ঘরকন্না পর্ব-০৫

0
859

#ঘরকন্না
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০৫

” দুই তিনদিনের মধ্যে তোমার ডিভোর্সের কাগজ চলে যাবে। সিগনেচারটা করে দিও। তোমার কাবিনে যে টাকা দেওয়ার কথা ছিল সেটা আবির পাঠিয়ে দেবে। ”

শাশুড়ির কথার পৃষ্ঠে বলে উঠলাম, ” আপনারা কি আমার সাথে মজা করছেন? ইচ্ছে হলো ছেলেকে বিয়ে দিলেন আবার ছেলেকে ডিভোর্স করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন! বিয়ে আর ডিভোর্স কি হাতের মোয়া নাকি? ছেলেকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন কেন? মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সংসার কেন ভাঙছেন? ছেলেকে বউ ছাড়া রাখতে চাইলে বিয়ে দিতে হতো না। আমি আপনার ছেলেকে ডিভোর্স দেব না। দেখি কীভাবে সে আমাকে ছাড়ে।”

ওপাশ থেকে শাশুড়ী ধমকের সুরে বলে ওঠেন,” তুমি কি আমাকে তেজ দেখাচ্ছ অনু? আমি তোমার বড়, আমার সাথে এভাবে কথা বলবে না।”
” আমার এতক্ষণে মনে হচ্ছে আপনাকে এতদিন সম্মান দিয়ে ভুল করেছি। আপনি সম্মানের যোগ্য নন। আপনাকে সম্মান করা একদম উচিৎ হয়নি আমার।”
” থাপ্প*ড় দিয়ে গাল ফা*টিয়ে দেব আমি তোমার। মা-বাবা শিক্ষা দেয়নি? ওহ শিক্ষা পাবে কোথা থেকে? জন্মেই তো মাকে খে*য়ে ফেলেছ। এতিমদের আবার শিক্ষা আছে নাকি!”
” আপনার বাবা-মা ছিল না? আমি নাহয় ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারিনি কিন্তু আপনি? আপনি এত অশিক্ষিত মানুষের মতো কথা বলছেন কেন? এ বাড়িতে আসার সময় আমি সব মেনে নিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ আগেও ভেবেছিলাম আমার সাথে হয়তো আপনারা প্র‍্যাংক করছেন। এতক্ষণে বুঝলাম মনের কোণে যে সুক্ষ্ম আশা জেগেছিল সেটা ভুল।”
” তোমাকে তো আগে থেকেই আমার পছন্দ ছিল না। মিনকে শয়*তান তুমি। আমি মানুষ ভুল চিনি না। এতদিন ভালো সাজার নাটক করেছ, এখন আসল পরিচয় বেরিয়ে এলো।”
” আপনার আসল চেহারা তো অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছে। আমি আগে ভাবতাম জোর করে কোন কিছু করা উচিৎ না। জোর করে অন্যকিছু পাওয়া গেলেও ভালোবাসা পাওয়া যায় না তাই এতদিন চুপচাপ ছিলাম৷ এখন বুঝতে পারছি ভালো থাকার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। ”
” কী করবে তুমি? কী করার যোগ্যতা আছে শুনি?”
” আপনার ছেলেকে আমার কাছে থেকে দূরে রাখুন, দেখুন পারেন কি না।”

উনার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে কলটা কে*টে দিলাম। ফোনটা রেখে পাশের চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়লাম। তার মানে এগুলো ও বাড়ির কেউ পাঠায় নি!

মামি তখনও চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তিনি হয়তো আমাকে এভাবে কারোর সাথে কথা বলতে শোনেন নি। আমি কারও সাথে বলেছি কি না সেটাও মনে করতে পারছি না। আজ এই পরিস্থিতিতে এসে মনে হচ্ছে আমা ও বাড়ি ছেড়ে আসা উচিৎ হয়নি। ভালো মানুষের আসলেই ভাত নেই। মেনে নিতে নিতে একদিন আর নিজের ইচ্ছে বলতে কিছু থাকে না। এখন মনে হচ্ছে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য হয়তো সবার মন রাখা জরুরি নয়। নিজেকে সহজলভ্য করা উচিৎ নয়।

মামি এতক্ষণে আমার কাছাকাছি এসে বসলেন। চেয়ারসুদ্ধ আমাকে টেনে বিছানার দিকে এগিয়ে নিয়ে হয়তো আজ প্রথমবারের মতো তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার হৃৎস্পন্দন বেড়েছে, ভেতর থেকে কান্না ঠেলে আসতে চাইছে। বারবার বুক কেঁপে উঠছে, ফুঁপিয়ে উঠছি আমি৷

মামি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন,” কাঁদিস না মা।”

মামির কথায় এবার আমার কষ্টগুলো যেন বাধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। মামির কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে শব্দ করে কান্না করে উঠলাম। আমি আর কিছুতেই নিজেকে শক্ত রাখতে পারছিলাম না। সকাল থেকে তো অনেক কিছু সহ্য করলাম৷ মনে হচ্ছিল একটু ভেঙে গুড়িয়ে যাই আর কেউ এসে আমার টুকরো টুকরো অংশগুলো গুছিয়ে দিক। আমি তো এতিম, আমাকে আবার কে গুছিয়ে দেবে? নিজেকে নিজেরই ঠিক রাখতে হবে হয়তো।

কিছুক্ষণ গলা ছেড়ে চিৎকার করে কান্না করলাম। নিজের বুকের ভারী-ভাবটা একটু হলেও যেন কমে গেল। মামির কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে চোখ,গাল মুছে নিলাম।

চোখ-মুখ মুছে মামিকে ভাঙা ভাঙা গলাতেই বললাম,” মামা কোথায়, মামি?”

” দোকানে আছে। তোর শাশুড়ির সাথে এমন ব্যবহার করলি কেন? তুই না ধৈর্য্যশীল মেয়ে? তুই-ই তো তখন বললি তোর শাশুড়ি নাকি সম্মানের মানুষ তাই উনার কথা মেনে নিয়ে চলে এসেছিস?” মামি কথাগুলো বলেই আমার দিকে তাকালো।

আমি নীরবস্বরে বললাম,” আমার কথা শুনে আপনার মনে হলো মামি, উনি এখনো সেই সম্মানের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছেন?”
” কী হয়েছে খোলসা করে বল তো।”
” আর কী বলব মামি? নদীভাঙনের মতো আমার সংসার ভাঙতে চলেছে।”
” কী বলেছে উনি?”
” দুই,তিনদিনের মধ্যে ডিভোর্সের কাগজ আসবে।”
” তোর মামাকে একবার ফোন কর।”
” মামা-ই তো আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি কতবার নিষেধ করেছিলাম মামাকে যেতে৷ বলেছিলাম -মামা আমার শাশুড়ী কল দিয়ে যেতে বললে আসার প্রয়োজন নেই। মামা তবুও গিয়েছিল আমাকে নিয়ে আসতে।”
” কল লাগা তুই উনাকে।”
” আমার আর কারো সাথে কথা বলার রুচি হচ্ছে না মামি।”

মামির হাতেই ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম,” আমি কাল সকালেই ওই বাড়িতে যাব মামি। আমার সংসার আমাকেই বুঝে নিতে হবে। আমি কেন সবকিছু হারাবো? কী দোষ আমার?”

মামাকে কল করার প্রায় আধাঘণ্টা পরই মামা বাসায় ফিরলেন। মামি এমন করে বাসায় ফিরতে বলেছে যে মামা আর দেরি করতে পারেনি।

আমি তখন দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছি। মামি পাশেই বসে আছেন। বাহির থেকে মামার গলা শোনা যাচ্ছে। মামি দৌঁড়ে গিয়ে বাড়ির গেইট খুলে দিলেন। দুজনই আমার রুমের দিকেই আসছে। মামি আগে আগে রুমে ঢুকলো, মামাও সাথে সাথেই প্রায় এলেন।

আমার মুখের অবস্থা দেখে একপ্রকার আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল,” কী হয়েছে, কান্না করেছ কেন?”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মামি নিজেই বলে উঠলেন,” অনুকে তুমি এ বাড়িতে কেন নিয়ে এসেছ? অনু নাকি তোমাকে কল দিয়ে নিষেধ করেছিল যেতে? তবুও কেন ওকে নিয়ে এসেছ তুমি?”

মামা আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মামির দিকে তাকালেন, শক্ত গলায় বললেন,” তাতে তোমার কী? তুমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছ?”

মামিও তেজি গলায় বলে উঠলেন,” আমি তো ওর ছোটবেলা থেকেই ওকে দেখতে পারি না। আজ আর নতুন কী?”

মামা মামিকে আর কিছু না বলে বিছানার পাশে বসলেন। নরমস্বরে আমাকে বললেন,” কী হয়েছে মা? কেঁদেছিস কেন?”

মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বললাম,” কী হবে মামা? সংসার ভাঙার আনন্দে একটু কান্না করেছি।”
” তুই এখনও ওটা নিয়েই বসে আছিস?”
” থাকব না?”
” না, থাকা উচিৎ না।”
” সংসার ভাঙা এত সহজ মামা?”
” আরে বাবা সংসার ভাঙবে কেন?”

মামি এগিয়ে এসে ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,” এই তুমি ওকে মিথ্যে সান্ত্বনা একদম দেবে না। তুমি ওকে ও বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছ কেন সেটা বলো।”

আমি মামার দিকে সোজা হয়ে বসে বললাম,” আমি নিষেধ করার পরও ওখানে আজ কেন গেলে মামা? কেন আমার সংসারটা ভাঙতে তুমিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে?”

মামা আমাদের দুজনের দিকে একবার করে তাকিগে বলল,” কী হয়েছে তোদের বলবি আমাকে? এত হাইপার হয়ে যাচ্ছিস কেন তোরা?”

” অনুর শাশুড়ি কল করেছিল। উনি বলেছেন দুই, তিনদিনের মধ্যে ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দেবে।” মামির কথায় যেন মামা আকাশ থেকে পড়ল। মামির কথা শেষ হতেই তিনি চিল্লিয়ে উঠে বললেন,” কীহ্! কী বলছো তুমি, মাথা ঠিক আছে? আপা কেন এদব বলবেন?”
” বলেছে তো। উনি বলার পরই তোমাকে কল দেওয়া হয়েছে।”

মামির এবারের কথায় মামা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমি আর কিছু বলছি না। কেন জানি না আর কোন অনুভূতি এখন অনুভূত হচ্ছে না। চুপচাপ মুখে কুলুপ এঁটে বসে কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছি।

মামা কিছুক্ষণ মৌন থেকে নিরবতা ভেঙে বললেন,” আমি কি তবে ভুল করলাম? মিথ্যা কথা বিশ্বাস করলাম? কিন্তু উনি এমনটা কেন করলেন?”

আমি আর মামি যেন এবার নড়েচড়ে বসলাম। তার মানে মামাকে মিথ্যা বলা হয়েছে!

আমি আর মামি একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ দেখলাম। মামি আমার দিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ” কী বলেছেন উনি?”

মামা মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে মামাকে।

মামি আমারও জিজ্ঞেস করল,” তোমাকে কল করে উনি কী বলেছিলেন?”

মামা মামির দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নিজেই প্রশ্ন ছুড়লেন,” আমি কি তবে তোর সংসার ভাঙলাম?”

মামা বেশ স্পষ্টভাবেই বললেন,” আমাকে ঠকানো হয়েছে। তুই ফোন রাখার পর তোর শাশুড়ি কল দিয়েছিল। প্রথমে তোর ননদ কথা বলে তোর শাশুড়ির সাথে কথা বলতে বলল। উনি ফোন কানে নিয়ে আমাকে বলল- আবির আর তোর যেহেতু আয়োজন করে বিয়ে হয়নি তাই তোকে সারপ্রাইজ দিতে তোকে এই বাড়ি পাঠাবে। তোদের আবার বিয়ে দেওয়া হবে ধুমধাম করে। এত ভালো খবর শুনেই আমি তোকে নিয়ে আসতে গিয়েছিলাম।”

মামি বলে উঠলেন,” উনি যদি ওসবই করবেন তাহলে এখন এসব কেন করছে?”

আমি মামিকে ডেকে বললাম,” মামি, আমার মামাকেও ঠকানো হয়েছে। আমার সংসার ভাঙার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, আমি আর এসব সহ্য করব না। কালকেই আমি ওই বাড়িতে যাব। ”

মামা এবার বলে উঠলেন,” তুই যাবি মা, তুই যাবি। আমি নিজে কাল তোকে ওখানে রেখে আসব। তার আগে আমি তোর শাশুড়ির সাথে কথা বলব।”
” হ্যাঁ মামা, আমি আমার সংসার বুঝে নেব। কালকেই আমি ওখানে যাব।”

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে