ঘরকন্না পর্ব-০৪

0
886

#ঘরকন্না
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০৪

সামনে ট্রলিব্যাগটা নিয়ে বসে আছি। এটা লক করে পাঠানো হয়েছে আর সেটাও পাসওয়ার্ড দিয়ে খুলতে হবে তাছাড়া খুলবে না। বসে বসে ভাবছি লকটা খুলব কীভাবে! যে এসব পাঠিয়েছে তার কোনভাবে পাসওয়ার্ড জানিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল।
কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন আনলক করতে পারলাম না তখন ওভাবেই রেখে দিলাম। মামি লাগেজটা নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে চেষ্টা করছে কিন্তু শেষমেশ তিনিও ব্যর্থ হলেন। পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।

আনলক করতে না পেরে মামি ক্ষণকাল চুপ থেকে বললেন,” কী আছে এর ভেতরে বল তো?”
” হতে পারে এর ভেতরে কয়েক খন্ড করা লা**শ আছে।”
” আজেবাজে কথা বলবি না।”
” আমার এখানে থাকতে আপনার বিরক্ত লাগছে না মামি? আমাকে তো আপনার সহ্য হয় না।”

মামি আমার কথায় কোন জবাব না দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যেতে চাইলে আমি খপ করে অত্যা*চারী শাশুড়ির মতো হাত ধরে ফেললাম। মামির মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে এতক্ষণে।

মামিকে টেনে বিছানায় বসিয়ে হাত ধরেই বললাম,” আমাকে দেখতে না পারার মিথ্যে অভিনয় আপনি কেন করেন মামি? আপনার অভিনয় ঠিকঠাক হয় না। আপনার এই কঠোর আচরণেই অধিকারবোধ দেখিয়ে ফেলেন যেটা ভালোবাসা থেকে আসে।”

মামি আমার কোন কথার জবাব দিল না শুধু ছোট করে বলল,” ছেলে হয়ে জন্মালি না কেন? ছেলে হলে অন্তত আজীবন রেখে দিতে পারতাম। পেলেপুষে এত বড় করে অন্যের হাতে দিতে হতো না।”
” কার মুখে কী শুনছি আমি!”

মামি আর কিছু বলছে না। ইচ্ছেতে কিংবা ভুল করে কথাখানা বলে ভুল করে ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে হয়তো তার।
আমি আবার বলে উঠলাম,” মেয়ে হয়ে জন্মেছি। এতবছর জ্বা*লিয়েছি আর জ্বা*লাতন সহ্য করতে হবে না, সুন্দর না? আপনার তো খুশি হওয়ার কথা মামি। ছেলে হলে নিজে তো জ্বা*লাতামই সাথে বিয়ে করে বউ-বাচ্চাসহ জ্বা*লাতাম। তখন তো আরও বড় শ*ত্রু হয়ে যেতাম।”

মামি এবার রাগী গলায় হুঙ্কার দিয়ে বললেন,” মুখ দিয়ে কি মিষ্টি কথা বেরোয় না? অন্যের কথা তো ভালো মেয়ের মতো মুখ বুজে সহ্য করিস আর আমার সাথে কেমন আচরণ করিস দেখ নিজেই দেখ। তুই আমার শ*ত্রু হবি না তো কে হবে? ছেলে হইলে এরকম করে পিছনে লাগতে আসতি না।”
” কেউ কেউ সম্মানের মানুষ, যাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কেউ কেউ ভালোবাসার মানুষ, যাদের সামনে মুখে লাগাম দিতে ইচ্ছে করে না।”

আমার কথায় মামির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এই প্রথমবারের মতো এই মানুষটার মুখে এত সুন্দর স্নিগ্ধ হাসি দেখতে পেলাম। এ যাবৎ তার কঠোর ব্যবহারে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। মানুষটা আমাকে ভালোবাসতো সেটা টের পেতাম কিন্তু কখনো ধরা দিতো না।

মামির দিকে এগিয়ে বসে বললাম,” মিসেস শরিফা, আপনার হাসি সুন্দর। এই হাসি দিয়েই কি আমার মামাকে বশ করে রেখেছেন?”
” তুই এত কষ্টেও মজা করতে পারছিস কীভাবে অনু?”

মামির সাথে এসব নিয়ে কথা বলার আর সাহস হলো না আমার। কষ্টকে পাত্তা দিলে সে আরও বড় আকার ধারণ করবে৷ যতটুকু সম্ভব নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করে যাওয়া। কারো কপালে সংসারের সুখ না-ই থাকতে পারে অন্য ভালো কিছু তো থাকবে। সৃষ্টিকর্তা আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছেন, শুধু আমাদের মেনে নিতে হবে।

” কী হলো চুপ করে আছিস কেন?” মামির কথায় ফিরে তাকালাম।

বিছানা ছেড়ে উঠে নিজেই বললাম,” এসব নিয়ে কথা বলতে একদম ভালো লাগছে না মামি। বাহিরে থেকে আসছি৷ ঘরে ভালো লাগছে না।”

মামিকে রেখেই বাহিরে চলে আসলাম। চারপাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছে। বেশ খানিকটা হয়েও গেছে। বাড়ির সামনেই সুপাড়ি গাছ কে*টে বসার জায়গা বানানো হয়েছে। সেখানে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলাম। কিছুদূরেই মেইন-রোড কিছুক্ষণ পরপরই ডাক ছেড়ে কেমন হর্ণ বাজিয়ে ট্রাক আর বাস যাচ্ছে। সেগুলোই আনমনে দেখছিলাম। হঠাৎ পাশে মামি এসে বসলো সেটা বুঝতে পারলাম। বাড়িতে মামি ছাড়া কেউ ছিল না। মামা রাতে বাড়ি ফিরবে। মামি ভেবে আর না তাকিয়ে রাস্তার দিকেই তাকিয়ে রইলাম।

হঠাৎ পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো,” কেমন আছিস, অনু?”

গলা শুনেই যেন ছিটকে পড়লাম আমি। অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। বসা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ” ক কে? কে আপনি?”

আমার কথার সাথে সাথে সেই পুরুষও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। লম্বা আর বিশালদেহী মানুষটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলে আমি বাড়ির দিকে পিছিয়ে যেতে থাকলাম। বাড়ির দিকে দৌঁড় দেব এমন সময় সে বলে উঠলো,” প্লিজ দাঁড়িয়ে যা অনু।”

আমার পা যেন এবার রীতিমতো কাঁপাকাঁপি শুরু করেছে। নিজেকে সামলে নিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পুনরায় প্রশ্ন ছুড়লাম,” কে আপনি? রাতের বেলা এখানে কী করছেন? ”

লোকটা সোজাসাপটা জবাব দিল,” আমি রিহেম।”
” রিহেম! কে রিহেম?”
” তোর ভাই।”
” আমার ভাই? আমার কোন ভাই নেই।”
” তুই মানিস আর না মানিস, আমাদের দুজনের শরীরে তো একই রক্ত বইছে।”
” আমার মায়ের একটাই সন্তান আর সেটা হচ্ছি আমি।”
” তোর বাবার তো একটা সন্তান না।”
” আমার কোন বাবা নেই।”
” বাবা ছাড়া কেউ পৃথিবীতে আসতে পারে না। ”
” আমার বাবা অনেক আগেই মা*রা গেছে। আমি যখন এ বাড়িতে আসি তখনই মায়ের সাথে বাবাকে ক*ব*র দিয়ে এসেছি। আর আমি হয়তো আপনার চেয়ে বয়সে বড় হব, তাই আপনি করে বললে খুশি হব। আপনার সাথে তুই করে কথা বলার মতো সম্পর্ক নেই আমার।”
” পারব না আমি। তুই চাইলে আমি তোকে আপা বলতে পারি কিন্তু আপনি কখনোই বলব না।”
” আমার আশেপাশে যেন আপনাকে কোনদিন আর না দেখি৷ আমার মামা-মামি যদি জানতে পারে আপনি এখানে এসেছেন তাহলে আপনাকে আস্ত রাখবে না।”

হঠাৎ মামির গলা শুনতে পেয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটা বলে উঠলো,” আপা, আব্বা অসুস্থ। তোকে দেখতে চেয়েছে তাই আমি আজ এখানে এসেছি।”
” আমার কোন বাবা নেই। আপনি আসতে পারেন।”

আমি নিজেই আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে সেখান থেকে চলে আসলাম। আমার বাবা পরিচয়ের মানুষটার কথা আমি কখনও কানে নিতেই চাই না। ওই মানুষটা আমার একটা সুন্দর জীবন শেষ করে দিয়েছে নিজের হাতে।

আমি ভেতরে প্রবেশ করার পরও বাহিরের মানুষটা সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। এটা আমার মায়ের গুণধর স্বামীর ছেলে, আমার ভাই নয়। আমার তো কেউই নেই, পরিচয় দেবার মতো।

বাড়ির মধ্যে আমাকে দেখতে পেয়ে মামি দরজার সামনে থেকেই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,” ঘরে আয়, তোর ওই চাবি আমি খুলে ফেলেছি।”

এক প্রকার দৌঁড়ে ঘরে এসে দেখি মামি সত্যি সত্যি ওটা আনলক করেছে। তাড়াতাড়ি সেদিকে এগিয়ে গেলাম আমি। মামি তালাটা আনলক করতে পারলেও ব্যাগের চেইনটা এখনো খুলে নি। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে মামি মুখে হাসি লেপ্টে বললেন,” পাসওয়ার্ড চারটা এক দেওয়া।”

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ” আপনি কীভাবে জানলেন?”
” হঠাৎ করে দিয়েছি, আর খুলে গেল। জলদি দেখ ভেতরে কী আছে।”
” আমার চেয়ে আপনিই দেখছি বেশি এক্সাইটেড, মামি।”
” কথা না বলে তাড়াতাড়ি খুলে দেখ।”

আমি আর দেরি না করে ব্যাগের চেইনটা খুলে ফেললাম। ওপরের অংশটা সরিয়ে দিতেই আমি অবাক।
মামি আবারও হাসতে হাসতে বলে উঠলো, ” দেখেছিস? আমি বলেছিলাম না যে বিয়ের শপিং হয়তো!”
” কিন্তু এসব কে দিবে মামি?”
” জামাই হয়তো দিয়েছে।”
” উনি দিলে এখানে আজকেই কীভাবে দিবেন এগুলো? আমার মনে হচ্ছে এটা অন্যকারো কাজ।”
” অন্যকেউ! কে দিবে এত টাকার জিনিস?”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে