ঘরকন্না পর্ব-০৬

0
867

#ঘরকন্না
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০৬

মামা প্রায় আধাঘণ্টা যাবৎ আমাকে আর মামিকে রুমে থাকতে বলে বাহিরে গিয়ে আমার শাশুড়ির সাথে কথা বলছে। এতক্ষণ সময় নিয়ে কী কথা বলছে সেটাই আমরা বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু বুঝতে পারছি না।

মামি মামার এত কথা বলা দেখে বলে উঠল,” আমার মনে হয় তোর আজকেই ও বাড়িতে চলে যাওয়া উচিৎ৷ বিষয়টা গরম গরম থাকতেই গিয়ে ওঠা উচিৎ । ”
” আজই যাব? রাত হয়ে গেছে তো।”
” কত রাত হয়েছে? কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হয়েছে। আবিরকে তোর দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না? দুই বছর পর স্বামী এসেছে দেখবি না?”
” কিন্তু মামি….”
” কোন কিন্তু না। তুই যা তৈরি হয়ে নে। আমি দেখছি তোর মামাকে গিয়ে জানাই। বাইকে করে রেখে আসবে।”

মামির কথা শুনে মনে হলো আমার সত্যি সত্যি আজই যাওয়া উচিৎ। আমি যদি ওখানে উপস্থিত না থাকি তাহলে আমার অনুপস্থিতিতে যা খুশি হয়ে যেতে পারে। মামা বাহিরে থেকে আমার রুমে এসে মামা বললেন,” তুই কি ও বাড়িতে যেতে চাচ্ছিস?”
” মামা, আমি এখনই যেতে চাচ্ছি।”
” এখন!”

মামি পাশে থেকে বলে উঠলো,” হ্যাঁ, মেয়ে যেতে চাইছে দিয়ে এসো। ”

মামা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,” আচ্ছা রেডি হয়ে নে।”

মামা নিজের রুমে চলে গেলে মামি আমার আলমারি খুলে লাল টকটকা একটা শাড়ি বের করে দিয়ে বলে,” এটা পরে যা। লালশাড়িতে মেয়েদের অদ্ভুত সুন্দর লাগে। লালশাড়ি, চুল ছেড়ে, চোখে কাজল আর ঠোঁটে একটু লাল লিপস্টিক- একটা পুরুষকে কাবু করতে যথেষ্ট। মাথাটা ভালো করে চিরুনি করে নে৷ লাল ব্লাউজটা শাড়ির ওখানেই দেখলাম হয়তো দাঁড়া দিচ্ছি।”

মামি আলমারির ড্রয়ার থেকে ব্লাউজ পেটিকোট বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,” আমি তোর মামার সাথে কথা বলছি, ততক্ষণে তুই তৈরি হয়ে নে।”

আমি মামির হাত থেকে ওগুলো নিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। মামি আমার গালে হাত দিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে চলে গেলেন৷ এই মানুষটা এত পরিবর্তন কীভাবে হয়ে গেল সেটাই বুঝতে পারছি না।

মামির কোন ছেলে-মেয়ে নেই। একদমই ছিল না এমনটা না। মামা মূলত আমার দেখাশোনা করার জন্যই তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছিলেন। প্রথমদিকে আমাকে খুব ভালোবাসলেও পরে কেন জানি না মামির মন বি*ষিয়ে গিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে ভালোবাসলেও বাহিরে বাহিরে সেটা বুঝতে দিত না। সবসময় খারাপ ব্যবহার করত আমি তবুও তার পিছু ছাড়িনি কখনো। মামির বিয়ের তিন বছরের মাথায় প্রথম ছেলে হয়েছিল। মাম-মামি কি খুশি ছিল! সেই খুশি বেশিদিন টিকে নি। বিশ দিনের মাথায় বাচ্চাটা কী যেন হয়ে মা*রা গিয়েছিল। সবাই খুব ভেঙে পড়েছিল। তারপর মামি আরও তিনবার মা হয়েছিলেন কিন্তু সন্তানকে ধরে রাখতে পারেন নি। সৃষ্টিকর্তা মামির কোল খালি করে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে গেছেন৷ এরপর থেকে মামি আর সন্তানসুখ পান নি।

আমি শাড়ি পরে কুচিগুলো ঠিক করতে না পেরে মামিকে ডাক দেওয়ার সাথে সাথে মামি আমার রুমের দরজায় এসে বললেন,” কী হয়েছে?”

আমি ঠোঁট উলটে বললাম,” মামি, শাড়ির কুচি খুব জ্বালাচ্ছে, আমি ঠিক করতে পারছি না।”

মামি একগাল হেসে বলল,” আমি ঠিক করে দিচ্ছি।”
” তার জন্যই তো ডাকলাম।”
” বুঝেছি। আমাকে কি কেউ প্রয়োজন ছাড়া ডাকে নাকি?”
” না ডাকতেই যে চলে আসে তাকে আর কীভাবে ডাকব? কখন ডাকব? আজ তো কেউ আমাকে একা থাকতেই দেয়নি৷”
” আমার কি এখন চলে যাওয়া উচিৎ? ”
” মা কি মেয়ের ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে? যেখানে মেয়েটা জেদি, রাগী,একগুয়ে স্বভাবের?”
” আয় এদিকে আয় কুচি ঠিক করে দিই৷ শাড়িও তো ঠিক করে পরিসনি। আমি পরিয়ে দিচ্ছি।”
” আমি এত সেজেগুজে তো যাচ্ছি আমার সংসার টিকবে তো? আবির আমাকে মেনে নেবে তো?”
” আল্লাহ ভরসা। কোন চিন্তা করিস না। শুধু কোনকিছুতে হার মানবি না। তোর শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ, তখন তার ফোনকল আর কথাবার্তা আমার খুব আজব লেগেছে।”
” যে আমার সাথে যেমন করবে আমিও তার সাথে ঠিক সেরকমই করব মামি।”

