#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৩
৭১.
মিলন পড়া না পেরে দুই কান ধরে দাড়িয়ে আছে।ক্লাস টিচার আজকে বিষণ রেগেছে।মিলন,সাজু তাকে জ্বালিয়ে মারছে।এইতো একটু আগের ঘটনা।মিলন পড়া না পেরে সাজুকে কলম দিয়ে খোচাচ্ছিল।তাই স্যার রেগে ক্লাস থেকে বের করে দেন।ফাজিল দু’টো স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
পুতুল ক্লাস রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে দুই ভাইয়ের কান্ড কারখানা।বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা সমানে ব’লে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে একে অপরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছে।কি হয়েছে বুঝতে পারছে না?তবুও পুতুল তাকিয়ে রয়।এরমধ্যে ক্লাসের স্যার পুতুল যে অমনোযোগী সেটা দেখতে পেয়ে দাড় করায়।জানতে চায় কি সমস্যা?পুতুল মাথা নাড়িয়ে না ব’লে।
সমস্যা নেই যখন পড়ায় মনযোগ দেওয়া।কথাটা শেষ করে স্যার আবার বই দেখে পড়াতে শুরু করেন।পুতুল বইয়ের দিকে মনযোগী হয়।
শেষ পিরিয়ডের ঘন্টা পরতেই একে একে ক্লাস কক্ষ ছেড়ে বের হয়।মিলন,সাজু কান ছেড়ে চুপচাপ ক্লাস রুমে গিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়।
দূরে যা?আমার সাথে কথা কবি না।যদি কথা কস?তাহলে মনে করব!তুই মরা মুরগী গু খাস।
ওয়াক্ক।ছি,মিলনের বাচ্চা এগুলো কি বলছিস?
আমি ঠিকই কইছি।আর আমি মিলন।শুধুই মিলন।এখানে মিলনের কোনো বাচ্চাটাচ্চা নেই।তোর আর আমার বাপের তিনখানা বাপ আছে।একটা বাড়িতে।আর বাকি দুইটা স্বাধীনের বাচ্চা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে।কথাগুলো শেষ করে দুই ভাই দুইদিকে গিয়ে বসে আছে।
পুতুলের আজ একটু দেড়ি হয়েছে।সে স্কুলের প্রাঙ্খনে দাঁড়িয়ে দুই ভাইকে হাত দিয়ে ডাকতে লাগল।কিন্তু দুইজনই এমন গাল ফুলিয়ে বসে থাকার কারণটা বুঝতে সময় লাগলো।এরা আবার ঝগড়া করছে।উফ,এরা আর ভালো হলোনা।পুতুল রেগে ওদের রেখে হাঁটা শুরু করলো।যার মানে আজকে সে এদের পাত্তা দিবে না।পুতুল একা একা চলে যাচ্ছে ব’লে সাজু,মিলন একসাথে দৌড়ে পুতুলের পিছন পিছনে হাঁটতে শুরু করে।পুতুলের পিছনে সাজু,মিলনকে আসতে দেখে সে হাঁটা বন্ধ করে পিছনে তাকায়।পুতুল দেখাদেখি তারাও পিছনে তাকায়।পুতুল হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলে তারাও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়।পুতুল থেমে গেলে তারা ওহ থেমে যায়।এভাবেই পুরো রাস্তা শেষ করে বাড়িতে পা রাখে।
পুতুল প্রতিদিন ভাইদের গোসল করিয়ে দেয়।আজকে সে চুপচাপ।সে গোসল করে নামাজ পড়ে,বিছানা চোখ বুজে সুয়ে আছে।সাজু,মিলন একসাথে মাথা চুলকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়।যার মানে আপু আজকে বেশি রাগ করছে মনে হয়।তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেও না।নিজেরাই গোসল ঘরে গেলো।মাথায় পানি দিয়ে সাবান চোখে লাগিয়ে এমন চিতকার মারছে।পুতুল,রেনু ভয় পেয়ে দৌড়ে আসে।সাজু,মিলন এর কান্ডে দু’জনই ভ্যাবাচ্যাকা গেলো।রেনু রেগে গিয়ে দু’টোকেই পিঠের মধ্যে ঠাসস ঠাসস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো।মায়ের হাতের মা’র খেয়ে কলপাড়ে কান্না করছে।একে তোও চোখ জ্বলছে সাবানের ফ্যানার জন্য।আবার পিঠে থাপ্পড় পড়ায় পিঠ জ্বলছে।পুতুল চুপচাপ দুই হাত ভাজঁ করে দাঁড়িয়ে রইল।রেনু,মিলন,সাজুকে গোসল করিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।সাজু তোয়ালে দিয়ে একটু পর পর চোখের আর নাকের পানি মুছে যাচ্ছে।আর মিলন চোখের পানি,নাকের পানি তোয়ালে দিয়ে না মুছে বসে আছে।মনের সুখে কান্না করছে।চোখের পানিতে গাল ভিজে আছে।নাকের সর্দি নাক থেকে বের হয়ে শূন্যে দুলনি খাচ্ছে।তবুও সে পরিষ্কার করবে না।এরজন্য যদি স্বাধীন মিয়ার বাড়ি ডুবে যায় তোও ডুবে যাক।এতে তার কিছু যায় আসে না।
সাজু নাকটা আবার মুছে খাটের ওপর গড়িয়ে কান্দে কান্দে উচ্চস্বরে বলল,
আজ আব্বা নেই ব’লে আমাদের ধরে মারছো।আব্বা খালি বাড়িতে আসুক।আমি বিচার দিমু রে…!ওই আব্বা গোও।রেনু আম্মা আমারে মাইরা লাশ বানাইয়া ফালাইছে।ওরে আব্বা রে…ওই আমার আব্বা গোও।আমারে বাঁচাও গোও…!পুতুল ঘরে ঢুকেই থ হয়ে গেছে।
এই মরা কান্না বন্ধ করবি না-কি শোলার ঝাড়ুটা নিয়ে আসবো।রেনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুই ছেলেকে ধমক দিচ্ছে।পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না?তার হাতটা অটোমেটিক মাথায় চলে গেছে।
৭২.
রমিজ মেম্বার হুক্কা টানতে টানতে বলল,
কি’রে খবর কি?আজকে কয়েকদিন ধরে দেখছি স্বাধীনের খবর নেই।
ওটা কি মরছে না-কি?
আরে না স্যার।স্বাধীন না-কি ঢাকায় গেছে শুনলাম।
কস কি?এটা তো ভালো খবর!
আগে পুরো কথা হুনেন।
আচ্ছা বল।
সে ঢাকায় গেছে এটা সত্যি।কিন্তু অন্য কামে।ওই যে তার বাড়িতে সুন্দরী পিচ্চি বোবা মাইয়াখানা আছে না।কি যেনো নাম?হয়,পুতুল। মাইয়া নাম পুতুল।সেই মাইয়া না-কি নকশি কাঁথা সেলাই করে।সেগুলো নিয়ে ঢাকায় গেছে।বিক্রি করবে ব’লে।
পুতুল। ওহহহ।ওই বোবা ছেড়ি।যার মা পালাইয়া গেছিলো।তার প্রেমিক নাগরের লখে।
হয়।
নজরে রাখ।স্বাধীন কবে গ্রামে পা রাখে?আসলেই আমারে জানাইবি।
ঠিক আছে।
হুম এখন ভাগ।
আজ পনেরো দিন পর স্বাধীন গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।পরিবারের জন্য এতদিন মনটা ছটফট করছে।কেমন আছে তারা,খুব জানতে ইচ্ছে করতো?তবুও খবর নিতে পারেনি।আজ বাসায় গিয়ে সবাইকে একসাথে দেখে চোখ জুড়িয়ে নিবে।সবাইকে দেখে মন শান্ত করবে।কতদিন হইছে বউ,পোলাপান থুইয়া এই অজানা শহরে রাত কাটিয়েছে।কষ্ট লাগতো।তবুও মনরে একটা কিছু দিয়ে বুঝ দিত।কষ্ট কাদের জন্য করছি?তাদের জন্যই তোও এই কষ্ট করা।
পুতুলের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।সংসারের কোনো কাজে তার হাত দেওয়া বারণ।রেনু সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে।পরীক্ষা শেষ হলে যেনো সংসারের কাজে হাত লাগায়।পুতুল মামীর কথাগুলো মেনে নিয়েছে।আর সাজু,মিলন নিজেদের দুষ্টুমি নিয়েই আছে।কিন্তু সেইদিন মায়ের মারের কথা ভুলেনি।সেটা মাথায় রাখছে।আব্বা আসলেই সবটা ব’লে দিবে।
৭৩.
রেনু,সাজু,মিলন,পুতুল আম্মা।তোমরা কই?
রেনু,স্বামীর কন্ঠ পেয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে।স্বাধীন কিছু বলার আগেই রেনু উঠোনের মধ্যেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।স্বাধীন হাতের ব্যাগটা ফেলে বউকে জড়িয়ে ধরে।কপালে চুমু বসিয়ে বলল,
আরে বউ কান্দ কেন?আমি আইসা পড়ছি তোও।আমি ভালা আছি।
তুমি কেমন ভালো আছোও?তা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি আমি।চেহারা শুকিয়ে কাঠ।সুন্দর মানুষটা কালো হয়ে গেছে। ঢাকায় কি অনেক কষ্ট?এমন শুকিয়ে গেছো কেন?ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো নাই।
আসলে বউ ঢাকায় তো তুমি নাই।তোমার রান্না খাইতে না পাইরা আমি শুকাইয়া গেছি।
এখন যেহেতু চলে আসছি।তাহলে আমার বউয়ের মজার মজার খাবার খেয়ে ঠিক হয়ে যাব।আমাকে আবার আগের মতো লাগবে।স্বাধীন বউয়ের কথা ঘুরাতে বলল,
তা বাকিরা কই দেখছি না যে?
ওরা আছে আশেপাশেই।তোমার গলা পেলেই চলে আসবে।রেনু,পুতুলকে ডাকতেই মাগরিব নামাজ পড়া শেষ করে।ঘর থেকে বের হয়।দুই বাঁদর আগেই দৌড়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে।তাদের বিচারের শেষ নেই।স্বাধীন ছেলেদের দেখে পান জুড়িয়ে যায়।সাদা পাজামা -পাঞ্জাবি পড়া।মাথায় সাদা টুপি পরে আছে।দেখেই মনে হচ্ছে।মাএ নামাজ পড়ে এসেছে।রেনু,পুতুলকে ডেকেই ছোট ছেলেকে ঘর থেকে আনতে যায়।
আব্বা আমি তোমারে কত মিস করছি।আম্মা পচাঁ আমাদের ভালোবাসে না।আমারে এমনে এমনে মারছে।মিলন,সাজু হাত পা দেখাতে লাগল।আব্বা,তুমি আম্মার বিচার করবা।স্বাধীন হেঁসে উঠে।
ওহ রেনু!তুমি নাকি আমার ছেলেদের মারছো।হুম,এটা কি ঠিক হইলো?আমার আব্বাগুলো কত ভালো?তারা কি করছে?রেনু ঘর থেকে ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠোনে আসে।
আমি তো ওগো সৎ মা।তাই খালি শুধু মারি। ভালোবাসি না।আর তারা যা করে সব ভালো করে।একদম সাধু বাবা।
পুতুল বারান্দায় এককোনায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।সবার মতো সে দৌড়ে আসেনি।স্বাধীন,রেনুর কোল থেকে ছোট ছেলেকে নিয়ে কপালে চুমু বসিয়ে,আদর করলো কিছুক্ষণ।তারপর রেনু কোলে তুলে দিল।
স্বাধীন এগিয়ে এসে পুতুলের মাথায় হাত রাখে।ডেকে ওঠে।
আম্মা।আম্মা।ওহ আম্মা।আমার আম্মা।কপালে মাঝে একটা চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করে।
আম্মা তুমি কেমন আছো?পুতুল দুই চোখের পানি মুছতে মুছতে ইশারায় বলল,
সে ভালো আছে।পুতুলের চোখের পানি বন্ধ হয় না।সে যতই চোখের পানি মুছে ততই চোখ থেকে আরো বেশি পানি বেরিয়ে আসে।চোখ দু’টো আজ এতটা বেহায়া কেমনে হলো?পুতুল বুঝতে পারে না।এতদিন নিজেকে সামলে নিলেও আজ মামাকে দেখে বেশি আবেগি হয়ে গেছে।
মামাকে হালকা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ফুফিয়ে ওঠে।স্বাধীন,পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।চারদিকে তাকিয়ে দেখে পরিবারের প্রত্যেকের মুখে হাসি লেগে আছে। স্বাধীনের বাড়িতে আজ ঈদের খুশি লেগেছে।
স্বাধীনের চোখ দুটো জুড়িয়ে গেলো।রাতের আধারের ওই আকাশ দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,এটাই আমার জান্নাতের বাগান।আমার সুখ।আমার মতো এতোটা সুখী আর কেউ নেই।আমি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ।আল্লাহ তোমার নেয়ামত খেয়ে আমি ভালো আছি।সুখেই আছি।শত কোটি শুকরিয়া তোমার দরবারে।
ঘর টা যদি সুখের হয়।
তারে জানি স্বর্গ কয়।
ভালোবাসার মাঝে স্বর্গ,
আর কোথাও নয়?
চলবে…..
#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৪
৭৪.
অনেক দিন পর স্বামী বাড়িতে এসেছে।রেনু একটুও ভালো কিছু রান্না করার চেষ্টা করে।পোলাও চাউলের খুদ দিয়ে পায়েস বানানো সিদ্ধান্ত নিলো।
তাছাড়া বাঙালির খাবারের তালিকায় পায়েস অন্যতম।বাঙালিদের যেকোনো শুভ অনুষ্ঠানে পায়েস থাকবেই থাকবে!উৎসব আয়োজনে বাঙালির খাদ্যতালিকায় পায়েসের জুড়ি মেলা ভার।বিশেষ দিনে,মিষ্টি মুখ করার জন্য পায়েস আয়োজন বেশি হয়ে থাকে।দুধ পরিমাণমতো চিনি,কাজুবাদাম ও কিশমিশ,দু’টো তেজপাতা।ছোট কয়েকটা এলাচ।সবগুলো একসাথে হাঁড়িতে চড়িয়েছে।
একটা পাত্রে চাল নিয়ে ভিজিয়ে রেখে ঝড়িয়ে নিলো।দুধ ঘন করে নিয়েছে।দুধ ফুটে উঠলে তাতে চাল দিয়েছে।কিছুক্ষণ পর পর চামচ দিয়ে নাড়া দেয়,যাতে পাত্রের তলায় না লাগে।এরপর হয়ে গেলে নামিয়ে নেয়।পায়েস সুগন্ধ পেয়ে সাজু,মিলন রান্না ঘরে উঁকি দেয়।
আম্মা পায়েস রান্না করছে।মিলন,সাজু জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল,
হুম,ইয়াম্মি।অনেক মজা হবে।কি সুন্দর সুগন্ধ আসছে?কারো ফিসফিস কথার আওয়াজে রেনু ঘুরে দেখতে পায় দুই বাঁদর দাঁড়িয়ে আছে।হাতের খুন্তিটা রাখতে রাখতে বলল,
এখানে কি চাই?
পা…য়ে…স।
এখন না।এশারের আজান পরে গেছে।বাবার সাথে হাত মুখ ধুয়ে নামাজে যাও।নামাজ পরে আসলে খেতে দিবো।
এখন একটুও খেয়ে যাই।
না।আগে যেটা ব’লেছি।ওটা করো।তারপরে তোমাদের কথা শুনা হবে।রেনুকে শত মানানোর চেষ্টা করে ওহ পারলোনা।তাই ওরা চুপচাপ নামাজ পড়তে চলে যায়।
এশার নামাজ পড়ে বাড়িতে আসতেই রাতের খাবার দেওয়া হয়।পায়েস দেয়নি ব’লে ওদের মন খারাপ হয়।রেনু দেখে ওহ না দেখার ভান করে খেদে বলল।
ওরা চুপচাপ খেয়ে উঠে।স্বাধীন দুই ছেলের মন খারাপের কারণ ইশারায় জানতে চাইলে রেনু কিছু ব’লে না।
রাতের খাবার খেয়ে সবাই যখন গল্পের জন্য একসাথে বসেছে।তখনই সবার হাতে হাতে একটা করে পায়েস বাটি তুলে দেয়।পুতুল নিজের বাটি থেকে এক চামচ মুখে দিতে নিলেই মিলন গাল ফুলিয়ে বলল,
আমি খাবো না।তোমরা খাও।মিলনের রাগ দেখে সাজু এক চামচ মুখে দিয়েছিল।সেটা গিলে নিয়ে ঠোঁট দুটো মুছে নিলো।বাটিটা মাটিতে রেখে সে-ও বলল খাবে না।স্বাধীন, পুতুল এদের কাহিনি বুঝতে না পেরে রেনুর দিকে তাকিয়ে রয়।রেনু নিজের বাটির পায়েস চামচ দিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বলল।
ঠিক আছে।খেতে হবে না।রেখে দেও।আমি তোমাদেরটা খেয়ে নিবো।এমনইতেই আমার এক বাটিতে পোষাচ্ছে না।তিন বাটি হলে ঠিক পুষে যেতো।কি করব হাঁড়িতে আর পায়েস নেই?তাই মনের সাথে সাথে পেট ভরাতে না পারায় দুঃখ লাগচ্ছিল।কিন্তু এখন কোনো ব্যাপার না।আমারটা সাথে তোমাদের দুইজনের টা ফ্রি।রেনু নিজের দিকে দুই বাটি টেনে নিতে নিলেই মিলন,সাজু তাড়াতাড়ি করে নিয়ে নিলো।কোনো কথা না ব’লে একের পর এক চামচ মুখে ঢুকিয়ে নিচ্ছে।পুরো বাটির পায়েস শেষ করে,রেনুর হাতে সুন্দর করে খালি বাটি দিয়ে চলে গেলো।রেনু মিটিমিটি করে হেঁসে উঠে।দুই ছেলের এতখন এসব করার কাহিনি বলতেই স্বাধীন,পুতুল হেঁসে দেয়।
অনেক রাত হয়ে গেছে।এবার যার যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো।মামীর কথায় পুতুল মাথা নাড়িয়ে চুপ করে ঘরে চলে যায়।নিজ কক্ষে এসে দেখে দুই ভাই চুপচাপ শুয়ে আছে।পুতুল দরজা বন্ধ করে।বাতি সুইচ টিপে বন্ধ করে নিজেও কিছুটা দূরত্ব রেখে চোখ বুজে নিলো।
৭৫.
জামাই আঁটি গ্রাম থেকে রেনু চাচাতো ভাই আসছে।বোনকে দেখে কয়েক দফা কান্নাকাটি করেছে।দশ বছর ধরে দেশের বাহিরে ছিলো।বোনের বিয়ে সময় সে দূর দেশে।আজ সেই বোন নাকি চার ছেলে,মেয়ে’র মা।ভাবতেই অবাক হচ্ছে।
নিজে বিয়ে করেনি।মাথার চুল পড়ে টাক হচ্ছে।তাই তো এবার দেশে ফিরতেই মা,বাবা ছেলেকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগছে।রেনুর ভাইয়ের নাম সাজ্জাদ।বিশ বছর বয়সে দেশ ছাড়ে।এখন ত্রিশ থেকে একটু বয়স বেশি হয়েছে।দেখতে হ্যান্ডসাম লাগে।কিন্তু হ্যান্ডসাম হলে কি হবে মাথার চুল না থাকায় টাকলু আঙ্কেল লাগছে।চুল থাকলে বেশ কয়েকটা রমনী পটলে ওহ পটে যেতো।
এই সাজ্জাদ সাহেবের কোনো রমনী না জুটলেও,বিদেশ থেকে এসে একটা কুকুর ভালোই জুটিয়ে নিয়েছে।তার গায়ের মশম সাদা।নাম দিয়েছে মানকি।এই নাম শুনেই মিলন হাসতেই থাকে।আর মুখ দিয়ে বলতে থাকে।
কুত্তার বাচ্চা ফুটফুটে সুন্দর।মিলনকে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করতে দেখে মানকি চোখের পলক ফেলে তাকায়।
সাজাদ্দ বোনের বাড়িতে আসার পথে তাঁকেও নিয়ে এসেছে।পুতুল কুকুর দেখলেই ভয় পায়।আর নতুন অতিথি সাথে নতুন মানকি নামক এই প্রানী দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।এই আপদ তাদের বাড়িতে না-কি কয়েকদিন থাকবে।তাই পুতুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে,এর থেকে দশ হাত দূরে থাকবে।
কিন্তু এইদিকে মিলন কুকুরটার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়।আবার জিহ্বা বের করে ভেঙায়।লেজ ধরে টানে।কখনো গোফ ধরে টানে।মিলন উল্টাপাল্টা কাজে কুকুরটাও বিরক্ত হয়ে উঠে।সে বেশ কয়েকবার কেউ কেউ করে উঠে।কুকুরের সাথে এমন মাখামাখি ভালো না।সবাই নিষেধ করে।কিন্তু সে শুনলে তোও।যদিও সাজ্জাদ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে।তবু্ও কুকুরের সাথে এতো মাতামাতি করা ঠিক না।দেখা যাবে সে বিরক্ত হয়ে কিছু করে বসেছে।
সাজ্জাদ,স্বাধীনের সাথে মাঠে গেছে।সে না-কি ক্ষেতে চাষবাস করবে।বাড়িতে মানকিকে রেখে গেছে।এই মানকি সাহেবের কোনো কাজ নেই।সে খায় দায় আর ঘুমিয়ে দিন কাঁটায়।আর রাত হলে সে যা করে সেসব রাতেই বুঝতে পারবে।
সাজ্জাদ মামা বিদেশি চকলেট এনেছে।রেনু মিলন,সাজু হাতে কিছু চকলেট ভাগাভাগি করে দিল।সেই চকলেট প্যাকেট ছিঁড়ে মুখে পুরে,
হুমম ম-ম।সেই স্বাদ।এত স্বাদ ক্যা?এত স্বাদ…।
মিলনের মজা করে চকোলেট খাওয়া দেখে মানকি সাহেব তার লেজ নাড়িয়ে বারান্দা থেকে নেমে মিলনের গায়ের সাথে গা লাগিয়ে দাঁড়ায়।
ওমা গো মা।দেখছো নিই এর কার বারটা।
ওই আমার কাছে কি তোর হ্যা?খুব তোও এতখন ভাব লইয়া আছিলি।মিলনের পাত্তা দেস নাই।এখন আইছেন কেন?দূরে যা।দূরে গিয়া মর গা।শালা ফটকাবাজ।চকলেট লোভী।লোভ কত?আবার আমারটা খাইতে আয়ে।তোরে আমি চকলেট দি.তা.ম না।না মানে না।তোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই।সো আমি দিতাম না।আবার আমার চকলেটের দিকে নজর দেস।দাঁড়া তুই।মিলন চকলেটগুলোতে থু থু মেরে দিয়ে বলল,
নে এবার,খাবি।খা।খা না।আমি জানতাম।এই রকম করলে তুই খাইতে পারবি না।তাই ইচ্ছে করে এটা করলাম।মিলন লাস্ট বড় চকলেটটাতে থু থু লাগিয়েছিল।মানকি তখন লেজ নাড়িয়ে উল্টো পথে চলে যাচ্ছিলো।মিলন তখনই মনের আনন্দে মুখে পুরতে নিলেই মানকি ফিরে এসে মিলনের হাতের চকলেট মুখে নিয়ে দৌড় মারে।নিজের মুখে চকলেট যেতে পারেনি।হাত খালি,সেখানে ওহ চকলেট নেই।মিলন একটা চিতকার করে বলল,
কুত্তার বাচ্চা আমার চকলেট নিছে।কুত্তা বাচ্চা একটা লোভী।মিলনের থু থু লাগানো চকলেট খাইছে।লোভী কুত্তা।
মিলন,কুকুরের সাথে পুরো বাড়িতে দৌড়াতে লাগলো।তার উদ্দেশ্য একটাই।কুত্তা বাচ্চার মুখ থেকে চকলেট বের করেই ছাড়বে।কিন্তু মানকি সাহেব ধরা দিলে তো।
৭৬.
ভাই সামনের মাসে সাজু,মিলন ছয় বছরে পা দিবে।তাই বলছিলাম কি?ওদের অল্প বয়স থাকতেই মুসলমানিটা করে ফেলেন।আমি সব ব্যাবস্থা করে রাখব।
হুম ভাই মুসলমানি করাবো।কিন্তু এরা যে দুষ্টুমি করে।দেখা যাবো একে অপরের সঙ্গে মারামারি করে রক্ত বের না করে বসে।
আরে এটা কোনো ব্যাপার না।একবার সুন্নতের কাজটা হয়ে গেলেই তারা নিজেরাই সর্তক থাকবে।সব ঠিক হয়ে যাবে।আর আমি তোও আছিই।সামলে নিতে পারব।
সাজ্জাদ,স্বাধীন বাড়িতে পা রাখতেই দেখে, মিলন দুই হাত দিয়ে কুকুরের মুখ হা করিয়ে কিছু একটা খুঁজছে।আর কিসব ব’লে বকাবকি করছে।
কি মামা কি হয়েছে?আপনি মানকি সাহেব সাথে এমন করছেন কেন?
-;তোমার মানকি গায়ে তোও কোনো কোর্ট,প্যান্ট,টাই পড়া দেখলাম না।তাহলে সে সাহেব হলো কি করে?তোমাকে সাহেব লাগছিল।প্রথম যেইদিন কোর্ট,প্যান্ট,টাই পরে আমাদের বাড়িতে আসছিলা।
কিন্তু এখন তার বিচার কর।তোমার এই মানকি,টানকিং আমার চকলেট খাইছে।তারে ভালোই ভালোই চকলেট পেট থেকে বের করতে বলো।যদি বের না করে।আমি কিন্তু কাচি দিয়ে তার পেট কেটে চকলেট বাহির করমু।
অসভ্য কুত্তা বাচ্চা।লোভী মানিক টানকিং।শরম নাই।অন্যেরটা কাইড়া খায়।ছ্যাছড়া কুত্তা।লোভী জানি কোনহানকার?
মানকি সাহেব মনে হয় মিলনের কথায় অপমান ফিল করলেন।তাইতো মিলনের কথা শেষ হতে না হতেই কেউ কেউ শুরু করে দিলো।যার মানে সে নির্দোষ।মানকি এমন কাজে মিলন রেগে বলল,
একে তোও চুরি করে খাইছে।তার ওপর সিনা জুড়ি করে।লোভী মানকি।অসভ্য।মামা তোমার এই অসভ্য কুত্তাটাকে বাহিরে রেখে আসোও।এ চরম লোভী।এর জায়গায় আমাদের মাঝে হবে না।সাজ্জাদ মিলনকে শান্ত করতে বলল,
মামা শান্ত হও।তোমার জন্য গুড নিউজ আছে।
গুড নিউজ।সেটা আবার কি?খায় না মাথা দেয়?
বলছি।আগে সবাইকে ডেকে আনো।মিলন, রেনুকে ডেকে আনলো।পুতুল তখন স্কুলে আছে।মামা আসার খুশিতে মিলন,সাজু দুইদিন ধরে স্কুলে যায় না।রেনু আসতেই জানানো হলো।সামনের শুক্রবারে সাজু,মিলনের মুসলমানি।তার উপলক্ষে ছোট খাটো খানাপিনা হবে নিজেদের মধ্যেই।বাহিরে লোক আসবে না।শুধু নিজেরাই থাকবে।সেই দিনের জন্য পোলা,মুরগী রান্না হবে।সাথে গরুর গোশত।
সুস্বাদু খাবারের কথা শুনে মিলন,সাজু লাফাতে লাগলো।
থাকতুম থাকতুম বাজায়।
মিলন মিয়ার ঢোল।
আমি মজার মজার খাবার খাবো।ওহ শুক্রবারে আমার মুসলমানি হবে।তোমাদের সবাইকে দাওয়াত দিলাম সবাই আইসো।আসলে ফিড়ি পেতে বসতে দিবো।পান,সুপারি খেতে দিব।সবাই গিফট নিয়ে আসবা।না নিয়ে আসলে কোনো সমস্যা নাই।না খাইয়ে পাঠিয়ে দিবো।
চলবে….
#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৫
৭৭.
শুনলাম তোমার ননদের মাইয়া এহনো এই বাড়িতেই আছে।তা তাকে কি সারাজীবন বসিয়ে রাখবা না-কি?মাইয়া মানুষ যখন, পরের বাড়িতে পাঠিয়ে দেও না কেন?স্বাধীন এই মাইয়ারে এত দিন খাওয়াছে।এই তো ম্যালা করছে।মাইয়াডারে বিয়া দিয়া ফালাও।
-;মামী মা।আপনি অতিথি মানুষ।অনেকদিন পরে আসছেন।কোথায় একটু আনন্দ,হাসি,মজা করবেন?তা না করে।আপনি আজকের এই শুভ্র দিনে কথাগুলো নিয়ে পড়ে আছেন?
-;রেনু তুমি ব্যাপরটা বুঝতাছো না।আরে পরের মাইয়া,পোলা নিয়ে এত মাতামাতি কিসের?ওদের নিয়ে মাতামাতি কম কর।নিজের ঘরেও দুইখান আছে সেটা কিন্তু ভুইলা যা-ইয়ো না।পরের মাইয়া,পোলার জন্য এত দরদ।আর নিজেরটার প্রতি কোনো দরদ নাই কেন?আবার ঢঙ্গ কইরায় বোবা মাইয়াডারে পড়াইতাছে।বলিই,টাহা কি গাছে ধরছে তোমার সোয়ামীর?এত যখন টাহা পয়সা আছে।আমারে দিয়া দেও।আমি গ্রামে গিয়া গরু কিনি।প্রত্যেক মাসে আমার থেকে লাভ নিয়া আইসো।
মামী মা থামুন।পুতুল আমাদের’টা খায় না, পড়েও না।ওর নিজের টাকায় ওর খরচ চলছে।এমনকি ওর মায়ের নামের সম্পত্তি যতটুকু প্রাপ্ত হোক পাওনা রয়েছে।সেইসব ওপরই ওর বসত ভিটা।ওইযে পশ্চিমে দিকের ছাপড়ার ঘরটা দেখতে পাচ্ছেন।ওটাতে পুতুল থাকে।ঝড় হয়,তুফান বয়।কিন্তু মেয়েটা আমাদের ঘরে এসে একটা রাত কাটাতে রাজি না।সে তার ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে ঘুমিয়ে থাকে।কয়েকদিন আগে বৃষ্টির জন্য যখন ঘরের চালের ফুটো দিয়ে টুপটাপ শব্দ করে পানি পড়ছিল।পুতুল ভাইদের কে নিরাপদে রেখেছে।নিজের ঘরে ছোট মাটির কলস এবং ভাঙ্গা হাঁড়ি পেতেছে।যাতে পানিটুকু মাটিতে কিংবা নিজের গায়ে এসে না লাগে।কিন্তু ঘরে ভিতরে জানালা বেয়ে পানি পড়ছে।বাহিরে ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃষ্টি জ্বালাতন সয্য করা দায় হয়েছে।নিজের গায়ে বৃষ্টির পানি পরে জ্বর এসেছে।জ্বরের জন্য
মেয়েটা বিছানা ছাড়তে পারছে না।আর আপনি তাঁকে নিয়ে আমার কাছে এসেছেন নিন্দা করতে।
পুতুলের হয়ে রেনুর সাফাই গাওয়াটা ভালো চোখে নিলেন না মনোয়ারা বেগম।পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন।এত চটাং চটাং কথা থামাও।আর মাইয়া মানুষ হইয়া তোমার গলায় দেখি খুব তেজ বাড়ছে।স্বাধীনের ঘরে আইসা মোটা চালের ভাত খাও।তার জন্য বুঝি এত সাহস বাড়ছে না।কলিজাটা মেলা বড় হইছে।এত চটাং চটাং কথা আমার লগে কমাইয়া কও বউ।মাইয়া মানুষের এত তেজ আমার পছন্দ নয়।গুরুজনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই।কেমন শিক্ষা দিয়েছে তোমার বাপ,মা?আর ওই মেয়ের হয়ে এত সাফাই গাইছো।পড়াশোনা করাচ্ছো।দুইদিন পরে তোও ওরে পরের বাড়িতে বিয়া দিমু।তখন হাতে বই থাকব না।হাতে থাকব খুন্তি।মাইয়া মাইনষের আবার এত পড়া লাগে নিই?
কেন মামী মা?মেয়েরা কি পড়াশোনা করে না?মেয়েদের এত ছোট নজরে দেখেন কেন?মেয়েরা চাইলেই সব পারে।একটা ভাঙ্গা সংসার মেয়েরা যেমন নিজ হাতে গড়তে পারে।তেমনই ভাঙ্গতে ওহ পারে।যে মেয়ে পরের বাড়িতে রাঁধতে জানে।আবার সেই হাতে ঘরের বাহিরে শিক্ষা আলো জ্বালাতে পারে।আজকের মেয়েরা ঘরে বাহিরে দু’টো দিকেই সামলাতে জানে।আপনি জানেন মেয়েরা ডাক্তার,পুলিশ,উকালতি থেকে শুরু করে সব কিছুতেই এগিয়ে যাচ্ছে।নারী কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই।
ওহ তা পুরুষের মতোই চালচলন করলেই কি মেয়ে মানুষ,পুরুষ মানুষ হয়ে যায়?তাদের মতোই চলার এত শখ?শোনো বউ,মাইয়া মানুষ হইছে ননীর পুতুল।তারে যে পাত্রের রাখব।সেই পাত্রের আকারে সে ধারণ করব।
আর মাইয়া মানুষের যে পর্দায় রাখতে হয় তা কি ভুইলা গেছো?
৭৮.
না,মামী।আমি আমার মেয়ে এবং ছেলেকে ইসলামের ধর্মীয় শিক্ষায় নিয়োজিত রেখেছি। মেয়েকে পর্দায় রাখার জন্য একটু একটু করে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।তারা পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।তাদের আরবি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।তার পাশাপাশি বাংলা….!
হইছে থামোও তুমি।পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের পাশাপাশি আরবি পড়াইছো।এর বাহিরে তুমি কি করছো?একটা সন্তানকে তুমি মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণের জন্য দিয়েছো।সব দেখি দুনিয়ার আরাম আয়েসের জন্য দিয়েছো।দুনিয়ায় আনন্দ নিয়ে আছো।আখিরাত নিয়ে তোমাদের কোনো চিন্তাই নাই।যদি চিন্তা থাকত।তাইলে মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহনের জন্য পাঠাতে।যাও তো বউ।আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।তোমার কথা শুনলে মাথা গরম হইয়া যায়।
যাচ্ছি মামী মা।তবে যাওয়ার আগে একটা শেষ কথা ব’লে যাই।আমার কোলে এই সন্তানকে কিন্তু আমি এবং আমার স্বামী মাদ্রাসায় পড়ানোর অনেক ইচ্ছা আছে।
তাকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করব।
আরেকটা কথা।যেটা আমি এবং আমার স্বামী ছাড়া কেউ জানে না।
আমরা পুতুলের বেলায় সর্ব প্রথম চেষ্টা করেছিলাম।গণ শিক্ষায়।যার মাধ্যমে হাফেজি পাস করে বের হবে।কিন্তু তার কথা বলতে না পারার জন্য সব জায়গায় থেকে খালি হাতে ফিরেছিলাম।সর্বশেষ আশার হাতছানি পাই তালেপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।তা-ই মেয়ের ভবিষ্যতে কথা চিন্তা করেই সেখানেই পড়তে দেওয়া হয়।
তাকে কিন্তু মেয়ে ব’লে কিংবা তার কথা বলতে না পারার জন্য দূর ছাই করিনি।আর তার পোশাক বেশ মার্জিত।সালোয়ার,কামিজ,কেচি বেল্ট এবং মাথায় হিজাব পরিধান করে স্কুলে যায়।কয়েকদিন থাকলেই দেখতে পারবেন।তার পোশাকে কোনো অশালীন কিছু নেই।
একইভাবে বাকি দুই ছেলেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় দিতে চেয়েছি।কিন্তু তাদের ইচ্ছে ছিলো বোনের কাছাকাছি থাকা।তা-ই তোও শত চেষ্টা করে ওহ দুই ছেলেকে মাদ্রাসা পড়াতে পারিনি।তাই ছোট ছেলের সাড়ে তিন বছর বয়সে সাধারণত মসজিদ ও মাদ্রাসা ভিত্তিক করে দিব।
মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তর মক্তব,নূরানি বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা নামে অভিহিত।ফোরকানিয়া শব্দের মূল ফুরকান যার অর্থ বিশিষ্ট।মিথ্যা থেকে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক করে বলে পবিত্র কুরআন-এর আরেক নাম আল ফুরকান।প্রাথমিক স্তরের যেসব মাদ্রাসায় কুরআন পাঠ ও আবৃত্তি শেখানো হয় সেগুলিকে বলা হয় দর্সে কুরআন।সাধারণত স্থানীয় কোন মসজিদেই আশেপাশের পরিবারের ছোটদের প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়।মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনরাই সাধারণত এর শিক্ষক বা উস্তাদ হন।
৭৯.
রেনু কথা শেষ করে।ছোট ছেলেকে নিয়ে পুতুলের ঘরে ঢুকেন।মেয়েটা জ্বরে ঘোরে কেমন নেতিয়ে পড়েছে।এই মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত।স্বামী বাড়িতে আসলেই তাকে আরেকবার বলবেন গঞ্জের ডাক্তার দেখিয়ে আনতে।
লুঙ্গি ধরে দুই ভাই খাটে বসে আছে।একটু পর পর নিজেদের দিকে নিজেরাই তাকায়।পরশু নানু বাড়ির লোকেরা এসেছে।তাদের সাথে সবাই দেখা করে গেছে।হাতে ও বেশ কচকচে দশ-টাকা,বিশ টাকা নোট গুছে দিয়েছেন।টাকা গুলো দুইজনের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে।তাদের সমবয়সী কিছু ছোট বাচ্চাদের দিকে টাকা ছুঁড়ে মারতে মারতে বলল,
এই নে টাকা।এই তুই নে।এই নে।তোরা চকলেট কিনে খাইস।তুই বরফি খাইস।তুই জুস খাইস।এমন করে সবার মাঝে টাকা ছুঁড়ে মারতে লাগল।সবাই যখন নতুন কচকচে টাকাগুলো মাটি থেকে তুলে হাতে নিতে গেলো।তখনই মিলন,সাজু ওদের হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিলো।দরজার সামনে মানকিং সাহেব চোখের পলক একটু পর পর ফেলে তাকিয়ে আছে।আর বাকিরা হা করে তাকাতেই মিলন,সাজু লুঙ্গি ধরে খাটে বসে বলল,
ওই তাকাইয়া আছস কেন?কি কবি ক?তোরা কইলে আমি কমু হ।
মিলন,সাজুর কমকান্ডে কুত্তা কেউ কেউ করে উঠে।
আজ বারে শুক্রবার ছিল।এই জুম্মা দিনেই তাদের সুন্নাতখানা কাজ করে।দুই ভাই গোসল সেরে যোহরে নামাজ পরে আসতেই আসল কাজটা করে ফেলে।সাজ্জাদ মামা,এবং আব্বা দুই ভাইয়ের চোখ হাত দিয়ে ধরতেই কেমন যেনো ব্যাথা পায়।কান্না করে উঠতেই দেখে তাদের কাম সাইরা লাইছে।দুই ভাইয়ের চিতকার চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে।তাদের কান্না থামানোর সাধ্য কারো হয়নি।নানা,নানু এবং বাকিদের মিষ্টি মিষ্টি কথায় কান্না বন্ধ হয়নি।দুইজনের হাতে টাকা দিতেই ঠান্ডা হয়।এবং কান্না আস্তে আস্তে বন্ধ হয়েছে।
৮০.
পুতুল বিছানা ছেড়ে আছরের নামাজটুকুও পড়ে নিয়েছে।জ্বরটা কেমন ছেড়ে দেয় আবার বেড়ে যায়।শরীর প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।মুখটা তিতো হয়ে আছে।পেটে কিছু রাখাটা কষ্ট কর।যাকিছু খাচ্ছে সব বমি করে ফেলে দিচ্ছে।বাড়িতে মেহমান আসছে।তাদের কাছে অবতী যাবে সেই ক্ষমতাটুকু নেই।ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকতেই।দুই ভাই মামার রুম থেকে ডেকে উঠে।
ওই আপু।তুমি কই?এখানে আসো।আমায় নিয়ে যা-ও।আমি যাব তোমার কাছে।
মিলনের ডাক শুনে।পুতুল আসছি টুকু উচ্চস্বরে বলবে সেই সাহস টুকু হচ্ছে না।পুতুলের থেকে সাড়া না পেয়ে মিলন ঠোঁট উল্টে খাটে গাল ফুলিয়ে বসে রয়।স্বাধীন আছরের নামাজ পড়ে বাসায় এসেছে।
শুনছেন।আপনি পুতুলকে নিয়ে একটু ডাক্তার কাছে যাবেন।মেয়েটার গায়ের জ্বর কমছে আবার বাড়ছে।ঠিক মতো খাবরটুকু খাবে সেই অবস্থা নেই।পেটে কিছুই রাখতে পারছে না।স্বাধীন মাথার টুপিটা খুলে পুতুলের রুমে পা দেওয়ার আগেই দরজার বাহিরে দাড়িয়ে কাশির মতো শব্দ করে রুমে পা দেয়।মামার গলা পেতেই পুতুল নিচু মাথা উপরে তোলে।
মামা কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা বোঝা চেষ্টা করেন।দেখেন জ্বরটা আবার বাড়ছে।অথচ যোহরে সময় কিছুটা কমেছিল।
আম্মা চলেন!ডাক্তার দেখাবো।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল।যার মানে সে যেতে চায় না।তার ভালো লাগছে না।স্বাধীন পুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে রুম থেকে চলে যায়।মামা চলে যেতেই টুপ করে চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝড়ে পড়ে।গায়ে নকশিকাঁথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।ঘুমানোর চেষ্টা করে।যদি ঘুমিয়ে চায় তাহলে হয়ত জ্বরটা তাকে কাবু করতে পারবে না।পুতুল ঘুমের চেষ্টা করে।
চোখ মেলে তাকাতেই দেখে মামা তার মাথার সামনে বসে আছে।মাথায় হাত দিতেই দেখতে পায় জল পট্রি মাথায়।তার পাশেই ডাক্তার বসে আছেন।ডাক্তার কি সব যেন মামাকে বলছে?পুতুলের সেইসবে মনযোগ নেই।শরীরটা কেমন হালকা লাগছে।আর গা দেখে মনে হচ্ছে ঘাম দিচ্ছে।নকশিকাঁথা সামনের হালকা অংশ ঘাম লেগে ভিজে আছে।পুতুল উঠার চেষ্টা করলেই মামা নিষেধ করেন।ডাক্তার সাথে মামা বের হয়ে যেতেই একটুও পর মামী রুমে ঢুকেন।ভিজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দেন।আর গায়ে কাপড়টা পাল্টে নিতে বলল।
চলবে….