#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২
হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো প্রত্যয়। আমির চৌধুরী রেগে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। উপস্থিত সকলে মজা নিয়ে নাটক উপভোগ করতে লাগলেন! আমির চৌধুরী প্রত্যয়ের বন্ধুদের ইশারা করতেই অন্তু আর মুহিব এসে এটাসেটা বুঝিয়ে তাদের সেখান থেকে সরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। এদিকে প্রত্যয় মায়ের ব্যবহারে ক্ষুদ্ধ হয়ে সেখান থেকে গটগটিয়ে হেঁটে উপরে চলে গেলো। আজ সকাল থেকে ও সবার সামনে অপদস্ত হচ্ছে। প্রথমে ওই সিরাত পালিয়ে গিয়ে সিনক্রিয়েট করলো। এখন মা এসে চড় মেরে হাসির পাত্র বানাচ্ছে ওকে সবার সামনে। মুশফিকা চৌধুরীও জোর কদমে পেছন পেছন চললেন। রাগে নিজেকে উন্মাদ লাগছে তার। এরকম একটা মেয়েকে তার ছেলে কিভাবে বিয়ে করতে পারে তা তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না। যায় নাকি তাদের সাথে? মিডেলক্লাস মেয়ে কোথাকার! ঘরে ঢুকেই তিনি প্রত্যয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘জোর করে বিয়ে করলে। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমার কত স্বপ্ন ছিলো তোমার ছেলের বিয়ে নিয়ে। তুমি সব শেষ করে দিলে।’
মায়ের কথায় প্রত্যয় চোখমুখ শক্ত বানিয়ে বলল, ‘কেন? তোমার বোনের মেয়েকে বিয়ে করিনি বলে রাগ হচ্ছে তোমার?’
মুশফিকা চৌধুরী থতমত খেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি তোমার মা। তুমি একবারও আমার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চাইবে না? লিয়ানা কি খারাপ ছিলো? তাদের স্ট্যান্ডার্ড দেখছো তুমি?’
প্রত্যয় রোষপূর্ণ গলায় বলল, ‘আমি দেখতে চাই না৷ আর এ বিষয়ে কোনো কথা শুনতেও চাইনা। নিচে তুমি যেটা করলে সেটা একদম ঠিক করলে না।’
‘আমি কখনো এই মেয়েকে তোমার বউ হিসেবে মানবো না।’
‘আই ডোন্ট কেয়ার।’
প্রত্যয়ের কাটখোট্টা জবাবে মুশফিকা চৌধুরী রাগে ভাষা হারিয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন। প্রত্যয় পরণের শার্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। হাঁকডাক ছেড়ে সে একমাত্র বোন প্রত্যাশাকে ডাকলো। সিরাতের কাছে বসেছিলো এতক্ষণ। আপডেট জানতে হবে। ওই শকুনি কি কি করেছে তা না জানা অব্ধি ওর শান্তি হচ্ছে না। ভাইয়ের ডাক শুনেই প্রত্যয়ের ঘর থেকে ছুটে এলো প্রত্যাশা, ‘বলো ভাইয়া।’
প্রত্যয় গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘সিরাত কি আবারও কোনো সিনক্রিয়েট করছে?’
‘কাঁদছিলো অনেক। এখন চুপচাপ বসে আছে।’
‘কিছু বলেছে?’
‘বলেছে তার মেয়ের ক্ষতি হলে তোমাকে খু’ন করবে।’
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, ‘এত সাহস?’
প্রত্যাশা মিনমিন করে বলল, ‘তুমি কেন এরকম একটা কাজ করলে ভাইয়া? সিরাতের ওপর প্রতিশোধ নেবে৷ সেটা অন্যভাবে নিলেই তো হতো। বিয়ে করার কি দরকার ছিলো? এখন তো সে তোমার শত্রুর বদলে বউ হয়ে গেলো!’
প্রত্যয় চমকে ওঠে বোনের মুখপানে চাইলো। আসলেই তো! কিন্তু পরক্ষণেই সিরাতের সব কার্যক্রম মনে করে সে বলল, ‘বউ না ছাই। আমার বিরুদ্ধে স্পাইগিরি করা, সবাইকে উস্কে তোলা, আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া মেয়ে আর যাই হোক না কেন আমার শত্রুই হবে। একে উচিৎ শাস্তি দেবো আমি।’
‘পারবে না। ও খুব মিষ্টি মেয়ে। তাছাড়া তুমি অতোও ভালো মানুষ নও।’
প্রত্যাশার দিকে চোখ গরম করে তাকালো প্রত্যয়। ধমকে বলল, ‘আদিক্ষেতা না দেখিয়ে যা এখান থেকে।’
প্রত্যাশা যাবার আগে চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলো, ‘যদি আবার সোহার কথা জিজ্ঞেস করে? কি বলবো?’
প্রত্যয় ফোনে মনোযোগ দিতে দিতে উত্তর দিলো, ‘আমি এমনিই ওকে ঢপ দিয়েছি। সোহার কিছুই হয়নি।’
প্রত্যাশা ভাইয়ের মুখ থেকে এ কথা শুনে হা হয়ে গেলো। তার এই চালবাজ ভাই এতো ভালো চাল জানে যে সিরাতের মতো মেয়েকেও ঢপ খাইয়ে বিয়েতে রাজি করিয়ে নিলো? ও একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘আমি পারবো না। তুমিই গিয়ে বলো।’
বলেই প্রত্যাশা ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।
প্রত্যয় অন্তুকে ফোন দিয়ে বললো মেহমানদের বিদেয় করে দিতে। এমনিতেও এসব মেহমান লোক দেখানো। এনেছিলো সিরাতকে ঘাবড়ে দিবে বলে। কিন্তু এই মেয়েটাই পালিয়ে গিয়ে ওর মুখে চুনকালি মেখে দিলো। প্রত্যয় বিছানায় শুয়ে দু’চোখ বন্ধ করলো। সিরাতকে এরপর কীভাবে অপদস্ত করবে সেটা ভাবতে লাগলো। এই মেয়েকে সে কেয়ার করবে না একদম।
সিরাত ঘরে বসে নিঃশব্দে কাঁদছে। জীবনটার শেষের শুরু হলো বোধহয়! ফোনটাও কোথায় যে হারালো ধস্তাধস্তির সময়! সোহার অবস্থা ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। ওই গুন্ডা তার ছোট্ট মেয়েটাকে কি অবস্থায় রেখেছে কে জানে! এ সমস্ত ভাবনার মধ্যেই ঘরে ঢুকলো প্রত্যয়। পরণে ট্রাউজার আর টি-শার্ট। সিরাতকে একপলক দেখে কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে বলল, ‘তেজ কমেছে?’
সিরাত ওঠে গিয়ে কলার চেপে ধরলো ওর। কটমট করে বলল, ‘আমার সোহা কোথায়? বিয়ে তো করেছি!’
প্রত্যয় সিরাতের রাগান্বিত চেহারা দেখে খুব মজা পেলো৷ একটা ফু দিয়ে মুখের সামনে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ বাড়িতে ঘুমাচ্ছে।’
সিরাত কেঁপে ওঠলো। হাত আলগা হয়ে এলো ওর। ধাক্কা দিয়ে প্রত্যয়কে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি বোকা না। নিশ্চয়ই ওর কোনো ক্ষতি করে… ‘
‘জানি তুমি খুব চালাক। আর এ চালাকির শাস্তি পেলে আজকে।’
সিরাত আশেপাশে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা একটা কাচের ফুলদানি তুলে ধরে বলল,
‘আমি সোহাকে সুস্থ-স্বাভাবিক দেখতে চাই। এক্ষুণি, এ মুহূর্তে।’
প্রত্যয় আশা করেনি এরকম কিছুর। তেজ মোটেও কমেনি। ও সিরাতের দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ও চিৎকার করে বলল, ‘আমার মেয়ের কিছু হলে আজ তোকে খু’ন করে লা’শ বানাবো বলে দিলাম।’
প্রত্যয় বিরক্ত হলো। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ফোন করলো কাউকে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই ভিডিওতে দেখা গেলো সোহাকে। প্রত্যয় ফোনের স্ক্রিনটা সিরাতের মুখের সামনে ধরলো। আধো আধো ভাঙ্গা বুলি শুনে স্ক্রিনে দেখলো হতচকিত, তৃষ্ণার্ত চোখে দেখলো ছোট্ট সোহাকে। বাড়িতেই আছে বাচ্চাটা, বিছানায় শুয়ে খেলছে। প্রত্যয় ফোন সরিয়ে নিতেই সরু চোখে তাকালো সিরাত। মানে কি এসবের? এত লুকোচুরি কেন? ওকে ভাবনায় রেখে প্রত্যয় ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘বোকা সিরাত।’
ধরণীতে রাত নেমে এসেছে। চারিদিক নীরব, নি:স্তব্ধ। সিরাতকে প্রত্যাশা এসে খাবার দিয়ে গেলো। কিন্তু ও সেসব ছুঁয়েও দেখলো না। খানিকক্ষণ পর মুশফিকা চৌধুরী ঘরে এলেন। তার মুখ কালো হয়ে আছে। সিরাত খাবার ছোঁয় নি দেখে তার গা আরো জ্বলে গেলো। মেয়েটাকে সহ্য হচ্ছে না মোটেও। লিয়ানার জায়গা দখল করেছে মেয়েটা। ওকে পুত্রবধূ করার স্বপ্নটা মাঠে মারা গেলো একেবারে। তিনি কিছু শাড়ি, জামাকাপড় নিয়ে এসেছেন। আমির সাহেব জোরাজুরি করলেন বলেই শ্বাশুড়ির দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন। নয়তো তার বয়েই গেছে এসব করতে। বিছানার ওপর শাড়িগুলো রেখে সিরাতের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমাকে আমার একটুও পছন্দ না।’
সিরাত উত্তর দিলো না। ওর কোনো ইচ্ছেও নেই। মুশফিকা চৌধুরী আবারও বললেন, ‘তোমার কোনো যোগ্যতা নেই আমার ছেলের বউ হওয়ার। ওর পাশে দাঁড়ানোর। লোভী মেয়ে।’
সিরাত তীক্ষ্ণ স্বরে জবাবে বলল, ‘আপনার ছেলেই ছলছাতুরীর আশ্রয় নিয়ে আমায় বিয়ে করেছে। ওনার বউ হওয়ার চেয়ে নদীতে ডুবে ম’রা ভালো৷ আমাকে কথা না শুনিয়ে নিজের ছেলেকে মানুষ বানান!’
মুশফিকা চৌধুরী ক্ষিপ্ত হয়ে চলে গেলেন। সত্যিই মেয়েটা বেয়াদব। সিরাত চুপচাপ মেঝেতে বসে রইলো। মনে হাজারো প্রশ্ন! সোহা যদি বাড়িতেই থাকে তাহলে তখন প্রত্যয়ের ভিডিও কল রিসিভ করলো কে? বাবা-মা? কিন্তু ওরাই বা কল ধরবে কেন? প্রত্যয়কে চেনে নাকি ওরা? অবশ্য চিনতেই পারে। ওদের ভার্সিটির জনপ্রিয় ছাত্রনেতা প্রত্যয় চৌধুরী। যে মুখোশ পরে ভালো মানুষ সেজে থাকে। এসব হাজারো ভাবনা মাথায় ঘুরতেই দেখলো প্রত্যয় ঘরে এসেছে। সিরাত চেঁচিয়ে বলল,
‘কি করেছেন আমার ফ্যামিলিকে?’
‘কিছুই করিনি।’
‘নর্দমার কিট আপনি। একটা কথাও বিশ্বাস করিনা।’
প্রত্যয় মুচকি হাসলো, ‘তোমার বাবা তো আমার খুব
বড় ভক্ত। আমাকে দেখেই
চা-মিষ্টির ব্যবস্থা করলো। তোমার ভার্সিটির সিনিয়র বলে খুব নম্র ব্যবহার করলো।’
সিরাত অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন? কেন? নিশ্চয়ই ভয় দেখিয়েছেন?’
প্রত্যয় মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘উহু। বলেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও। এসব বলেই তোমার বাবাকে পটালাম। তুমি এত চালাক হলে
কি করে বলো তো? তোমার পুরো ফ্যামিলিটাই
হাঁদারাম টাইপের।’
সিরাত ফুঁসে ওঠলো, ‘আমার পরিবারকে নিয়ে আর একটা কথাও নয়। লজ্জা করে না সরলসোজা মানুষগুলোকে নিয়ে মজা করতে? মিথ্যেবাদী কোথাকার?’
‘না করে না। আমি তোমাকে বিয়ে করবো শুনেই তো নাচতে নাচতে মত দিয়ে দিলো তোমার বাবা-মা। শতবছর তপস্যা করেও এমন মেয়েজামাই পাবে নাকি?’
প্রত্যয় গা জ্বালানো হাসি দিলো। চোখেমুখে গর্ব। সিরাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘ওরা তো জনপ্রিয় ছাত্রনেতা প্রত্যয় চৌধুরীর কুৎসিত রুপটা জানে না। জানে না তো আপনি নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের কি পরিমাণ টর্চার করেন। আপনার জন্য কতজন সুই’সাইড পর্যন্ত করেছে। আমার মতো নিরীহ মেয়েকে কিডন্যাপ করেন। জানলে ঝাটাপেটা করে বাড়ি থেকে তাড়াতো!’
বলে ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিলো। প্রত্যয়ের রাগ হলো খানিকটা। ওর গাল চেপে ধরে বলল, ‘তোমার জন্য যতগুলো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি প্রত্যেকটার হিসাব সুদে-আসলে পাবে তুমি। তোমার অশান্তিই আমার শান্তির ঘুম এনে দেবে।’
বলে সিরাতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এরপর বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এদিকে সত্যিই পুরো রাতটা নির্ঘুম কাটলো সিরাতের।
[ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ওকে?]
চলবে…