গোধূলির নিমন্ত্রণ পর্ব-০৩

0
869

“গোধূলির নিমন্ত্রণ”
নূরজাহান আক্তার আলো
[০৩]

-” যাব না কারণ এই ঘটনা আমি জানি, গতরাতে মেয়েটিকে আমিও উনার রুমে ঢুকতে দেখছি।”

একথা শুনে নাতাশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না আদিত্য স্যার এই রকম। দেখে তো মনে হয় কত ভালো মানুষ। অথচ তলে তলে এসব করে বেড়ান। ছিঃ! ভাবতেই ঘৃণা লাগছে উনি একজন শিক্ষক। তারপরেও কেন জানি মন সায় দিচ্ছে না। নাতাশাকে মন খারাপ করতে দেখে
মেধা ঘাসের উপর আরাম করে বসে বলল,
-“তোকে একটা সিক্রেট বলি?”
-”হুম।”
-”আদিত্য স্যার আমার পূর্ব পরিচিত। একটা সময় স্যারদের বাসায় আমরা ভাড়া থাকতাম।”
– “‘সিরিয়াসলি?”
-“‘হুম।”
-”’যেহেতু চিনিস তাহলে জানার কথা উনি আসলে কেমন?
তোর কী মনে হয় উনি আসলেই এমন জঘন্য কাজ করতে পারে?”
– “মানুষ যেমন মরণশীল তেমনিস্বভাব পরিবর্তনশীল। কিছু কিছু মানুষের স্বভাব কয়লার মতো শতবার ধুলেও লাভ হয় না। তারা অন্যকে কাঁদিয়ে সুখ পাই। যেন অন্যের কাঁদানোর মাঝেই তার সুখ লুকায়িত। স্বার্থপররা এসব করে তবুও দেখ বেলাশেষে তারাই ভালো থাকে।”
-“ছাতার মাথা এসব কি বলছিস? তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝছি না আমি। এই দাঁড়া দাঁড়া তুই কী আদিত্য স্যারকে ভালো টালো বাসতি নাকি? তোর কথাগুলোতে এমন অভিমানে ঠাসা কেন? কিরে বল আমার?”
– “‘ আশ্চর্য! উনাকে ভালোবাসতে যাব কেন? পৃথিবীতে কী ছেলের অভাব? ভাড়াটিয়া হিসেবে দূর থেকে যতটুকু চেনার ততটুকুই চিনি।”

একথা শুনে নাতাশা আর কথা বাড়াল না। চট করে দাঁড়িয়ে মেধার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকল।ওদিকে শিক্ষকগণ
আদিত্যকে স্টুডেন্টেরাও ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে
জানার কৌতুহল। মাঝে মাঝে কেউ কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে আদিত্যের দিকে। আদিত্য সবার প্রশ্ন শুনে এখনো একটাও জবাব দেয় নি। সবার প্রশ্ন করা শেষ হলে সে আরাম করে বসল। তারপর অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা শাওনকে ডেকে সামনে আসতে বলল। শাওন এসে দাঁড়ালে আদিত্য তাকে জিজ্ঞাসা করল,
“তৃমি দেখেছো আমার রুমে একটা মেয়েকে ঢুকতে?”
“হুম।”
“মেয়েটা কি ব্ল্যাক শাড়ি পরা ছিল?”
“সম্ভবত, ঠিক মনে পড়ছে না আমার।”
“ওহ আচ্ছা। তাহলে শোনো আমি বলছি, আমার রুমে একটা নয় বরং তিনটে মেয়ে এসেছিল। আর তারা সবাই জিন্স আর শার্ট পরে ছিল। শুধু তারাই না দুজন সাভেন্টও এসেছিল।”
একথা শুনে মেহবার স্যার পথ খুঁজে পেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।

“আপনি এসেছেন পিকনিকে মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতে নয়। কেন মাঝরাতে তিনটে মেয়ে আপনার রুমে আসবে? এখানে কী আপনিই শুধু সুপুরুষ আর আমরা কাপুরুষ? আমাদের কাছে না এসে আপনার কাছে কেন গেল তাও মাঝরাতে?”

“একজন কথা বললে তার কথা শেষ না করা অবধি ওয়েট করাও একটা ভদ্রতা। যাই হোক, আমি কিন্তু আমার পুরো কথা শেষ করি নি। আর আমি সুপুরুষ কী না এর গল্প নাহয় আপনাকে আলাদাভাবে শুনাব। তখন যাচাই করে দেখবেন আমি আসলে কী!”

এই কথা বলে আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে শাওনের শার্টের কলার ঠিক করে স্বজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।থাপ্পড়ের শব্দে নীরাবতায় ছেড়ে গেল চারিপাশ। শাওন বাম গালে হাত দিয়ে
হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার হতভম্ব ভাব বাড়িয়ে দিয়ে আদিত্য পুনরায় আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল ডান গালে।
সাব্বির এসে আদিত্যকে ধরায় তৃতীয় থাপ্পড় খাওয়া থেকে বেঁচে গেল শাওন। তারপর আদিত্য দু’জন সাভেন্টকে ডেকে সর্বসম্মুখে জানাল আসল ঘটনা। গতরাতে সত্যি সত্যিই তার রুমে তিনটে মেয়ে প্রবেশ করেছিল। তবে সে রুম বুক করার আগে মেয়ে তিনটি ওই রুমে ছিল। হঠাৎ করে জরুরি তলবে তারা রুমে ছেড়ে চলে যায়। আর আদিত্য এসে প্রবেশ করে রুমটাতে। তখন তাড়াহুড়োয় একজনের হাতের ডায়মন্ডের
রিং ড্রয়ারে রেখে চলে গিয়েছিল। পরে খেয়াল করে হাতের রিং নেই। তখন ই বাসায় থেকে ছুটে আসতে আসতে রাত হয়েছে। মেয়েটারও মনে পড়ছিল না ঠিক কোথায় রেখেছিল রিং টা। রুমের দরজা খোলা বিধায় অনেকেই যাওয়ার সময় তাকাচ্ছিল এদিকে। পরে আরেকটা মেয়ে বিরক্ত হয়ে রুমের দরজা আঁটকে দিয়েছিল। আর দরজা আঁটকানো দেখেছে মেধা আর শাওন। অথচ সেই মুহূর্তে আদিত্যের রুমে দুইজন সাভেন্টসহ ওই তিনটে মেয়ে ছিল। মেয়েগুলো রিং পাচ্ছিল না তাই সময় নিয়ে খুঁজে তারপর ড্রয়ারে পায়। এবং এতক্ষণ
রুমে এলাও করার জন্য আদিত্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায়। সাভেন্টের মুখে একথা শুনে সকলে এবার মূল কাহিনি বুঝতে পারে। অদূরে বাসের বাকি ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে মুখ কাঁচুমাচু করে। তখন আদিত্য তাদের উদ্দেশ্যে বলল,

-“তোমরা আমার স্টুডেন্ট। অন্যা/য় করলে শাসন করার
অধিকার আমার আছে। বাসের ওই ঘটনায় কারণে তোমরা আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিলে কারণ তোমাদের শাসন করে ছিলাম। এজন্য একটা মেয়েকে সেন্সলেস করে আমার রুমে
রেখে আসতেও চেয়েছিলে। যাতে সকলের সামনে আমাকে অপদস্ত করতে পারো।”

আদিত্যর এই কথা শুনে শাওনসহ তার বন্ধুদের মুখ শুকিয়ে গেল। একথা আদিত্যের জানার কথা না তাহলে? শাওন ওর বন্ধুদের দিকে তাকালে বন্ধুরা না করল। অর্থাৎ তারা কিছুই বলে নি এ ব্যাপারে কিছু জানেও না। ওদের ভয়ার্ত মুখ দেখে তখন আদিত্যই হেসে জানাল,

-“তোমরা যেখানে বসে পরিকল্পনা করছিলে তার বিপরীত পাশে আমি বসে ছিল। গাছ আর পিলারের কারণে হয়তো দেখতে পাও নি। তবে এটা জ/ঘ/ন্য একটা কাজ করেছো।
এর শাস্তি অবশ্যই পাবে আর সেটা দিবে কলেজ কতৃপক্ষ। এখানে আর কোনো সমস্যা চাচ্ছি না আমি, আছি তো আর একদিন।”

একথা বলে প্রিন্সিপালের দিকে একবার তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করল আদিত্য। প্রিন্সিপাল হচ্ছে আদিত্যের বড় মামা। উনি জানেন ভাগ্নের রাগ সম্পর্কে। তাই ছেলেগুলোকে জানালেন ফিরে গিয়ে তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবহার করা হবে।সঠিক
প্রমাণের ভিত্তিতে আদিত্য নিরাপরাধ সাবস্ত হলো। উপস্থিত স্টুডেন্টরা আসল কাহিনি বুঝে শাওনকে ধীক্কার দিতে দিতে চলে গেল। তারপর স্যারদের তত্ত্বাবধানে বান্দরবানের কিছু
কিছু পর্যটক এলাকা বেড়ানো হলো, দেখা হলো, জানা হলো এবং খাওয়া হলো। আনন্দ উল্লাসে কেটে গেল আরো দুটো দিন। তারপর তারা ঢাকায় ফিরে কর্মব্যস্ত জীবনে পুনরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দিন চলতে থাকল রুটিনমাফিক। এরমধ্যে
আদিত্য আর মেধা র দেখা হলেও কথা হয় নি। চোখাচোখি হলেই দু’জনই দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিতো। বান্দরবনের একটা জায়গা ঘুরতে গিয়ে মেধা মাটিতে আদিত্যের ফোনটা রেখে অদূরে দাঁড়ানো সাব্বিরকে জিজ্ঞাসা করেছিল ফোনটা তার নাকি? তখন সেখানে আদিত্যও উপস্থিত ছিল। সে অবশ্য কিছু বলার আগে সাব্বির মেধা থেকে ফোন নিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দেয়। জানায় ওটা আদিত্যর ফোন অসাবধানতায় পড়ে গেছে হয়তো। সেদিনও আদিত্য মেধাকে কিছু বলে নি।
তবে যে কারণে ফোনটা রাখতে দিয়েছে তার উদ্দেশ্য সফল হয় নি। মেয়েটা পূর্বের মতোই জেদি আছে। হাতে ধরে কিছু না বুঝালে বুঝতেও চাই না। এদিকে প্রিন্সিপালের অনুমতি নিয়ে বেশ কয়েকজন স্টুডেন্ট আদিত্যের কাছে প্রাইভেট পড়তে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে স্টুডেন্টের সংখ্যা বাড়লেও মেধা কখনোই পড়তে আসবে না একথা তার অজানা নয়। এজন্য সন্ধ্যার দিকে হাঁটার নাম করে সে মেধার হলের দিকে গিয়েছিল।ভাগ্যক্রমে মেধা তখন ওষুধ আনতে বেরিয়েছিল।
ভর দুপুরে কলেজ থেকে ফেরার পথে ফুচকা খেয়ে নাতাশার পেট খারাপ হয়েছে। মিনিটে মিনিটে বেচারি পেট ধরে ছুটছে ওয়াশরুমের দিকে। একটুপরে বেরিয়ে এসে আহা/জা/রি
করে গালি দিচ্ছে ফুচকাওয়ালাকে। অবস্থা খারাপ দেখে সে এসেছে ওষুধ আর স্যালাইন নিতে নয়তো অবস্থা গুরুতর হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। তবে এভাবে আদিত্যের সামনে পড়ায় একটু ঘাবড়ে যায় সে। তখন আদিত্য বলে,

-”সারাদিন ঘুরেও পেট ভরে নি, সন্ধ্যার পর বাইরে কি?”
– “ওষুধ আনতে গিয়েছিলাম।”
-“কার?”
-”নাতাশার।”
-”ওহ।”
-”আগামীকাল থেকে পড়তে যাবে আমার কাছে।”
-”’কেন?”
–আমি বলেছি তাই।”
-”আপনি বললেই শুনতে হবে?”
-” না শুনলে হলে থাকা হারাম করে দিবো। একেবারে আমার বেডরুমে নিয়ে গিয়ে তুলবো। আশা করছি আমাকে পুনরায় পুরনো কাসুন্দি ঘেটে কিছু বলতে হবে না।”
-”সমস্যা কি আপনার? আপনি সব সময় কেন এমন করেন?
কি করেছি আমি? কি কারণে আমার পেছনে পড়ে আছেন?
ভালো আছি সহ্য হচ্ছে না আপনার? সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলেই তো এসেছে তাহলে….!”
-“আগামীকাল বিকাল চারটায় যেন আমার বাসা দেখি। এখন রুমে যাও।”
আদিত্য তার কথা শেষ করে ঘুরতে যাবে তখন মেধা অশ্রু ভেজা চোখে তাকিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলল,
-“তুমি কি আজীবন স্বার্থপরই থেকে যাবে আদিত্য?”
অনেকদিন পর এ “তুমি” ডাকটা শুনে আদিত্য থমকে গেল। পিছু ফিরে নিরুত্তর হয়ে চেয়ে রইল অশ্রুসিদ্ধ নেত্রে তাকিয়ে থাকা এক অভিমানিনীকে। যার কথার ভাঁজে ভাঁজে নীরব অভিমান ঝরে পড়ছে। যার চোখে স্পষ্টভাবে ভেসে উঠেছে
এক আকাশ সমান অভিমান। মেধাকে জবাবে আশায় তাকিয়ে থাকতে দেখে আদিত্য চমৎকার হেসে বলল,
– ” নিজের জিনিস আদায়ের ব্যাপারে আমি বরাবরই স্বার্থপর ছিলাম, আছি, আর তাই থাকব।”

To be continue……!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে