চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-০১

0
580

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#সূচনা_পর্ব

১.
আট’মাসের অন্তসত্বা রাজিয়া তার ছ’বছরের পুতুল মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাইয়ের ভিটায়!গায়ে তার কালচে মারের দাগ।বাবা’র অমত থাকা শর্তে ও ভালোবাসার টানে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল।বাবা মানতে পারেনি।একমাএ মেয়ে”র এমন কাজে মনে খুব আঘাত পান।এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন।মৃত্যুর আগে বিয়েটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে ত্যাজ্য করে যান মেয়েকে।বিয়ে”র কয়েক মাস ঘুরতে না ঘুরতেই জামাই জুয়াড়ি,নেশাখোর জানতে পারে রাজিয়া।তবুও ভালোবেসে ফিরাতে চায় মোস্তফা সরোয়ার কে।কিন্তু সে ভালো পথে ফিরেনি।উল্টো বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে যতটুকু গহনা পেয়েছিল।সে সব গহনা জুয়ায় গো হারা হেরেছে।

আর বেশ কয়েকদিন ধরে বাপের বাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইতে বলে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।রাজিয়া বাপের বাড়ি এককানা কড়ি আনতে পারবে না।মোস্তফা সরোয়ার মুখের ওপর সরাসরি না করে দেয়।যার স্বরূপ তার শরীরে এমন বিবস্ত্র দাগ।ছোট্র পুতুলের সামনে যখন তার বাবা মায়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।তখন ছোট পুতুল ভয়ে কাঁপতে থাকে।লুকিয়ে থাকে খাটের তলায় কিংবা ঘরের এক কোণে।মায়ের গায়ে মা”রের দাগের স্বাক্ষীয় সে নিজেও বেশ কয়েক বার হ’য়েছে।সে মুখে বলতে পারেনি।

-; আমার মা’কে মেরো না বাবা।কারণ,সে ছোট ভিতু প্রাণী।সে শুনতে পারে।কিন্তু মুখে বলতে পারে না।সে বাকপ্রতিবন্ধী।চোখে দেখতে পায় এবং শুনতে পায়।
কিন্তু বলতে পারে না।আজ যখন বাবা মা”কে মেরে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলোও।তখন সে নিশ্চুপ মূর্তি।চোখ দু”টো ছলছল করে উঠে।মায়ের ছে”ড়া শাড়ির কোনা খামচে ধরে টেনে বাহিরে চলে আসার পথেই বাপের বিটায় একদলা থু*থু ফেলে পুতুল।আর জীবনেও আসবেনা সরোয়ার পরিবারে কাছে।পুতুলের ব্যবহার দেখে সরোয়ারে মা নাসিমা বানু তেলে বেগুনের মতো জ্বলে উঠে।দৌড়ে আসে ছেলের কাছে বউ আর নাতির নামে কা”নে বি*ষ ঢালতে।

-;দেখছিস বাঁজান।কত বড় বেয়াদব ছেমরি।দে দে আর দুই খান লাগা ওর গালে।মা যেমন ছি”লান।তার ঘরেও হয়েছে ছি”লানের জি।লাথি মাইরা বাহির কর বা”ন্দির বাচ্চারে।আমি তোরে আবার বিয়া করামু বাজান।সুন্দর লাহান পরি আনমু।সাথে মোটা অঙ্কের যৌতুকের টাকা আরও ঘরের জিনিস আইবো।তুই যদি এই প্রেমের বিয়া না করতিস।তাহলে আজ তোর কপাল সোনার কপাল থাকতোও।পায়ের ওপর পা তুলে তুই রাজ করতিস।এহন বুঝ কেমন লাগে?তার ওপর মাইয়া হওয়াছে মা*গিতে।তোর র*ক্ত চুইসা খাও নের লাইগা।দেখ পেটের”টা ও আবার মাইয়া হইবো।এইটার মতো বোবা,লেংঙরা,কু’রা হইবো।এই মাইয়া জীবনে বিয়া দিতে পারতি না।কেডা করবে ওরে বিয়া।বোবা মাইয়া কে নিবো ঘারে।তাই কইতাছি বিদায় কর।এগুলোরারে জলতি বাহির কর।আমি তোরে আবার বিয়া দিমু বাপ।

-;আম্মা আপনি এসব কি বলেন?আল্লাহ”র দোয়াই লাগে আপনি চুপ করেন।আপনার কারণে আমি সরোয়ার পরিবারের শত লাঞ্ছনা,কুঞ্জনা সয্যে করে পড়ে ছিলাম।স্বামীর সাথে সংসার করব ব”লে!বাপের বাড়ি ছেড়ে আপনার ছেলে হাত ধরে পালিয়ে আসছি।এখন আপনি বলছেন বের করে দিতে।বের হয়ে কোথায় যাবোও আম্মা?আমার যে আর যাওয়ার জায়গায় নাই।বাপ,ভাইয়ের মুখে চুলকালি মাইখা হাত ধরেছিলাম তার।আর কথায় কথায় আমার মেয়ে কে গালাগালি দেওয়া বন্ধ করুন।

আমাকে যা বলার বলুন।আমার মেয়ে কে এর মধ্যে কেনোও টানছেন।মেয়েরা বাবাদের ঘারে বোঝা হয়না আম্মা।বারবার কেনো ভুলে যান আপনারা।ওর শরীরে কিন্তু আপনাদের রক্ত বইছে।সে সরোয়ার বংশের মেয়ে।মেয়ে”কে মানুষ মতো মানুষ করলে সে এই বংশের আলো বাতি হবে।তাকে নোংরা কথা বলে তার মন মানসিকতা নষ্ট করবেনা।
আর গর্ভের সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে সেটা নির্ধারণ করেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।তিনি খুশী হলে কন্যা সন্তান দান করেন।কিন্তু আপনাদের কন্যা সন্তান নিয়ে হায় হুদাস এর শেষ নেই।কেনোও আম্মা মেয়েরা কি মানুষ নয়!তাদের নিচু চোখে কেনো দেখেন?যেখানে আপনি নিজেও একজন মেয়ে।আমরা মেয়েরা মেয়েদের শএু হ’য়ে দাঁড়ায়।আপনার মতো কিছু শ্বাশুড়ি কারণে আজ মেয়েরা পরের বাড়িতে সুখে নেই।আপনি মেয়ে জাতির কলঙ্ক।

-;হায়,হায় আমার ঘরে কা”লনাগিনী আসছে।এই কালনাগিনী আমার সব শেষ করে দিবে।আমার ছেলের সামনে,ছেলের বউ আমারে অপমান করছে।আর ছেলে দাঁড়ায় দাঁড়ায় সব দেখতাছে।আমার এখন নদীতে ডুইবা মরা উচিত।ছেলে বউ পাগল হয়ে গেছে।এহন আর মায়ের দরকার কি?আজ এর একটা বিহিত হওন লাগব।এর বিহিত না করলে কিন্তু গলায় ভরা কলসি লাগিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিমু আমি।

মায়ের উস্কানিমূলক কথায় রেগে চিতকার করে লাকড়ি কাটারি ঘর থেকে লাকড়ি নিয়ে মারতে আসে।মায়ের সামনেই বউয়ের গায়ে হাত তুলে।রাজিয়া ব্যাথা সয্য করতে না পেরে মোস্তফার পায়ে ওপর পড়ে।কিন্তু মোস্তফা থামেনি।উল্টো বলল,

-;আজকেই তোরে তালাক দিমু।তুই আমার সামনে আমার মায়েরে কথা শুনাস।এক তালাক,দুই তালাক,তিন তালাক বলেই মোস্তফা বাসা থেকে বের হয়ে যায়।মোস্তফা মুখে তালাক দিতেই রাজিয়া আল্লাহ গোও ব’লে ওখানেই বেহুস হয়ে যায়।আর নাসিমা ছেলের কাজে আড়ালেই মুচকি হাসে।

চোখে,মুখে পানি পেতেই চোখ খুলে রাজিয়া।পুতুল কাঁদছে।মা মা ব’লে হাত বুলিয়ে ডাকার আকুতি তার চোখে।শরীরের শক্তি নেই।ব্যাথা শরীরের মেয়ে কে বুকে টেনে শান্ত করতে লাগল।মা,মেয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল।তাদের জীবনের পরিহাস দেখে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চল,কতক্ষণ বেহুস পড়ে ছিল রাজিয়া জানা নেই।তবে যোহর আজান পড়তেই মাথায় কাপড় টানে।মুখে বুলি আওড়ায়,

-;এতক্ষণ বেহুস হ’য়ে পড়ে আছি মাটিতে।আর আম্মা সেটা দেখেও আমাকে আর আমার মেয়েকে একটু ঘরে নিলোও না।আম্মা এত নিষ্ঠুর কেনো?তাদের মনে কি কোনো দয়া,মায়া নাই।যৌতুকের টাকাই কি তাদের কাছে সব?কিছু সময় চুপচাপ থাকার পড়।আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।নিজের গায়ের কাপড়টা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে মেয়ের এক হাত ধরে বলল,

-;চল পুতুল।

ছোট্ট পুতুল মায়ের কথায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।মেয়ের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে একটু ঝুঁকে নিচু হয়ে বল,

-;তোর বাপ আমারে তালাক দিছে।এরপর কেমন থাকুম তার সংসারে?তুই ক?আমি তো এখন পরগাছা।এত ভালোবাসার প্রতিদান আজ বুঝি পাইলাম।বাপ,ভাইয়ের মনে কষ্ট দিচ্ছিলাম না।তার ফল আমি পাইছি।চল,এখান থেকে চইলা যাই।তোরে রাইখা গেলে মা*ইরা ফেলাইব এরা।আমি বাঁইচা থাকতে তোরে এহেনে রাইখা যামু না।মা রারি হয়েছি তো কি হইছে?তুই আমার কলিজা মধ্যে থাকবি।আমি তো মা,চাইলেও তোরে ফালাইয়া দিতে পারুম না।এই আল্লাহ দুনিয়ায় কোথাও না কোথাও ঠিক ঠাঁই হইবো,আমগো মা,বেটির।

২.
তুই,তুই এখানে কোন সাহসে আইছোস?বাপ,ভাইয়ের মুখে চুলকানি মাইখা ছাইড়া তোও চইলা গেছিলি।তাহলে আবার কেন আমার দুয়ার আইসা খাঁড়াইছোদ?

-;ওহ ভাইজান আমরে একটু জায়গায় দেও।তুমি ছাড়া এখন আমার যাওয়ার কোনো জায়গায় নাই।সরোয়ার আমারে তালাক দিছে।আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাব?একটু দয়া কর।

-;দয়া করব তোকে।কেন করমু দয়া?তুই তোও আমাদের জন্য একটু দয়া করিস নিই।তোর জন্য আমার মুখের হাসিটা চলে গেছে। তোর জন্য আমি এতিম হইছি।তাই এখানে তোর কোনো জায়গায় হবেনা।তুই এখনই বাইর হইয়া যা আমার বাড়ি থেইকা।তোর এই মুখ আমি দেখতে চাইনা।তোর জন্য আমি বাপ ছাড়া।তোর জন্য আব্বা কষ্ট পাইতে পাইতে মইরা গেলো।আমার হাতে ওপর আব্বা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে।

ভাইয়ের কথা রাজিয়া চমকে উঠে।

-;আব্বা… আব্বা মইরা গেছে মানে?ওহ আল্লাহ এটা তুমি কি কও ভাইজান?এত বড় মিথ্যে কথা বইলো না।তুমি…তুমি আব্বারে ডাক দেও।আমি তার সাথে কথা বলমু।একটিবার তারে ডাক দেও।আব্বা ডাক শুনি না কত বছর হয়ে গেছে।আব্বা,আব্বা আপনি কই?ঘর থেকে বাইরে আসেন।আমি আপনার রাজিয়া।দেইখা যান আমি আইছি আব্বা যান।আমি আইছি।রাজিয়া কান্নায় স্বাধীন মন গলে না।

রাজিয়া উচ্চস্বরে ডাকে ভেতর থেকে স্বাধীন বউ রেণু বের হয়ে আসে।রাজিয়াকে চিন্তে না পারায় দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়।

-;চিতকার কইরা লাভ নাই।এখন কান্দিস ক্যান?তোর জন্য আমি আমার আব্বারে হারাইছি।কেন চইলা গেলি বোন?ঐ জুয়ারি সব খবর আব্বা জানত।আর জানত বইলা তার হাতে তোরে তুইলা দিতে চায় নাই।তোর লাইগা ভালো সমন্ধো ঠিক করা রাখছিলো অন্য ছেলের সাথে।কিন্তু তুই তার প্রেমে অন্ধ হয়ে তারে নিয়ে ভাইগা গেলি।একটিবার পিছনে ফিরে আব্বা মুখটা যদি দেখতি।তাহলে বুঝতি একমাত্র কন্যার শোকে বিছানায় পড়েন আব্বা।আমার আব্বা মেয়ের এমন কাজে কষ্টে মরে যান।আমি পারি নাই তারে বাঁচাইতে।গ্রামের মানুষ অনেক কথা শুনাইছে বাড়ি বয়ে এসে।এসব আব্বা নিতে পারে নাই।বুকের ব্যাথা বুকে লইয়া ঘরে বইসা থাকতো।তুই চলে যাওয়ার তিন দিন পর-ই তার মৃত্যু হয়।সদরের হাসপাতালে আর নিতে পারি নাই।বাড়িতে তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।আমি ভুলি নাই আব্বা কথা।তাই তোরে
আমি এই বাড়িতে জায়গায় দিমু না।তোর জন্য এই বাড়ির দরজা বন্ধ।তুই তোর পথ আগেই বেছে নিয়েছিস।স্বাধীন,বউ,বাচ্চা নিয়ে ঘরে ঢুকেই বোনের মুখের ওপর ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে দেয়।ছোট পুতুল মায়ের আহাজারি দেখে নিজে ওহ কেঁদে ওঠে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে