গৃহযুদ্ধ পর্ব-০৪

0
1580

#গৃহযুদ্ধ পর্ব ৪
________
__________
বউয়ের সাথে ঘুরছি এই সময়ে মণিকা ভাবির মেসেজ এবং কল একটু বিরক্ত লাগলো।
মেসেজগুলো দ্রুত ডিলেট করে ফোন সুইচড অফ করে দিলাম।
বিফ চাপ চলে এসেছে ইতিমধ্যেই।
সুপ্তি কাটাচামচ নিয়ে নিজের প্লেট থেকে এক টুকরা মাংস তুলে আগেই আমার মুখে ঢুকিয়ে দিলো। এ অভ্যেসটা ওর বরাবরের, কোথাও খেতে গেলে খাবার যে পাত্রেই থাকুক, আগে আমার মুখে উঠিয়ে দিবে তারপর নিজে খাবে৷ আমিও আমার প্লেট থেকে তুলে ওকে খাইয়ে দিলাম।
সুপ্তি খেতে খেতে বললো,
– এখানের চাপটা বেশ মজার।
আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেতে থাকলাম, আমার মনে একটা ভয় কাজ করছিলো,
সুপ্তি সকালে যে খাবারগুলো রান্না করে রেখে গেছিলো, সেগুলো ওভাবেই পরে আছে টেবিলে।বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই সুপ্তির নজরে আসবে। ও জিজ্ঞেস ও করবে আমাকে।
কি বলবো ওকে, সেটা মনে মনে ভাবছিলাম আমি,
মাত্র কয়েকদিনে ওকে অনেক অনেক মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে আমার।
ইচ্ছে করছে সবকিছু বলে দিয়ে মাফ চেয়ে নেই৷
কিন্তু সুপ্তি খুব ঠান্ডা মেজাজের লোক বয়টা এখানেই। ও এমনিতে ঠান্ডা থাকে কিন্তু কোন এক কারণে রেগে গেলে ওকে আর এক দু মাসেও স্বাভাবিক করা যায়না। এ ভয়ে চুপচাপ রইলাম। সবকিছু এমন ভাবে ম্যানেজ করতে হবে, যেন আমাকে আর কোন ধরণের মিথ্যা কথা বলতে না হয়।
চামচ দিয়ে মাংসগুলো ঘাটাচ্ছিলাম এবং এগুলো ভাবছিলাম। সুপ্তি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, রোহান?
কোন বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছো?
আমি বললাম না।
সুপ্তি আবারো জিজ্ঞেস করলো,
আমার বিষয়ে তোমার কাছে কোনো নালিশ এসেছে অফিস থেকে?
উত্তর দিলাম না।
কিন্তু খট করে মনে একটা প্রশ্ন চলে আসলো!
সুপ্তি এমন কি করেছে যার কারণে ওর নামে আমার কাছে নালিশ আসতে পারে?
নইলে শুধু শুধু তো ও এ’কথা বলার মানুষ না!
সুপ্তিকেও দেখলাম এক্লটু টেনশনের ভেতরে আছে।
সরাসরি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। অফিস থেকেই খোঁজ নিতে হবে ওর ব্যপারে, কিছু তো একটা ঘটেছেই।
সুপ্তির অফিসের রিটেইলর আমার এক বন্ধুর খুব কাছের লোক। ভাবলাম, সেই বন্ধুর সাহায্য নিয়েই ওর ব্যপারে একটু খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করব। আমাকে চিন্তা করতে দেখে সুপ্তির ভেতর অস্থিরতা বেশ বেড়ে যায়৷ ওর অস্থিরতা দেখে আমি ভেতরের চিন্তারো আবার নতুন ডালপালা গজিয়েছে। সন্দেহের ডালপালা।
হঠাৎ করেই টেবিলের উপরে একটা গ্লাস কাত হয়ে পড়ে যায়,
সুপ্তির এবং আমার জামাকাপড় ভিজে যায় বেশ অনেকখানি,
সুপ্তি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিয়ে বলে, মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মত কাজ করো, এ বয়সেও কেউ এভাবে পানি ফেলে জামাকাপড় নষ্ট করে!”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, আমি তো গ্লাসের দিকে হাত ও দেইনি, পানির গ্লাস ফালানোর তো প্রশ্নই আসেনা।
ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি তো পানির গ্লাস ফেলিনি।
ও বললো, দেখলে বাচ্চাদের মতই অস্বীকার করলে,
আরে বাবা কেউ তোমাকে বকছে না তো!
কেনো যেনো ওকে একটু ধমক দিয়ে বলে ফেললাম, নিজের দোষ অন্যের উপরে চাপানো বন্ধ করো।
ও আমার ধমক শুনে একটু চুপষে গেলো।
আশপাশের সবাই আমাদের দিকে ফিরে তাকালো।
ওয়েটার এসে টেবিলের পানি মুছে দিয়ে চলে গেলো।
ওয়েটার যাওয়ার পর সুপ্তি টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আমাকে বললো,
-আমাকে এভাবে অপমান না করলেও পারতে। পানিটাতো তুমি ই ফেলেছো। শুধু শুধু আমাকে কেন সবার সামনে বকা দিলে?
– শোনো! তোমার বাজে অভ্যেস হয়েছে,অন্যের উপর দোষ চাপানো।
সকালে মণিকা ভাবিকে ধাক্কা মেরে চলে গেছো এজন্য উনি তোমাকে কল দিয়ে একটু বকাঝকা করেছে।
দোষ তো তোমার ও ছিলো৷ কিন্তু তুমি আমাকে বললে ভিন্ন কথা।
– আমি কাউকে ধাক্কা দেইনি রোহান। যদি কেউ তোমাকে এমন কিছু বলে থাকে সে মিথ্যা বলেছে।
– সবাই তোমার মত না সুপ্তি, এইমাত্র ও পানির গ্লাস ফেলে তুমি আমার দোষ দিলে। যেখানে আমাকেই তুমি দুষতে পারো সেখানে অন্য কেউ তো দূরের কথা।
আমার একটা বদ অভ্যেস আমি রেগে গেলে অনেক জোড় গলায় কথা বলিআশপাশের লোকজন খাওয়া বাদ দিয়ে সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।এর ভেতর থেকে একটা মহিলা এগিয়ে আসলো আমাদের দিকে। এসে বললো,
আসলে আমি সরি, আমার বাচ্চাটা টেনিস বল দিয়ে খেলতে খেলতে ভুলে আপনাদের টেবিলের দিকে বলটা ছুড়ে মেরেছিলো। টেবিলের পায়ার সাথে বলটা ধাক্কা লাগাতেই আপনাদের একটা পানির গ্লাস কাত হয়ে গেছিলো।
ওনার কথা শোনার পরে দুজনেই ভুলটা বুঝতে পারলাম। আমি চিন্তায় এত মগ্ন হয়ে গেছিলাম যে বিষয়টি খেয়াল ও করিনি।
সুপ্তিও কোন কিছু একটা নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন ছিলো, ওর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। মহিলাটি এসে ক্লিয়ার করে আমাদের ভুকটা ভাংগিয়ে দিলো। লোকজন তখন ও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে নাটক দেখার অপেক্ষায়। হুট করে নাটকের মতই কিছু একটা করলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে,
টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে কানে হাত দিয়ে দুবার উঠবস করলাম। চিৎকার করে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম,
সরিইইই বউউউউউউ
আমার ভুল হয়ে গেছেএএএএএ
আর কখনো এমন হবেনা আ আ…
সুপ্তি দ্রুত উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো, পাগল একটা, ভুল তো আমার ও হয়েছে। আমিও সরি।
ওকে আমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।আশপাশের লোকজন আচমকাই হাত তালি দিয়ে উঠলো। ভালোবাসা এমন একটা জিনিস, যেটার প্রকাশ
মাঝে মাঝে চরম বিরক্তিকর পরিবেশকেও স্বর্গের মত উপভোগ্য করে তুলে।
মিনিট দুয়েক আগেই তাকিয়ে থাকা লোকজনের উপর অনেক বিরক্ত হচ্ছিলাম, অপমানিত বোধ করছিলাম ভেতরে ভেতরে, অথচ এখন তাদেরকেই খুব ভালো লাগছে।
ভালোবাসা প্রকাশে কখনো লজ্জা করতে নেই। বিশেষ করে বউকে ভালোবাসা দেখাতে।
একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখা উচিৎ, আপনি আপনার স্ত্রীকে যত বেশি ভালোবাসবেন, আপনার আশেপাশের লোকজন আপনার স্ত্রীকে তত বেশি ই সম্মান করবে।
যদি আপনি ই আপনার স্ত্রীকে অবহেলা করেন, আশেপাশের লোকজন ও আপনার স্ত্রীকে নিচু চোখে দেখবে।আসার সময়ে লাল টুকটুকে দুটো বেলুন কিনে দেই সুপ্তিকে। কোন এক অজানা কারণে সুপ্তির লাল টুকটুকে গ্যাস বেলুন অনেক পছন্দের। বেলুন হাতে পেলে ও রাস্তায় লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে।
আমার কিউট বউটাকে তখন একটা গুলুমুলু ছোট্ট খরগোশ মনে হয়।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা বাজে। গেটের সামনে এসেই বেশ অবাক হতে হয় আমাদেরকে।
সুপ্তির ছোট ভাই পলাশ এসেছে।
আমাদের না পেয়ে এতক্ষন দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো ও।
আমার ফোন অফ ছিলো তাই কল দিয়েও পায়নি। সুপ্তির ফোন ছিলো ওর ব্যাগে। সাইলেন্ট অবস্থায়। হঠাৎ করে পলাশকে দেখেই সুপ্তি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। সুপ্তিকে বললাম পলাশের জন্য চকলেট ও মিষ্টি নিয়ে আসতে দোকান থেকে। সুপ্তি পলাশকে নিয়ে চলে গেলো পাশের একটা দোকানে। সেই সুযোগে আমি এক দৌড়ে বাসায় চলে যাই সুপ্তির রান্না করা খাবারগুলোকে ফেলে দেয়ার জন্য।
কিন্তু গিয়ে আমাকে অবাক হতে হয়। ডায়নিং টেবিল একদম চকচকে ফকফকে।
কে করলো এই কাজ!
রুম থেকে মণিকা ভাবীর দামী পারফিউম এর ঘ্রাণ বের হচ্ছে।
নিশ্চয়ই উনি সেকেন্ড চাবি দিয়ে আমার ফ্লাটে প্রবেশ করেছিলো।
মণিকা ভাবীর বডি স্প্রের ঘ্রাণ সরাতে আমি পুরো বাসায় এরোসল স্প্রে করলাম, একটু পরেই পলাশকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করলো সুপ্তি। আমি মানুষটা পাশে আছি না নাই সেটাই খেয়াল করলো না ও।দরজা খোলার পরে পলাশের সাথে কথা বলতে বলতে নিজের রুমে চলে গেলো। একটু মন খারাপ হলো আমার। যেখানেই যাই বাসায় ঢুকেই আগে একে অপরকে পাক্কা পাঁচমিনিট জড়িয়ে ধরে রাখি। আজ হঠাৎ করেই এর ব্যতিক্রম ঘটলো।
ফ্রেশ হয়ে আমি গিয়ে বসলাম আমার কম্পিউটারে হালকা পাতলা কিছু কাজ বাকি আছে তা করার জন্য।
সুপ্তি এমন সময়ে আমার জন্য চা করে দেয়৷
মাঝে মাঝেই এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে যায়।
কিন্তু আজ ও একবার ও আমার রুমে আসলো না। নিজের ভাইয়ের সাথে গল্প যেন ওর শেষ ই হচ্ছেনা।
মন খারাপ করে মণিকা ভাবির ডায়েরিটা খুললাম।
ডায়েরি খুলতেই কেয়া ফুলের অপূর্ব একটা ঘ্রাণ এসে লাগলো আমার নাকে।
প্রথম পাতায় সুন্দর করে একটা লাভ চিহ্ন আকা, লাভের ভেতরের অংশে লেখা, আমার প্রিয় অনুভূতির খেলাঘর।
ডায়েরিটা পড়ার জন্য পাতা উল্টাবো, হঠাৎ করেই কাঁধের উপরে অনুভব করলাম সুপ্তির হাতের স্পর্শ।
.
.
.
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে