ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা সবাই ‘চন্দ্রকুঠিতে’ থাকতে শুরু করি। আমাদের দিন ভালোই চলছিলো। এমন সময় চন্দ্র গর্ভবতী হয়। চন্দ্রের গর্ভাবস্থায় ওর দেখাশোনা আমার থেকে বেশি ওর বোন ময়নামতি করতো। ময়নামতি তার স্বামী এবং কন্যা আমাদের সাথেই থাকতো। চন্দ্র আর ময়নার মধ্যে খুব ভাব ছিলো। এরা একে-অপরকে খুব ভালোবাসতো।
তখন চন্দ্রর গর্ভাবস্থার তিন মাস চলছিলো। আমি একটি কাজে গ্রামের শেষ প্রান্ত গেছিলাম। সেখান থেকে ‘চন্দ্রকুঠিতে’ আসার মাঝরাস্তায় মাধুরি(ময়নার মেয়ে) সাথে দেখা। চার বছরের বাচ্চা মেয়েটি বেশ ভয় পেয়েছিলো। অনেকটা পথ দৌড়ে আসায় বেশ হাঁপিয়েও গেছিলো। আমি ওকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” কি হয়েছে মামনি? তুমি এভাবে ছুটছো কেন”?
ছোট্ট মাধুরি অস্পষ্ট সুরে বললো, ” র র ক্ত লা ল”
” কি? আচ্ছা বাড়ি চলো তারপর সব শুনবো”?
ওকে নিয়ে বাড়ির রাস্তায় যাওয়ার জন্য এগেলোই ও কান্না করতে শুরু করে দেয়। ইশারায় ওদিকে যাবে না বুঝায়। ওকে কোলে নিয়ে জোর করে হাঁটা শুরু করলে ওর কান্না আরো বেড়ে যায়, এমন সময় এক কাকার সাথে দেখা। কাকাই বললো আমাদের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছে। পুলিশের কথা শুনে বুঝলাম বাড়িতে নিশ্চিয়ই কিছু হয়েছে। যেটা মাধুরি দেখে ভয় পেয়ে ছুটে এসেছে। আমি ভাবলাম এই অবস্থায় মাধুরিকে বাড়িতে নিয়ে গেলে ও পুলিশ দেখে হয়তো আরো বিচলিত হবে। অনেককিছু ভেবে ওকে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে রেখে বাড়ি চলে এলাম। এসে দেখলাম যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সামনে ময়নামতি, তার বর এবং কাকার(ময়নার বাবা) মৃতদেহ পড়ে আছে আর চন্দ্রকে পুলিশ ঘিরে ধরেছে। আমি এক প্রকার শকড হয়ে গেলাম। পুলিশ যখন চন্দ্রকে নিয়ে গেলো তখন আমি বাঁধা দিতে গেলে আমাকে বাবা টেনে তার সাথে নিয়ে যায়।
বাবা আমাকে টেনে একটা রুমে নিয়ে যায় তারপর বলে, ” ও একটা খুনি। তুই ওর কাছে আর কখনো যাবি না”।
” না বাবা। এসব সত্যি হতে পারে না। চন্দ্র কখনোই এরকম করতে পারে না”।
” আমাদের চোখের সামনে সবকিছু হয়েছে। আমরা নিজেদের চোখে ওকে খুন করতে দেখেছি”।
” না। আমি এসব বিশ্বাস করি না”।
” তারমানে তুই বলছিস আমরা মিথ্যে বলছি”?
” আমি জানি না। আমি শুধু জানি চন্দ্র এরকম করতে পারে না”।
” চন্দ্রাবতীই এসব করেছে”।
পিছন থেকে চন্দ্রর কাকীমা বলে উঠলো।
” আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা সত্যি নয়”।
তারপর আমার ভাইয়েরা বলে উঠলো,” আমরা সবাই স্বাক্ষী চন্দ্রই এরকম করেছে”।
এদের কারো কথাই আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কারন আমি জানি চন্দ্র এরকম করতে পারে না। তখনি বড় ভাবী বলে উঠলো,” ওরা মিথ্যে বলছে। এসব ওরা করেছে। চন্দ্র কিছুই জানে না”।
কথাটি বলতে দেড়ি হলেও ভাইয়ার ভাবীর গায়ে হাত তুলতে দেরি হয়নি।
” তোকে এত বেশি বুঝতে কে বলেছে”?
তারপর বাবা বলে উঠলো,” দেখ আরিফ আমি সব স্বীকার করছি। আমরা শুধু চন্দ্রর থেকে সম্পত্তি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর কাকা সব জেনে গিয়ে বাঁধা দিতে চেয়েছিলো তাই রত্না(কাকার স্ত্রী) নিজ হাতে স্বামীকে মেরে ফেললো। কারন সম্পত্তি ওরো প্রয়োজন ছিলো”।
কাকীমা বললেন,” বাকিটা আমি বলছি। আমি আমার বরকে মারার সময় ময়না সব দেখে নেয় এবং সে সাথে সাথে চন্দ্রকে সব বলে দেয়। তখন আমার মাথায় খুন চেপে গেছিলো তাই চন্দ্রকে শেষ করতে এগিয়ে যাই। সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমার মেয়ে। চন্দ্রকে করা আঘাত আমার মেয়ে বুক পেতে নেয়। তারপর ও মারা যায়। চন্দ্রর চিৎকার চেঁচামেচিতে ময়নার বরও সেখানে আসে। তারপর আর কি তাকে তোমার বাবা মেরে ফেলে। চন্দ্রকে আমি মারতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওকে মারলে সম্পত্তি কিভাবে পাবো তাই তোমার বাবা মারতে দেয়নি”।
আমি ওখানেই বসে পড়লাম।
” সামান্য সম্পত্তির জন্য তোমরা এমন করেছো”?
আমার কথা শুনে বাবা বললো,” তোমার কাছে সামান্য হতে পারে আমাদের কাছে নয়। যাই হোক এবার তুমি শোন আমাদের সবার সাক্ষীতে চন্দ্র দোষী প্রমাণিত হয়ে যাবে। তুমি আটকাতে পারবে না। তাই যা বলছিলাম তুমি আদালতে আমাদের হয়ে সাক্ষী দেবে। তুমি আদালতে বলবে চন্দ্র আর ময়নার মধ্যে সম্পর্ক খুব খারাপ ছিলো। ওরা একে-অপরকে সহ্য করতে পারতো না। সেজন্য জেদের বসে এসব করেছে “।
আমি প্রচন্ড রেগে গেলাম। রেগে কিছু বলতে যাবো এমন সময় বড় ভাইয়া বলে উঠলো, ” তুই কিছু বলার আগে কান খুলে শুনে রাখ, তোর মেঝো ভাই কিন্তু একটি কারাগারের জেলার। থানার ওসির সাথেও ওর ভালোই সম্পর্ক আছে। জেলের মধ্যে চন্দ্রকে মেরে ফেলা আমাদের জন্য কঠিন কিছু নয়”।
তারপর বাবা বললো,” আমাদের কথা শুনলে তুই চন্দ্রকে হারাবি ঠিকি তবে তোর অনাগত সন্তানকে পাবি। আমাদের কথামতো চললে তোর সন্তান জন্ম নেওয়ার পর আমরা তাকে তোর হাতে তুলে দিবো”।
এরপর বাকিটা আমাকে ভাবতে বললো। কিছুক্ষণ পর আমি চন্দ্রর সাথে দেখা করতে যাই। চন্দ্রর সাথে দেখা হওয়ার পর চন্দ্র আমাকে বাবার কথামতো কাজ করতে বলে। চন্দ্রের মুখে এসব শুনে বুঝতে বাকি রইলো না থানার মধ্যে ওকে ভয় দেখানো হয়েছে।
শেষে উপায় না পেয়ে বাবার কথা মতো সাক্ষী দেই। ভাবীরা নিজেদের সন্তানদের জন্য সাক্ষী দিতে বাধ্য হয়। তারপর আদালত রায় দেয় সন্তান জন্ম নেওয়ার পর চন্দ্রর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার।
কেটে গেলো কিছু মাস। এতদিনে আমি আর মাধুরি একটা আলাদা সংসার শহরে গড়ে নিয়েছিলাম। কেউ জানতো না আমার সাথে মাধুরি আছে। তাদের স্মৃতি থেকে ময়নার মেয়ের কথায় মুছে গেছে। তারপর জন্ম হলো মুনের। চন্দ্রর কথামতো আমি তার নাম রাখলাম মুনতাহা মাহযাবিন। ছোট্ট করে মুন। চন্দ্র যে জেলে ছিলো সেখানকার জেলার ছিলো আমার ভাই। তাই তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু করা সম্ভব হয়নি। যার জন্য সেদিন মুনকে নিয়ে আসার জন্য বাবা আরো একটি শর্ত দেয়। তাহলো চন্দ্রর সব সম্পত্তি তাদের নামে করে দেওয়া। চন্দ্র তাদের কথামতো তাই করলো। এরপর আমি মুনকে নিয়ে চলে এলাম।
চন্দ্রর ফাঁসি হওয়ার পর কেটে গেলো অনেকগুলো বছর। আমার দুই মেয়েকে নিয়ে আমার সংসার খুব সুন্দর ছিলো। কিন্তু আমার সেই সংসার সুখের হলো না। আমার ভাই আমাদের খুঁজছে এটা আমি জানতাম না। তাই বুঝতে পারিনি ভাই আমার সাথে মাধুরিকে দেখে তাকেই আমার সন্তান বলে ভেবে নিবে। বুঝতে পারলাম সেদিন যেদিন মাধুরি চলে গেলো। মাধুরি চলে যাওয়ার পর ওর মোবাইলটি প্রথমে আমিই খুঁজে পাই সেখানে ‘চন্দ্রকুঠি’ নামটি দেখেই বুঝে যাই, আমার মাধু কোন বিপদে পড়তে চলেছে।
হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাই ফোন করে৷ আমার মাধুর সর্বনাশ কিভাবে করেছে সেটার বর্ননা দেয়। আমি অনেক অনুরোধ করি ভাইকে। এমনকি এটাও বলি মাধুরি আমার মেয়ে নয়। আমার মেয়ে মুন। কিন্তু ভাই সেটা বিশ্বাস করে না। তারপর আমিই মুনের ব্যাগে মাধুরি মোবাইলটি রেখে দেই। কারন আমার বারবার মনে হয়েছিলো আমি মানুষ হিসাবে অকৃতজ্ঞ। যে ময়না আমাদের জন্য জীবন দিলো তার মেয়ের দায়িত্ব নিয়েও আমি তাকে ভালো রাখতে পারিনি। কেন ভালো রাখতে পারি নি! কারনটা আমার মেয়ে। তাই আমি চেয়েছিলাম হয় মুন মাধুরিকে খুঁজে নিয়ে আসুক নয়তো ও সেই অন্ধকারে হারিয়ে যাক যেখানে মাধুরিকে ওর জন্য যেতে হয়েছে। শুধুমাত্র ওর জন্য।(সংক্ষেপে অনেক ডায়লগ দিলাম, বুঝতে অসুবিধা হলে দুঃখিত)
বর্তমান,
সব শুনে মুন বাকশূন্য হয়ে গেলো। আগে ভেবেছিলো মুনের জন্য মাধুরির জীবনটা এমন হলো না তো। এখন ভাবনাটা সত্যি হয়ে গেলো। আরিফ সাহেব মুনকে জড়িয়ে ধরলেন। মুন বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। আরিফ সাহেব তো সেই শুরু থেকেই কান্না করে চলেছে। মুন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তার বলার মতো কিছু অবশিষ্ট নেই।
কিছুক্ষন পর নিজেদের সামলে বাবা, মেয়ে পাশাপাশি বসলো। রিয়াদ সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলো,” চন্দ্রকুঠিতে এসব অবৈধ কাজ কবে থেকে শুরু হয়েছে”?
” সেসব আমি জানি না। সেদিন ভাই ফোনে বললো ওখানে এসব হয়, আর মাধুরিকে সেসব করতে হবে। তার আগে আমি জানতাম না ওখানে এই ধরনের কিছু হয়”।
রিয়াদ আশাহত হলো। নিজেদের সামলে মুন তার বাবাকে মাধুরির কাছে নিয়ে গেলো। মাধুরি বাবাকে পেয়ে বেশ কিছুক্ষন কাঁদলো। মাধুরি তার বাবার কাছে মায়ের গল্প জানতে চাইলো। তখন মুন নিজের গল্প মাধুরিকে বসিয়ে দেয়। মাধুরি আরিফ সাহেবের মেয়ে নয় এটা শুনলে খুব কষ্ট পাবে। তাই ওকে সম্পূর্ণ সত্যিটা জানানো হলো না। সব শুনে মাধুরি বললো,” তাহলে মুন কে”?
বাবা বললেন,” ও আমার আর এক মেয়ে। যাকে ভাগ্য আমাকে দিয়ে গেছিলো উপহার হিসাবে”।
মাধুরি বললো,” সব ঠিক আছে কিন্তু কাকাকে মা কখন অপমান করলো? সেটা তো বললে না”?
” সেটা আমিও জানি না। হয়তো কারাগারে থাকাকালীন কিছু হয়েছিলো”।
তারপর বাবা, মেয়ে সব ভাবনাকে দূরে ফেলে নিজেদের নিয়ে মেতে উঠলো। বাবা, মেয়েকে একা ছেড়ে মুন এবং রিয়াদ বেরিয়ে গেলো।
__________
মুন এবং রাফি পার্কের একটি বেঞ্চে বসে আছে। রাফি মুনকে ফোন করে ডাকলো। মুনের মনে হলো হয়তো তাদের ভাবনা সত্যি হতে চলেছে। মুনকে ভুল প্রমান করে রাফি বলে উঠলো,” দেখো মুন তুমি আমার কাছে মাধুরির বোন ছাড়া অন্যকিছু নও। আমি তোমাকে অন্যকিছু ভাবতেও পারবো না। এখন তুমি হয়তো বলবে সারাজীবন কি আমি মাধুরির দুঃখে কাতর হয়ে কাটাবো? তাহলে আমার উত্তর হবে না। জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না। সে এগিয়ে যাবে। তবে এগিয়ে যাওয়া জীবনে আমি মাধুরির সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো কখনো ভুলবো না। মাধুরি আমার হৃদয়ে সবসময় থাকবে। আর তুমি থাকবে তার বোন হয়ে। তাই….”।
রাফির কথা শেষ হওয়ার আগেই মুন রাফির সামনে ভিডিওটা ধরলো। যেখানে রাফিকে আটকে রাখা হয়েছে। রাফি বেশ অবাক হয়ে বললো,” এটা কে? এটা তো আমি মনে হচ্ছে, কিন্তু”?
” কিন্তু কি”?
স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করলো মুন। রাফি বেশ বিষ্ময় নিয়ে বললো,” আমার সাথে এরকম কিছু কখনো ঘটেনি তো। তাহলে এই ভিডিওতে আমি কি করে থাকতে পারি”?
এবার মুন বেশ চমকালো। মুন ভেবেছিলো রাফি জেনেশুনে ওদের কাছে সত্যিটা লুকিয়েছিলো। তাই ভেবেছিলো ভিডিও দেখার পর হয়তো মুখ খুলবে। কিন্তু ভিডিও দেখার পর রাফির এই চমকানো মুখ এবং নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করার বিষয়টা কিছুতেই মাথায় ডুকলো না। তারমানে রাফি নিজেই জানে না ও কখন বন্দী হলো। এটা কিভাবে সম্ভব!
