গৃহযুদ্ধ পর্ব-১৩

0
1304

#গৃহযুদ্ধ পর্ব ১৩
__________
________________

জানো রোহান ওরা আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছে।
অনেক বেশি!!
আমি অনেক ব্যাথা পেয়েছি পুরো শরীরে। আমাকে অনেক মেরেছে।
কথাগুলো শুনে আমার চোখ থেকে অজান্তেই পানির ফোঁটা টপটপ করে ঝড়ে পড়তে লাগলো। ওকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার শক্তিও চলে গেছে। মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছি।
সুপ্তির গায়ের সেই পুরোনো আদরমাখা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। জড়িয়ে ধরলাম ওকে, খুব শক্ত করে।
প্রাণভরে ওর ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে নিঃশ্বাস নিলাম। বহু পরিচিতো আলিঙ্গন।
কতদিনের চেনা অনুভূতি। বুকের হাড় ভেংগে মনে হয় হৃদয় বের হয়ে আসবে, এমন ভাবে ধুক ধুক করছিলো। কিছুক্ষন আগ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজের আমিকে বড্ড অচেনা লাগছে আমার। এত মায়াভরা, ভালোবাসা ভরা বুকটা শুধুমাত্র আমার জন্য,আর আমি সেটাকে অবহেলায় দূরে রেখেছি। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো।
ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
আমার শার্টের বুকের অংশটুকু ভিজে গেছে সুপ্তির চোখের পানিতে। অন্ধকারেও যেনো দেখতে পেলাম সুপ্তির দুচোখ বন্ধ।
মুক্তোর মত পানি গড়িয়ে পড়ছে ওর চক্ষুযুগল থেকে। সুপ্তির মাথার পেছনে থাকা চুলগুলোর ভেতরে আমার বা হাতের আংগুল গুঁজে দিলাম। এরপর আস্তে আস্তে ওর কোমল ঠোঁটে আমার ঠোঁট নামিয়ে দিলাম! কিছু কিছু গভীর চুম্বনের মাঝে শুধু কামুকতা থাকে না।
– সবকিছু ঠিক আছে,একদম কিচ্ছুই হয়নি, দুজন মানুষ একাকিত্বে এক-সত্তায় মিশে ছিলো আছে থাকবে, এ অনুভূতিরও প্রতিফলন ঘটায়।
সুপ্তির ঠোঁটে পরম মমতায় চুম্বন খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে রাখলেও, কল্পনায়, মস্তিষ্কের ক্যানভাসে ওর মুখচ্ছবিটা ঠিক ই ভাসছিলো, আমার কাছে সে মুখটা,এ পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী মুখ। সবথেকে নিষ্পাপ মুখ। সবথেকে বিশ্বস্ত মুখ।
“কে বলেছে পৃথিবীতে জান্নাত নেই?
এইযে পবিত্র ভালোবাসা, বিচ্ছেদের কষ্টের পর মিলনের আনন্দের মুহুর্ত কয়েক সেকেন্ডের জন্য কি পৃথিবীটাকে জান্নাত করে তোলে না!
এখন মনে হচ্ছে গত কিছু দিন,খুবই অভাবে ছিলাম, ভালোবাসার অভাবে। অমন একাকিত্বের ভয়ানক দিনগুলোতে আর ফিরে যেতে চাইনা।
স্ত্রীর ভালোবাসা হলো ছেলেদের জন্য শক্তি।একইভাবে
স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, ছেলেদের দুর্বলতার।
মানুষ পরিবর্তনশীল।
সে সবথেকে বেশি পরিবর্তন হয় প্রেমে পড়ার পরে,ভালোবাসায় আবদ্ধ হওয়ার পরে। ভালোবাসা বিষয়টা, একজন মানুষকে ভীতু করে তোলে।
যে ছেলেটা রগচটা, পাড়ায় পাড়ায় মারামারি করে বেড়ায়, সেও একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হলে হুট করেই বদলে যায়৷
যদি তার জন্য তার ভালোবাসার মানুষের প্রতি কোনো আঘাত আসে?
যদি কটু কথা শুনতে হয়? যদি অপমানিত হতে হয়?
এ ভয়ে তারা ভীতু হয়ে ওঠে। ভদ্র হয়ে ওঠে।
যে ছেলেটা অতি দ্রুত বেপরোয়া গতিতে বাইক চালায়, সেও প্রকৃত ভালোবাসা খুঁজে পেলে, তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে খুব সাবধানে চলাফেরা করে। কোন বিপদ তাদের মাঝে হুট করে যেন এসে না পরে।
মাঝে মাঝে কিছু ছেলেকে দেখা যায়, পেছনে সো কল্ড প্রেমিকা নিয়ে খুব দ্রুত গতিতে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে, রিকশার পাশে নিজের প্রেমিকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে রিকশাওয়ালার সাথে বাজে ব্যবহার করছে, এদের ভালোবাসার গভীরতা ঠিক কতটুকু তা খুব করে জানতে ইচ্ছে করে।
এদের মাথায় এটুকু চিন্তা কি থাকেনা? বাইকটা কোনো কারণে কাত হয়ে গেলে পেছনে থাকা মানুষটার কি হবে?
কিংবা রিকশাওয়ালাটা চলে যাওয়ার সময়,মনে মনে হলেও ওকে কিংবা ওর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে একটা বাজে মন্তব্য করে যেতে পারে,
নিজের ভালোবাসার মানুষের প্রতি সম্মান থাকলে, ছেলেরা আসলেই ভীতু হয়ে যায়৷
কিন্তু এই ভালোবাসার মানুষটির যখন কোন কারণে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন এসব নিরব, ভীতু ছেলেগুলোই হয়ে ওঠে সবথেকে ভয়ানক, সবথেকে হিংস্র।
সুপ্তির ভালোবাসা আমাকে বদলে দিয়েছিলো খুব,আমি আমার পাস্ট, আমার অতীত ছেড়ে সুপ্তির ভালোবাসাতে ডুব দিয়েছিলাম। নিজেকে পরিবর্তন করেছি। আমার নিজের পূর্বের পরিচয়টাই ভুলেই গেছি একেবারে।
কিন্তু সুপ্তির অনুপস্থিতিতে,ভালোবাসার অভাবে আমি আবার ফিরে গেছিলাম আমার অন্ধকার অতীত-রাজ্যে৷
যে হাতে সুপ্তির জন্য ভালোবাসার গোলাপ থাকতো, সে হাত ভরে উঠেছিলো তাজা রক্তে। যে নাক সুপ্তির দেহে ভালোবাসার গন্ধ খুঁজে পেত, সে নাকেই শুঁকতে হয়েছে তাজা রক্তের গন্ধ।
কি ভয়ানক সময়ের ভেতর থেকে কেটেছে আমার দিনগুলো।
ভুলে যেতে চাই সব।
সুপ্তিকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেই৷
শুধু বলি,মাঝের কিছু দিনের কথা আমি ভুলে যেতে চাই।
না তুমি মনে করবে, না আমি।
সুপ্তি মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। ওকে বলি,
আমার দিকে তাকাও, সুপ্তি আবছা অন্ধকারে আমার দিকে তাকায়,
– একটা হাসি দাওতো।
বলার একটু পরেই
ফিক করে হেসে ফেলে ও।
মনে হলো মনে জমে থাকা দুঃখ কষ্ট সব চলে গেছে বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে। ভালোবাসার বৃষ্টিতে। বেশ অনেক ক্ষন পরে আমরা একসাথে আমাদের রুম থেকে বের হলাম। আমাদের মাঝের সব দুরত্ব দূর হয়ে গেছে। অবশ্য একটা কথা আপনাদের বলে নেই। যদিও এটা গোপন করা আমার উচিৎ ছিলো,
তাও আমার পেট পাতলা স্বভাব, কিছু গোপন করতে পারিনা।
যাই হোক, সুপ্তি আমাকে মণিকা ভাবীকে নাম ধরে ডাকার জন্য এবং তাকে সুন্দর বলার জন্য ৫০+৫০ ১০০ বার কান ধরে উঠবস করিয়েছে।
অন্ধকারে দ্রুত কান ধরে ওঠা বসা করে নিয়েছি। কেউ দেখেওনি,কেউ জানেওনা৷ হিহি।
বেডরুম থেকে বাইরে এসে দেখি রেশমি ড্রয়িং রুমে নেই। ও বারান্দায় দাঁড়ানো। আমি সুপ্তিকে বললাম, সুপ্তি তুমি এখানে থাকো। আমি নিচে গিয়ে ঠান্ডা কিছু নিয়ে আসি।বলে ওর কপালে চুমু খেয়ে শার্ট নিয়ে দ্রুত নিচে চলে আসলাম।
আমার সন্দেহ সত্য হলো। নিচে এসে দেখি চাপ দাঁড়িওয়ালা ফর্সা, লম্বা একটা ছেলে বাসার সামনে দাঁড়ানো। মণিকা যে বারান্দায় দাঁড়ানো তার ঠিক নিচেই৷ ছেলেটা উপরের দিকে তাকিয়ে ফোনে কথা বলছে। দেখে চুপচাপ ওখান থেকে চলে আসলাম।
ছেলেটা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া আমার জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে।
রাতে মণিকা ভাবীর দাওয়াত গ্রহণ করে গেলাম তার বাসায় খেতে।
রেশমি ও সুপ্তি প্রথমবারের মত মণিকা ভাবীর বাসায় গেলো। বারান্দায় ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। বেশ সুন্দর করে সেজেছেন মণিকা ভাবি৷
আমি মণিকা ভাবীর দিকে তাকালেই আমাকে আড়চোখে রাঙানী দিচ্ছে সুপ্তি।
ডিনারে দেখলাম সবার জন্য খাবারের প্লেটের সামনে ছোট ছোট ডিশে আলাদা আলাদা ভাবে সবকিছু রাখা আছে। চেয়ার টেনে সাদর আমন্ত্রনে তিমি রেশমিকে বসালেন।
এরপর সুপ্তিকে। এরপর আমাকে বসিয়ে আমার পাশে বসলেন তিনি। কারো কিছু লাগবে কিনা তার তদারকি করছে ফুলী। ফুলীকেও আমাদের সাথে খেতে বসতে বলায়, ফুলী জানালো সে আগেই পেটপুরে খেয়ে নিয়েছে। মিষ্টি ভাষায় ছোট একটা ভাষন দিলেন মণিকা ভাবি,
তার বক্তব্যে খুবই রুচিশীলতা ফুটে উঠলো।
ফর্মালিটি শেষ করে সবাই খেতে বসলাম, অনেক দিন পর মোমের আলোতে সুপ্তিকে দেখছি! অপূর্ব, মনে হচ্ছে মহাকাব্যিক কোন দেবী। ওর দিক থেকে চোখ ফিরছেনা। আমি যে একনজরে ওর দিকে তাকিয়ে আছি বিষয়টি মণিকা ভাবি হয়ত খেয়াল করেছে। হঠাৎ তার দিকে চোখ পড়ায় দেখলাম তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
রেশমি হাসি দিয়ে বললো,
না না মণিকা ভাবী আপনাকেও আমরা দেখছি৷ আপনার রূপে আমরা মুগ্ধ, রোহান একটু তাকাও ভাবীর দিকে। কত সুন্দর করে সেজেছেন। আমি ছেলে হলে তো ক্রাশ খেতাম।
মণিকা ভাবির গায়ে কথাগুলো লাগলো বোধ হয়,
তিনি রেশমির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন,
ক্রাশ খেতে হবে না, আপাতত খাবার খাও,কেমন?
সবাই হাত ধৌত করে প্লেটে খাবার নিলাম। সবার আগে সুপ্তি খাবার মেখে আমার মুখে তুলে দিলো। আমিও ওর মুখে এক লোকমা তুলে দিলাম৷
মণিকা ভাবি মুখ ছোট করে বললো, রোহান, কিছু লাগলে আমাকে বলো, ঠিক আছে?
আমি বললাম আচ্ছা।
সুপ্তি খাবার মুখে দিয়ে বললো, ভাবি, অপূর্ব, এত ভালো রান্না আমি জীবনে খাইনি। সত্যি অসাধারণ।
খাবারের স্বাদ আমার কাছেও ফাটাফাটি লাগলো।
ফাটাফাটি, মারাত্মক, অতুলনীয় সবকিছুর উপমা এক করেও হয়ত ভাষা দিয়ে খাবারের স্বাদের অনুভূতি প্রকাশ করা যাবেনা।
আইটেম ও ছিলো অনেক।
হাসের মাংসের ভূনা, ডিমের কোরমা, চিকেন রোস্ট, চিংড়ির মালাইকারী- দো পেয়াজা, গরুর মাংসের কালোভূনা,ইলিশ মাছের পাতুরি, রুইয়ের কোফতা কারী, ইলিশের ডিম, পোলাও, সাদা ভাত, পায়েস কি নেই আইটেমে!
এত কিছু খাবার দেখেই তো পেট ভরে যাওয়ার কথা,
আমি ও সুপ্তি একপাশ থেকে খাচ্ছি, এবং সুপ্তি ভাবীর প্রশংসা করেই যাচ্ছি। রেশমি দেখলাম অনেকটা চুপচাপ, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সামথিং ওয়াজ রং।
হঠাৎ করেই ও চিৎকার দিয়ে ওঠে!
ও মা গো! আমার জীভ পুড়ে গেলো!
ঝাল! ঝাল! টেবিলের ওপর থেকে পায়েস নিয়ে কতখানি পায়েস খেলো, তাতেও ঝাল কমলো না! বরং ওর ছটফটানি আরো বেড়ে গেলো। ও দৌড়ে মণিকা ভাবীর রুম থেকে বের হয়ে গেলো। এমনটাতো হওয়ার কথা না। আমাদের খাবার তো ঠিক ই আছে৷ হঠাৎ এমন একটা ইন্সিডেন্স ঘটলো! এত স্বাদের খাবারগুলো রেখে যেতে মন চাচ্ছে না। এর মধ্যে সুপ্তি দৌড়ে চলে গেলো রেশমির পেছনে পেছনে। আমি বসে রইলাম। সুপ্তি ভাবি দেখি চোখমুখ টান টান করে অন্য দিকে চেয়ে বসে আছে। আমার দিকেও তাকাচ্ছে না। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম রেশমির বিষয়টায় সে খুব মজা পেয়েছে। খুব কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে। আমার দিকে না তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মণিকা ভাবী বললো,
রোহান তুমি বসো। আমি একটু আসছি। বলে সেও উঠে চলে গেলো।
আমি আর কি করব! বসে বসে খেতে লাগলাম।
একটু পর দেখি ফুলী আসলো হাসতে হাসতে। এসে বললো, কি হয়েছে মণিকা আফার?
আমি বললাম, জানিনাতো।
ফুলী হাসতে হাসতে বললো, মণিকা আফা বাথরুমের দরজা আটকে জোড়ে জোড়ে পাগলের মত হাসতেছে। আমি মুখে খাবার চিবুচ্ছিলাম। ফুলীর কথা শুনে হাসতে গিয়ে মুখ থেকে সব খাবার বের হয়ে পড়লো! মণিকা ভাবীর বিষয়টা কল্পনা করেই প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে আমার।
.
.
.
রেশমির জিহবা ফুলে উঠেছে। ও কথাও বলতে পারছেনা। জিহবা কালো হয়ে গেছে পুড়ে। মণিকা ভাবীর চেহারা নিয়ে কথা বলার শাস্তিটা রেশমিকে এভাবে দেয়াটা ঠিক হয়নি।
ও যন্ত্রনায় ছটফট করছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে দিলাম রেশমিকে।
সুপ্তির জন্য চা বানিয়ে আনলাম।
রেশমি ঠান্ডা পানি এবং সুপ্তি চা খেয়েই গভীর ঘুমে অজ্ঞান হয়ে গেলো।
দুজনের পানীয় এর সাথেই আমি মিশিয়ে দিয়েছি হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ এটিভেন-১।
আমার ঠোঁটের কোণায় বাঁকা এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।
ঠিক ডেভিলরা যেভাবে হাসে।
.
.
.
চলবে…
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে