গৃহযুদ্ধ পর্ব-০৫

0
1437

#গৃহযুদ্ধ পর্ব ৫
__________
______________
কাঁধে সুপ্তির হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলাম। আমার হাতে তখন মণিকা ভাবীর ডায়েরিটা ধরা।
কি করব বুঝতে না পেরে পেছন ঘুরে সুপ্তির দিকে তাকালাম।
সুপ্তি আমার চোখে চোখ রেখে বললো, পলাশ ঘুমিয়ে গেছে।
তোমার মানিব্যাগে একটা চিরকুট পেলাম।
কে দিয়েছে এটা?
মনে মনে বললাম -শিট!!
পলাশকে আইসক্রিম ও চকলেট কিনে দেয়ার জন্য মণিকার হাতে পুরো মানিব্যাগটাই ধরিয়ে দিয়েছিলাম আমি। টাকা দেয়ার সময় হয়তও মণিকা ভাবীর দেয়া চিরকুটটা দেখে ফেলেছে।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে সুপ্তি আবারো জিজ্ঞেস করলো,
বলো কে দিয়েছে এই চিরকুট!
উত্তরে জানালাম মণিকা ভাবী দিয়েছে।
মণিকা ভাবী! তোমাকে চিরকুট দিয়েছে,সেটাও আবার লিখেছে আমার রান্নার হাত ভালো না!
আমাকে নিয়ে তার মাথাব্যথা কেনো?
আর তুমি ই বা তাকে কিছু বলোনি কেনো!
তড়িঘড়ি করে কি বলবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসলো।
বলে দিলাম, উনি আজ ই এটা আমাকে দিয়েছেন।তাও দুপুরবেলা। আমি তোমাকে দেখাব বলেই মানিব্যাগে রেখেছি। কিন্তু বাসায় ফিরে তুমি তো পলাশকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলে তাই সময় পাইনি।
যেখানে সুপ্তির চোখে নিভু নিভু আগুন ছিলো এতক্ষন, সেখানে দেখা দিলো একগুচ্ছ অনিশ্চয়তার ছাপ। যেটাকে বলে কনফিউজড।
ওর চোখ চলে গেলো আমার হাতের ডায়েরির দিকে,
জিজ্ঞেস করলো, কি এটা?
উত্তর দিলাম,এটাও মণিকা ভাবীর ই ডায়েরি। উনি আমাকে ডায়েরি এবং চিরকুট একসাথেই দিয়েছেন।
সুপ্তি আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে ডায়েরিটা নিয়ে গেলো।
দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের রুমে ঢুকে ধপাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আমার বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ করে কাঁপন ধরেছে। কি করবো বুঝতে পারছিনা। এমন সময়ে আসলো মণিকা ভাবির ফোন।
তার ফোন-কল দেখে সত্যি ই অনেক বিরক্ত লাগছিলো তখন।
তাও কি মনে করে যেন ফোনটি ধরলাম,
ফোন ধরার পর ওপাশ থেকে ভেসে আসলো একটা মোলায়েম কন্ঠস্বর,
– রোহান,
তুমি কি আমার ডায়েরিটা পড়েছো?
– না ভাবি,
– তুমি আমাকে ভাবী না বলে মণিকা বলেই ডেকো। তোমার মুখে আমার নামটা বেশ সুন্দর শোনাবে।
আমি নিরব রইলাম।
উনি আবার বললেন,
তুমি কি আমার ডায়েরী পড়োনি রোহান?
একটু সময় কি হয়নি তোমার?
– না,আসলে কাজে অনেক প্রেসার যাচ্ছিলো।
– কি কাজ করো তুমি? সব কাজ বাদ দিয়ে দাও।
– আমার সংসার চলবে কিভাবে!
– সংসার! এ যে এক মিথ্যে বাঁধন। সংসারে আবদ্ধ থেকে কি লাভ বলো! বরং নিজের ভালোলাগায় গা ভাসিয়ে দাও প্রিয়। শান্তি খুঁজে পাবে। তোমার টাকা পয়সায় সমস্যা হলে তুমি আমার কাছ থেকে নিও।
আমি ওনার এ কথাগুলো শুনেও নিরব রইলাম,
উনি পুনরায় বলতে লাগলেন,
ডায়েরিটা হাতে নাও,
প্রথম দিকের কথাগুলো একান্ত তোমাকে ভেবেই লেখা। ঠিক চার নম্বর পৃষ্ঠায় একটা কবিতা আছে। তুমি কি কবিতাটা আমাকে পড়ে শোনাবে?
– আমি আবৃত্তি করতে পারিনা, আর তার থেকেও বড় কথা হলো…
উনি আমাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই বললেন,
তোমার গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর আমার কাছে খুবই আকর্ষনীয় লাগে রোহান। আমাকে কবিতাটি পড়ে শোনাও।
কিছু একটা বলতে যাব এর মাঝেই মণিকা ভাবীর বিকট চিৎকার শুনতে পেলাম। ফোনের ওপাশ থেকে তো পেলাম ই আমার বাসা থেকেও ওনার চিৎকারের কন্ঠস্বর শোনা গেলো। ফোনের লাইনটাও কেটে গিয়েছে। কি হয়েছে জানার জন্য মণিকা ভাবীকে আবারো কল করলাম, ফোন সুইচড অফ। একটু পর শোনা গেলো দরজায় ধুপ ধাপ কিল ঘুষি পড়ার শব্দ। এত জোড়ে শব্দ হলো যে সুপ্তিও দৌড়ে দরজার সামনে চলে এলো।
দরজা খুলে দিতেই ভাবীর বাসার ছোট্ট মেয়েটার দেখা, আমাকে দেখে বললো, স্যার স্যার, মণিকা আপা কথা বলতে বলতে সিঁড়ি থেকে নিচে পড়ে গেছে। তার আর হুঁধ আইতেছে না। মাথা থেকে রক্ত পড়তাছে, আপনে একটু তাড়াতাড়ি আহেন।
ওর কথা শুনে আমি ও সুপ্তি দুজনেই দৌঁড়ে গেলাম। দেখতে পেলাম উনি বাসার সামনের সিঁড়ির নিচের অংশে পড়ে আছেন। পাশে পরে আছে একটা কফির কাপ।
ফ্লোর রক্ত এবং কফিতে মাখামাখি হয়ে আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছেনা ঠিক কোথা থেকে রক্ত বের হয়েছে, হয়ত মাথা ফেঁটেছে কোথাও দিয়ে। দ্রুত ইমার্জেন্সি এম্বুলেন্সের নম্বরে ফোন দিলাম আমি।
মিনিট দুয়েকের মাঝেই এম্বুলেন্স চলে আসলো।
মণিকা ভাবীকে দ্রুত ওঠানো হলো এম্বুলেন্সে। তার মাথা থেকে তখনও টপ টপ করে রক্ত ঝড়ছে। সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিউএ কান্না করছে।
ভয়ে একপাশে জড়োসড়ো হয়ে আছে। মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা দেখে সুপ্তি প্রচন্ড ভয় পায়।
মণিকা ভাবীকে এম্বুলেন্সে উঠানোর পরে সুপ্তিকে বললাম আমি ওনার সাথে যাবো? হাসপাতালে? সুপ্তি কান্না করতে করতেই বললো, না তুমি বাসায় থাকো। পলাশকে দেখো,আমি ওকে( মণিকা ভাবীর বাসার ছোট মেয়েটাকে)
নিয়ে যাচ্ছি।
ওর কথার সাথে আমি দ্বীমত পোষন করলাম না। ওরা দুজনে মণিকা ভাবীকে নিয়ে হাপতালের উদ্দেশ্যে চলে গেলো৷
অনেকটা বিষন্ন মনে বাসায় ফিরে আসলাম। ফেরার সময়ে পরে থাকা কফির মগ, তরল রক্ত এবং কফির দিকে বেশ অনেক্ষন তাকিয়ে ছিলাম। জানিনা কেনো যেন আমারো খুব করে কান্না চলে আসছিলো,
বাসায় ফিরে দেখি পলাশ ওর বোনের ফোন নিয়ে গেমস খেলছে।
সুপ্তি ফোন না নিয়েই চলে গেছে তাহলে।
একটা টেনশন কাজ করছিলো মনে। তবে ও চাইলেই আমাকে যে কোন প্রয়োজনে ফোন দিতে পারবে যে কারো মোবাইল থেকে৷
পলাশকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে ঘুমাস নি এখনো?
ও উত্তর দিলো, না ভাইয়া৷
– একটু আগে তোর আপু এখানে একটা ডায়েরি নিয়ে ঢুকেছিলো?
– হ্যাঁ
– তারপর কি করেছে? পড়েছে?
– না, ঐ যে বালিশের নিচে রেখেছে। আপু অনেক কান্না করছিলো আর দেয়ালে সাথে হাত দিয়ে অনেক জোড়ে ঘুষি মেরেছিলো বারবার।আমি অনেক জোড়াজুড়ি করে তাকে থামিয়েছি।
ভাইয়া তোমার সাথে কোন ঝামেলা হয়েছে আপুর?
আমি বললাম, “না। তুই ফোন রেখে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়িস। ”
বলে, বালিশের নিচে থেকে ডায়েরি টা নিয়ে চলে আসলাম।
ভাগ্যিস সুপ্তি ডায়েরিটা পড়া শুরু করেনি। কি লেখা আছে এতে আল্লাহ ই ভালো জানেন।
পলাশকে ঘুমাতে বলে ওখান থেকে চলে আসলাম আমি। হঠাৎ করেই মনে পড়লো মণিকা ভাবীকে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়ার পরে ছোট মেয়েটিকে সাথে নিয়ে সুপ্তি দ্রুত ওদের সাথে চলে গেছে। মণিকা ভাবির বাসার তো দরজা তো একেবারেই খোলা।খালি বাসা খোলা অবস্থায় থাকলে চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
নিজের বাসার তালা চাবি নিয়ে মণিকা ভাবীর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দরজা দেয়ার সময় হঠাৎ করেই আমার চোখ চলে গেলো বারান্দার দিকে, একটা রকিং চেয়ার একা একাই দুলছে। আমার মনটা ছিলো প্রচন্ড রকমের বিষন্ন। মনে মনে চিন্তা করলাম, বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষন বসি৷ হয়ত মনের অবস্থা ভালো হতেও পারে।
যেই ভাবা সেই কাজ।
আস্তে আস্তে পা ফেলে চলে আসলাম বারান্দাতে।
এখানে দাড়ালেই দক্ষিণা বাতাস মনটাকে জুড়িয়ে দিয়ে যায়। মণিকা ভাবীর লেখা ডায়েরীটা আমার হাতেই ছিলো। জানালার লাইটগুলো সব অফ, কিন্তু থালা আকৃতির বড় চাঁদ, পূর্ণিমার আলোর কিছু অংশ ঢেলে দিয়েছে এ জায়গাটাতে। বারান্দাতে লাগানো গাছের পাতার ফাঁকা দিয়ে চিরিচিরি জোছনার যে আলো এসে পড়ছে, তাতে ডায়েরির লেখাগুলো খুব স্পষ্টভাবেই পড়া যায়।
এমন একটা পরিবেশ ই ডায়েরিটা পড়ার জন্য বেশ উপযুক্ত। কিন্তু আমার মনে হয় এ ডায়েরির সাথে শত্রুতা আছে কোনো।
পড়া শুরু করবো, এমন সময়ে হঠাৎ একটা ফোন আসে আমার ফোনে।
ফোনটি এসেছে গ্রীন-লাইফ হাসপাতাল থেকে, ওখানেই ভর্তি করা হয়েছে মণিকা ভাবীকে।
মাথায় প্রচন্ড জোরে আঘাত পাওয়ায় তিনি এখন কোমাতে আছেন। এছাড়াও তার পায়ের হাড়ে চিড় ধরেছে। তাকে এমারজেন্সি চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এখন বিল পেমেন্ট এর ব্যবস্থা করতে হবে।
আমি ফোনে সুপ্তিকে চাইলাম।
উনারা জানালো, মণিকা ভাবীকে হসপিটালে এডমিট করিয়ে সুপ্তি চলে গেছে।আমাকে ফোনে ধরিয়ে দেয়া হলো মণিকা ভাবীর বাসায় হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে থাকা মেয়েটিকে। ঐ মেয়েটিও একই কথা জানালো সুপ্তি চলে গেছে।
বারান্দা থেকে উঠে পড়লাম সুপ্তি বাসায় ফিরে আমাকে এখানে এসে দেখলে ব্যপারটা ঠিক হবেনা।
মণিকা ভাবীর বাসা তালা মেরে আমি নিজ বাসায় গেলাম। পলাশ ঘুমিয়ে পড়েছে।
কম্পিউটার টেবিলে সুপ্তির জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন আমিও ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাংলো বেলা সাতটায়।
ঘুম ভাংগার পর পর ই মনে পড়লো সুপ্তির কথা। দৌড়ে পলাশের রুমে গেলাম।
পলাশ ঘুমাচ্ছে অঘোরে। পুরো বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও নেই সুপ্তি।
সাথে সাথে হাসপাতালে ফোন দিলাম। তারা জানালো সুপ্তি হাসপাতালেও নেই।
ফোন দিলাম ওর অফিসের কলিগদের৷ তারা জানালো সুপ্তির অফিস নয়টার আগে খোলেই না।
প্রেসারে আমার মাথা থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়তে শুরু করলো! কি করবো এখন আমি! দ্রুত একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে পড়লাম। ওর হাতে ফোন ও নেই যে একটা ফোন দিয়ে দেখবো! একদিকে মণিকা ভাবীর মৃতপ্রায় অবস্থা, অপরদিকে সুপ্তি নিরুদ্দেশ।
দিশেহারা অবস্থায় রাস্তায় হেঁটে চলেছি। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে আমিও কোন বড় ট্রাক বা বাসের নিচে পড়ে যাবো।
.
.
.
চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে