গৃহযুদ্ধ পর্ব-০১

0
3618

#গৃহযুদ্ধ
লেখকঃ Hasibul Islam Fahad
পর্ব ১

আমার বউয়ের রান্নার হাত একদম-ই ভালো না। বিষয়টি নিয়ে আমার যতটা না মাথাব্যাথা তার থেকেও বেশি মাথাব্যথা আমার বাড়িওয়ালি ভাবীর।
প্রেম করে বিয়ে করার সুবাদে বউ যেভাবেই রান্না করুক, ভালোবাসা মাখামাখি করে খেয়ে নিতে আমার কোনো সমস্যা হয়না। আমি নিজে,একজন ছোটখাটো মাপের গ্রাফিক্স ডিজাইনার। সারাদিন বাসায় বসেই অনলাইনে কাজ করতে হয়৷আমার স্ত্রী সুপ্তি বি এস সি নবম সেমিস্টারে পড়াশোনা করছে। সাবজেক্ট কম্পিউটার সাইন্স।
অভিজ্ঞতা থাকায় হুট করেই হাজার বিশেক টাকার একটা জব পেয়ে যায় ও। যখন সংসারে দুজনের ইনকামের টাকা আসা শুরু করলো, আমরা পূর্বের ছোট্ট বাসাটা ছেড়ে সুবিধামত এড়িয়ায় নতুন একটা বাসা নিয়ে নিলাম।সমস্যাটা এই নতুন বাসার মালকিন ভাবীকে নিয়েই৷
বাসা ভাড়া নেয়ার আগে ফর্মালিটি মেইনটেইন করার জন্য আমাদের মাঝে যে সাধারণ কথাবার্তা হয়, তাতে আমরা জানতে পারি, বাড়িওয়ালা ভাবীর নাম
মণিকা রহমান।তিনি স্বামী হারা হয়েছেন বছর দুয়েক আগে৷ এখন একা-ই জীবনযাপন করছেন। আমিও গল্পে গল্পে বলে ফেলি, সুপ্তি নতুন চাকরী পেয়েছে, এজন্যই ওর অফিস থেকে কাছে হয় এমন জায়গায় দেখেশুনে ভালো একটা বাসা নিতে হলো।
বাড়িওয়ালী নতুন চাকরীর কথা শুনেই অনেক এক্সাইটেড হয়ে গেলেন। নিজ থেকেই অতি উৎসাহ নিয়ে বললেন! ওয়াও নতুন চাকরী! তাহলে তো সে উপলক্ষে তোমাদের বাসায় আমার দাওয়াত খেতে হবে একদিন!
যেদিন উঠবে সেদিন রাতেই আমি তোমাদের বাসায় খাবো৷
ওনার কথা শুনে হঠাৎ করেই একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও হাসিমুখে বলে দিলাম। ঠিক আছে ভাবী। প্রথম যেদিন উঠবো, সেদিন আমাদের বাসায় ডিনার করবেন।
.
.
মাসের শুরুতেই নতুন বাসায় উঠে গেলাম। বাসায় ওঠার পর ই আমাদের দুজনের মাথায় একটা চিন্তা ভর করছিলো,
বাড়িওয়ালীকে দাওয়াত দিয়ে বা দাওয়াত ছাড়া যাই হোক, খাওয়াতে তো হবেই।দুপুরের মধ্যে আমাদের ছোট্ট সংসারের জিনিসপত্রগুলো সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজিয়ে নিলাম বাসাটায়। এরপর
সুপ্তি এবং আমি নামলাম বাজার সদায় করতে।
মুরগী নিলাম একটা, গরুর মাংস এক কেজী, সাথে পোলাওর চাল এবং পায়েস রান্নার জন্য যা যা দরকার কিনে নিলাম। মেয়ে মানুষদের সাথে নিয়ে বাজারে গেলে তারা ছেলেদের থেকে বেশি আগ্রহী হয়ে বাজার করে। কিন্তু সুপ্তির চোখে তাকিয়ে আমি অপরাধবোধের একটা ছায়া খুঁজে পাচ্ছিলাম।
রান্না না জানা বিষয়টাইএকটা মেয়ের কাছে অনেক বেশি কষ্টের।
সুপ্তি সবসময় নিজের ভেতর সে কষ্টটা লুকিয়ে রাখে।হাসিমুখে থাকে।
কিন্তু বাজার করতে আসলেই মনে হয় ওর রান্না নিয়ে কষ্ট লুকানোর শক্তিটা কমে যায়।বাজারে এত এত শাক সবজি মাছ মাংস দেখলে যে কোন মেয়েই চাইবে কিনে নিয়ে তার প্রিয় মানুষকে অনেক মজা করে রান্না করে খাওয়াতে৷
সুপ্তির রান্নার হাত যে খারাপ সেটা সুপ্তির হাতের বানানো খাবার খেতে খেতে আমি নিজেও ভুলে গেছিলাম।
ওর হাতের রান্না,
আমার পেট ও মন দুই-ই ভরিয়ে দিত।
যেহেতু আমি বাসায় একা থাকি, তাই সুপ্তি কোন রকম কাজের বুয়া বাসায় এলাউ করে না। ওর কোন বিষয় নিয়ে আমার মাঝে কোন প্রকার আফসোস বা অভিযোগ কিছু তো ছিলোই না বরং কিছু কিছু ছেলেমানুষী আমার খুবই ভালো লাগে।
বাজার শেষ করে বাসায় আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা।
সদয়পাতি নিয়ে কিচেনে ঢুকে, সুপ্তি ইউটিউব নিয়ে বসে গেলো। কোন আইটেম কিভাবে রান্না করলে খেতে মজা লাগবে, সেগুলো দেখছিলো আর একটু পর পর আমাকে বাইরে পাঠাচ্ছিলো। যে মহিলারা ইউটিউব চ্যানেলে রান্নার ভিডিও দেয় ওদের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো আমার। এত এত আইটেমের মশলা কেনো দেয়া লাগবে রান্নায়! এর ভেতরে এমন কিছু আইটেম আছে যার নামও জীবনে শুনিনি।
যাই হোক বহু কষ্টে যা যা পেরেছি সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছি।
এদিকে বউ আমার সবকিছু নিয়ে ঘটা করে রান্না করতে বসেছে। ওর রান্নার তোড়জোড় দেখে আমিও একটু এগিয়ে গেলাম সাহায্য করতে। কোমড়ে কাপড় গুজে, হাতে খুনতী নিয়ে ইউটিউব দেখে টুকটুক করে রান্নার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো ও। ওকে দেখে এখন পুরোদস্তুর একজন গৃহিনী মনে হচ্ছে। কপালে, নাকের নিচে, পেটে ঘেমে ঘুমে একাকার।
ইচ্ছে করছে রান্না টান্না সব বাদ দিতে বলে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থাকি ঘন্টাখানেক।সুপ্তির ঘর্মাক্ত ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুমু এঁকে দেয়ার ইচ্ছেটা খুব কষ্ট করে সংবরণ করলাম। কিচেনে ,থালাবাসন চুলা এবং তরিতরকারি র সাথে ঘন্টা তিনেক যুদ্ধ করার পরে রান্নার কাজ শেষ হলো।ঘড়িতে সময় তখন ন’টা বেজে পাঁচ মিনিট।
সুপ্তি আমাকে বললো, ডায়নিং রুমে সব খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করা শেষে বাড়িওয়ালা ভাবীকে ডেকে আনতে।
দুজনে মিলে খাবারের আইটেম গুলো ডায়নিং টেবিলে একে একে সব সাজালাম।
সুপ্তির মুখে মুচকি মুচকি একটা প্রশান্তির হাসি। তরকারির রঙ দেখে মনে হচ্ছে রান্না বেশ স্বুসাদু হয়েছে। দু’এক টুকরা মুখে দিয়ে দেখলাম, নাহ আগের তুলনায় বেশ অমায়িক করেই রান্না করেছে ও।খাবার চিবিয়ে গিলে কেমন হয়েছে বলার আগ পর্যন্ত আমার মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো সুপ্তি। যখন বললাম আগের তুলনায় অনেক অনেক ভালো হয়েছে! কেন জানিনা ও হুট করে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর নাকের উপরে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামের উপরে চুমু খেয়ে বললাম, আমি একটা পারফেক্ট বউ পেয়েছি। আমি অনেক লাকি একজন মানুষ। সুপ্তি বোধ হয় লজ্জা পেল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে ওর মাথা গুজে দিলো।
.
টুং-টাং কলিংবেলের শব্দ হওয়াতে দুজনেই একটু হতচকিত হয়ে উঠি।এ সময়ে মণিকা ভাবী ছাড়া আমাদের বাসায় আর অন্য কারো আসার কথা না।
সুপ্তি দৌড়ে রুমে চলে গেলো। জামাকাপড় ওড়না চুল, একটু ঠিকঠাক করে নিতে।
আমি দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলতেই কড়া একটা পারফিউমের ঘ্রাণ এসে লাগলো নাকে। বেশ সেজেগুজে একদম ফিটফাট হয়েই আমাদের বাসায় এসেছেন মণিকা ভাবি।
দরজা খুলতেই বললো,
ডাকার আগেই চলে এলাম। সন্ধ্যায় বাজার করে এনেছো দেখেই বুঝেছি, আমার মজা করে বলা কথাটা তোমরা সিরিয়াস ভাবে নিয়েছো। তা তোমার বৌ কোথায় এখনো রান্না করে নাকি!
হাসতে হাসতে বললাম,

– ভেতরে আসুন।
ওর রান্না শেষ।
ওনাকে সরাসরি ডায়িনিং টেবিলেই এনে বসালাম।
আমিও বসলাম একটা চেয়ারে। এরপর সুপ্তিকে ডাক দিলাম।
সুপ্তি এ কয়েকমিনিটে বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে। মনে হয় গালে হালকা করে একটু পাউডার ও ঠোঁটে লিপ্সটিক ও লাগিয়েছে। এত ফর্মালিটির কি আছে আমার মাথায় ঢোকেনা। আমি তো বাজার করে আসার সময় থেকে সেই একই জিন্স আর গেঞ্জি পরা।
যাই হোক ডায়নিং এ বসেই আমাদের ছোট খাট একটা আড্ডা হয়ে গেলো। এরপর শুরু হলো খাওয়াদাওয়া পর্ব।
প্লেটে সবাইকে ভাত দেয়ার পর
তরকারির বাটি থেকে ঢাকনা সরিয়ে সুপ্তি সবাইকে খাবার উঠিয়ে দেয়।
মণিকা ভাবি বলেন,
আমি অত ফর্মালিটি মেন্টেইন করিনা। নিজেই নিয়ে খাচ্ছি। প্রথমেই শুরু করলেন করলা ভাজি দিয়ে৷ দু লোকমা খেয়ে ভাজিগুলো একপাশে রেখে তিনি মুরগীর মাংসে হাত দিলেন।
মাংস দিয়ে একলোকমা মুখে দিতেই ভ্রু কুঁচকে বলে ফেললেন, এত বাজে রান্না আমি কোনদিন খাইনি। কোনকিছুই পরিমান মত নেই। ইচ্ছা করে আমাকে এনে অপমান করেছো নাকি তোমরাই ভালো জানো।
বলেই উঠে হন হন করে হেঁটে বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।
সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর গাল দুটো লাল হয়ে আছে। চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। আমি উঠে গিয়ে দরজা দিয়ে আসলাম। সুপ্তির পেছনে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখতেই ও ঝাটকা মেরে আমার হাত সরিয়ে দিলো। দৌড়ে বেডরুমে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। হাজারটা ডাকাডাকি করার পরেও আর দরজা খোলাতে পারলাম না।
এত যত্ন করে রান্না করা খাবার গুলো অযত্নে টেবিলের উপরে পরে রইলো। কেউ ই আর ছুয়েও দেখলো না। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসতেই কখন যে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম! আল্লাহই ভালো জানেন। সকালে যখন ঘুন ভাংলো, দেখলাম টেবিলের উপরে নতুন খাবার, সাথে একটা চিরকুট।
চিরকুটে লেখা,- কাল বেশি ভালো রান্না করতে গিয়ে বেশি খারাপ হয়েছে।সব ফেলে দিয়ে সকালে যা পেরেছি রান্না করে রেখে গেছি। খেয়ে নিও। আর আমাকে মাফ করে দিও। আমার জন্য তোমার খারাপ খাবার খেতে হয়, আবার মানুষের সামনে অপমানিত ও হতে হয়।
চিরকুটের দিকে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। নিশ্চয়ই সকালে আমাকে না বলেই অফিসে চলে গেছে। আর এটা শিওর যে ও এখনো কোন কিছুই খায় নি।
দ্রুত পায়ে বাসায় তালা মেরে আমি ওর অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলাম।হোটেল থেকে ওর প্রিয় খাবার,নেহারী, পরোটা কিনে ওকে দিয়ে আসলাম। সাথে একটা চিরকুট ও দিয়েছিলাম। কি লিখেছি তা আপনাদের বলব না। অতিরিক্ত রোমান্টিক কথাবার্তা।
যাই হোক ওকে খাবার দিয়ে বাসায় ফেরার পথে,
দেখা হয়ে গেলো মণিকা ভাবীর সাথে। আমাকে দেখেই উনি বললেন, আমি আসলে কালকের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। তোমরা কেন আমাকে ইচ্ছা করে পচা রান্না খাওয়াবে! তাহলে তো এত এত বাজার করতে না।
আমি বুঝতে পারিনি৷
– আচ্ছা, ঠিকাছে৷ সমস্যা নেই।
বলে চলে আসব, এমন সময় উনি আবার ডাক দিলেন,
– এই শোনো!
– জ্বী বলুন!
– কেমন মেয়ে বিয়ে করলে তুমি! রান্নার হাত একদম ই ভালো না।
ওনার কোন কথার উত্তর না দিয়ে আমি সোজা বাসায় চলে আসলাম।
দরজা খুলতে যাবো,
এমন সময় দেখি দরজার সামনে কয়েকটা বাটি রাখা, সাথে একটা চিরকুট ও!
বাহ কো-ইন্সিডেন্স ঘরের ভেতরে বাইরে খাবার! তাও চিরকুট সহ! মনে আগ্রহ নিয়ে চিরকুট টা খুললাম।
লেখা আছে,
” তোমার বউয়ের রান্নার হাত ভালো না। ”
তাই তোমার ভাবী নিজে তোমাকে খাবার পাঠিয়েছে। খেয়ে নিও কেমন?
ইতি, তোমার ভাবি। ব্রাকেটে লেখা মণিকা।
দরজা খুলে ওনার খাবার বাটিগুলোকে তুলে ভেতরে আনলাম। অনেকটা রাগ নিয়েই সবক’টি বাটি খুললাম আমি। উনি যে আমার বৌ এর রান্নার এত সমালোচনা করলো নিজে কি রান্না করে তা দেখার জন্য।
বাটিতে পোলাও বিফ স্টেক এবং চিকেন কারী ছিলো।
প্লেটে তুলে মুখে দিতেই বেশ অবাক হতে হলো আমাকে!
কারো হাতের রান্না এত সুন্দর ও হতে পারে!
খাবারের স্বাদে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো আমার৷ কখন যে চেটেপুটে পুরো খাবারটাই শেষ করে ফেলেছি, সেদিকে একদম ই খেয়াল নেই।
সুপ্তির বানিয়ে দেয়া খাবারগুলো অবহেলায় অনাদরে পরে রইলো টেবিলের উপরেই৷

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে