“গোধূলির নিমন্ত্রণ”
নূরজাহান আক্তার আলো
[০২]
পরেরদিন সকালবেলা মেধা কেবল ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।আজ আবহাওয়া ঠান্ডা ঠান্ডা। নীলাম্বরে ভেসে বেড়াচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ভেলা। বইছে মৃদুমন্দ বাতাস। সে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে নয়ন ভরে দেখছে সৌন্দর্য লীলা। রিসোর্টটা সত্যিই ভীষণ সুন্দর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও
বেশ নজরকাড়া। যদিও এখানে এসে আর রুমে থেকেই বের হয় নি সে। অতিরিক্ত ঘুমের কারণে ঘোরে দেখার ইচ্ছেও হয় না তার। এক ঘুমেই দিন পার করেছে। নাতাশা তার খাবার নিয়ে গিয়েছিল বলে পেটের টানে ঘুমের ঘরে খেয়েছিল। কী করবে? পেট তো আর কোনো কারণ বারণ শুনে না। একটু কম পড়লেই ছলাকলা শুরু করে দেয়। আর আদিত্য স্যার কী এক ওষুধ দিয়েছে খেয়ে ঘুম ছুটছে না চোখ থেকে। মনে হচ্ছে পৃথিবী উচ্ছ/নে যাক তাকে আগে ঘুমাতেই হবে, ঘুমই তার জীবন, ঘুমই মরণ, ঘুম ছাড়া এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বারণ।যদিও অতিরিক্ত ঘুমের কারণে এখনো চোখ মুখফুলে ঢোল হয়ে আছে। তবুও ভালো লাগছে মাথা হালকা লাগছে। শরীরটাও ফুরফুরে লাগছে। খচ্চর মাইগ্রেনের ব্যথাও ঘুমের চোটে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। তবে একটা কথা না বললেই নয় ওষুধটা বেশ ভালোই কাজ দিয়েছে। সময় করে আদিত্য স্যারের থেকে ওষুধের নামটা জেনে নিতে হবে। এসব কথা ভেবে সে আরো একটু সামনে এগিয়ে গেল। নাতাশা ভুশভুশ করে ঘুমাচ্ছে এত খুঁচিয়েও তাকে টেনে তোলা গেল না। তাই সে নিজেই একা একা ঘুরতে বেরিয়েছে। কতক্ষণ আর একা একা বসে থাকা যায়? হাঁটতে হাঁটতেই চেনা জানা অনেকের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে তার। স্বভাবসূলভ মিষ্টি হাসি হাসছে সে।
অনেকে ফোন হাতে নিয়ে নেটওয়ার্কের আশায় হাত এদিকে ওদিকে ঘুরাচ্ছে, কেউবা সেলফি নিতে ব্যস্ত। এসব দেখতে দেখতে সে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করল আদিত্য স্যার বাদে এখানে সব শিক্ষকরা উপস্থিত আছেন।এক স্থানে গোল হয়ে গল্প করছেন সবাই। মাঝে দম ফাটানো হাসিতে পেটে পড়ছে সকলে। রোজিনা ম্যাম বেশি হাসছেন যদিও তিনি অকারণে হাসেন বেশি। সাব্বির স্যারের টি-শার্টের একটা বোতাম নেই
দেখে এই নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে।কে কোথাও হানিমুনে যাবেন অথবা গিয়েছেন এসব গল্প চলছে একটার পর একটা। প্রিয় শিক্ষকদের এভাবে হাসতে দেখে মেধাও মুখ টিপে হাসল।
তখন আদিত্য স্যারের আগমন ঘটল। পূর্বের মতো ফিটফাট বেশে ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। পরনে মেরুন রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট। হাতে সিলভার রঙের হাতঘড়ি। চুলগুলো পূর্বের মতোই পরিপাটি। মেধাকে দেখে আদিত্য তার হাঁটার গতি কমিয়ে ফোন কেটে এগিয়ে এলো। অতঃপর পূর্বের মতোই গম্ভীরভাবে বলল,
– “ফোন কোথায় তোমার?”
– ”ফোনে চার্জ নেই তাই।”
-”চার্জ দেওয়ার কথা কী আমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে?”,
-” জি না।”
-”কতবার বলা লাগবে ফোন যাতে এক্টিভ থাকে? কথা কানে ঢুকে না নাকি পাত্তা দিতে ইচ্ছে করে না।”
-”আর হবে না।”
-”হবে না, হবে না, করে কম কিছু তো হওয়ালে না? হেডেক কমেছে?”
-”হুম।”
-”বেশি করে ফোনে চ্যাট করবা তাহলে হেডেক হবে না।”
-”খোঁচা না মারলেই কী নয়?”
-”সত্যি কথা যদি খোঁচা মতো লাগে তবে এর দায়ভার আমার নয়।”
-”আ আমি….!”
-“আমার ফোন দিয়ে বাসায় কথা বলে নাও। মামনি টেনশন করছে। আর ফোনটা তোমার কাছেই রেখে দাও সময়মতো চেয়ে নিবো আমি। আগ বাড়িয়ে বেহায়ার মতো ফোন দিতে
আসার প্রয়োজন নেই। আর কাউকে দেখানোর দরকার নেই আমি তোমাকে চিনি। কথা বোঝা গেল নাকি আবার বলতে হবে?”
-”লোকে দেখলে কি হবে?”
-”লোক দেখলে কী হবে তা তুমি ভালো করে জানো। এসবের ধার ধারে না আদিত্য। ”
-”আচ্ছা।”
অতঃপর আদিত্য সেখান থেকে চলে গেল আর সে আনমনে ফোন অন করতেই স্ক্রিণে ভেসে উঠল চেনা এক রাজপুত্রের ছবি। সেই রাজপুত্র আর কেউ নয় স্বয়ং আদিত্য। যাকে সে বর্তমানে স্যার বলে ডাকে, স্যার হিসেবে সন্মান করে। এখন তার পূর্বের ডাকটা ভাটা পড়েছে। পুরনো সম্পর্কে তিক্ত দুরত্ব বেড়েছে। ফিকে হয়ে গেছে খুনশুঁটিগুলো। কলেজের কেউই জানে না তারা পূর্বপরিচত, কোনো একটা সময় তাদের মধ্যে মিষ্টিমধুর এক সম্পর্ক বিদ্যামান ছিল। যদিও এখন নেই তাই ভেবেও লাভ নেই। এসব পুরনো কথা ভেবে সে পুনরায় সেই ছবিটি দেখে মুচকি হাসল। আদিত্যদের বাসার ছাদে ছবিটি তোলা আর ছবিটি তুলেছিল সে নিজেই। আর এই লোকটা বরাবরই গোছালো তবে ভীষণ একগুঁয়ে স্বভাবের। যখন যা বলবে তাইই করেই ছাড়বে। এই যেমন বতর্মানে সে নিজের অফিস ছেড়ে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষকতা করার। অথচ
সে একজন সফল বিজনেসম্যান। নিজের বিজনেসটা দাঁড় করিয়েছে অনেক পরিশ্রম করে। তাছাড়া সে যত টুকু জানে এই নিয়ে আদিত্যের বাসায় অশান্তিও হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
আদিত্যের বাবা দুটো অফিস সামলাতে না পেরে হিমশিম খাচ্ছেন। রাগে দুঃখে উনি আদিত্যের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। আদিত্যের ছোট ভাই আমান পড়াশোনায় ব্যস্ত। সে অফিসের আশেপাশেও ঘেষে না। কিছু করার কথা বললে সে বলে, আমি ছোট মানুষ এসব বুঝি না। আদিত্যের মা সীমা বেগম উনি থাকেন মর্জিমতো। যখন যা ইচ্ছে তাই করেন উনি। দুই সপ্তাহে যাবৎ ঘটকালি শুরু করেছেন। এক প্রকার জেদ দেখিয়ে ঘটকালিতে নেমেছেন তিনি। আর সেই ঘটকালি করছে নিজের বড় ছেলের জন্য। রুপবতী মেয়েরা সহ তাদের মায়েদের নাম ও ফোন নাম্বার, লিস্ট করেছেন।
ছেলে বাড়ি ফিরলেই উনি বিয়ের কাজ সেরে ফেলবে। অথচ
আদিত্য নিজের সিদ্ধান্তে অটল। সে বাড়ি যাবে না কলেজও ছাড়বে না।আর মেধা আদিত্যের ব্যাপারে এতকিছু জেনেছে কারণ তারা স্বা..,না, না, প্রতিবেশী। পুরনো কথা ভেবে মেধা
চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আদিত্যের ফোন থেকে ওর বাসায় কল দিলো। রোজকার মতো ফোন ধরেই তার মা ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে কথা বলছেন। বাবা নাকি কেবল অফিসে গেছে। আর একটু আগে কল দিলে বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারত। বাবা নাকি এতক্ষণ তার কলের অপেক্ষায় করছিল। একথা শুনে মেধার মনটা খারাপ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল না জানি বাবা কত কষ্ট পেলো। ফোনে চার্জ দিয়ে বাবার সঙ্গে একটু পরেই কথা বলে নিবে। তারপর সে আর কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে চুপ করে বসে রইল। সামনে বড় একটা পুকুর রয়েছে। সেখানে মাছরাঙা পাখি অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরঘুর করছে।
সে সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নজর রাখল আদিত্যের ছবির দিকে। সে কী জানে কলেজে তাকে নিয়ে কত কানাঘুষা হয়।
তার ড্যাসিং লুক আর পারসোনালিটি দেখে কুপোকাত হয় কত মেয়ে। এমনকি সে মেয়েদেরকে ক্লাস করাবে না একথা ঘোষনা হওয়ার পর, কত মেয়ে নিরাশ হয়েছে সেটা জানে?
হয়তো জানে। প্রথমদিন তাকে কলেজে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল। ভদ্রতাসূচক সালাম না দিয়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। এই সুযোগে আদিত্য তাকে অপমান করতে ছাড়ে নি। কলেজের স্যার হিসেবে আদিত্যের এন্ট্রি ছিল খুব সাদামাটা ভাবে। যেমনটা একজন শিক্ষকের হয় তেমনই। কিন্তু দ্বিতীয় দিন সে বুঝিয়েছিল, সে সাদামাটা ভাবে চললেও সে মোটেও সুবিধার নয়। আর এটা বুঝিয়ে ছিল কলেজের প্রবেশ গেটে বসে মেয়েদের বিরক্ত করা বখাটেগুলোকে দিয়ে। যদিও সে প্রথমে সুন্দর করে বলেছিল এখানে যাতে না বসে। কিন্তু ওর কথা গুরুত্ব না দিয়ে বখাটেগুলো পা-ওয়ার দেখাতে থাকে।
মেরে গুম করে দিবো, হ্যান, ত্যান বলে ভাষণ দিকে থাকে।
এদিকে তারও ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে তাই বেশি পটরপটর
করা ছেলেটাকে দু থাপ্পড় দিয়ে বলে, ”এবার কি করবি করে দেখা।”
তারপর ছেলেগুলো রেগে রাজনৈতিক এক নেতাকে ডাকে আদিত্যকে মারার জন্য। পরে নেতা এসে দেখে আদিত্যের
বড় মামীর ভাই সে। অতঃপর সেই নেতায় বখাটেগুলোকে
ইচ্ছেমতো শাসিয়ে গেটে বসতে নিষেধ করে দিয়েছে। পরে এই নিয়ে কানাঘুষা হলেও ব্যাপারটা এমনিতেই চেপে গেছে। এভাবে বেশ কিছুদিন চলতে থাকে। তারপর আদিত্য জানায় সে আর মেয়েদের ক্লাসই করাবে না। কিছু কিছু মেয়ে ভীষণ জ্বালাতন করে তাকে। প্রমাণসহ দেখানোর কারণে কলেজ কতৃপক্ষ বিবেচনা করে শুধু ছেলেদের ক্লাস শিক্ষক করেছে তাকে।
এইতো এভাবে দিন চলতে চলতে আদিত্যের আসা দুইমাস পেরিয়েছে। কলেজে পেরিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই আদিত্যের বাসা। এখানে আদিত্য আর সাব্বির ভাড়া থাকে। কলেজের যাতায়াতের সুবিধার জন্য বাসাটা নেওয়া। কলেজের স্যার
হলেও তাদের কথা হয় না বললেই চলে। ওর খোঁজ না পেয়ে আম্মু একপ্রকার বাধ্য হয়ে আদিত্যকে কল করেছে বিধায়
কথা হয়েছে। নতুবা আদিত্যও কথা বলার আগ্রহ দেখায় না আর ওরও প্রয়োজন পড়ে না। কি দরকার যেচে অপমানিত হওয়ার। সে এখন দূরের মানুষ দূরে দূরেই থাকুক। এভাবেই তার দিন পেরিয়ে যাবে,সময় ফুরিয়ে আসবে। আফসোসের ঘরে তালাবদ্ধ করেছে অনেক আগেই। যেদিন থেকে মানুষ
চিনতে শিখেছে, সত্য মিথ্যাের পাথক্য বুঝেছে। আর এসব বুঝেছে বলে বলেই ঢাকা এসে একা থাকছে। জেদ এতদূরে টেনে এনেছে, মনোবলও বাড়িয়েছে শতগুনে। নয়তো সেই আদুরিণী মেধা ঘরকুনো হয়ে ঘরেই পড়ে থাকত। চট্টগ্রামের মেয়ে হলেও সে বর্তমানে থাকছে ঢাকায়। কলেজের পাশেই নবীনা নামের একটা হলে থাকছে ছয় মাস যাবৎ। খাওয়ার সমস্যা হলেও মানিয়েছে নিজেকে। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও
সব সযে নিয়েছে, হিসেব করে চলতেও শিখেছে। পরিস্থিতি আর আত্মসন্মান আজ তাকে বড় বানিয়ে দিয়েছে।নিজেকে
তুচ্ছ ভাবাও ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। বাবার একমাত্র মেয়ে হওয়াতে বাবা কখনো এতদূর রাখতে রাজি নন। উনি চান, মেয়ে চট্টগ্রামে থাকুক নিজের বাসায় নিরাপদে থাকুক। সেখানকার কলেজে পড়াশোনা করুন, নিজের ক্যারিয়ার গড়ুক, ভালো থাকুক। কিন্তু মেধার জেদ সে ঢাকাতে থাকবে, আর এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে। বাসায় তার দমবন্ধ লাগে, কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যায় প্রতিনিয়ত সে। বুকটা জ্বলে অসহ্য এক যন্ত্রনায়। এসব কথা তো আর কাউকে বলতে পারে না সে। তাই পড়াশোনার অজুহাতেই দূরে পড়ে থাকে।
আর এসব কথা কেউ না জানলেও একটা মানুষ সব জানে।
আর জানে বলেই তাকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে ইঙ্গিতে
ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় তার দিকে।
মেধা যখন বসে বসে নিজের ভাবনায় বিভোর ছিল তখন নাতাশা দৌড়ে এলো। বড় করে হাঁ করে পরপর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-“আদিত্যে স্যার নাকি পারসোনালভাবে নিজের জন্য একটা রুম বুক করেছিল। গতরাতে সেইই রুমে একা রাত্রি যাপনও করেছেন। কে নাকি দেখেছে স্যার তার রুমে একটা মেয়েকে ঢুকিয়েছে। এই নিয়ে এখন ঝামেলা হচ্ছে। উঠ, চল, দেখ কী অবস্থা সেখানে।”
-”কয়লা ধুইলেও ময়লা যায় না” কথাটা কিন্তু একদম সত্যি তাই না রে?
-”এ্যাঁ? কীসব আবোল তাবোল বকছিস তুই? এখন উঠ চল আমার সাথে।”
-”না, যাব না আমি, ভালো লাগছে না আমার। ”
-”আশ্চর্য! যেখানে সবাই দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে সেখানে তুই যাবিই না বলছিস? চল না বা*।”
একথা শুনে মেধা কিছুক্ষণ থেমে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
-” যাব না কারণ এই ঘটনা আমি জানি, গতরাতে মেয়েটিকে আমিও উনার রুমে ঢুকতে দেখছি।”
To be continue…….!!