চলবে,
[ ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন]
#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১৪)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি
” এই ভিডিওটা তুমি কোথায় পেলে”?
রাফির কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো মুন।
” কি হলো বলো”?
” আপুকে এই ভিডিওটা পাঠিয়ে, কেউ তাকে ফাঁসিয়েছে”।
” কি? মাধুরিকে ফাঁসিয়েছে মানে”?
তারপর মুন রাফিকে ‘চন্দ্রকুঠির’ ভিতরে মাধুরির সাথে যা যা হয়েছে সব বলেছে। শুধু তালুকদার বাড়ি লোকদের নামগুলো বাদে।
” মাধুরি এখন কোথায়? ও ঠিক আছে তো”?
রাফি বেশ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললো। রাফির উত্তেজনা দেখে মুন কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে মুন বললো,” কালকে আমি যেখানে বলবো সেখানে চলে এসো। আপুকে সেখানেই পাবে”।
” কাল? আজ নয় কেন? এখনি যাই না”?
” না। এখন যাওয়া যাবে না। আপু এখন বাবার সাথে আছে। এখন গিয়ে বাবা, মেয়ের মাঝে ডোকাটা ঠিক হবে না”।
” আচ্ছা। কাল একটু তাড়াতাড়ি ঠিকানাটা দিও”।
” আচ্ছা”।
রাফির সাথে কথা শেষ করে মুন চলে গেলো।
মুন সেখান থেকে সোজা রিয়াদের সাথে দেখা করলো। রিয়াদ মুনকে দেখেই প্রশ্ন করলো,” এটা কার বাড়ি? হঠাৎ এখানে আসতে বললে কেন”?
” এসব বলার সময় নেই। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি সেটা বলুন”?
” সেটা তো ভাবতে হবে”।
” তাহলে ভাবুন”।
” হুম”।
রিয়াদ কিছু বলতে নিবে তখনি মুন বলে উঠলো,” আপনি তো আপনার কথা বলেননি, সেটা কখন বলবেন”?
” আমার কথা মানে”?
” আপনার চন্দ্রকুঠিতে যাওয়ার দ্বিতীয় কারনটি কি”?
” তুমি এটা এখনো মনে রেখেছো”?
” ভুলে যাওয়াটা আসা করেছিলেন”?
” না। এরকম আসা করাটা বোকামি সেটা আমি আগেই বুঝেছি। তাই এরকম আসা রাখার ভুল করিনি”।
” এত কথা বাদ দিয়ে আসল কথা বলুন”।
” আচ্ছা বলছি। তুমি যে কারনে গিয়েছিলে আমিও সে কারনে গিয়েছিলাম”।
” মানে”?
মুন ভেবে নিলো রিয়াদ কারনটি না বলে আবার অহেতুক কথা বলবে। মুনকে ভুল প্রমাণ করে রিয়াদ বললো,” তুমি যেমন তোমার বোনকে খুঁজতে গিয়েছিলে তেমন আমিও”।
মুন বেশ অবাক হলো। মুনকে বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে রিয়াদ বললো,” আমি, আপু, বাবা, মা এই চারজনকে নিয়ে আমাদের পরিবার। আমি যখন চাকরি পেয়ে ট্রেনিং এ যাই। তখন আমাদের পরিবারে নেমে আসে এক ঝড়। যে ঝড়ের আবাস আমার বাবা-মা আমাকে দেয়নি। তাই আমি তখন কিছুই জানতে পারি না। ট্রেনিং শেষে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন জানতে পারলাম। তিন মাস আগে আমার বোন একটি চিঠি লিখে বাড়ি থেকে চলে যায়। চিঠিতে বলা ছিলো সে যে ছেলেটিকে ভালোবাসে তার বাবা-মা তাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তাই তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আপু নিজ ইচ্ছায় গিয়েছে এটা জেনেও আমি আপুর খোঁজ করার চেষ্টা করি। বাবা-মা বারণ করেছিলো কিন্তু আমি শুনিনি। অনেক খোঁজ করেও আপুকে পাইনি। ভেবেছিলাম সে ভালো আছে তার নতুন সংসারে। সেখানে আমাদের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু একদিন হঠাৎ”!
এতটুকু বলে রিয়াদ থামলো। মুন কৌতুহল নিয়ে রিয়াদের দিকে তাকালো। মুনকে কৌতূহল নিয়ে তাকাতে দেখে রিয়াদ আবার বললো,” হঠাৎ একদিন আমার কাছে একটি ফোন আসে। আমার পুরনো নাম্বারে। অচেনা নাম্বার দেখে কিছুটা অবাক হই। ফোনটি রিসিভ করে কানে ধরতেই শুনতে পাই সেই চিরচেনা আপুর গলা, আপু বলছিলো আমাকে বাঁচা ভাই। আমি ভালো নেই। তারপর ফোনটি কেটে যায়। ঐ নাম্বারে আজো কল করলে বন্ধ বলে। যাই হোক সেই ফোনটি কদমতলী গ্রাম থেকে এসেছে এটুকু জানতে পারি। তারপরি সেখানে যাই। তখন ‘চন্দ্রকুঠির’ কথা মাথায় আসেনি, এছাড়া তখন তো আর জানতাম না সেখানে কি হয়! তখন জানলে হয়তো খুঁজে পেতাম”।
রিয়াদ একটু থেমে আবার বললো,” এটাই আমার কথা”।
মুন কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর বললো,” তারমানে সেদিন ঐ মহিলাগুলোকে আপনি নিজের বোনের ছবি দেখাচ্ছিলেন”?
” হ্যাঁ।
” আমাকে একটু দেখাবেন”?
রিয়াদ এবার ঘুরে মুনের দিকে তাকালো। তারপর বললো,” ওখানে নেই আপু। আমার মনে হয় আমি আর আপুকে খুঁজে পাবো না। তাই বেকার ছবি দেখে কি করবে তুমি”?
” আচ্ছা এমনিই দেখি না। চিনে রাখি যদি কখনো দেখা হয়”।
রিয়াদ কিছু না বলে মুচকি হাসলো। তারপর ফোন থেকে ছবি বের করে মুনের সামনে ধরলো। মুন ফোনের দিকে তাকালো। ফোনে রিয়াদ এবং একটি মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ফুটে উঠেছে। রিয়াদ পাশে মেয়েটিকে দেখে মুন চমকে গেলো।
” এ আপনার বোন”?
” হ্যাঁ”।
” নাম কি এর”?
” রিশিতা জাহান”।
“কি”?
” তুমি এত চমকাচ্ছো কেন”?
” এই মেয়েটিকে আমি চিনি। এর নাম রিশিতা নয় রেবেকা”।
” মানে? কোথায় দেখেছো”?
তারপর মুন প্রথম থেকে সবটা বললো। সব শুনে রিয়াদ কিছুটা ভেঙে পড়লো। মুন রিয়াদকে আশ্বাস দিয়ে বললো,” চলুন। তার সাথে দেখা করবেন”।
” হ্যাঁ চলো”।
____________
মুন আর রিয়াদ চলে এলো কারাগারে। কারাগারে এসে রেবেকার সাথে দেখা করতে চাওয়ার পর যা শুনলো তার জন্য দু’জনের কেউ প্রস্তুত ছিলো না।
রহিমা ওদের দু’জনকে কারাগারে দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” তোমরা এখানে কেন এসেছো”?
” রেবেকার সাথে দেখা করতে”।
তখনি সেই বৃদ্ধা মহিলা কনস্টেবল(যে মুনকে দেখে চমকে গেছিলো) এলো এবং বললো,” রেবেকা বেঁচে নেই”।
” কি”?
রিয়াদ সেখানেই বসে পড়লো। মুন রিয়াদকে ধরলো এবং বললো,” আপনি শান্ত হন প্লীজ। এভাবে ভেঙে পড়বেন না”।
” আপনি জানেন না ও আমার জন্য কি ছিলো”?
রিয়াদের চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মুন একটু শান্তভাবে বললো,” কিভাবে মারা গেলো”?
” ওর বাচ্চার মৃত্যুর খবর পেয়ে আত্নহত্যা করেছে”।
এবার মুনও একটু ভেঙে পড়লো। যে বাচ্চাটা মুনকে নিজের জন্মের স্মৃতিচারণ ঘটালো সেই বাচ্চাটিও বেঁচে নেই। ওদের দু’জনের অবস্থা দেখে রহিমা বললো,” আমিও কিছু জানতাম না। আজকে এসেই শুনলাম তিনদিন আগে এসব হয়েছে। ওর মৃতদেহ দাফন হয়ে গেছে। তাই এখন তোমাদের জন্য ওর কবরটি ছাড়া দেবার মতো কিছু নেই”।
রিয়াদকে ভেঙে পড়তে দেখে রহিমা কিছুটা আন্দাজ করে নিলো। তাই এই কথাটি বললো। রহিমার কথা শেষ হতেই অন্য মহিলাটি বললো,” আমার কাছে আরো একটি জিনিস দেওয়ার মতো আছে”।
” সেটা কি”? রিয়াদ বললো
” তবে এটা তোমাকে নয় মুনকে দিতে চাই। রেবেকা এটা মুনের জন্যই রেখে গেছে”।
এবার মুন বললো,” কি”?
মহিলাটি একটি চিঠি মুনের দিকে এগিয়ে দিলো। মুন ওনার হাত থেকে চিঠিটি নিলো। মহিলাটি বললেন,” আমি এখানে আসার আগে সেই কারাগারে কর্মরত ছিলাম যেখানে তোমার মতো…..”।
কথাটি শেষ করতে না দিয়ে মুন বললো,” আপনার চমকানোর মানেটা সেদিন না জানলেও আজকে ঠিকই জানি। তাই বলতে হবে না”।
মুন এবং রিয়াদ কারাগার থেকে বেরিয়ে এলো। দু’জনে গাড়িতে বসে আছে। চিঠিটার দিকে তাকিয়ে মুন রিয়াদকে বললো,” আপনি ঠিক আছেন। তাহলে আমরা চিঠিটা পড়তে পারি”?
রিয়াদ মুনের দিক তাকালো এবং বললো,” আমি ঠিক আছে। তুমি চিঠিটা পড়ো”।
” ঠিক আছে”।
এরপর মুন চিঠিটা পড়তে নিলো। চিঠির ভাঁজ খুলতেই প্রথমে লেখা দেখলো,
প্রিয় চন্দ্র,
তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে তখন হয়তো আমি থাকবো না। তুমি একটু অবাক হচ্ছো চিঠির উপরে চন্দ্র লেখায় তাই তো! আসলে তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তখন কিছু মূহুর্তের জন্য হলেও তোমাকে চন্দ্র ভেবেছিলাম।
আমি আমার গল্পটা সম্পূর্ণভাবে তোমাকে বলছি। তারপর তুমি নিজেই বুঝে যাবে সবকিছু।
আমি রিশিতা। বাবা-মা, ভাই নিয়ে আমার একটা সুন্দর পরিবার ছিলো। হঠাৎ একদিন সব এলোমেলো হয়ে গেলো। মায়া, মোহ বেড়াজালে প্রেম নামক এক মিথ্যে আবেগে ডুব দিয়েছিলাম আমি। ভালোবেসে যার সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম সেই মানুষটা ধোঁকা দিয়ে বিক্রি করে দিলো ‘চন্দ্রকুঠি’ নামক এক অন্ধকার নিষিদ্ধ পল্লীতে। সেখান থেকে আমার যন্ত্রণাময় জীবন শুরু। রিশিতা থেকে হয়ে উঠলাম রেবেকা। টাকার কাছে বিক্রি হওয়া জীবনটার প্রতি খুব ঘৃনা হতো। আর সবচেয়ে বেশি ঘৃনা হতো সেই মানুষটার কথা ভাবলে যার জন্য আমার এই অবস্থা। সেই মানুষটির নাম ফাহাদ।
তো যাই হোক ঘৃনিত জীবন থেকে মুক্তি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুক্তি নেওয়ার আগেই জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি। মা শব্দটি শুনে আনন্দিত হয়েছিলাম। যখন ভাবতাম এ সন্তান পাপের তখন খুব খারাপ লাগতো। তবুও এই সন্তানকে খুন করার কথা ভাবতে পারিনি। যতই হোক প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি ছিলো এটা।
গর্ভবতী অবস্থায় ওরা আমাকে ছাড়লো না। একজনকে রুমে পাঠিয়ে দিলো। সহ্য করতে না পেরে লোকটিকে মেরে দিয়েছিলাম। যে কারনে আজ আমি খুনি। সবি তো শুনলে। যেটা বাকি রইলো তাহলো চন্দ্র কে? তাকে কিভাবে চিনি?
চন্দ্রর ব্যপারে আমি চন্দ্রকুঠির একজনার কাছেই শুনেছি। যদিও সবটা জানি না। তবে শুনেছি এই বাড়িটা তার ছিলো। একদিন পুরনো আসবাপত্র রাখতে বাইরের তালাবদ্ধ ঘরটি খোলা হয়েছিলো। সেদিনই ঐ ঘরটির মাঝ থেকে আমি চন্দ্রর একটি ছবি পাই। তারপরো আমি ওর সম্পর্কে জানি।
সেদিন যখন তুমি আমার সামনে মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে ছিলে। কিছু মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো ছবি থেকে চন্দ্র বেরিয়ে এসেছে আমার সামনে।
তোমার সাথে চন্দ্র আর চন্দ্রকুঠির সম্পর্কে আছে এটা ভেবে তোমাকে সব বলতে চেয়েছিলাম। তবে তুমি যেদিন শুনতে এসেছিলে সেদিন তোমাকে সব বলা সম্ভব হয়ে উঠেনি। কারন আমি কিছু বললে আমার বাচ্চাটিকে মেরে ফেলা হতো…………।
আজ শেষ সময়ে খুব ইচ্ছে করলো তোমাকে সব বলতে। তাই তোমার জন্য আমার লেখা এই শেষ চিঠি।
ইতি
রিশিতা
চিঠিটা পড়া শেষে মুনের চোখ দিয়ে অশ্রুকোনা গড়িয়ে পড়লো। ভালোবেসে কতটা নির্মমভাবে ঠকে গেলো মেয়েটা। কতটা যন্ত্রণাময় ছিলো সেই দিনগুলি। মুনকে কাঁদতে দেখে রিয়াদ বললো,” এখন কান্না করে কোন লাভ নেই। রিশিতা, মাধুরির মতো অনেকগুলো মেয়ের যন্ত্রণার খুশি হতে হলে ওদেরকে শাস্তি দিতে হবে। তাই কান্না থামাও মুন”।
” আমরা এখন কি করবে”? কান্নারত অবস্থায় বললো মুন
” সেটা আমি ভেবে নিয়েছি, বাকিটা তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে”।
” আচ্ছা”।
মুন এবং রিয়াদ যে বাসা থেকে কারাগারের উদ্দেশ্য বেরিয়ে ছিলো সেখানেই আবার চলে এলো। বাসার সামনে গিয়ে বেশ অবাক হলো মুন এবং রিয়াদ। দরজার তালা ভাঙা। রিয়াদ এবং মুন দরজা খুলে ভিতরে ডুকে আরো অবাক হয়ে গেলো। সব জিনিস ছড়ানো, ছেটানো। ঘরটার এমন অবস্থা দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে বসে পড়লো মুন এবং রিয়াদ।
হঠাৎ চিন্তিত মুখ দূর করে দু’জনেই হেঁসে দিলো।
চলবে,