#ঘরকন্না
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০৮(অন্তিমপর্ব)
আবিরের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বলে উঠলাম,” আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখি? আপনাকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কেমন সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে এখনই ঘুম ভেঙে যাবে আর স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। আপনাকে প্লিজ একটু ছুঁয়ে দেখি?
আমার কথায় মুচকি হাসে আবির। এক ঝটকায় আমাকে বুকে টেনে নেয়। আলতো করে জড়িয়ে নেয় আমাকে। যে নারী নিজের পুরুষের বুকে মাথা ঠাই পায় সে নারী ভাগ্যবতী হয়। মা হারানোর পর নিজেকে কখনো ভাগ্যবতী মনে হয়নি আজ আবার নতুন করে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।
উনার বুকে মাথা রেখে চুপচাপ চোখবন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে তিনি বলে উঠলেন,” অনু, নিচে যাবে না?”
মাথা না তুলেই নরম-স্বরে বললাম,” হুম। আরেকটু এভাবে থাকি। ”
” এই তোমার লজ্জা লাগছে না আজকেই যাকে দেখলে তাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে?”
” আমার বর আমি জড়িয়ে ধরে রাখব তাতে কার কী সমস্যা? আপনার সমস্যা হলেও আমি সেটা দেখব না।”
” আচ্ছা তাই?”
” জি।”
হঠাৎ উনার বুক থেকে মাথা তুলে বললাম,” আমাকে সকালে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেন বলুন তো?”
আবির হাসতে হাসতে বলে ওঠে,” সেটা জানার জন্য রুমে যেতে হবে। আমার সুন্দরী বউকে আলোতে একটু দেখার জন্য মনটা আনচান করছে।”
” দুই বছর খুব কম সময় না৷ বিয়ে করে বউয়ের টানে এতদিন আসেননি আমিও এখন তাড়াতাড়ি রুমে যাব না।”
” যাবে না?”
” উহু যাব না।”
” সত্যিই যাবে না?”
” আপনাকে মিথ্যে বলতে যাব কেন? এতদিন এই আমার মায়ায় আসেননি আজ ভালোবাসা উথলে পড়ছে। সারাদিন কান্না করিয়ে এখন এসেছেন প্রেম দেখাতে।”
” আমার অনুর কি রাগ হয়ে গেল?” বলেই পাজাকোলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগুতে লাগলো আবির। আমি ভয়ে শক্ত করে দুইহাত দিয়ে তাকে ধরে রইলাম। আবির ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে এলো। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “চোখ বন্ধ করো।”
” কেন?”
” সারপ্রাইজ আছে।”
” কী সারপ্রাইজ? ”
” আরে আমাদের বাসরঘর, হয়েছে? এবার চোখ বন্ধ করো।”
” ঘর সাজানো হয়েছে!”
” বন্ধ করবে তুমি?”
” আচ্ছা করছি। ”
” আমি যখন চোখ খুলতে বলব তখন খুলবে, এর আগে চোখ খোলা যাবে না ঠিক আছে?”
” আচ্ছা।”
আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। আবির আমাকে কোলে নিয়েই একহাত দিয়ে দরজাটা খুলল। দরজা বাম-বাহু দিয়ে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল সে৷ আমি যতটুকু বুঝলাম ঘরটা তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফুলের গন্ধে পাচ্ছিলাম।
আবির আমাকে আস্তে করে মেঝেতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,” এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।”
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কান সজাগ থাকায় বুঝতে পারলাম আবির আলমারি খুলে মুহুর্তের মধ্যেই আবার বন্ধ করল।
” তুমি কি আজীবনের জন্য আমার হবে? তুমি শুধু আমাকে একটু ভালোবেসো আমি পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ তোমার করে দেওয়ার চেষ্টা করব। শুধু আমার জীবনের সবটা জুড়ে থেকে যাও। তুমি আমার ব্যক্তিগত মানুষটা হয়ে যাও যার অনুপস্থিতিতে সবকিছু শূণ্য শূন্য লাগবে। যার কষ্টে আমার দমবন্ধ হয়ে আসবে। যার মুখ আমার চোখ আর মন শীতল করবে। যার হাসি আমার হৃদয়ে বারবার প্রতিধ্বনিত হবে। যাকে ছাড়া আমার সবকিছু বিষাদের নীলরঙে ডুবে যাবে।”
আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখতে পেলাম আবির মেঝেতে হাটুগেড়ে বসে আছে। হাতে একটা রিং আমার দিকে বাড়িয়ে রেখেছে।
” ভালোবাসি তোমাকে অনু।”
” আমি একটুও ভালোবাসি না।”
” না ভালোবাসো, অন্যকারো না হলেই হবে।”
মুচকি হেসে নিজের হাত তার দিকে এগিয়ে দিতেই রিং’টা পরিয়ে দিল।
উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো৷ বাচ্চাদের মতো আবদারের সুরে বলল,” আরেকবার জড়িয়ে ধরি বউ?”
” নাহ, দূরে থাকুন।”
” ওসব ভুলে যাও।” বলেই হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়িয়ে আরও একবার বুকে স্থান দিল সে৷
রাত বারোটা-
আবির দেশে আসার সময় আমার জন্য কি কি এনেছে সেসব দেখাচ্ছিল। সমস্ত রুম ফুলের গন্ধে যেন ডুবে আছে। আমার জন্য আনা জিনিসপত্র দেখছিলাম আর রুমটা বারবার এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। সকালে যেমন দেখেছিলাম সেরকম কিছুই নেই।
আবির বলে উঠল,” পছন্দ হয়েছে এসব? মাসখানেক আগে থেকে একটু একটু করে কেনাকাটা করেছি আমি আমার বউয়ের জন্য।”
আমি সবগুলো জিনিসের ওপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে বললাম,” আপনার পছন্দকে অপছন্দ করার কোন সাহস আমার নেই। এখানকার সবকিছু সুন্দর।”
হঠাৎ আমার সন্ধ্যার সেই পার্সেলের কথা মনে পড়ল।
আবিরকে জানানো উচিৎ বলে মনে হলো। বলে উঠলাম,” আজ সন্ধ্যায় আমার নামে একটা পার্সেল এসেছিল। ইয়া বড় একটা লাগেজ ব্যাগ। যা যা সেখানে আছে, সবগুলো দেখলেই মনে হবে বিয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। কে পাঠিয়েছে কিছুতে জানতে পারিনি আমি। প্রথমে মনে হয়েছিল এখান থেকে পাঠানো হয়েছে।”
আবির হো হো করে হেসে উঠল। সে বলল,” এতক্ষণেও বুঝতে পারোনি ওগুলো কে পাঠিয়েছে?”
আবিরের হাসিতে কেমন যেন সন্দেহ হলো তাকে জিজ্ঞেস করলাম,” আপনি পাঠিয়েছেন? কীভাবে পাঠালেন?”
” আমি ওগুলো পাঠাইনি।”
” তবে?”
” আম্মা আর নিশু পাঠিয়েছে।”
” মানে?”
” মানে প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল বড় করে একটা অনুষ্ঠান করে তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হবে। তার কন্য প্রায় অনেকদিনই সময় লাগত। তাই আম্মাকে নিষেধ করেছি কিন্তু আম্মা ওগুলো কিনেই তোমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।”
” আমার কেমন বিশ্বাস হচ্ছে না এসব। এতকিছু আমার জন্য কেন?”
” কারণ আমার বউকে এরকম করে কেউ কখনো ভয় পাইয়ে দেয়নি।”
” কিন্তু আম্মা তো আমাকে অপছন্দ করে। আপনার জন্যই হয়তো জোর করে মেনে নিয়েছেন। ”
” কীভাবে বুঝলে?”
” সকালে যখন আম্মার জন্য চা নিয়ে যাই তখন শুনেছিলাম আম্মার আর নিশিতা কথা বলছিল আমাকে নিয়ে।”
” তোমাকে পছন্দ করে না এসব?”
” হ্যাঁ আপনি কীভাবে জানলেন? এসবও প্ল্যান করা ছিল?”
আবির মুচকি হেসে বলল,” হ্যাঁ, সব প্ল্যান করা৷ তুমি আমাকে কতটুকু চাও, আমাকে পেতে কী কী করতে পারো সেটা দেখার ইচ্ছে ছিল।”
” মানে আম্মা আমাকে অপছন্দ করে না? নিশিতাও না?”
” কেউই তোমাকে অপছন্দ করে না অনু। সবাই তোমাকে ভালোবাসে।”
” কিন্তু সন্ধ্যার ডিভোর্সের কথাটা?”
” তুমি যেন আমাকে টাকার বিনিময়ে ছাড়তে রাজি হও কি না সেটা দেখতে। জানো তো একবার একজনকে হারিয়ে আমি একেবারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। এবার আর তোমাকে হারাতে চাই না।”
” বিশ্বাস করতে এত পরিক্ষা? আমি কি পাশ করেছি?”
” তুমি আমার মন জিতে নিয়েছ।”
” ভালোবাসলে বিশ্বাসটা রাখতে হয়।”
” আমি দেখতে চেয়েছিলাম সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আমাকে চাও কি না।”
” আপনাকেই চাই। আমি একটা ঘর চাই, সংসার চাই, সবার সাথে একটু ভালো থাকতে চাই। এই ছেড়ে যাওয়ার যুগে আমি আপনার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে চাই আবির।”
” তোমার বাবা? ”
” আমার বাবা-মা নেই।”
” তুমি যেমন আমাকে চাও, সংসার চাও তেমন তোমার বাবাও তার মেয়েটাকে একটু চোখের দেখা দেখতে চায়। মানুষকে ক্ষমা করে দিতে হয় অনু আর উনি তো তোমার বাবা। আগামীকাল বিকেলে আমরা তোমার বাবাকে দেখতে যাব।”
” কিন্তু…”
” কোন কিন্তু নয়। ”
” আপনি জানলেন কীভাবে?”
” সেটা তোমার জানতে হবে না। আগামীকাল আমরা ওখানে যাচ্ছি। এটাই ফাইনাল।”
আমি সবকিছু সাইডে ফেলে বললাম,” আমার সংসারটা টিকল তবে? সারাদিনে কত চিন্তায় ছিলাম সংসার ভাঙার ভয়ে কত কান্না করেছি জানেন? এরকম আর কখনো করবেন না প্লিজ। আমি এসব আর সহ্য করতে পারব না। মাকে হারানোর পর আমি আর ভালো কিছু পাইনি আবির৷ আমার সংসারটা আমার কাছে থেকে কখনো কেড়ে নিবেন না। আমি এখানেই আমার জনম কাটিয়ে দিতে চাই।”
” ভালোবাসো আমাকে? আমাকে তোমার হৃদয়ে রাখবে আজীবন?
আবিরের কথায় মুচকি হেসে গেয়ে উঠলাম,” আমার ভেতরও বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে….”
আবির জানিয়ে দিল আজ থেকে সে আমার। আর কোন হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই৷ এই সংসার আমার, শুধুমাত্র আমার। সংসারের মানুষগুলোকে ভালোবাসা আর কর্তব্যে ভালো রাখার দায়িত্বটাও আমার। এই সংসার আমার সুখ, আমার শান্তি৷ এই মানুষটা ব্যক্তিগতভাবেই আমার। আমাদের মৃত্যু ছাড়া যেন আমরা কখনো আলাদা না হই, আমাদের ভালোবাসা আজীবন বেঁচে থাকুক। আমার ভালো থাকা এই মানুষগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠুক। এই মানুষটার দিক থেকে আমার আঁখি না ফিরুক। এই মানুষটা আজীবন আমাকেই ভালোবাসুক।
~ সমাপ্ত।