মামি আমাকে পুরোপুরি তৈরি করে দিয়ে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো৷ পিছন থেকে আমার কাধে থুতনিতে ভর করে আয়নায় আমার দিকেই তাকিয়ে রইল।

” তোকে কী সুন্দর লাগছে দেখেছিস? বরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে মেয়েদের সেজে থাকতে হয়।”
” বুঝলাম।”

মামি এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,” আমি তোর মামাকে বের হতে বলছি। ”
” মামি ওই লাগেজটা ভালো করে রেখে দিয়েন। কে দিল সেটা তো জানতেই পারলাম না।”
” আচ্ছা রেখে দিব। ”
” আমি ভাবছি আবারও চোখের পানি ফেলে ফিরে আসতে হয় কি না।”
” আগেই এত নেতিবাচক কিছু ভাবিস না, যা ভালো মন নিয়ে।”
” হুম।”

মামি মামাকে ডাকতেই মামা বাহিরে গিয়ে নিজের বাইকটা বের করলেন। মামির থেকে বিদায় নিয়ে বের হব তখন মামি হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরলেন। আকস্মিকভাবে ঘটায় আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ এই মানুষটার এত ভালোবাসা, নিজেকে ধরা দেওয়া আমি কেমন মেনে নিতে পারছি না। এত শক্ত প্রকৃতির মানুষ কেন বারবার ভালোবাসা জাহির করছে! মামিকে বাসায় একা রেখেই আমার আর মামার রওয়ানা দিতে হলো। বাসায় ফিরে মামিকে কল করে জানাবো বলেই বিদায় নিলাম।

মামা বেশ দ্রুত গতিতে বাইক চালাচ্ছে। রাত হওয়ায় রাস্তাটা বেশ ফাঁকা। আমি মামার কাধে হাত রেখে চুপচাপ বসে আছি। নিজের স্বামীকে প্রথমবারের মতো সামনাসামনি দেখার জন্য একটা উত্তেজনা কাজ করছে। আমি যাওয়ার পর ও বাড়িতে কী হবে সেটাও বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি যে আমাকে নরম হওয়া যাবে না। বিয়ের আগেই মেয়েরা কিছু কিছু ছেলের ঘরে উঠে যায় বিয়ের জন্য আজ প্রয়োজনে স্বামীকে পেতে এমন কাজ করতে হবে। নিজেকে বারবার বুঝাচ্ছি ভেঙে পড়া যাবে না, শক্ত থাকতে হবে তবুও ভেতর থেকে একটা ভয় কাজ করছে।

আমাকে একদম চুপ থাকতে দেখে মামা বললেন,” ও বাড়িতে যেতে ভয় লাগছে?”
” হ্যাঁ মামা। আমার শাশুড়ীর সাথে তোমার কী কথা হলো তখন?”
” ওসব তোর শুনতে হবে না। তুই ওখানে গিয়ে আগেই কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করিস না, মা।”
” আমি আগে আগে কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করি না মামা।”
” কেউ কিছু বললেও আজ আর জবাব দিবি না। বাড়িতে যেয়ে শাশুড়ির কাছে খারাপ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইবি।”
” হুম। তখন হয়তো একটু বেশিই রাগ দেখানো হয়ে গেছে৷ আমি মাফ চেয়ে নেব সমস্যা নেই। তবে উনি যদি আবারও খারাপ ব্যবহার করে তাহলে আমি চুপ থাকব না।”
” একটু সহ্য করে নিস মা।”
” চেষ্টা করব মামা। তবে আমার ভয় লাগছে খুব। উনারা কি আমার সাথে ভালো ব্যবহার করবে?”
” দেখি গিয়ে চল।”

আমিও আর কথা বাড়ালাম না। এখন শুধু বাড়িতে পৌঁছানোর অপেক্ষা করতে লাগলাম। মামা গতি বাড়িয়ে দিলেন। আমি চুপচাপ বসে চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। তিনিই একমাত্র আমাকে এসব থেকে বাঁচাতে পারেন।

মামা বাড়ির সামনে এসে বাইক থামালেন। সদর দরজার ভেতরে নিয়ে একপাশে রেখে লক করে রাখে মোবাইলে সময় দেখে বললেন,” সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আয় মা তাড়াতাড়ি আয়।”

মামা আগে আগে হাটা শুরু করলেন৷ আমি মামার পিছু পিছু হাটছি। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। অতিরিক্ত ভয়ে পেটের নাড়িও কাঁপছে, বেশ বুঝতে পারছি। হাটার শক্তিও পাচ্ছি না, মনে হচ্ছে এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাব৷ এ বাড়িতে এর আগেও এসেছি কিন্তু এমন কখনো হয়নি।

মামা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল,” আমার মা’র মুখ এমন কাঁদো কাঁদো লাগছে কেন?”
” মামা, আমার ভয় লাগছে।”
” ধুর মেয়ে, কিছু হবে না৷ সাহস রাখ।”

মামা আমার মাথা হাত বুলিয়ে কলিংবেল চাপলেন। মামা বেল বাজানোর সাথে সাথে দরজার ওপাশে শব্দ হলো৷ কেউ খুলতে চলে এসেছে। মনে হচ্ছে ওপাশে কেউ তৈরি হয়ে ছিল দরজা খোলার জন্য। দরজার পাল্লা সরে গেল। দরজার ওপাশে আমার ননদের হাসি হাসি মুখের দেখা মিলল।

আমাকে দেখেই বলে উঠল,” চলে এসেছ!”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে