গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫৫ (শেষ পর্ব)
কুঞ্জনের প্রশ্ন শুনে সায়ান উচ্চস্বরেই হাসলো, এই প্রশ্নটা ওর কাছে হুট করেই ফানি মনে হলো। ও নিজেই যখন জেনেছে তখন অকারণেই হাসি পেয়েছিলো কারণ মানুষটি খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। ও কুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললো
“রুশির বাবা আমাকে মেসেজ করেছিলো তাও ফ্রেঞ্চে।উনি আমাকে অন্য ভাষায় করেনি কারণ প্রিয় মা যদি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে তবে মিথ্যে বলতে পারবে না আর ফেঞ্চে করলে মা ফ্রেঞ্চে কথা বলতে পারলেও পড়তে পারেনা তাই অফিসের কাজ ছাড়া অন্যকিছু ভাববে না।উনি রুশির একাকিত্ব বেশ টের পেয়েছিলেন যেটা মা পাননি কিংবা পেয়েছিলেন কিন্তু সন্তানের বেঁচে থাকার চেয়ে বেশি কিছুই হয়তো মুল্যবান ছিলো না তার কাছে হয়তো ভেতরে ধুকেধুকে মরাটাও না! আমি তার ফিলিংস বুঝতে পারি, উনি হয়তো ওনার জায়গায় ঠিক ছিলেন। কারণ মায়েরা ইমোশনালি দুর্বল হয়, তারা সন্তানের উপর এতোটুকু কষ্টের ছায়া পড়তে দিতে রাজি নন। কিন্তু রুশির বাবা যখন দেখেছেন রুশি স্টেবল হতে পারছে না কারণ সে অতীত মনে করার চেষ্টা করছে, আর এটা সে তখনি করে যখন একা থাকে। উনি তার লাইফে কাউকে আনতে চেয়েছেন যাতে ওকে আর একাকিত্ব আর ঘিরে না ধরে আবার তিনি এটাই ভুলে যাননি যে রুশি তখনো আমার স্ত্রী ছিলো। তাই উনি টেকনিকালি আমার আমানত আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন!”
সায়ান এইটুকু বলে চুপ করে থেকে আবার কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বললো
“কিন্তু একটা জিনিস ভেবে আমিও অবাক হয়েছিলাম যে উনি কিভাবে ওইসময়েই আমাকে মেসেজ করলো যখন আমরা ক্যালিফোর্নিয়ায় শিফট হতাম!পরে জানতে পারি প্রায় একমাস আগে থেকে প্রাইভেট নাম্বারে তারা শাহেদের সাথে যোগাযোগ করতো আর ওকে ওয়াদা দেয়াতে ও আমাদের বলতে পারেনি।কিন্তু ও চেষ্টা করেছিলো বের করতে রুশি কোথায় আছে কিন্তু পারেনি তাই বাবাকে ওই সাজেশন দিয়েছিলো আমাকে মেসেজ দেয়ার জন্য কারণ ও বলেছে আমরা কেউই ভালো নেই। আমি সবকিছু জেনে তো ভালো নেই ই কিন্তু রুশি না জেনেও ভালো ছিলো না। যাইহোক শশুর মশাই সাহায্য না করলে কখনোই ফ্রান্সে যাওয়া হতো না আর কখনোই ওকে খুঁজে পেতাম না। রুশির পাওয়ার প্রায় তিনমাস পর আমরা সবাই লন্ডল শিফট করি আর আমরা টেমস নদীর এখানে থাকা শুরু করি আর তারা তাদের আগের জায়গায় অর্থাৎ ক্যামডেন টাউনে!”
কুঞ্জন কথাগুলো শুনে চুপ করেই ছিলো, তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই অভিমানী স্বরেই প্রশ্ন করলো
“তাহলে এতোদিন আমার মামা-মামি আছে, নানু কিংবা পরিবারের আরো সদস্য আছে এটা আমি জানতাম না কেনো?আমি যতটুকু জানি মাম্মা কিংবা পাপা কেউ আমাকে কিছু বলেনি, আমি সবসময় ভাবতাম মাম্মা তার বান্ধুবীর সাথে কথা বলে তাই ইন্টারেস্ট দেখায় নি। আমার থেকে সব লুকানো হলো কেনো?”
সায়ানের হাসিমুখে হঠাৎ গম্ভীরতা দেখা দিলো, সে কিছুটা গম্ভীর স্বরেই বললো
“কারণ সামাদ খানকে আমরা খুঁজে পাইনি আর না তার পরিবার সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা আছে। তবে ক্যামডেন টাউনে আমাদের উপর যে এটাক হয়েছে আমরা আশি পার্সেন্ট শিউর ওইটা তার দ্বারাই হয়েছে কিন্তু আমরা কোন ক্লু খুঁজে পাইনি। আমরা পরিবারের সবাইকে সেফ রাখতে চেয়েছিলাম তাই একে অপরকে ফ্রেন্ড কিংবা দূর আত্মীয় ছাড়া পরিচয় দেয়া হয়না। আর আমরা সবাই প্রায় সেপারেটলি থাকি আর সবগুলোতেই হাই প্রোটেকশন দেয়া যাতে এটলিস্ট ঘরের ভিতরে কোন এটাক না হয়। তুমি তো জানোই তোমাকে অলওয়েজ দুজন বডিগার্ড ফলো করে কিন্তু এটা হয়তো জানোনা তোমার অগোচরে আরো অনেকজন তোমাকে ফলো করে। আর আমাদের কথা হলেও তা প্রাইভেট নাম্বারে কথা হয় আর তা খুব বেশি সময়ের জন্য নয় যাতে করে কিছুতেই কারো লোকেশন ট্রেক করা না যায়। তোমাকে জানানো হয়তো যেতো কিন্তু ইচ্ছে করেই বলিনি কারণ সবটা সলভ হওয়ার পর বলতাম। পাখিকেও বলা হয়নি তাই দেখো না পাখি সামুকে ফুফি না বলে আন্টি বলতো!”
“যদি এভাবে ভয়েই থাকতে হয় তাহলে এই বাচাকে কি বলে?সারাজীবন কি এভাবেই চলতে থাকবে তাদের থেকে পালিয়ে পালিয়ে?”
“নাহ! পালানো অনেক হয়েছে আর না। তোমার বাবা এখানে এসেছেই এটা নিয়ে ডিসকাস করতে কারণ কোন এক সুত্রে উই গট টু নো সামাদ খানের ফেমিলি বাংলাদেশে আছে রিসেন্টলি! তাই এবার তারা এটাক করার পুর্বে আমরা তাদের এটাক করবো, আর সামাদ খানের সাথে তো আমার বোঝাপড়া আছেই!আমার জীবনের প্রত্যেকটা কষ্টের হিসাব তাকে দিতে হবে,আর আমার বউকে মারার অপরাধে তাকে হাজারবার খুন করলেও তা কম হয়ে যাবে!”
সায়ান এইটুকু বলে থেমে গেলো, বাচ্চাদের সামনে এভাবে বলা উচিৎ হয়নি! ও গলা খাকারি দিয়ে উঠে গেলো আর নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। রুশিও তার পিছু গেলো আর বাকি সবাই যার যার কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলো,কুঞ্জনের বাবা আর শাহেদ আংকেল কথা বলতে লাগলো আর ওর মা আর চন্দ্রিকা আন্টি উঠে গেলো সেখান থেকে। বাকি রইলো ও আর পাখি!
কুঞ্জনের বেশ জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো শাহেদকে যে চন্দ্রিকার বাচ্চার বাবা কে ছিলো কিন্তু ছোট হয়ে বড় একজনকে এমন প্রশ্ন করাটা অবান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও কুঞ্জন সেই ডায়েরী থেকে নব্বই পার্সেন্ট শিওর ওইটা শাহেদের বেবি ছিলো কারণ শাহেদ চন্দ্রিকাকে বেশ অপমান করতো কিন্তু যখন চন্দ্রিকা বললো ও ইচ্ছে করে বাচ্চা মারেনি তখন ও ঠিক ভাবে ব্যাবহার করতো এমনকি ও জিজ্ঞেসও করেছিলো যে চন্দ্রিকা কি আসলেই সেই বাচ্চা মারেনি?চন্দ্রিকা না বলাতেই ও বেশ খুশিই হয়েছিলো। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন চন্দ্রিকাকে বেঁধে রাখা হয়েছিলো আর খোলা অবস্থায় কেউ একজন তাকে জোর করেছিলো! হয়তো সেটা শাহেদ ছিলো এবং সে নিজের হুশে ছিলো না। কারণ সামাদ খান চাইলে সবই করতে পারে,আর শাহেদ নিজেই বলেছিলো যে সে সামাদ খানের খারাপ কাজে জড়িত ছিলো, হয়তো চন্দ্রিকার এবর্শন ব্যাপারে শাহেদকে ভুল ইনফরমেশন সেই দিয়েছিলো কিন্তু শাহেদ তবুও চন্দ্রিকাকে ছাড়েনি বরং ভালোবেসে গেছে নিঃস্বার্থভাবে!
কুঞ্জন জানেনা ওর ভাবনার যৌক্তিকতা কতটুকু কিন্তু এই অজানা কথাগুলোর রহস্য উদঘাটন করতে পেরে নিজেকে আসলেই ডিটেক্টিভ মনে হচ্ছে। অবশেষে ও সায়ান-রুশির রহস্য বের করেছে আর তাদের শেষ পরিণতিও জানতে পেরেছে!
কুঞ্জন সম্পুর্ণটা শুনে চুপচাপ বসে ছিলো সেখানে কতক্ষন তারপর উঠে গিয়ে শেষ সিঁড়ির কাছে বসলো! ,ও ভেবেছিলো অন্যসব মুভি কিংবা গল্পের মতো একসময় রুশির স্মৃতি ফিরে আসবে,তার সবকিছু মনে পড়ে যাবে।কিন্তু বাস্তবতা কোন সিনেমা নয় যে পরের অংশ স্ক্রিপ্টে লিখা থাকবে আর সেটার এন্ডিং আগে থেকেই প্রেডিক্ট করা যাবে। লাইফ ইজ মোর দেন ড্রামা!এখানে হুট করেই নাটকীয় ভাবে স্মৃতি ফিরে আসেনা! আবার প্রেমে পড়লে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায় না, পছন্দের মিউজিক বাজতে শুরু করেনা, না চুল নড়তে থাকে আর না হুট করে ফুল পড়তে থাকে গায়ে। বরং কিছু অনুভুতি ধীরেধীরে জমা হয় তারপর সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশ করা যায় না বরং গুমোট অনুভুতি হিসেবে থেকে যায়। কিছু মানুষের ভাগ্য হয়তো অনেক ভালো হয় যে তারা তাদের ভালোবাসার মানুষকে পায় আর বাকিরা পায়না কিংবা পেয়েও হারিয়ে ফেলে!
উপরওয়ালা সবার জন্যই নির্দিষ্ট জোড়া রেখেছেন, কুঞ্জন এতোদিন সেই মানুষটির অপেক্ষায় ছিলো কিন্তু আজ!পাখিকে দেখেই ও বড়োশড় ক্রাশ খেয়েছে তা আর বলতে বাকি নেই, কোথাও কিছু একটা ফিল হয়েছে তবে সেই অনুভুতির নাম জানেনা ও! অন্যসব গল্পের মতো ওদের গল্পটা বেশ ভিন্ন, পাখি হয়তো মজা করে বললেও নিজের থেকে ছোট কাউকে মেয়েরা কখনোই মেনে নিতে চায়না অথচ “তুই কি আমাকে বিয়ে করবি?” পাখির বলা কথাটা ও সত্যিই সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে! আচ্ছা অনুভুতিগুলোর বেড়াজালে মানুষ কি বড্ড বোকা হয়ে যায়?নাহয় বিষয়টি সম্পুর্ণ মজা জেনেও ও সিরিয়াসলি কি করে নিতে পারলো?সবটা জেনেও সত্যটা মানতে এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে ওর?
________________________
সায়ান রুমে এসে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো, রুশিও পিছু এসে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম সায়ানের কাছাকাছি থাকতে বেশ জড়তা কাজ করতো ওর। খাটে মাঝখানে পাখি আর ওরা দুজন দুপাশে! কিন্তু ধীরেধীরে সেই দুরত্বটা গুচে গেলো হয়তো ভালোবাসে তাই!কিংবা সায়ানের মতে তো ও তাকে আরো আগে থেকে তাকে ভালোবাসে।রুশি সায়ানকে হুট করে জড়িয়ে ধরলো আর শান্ত স্বরে বললো
“আমি মাঝেমাঝে সবকিছু মনে করতে চাই, মনে হয় সেই অনুভুতি গুলো হয়তো অনেক মুল্যবান ছিলো! কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না”
“তুমি আবার চেষ্টা করেছো মনে করার?”
“নাহ, মনে করার চেষ্টা করতে চাই।”
“কোন দরকার নেই। আমি চাই তুমি সুস্থ থাকো আর আমার সাথে থাকো সবসময়। এই হাত একবার ছুটে যাওয়াতে অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি,সেই কষ্ট দ্বিতীয়বার সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই!আমাকে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না সত্যিই, প্লিজ আর কখনো ছেড়ে যেওনা”
“উহুম যাবো না,কোথায় যাবো আমি তোমাদের ছেড়ে?আমার যে তোমাদের ছাড়া গতি নেই”
সায়ান মুচকি হেসে রুশির কপালে ঠোঁট ছোয়ালো আর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।সৃষ্টিকর্তা যা করে ভালোর জন্যই করে! হয়তো ভালো হয়েছে রুশির কিছু মনে নেই, কারণ ওই দিনগুলোতে রুশি তেমন সুখ পায়নি, অবহেলা আর কষ্ট ছাড়া। তাছাড়া চন্দ্রিকার সাথে রুশির সম্পর্ক অনেক ভালো এখন কিন্তু সব মনে থাকলে হয়তো থাকতো না, রুশির সেই কষ্টের অনুভুতি মনে না পড়ুক এটাই ও চায়। বরং ওর জীবনে শুধু সুখ থাকুক আর ওকে সুখে রাখার জন্য সায়ান সব করতে রাজি আছে, সব!
ও হুট করেই বলে উঠলো
“আই লাভ ইউ মিসেস খান!”
রুশি মুচকি হাসলো তারপর সায়ানের বুকে কিল মেরে বললো
“মি ঠু মিস্টার খান!”
________________________
কুঞ্জনের ভাবনার মাঝেই পাখি এসে ধপ করে ওর পাশে বসলো তারপর মাথায় টোকা মেরে বললো
“কিরে ছোটু! এই ছোট মাথায় কি বিশাল চিন্তা নিয়ে ভাবছিস রে?”
“কিছুনা”
“হুম, কিছু একটা তো ভাবছিলি। যাইহোক জবাব দিলি নাতো? বিয়ে করবি আমায়?”
বলেই খিলখিল করে হেসে দিলো পাখি আর কুঞ্জন মুখ ফুলিয়ে বসলো আর বললো
“আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি পাখি! তাই এখন কিছু বলতে পারবো না”
পাখি আরেকটা গাট্টা মারলো কুঞ্জনের মাথায় তারপর বললো
“বড়োরা পাখি বলে ডাকে বুঝলি! তুই মোটেও এসব বলবি না। আমার নাম রিয়ানা জামিল খান! তুই আমাকে রিয়ানা আপু বলবি বুঝলি!”
“আমার কাউকে আপু বলে ডাকিনা মিস.পাখি!”
“হেই ছোটু!ইটস রিয়ানা ফর ইউ ওকে!”
বলেই পাখি উঠে চলে গেলো আর কুঞ্জন তাকিয়ে রইলো, ও পাখির সামনে মুখ ফুলালেও বিয়ের কথায় ও বেশ খুশি হয়েছে! পাখির প্রতি ওর অজানা অনুভুতি কাজ করে, কিন্তু সেই অনুভুতি গুলো প্রকাশের আদোও সুযোগ হবে কিনা ও জানে না। অদ্ভুতভাবে মাত্র কয়েকঘন্টার পরিচয়ে ওর পাখিকে বেশ ভালো লেগেছে। বলা হয়না “পেয়ার কিলিয়ে এক পাল হি কাফি হ্যায়” ওরও তাই হয়েছে। কিন্তু এই #গুমোট_অনুভুতিরা কি আদোও প্রকাশ পাবে কিনা ওর জানা নেই, শুধু এইটুকু জানে ও এই অনুভুতির মায়াজালে ফেঁসে গিয়েছে, বড্ড বাজেভাবে ফেঁসে গিয়েছে!
~~~সমাপ্ত~~~
(গল্পটি অনেক উত্থানপতনের মাঝে দিয়ে শেষ হয়েছে, হয়তো আরো সুন্দরভাবে সাজানো যেতো কিন্তু পারিনি। যাদের ভালো লাগেনি বা হতাশ হয়েছেন তাদের কাছে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। যারা এতোদিন সায়ান-রুশি আর আমার পাশে ছিলেন তাদের অস্যংখ্য ধন্যবাদ আর ভালোবাসা রইলো। আমি জানিনা সব প্রশ্নের উত্তর আপনারা পেয়েছেন কিনা বা আমি ঠিক ভাবে লিখতে পেরেছি কিনা। যদি কিছু বাদ পড়ে যায় তাহলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।সবার জন্য ভালোবাসা রইলো, আল্লাহ হাফেজ!)