গৃহযুদ্ধ পর্ব-০৬

0
1365

#গৃহযুদ্ধ পর্ব ৬
_________
____________

উদ্ভ্রান্তের মত রাস্তার উপর দিয়ে ছুটে চলেছি।কি করবে বুঝতে পারছিনা। সুপ্তি হুট করেই কোথায় উধাও হতে পারে। একমাত্র উপায় থানায় জিডি করা। সিসিটিভি ক্যামেরা অনুসন্ধান করলেই বোঝা যাব্ব সুপ্তি কোথায়! কিন্তু সেটাও তো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকলাম উদ্দেশ্যহীন। মণিকা ভাবীকে যেখানে ভর্তি করা হয়েছে, সেখানে,সুপ্তির অফিসের সামনে বাসার সামনের রোডে, সব জায়গায় খুব ভালোভাবে খোঁজ নিলাম। কোথাও কেউ সুপ্তিকে দেখেনি
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলো। শাহবাগ থানায় সুপ্তির নিঁখোজ হওয়ার ব্যপারে একটা রিপোর্ট লেখালাম।
মনটা খুব বিষন্ন হয়ে আছে৷ জীবনে কখনো সিগারেট মুখে নেইনি। তাও আজ একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে হেঁটে চলেছি। মাথা বেশ হালকা লাগছে।
সন্ধ্যার একটু আগে এসে পৌঁছালাম গ্রীন-লাইফ হাসপাতালে, দূর থেকে মণিকা ভাবীকে দেখলাম, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। অনড় হয়ে শুয়ে আছে সে।
তাদের বাসায় কাজ করা মেয়েটি সারাদিন না খেয়ে ইমার্জেন্সি রুমের দরজার সামনেই বসে আছে।
ওকে কিছু খাবার কিনে দিলাম। ডাক্তাররা জানালেন মণিকা ভাবীর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মোটামুটি ভালো অংকের টাকা লাগবে। আমি ডাক্তারদের সব খুলে বললাম, যে আমি ভাড়াটিয়া৷ উনি এক্সিডেন্ট করেছেন ওনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। এটুকুর বেশি কি ই বা করতে পারি৷
প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তাররা একটু অর্থলোভী হয়ে থাকে। তারা বললো, দু-দিনের বিল ডিউ পরে গেলে আমরা রোগীকে আর সার্ভিস দিতে পারবো না৷
সবকিছু শুনে মনে হচ্ছে মাথায় আমার আকাশ ভেংগে পড়লো। ওনার বাসার মেয়েটাকে সাথে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
পলাশও বেশ মনমরা হয়ে আছে। ওর বোনের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা, বিষয়টা ওকেও কষ্টদায়ক পরিস্থিতিতে ফেলেছে।আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ও কান্না করছে।
হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে ফ্লোরের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। মাথায় খাঁ খাঁ শূন্যতা।
সন্ধ্যার একটু পর হবে হয়ত সময়টা।
টুং-টাং করে বাসার কলিং বেল বাজলো। হুট করে মনে হলো দেহের শব রক্তগুলোতে একটা তুফান বয়ে গেছে।
দৌড়ে দরজার কাছে গেলাম। আমার সাথে দৌড়ে আসলো পলাশ ও। দ্রুত দরজা খুলতেই নিরাশ হতে হলো আমাদের।
আমার সামনে স্যূটেট ব্যুটেট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ স্মার্ট একজন ভদ্রলোক। দেখে মনে হচ্ছে হয়ত মণিকা ভাবীর কোন আত্মীয় হবে।
আশা করেছিলাম সুপ্তিকে দেখতে পাব।কিন্তু সে আশায় তো গুড়ে-বালি।
জিজ্ঞেস করলাম কাকে চাচ্ছেন?
লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
জ্বী সুপ্তির খোঁজে আসছিলাম। ও বাসায় আছে? আসলে ওকে ফোনে পাচ্ছিলাম না তো তাই খোঁজ নিতে চলে আসলাম।
ভ্রু কুঁচলে গেলো আমার।
জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার পরিচয়?”
– আমি সুপ্তির ডেন্টিস্ট। ওর দাঁতের সমস্যার জন্য আমার এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলো৷
– ওহ, আচ্ছা। ও বাসায় নেই৷
– আচ্ছা। ও কখন আসবে?
– জানিনা। আসলে আপনার সাথে যোগাযোগ করতে বলব।
লোকটার হাসি মুখ খানা চুপসে গেল। এক হাতে করে পেছনে লুকিয়ে রাখা একটা গিফট বক্স টা সামনে এনে সেটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। ওনার ভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছিলো অনেক আশা করে গিফট বক্স টি নিয়ে এসেছেন উনি। সেটা সুপ্তিকে না দিতে পারায়৷ বক্সটির কোন ভ্যালু ই রইলো না তার কাছে।
উনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
.
.
.
পলাশকে বাইরে থেকে খাবার এনে দিলাম। ও খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত তখন দশটা। বাসা থেকে বের হয়ে মণিকা ভাবীদের বাসার কলিংবেল বাজালাম দরজা খুলে দিলো ছোট্ট মেয়েটি।
অনুমতি না নিয়েই ভেতরে ঢুকে গেলাম। সোজা চলে গেলাম একেবারে বারান্দায়।
যতদূর জানি, এ মেয়েটি ফুল বেশ পছন্দ করে। এজন্য ওকে মণিকা ভাবী আদর করে ফুলি ডাকে।
আমিও একই নামে ওকে ডাকলাম,
এই ফুলী,
এদিকে আসো।
ফুলী মন খারাপি চেহারা নিয়ে আসলো আমার কাছে।
ওকে বললাম, কড়া করে দু কাপ চা বানিয়ে আনতে।দুধ চা।
ফুলি চলে গেলো।
প্রথমে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে নিলাম। পায়ের উপর পা ফেলে
রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে সিগারেটে বড় একটা টান দেই।
ধোয়াগুলো বাতাসে ছেড়ে দিতে দিতে ভাবি, সিগারেট খাওয়ার ও একটা আর্ট আছে। এমন আয়েশ করে সিগারেট খেতে খেতে অনেক কিছু চিন্তা করে ফেলা যায়।
চিন্তা করা খুব কঠিন একটা কাজ।
সবথেকে বেশি চিন্তা করে ভিক্ষুকরা। তারা নির্দিষ্ট একটা জায়গায়, পুরানো প্লেট নিয়ে আয়েশ করে বসে একটা নির্দিষ্ট চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়। তারা জ্ঞানীগুণী মানুষের চেয়েও বেশি চিন্তা করে। দেশের জটিল সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে, এই যেমন হঠাৎ করে ওভারব্রিজ ভেংগে পড়লে কতজন মানুষ আহত হবে, কতজন মারা যাবে, কারো পকেট থেকে মানিব্যাগ বা মোবাইল ছিটকে পরে যাবে কিনা। যদি এমন কিছু হয় তাহলে আজ নিশ্চয়ই বাড়তি ইনকাম হবে।
এরকম মহাজাগতিক চিন্তা করতে করতে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা সময় পার করে দেয়,তাদের বোরিং লাগেনা। ভিক্ষুকদের পরে সবথেকে যারা বেশি চিন্তা করে তারা হচ্ছে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকা মানুষ।
আমি এখন তাদের দলে।
সুপ্তির বিষয়টি আমার কাছে ক্লিয়ার না।
ওর দাঁতে কোন সমস্যা নেই। তাহলে ডেন্টিস্ট এর কাছে কেনো গেলো!
সুপ্তি ক্যান্টিনে সিংগাড়া খেতে যাওয়ার আগেও আমাকে বলে যায়।
সেখানে একজন ডেন্টিস্ট এর কাছে গিয়ে ট্রিটমেন্ট নিয়ে আসলো,
আমাকে জানালো ও না কিছু!
আবার আমাকে কিছু না জানাক,
ঐ ডাক্তার কেনো সুপ্তিকে খুঁজতে বাসা পর্যন্ত চলে আসবে? তাও হাতে একটা গিফট বক্স নিয়ে?
মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
ফুলী চা বানিয়ে এনেছে।
ওর বানানো চায়ে চুমুক দিলাম।
মণিকা ভাবীর মত পারফেক্ট বলা না গেলেও চলে আরকি।
ফুলীকেও বললাম আমার সামনের রকিং চেয়ারে বসে চা খেতে। কিন্তু ও কখনো রকিং চেয়ারে বসেনি। তাই আমার সামনে ফ্লোরে বসে চা খেতে লাগলো।
ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
তোর মণিকা আপার কি কোনো আত্মীয় স্বজন নেই?
ফুলী জবাব দিলো,
– আমি এইখানে আছি তিন বছছোর,
এর মধ্যে কাউরে আইতে দেখিনাই ভাইজান।
– ওনার চিকিৎসার জন্য তো টাকা পয়সা লাগবে৷কিভাবে কি করব বুঝছি না।
– ভাইজান, আফাজানে আলমারির চাবি কই রাখে আমি জানি। আপনে আলমারি খুলে টাকা বের কইরা নিয়া ডাক্তারগো বিল দিয়া দেন।
– কি বলো! তুমি চাবির খোঁজ জানো?
– হ,ভাইজান জানি।
মনে মনে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেল তবে। মণিকা ভাবীর চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে তাহলে আরা ভাবতে হবেনা।
সুপ্তির বিষয়টা আমার কাছে ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে।
অফিস থেকে কোন বিষয়ে নালিশ আসার কথা বলেছিলো আমাকে সুপ্তি।
সবকিছু যোগ দিয়ে ফলাফল বের করতে মহাপুরুষ টাইপ চিন্তাভাবনা করা দরকার।
এজন্য আগে আমাকে রিল্যাক্স হতে হবে।
ফুলিকে মাথা টিপে দিতে বললাম।
ফুলি হালকা সরিষা তেল হাতে মেখে মাথা টিপে দেয়া শুরু করলো।
রিল্যাক্স হতে হতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম ঠিক নেই। হঠাৎ দমকা বাতাস এসে গায়ে ধাক্কা দিতেই ঘুম ভেংগে গেল।চারদিকে তাকিয়ে বুঝলাম সকাল হতে আর একটু সময় বাকি। ফুলি সোফার উপরে ঘুমিয়ে আছে। মোবাইলে বেশ অনেকগুলো কল এসেছে আমার। সবগুলো সুপ্তির নম্বর থেকে। তার মানে পলাশ ফোন দিয়েছে।
দ্রুত দরজা খুলে চলে গেলাম আমার নিজের বাসায়। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুললো পলাশ।
জিজ্ঞেস করলো, আমি কোথায় ছিলাম?
ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই ও নিজেই বললো,
আপনাকে কতবার কল করেছি!
একটু আগে আপু এসেছিলো।
তার ঠোঁট, গাল,কপালে অনেক দাগ দেখেছি, মনে হচ্ছে কেউ খামচি দিয়েছে এমন। প্রচন্ড কান্না করছিলো আপু। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা ব্যাগে কিছু জামাকাপড় নিয়ে আপু আবার চলে গেছে।
বুকের মাঝে কামড় দিয়ে উঠলো।
আমার ভালোবাসার কলিজাটা বাসায় এসেছে, আবার চলেও গেছে। আমাকে কিচ্ছু জানালো না। কি হয়েছে ওর এটাই আমি ভেবে পাচ্ছি না।
ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় নিজে কিছুক্ষন জোড়ে জোড়ে আঘাত করি।
গ্রীন-লাইফ হাসপাতাল থেকে কল এসেছে।
মণিকা ভাবীর জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু ঘোরের মাঝে সে নাকি রোহান রোহান বলে কাতরাচ্ছে।
ডাক্তাররা ফোন করে দ্রুত আমাকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য বললো।
.
.
.
চলবে…
লেখকঃ
হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে