গোপন_ভালোবাসা❤️ মুমুর্ষিরা_শাহরীন

0
802

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
গোপন_ভালোবাসা❤️
মুমুর্ষিরা_শাহরীন
#রোমান্টিক
দু ঘন্টা আগে আমার বিয়ে হয়েছে। বাসররাতে ছড়ানো ছিটানো ফুলগুঞ্জা বিছানায় বসে অপেক্ষা করছি তার জন্য। বুকে উথাল-পাথাল ঢেউ। না জানি কি হয়?
এই প্রথম দেখা হবে। হ্যা, আগেও হয়েছিলো কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে একটা ঘরে একা আমি আর সে এভাবে তো আর হয় নি। হয়েছে জনা সমাগমস্থলে। সবার সামনে। আমি বোধ হয় একবার চোখের পলক দেখেছি মাত্র। মাশাল্লাহ স্বামী আমার বেশ সুদর্শন, এক ঝলক দেখেই বুঝেছি।

আমার হাত পা কাঁপছে। কি হবে? কীভাবে কথা শুরু করবো? তাকে সালাম করবো কীভাবে? সে আমার সাথে কি কথা বলবে? কীভাবে কি করবে? আজ ই কি সব হবে? ভেতর বাহির শরীর সব কি আজ পরিচিত হয়ে যাবে? না কি সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে আগে মন পরিচিত হবে? কি জানি কি হয়? আচ্ছা আমি তার চোখে চোখ রাখবো কীভাবে? লজ্জা করবে না!

হাতে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে টকটকে লাল পাপড়িগুলো নির্দয় ভাবে একটার পর একটা ছিড়ে ফেলছিলাম। মনে উৎকন্ঠার ঢেউ। কাপছে বুক ভয়ে, উত্তেজনায়।
অতঃপর অপেক্ষার অবসান কাটিয়ে আমার বুকটাকে ধক করে কাপিয়ে প্রবেশ করলো আমার সদ্য বিবাহ করা স্বামী। পড়নে ক্রিম কালার শেরওয়ানি, মেরুন কালার চুরিদার, মাথায় মেরুন কালার সাথে ক্রিম কালার মিশ্রনে পাগড়ি। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। ঘেমে নেয়ে একাকার সে।

আমি মাথা নিচে নামালাম। উঠে গিয়ে তাকে সালাম করলাম। সে ক্লান্ত কন্ঠে বলল, ‘এখনো জেগে আছো? আচ্ছা এসব শাড়ি কাপড় খুলে এসো, যাও।’

আমি চমকে গেলাম। এ কি অবস্থা! দেখা হতেই এই বিশ্রী প্রস্তাব। সে তো আমার স্বামী। আরো অনেক সময় পরে আছে। আর সে এখনি এসব…ছি!

আমার ভাবনার মাঝেই আমার স্বামী আমাকে অনেকবার ডেকেছে। এবার না পেরে আমার বাহুতে ধরে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল,

‘প্রমা… এই প্রমা।’

আমি চকিতেই তাকালাম তার দিকে। এরপর নিচু গলায় ঘৃণার সহীত বললাম, ‘কি?’

‘যাও। এসব শাড়ি খুলে কোনো পাতলা থ্রি-পিস পরে এসো। যা গরম!’

আমি অবাক হয়ে গেলাম। ঠোঁটদুটো কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেলো। এই লোকে এতোক্ষন থেকে এই কথা বলছিলো? আমি হেসে দিলাম। এরপর কিছু বলতে যাবো। কিন্তু মনে হলো উনাকে আমি ডাকবো কি বলে? প্রশ্নটা করেই ফেললাম,

‘আচ্ছা আপনাকে আমি কি বলে ডাকবো? মানে স্বামী স্বামী বা ওগো ওগো করে তো আর ডাকা যায় না।’

সে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, ‘তাহলে আর কি! জান জান বলে ডেকো।’

কি খারাপ! আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, ‘নাম কি আপনার?’

সে হায়হায় করে বলল, ‘আল্লাহ স্বামীর নাম ধরে ডাকবে? তুমি জানো আমি তোমার কত বড়? প্রায় দু-তিন বছরের বড় হবো।’

আমি চোখ তুলে একবার তাকালাম। সাথে অবাক হলাম দু-তিন বছর একটা বড় হলো না কি? আমি মিনমিনে গলায় বললাম, ‘তা বলি নি। আপনার নামটা বলুন। আমি আপনার নাম ধরে ডাকবো না। শুনবো। বিয়ের ওতো ভেজালের মধ্যে নাম শুনার দিকে খেয়াল ছিলো না।’

‘আমার ডাক নাম প্রথম। পুরো নাম মুসাদ্দেক হাসান প্রথম।’

‘ওহ…’

‘শুয়ে পড়ো তাহলে। ভয়ের কিছু নেই। আজ কিছু হবে না।’

আমি মাথা নিচু করে শাড়ি বদলাতে গেলাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমার খুব খুশি লাগছিলো। মানুষটা কি সত্যি এতোটা ভালো? না কি শুধু আমার কাছেই ভালো লাগছে?

জামা কাপড় পালটে দুজনে দু রাকাআত নফল নামাজ পড়ে শুতে গেলাম। একটা পাতলা শাড়ি আমার গায়ে। আমি বেশ দূরত্ব রেখেই শুয়েছি তার থেকে। হঠাৎ সে আমাকে হেচকা টান দিলো। আমি হুমড়ি খেয়ে পরলাম তার বুকের উপর। ভয় পেয়ে গেলাম। আজ তো এমন হওয়ার কথা ছিলো না। তার মানে মানুষটা যা দেখায় সে আসলে তা নয়। চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইলো।

প্রথম আমার পিঠে এক হাত রাখলো। বলতে নেই, আমার ভেতর মৃদুমন্দ কাপন সৃষ্টি হলো। ভালো লাগলো। চোখ নির্বিঘ্নে নিজ দায়িত্বে বন্ধ হয়ে গেলো। আমি বলতে শুনলাম। প্রথম বলছে আমার কানে ফিসফিস করে,

‘আমি কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোলে রেখেছি। আর তুমি পাতলা শাড়ি পরে এসেছো? তার উপর এত্তো বড় গলার ব্লাউজ। পিঠের অনেকাংশই তো দৃশ্যমান। কি চাইছো বলো তো তুমি?’

আমি চট করে চোখ খুললাম। তার চোখের সাথে আমার চোখ মিলে গেলো। এরপর কিছুক্ষন দমবন্ধকর পরিস্থিতি। আমি লজ্জা পেলাম। সরে আসতে চাইলাম তার কাছ থেকে। কিন্তু তার শক্তির সাথে পেলাম না। সে আমাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। বলল,

‘আজ থেকে আমার বুকেই তোমার স্থান।’

সত্যি কথা, সে সময় আমার চোখ থেকে আপনা আপনি দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। আমার ভাগ্যে আল্লাহ এতো ভালো একজন স্বামী রেখেছিলো? প্রতিদিন তাহাজ্জুদ নামাজে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম, ‘হে আল্লাহ, আমি বাবা মার অবাধ্য হবো না। কিন্তু আমার মনের মতোই কাউকে যেনো আমি পাই।’ আল্লাহ আমার কথা শুনেছে। দিয়েছে আমাকে একজন ভালো স্বামী।

আমি তার বুকে শুয়ে থাকলাম। আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়লো তার বুকের উপর। সে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে প্রমা কাদছো কেনো?’

নাক টেনে তাকে আরো শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আল্লাহ এতো ভালো স্বামী দিলো তাই কাদছিলাম।’

প্রথম আমার কপালে চুমু দিলো। এই প্রথম কোনো ছেলের এতো কাছের স্পর্শ আমার শরীরে লাগলো। কেপে উঠলো পুরো শরীর। আমি তার নীল গেঞ্জির গলার দিকে ফাকা স্থান থেকে বের হওয়া বুকের লোম গুলো খুটছি। সে আমার গালে চট করে চুমু দিলো। আমার শরীর ক্রমশ অসাড় হয়ে এলো। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেতে শুরু করলো। একসময় আমি তার বুকের মাঝে আলতো করে একটা চুমু একে দিলাম। সে আমাকে নিজের সাথে পিষিয়ে ধরলো। মিশে গেলাম তাহাতে আমি।

_______________________________

আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আমার কোল আলো করে আসতে চলেছে আমার আর উনার সন্তান। ঠিক যতটা না আমার উৎফুল্লতা তার থেকে দ্বিগুন বেশি উনার।

আমি তার বুকের উপর শুয়ে ছিলাম৷ সে আমার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে গম্ভীর সুরে বলল, ‘একটা কথা বলার ছিলো।’

‘বলুন।’

‘আগেই বলার উচিত ছিলো। কিন্তু আজ বলছি। কারন মনে হচ্ছে এখন বলার উচিত।’

আমার বুক কেপে উঠলো। কি এমন কথা! সে তার ফোন মেলে ধরলো আমার চোখের সামনে। আমি ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটা হয়তো নাইন বা টেন হবে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম! কারন ছবিটা আমার বোনের। আমার বড় বোন। যে বড় বোন বিদেশে বর নিয়ে সেটেল। আমার ভয় লাগতে শুরু করলো। হঠাৎ আপুর ছবি উনার ফোনে কেনো? কাপা কাপা গলায় প্রশ্ন করলাম,

‘আপুর ছবি আপনার কাছে কেনো?’

উনি মুখটা অনেক গম্ভীর বানিয়ে ফেললেন। আমার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যেতে শুরু করলো। এখন মনে হচ্ছে পেট ও ব্যাথা করছে। তিনি বলতে শুরু করলেন,

‘তোমার আপু আর আমি ব্যাচমেট। স্কুল কলেজ আমরা একসাথেই পড়েছি। কিন্তু ভারসিটিতে আলাদা। আমরা যখন কলেজে পড়তাম তখন আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার। তখন তুমি বোধ হয় নাইনে পড়ো। তুমি না কি কারোর সামনে আসো না। বাইরেও মুখ ঢেকে চলাফেরা করো। মানে পর্দা করো। বিষয়টা আমার কাছে খুব ই ভালো লাগলো। আমি একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। ওয়াশরুমে যেতে হতো তোমাদের রান্না ঘর পার করে। তো যখন ওয়াশরুম থেকে ফিরছিলাম দেখলাম রান্না ঘরে একটা ছিপছিপে গড়নের একদম সাধারণ মেয়ে। থ্রি পিস পরে মাথায় সুতির উড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চা ঢালছে।
বিশ্বাস করো, দৃশ্যটা আমার বুকে গিয়ে লাগলো। ওই চায়ের গরম ধোয়ায়…. তোমার ফর্সা লাল মুখশ্রী দেখে আমি এলোমেলো হয়ে গেলাম। কিন্তু তোমার অতি সাধারণ চলা ফেরা দেখে ভেবেছিলাম তুমি বোধ হয় ওই বাড়ির কাজের লোক।’

এইটুকু বলে প্রথম দাত দিয়ে জিহ্বা কাটলো। আমি ফুসে উঠলাম। জ্বলন্ত খড়ির মতো পুড়তে পুড়তে বললাম, ‘তারপর?’

সে বেশ আয়েশ করে বসে বলল, ‘তারপর? তারপর আমি তোমার আপুর কাছে গিয়ে বললাম, ‘রান্নাঘরে একটা মেয়ে দেখলাম অনেক সুন্দর। তোদের বাড়ির কাজের লোকগুলোও এতো সুন্দর কেনো রে?’
তোমার আপু বড় বড় চোখ করে তাকালো আমার দিকে। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আমাদের বাড়িতে তো কোনো মেয়ে কাজের লোক নেই। শুধু রহিম চাচাই আছেন।’
আমি বললাম, ‘আয়হায়! কি বলি তাহলে কাকে দেখলাম নীলটে রঙের জামা পরে সুতির উড়না মাথায় দেওয়া।’
সে একটু ভেবে হায়হায় করে উত্তর দিলো, ‘হাইরে! তুই তো আমার বোনরে দেখে ফেলছোস। এটা যদি আমার বোন প্রমা জানতে পারে তাহলে আমার আর কোনো ফ্রেন্ড রে বাড়িতে ঢুকতে দিবো না।’

আমার মুখ তখন উজ্জ্বল বাতির নেয় ঝিলিক দিচ্ছিলো। সাথে ভালো লাগছিলো তোমার সেই সাধামাটা চলন দেখে। মনের স্থানে সেই তোমাকে কবেই জায়গা দিয়ে দিলাম। সেই থেকে তোমার পিছু নিতাম। খোঁজ খবর রাখতাম। তোমার জন্যই তোমার আপুর সাথে যোগাযোগ রাখতাম। পড়াশোনা শেষ করে একটা সময় আমি তোমার আপুকে সব বললাম। তোমার আপুর তখন বিয়ে হয়ে গেছে। তোমার আপু আমাকে বলল তোমার বাবাকে পটাতে। তোমাকে পটিয়ে কোনো লাভ হবে না। কারন তোমার বাবা মা যার সাথে বিয়ে দিবে তুমি তাকেই বিয়ে করবে। ব্যস, আমি তোমার বাবাকে পটানো শুরু করলাম। তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম। আমার ফ্রেন্ড কয়েকজনরে কাজে লাগালাম। যারা তোমার বাবার কাছে গিয়ে আমার নামে ভিষণ ভালো ভালো বক্তব্য দিয়েছে। ব্যস, তোমার বাবাও পটে গেলো। আর পটবে নাই বা কেনো। হ্যান্ডসাম, গুড লুকিং, ব্রাইট একটা ছেলে আমি। ভালো জব করি। পটবে না আবার..।’

এই জায়গায় প্রথম একটু ভাব নিয়ে বলল খানিকটা কলার উঁচিয়ে। আমি গালে হাত দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে আমাকে নিজের সাথে ঝাপটে ধরে বলল, ‘তারপর আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। এখন তুমি আমার বাচ্চার মা হতে চলেছো।’

বিস্ময় নিয়ে বললাম, ‘এতো কিছু? সেই নাইন থেকে আপনি আমাকে ভালোবাসেন? মানে? এতোদিন জানান নি কেনো হ্যা? বিয়ের পরেও তো জানাতে পারতেন।’

প্রথম মুচকি হেসে আমার নাক টেনে বলল, ‘এই যে এখন জানিয়ে দিলাম। পিচ্চি একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। আর সেই মেয়ে এখন আমার বাচ্চার মা হবে।’

এরপর সে আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেশ সন্তুষ্টি নিয়ে বলল, “আমার গোপন ভালোবাসা। আমার অপ্রকাশিত ভালোবাসা। আমার বাচ্চার মা টা রেহ….।”

আমিও তাকে ঝাপটে ধরে বললাম, “আমার প্রকাশিত ভালোবাসা।”

সে হাসলো। আমিও হাসলাম। এরপর মুখ কুচকে বললাম, ‘আহা! আস্তে ধরুন না! পেটে ব্যাথা পাই তো।’

সে ‘উপসস স্যরি স্যরি বলে’ আমাকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে পেটের উপর একটা চুমু দিলো। কি সুন্দর সেই দৃশ্য! এমন সুন্দর মুহুর্তের একটা ছবির অভাববোধ করছি আমি এই মুহুর্তে। ইশশ…কি কিউট আমার জামাইটা! আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া!

সমাপ্ত❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে